জান্নাহ্,পর্ব:১১,১২

0
1729

জান্নাহ্,পর্ব:১১,১২
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
পর্বঃ১১

মস্তিষ্ক ঝিমঝিম করছে সারহানের।কখন থেকে শায়িখকে ট্রাই করে যাচ্ছে কিন্তু তার নাম্বার আউট অফ রেঞ্জ।রাগে মস্তিষ্কের দু’পাশের রগ টনটন করছে।মোবাইলে অক্ষি নিবদ্ধ করে ধুম ধরে বসে আছে সারহান।

ত্রস্ত পায়ে ঘরে ঢোকে জান্নাহ্।স্কুল শেষে দ্রুত বাসায় আসে।ভ্যাবসা গরম পড়তে শুরু করেছে।হুটহাট আঁধার কালো মেঘ ঘনিয়ে যেমন বর্ষণ শুরু হয় তেমন গনগনে সূর্যের আলোয় তপ্ত হয় ধরা।বোরখা খুলেই ফ্যানের নিচে দাঁড়ায় জান্নাহ্।তার সমস্ত শরীর ঘামার্ত।সারহান কোন উল্লেখ যোগ্য প্রতিক্রিয়া করলো না।নির্বিঘ্ন গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে–

“এক্সাম কেমন হলো আপনার?

জান্নাহ্ নিষ্কম্প গলায় হাসি হাসি মুখে বললো–

“ভালো।”

ধীরপায়ে সারহানের পাশে এসে বসে জান্নাহ্।একটা ব্ল্যাক কালারের টি-শার্ট পড়া সারহান।সারহানের দিকে আবেগভরা চোখে তাকিয়ে আছে জান্নাহ্।সারহান যখন বুঝতে পারলো জান্নাহ্ এর অনিমেষ চাহনি সে মাথাটা বাকিয়ে নরম চোখে তাকায় জান্নাহ্ এর দিকে।জান্নাহ্ এর ঠোঁটের নিচের গর্তটায় চোখ আটকায় সারহানের।ঘাড় কাত করে তার গলার কাছ যেতেই জান্নাহ্ মৃদু গলায় বলে উঠে–

“সারহান!

সারহান ফিকে গলায় বললো–

“হু।”

“আমি ঘেমে আছি।”

রহস্য হাসে সারহান।মোহবিষ্ট গলায় বললো–

“আপনার সবকিছুই তো আমার।যান ফ্রেশ হয়ে আসেন।”

জান্নাহ্ উচ্ছ্বাসিত হয়ে ওয়াশরুমে যায়।সারহান তার মোবাইলে ব্যস্ত।শায়িখের সাথে কন্টাক করা বেশ জরুরি।
ওয়াশরুম থেকে ব্লাউজ পেটিকোট পড়ে বের হয় জান্নাহ্।একটা কাচা হলুদ রঙের সুতি কাপড় নিয়ে তা পড়তে থাকে।সারহানের নজর যায় জান্নাহ্ এর পায়ের দিকে।কাপড় পরে সারহানের পাশে এসে বসে জান্নাহ।হাস্যোজ্জ্বল মুখ তার।সারহান উঠে গিয়ে হাঁটুগেড়ে জান্নাহ্ এর সামনে বসে।তার পা নিজের উরুর উপর নিয়ে কাটা জায়গায় আঙুল ছোঁয়াতে থাকে।জান্নাহ্ মৃদু আর্তনাদ করে উঠে।অবিচলিত গলায় সারহান বললো–

“কীভাবে হয়েছে এইসব?

জান্নাহ্ মিনমিনে গলায় বললো–

“ইটের সাথে লেগে গেছে।”

সারহান গম্ভীর গলায় বললো–

“মিথ্যে বলা শিখে গেছেন রজনীগন্ধ্যা!ইটের সাথে লেগে কেটে যাওয়া আর অন্যভাবে কেটে যাওয়ার মাঝে তফাৎ কী আমি বুঝতে পারি না!

জান্নাহ্ অনুযোগের গলায় বললো–

“স্কুল থেকে আসার পথে গাড়ির সাথে ধাক্কা লাগে।”

বেড সাইড টেবিল থেকে তুলো নিয়ে জান্নাহ্ এর পায়ের ক্ষত স্থানের পানি মুছে দেয়।তার দিকে তাকিয়ে নির্মল গলায় বললো–

“আপনাকে না বলেছি রিক্সা করে চলে যেতে।টাকা তো দিয়ে যাই আমি।নাকি আরো লাগবে আপনার?

জান্নাহ্ মাথা নিচু করে নিজের ভুলের স্বীকারোক্তি দেয়।সারহান শক্ত গলায় বললো–

“এমন আর করবেন না।”

কাউচে উঠে বসে সারহান।মোবাইলের মেসেজ টোন বেজে উঠে তা দেখে চোখের পাতা প্রশস্ত করে সারহান।স্বাভাবিক গলায় বললো–

“আপনার নিশ্চয়ই খিদে পেয়েছে।যান খেয়ে আসুন।”

“আপনি খাবেন না?

জান্নাহ্ এর দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকায় সারহান।মাত্র গোসল করায় ভেজা চুল দিয়ে এখনো পানি ঝড়ছে।চোখে মুখে স্নিগ্ধ শুভ্রতা।ফর্সা রঙে কাচা হলুদ রঙ যেনো দ্যুতি খেলে যাচ্ছে।জান্নাহ্ এর চোখ দুটো হাসছে।তার কিশলয়ের মতো গোলাপী অধরপল্লব স্থির হয়ে চেয়ে আছে সারহানের দিকে।সারহান আলতো করে জান্নাহ্ এর ভেজা চুলে আঙুল গলিয়ে দেয়।মাথার এক সাইডে সিঁথি করে দুপাশে চুলের বিভাজন করে দেয়।জান্নাহ্ এর নরম তুলোর মতো গালে হাত রেখে চাপা স্বরে বললো–

“ভাতের খিদে নেই আমার।আপনার খিদে আছে।যান তাড়াতাড়ি খেয়ে আসুন।আমি অপেক্ষা করছি।”

জান্নাহ্ বোকা বোকা চাহনি দিয়ে উঠে চলে যায়।সারহানের মোবাইল বেজে উঠে।তা রিসিভ করেই বারান্দায় চলে আসে।অভব্য ভাষায় কিছুক্ষন গালি দেওয়ার পর শান্ত হয় সারহান।তপ্ত গলায় জিঙ্গেস করে–

“ইহতিশাম এখন কোথায়?

শায়িখ নরম গলায় বললো–

“শুনেছি শহরের বাইরে।কিন্তু তার এসিসটেন্ট কিছুতেই বলছে না সে আসলে আছে টা কোথায়।”

সারহান ব্যস্ত গলায় বললো–

“খোঁজ নাও।আর আমাকে জানাও।”

লাইন কেটে সারহান সেই মেসেজ দেখে আবার।গম্ভীর তার দৃষ্টি।অধৈর্য তার দেহপিঞ্জর।উন্মত্ত তার মস্তিষ্ক।

“তার হৃদয় বড় কঠিন
সে খোঁজে সুখের নীড়,
তার শিরায় আমার বাস
তার চোখেই আমার সর্বনাশ।”

সারহান আরো কয়েকবার পড়ে।এর আগে তিথি আর সামিরার মৃত্যুর আগেও এইরকম ছোট্ট কবিতার চিরকুট এসেছিলো।কাল রাতে আবার এসেছে।তবে এইবার কার পালা?
,
,
,
একটা কালো পাড়ের লাল সিল্কের শাড়ি পরেছে জান্নাহ্।মেকাপে তার জুড়ি নেই।এইসব তার ভীষণ পছন্দ।কিন্তু বিয়ের পর তেমন কোথাও যাওয়া হয় না বলে সাজাও হয় না।আজ সারহান তাকে একটা প্রোগ্রামে নিয়ে যাবে।জান্নাহ্ অবশ্য জিঙ্গেস করেনি কোথায় যাবে তারা।সে আপনমনে নিজেকে সাজাতে ব্যস্ত।ভারি মেকাপে আরো বেশি সুন্দর লাগছে জান্নাহ্কে।
আয়নায় নিজেকে দেখে নিজেই হাসে জান্নাহ্।

সারহান হোয়াইট শার্টের উপর রয়েল ব্লু কালারের ব্লেজার পড়েছে।তার পিচ কালারের ঠোঁট দুটোতে স্মিত হাসি।নিঃশব্দে জান্নাহ্ এর পেছনে এসে দাঁড়ায়।জান্নাহ্ তার সলজ্জ চোখ দুটো অবনত করে লাজুক হাসে।জান্নাহ্কে আলতো হাতে ঘুরিয়ে নিজের দিকে ফেরায় সারহান।কোমর চেপে ধরে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়।জান্নাহ্ থেকে বেশ খানিকটা লম্বা সারহান।তাই তার মাথাটা ঠিক সারহানের হৃদপিন্ড বরাবর গিয়ে ঠেকে।হালকা ঝুঁকে জান্নাহ্ এর গলায় নাক ঘষতে থাকে সারহান।শিরশির করে উঠে জান্নাহ্ এর দেহপিঞ্জর।
দুর্বল গলায় বললো–

“সারহান!আমরা বাইরে যাবো।”

সারহান তার অধরের সেই হৃদয় গলানো হাসি ধরে রেখে জান্নাহ্ এর কানে ফিসফিসিয়ে বললো–

“বাইরে যাবো বলে কী আমার রজনীগন্ধ্যার সুবাস নিতে পারবো না।”

দুর্বোধ্য হাসে জান্নাহ্।জান্নাহ্ গলার সাথে ঘ্রাণেন্দ্রিয় ঠেকিয়ে এক সুদীর্ঘ শ্বাস টেনে নেয় সারহান যাতে করে সে জান্নাহ্ সমস্ত সৌরভ নিজের মধ্যে সংবরণ করে নেয়।সস্মিত অধর জোড়া ছড়িয়ে ফিচেল গলায় সারহান বললো–

“এতো ময়দা কেন মেখেছেন!একটু পর তো এইগুলো সব আমার পেটেই যাবে।”

লজ্জায় সারহানের বুকে মুখ লুকায় জান্নাহ্।লোকটা কিসব বলে!
সারহানের বুকে নাক গুঁজে দিতেই তার শরীরের চন্দন আর গোলাপ মিশ্রিত ঘ্রানের প্রখরতা জান্নাহ্কে ধীরে ধীরে দুর্বল করে দেয়।সারহান দুই হাতের শক্ত বন্ধনে আবদ্ধ করে জান্নাহ্কে।স্বগতোক্তি করে বললো—

“মাই মিল্কি বিউটি।”

,
,
,
স্থানীয় এলাকার নব-নির্বাচিত কাউন্সিলর এর পার্টিতে এসেছে সারহান আর জান্নাহ্।জান্নাহ্ বেশ অবাক হয়।সারহান সারা মাস শহরে থাকে তবুও সে এমনভাবে কাউন্সিলরের সাথে কথা বলছে যেনো তারা অতি পরিচিত।জান্নাহ্কে দাঁড় করিয় প্রায় আধাঘন্টা কথা বললো সারহান।কোনো একটা ব্যাপার নিয়ে মন কষাকষি চলছে।
জান্নাহ্ এর আশেপাশে অনেক বড় বড় লোক।তারা সবাই রাজনীতির সাথে যুক্ত।জান্নাহ্ পোস্টারে তাদের দেখেছে।আজ স্বচক্ষে দেখছে।কিন্তু অস্বস্তিও হচ্ছে তার।সবার চাহনি জান্নাহ্ হজম করতে পারে না।

জান্নাহ্ এর অস্বস্তি আরো বাড়ে মেঘনোলিয়া কে দেখে।ঘামতে শুরু করে সে।উসখুস করছে মন।এসি অন করা।তবুও গলাটা শুকিয়ে আসে জান্নাহ্ এর।মেঘনোলিয়া ক্রোধিত চোখে তাকিয়ে আছে।সারহানের ডাকে সম্বিৎ ফেরে জান্নাহ্ এর।হাতে কোল্ড ড্রিংসের গ্লাস।জান্নাহ্ তা নিয়ে ঢকঢক করে গিলে নেয়।গলাটা খরখরে হয়ে রয়েছিলো যেনো।সারহান বিচলিত গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে–

“কী হয়েছে রজনীগন্ধ্যা!আপনি ঠিক আছেন তো?

জান্নাহ্ ছোট্ট করে ঢোক গিলে।মিইয়ে গলায় বললো–

“আমরা কখন যাবো?

সারহান ফটফট করে হেসে ফেলে।সরস গলায় বললো–

“আসলামই তো মাত্র।এখনই চলে যেতে চাইছেন?
ভয় পাচ্ছেন রজনীগন্ধ্যা?

জান্নাহ্ ভীত চোখে তাকায়।সারহান জান্নাহ্ এর কপালে ছোট্ট চুমু খেয়ে বললো–

“ভয় পাবেন না।আমি থাকতে আপনার কোনো ক্ষতি হবে না।”

সারহানের ক্ষীপ্র দৃষ্টি নিক্ষেপিত হয় মেঘনোলিয়ার দিকে।সে এখনো জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে আছে।
সবাই ব্যস্ত।সারহানের মোবাইলে অনবরত কল করে যাচ্ছে মেঘনোলিয়া।রাগে রি রি করছে সারহানের শরীর।জান্নাহ্ কে এক সাইডে ব্যস্ত করে মেঘনোলিয়াকে টেনে পার্টি হলের পেছন দিকে নিয়ে আসে।উষ্ণ গলায় বললো–

“সমস্যা কী তোমার?বারবার কল কেন করছো?

মেঘনোলিয়া নিজের রাগকে প্রশমিত করে আনম্র হয়ে সারহানকে স্পর্শ করতেই দাপিয়ে উঠে সারহান।হিনহিনে গলায় বললো–

“একদম ছুঁবি না আমায়।”

একটা দম নেয় সারহান।কিছু একটা ভেবে নিশ্চুপ হয়।ডান হাতের তর্জনী দিয়ে ভাঁজ পড়া কপালটা বার কয়েক চুলকে তেড়ে এসে মেঘনোলিয়ার গাল চেপে ধরে ফ্যাসফ্যাসে গলায় বললো–

“তোর সাহস কী করে হয় জান্নাহ্কে অপদস্ত করার!আমার রজনীগন্ধ্যা সে।তার গায়ে একটা আঁচড়ও আমি সহ্য করবো না।”

চোখ ফেটে জল নেমে আসে মেঘনোলিয়ার।ঘোলা চোখে সারহানকেই দেখে যাচ্ছে।প্রথম দিকে শরীরী আকর্ষণ টানলেও এখন সে সারহানকে ভালোবাসতে শুরু করেছে।তাকে পেতে চায় সে।সারহান ফোঁস করে এক দম ফেলে।গলায় নমনীয়তা এনে বললো–

“দেখো মেঘ,জান্নাহ্ আমার স্ত্রী।ভুলেও ওর দিকে হাত বাড়াবে না।তোমার আমার যা সম্পর্ক তা শেষ।ডোবাতে বারবার হাত চুবাই না আমি।”

মেঘনোলিয়া অবাক হয়।সম্পর্কের শুরুতে ঘন্টার পর ঘন্টা একসাথে কাটিয়েছে তারা।তখন মনে ছিলো না!এখন তাকে ডোবা মনে হচ্ছে!
খেঁমটি মেরে মেঘনোলিয়া বললো–

“কী বলতে চাও তুমি!আমি যদি ডোবা হই তাহলে তুমি কী!সেই ডোবার মাঝি।”

সারহান ক্ষীপ্ত গলায় বললো–

“একদম চুপ।”

সারহান মোবাইল বের করে মেঘনোলিয়া আর কাউন্সিলরের একটা ছবি দেখায়।আঁতকে উঠে মেঘনোলিয়া।সারহানের হাত থেকে মোবাইল নেওয়ার চেষ্টা করতে সারহান সরে দাঁড়ায়।বাঁকা হেসে বললো–

“আমি ওই ভ্রমর নই যে মরা গাছে ফুল ফুটাতে যাবো।আমার তাজা ফুলই পছন্দ।জাস্ট লাইক মাই রজনীগন্ধ্যা।তার সৌরভের একমাত্র অধিপতি আমি।
আজকের পর আমার সাথে কন্টাক করার একদম চেষ্টা করবি না।তাহলে তোর সাথে কী হবে তা চিন্তা করার জন্য তুই নিজেই থাকবি না।”

গটগট করে সেখান থেকে সরে আসে সারহান।ফোঁস ফোঁস করতে থাকে মেঘনোলিয়া।স্কুলের একটা কাজে প্রিন্সিপ্যালের সাথে কাউন্সিলরের বাড়ি গিয়েছিলো মেঘনোলিয়া।হাটার সময় পড়ে যেতে গেলে কাউন্সিলর আলহাজ্ব রহমান তাকে সামলায়।আর এই ছবিটাই সারহান তাদের সম্পর্ক শেষ করতে ব্যবহার করলো।মেঘনোলিয়াও তেজে উঠে।স্বগতোক্তি করে বললো–

“যেই মেয়ের জন্য তুমি এইসব করছো এইবার তার কাছেই তোমার আসল চেহারা উন্মুক্ত করবো আমি।আমাকে তো শেষ করেই দিয়েছো।এইবার তোমাকেও আমি রক্তজলে কাঁদাবো।জাস্ট ওয়েট এন্ড ওয়াচ।”

চলবে,,,

#জান্নাহ্
#পর্বঃ১২
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

কমিউনিটি হল জুড়ে ঝলমলে আলো।সবার মুখেই নির্লিপ্ত হাসি।কিন্তু কারো চোখে জ্বলছে তীব্র আগ্নেয়গিরির লাভা।সারহানের পাশেই নিরুত্তাপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে জান্নাহ্।তার ভীত দৃষ্টি মেঘনোলিয়ার দিকে।মেঘনোলিয়া সুযোগ সন্ধানী।জান্নাহ্কে একা পাওয়ার তুমুল আগ্রহ তার।

জান্নাহ্ এর অস্বস্তি বাড়তে থাকে।এসি অন করা রুমেও থমথমে পরিবেশ।জান্নাহ্ এর চিন্তিত মুখ দেখে স্বশব্দে প্রশ্ন ছুঁড়ে সারহান–

“আপনার কী সমস্যা হচ্ছে রজনীগন্ধা?

জান্নাহ্ ঠোঁট চিপে না বোধক সম্মতি দেয়।সারহান এক ভ্রু উঁচু করে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে মেঘনোলিয়ার দিকে তাকায়।নাকের ডগা ফুলিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে।মেঘনোলিয়া এখনো তাকিয়ে আছে।ফোঁস ফোঁস করছে সে।রাগে গলার শিরাগুলো ফুলে ফেঁপে উঠেছে।তার অরুনলোচন আঁখি বলে দিচ্ছে আজ কিছু তো একটা হবে।পাশ দিয়ে যাওয়া সার্ভিস বয়ের সাথে ধাক্কা লেগে খাবারের কিঞ্চিৎ অংশ লেগে যায় মেঘনোলিয়ার গায়ে।ক্ষেপে উঠে মেঘনোলিয়া।কয়েকটা কড়া কথা শুনিয়ে মামলা ঠান্ডা হতেই ওয়াশরুমের দিকে এগিয়ে যায়।সারহান সেদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে জান্নাহ্ এর দিকে তাকায়।জান্নাহ্ এর শান্ত মুখে গভীরতার ছাপ।তাকে স্পর্শ করতেই সারহান টের পায় জান্নাহ্ শরীর ঈষৎ উষ্ণ।তার গলায় আর কপালে হাতের উল্টো পিঠ ছুঁইয়ে বললো–

“শরীর খারাপ লাগছে রজনীগন্ধা ?

জান্নাহ্ অস্ফুট আওয়াজ তুলে বললো-

“উঁহু।”

সারহান ঠোঁট চেপে ধরে এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে।একটা কোল্ড ড্রিংকসের গ্লাস নিয়ে জান্নাহ্ এর হাতে দেয়।আলতো গলায় বললো–

“এইটা খান,আমি আসছি।”

জান্নাহ্ ভীত গলায় বললো–

“কোথায় যাচ্ছেন?

সারহান বিগলিত হাসে।রহস্য গলায় বললো–

“আপনাকে ছেড়ে কোথায় যাবো?

সারহান যেতেই ঠান্ডা ড্রিংসটা গলায় ঢালে জান্নাহ্।খালি পেটে কার্বোনেটেড বেভারেজ পড়তেই মোচড় দিয়ে উঠে জান্নাহ্ এর পেট।যেনো সব বেরিয়ে আসবে।

নিজের হাত বেয়ে গড়িয়ে পড়া রক্তের স্মিত ধারা মুছে সেখানে ফাস্টএইড করে নেয় সারহান।এইসবে তার বিন্দুমাত্র ভাবাবেশ নেই।অভ্যস্ত সে।চিন্তা হয় জান্নাহ্ এর জন্য।রক্ত একদম সহ্য করতে পারে না মেয়েটা।সারহান ফিচেল হাসে।এই মেয়ে নাকি আবার ডক্টর হবে।জান্নাহ্ এর কোনো ইচ্ছেই সারহান অপূর্ণ রাখে না।যথাসাধ্য চেষ্টা করে পূরণ করার।তাই সব জেনেও সাইন্স নিয়ে পড়ার বিরুদ্ধে টু শব্দ করে নি সারহান।নির্দিষ্ট জায়গায় এসে জান্নাহ্কে পেলো না সারহান।এদিক ওদিক চড়ুই পাখির মতো খুঁজতে থাকে।

আচমকাই মানুষের কোলাহলে দৌঁড়ে ওয়াশরুমে আসে সারহান।জান্নাহ্ ফ্লোরে পড়ে আছে।ঘিরে রেখেছে তাকে মানুষ।সারহান জান্নাহ্ এর কাছে যেতেই দেখে তার সমস্ত শরীর লালচে হয়ে চাকা চাকা হয়ে আছে।জান্নাহ্ এর পালস রেট টগবগিয়ে চলছে।অধৈর্য গলায় ডেকে উঠে সারহান—

“রজনীগন্ধা,রজনীগন্ধা।কী হয়েছে আপনার?এইসব হলো কী করে?

জান্নাহ্ নিশ্চল,নিস্তব্দ।সারহান পাঁজাকোলে করে জান্নাহ্কে তুলতে গেলেই চোখ পড়ে ওয়াশরুমের দরজায়।রক্তের ক্ষীনধারা বেরিয়ে আসছে।চোখের পাতা প্রশস্ত করে সারহান।কিন্তু এখন অন্য কিছু ভাবতে চাইলো না।
জান্নাহ্কে নিয়ে সেখানকার রেস্টরুমে শুইয়ে দেয় সারহান।জান্নাহ্ এর সারা দেহে লাল হয়ে চাকা চাকা হয়ে আছে।পুরো শরীরে আঁচড়ের দাগ।তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে সারহান।নিশ্চয়ই হিং যুক্ত কিছু খেয়েছে।জান্নাহ্ এর চিংড়ি মাছে অ্যালার্জি।ভয়াবহ অ্যালার্জি।জান্নাহ্ এর জন্য সারহান নিজেও চিংড়ি মাছ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে।আর এই মেয়ে!

বাইরে বেশ হৈ হুল্লোড় চলছে।পুলিশ এসেছে।ওয়াশরুমের ভেতর একটা লাশ পাওয়া গেছে।কিন্তু সারহান নড়লো না।জান্নাহ্কে আধশোয়া করে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে বসে আছে।প্রায় ঘন্টাখানেক পরে নড়ে উঠে জান্নাহ্।সারা শরীরের অসহনীয় ব্যথা।কুঁকড়ে উঠে জান্নাহ্।সারহান আলতো হাতে তাকে বিছানার হেডবোর্ডের সাথে হেলান দিয়ে বসায়।চোখ দুটো লাল হয়ে ফুলে উঠেছে।শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে জান্নাহ্ এর।মাথায় প্রচন্ড যন্ত্রণা হচ্ছে।যেনো কেউ ড্রিল মেশিন চালিয়ে দিয়েছে তার মগজে।চুলকানিতে অসহ্য লাগছে জান্নাহ্ এর কাছে।কেঁদে ফেলে জান্নাহ্।ঝপাৎ করে সারহানকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে উঠে।ব্যতিব্যস্ত সারহান জান্নাহ্ এর পিঠে হাত বুলিয়ে শান্ত ও স্বাভাবিক গলায় বললো–

“রিল্যাক্স,কী খেয়েছেন আপনি?

জান্নাহ্ মাথা ঘষতে থাকে সারহানের বুকে।যতই কান্না গিলে নেওয়ার চেষ্টা করছে ততই উপচে আসছে।মরে যেতে ইচ্ছে করছে জান্নাহ্ এর।অবর্ণনীয় যন্ত্রণা সে সহ্য করতে পারছে না।জান্নাহ্ এর মাথাটা ঠিক সারহানের গলার নিচটায় আবদ্ধ।ঘনঘন দম ফেলছে জান্নাহ্।রেস্টরুমের দরজা খুলে কেউ একজন ভেতরে আসে।সাথে পুলিশ।হালকা মাথা উঁচিয়ে তাদের দেখেই সারহানকে খাঁমচি মেরে ধরে জান্নাহ্।সারহানের বলিষ্ঠ শরীরের মাংসও দলিয়ে যায় জান্নাহ্ এর খাঁমচিতে।সারহান নির্বিকার গলায় বললো–

“ডোন্ট ওয়ারি,আমি থাকতে আপনার একটা লোমকূপও কেউ স্পর্শ করতে পারবে না।”

ইন্সপেকটর হতভম্বের মতো তাকিয়ে থাকে।নরম গলায় বললো–

“কে হয় সে আপনার?

সারহান ঠান্ডা কিন্তু দাম্ভিক গলায় বললো–

“ওয়াইফ।”

ইন্সপেকটর হেয়ালি গলায় বললো–

“ও আচ্ছা।তাকে কিছু প্রশ্ন করা দরকার।লাশটা সবার আগে তিনিই তো দেখছেন।”

চমকে উঠে জান্নাহ্।অবিশ্বাস্য গলায় বললো–

“লাশ!কিসের লাশ?কার লাশ?কী হয়েছে সারহান?

সারহান মৃদু গলায় জান্নাহ্কে আশ্বস্ত করে বললো–

“ক্লাম ডাউন।কিচ্ছু হয় নি।”

ইন্সপেকটর বিরক্ত হয়।একজন মানুষ খুন হয়েছে আর উনি বলছেন কিছু হয়নি!আজিব!
সারহান সোজা করে বসায় জান্নাহ্কে।জান্নাহ্ এর শরীর ভীষণ ক্লান্ত।চোখে মুখে রাজ্যের অবসাদ।তবুও কোমল গলায় প্রশ্ন করে সারহান–

“কী হয়েছিলো আপনার?আর কী খেয়েছেন আপনি?

জান্নাহ্ বেশ কিছুক্ষন আবেগশূন্য হয়ে তাকিয়ে থাকে।নিজেকে ভাসমান মনে হচ্ছে তার।সারহানের গায়ের সাথে লেপ্টে কাতর গলায় বললো–

“আআমি নুডুলস খেয়েছিলাম।তারররপর অ্যালার্জি অ্যাটাক হয়।তাতে চিংড়ি মাছ ছিলো আমি খেয়াআল করিইইনি।বমিটিং হচ্ছিলো।তাই ওয়াশরুমে যাই।যখন বেএএএর হবোওও তততখখন…।”

ঝমঝমিয়ে কাঁদতে থাকে জান্নাহ্।তার পুরো শরীর থরথর করে কাঁপছে।জান্নাহ্ এর মাথাটা সজোরে বুকের সাথে চেপে ধরে সারহান।জান্নাহ্ এর দেহপিঞ্জর উতপ্ত।ইন্সপেকটর দাঁত মুখ খিঁচে দারাজ গলায় বলে উঠে–

“এইসব কী ধরনের নাটক!একটা খুন হয়েছে আর আপনারা…।”

দাঁতে দাঁত চেপে খলবলিয়ে উঠে সারহান।দাঁড়িয়েই ইন্সপেকটরের কলার চেপে ধরে গমগমে গলায় বললো–

“এএ একদম চুপ।কানে শুনতে পাসনি কী বলছে সে।জানেনা সে কিছু।বের হ এখান থেকে।”

হতচকিত ইন্সপেকটর ভড়কে উঠে হিনহিনে গলায় বললো–

“দেখুন মি.ভালো হবে না বলে দিচ্ছি।ছাড়ুন,ছাড়ুন বলছি।”

জান্নাহ্ ভয়াতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।জান্নাহ্ এর হিমোফোবিয়া।রক্তের প্রতি এংজাইটি।এর কারণে সামান্য পরিমাণ রক্ত দেখলেও আক্রান্ত রোগীর পালস রেট বেড়ে যায়।শ্বাসকষ্ট শুরু হয়।অনেক সময় রক্তচাপ বেড়ে রোগী অজ্ঞান হয়ে যায়।জান্নাহ্ এর সাথেও তাই হয়।সে যখন ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসছিলো তার পাশেরটাতে তাকাতেই রক্তের ধারা দেখে সেখানেই সেন্সলেচ হয়ে যায়।আর অ্যালার্জি অ্যাটাক।দুই মিলেই পুরোই কাবু করে ফেলে জান্নাহ্ কে।ইন্সপেকটর রাগে গজরাতে গজরাতে বাইরে আসে।একটা স্ট্রেচারে রাখা হয়েছে মেঘনোলিয়ার লাশ।সারহান আরো বেশ কিছুক্ষন পরে বের হয়।মেঘনোলিয়ার লাশের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।সে চাহনিতে মায়া ছিলো না।ছিলো আক্ষেপ।মেয়েটার চোখ দুটো মায়াবী ছিলো।ফোঁস করে এক শ্বাস ছাড়ে সারহান।ইন্সপেকটর কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সারহানের দিকে।কেন যেন সারহানকে সন্দেহ হচ্ছে তার।চকিতে তার দৃষ্টি পড়ে সারহানের হাতের দিকে।সেখানে ব্যান্ডেজ করা।ইন্সপেকটর মেঘনোলিয়ার দিকে তাকায়।মেয়েটা চিৎকার দেওয়ারও সুযোগ পায়নি।উদ্ভাসিত অক্ষিযুগল।গলার ঠিক মাঝ বরাবর একটা সুদীর্ঘ গর্ত।ইন্সপেকটর অবাক হয়।এভাবেও আজকাল খুন হয়!

ইন্সপেকটর সারহানের সামনে গিয়ে তার হাতের কথা জিঙ্গেস করতেই সারহান কমিশনারের দিকে ক্ষেপা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে।কমিশনারের পিএ ইন্সপেকটরকে সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে আসে।সারহান ধীরগতিতে মেঘনোলিয়ার লাশের সামনে বসে।মেয়েটার চোখ দুটো এখনো জীবন্ত মনে হচ্ছে।কী দরকার ছিলো এইসব করার!ভালোই তো ছিলো সব।সারহান স্বগতোক্তি করে বললো–

“তোমার উপর আমার কোনো রাগ নেই।তবে জান্নাহ্ এর সাথে খারাপ আচরণ করে তুমি ঠিক করো নি।এর জন্য আমি তোমাকে ক্ষমা করবো না।”

মেঘনোলিয়ার গলার ক্ষতটা দেখে সারহান।একটা তীক্ষ্ম চাকু ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে।আর কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই।রহস্য হাসে সারহান।পাক্কা ক্রিমিনাল।

সারহানের কথামতো সিসিটিভি ফুটেজ দেখা হয়।সেখানে দেখা যাচ্ছে জান্নাহ্ ওয়াশরুমে ঢোকার পর কেউ একজন বের হয়েছে।কালো রঙের হুডি পরা হলেও সে যে পুরুষ তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।সারহান জান্নাহ্কে জিঙ্গেস করে সে কাউকে দেখেছিলো কিনা!জান্নাহ্ বলেছে সে যখন ভেতরে যায় তখন একটা ওয়াশরুমে দরজা বন্ধই ছিলো।যখন বের হয় ওয়াশরুম থেকে তখন সে দেখে ওয়াশরুমের দরজা ভেজানো।আর তার নিচে রক্তের স্রোত।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here