জান্নাহ্,পর্বঃ৩,৪

0
1624

জান্নাহ্,পর্বঃ৩,৪
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
পর্বঃ৩

মাথার ঠিক ওপরে ফ্যান ঘুরছে।সামনে থাকা কাঁচ দিয়ে দেখা যাচ্ছে পথচারীদের।কেউ একা তো কেউ সাথে সঙ্গী করে।সারহানের অক্ষি নিবদ্ধ সেদিকে।একটা ছেলে আর একটা মেয়ে পাশাপাশি বসে আছে ফুটপাতে।শহরাঞ্চলে এমনটা অহরহ হলেও মফস্বলে অনেকটা দৃষ্টিকটু তা।সারহান বাঁকা হাসে।

তার সামনে স্থির হয়ে বসে আছে জাবিন।ভীত দৃষ্টি তার।শ্রান্ত তার দেহ।সারহান তার দিকে তাকিয়ে মৃদু গলায় বললো–

“কেমন আছিস?

ঠান্ডা গলায় প্রত্যুত্তর করে জাবিন–

“ভালো।”

সারহান গলার স্বর একটু তীক্ষ্ম করে বললো–

“পার্কে কী করছিলি তুই?

ফাঁকা ঢোক গিলে জাবিন।কিন্তু কোনো কথা বললো না।চোরা চোখে এদিক অধিক তাকায়।কঠিন গলায় সারহান বললো–

“কোল্ড ড্রিংকস?

জাবিন নিঃশব্দে মাথা হেলায়।সারহান ওয়েটারকে বলে দুটো কোল্ড ড্রিংকস আর দুটো পাস্তার ওর্ডার করে।যতক্ষন ওয়েটার আসলো ততক্ষন জাবিন নিচের দিকে তার দৃষ্টি নত করে রাখলো।জাবিনের বুকের ভেতর খা খা রোদ্দুরে যেনো তৃষ্ণায় ফেটে যাচ্ছে।শরীরের শিরা উপশিরা যেনো রক্ত প্রবাহ থামিয়ে দিচ্ছে।স্বরনালি কাঁপছে মৃদু ছন্দে।কিন্তু আওয়াজ নিঃসরিত হচ্ছে না।

সামনে রাখা কোল্ড ড্রিংকস বেয়ে শীতল জল গড়িয়ে পড়ছে।সারহানদের টেবিলে একটা এক্সট্রা বাটি আছে।সারহান শক্ত গলায় জাবিন কে বললো–

“তোর মোবাইলটা দে।”

জাবিন থতমত খেয়ে যায়।ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলে সামনে তাকায়।আকস্মিক সারহানের উচ্চ আওয়াজে কেঁপে উঠে জাবিন।

“মোবাইলটা দে বলছি।”

নিজের পকেট থেকে কম্পিত হাতে মোবাইল বের করে জাবিন।অনেকটা অস্বস্তি,দ্বিধা,ক্রোধ আর ঘৃণা নিয়ে সারহানের হাতে মোবাইলটা দেয় জাবিন।তা হাতে নিয়ে সরু চোখে তার দিকে তাকায় সারহান।টেবিলের উপর মোবাইলটা রেখে দুটো কোল্ড ড্রিংকস দুই হাতে নিয়ে বাটির মধ্যে ঢালে।টেবিলে রাখা মোবাইলটা সেই বাটির মধ্যে চুবিয়ে দেয়।হতভম্ব হয়ে যায় জাবিন।তার মনে হলো কেউ তার কলিজা কেটে গরম পানিতে ছেড়ে দিয়েছে।দাঁত কিড়মিড় করে এক হিংস্র চোখে তাকায় সারহানের দিকে।কিন্তু মুখে একটা শব্দও করলো না।পাস্তার প্লেট থেকে ফ্রক নিয়ে বাটির মধ্যে ঘুরাতে থাকে।সেদিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে আছে জাবিন।

একটু শান্ত হয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে সারহান।থমথমে গলায় বললো–

“জান্নাহ্কে মামি কেন ডাকিস না তুই?

ফোঁস ফোঁস করছে জাবিন।যেনো জ্বলন্ত উনুন তার মাথায় জ্বালানো হয়েছে।দাঁতে দাঁত চেপে সারহান আবার প্রশ্ন করে–

“জান্নাহ্কে মামি কেন ডাকিস না তুই?

শক্ত ও দৃঢ় গলায় জাবিন বললো–

“ডাকবো।”

“যা এখান থেকে।আজকের পর তোর মোবাইল ব্যবহার করা বন্ধ।যদি আমি আর কোনোদিন তোকে কোচিং ফাঁকি দিয়ে অন্য কোথাও যেতে দেখেছি তাহলে সারজীবনের জন্য তোর পড়ালেখা বন্ধ।ওঠ এখান থেকে।”

সারহানের ধমকে দ্রুত সেখান থেকে উঠে যায় জাবিন।জাবিন শুভ্রার ছেলে।বয়সে সে জান্নাহ্ থেকে বড়।বিয়ের এতোদিন পরেও জান্নাহ্কে জাবিন কখনো মামি বলে সম্মোধন করেনি।জান্নাহ্ এর সাথে এ ছাড়াও আরো একটা সম্পর্ক আছে তার।যা এই বাড়িতে জান্নাহ্ আসার আগে ছিলো।জান্নাহ্ ছাদে কাপড় মেলতে গেলে জাবিন তখন বাড়ির ভেতরে আসছিলো।জান্নাহ্কে ওই অবস্থায় দেখে নিজেকে সামলাতে পারেনি জাবিন।তাই তার কয়েকটা ছবি তোলে।সারহানের দৃষ্টি জান্নাহ্ এর সর্বত্র।

মোবাইলের রিংটোন বেজে উঠে সারহানের।একরাশ ক্ষোভ আর বিরক্তি নিয়ে রিসিভ করে।সংক্ষুব্দ গলায় বললো–

“এতোবার কল কেন করছিস?

মেঘনোলিয়া ধীর গলায় বললো–

“আমি তোমার জন্য সেই কখন থেকে অপেক্ষা করছি সারহান।”

সারহান চোয়াল শক্ত করে ক্ষীপ্ত গলায় বললো–

“এতো জ্বালা কেন তোর শরীরে।সহ্য না হলে পেথিড্রিন নে।আর একবার যদি কল করেছিস তো সারাজীবনের মতো আমার চেহারা ভুলে যাবি।”

লাইন কেটে দেয় সারহান।তার দুই চোখ দিয়ে অগ্নিনালা বের হচ্ছে।
,
,
,
ছেলের গালে ঠাস করে এক চড় বসায় শুভ্রা।জাবিন বিক্ষিপ্ত গলায় বললো–

“তোমার ওই ভাই জান্নাহ্কে একদিন মেরেই ফেলবে।”

শুভ্র ছেলের গালে সজোরে আরেকটা চড় মেরে বললো–

“ভাই কিসের!মামা বল।”

“ওই সারহানকে আমি কোনোদিনও মামা বলবো না।”

ছোটবেলা একবার এক্সামে ফেল করেছিলো বলে জাবিন কে তিনদিন অন্ধকার ঘরে বন্ধি করে রেখেছিলো সারহান।সেই থেকে চাপা ক্ষোভ জন্মেছে সারহানের জন্য জাবিনের মনে।তা আগ্নেয়গিরি লাভার মতো উগরে উঠে যখন জান্নাহ্কে বিয়ে করে এই বাড়িতে আনে সারহান।

শুভ্রা খলবলিয়ে বললো–

“সারহান জানলে কী হবে জানিস!

“কী হবে!মেরে ফেলবে!এমনিতেও ওই সারহান কাউকে বাঁচতে দিবে না।ওর জন্য তোমাদের ভুগতে হবে।আর জান্নাহ্কেও মরতে হবে।”

“চুপ,একদম চুপ।জান্নাহ্ মরুক বা বাঁচুক।তাতে তোর কী?

জাবিন চুপ করে থাকলো।ঘরের দরজায় এক লাথি মেরে বেরিয়ে যায়।শুভ্রা ধপ করে নিচে বসে পড়ে।এই ছেলেকে নিয়ে প্রচন্ড ভয় হয় তার।
,
,
“এইটা কী তিতিসোনা?

“আম।”

“আর এইটা?

“কাঁঠাল।”

“ভেরি গুড আমার সোনাপাখিটা।”

তিতি শুভ্রার চার বছরের মেয়ে।এই বাড়িতে যদি কাউকে সবাই বিনা স্বার্থে ভালোবেসে থাকে তাহলে সে হলো তিতি।জান্নাহ্ যখন এই বাড়িতে আসে তখন তিতিই ছিলো তার সারাদিনের সঙ্গী।গুটিকয়েক কাজ ছাড়া আর কোনো কাজ নেই জান্নাহ্ এর।নিজের পড়ালেখা আর তিতিকে নিয়েই কাটে তার দিন।

“তিতিসোনা,এইটা কী বলোতো?

“নাশপাতি।”

“ইয়েহ!
আমার তিতি সোনা সব পারে।”

জান্নাহ্ তিতির গালে চুমু খায়।তার বিপরীতে তিতিও জান্নাহ্ এর ঠোঁটে চুমু খায়।উচ্ছলিত গলায় বললো–

“পরীমা,মামা কখন আসবে।”

জান্নাহ্ কে যেদিন প্রথম দেখে তিতি কিছুতেই তার কাছে আসতে চাইছিলো না।তাই সারহান একটা পুরো রাত তাদের সাথে রাখে তিতিকে।চাঁদের আলোয় যখন জান্নাহ্কে তিতি দেখে উচ্ছ্বাসিত হয় সে। সারহানকে জিঙ্গেস করতেই সে তিতি কে শিখিয়ে দেয় জান্নাহ্কে পরীমা বলে ডাকতে।জান্নাহ্ এর বেশ পছন্দ হয় ডাকটা।তিতি যখন তার আধো আধো বোলে জান্নাহ্কে পরীমা বলে ডাকে জান্নাহ্ এর সত্যিই নিজেকে মা মনে হয়।

নরম পায়ে ঘরে ঢুকে সারহান।তাকে দেখেই দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে তিতি।সারহান ভাগ্নির চোখে মুখে অধর ছুঁইয় বললো–

“কেমন আছে আমার তিতি মামুনি?

“ভালো।”

সারহান এক বক্স চকলেট ধরিয়ে দেয় তিতির হাতে।প্রশ্ন করে–

“তিতিপাখির পড়া কী শেষ?

তিতি চটপটে গলায় বললো–

“হুম।”

“তাহলে মামুনির কাছে যাও।”

“আচ্ছা।”

তিতি যেতেই কাউচে হেলান দিয়ে বসে সারহান।কলার টা পিছনের দিকে ছড়িয়ে দেয়।চক্ষু মুদন করে থমথমে গলায় বললো–

“দাঁড়িয়ে আছেন কেন?

“জান্নাহ্ নিঃশব্দে তার পাশে এসে বসে।নরম গলায় সারহান বললো–

“সন্ধ্যায় কিছু খেয়েছেন?

“জ্বী।
কোথায় ছিলেন আপনি?

সারহান চোখ খুলে শক্ত দৃষ্টিতে তাকায়।মুহুর্তেই জান্নাহ্ এর ঝলমলে মুখটা চুপসে যায়।একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে সারহান বললো–

“আপনি এতো পানসে কেনো হয়ে যাচ্ছেন রজনীগন্ধ্যা?

জান্নাহ্ মরিচা পড়া লৌহার মতো চেয়ে থাকে।সারহান আবার বললো–

“এখন আর আগের মতো স্বাদ পাই না।শরীরের যত্ন নেন না আপনি!

জান্নাহ্ বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলতে থাকে।অসহায় তার দৃষ্টি।স্থির তার দেহপিঞ্জর।নিঃশ্বাসের গড়পড়তায় উঠানামা করছে জান্নাহ্ এর বুক।প্রগাঢ় দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে আছে সারহান।ধীরগতিতে সারহান তার হাত জান্নাহ্ এর পেছন দিক থেকে ঘুরিয়ে জান্নাহ্ এর উদোরে চেপে ধরে।আরেক হাত দিয়ে জান্নাহ্ এর হাত টেনে তার বুকের উপর শোয়ায়।জান্নাহ্ এর অধরপল্লবে দীর্ঘ সময় মত্ত থাকে সারহান।পেশিবহুল দুই হাত দিয়ে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরেছে জান্নাহ্কে।জান্নাহ্ তার বুকে আর পিঠে ব্যাথা অনুভব করে।কিন্তু সারহানকে বাঁধা দেওয়ার ইচ্ছা বা শক্তি কোনোটাই তার নেই।দীর্ঘ সময় নিয়ে জান্নাহ্ এর অধরামৃত শুঁষে তার গলা, বুকে চুমু খেতে থাকে সারহান।সারহানের স্পর্শেই যেনো কম্পন শুরু হয় জান্নাহ্ এর শরীরে।নিজেকে শান্ত করে সারহান।স্থির দুই চোখে জান্নাহ্কে দেখে।সারহানের ছোঁয়ায় উন্মাদ হয়ে উঠেছিলো জান্নাহ্।কিন্তু সারহান থেমে যেতেই নিজেকে বড্ড অসহায় লাগছে নিজের কাছে তার।সারহান অধর কোণে বাঁকা হাসে।জান্নাহ্ এর অবস্থা এখন জ্বলন্ত উনুন থেকে লাকড়ি সরিয়ে নেওয়ার মতো।দুই চোখ বুজে মৃদু গলায় সারহান বললো–

“আমার জন্য ঠান্ডা পানি নিয়ে আসুন রজনীগন্ধ্যা।আপাতত আপনার দেওয়া উত্তাপ পানি দিয়ে শীতল করি।”

জান্নাহ কোনো কথা বললো না।শাড়িটা ঠিক করে হাঁটা ধরে।জোর গলায় সারহান বললো–

“রজনীগন্ধ্যা,শাড়িটা ঠিক করুন।বাইরে নেড়ি কুকুর বসে আছে।”

চলবে,,.

জান্নাহ্
পর্বঃ৪
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

কৃষ্ণকায় আকাশে তারার ঝলকানি।তার মাঝে দাম্ভিকতার সাথে রাজ সিংহাসনে বসে আছে রূপালি চাঁদ।তার আশপাশ জুড়েও তার দাম্ভিকতার রূপ।এক ধ্যানে তাকালে এই তো মনে হবে যেনো ছুটে আসছে আকাশের রাণী।যেনো তার কিরণে অবগাহন করাবে।রাতের নিস্তব্ধতায় আলোড়ন সৃষ্টি করে অজানা প্রত্যঙ্গ।থমথমে বাতাসে ভেসে আসছে অদ্ভুত ফুলের ঘ্রান।আকাশ ঘুমোচ্ছে।তাকে পাহারা দিচ্ছে চাঁদেশ্বরী।দিনের আলোয় নীলাভ আকাশ রাতের মায়ায় এক কৃষ্ণ গহব্বর।সেখানেই উঁকি মেরে থাকে চাঁদ।

জান্নাহ্ এর ছোট্ট শরীরের উপর নিজেকে সমার্পিত করে তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে সারহান।মোবাইলে ভ্রাইব্রেট হতেই চোখে টোকা পড়ে তার।চোখ দুটো কুঁচকে আবার মেলে ধরার চেষ্টা করে।চোখের পাতা হালকা প্রশ্বস্ত করে বেড সাইড টেবিল হাতড়ে মোবাইল নিয়ে কানে ধরে সারহান।কে কল করেছে তা দেখার প্রয়োজন বোধ করলো না।ঘুম জড়ানো গলায় একরাশ বিরক্তি অধরে নিয়ে সারহান বললো–

“হ্যালো।কে?

ওপাশের ব্যক্তিটি দ্রুত গতিতে বললো–

“স্যার আমি শায়িখ।”

সারহান বিরক্তিকর গলায় বললো–

“এতো রাতে কল করলে কেন?

“স্যার একটা জরুরি কথা ছিলো।”

তপ্ত গলায় সারহান বললো–

“বলো।”

শায়িখ জানে সারহানকে ছোটখাট বিষয় নিয়ে বিরক্ত করলে সে ক্ষেপে যায়।আর মেয়ে মানুষের সাথে থাকাকালীন তো আরো বেশি।তবুও একান্ত জরুরি খবর বলেই তাকে বাধ্য হয়ে কল করেছে শায়িখ।সারহানের নজর পড়ে ঘুমন্ত জান্নাহ্ এর উপর।কী অদ্ভুত নেশা এই মুখে!সারহান তার ঘ্রাণেন্দ্রিয় বুলাতে থাকে জান্নাহ্ এর গলার নিচ থেকে বুকের উপর। এক মিষ্টি সুবাসে উন্মত্ত হয়ে উঠে সারহানের শরীর। জান্নাহ্ এর ঘুমন্ত চেহারায় এক পশলা চাঁদের আলো পড়তেই ঝাঁঝিয়ে উঠে সারহানের চোখ।সারহান নিভু নিভু চোখে হাসে।দূর্বল হাতে কানে মোবাইল চেপে ধরেই জান্নাহ্ এর অধরে অধর মেশায়।নড়ে উঠে জান্নাহ্।তার শ্রান্ত দেহ নিয়ে বেশি নড়াচড়া করলো না সে।শায়িখ তার স্যারকে ভালো করেই জানে।তাই এই পাশের সেই অস্ফুট শব্দে সে অভিনিবেশ করলো না।নিজের গুরুত্বপূর্ণ কথা শেষ করে কল কেটে দেয়।মোবাইলটা ছুঁড়ে ফেলে সারহান।জান্নাহ্কে পুরো আড়ষ্ট করে নেয় তার বক্ষপিঞ্জিরায়।যেখানে জান্নাহ্ শুধু ডানা ঝাপটানো এক অসহায় পাখির ছানা।
,
,
,
সকালের প্রভাত কিরণ উঁকি দিয়।এক মুঠো হলদে রোদ এসে হানা দেয় জান্নাহ্ এর চোখে।চোখ কুঁচকে নেয় জান্নাহ্।সকাল হয়েছে বুঝতে পেরে ধীরগতিতে উঠে বসে।তার এলোমেলো শাড়ি কোনোমতে গায়ের সাথে লেপ্টে আছে।ঘর জুড়ে কোথাও সারহানকে দেখতে পেলো না।জান্নাহ্ অবগত হয় সারহানের ফিরে যাওয়ার বিষয়ে।বিছানা থেকে পা নামায় জান্নাহ্।শরীরে প্রচন্ড ব্যাথা হচ্ছে তার।শাড়িটা কোনোমতে গুঁজে ওয়াশরুমে যায়।

আজ জান্নাহ্ স্কুল যাবে।সকাল আটটায় তার স্কুল।এখন ঘড়িতে ছয় টা।ভালো করে ফ্রেশ হয়ে স্কুল ড্রেস পরেই বের হয় জান্নাহ্।আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।সারহান থাকলে নিজেকে দেখার সময়টুকুও পায় না সে।জান্নাহ্ খেয়াল করে তার চোখের নিচটা ঈষৎ কালচে।তার পেটটাও একটু উঁচু।জান্নাহ্ এর মন ক্ষুন্ন হয়।এই জন্যই সারহান তাকে এইসব বলেছে।আয়নায় অপলকে চেয়ে নিজেই নিজেকে শাসায়—

“জান্নাহ্,এখন থেকে কম খেতে হবে।বুঝলে।”

নিজের কথায় নিজেই খলখলিয়ে হাসে জান্নাহ্।যখনই একা থাকে নিজের সাথেই কথা বলে সে।বেশ লাগে তার কাছে।মাথাটা আয়নার সামনে এনে চোখটা ভালো করে দেখে।বললো–

“ইশ!কী বিদঘুটে!

ঘড়ির দিকে তাকায় জান্নাহ্।প্রায় পৌনে সাতটা।এখনো অনেক সময় বাকি।হঠাৎ একটা পাখির ডাক শুনতে পায় জান্নাহ্।ব্যস্ত হয়ে বারান্দায় গিয়ে দাড়ায়।একটা ঠান্ডা বাতাস এসে লাগে তার চোখে মুখে।বারান্দার সাথে শিয়র উঁচু করে দাঁড়ানো মেহগনি গাছটার পাতা গুলোয় ছোট ছোট পানির ফোঁটা।বোধ হয় বৃষ্টি হয়েছিলো খানিকটা।ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি যাকে জান্নাহ্ চোরা বৃষ্টি বলে।একটা লম্বা শ্বাস টেনে নেয় জান্নাহ্।ভোরের স্নিগ্ধ,ভেজা বাতাসে তার শরীর জুড়িয়ে আসে।শুভ্র আকাশে ঝিলমিলে নরম রোদ।এই রোদে অবগাহনে মনে প্রশান্তি জাগে।একটা পাখি উড়ে যাচ্ছে।জান্নাহ্ ভাবে,”ইশ!সেও যদি উড়তে পারতো!তাহলে অনেক দূরে চলে যেতো।পৃথিবীর এই রাগ,হিংসা,ছলনা আর ধোঁকা থেকে অনেক দূরে।যেখানে শুধু সে আর তার প্রাণ থাকবে।”

কিন্তু তা হবার নয়।বিয়ের পর থেকে এই বাড়ির চৌকাঠেই বন্দি সে।স্কুল,টিউশন ছাড়া আর কোথাও যাওয়ার সুযোগ হয় না।একটা শীতল দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে জান্নাহ্ এর হৃদয় গহব্বর থেকে।

ঘরে আসে জান্নাহ্।আবারো চোখ যায় সময় প্রহরির দিকে।আটটা পাঁচ।বিছানায় বসে জান্নাহ্।ভেজা চুলগুলো ছড়িয়ে শুয়ে পড়ে।স্মৃতিমন্থনে ব্যস্ত হয় সে।

মনে পড়ে তার আর সারহানের প্রথম দেখা।যেদিন সারহান আর তার বাবা জান্নাহ্কে দেখতে গিয়েছিলো।জান্নাহ তখন চৌদ্দ বছরের কিশোরী।বাড়ন্ত শরীর তার।পদ্মলোচন দুই আঁখি।কিশলয়ের মতো কোমল দুই ঠোঁট।দুধে আলতা রঙ।পিতামাতাহীন জান্নাহ্ মামার পরিবারে মানুষ।মামি সদা তৎপর ছিলেন কী করে জান্নাহ্কে বিদায় করা যায়।আর হলোও তাই।প্রথম দেখায় সারহানের বুকে বিঁধে জান্নাহ্ নামের মেয়েটির ওই দুই চোখ।মাথায় দীর্ঘ ঘোমটা টানা জান্নাহ্ ওড়নার ফাঁক দিয়ে একবার দেখে সারহানকে।সেই এক পলকেই সারহানের ওই গভীর চোখ,কঠিন অভিব্যক্তি আর এক অজানা নেশা জান্নাহ্ এর বাড়ন্ত কিশোরী মনকে ঘায়েল করে।কিন্তু সারহানের নজর আটকে অন্য কোথাও।যা জান্নাহ্ জানতে পারে তাদের বাসর রাতে।সারহানকে যখন জান্নাহ্ এর সাথে একা কথা বলতে দেওয়া হয় তখন সারহান বলেছিলো,”আপনি আমাকে আপনার প্রাণসঞ্চারক হওয়ার অধিকার দিবেন,রজনীগন্ধ্যা?
আমার অন্তিম শ্বাস পর্যন্ত আপনাকে আমি আমার প্রাণের ডোরে বেঁধে রাখবো।”
ব্যস,এই দুটো লাইনই আজ জান্নাহ্ এর মৃত্যু যন্ত্রণার জন্য দায়ী।সেইদিন সারারাত ঘুমাতে পারেনি জান্নাহ্।শুধু সারহানকে ভেবেছে।একটা মানুষ এতো সুন্দর হয় কী করে!এতো সুন্দর করে অধিকার চায় কী করে!
দুই দিনের ভেতর একটা ছোট অনুষ্ঠান করে পারিবারিকভাবে বিয়ে হয় জান্নাহ্ আর সারহানের।কিন্তু বিয়ের রাতে সারহানের অদ্ভুত আচরণে সব ধারণা বদলে যায় জান্নাহ্ এর।সেই সুখের যন্ত্রণা আজও কাঁপিয়ে তোলে জান্নাহ্কে।

মোবাইলে এ্যালার্ম বাজতেই সপ্রতিভ হয় জান্নাহ্।ঘড়িতে তখন সাড়ে সাতটা।ফটাফট তৈরি হয়ে ঘর থেকে বের হয় সে।স্কুল ড্রেসের উপর বোরখা পরে জান্নাহ্। ঘরের দরজায় আসতেই শুভ্রা বলে উঠে–

“না খেয়ে যাচ্ছিস কেন?

জান্নাহ্ মৃদু গলায় বললো–

“ক্যান্টিন থেকে খেয়ে নিবো।তুমি চিন্তা করো না।”

সম্মতি দেয় শুভ্রা।সকালে ড্রয়ার খুলতেই সেখানে হাজার পাঁচেক টাকা দেখে জান্নাহ্।সারহান রেখে গেছে।যতবারই বাড়ি আসে যাওয়ার সময় টাকা রেখে যায়।অবশ্য এই টাকার তেমন প্রয়োজন পড়ে না জান্নাহ্ এর।কারণ তার আনুষঙ্গিক সকল খরচ সারহান নিজেই বহন করে।ছাদের ওপর থেকে দুই লোলুপ দৃষ্টি জান্নাহ্ এর দিকে চেয়ে আছে তা জান্নাহ্ টের পায় না।
,
,
,

স্কুল পৌঁছাতেই প্রফুল্ল হয় জান্নাহ্ এর মন।আজ তিনদিন পর স্কুল এসেছে সে।ঘরের সমস্ত অশান্তির মাঝে এই এক টুকরো সুখ তার।স্কুলের গেটের পাশেই একটা রেইন ট্রি।শুকনো পাতায় বিছিয়ে আছে গাছের নিচটা।আর্দ্রতায় জড়ানো তা।হঠাৎ একটা বাতাসেই নড়ে উঠে রেইন ট্রি পাতা।ঝমঝম করে কিছু পানি ছিঁটকে এসে পড়ে জান্নাহ্ এর শরীরে।কেঁপে উঠে জান্নাহ্।স্কুল গেইট দিয়ে ভেতর প্রবেশ করে সে।দুই ধারে বিল্ডিং মাঝে মাঠের মতো জায়গা।জান্নাহ্ এর স্কুলটা অনেকটা ইংরেজি শব্দের ইউ আকৃতির।প্রথম ভবনে মাত্র দোতালা।পরে যেই ভবনটা করা হয় তা পাঁচ তলা।।দোতালা ভবনটাই মূল ভবন।এখানেই অধ্যক্ষের জন্য বরাদ্দকৃত রুম,শিক্ষক মিলনায়তণ,লাইব্রেরি,অফিস রুম সব।জান্নাহ্দের ক্লাস পাশের ভবনে।মূল ভবনকে পার করেই সেখানে যেতে হয়।দ্বিতীয় ভবনের মধ্যখান বরাবর কৃষ্ণচূড়ার গাছ।ফেব্রুয়ারি আসলেই গাছের সাথের করিডোরে বিছিয়ে থাকে কৃষ্ণচূড়ার রক্ত লাল ফুলে।ভবনের কোনার দিকটায় শিমুল ফুলের গাছ।পাতাবিহীন গাছটায় লাল শিমুলে ভরে আছে।এই সময়টা বেশ লাগে জান্নাহ্ এর।

সিড়ি দিয়ে উঠতেই দেখা হয় জান্নাহ্ এর ঘনিষ্ঠ বান্ধবী তিলের সাথে।তাকে দেখেই উচ্চলিত তিল খুশিতে গদগদ হয়ে বললো–

“কই ছিলি তুই!আছিস নি কেন এতোদিন?

জান্নাহ্ ইতস্তত করে বললো–

“একটু ব্যস্ত ছিলাম।”

তিল তার কোমর দিয়ে এক ধাক্কা মারে জান্নাহ্কে।আমুদে গলায় বললো–

“মিথ্যে বলিস কেন!আমি জানি না নাকি!সারহান ভাইয়া এসেছিলো তাই না?

অপ্রস্তুত হয় জান্নাহ্।ক্ষুন্ন গলায় বললো–

“দুর।তেমন কিছু না।চল ক্লাসে যাই।”

দুই বান্ধবী ক্লাসে ঢোকে।আজ তাদের প্রথম পিরিওড হায়ার ম্যাথ এর।এই ক্লাসটায় অস্বস্তি হয় জান্নাহ্ এর।মেঘনোলিয়া প্রথম প্রথম জান্নাহ্কে অনেক উৎসাহ দিলেও হঠাৎ করেই কেমন আজব আচরণ শুরু করে।অধ্যায়ের সব চেয়ে কঠিন অংক টায় জান্নাহ্কে করতে দেয়।তাও আবার বোর্ডে।না পারলেই এক ক্লাস শিক্ষার্থীদের সামনে অপমান করে।আজও তার ব্যতিক্রম হলো না।তিনদিন ক্লাসে না আসার শোধ নেয় মেঘনোলিয়া।পুরোটা সময় জান্নাহ্কে দাঁড় করিয়ে রাখে।মেঘনোলিয়ার ক্ষীপ্র দুই চোখের তেজ যেনো জ্বলসে দিবে জান্নাহ্কে।জান্নাহ্ যেনো মেঘনোলিয়ার চোখের বালি।কিন্তু জান্নাহ্ জানে না এর জন্য তার প্রানপ্রিয় স্বামীই দায়ী।
,
,
জান্নাহ্দের স্কুলের সামনে থামে একটা কালো গাড়ি।কিছুক্ষন পর সেখান থেকে বেরিয়ে আসে এক সুদর্শন পুরুষ।কালো রঙের শার্টের উপর গাঢ় নীল রঙের ব্লেজার।চোখে কালো রঙের রোদচশমা।কালো হাতঘড়ি সাথে জুতো।দেখেই বুঝা যাচ্ছে কালো রঙ তার কতটা প্রিয়।

গাড়ি থেকে বের হয়েই দৃঢ় হয়ে দাঁড়ায় রাফাত।তার তেজস্বী অক্ষিযুগল বুলায় পুরো স্কুলে।উৎসুক স্কুলের শিক্ষার্থীরা বিশেষ করে মেয়েরা একবার হলেও তাকাতে ভুললো না রাফাতের দিকে।রাফাত তার অধরে স্মিত হাসি ধরে রাখলো।বুকে হাত ভাঁজ করে গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়ায় রাফাত।রোদচশমার ভেতর দিয়েই মেয়েদের উদ্ভাসিত দুই চোখ এড়ালো না রাফাতের নজর থেকে।মুচকি হাসলো সে।একটু নিচু স্বরে গাঢ় গলায় বললো—

“আমি এসেছি।এইবার তোমাকে ফিরতেই হবে।আর কতো পালাবে তুমি!আমার শরীরের প্রতিটি রক্তকণিকা তোমায় ছোঁয়ার অপেক্ষায়।আমার শ্বাসনালীর প্রতিটি নিঃশ্বাস তোমার জন্য ব্যাকুল।আমার শরীরে প্রতিটি অঙ্গ যে তৃষ্ণার্ত।তোমায় তাদের তৃষ্ণা মেটাতেই হবে জানেমান।তাদের তৃপ্ত না করে আমি তোমায় মরতেও দিবো না।”

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here