দখিনা প্রেম,পর্ব-২৫ শেষাংশ

0
2057

দখিনা প্রেম,পর্ব-২৫ শেষাংশ
লাবিবা ওয়াহিদ

বিছানায় উবুড় হয়ে শুয়ে বিয়ের ছবিগুলো দেখছে সেহের। ফোনটা সা’দ সেহেরকে তার বাসরে উপহার হিসেবে দিয়েছিলো। তাদের বিয়ের আজ প্রায় কয়েকবছর কেটে গেছে। সেহের এবার অনার্স ২য় বর্ষে। অবসর সময়ে তাদের বিয়ের ছবি দেখা যেন সেহেরের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। রিসিপশনের সাঁজে সা’দ তাকে ফিসফিস করে বলেছিলো,

—“জানো আমি ঠিক তোমার এই সাঁজে তোমায় স্বপ্নে দেখেছিলাম। সেদিন আমার রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছিলো স্বপ্নের হুরপরীর কথা চিন্তা করতে করতে। আমার সেই হুরপরীটা যে আমার বউ সেটা আজ তোমায় না দেখলে জানতামই না। কতোটা স্নিগ্ধময়ী লাগছে তোমায় জানো?” সা’দের কথাগুলোতে সেদিন সেহের ভিষণ লজ্জা পেয়েছিলো। সেহেরের মা এখন আলহামদুলিল্লাহ সুস্থ।
আজ সেহেরের ভার্সিটি বন্ধ। সা’দ গেছে তার শুট নিতে। বাড়িতে সার্ভেন্টরা আর সেহের ছাড়া কেউ-ই নেই। বরিং লাগছে সেহেরের কাছে সবকিছু। আসিয়াও নেই। সে গেছে রুবাইয়ের সাথে ফরেইনে। বেবির জন্য রুবাইয়ের দেশ-বিদেশে ছুটাছুটি করতে হচ্ছে বেশ, তানজীলও আছে তার সাথে। রুবাই একা থাকবে দেখে আসিয়াও সঙ্গে গিয়েছে। সেহের তার মায়ের সাথে মাঝেমধ্যে দেখা করতে গেলেও সা’দ ফেরার সময় সেহেরকে নিয়ে আসে। তবে আজ কেন যেন তার বাসায় যেতে ইচ্ছা করছে না। হঠাৎ কী চিন্তা হতেই সেহের উঠে বসলো এবং চুল খোপা করতে করতে নিচে চলে গেলো। রান্নাঘরে ঢুকতে ঢুকতে সেহেরের বড়ো বোন অধরাকে ফোন লাগালো। অধরা এবার মাস্টার্স কমপ্লিট করেছে। দেশে ফিরেছে ছ’মাস আগেই। এখন তার বিয়ের কথাবার্তা হচ্ছে।

—“হ্যাঁ সেহের বল!”

—“তুই এখন কই আপু?”

—“এইতো ফ্রেন্ডের সাথে মিট করতে আসছিলাম, কেন? কিছু লাগবে?”

—“না। শুটিং স্পটে যাবি?”

—“যাওয়া তো যায়-ই কিন্তু হঠাৎ?”

—“এমনি বাবা আর ওনাকে সারপ্রাইজ দিবো। তুমি ঘন্টাখানেকের মধ্যে এসে আমাকে পিক করিও।”

—“ওকে। তাহলে এখন রাখি। বাই!”

—“আল্লাহ হাফেজ।”

বলেই সেহের কল কেটে রান্নায় মনোযোগ দিলো। আজ আকাশটা মেঘলা, কিছুক্ষণ আগে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টিও হয়েছিলো। এমন সুন্দর একটা দিনে খিঁচুড়ি খাওয়ার মজাই আলাদা। রান্নার পুরোটা সময় সেহের তার দাদীর সাথে কথা বলে কাটিয়েছে। হয়তো ওরা তার রক্তের মানুষ না, তাতে কী? সেহের তাদের জান দিয়ে ভালোবাসে। রিমন স্কুলে গেছে তাই তাকে ফোনে পায়নি সেহের। রিমন এবার ক্লাস সিক্সের ছাত্র, সেহের চেয়েছিলো রিমনকে আর দাদীকে শহরে তাদের কাছে নিয়ে আসতে কিন্তু দাদী তার গ্রামকেই বেশি ভালোবাসে। দাদীমা না আসলে রিমনও আসতে পারবে না তাই সে দাদীমা চাচীদের সাথেই থাকে।গতবছর কবির মাদক পাঁচার করে ফেরার সময় রোড এক্সিডেন্টে মারা যায়, জোহরা তো স্বামী এবং মেয়ের শোকে মানসিক রোগীতে পরিণত হয়েছে। সারাক্ষণ নিজেকে ঘর বন্দি করে রাখে। আর তপা! তার বিয়ের ১২ দিন বাদেই জানতে পারে সে প্রেগন্যান্ট! বাচ্চাটা কামালের না বরং আশরাবের। এ কথা শুনে কামাল তো তাকে শারীরিক নির্যাতন করতে আসছিলো, তার আগেই তপা নিজেকে বাঁচাতে ভারী কিছু দিয়ে কামালের মাথায় জোড়ে আঘাত করে। যার ফলে কামাল ঘটনাস্থলেই মারা যায়। তপা সেই ঘটনায় বেশ ভয় পেয়ে যায়, তাই সে ফুলদানিটা সঠিক জায়গায় রেখে নিজের আঙ্গুলের ছাপ মুছে নিজের ঘরে গিয়ে কাঁথা টেনে ঘুমিয়ে পড়েছিলো৷ আজ অবধি কেউ-ই জানতে পারেনি কামালের আসল খুনি কে। কামাল মারা যাওয়ার ১মাস পর যখন আশরাবের বিয়ের কথা চলে তখন তপা তাকে জানায় তাদের সন্তান তপার গর্ভে। বাচ্চার কথা শুনে আশরাব সেই মুহূর্তে তপাকে বিয়ে করে। এতে আশরাবের সাথে তার মায়ের ছাড়াছাড়ি হলেও আশরাব ঠিকই তার পরিবারের খেয়াল রেখেছে। বাচ্চার জন্যেও আশরাব তপাকে পূর্বের ভুলগুলো ক্ষমা করে দেয়। আশরাবকে পেয়ে তপার জীবনটা যেন বদলে যায়। আর কামালের সাথে বিয়ের দিন থেকে কঠিন অপরাধবোধে ভুগেছে সে বারংবার। আশরাবের সাথে বিয়ে হওয়ার পর তপা সেহেরের নাম্বার জোগাড় করে তাকে কল দিয়ে কান্নাকাটি করে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছে। আর সেহের! সে তো কখনো ওদের শাস্তি দেয়ার কথা ভাবতেই পারেনি, তাই এবারও সেহের সকলকে ক্ষমা করে দেয়।

তপার দিনগুলো ভালোই কাটছিলো কিন্তু যখন তার প্র‍্যাগনেন্সির সাত মাস পেরিয়ে গেছে। তখন সে পুকুরপাড়ে হাত-মুখ ধুঁতে সিঁড়ি দিয়ে নামছিলো। আশরাব সেদিন বাড়িতে ছিলো না। তপা হঠাৎ বেসামাল হয়ে একটা সিঁড়িতে পা পিছলে পড়ে পানিতে পরে যায়। যদিও তপা সাঁতার জানতো কিন্তু ভারি এবং দুর্বল শরীর নিয়ে সে একেবারেই সাঁতার কাটতে পারেনি। শেষ রক্ষাও তার হলো না, পুকুরে ডুবে মারা গেলো। পুকুরঘাটের সিঁড়ি রক্তে মাখামাখি, পুকুরের এক অংশ পানিও।
আশরাব প্রায় একবছর নিজেকে না সামলাতে পারলেও এখন নিজেকে বেশ সামলিয়েছে কিন্তু ভেতরে তার আকাশ ছোঁয়া ক্ষত। সে এই ক্ষত না পারে কাউকে দেখাতে আর না পারে বলতে। জীবন্ত লাশ সে এখন, জীবন্ত লাশ! সুখ যেন তার হাতে কোনোদিনও ধরা দেয়নি।

আবিদ আর মানজুর বিয়েও হলো কয়েকমাস হলো। প্রথমে মানজুকে অন্যজায়গায় বিয়ে দিবে বলেছিলো। মানজু তো কেঁদেকেটে সেহেরের মাথা খারাপ করে দিচ্ছিলো৷ সেহেরের তখন পরীক্ষা চলছিলো বিধায় সে গ্রামে যেতে পারেনি তবে ব্যবস্থা ঠিকই করে দিয়েছে। সেহেরের দাদীর মতো একটা দাদী থাকলে আর কী লাগে? দাদীমা সব শুনে সেদিনই মানজুর বাড়িতে গিয়ে বিয়ের কথা পাকা করে আসে। আবিদ যেহেতু পড়াশোনা শেষ করে বাবার ব্যবসায় হাত লাগিয়েছিলো সেহেতু মানজুর বাবা-মা অমত করেনি। খুবই ভালোভাবে তাদের বিয়েটা সম্পূর্ণ হয়।

সেহের রান্না সেরে নিজ হাতে খাবারগুলো হটপটে ঢুকালো। অতঃপর রুমে গিয়ে শাওয়ার নিয়ে রেডি হয়ে গেলো। সা’দ তাকে বোরকা ছাড়া বের হতে নিষেধ করেছে তাই সেহের সবসময় বোরকা হিজাব পরেই বের হয়। রেডি হয়ে নিচে নামতেই দেখলো অধরা তার জন্য অপেক্ষা করছে। সেহের মুচকি হেসে অধরাকে এগোতে বলে সার্ভেন্টের হাত থেকে হটপটটা নিয়ে নিজেও বেরিয়ে গেলো।

—“কী কারীব তুমি বিয়ে কবে করবা? এতোদিন তো আমার বিয়ে বিয়ে করে সব মাথায় তুলেছিলে, আর এখন আমি বিয়ে করে সংসারীও হয়ে গেলাম অথচ তোমার খবর নেই। ব্যাপার কী হু?” সা’দের কথা কারীব হেসে লাজুক সুরে বলে,

—“বাবা-মা মেয়ে দেখছে স্যার, মনে হচ্ছে আমিও কিছুদিনের মধ্যে ডাবল হয়ে যাবো!” কারীবের কথায় সা’দ, কারীব উভয়ই হেসে উঠলো। ফারুক হোসাইন দূরে বসে চা খাচ্ছে এবং নিজের স্ক্রিপ্ট মনোযোগ সহকারে পড়ছে। সা’দ আর ফারুককে বিরক্ত করলো না। শ্বশুড়, জামাই এখন প্রায় শুটিং এই একসাথে থাকে। ফারুক হোসাইন তো গতবছর সেরা অভিনয়ের এওয়ার্ডও পেয়েছেন, সাথে সা’দও বেশ কিছু এওয়ার্ড পেয়েছেন তার নিখুঁত এবং বাস্তব জীবনের টেলিফিল্ম, নাটক এবং ফিল্মের জন্য।

তাদের ব্যস্ততার মাঝেই অধরা এবং সেহের স্পটে আসলো। কর্মচারীরা তো সেহেরকে ঠিক চিনে ফেলে, সকলে কি যে খুশি। সেহের এতো মানুষের মাঝে তার বিদেশিকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। সা’দ তো এখনো খেয়াল করেনি সেহেরকে। সেহেরকে দেখে কিছুটা মুগ্ধ হলো টেলিফিল্মের একজন অভিনেতা জয়। জয় কাউকে সেহেরের বিষয়ে জিজ্ঞেস করতেই সে জানালো সেহের সা’দের স্ত্রী। এ কথা শুনে জয় চোখ নামিয়ে ফেলে কারণ, সা’দকে সে অত্যন্ত সম্মান করে। সা’দ যদি না হতো তার ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে আসা ইমপসিবল ছিলো, সা’দ এক বছর যাবত নবীনদের বড়ো একটা সুযোগ করে দিচ্ছে। জয়কেও সে-ই প্রতিষ্ঠিত করছে। সেহের সা’দের সামনে কোমড়ে দুই হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সা’দ কারো উপস্থিতি টের পেয়ে স্ক্রিপ্ট থেকে চোখ সরিয়ে মাথা উঁচু করে তাকালো। সেহেরকে দেখে সে হতবাক হয়ে গেলো এবং অস্ফুট সুরে বলে উঠলো,

—“তুমি এখানে?”

—“হু আমি৷ আপনার ওই বই-পত্র দেখা হলো?”

সেহেরের কথায় সা’দ ভ্রু কুচকে ফেলে। সেহের আবার বললো,

—“সারাজীবন তো এই স্ক্রিপ্টের মধ্যেই থাকেন, বলি ঢুকে যেতে পারেন না? ঢুকলে কী এমন ক্ষতি হয় হু?”

সেহেরের এমন রাগীমাখা কথাবার্তা শুনে কারীব তৎক্ষনাৎ কেটে পরলো।

—“আরে ধুর রেগে যাচ্ছো কেন? এটাই তো আমার কাজ! নইলে তোমার জামাই ডিরেক্টর কী করে হলো বলো তো? সবই তো তোমার জামাইর আর এইসব স্ক্রিপ্টের ক্রেডিট তাই না বলো?”

সেহের ভেংচি কেটে সা’দের পাশের চেয়ারে বসলো। এখনো বউ রেগে আছে তাই সা’দ তার বউয়ের রাগ ভাঙ্গাতে বললো,

—“বউ তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে!”

—“কিসের সারপ্রাইজ?”

সা’দ টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা সুন্দর রঙিন প্যাপারে মোড়ানো প্যাকেট নিলো। সেহের মুখ ঘুরিয়ে বসেছিলো। চোখের সামনে প্যাকেটটা ধরতেই সেহের অবাক হয়ে সেটার দিকে তাকিয়ে সা’দের দিকে তাকালো। প্যাকেটটার দিকে তাকিয়ে অস্ফুট সুরে বলে উঠে,

—“কী আছে এতে?” সা’দ সেহেরের হাতে প্যাকেটটা ধরিয়ে দিয়ে বলে,

—“নিজেই খুলে দেখো।”

সেহের কাগজ খুলে দেখলো একটা সাদা বইয়ের পেছন দিক। বইটা উল্টিয়ে সামনের কভার দেখতেই সেহের বিস্মিত হলো।
“বসন্তি ফুল” [স্ক্রিপ্ট]
“সেহের আশফির ফুল” লিখা।
সেহেরের চোখদুটো জ্বলজ্বল করে উঠলো। সে দ্রুত ভেতরের কিছু পেজ পড়ে দেখলো। হ্যাঁ তারই লেখা। সেহের ছলছল নয়নে সা’দের পানে তাকালো। সা’দ সেহেরের দিকে তাকিয়ে আছে। সেহের তাকাতেই চোখ দিয়ে আশ্বাস দিলো। সেহের অস্ফুট সুরে বললো,

—“এটা তো আমি আমার ডায়েরীতে লিখেছিলাম, আপনি আমার ডায়েরী কই পেলেন?”

—“যেখান থেকেই পাই না কেন, পেয়েছি তো। আমি কী জানতাম নাকি আমার বউয়ের এতো গুণ! তাই এই সুযোগ হাতছাড়া করলাম না। ভাবছি সামনের শুটে এটা শুরু করবো। এখন বলো এই স্ক্রিপ্টার পেমেন্ট কতো নিবে তোমার জামাই’র থেকে?”

সা’দের কথায় সেহের ফিক করে হেসে ফেললো। দূর থেকে ফারুক হোসাইন এবং অধরা সেহেরের হাসিমাখা মুখটা দেখছে। সেহের হাসি থামিয়ে বলে,

—“সেটা পরে দেখা যাবে এখন আসুন, খিঁচুড়ি তো ঠান্ডা হয়ে যাবে। অনেক কষ্ট করে আপনার জন্য এবং বাবার জন্য নিজ হাতে রেঁধে এনেছি আপনাদের সারপ্রাইজ দিবো বলে।”

—“চলুন মহারাণী আমিও যে আপনার সুস্বাদু খাবারের অপেক্ষায় আছি!”
সা’দের নাটকীয় কথাবার্তায় সেহের নিশব্দে হাসলো।

সমাপ্ত।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here