জান্নাহ্,পর্বঃ৫৫,৫৬

0
1512

জান্নাহ্,পর্বঃ৫৫,৫৬
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
পর্বঃ৫৫

আয়নায় দাঁড়িয়ে নিজেকে সাজাতে ব্যস্ত মৃণালিনী।ঘড়িতে সন্ধ্যা সাত।হলুদ রঙের টপস এর সাথে ব্রাশ জিন্স।টপসের এক হাতা হেলানো নিচের দিকে যেখানে তার ভেতরকার জামার স্ট্রিপ বেরিয়ে আছে।কাঁধ পর্যন্ত থাকা চুলগুলোকে এক সাইডে সিঁথি করে ফেলে রেখেছে।ঠোঁটে গাঢ় খয়েরি লিপস্টিক।কানের মধ্যে ঝুলছে আজকালকার ফ্যাশনেবল রিং।দরজায় দাঁড়িয়ে নিজের মাকে পর্যবেক্ষণ করছে জান্নাহ্।মৃণালিনী মেয়েকে দেখে উচ্ছ্বাসিত হাসলেন।মেয়ের কাছে গিয়ে হাত দুটো ধরে বললেন—

“মাম্মাকে কেমন লাগছে ডল?

জান্নাহ্ গম্ভীর মুখে বললো—

“ভালো।কোথায় যাচ্ছো তুমি?

মৃণালিনী হাসি হাসি মুখে বললেন—

“আজ আমার এক বন্ধুর জন্মদিন।ওটা সেলিব্রেট করতে যাচ্ছি।এবং তুমিও যাচ্ছো আমার সাথে।”

জান্নাহ্ চট করেই বললো–

“নো মাম্মা।আমি তোমার সাথে যাবো না।তুমি জানো এইসব আমার পছন্দ না।”

মৃণালিনী আদর মাখা গলায় বললেন—

“আমার বন্ধু তোমাকে দেখতে চেয়েছে ডল।আমি তাকে কথা দিয়েছি।তোমার নিশ্চয়ই যাওয়া উচিত।”

জান্নাহ্ আপত্তি করে বললো—

“নাহ।আমি যাবো না।”

মৃণালিনী আনম্র গলায় বললেন—

“ডু ইউ লাভ মি?

জান্নাহ্ এর কেনো যেনো কান্না পেলো।মায়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে বললো—

“আই লাভ ইউ মাম্মা।আই লাভ ইউ সো মাচ।”

“আই লাভ ইউ টু ডল।যাও তৈরি হয়ে এসো।”

অগত্যা জান্নাহ্কে যেতে হবে।
সারহানের পেইন্টিং এর সামনে উদাস হয়ে দাঁড়িয়ে আছে জান্নাহ্।একটা স্লিভলেস গাউন পরেছে জান্নাহ্।তার উপর গোল্ডেন কালারের কটি।চোখে গাঢ় কাজল আর ঠোঁটে নুড কালারের লিপস্টিক।বাম হাত ভর্তি চুড়ি।চুড়ি জান্নাহ্ এর ভীষণ প্রিয়।সারহানের দিকে কাতর নয়নে তাকিয়ে আছে।মৃণালিনীর পায়ের শব্দে আড়াল করে সারহানকে।
,
,
,
ধীম ধীম আওয়াজে গান চলছে।ক্লাবের সবাই ব্যস্ত।ক্ষীণ আলো জ্বলছে।তাতে অবশ্য মুখ দেখা যায়।জান্নাহ্ এর গা ঘিনঘিন করে।কেমন উটকো গন্ধ!
তার দিকেই আস্ত নজরে তাকিয়ে আছে পাশে বসা রৌশান।জান্নাহ্ সেদিকে কোনো ধরনের প্রতিক্রিয়া না করে নিজের কোল্ড ড্রিংসের স্ট্রতে সিপ লাগায়।রৌশান মুগ্ধ গলায় বললেন–

“মানতে হয়।তোমার মেয়ে কিন্তু তোমার মতো সুন্দরী।”

মৃণালিনী দাম্ভিকতার সাথে বললেন—

“ভুল বললে।আমার ডল আমার চেয়েও সুন্দরী।শী ইজ লাইক আ এঞ্জেল।”

মৃণালিনী নিজের মেয়ের হাতে চুমু খেলেন।রৌশান ফিচেল হেসে বললো—

“তা অবশ্য তুমি ভুল বলোনি।”

জান্নাহ্ আড়চোখে রৌশানের দিকে তাকায়।লোকটাকে পছন্দ হচ্ছে না জান্নাহ্ এর।সেই কখন থেকে ফ্যাকাশে দৃষ্টিতে তাকে উপর থেকে নিচে দেখছে।মৃণালিনী তার এক বন্ধুকে দেখে বললেন—

“ডল,তুমি বসো আমি আসছি।”

“ওকে মাম্মা।”

মৃণালিনী উঠে যেতেই রৌশানের চোখে দ্যুতি খেলে গেলো।অদ্ভুত দৃষ্টিতে জান্নাহ্ এর গলার দিকটায় তাকিয়ে রইলো।জান্নাহ্ তার খোলা চুলগুলো ঘাড়ের দুই পাশে ছড়িয়ে দেয়।শক্ত গলায় বলে উঠে জান্নাহ্—

“আপনিই মাম্মার সেই কলেজ টাইমের বয়ফ্রেন্ড?

রৌশান স্মিত হেসে সম্মতি দিলো।জান্নাহ্ কড়া গলায় শাসিয়ে উঠে—

“কেন ছেড়ে দিচ্ছেন না আমার মাম্মার পিছু?আপনি তো বিয়ে করেছেন।তবুও কেন আমার মাম্মাকে নিজের প্রতি অ্যাট্রাক্ট করছেন?

রৌশান মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।এই টুকু বাচ্চা মেয়ে কী সুন্দর কথা বলে!জান্নাহ্ এর ঠোঁটের নড়াচড়া দেখছে রৌশান।সাবলীল গলায় রৌশান বললো–

“তুমি হয়তো জানো না ডল,আমার ডিবোর্স হয়ে গেছে।”

জান্নাহ্ ক্রোধান্বিত গলায় বলে উঠে—

“একদম আমাকে ডল ডাকবেন না।এই নামে শুধু আমার মাম্মা আর বাবা ডাকবে।”

রৌশান চতুর হেসে জান্নাহ্ এর হাত স্পর্শ করে বললো—

“ওকে,ওকে।জাস্ট ইজি জান্নাহ্।তোমার মা ঠিকই বলেছে।তুমি তার চেয়েও সুন্দরী।জাস্ট আ ফায়ার বিউটি।এই বয়সে এতো সুন্দর তুমি ভাবতো আঠারো ক্রস করলে তুমি তো দুনিয়া কাঁপাবে।তুমি ইচ্ছে করলেই মডেলিং করতে পারো।আমি হেল্প করবো তোমায়।”

জান্নাহ্ ঝাঁড়া মেরে উঠে দাঁড়ায়।গর্জে উঠে বললো—

“ডোন্ট টাচ মি।ইউ রাবিশ!

রৌশান ক্ষীপ্র গলায় বললেন—

“জান্নাহ্!

“চুপ করুন।”

মেয়ের গলার উঁচু আওয়াজে মৃণালিনী দপদপিয়ে আসেন।মায়ের বুকে মাথা গুঁজে দেয় জান্নাহ্।কেঁদে কেঁদে বললো—

“দেখনা মাম্মা,হি টাচ মি ইন ব্যাড ওয়ে।”

মৃণালিনী খলবলিয়ে বললেন—

“হোয়াট?

রৌশান নিজের ডিফেন্সে বললেন—

“মৃণালিনী তোমার মেয়ে মিথ্যে বলছে।আমি তো…।”

তার আগেই এক চড় বসিয়ে দেয় মৃণালিনী রৌশানের গালে।ক্লাবের সবাই নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে আছে।ক্ষীপ্ত কন্ঠে ঝাঁজিয়ে উঠে মৃণালিনী—-

“তোমার সাহস কী করে হলো আমার মেয়েকে ছোঁয়ার!ইউ ফ** ফেলো।”

রৌশান উত্তেজিত হয়ে বললেন—

” ইউ স্লাট,ভাবিস কী নিজেকে তুই!

মৃণালিনী সজোরে আরেক চড় বসিয়ে দেয় রৌশানের গালে।দু দুটো চড় খেয়ে হতভম্ব হয়ে যায় রৌশান।মৃণালিনী অ্যাডিক্টেড হলেও নিজের সম্ভ্রমে কখনো আঘাত হানতে দেয়নি।সেখানে নিজের ফুলের মতো মেয়ের জন্য এক চুলও ছাড় নয়।রৌশান তেড়ে গিয়ে মৃণালিনীকে পাল্টা আঘাত করতে চাইলে কেউ তার হাত ধরে ফেলে।রসালো গলায় বলে উঠে—

“আরে মামা।রিল্যাক্স।নারীর গায়ে হাত দেওয়া কাপুরুষের কাজ।”

রৌশাণ গমগমে গলায় বললেন—

“হোয়াট রাবিশ!তুই কে?

“তোর বাপ।”

রৌশানের হাতটা পেছনে মুড়ে ধরে ছেলেটি।মৃণালিনীকে উদ্দেশ্য করে বললো—

“আপনি যেতে পারেন ম্যাম।একে আমি দেখছি।”

মৃণালিনী কৃতজ্ঞতার সুরে বললো—

“থ্যাংকস আ লট।”

জান্নাহ্ নিজের মায়ের বুকে মুখ গুঁজে নাক টেনে যাচ্ছে।কিন্তু ছেলেটার কন্ঠস্বর তার পরিচিত মনে হলো।হালকা মাথা বাঁকিয়ে দেখলো সে।ছেলেটার পেছন দিকটা দেখে সে বুঝতে পার এ তারই প্রাণ।সারহান আরো কয়েকধাপ কথা বললো।গলার আওয়াজ আর এক সাইড থেকে দেখে জান্নাহ্ নিশ্চিত হলো এটা সারহানই।নিজেকে লুকায় জান্নাহ্।সে চায় না তার প্রাণ তাকে এইভাবে দেখুক।সারহান থমথমে গলায় মৃণালিনীকে ডেকে বলে–

“আমি পেছন থেকে আপনার মেয়ের কথাগুলো শুনেছি।সে ভুল কিছু বলেনি।আপনার মেয়েকে দেখে মনে হচ্ছে সে এখনো এইসব জায়গার জন্য উপযুক্ত নয়।নেক্সট টাইম তাকে এখানে আনার আগে দু’বার ভাববেন।আর পারলে নিজেও এভয়েট করবেন এইসব জায়গা।এগুলো সবার জন্য নয়।রঙিন পালক লাগালেই তো আর কাক ময়ূর হয়ে যায় না।তাই ময়ূর রূপী কাক চিনতে আমাদের ভুল হয়।যান।”

মৃণালিনী অপ্রস্তুত হলেন সারহানের কথায়।কিন্তু তার গভীরতাও বুঝতে পারলেন।

সারহান কপট হেসে ফিচেল গলায় বললো—

“শালা পার্ভাট, আজ তিনদিন ধরে তোকে টার্গেট করে রেখেছি।আর তুই আছিস নতুন পাখি ধরার ধান্দায়।”

ভ্যাবাচাকা খেয়ে রৌশান বললেন—

“কে তুই?কী চাস?

সারহান জোরালো গলায় ডেকে উঠে—

“শায়িখ,শায়িখ।”

শায়িখ হাঁপাতে হাঁপাতে এসে দম স্থির করে বললো—

“জ্বী স্যার।”

সারহান খটমটিয়ে বললো—

“কোথায় ছিলে তুমি?

শায়িখ মিনমিনে গলায় প্রত্যুক্তি করে—

“ওয়াশরুমে স্যার।”

সারহান নাক ফুলিয়ে বিতৃষ্ণা গলায় বললো—

” আমি বুঝিনা জরুরি কাজের সময় তোমার সবসময় ওয়াশরুমে কেন যেতে হয়।”

শায়িখ অনুযোগের সুরে বললো–

“সরি স্যার।”

“ওই ছেলে দুটো কোথায়?

“এখনই নিয়ে আসছি স্যার।”

একটু পরই দুটো উঠতি বয়সের ছেলেকে নিয়ে ফিরে শায়িখ।ছেলে দুটো ভয় তটস্থ হয়ে থরথর করে কাঁপছে।সারহান তেজি গলায় বললো—

“এই দুটোকে চিনিস?

রৌশান দম্ভ করে বললো —

“নাহ।”

সারহান রৌশানের ব্লেজারে কলার টেনে এক ঘা বসায় তার গালে।তপ্ত গলায় বললো–

“আরেকবার মিথ্যে বললে এখানেই পুঁতে দিবো।”

রৌশান ক্ষীপ্ত চোখে তাকিয়ে আছে।সারহান স্বশব্দে বললো—

“মেয়েদেরকে মডেলিং এর কথা বলে বাইরে পাচার করিস আর যুবক ছেলেদের ড্রাগসের নেশা ধরিয়ে ওদের দিয়েই ড্রাগস সাপ্লাই করাস।”

রৌশান প্রতিবাদ করে বললেন—

” এইসব মিথ্যে।”

“প্রীতির অ্যাকসিডেন্ট এদের দিয়ে করিয়েছিলি তাই না!

ভীত চোখে তাকিয়ে ঢোক গিলতে থাকে রৌশান।সারহান ছেলেদুটোর দিকে কড়া চোখে তাকাতেই ছেলে দুটো হন্তদন্ত হয়ে বললো—

“জ্বী স্যার।রৌশান স্যার ই বলেছিলো প্রীতির অ্যাকসিডেন্ট করাতে।প্রীতির কাছে একটা ভিডিও আছে।”

“ইয়া।ওটা এখন আমার কাছে।আর প্রীতিও বেঁচে আছে।
শায়িখ,পুলিশ আসতে আর কতক্ষন?

হকচকিয়ে যায় রৌশান।শায়িখ মৃদু গলায় বললো—

“পুলিশ কমিশনার কে কল করেছি।”

সারহান বিরক্তি নিয়ে বললো—

“ওই নাদাপেটাকে কল করেছো কেন?বউ ছেড়ে আসতেই তো সকাল হয়ে যাবে।”

শায়িখ ঠোঁট চিপে হেসে বললো—

“কমিশনার তার মেয়ের হবু জামাইকে পাঠাচ্ছে।”

সারহান রসালো গলায় বললো—

“ওর জামাই তো কচ্ছপ।”

শায়িখ বিজ্ঞ আচরণ করে বললো—

“স্যার,ছোটোবেলার গল্পটা মনে আছে না।স্লো এন্ড স্টেডি উইন দ্যা রেস।”

সারহান শায়িখের কাঁধে চাপড় মেরে বললো–

“সাবাস!

জান্নাহ্ রা যেই টেবিলটায় ছিলো সেটার উপরে উঠে বসে সারহান।ছেলেদুটো কে বললো রৌশানকে পুলিশ আসার আগ পর্যন্ত ধরে রাখতে।তাহলে ওদেরকে সে ছেড়ে দিবে।ছেলে দুটো তাই করলো।চেপে ধরে রাখলো রৌশানকে।রৌশান টাকা অফার করে সারহানকে।সারহান মশকারি করে বললো—

“টাকার বালিশে ঘুমালে স্লিপিং পিল লাগে আমার।আগে ওটা পেয়ে নেই তারপর।”

মুচকি হাসে শায়িখ।তার স্যার বিয়ের কথা বলছে।দমদমে গলায় ক্লাবের ম্যানেজারকে ডাকে সারহান।

“ম্যানেজার!

ম্যানেজার কাঁচুমাচু হয়ে তার সামনে এসে দাঁড়ায়।তীর্যক গলায় বললো—

“আজকের পর যদি আন্ডার এইটিন কোনো ছেলে বা মেয়েকে ক্লাবে ঢুকতে দিয়েছিস তো তো তু গ্যায়া।”

“সরি স্যার,আর ভুল হবে না।”

“শায়িখ আমার জন্য ঠান্ডা কোল্ড ড্রিংস নিয়ে এসো।এদের সামলাতে গিয়ে আমার গলা শেষ।”

ভৃত্যের মতো শায়িখ বললো—

“জ্বী স্যার।এখনই আনছি।”

“দুই মিনিটে পুরো ক্লাব খালি চাই আমি।”

এতোক্ষন দর্শকের মতো মজা লুটে নেওয়া মাতালরা আস্তে আস্তে ক্লাব থেকে বেরিয়ে যেতে লাগলো।সারহান দুই হাতে টেবিলের উপর ভর দেয়।সে অনুভব করে তার হাতে কিছু একটা লেগেছে।সারহান হাত উঠিয়ে তালুতে দেখে একটা লেন্স লেগে আছে।বিক্ষিপ্ত হাসে সারহান।স্বগতোক্তি করে বললো–

“মনে হয় ওই বাচ্চা মেয়েটার লেন্স!এতো কম বয়সে কেউ লেন্স ইউজ করে!স্ট্রেঞ্জ!

চলবে,,,

#জান্নাহ্
#পর্বঃ৫৬
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

বাবার পায়ে মুখ গুঁজে সমানতালে কেঁদে চলছে জান্নাহ্।জাফিন মেয়েকে আনম্র গলায় বললেন—

“ডল,প্লিজ ডোন্ট ক্রাই।”

ঝাড়ি মেরে উঠে জান্নাহ্–

“কাঁদবো, একশবার কাঁদবো আমি।”

জাফিন বিগলিত হাসলেন।বাবার পায়ের উপর থেকে মাথা উঠিয়ে জান্নাহ্ আবার ক্রন্দনরত গলায় বললো—

“কেন নিয়ে গেলো আমায়?ওই নোংরা লোকটা আমাকে ওভাবে ছুঁয়েছে।শুধুমাত্র মাম্মার জন্য।”

জাফিন মেয়ের দুই চোখ মুছে বিনয়ী গলায় বললেন–

“আই এম সরি।আমার তোমাকে যেতে দেওয়া উচিত হয়নি।”

জান্নাহ ঠোঁট ভেঙে বললো—

“আজ শুধু মাম্মার জন্যই ওই নোংরা লোক আমাকে স্পর্শ করলো।আই হেট মাম্মা।”

“এভাবে বলেনা ডল।”

“কেন?

জাফিন হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন—

“মাম্মা তোমাকে প্রটেক্ট করেছে ।সে জানতো না তার বন্ধু এমন।”

ভাঙা ভাঙা গলায় জান্নাহ্ বললো—

“মাম্মা তোমাকে ভালোবাসে না।ওই নোংরা লোকটাকে কী করে পছন্দ করে?

ফিক করে হাসলেন জাফিন।জান্নাহ্ ভ্রু নাচিয়ে বললো—-

“হাসছো কেন তুমি?

জাফিন শীতল গলায় বললেন—

“তোমার মাম্মা যতটা তোমায় ভালোবাসেন তার চেয়ে একটু কম আমাকে ভালোবাসেন।”

জান্নাহ্ এপাশ ওপাশ করে ঠোঁট।ভ্রু দুটো কুঞ্চি করে চোখের কোণ ক্ষীণ করে বললো–

“আজ যদি সারহান আমাকে দেখে ফেলতো!তাহলে কী ভাবতো বলোতো।ভাবতো আমি খারাপ মেয়ে।”

জাফিন আওয়াজ করে হেসে উঠলেন।সরস গলায় বললেন–

“তাহলে আমার ডলের এই জন্য রাগ হচ্ছে!

ঝট করে উঠে দাঁড়ায় জান্নাহ্।সংকীর্ণ গলায় বললো—

“আরেকটু হলেই সারহান আমাকে দেখে ফেলতো।এই সবকিছুর জন্য মাম্মা দায়ী।জোর করে আমাকে নিয়ে গিয়েছিলো।”

জাফিন চোখের পাতা প্রশ্বস্ত করে তাকালেন।জিঙ্গাসু গলায় বললেন—

“ডল,তোমার চোখের আরেকটা লেন্স কোথায়?

জান্নাহ্ গালের উপর থেকে নোনতা জল মুছে ফিকে গলায় বললো—

“কোথায় যেনো পড়ে গেছে।”

জাফিন মনমরা হয়ে বললেন–

“তোমাকে কতোবার বললাম,লেন্স ইউজ করতে না।তবুও।”

জান্নাহ্ আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।চোখ থেকে বাকি লেন্সটা খুলে সন্তর্পনে রাখে।নম্র গলায় বললো—

“তুমি জানো আই লাভ ঐশ্বরিয়া রায় বচ্চন।তাকে নীলনয়না বলা হয়।তার চোখ আমার পছন্দ।আই উইশ আমার চোখও তার মতো হতো!

“তাই বলে তুমি সবসময় লেন্স ইউজ করতে পারো না!

“আমি তো বাইরে গেলে ইউজ করি।”

জান্নাহ্ নিজের বাবার কাছে গেলো।তার হাত ধরে গদগদ হয়ে বললো–

“আচ্ছা বাবা,আমাকে কোন চোখের মনিতে ভালো লাগে?
নীল না কালো।”

জাফিন দম্ভ করে বললেন—

“উপরওয়ালা আমার মেয়েকে কোনোদিক দিয়ে কম দেয়নি।তার আর্টিফিসিয়াল কোনো কিছুর প্রয়োজন নেই।”

থমথমে হাসে জান্নাহ্।সে ঠিক করে তার প্রাণের সামনে সে এইভাবেই যাবে।সে কী তাকে চিনতে পারবে?কারণ সারহান যখন জান্নাহ্কে একপলক দেখেছিলো তখন জান্নাহ্ এর চোখের মনি নীল ছিলো।

জান্নাহ্ সারহানের সামনে গিয়ে তাকায়।গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বিড়বিড় করে করে অনুযোগের সুরে জান্নাহ্ বললো–

“প্লিজ প্রাণ, আমি খারাপ মেয়ে নই।আমি আর কখনো সেখানে যাবো না।”

জাফিন প্রগাঢ় দৃষ্টিতে মেয়েকে দেখে।তার শান্ত হৃদয়ে হঠাৎ এলোমেলো ভাবনা উঁকি দিচ্ছে।জাফিনের সমান্তরাল কপাল ধীরে ধীরে কুঞ্চি হতে লাগলো।চোখের দৃষ্টি হতে লাগলো প্রশ্বস্ত।মেয়ের হাবভাব নিয়ে সে ততটা চিন্তিত না থাকলেও এখন তাকে তা ভাবাচ্ছে।জান্নাহ্কে যেকোনো পরিস্থিতিতে মানিয়ে নেওয়ার মতো শিক্ষা জাফিন দিয়েছে।কিন্তু তাতে এখন সংকোচ হচ্ছে।ধীরে ধীরে সারহানের প্রতি জান্নাহ্ এর দুর্বলতা বেড়ে চলছে।ছোটবেলা থেকেই নিজের বাবাকে আইডল মানে জান্নাহ্।তাই সারহানের প্রতি তার অ্যাটার্ক্ট হওয়া স্বাভাবিক।কিন্তু জাফিন ভাবছে অন্যকিছু।দুই দুইবার দেখা হওয়া আর সারহানের প্রতি জান্নাহ্ এর ঝুঁকে যাওয়া এটা কী নিছক কো ইন্সিডেন্ট নাকি ভবিতব্য!তার শান্ত,স্থির মেয়ের এমন চঞ্চলতা সত্যিই আশ্চর্যজনক।
সে যাই হোক।নিজের মেয়েকে জাফিন যাকে তাকে দিতে পারে না।পারে না নিজের মেয়ের মনে জন্ম নেওয়া প্রথম অনুভূতিকে দমিয়ে ফেলতে।জাফিন একবার ভুল করেছে।দ্বিতীয়বার তা করতে পারে না।সে তার মেয়েকে তার মতো সাফার হতে দিতে পারে না।তাই সে মন স্থির করলো।সারহান সম্পর্কে সে খোঁজ নেবে।তার মেয়ে হীরে।হীরে কে নিশ্চয়ই জহুরির হাতে তুলে দিবে সে।
,
,
,
ল্যাপটপের সাটার অফ করে মাত্রই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো জান্নাহ্।একটা কোমল গলা শুনতে পায় জান্নাহ।

“পরীজান!

জান্নাহ্ চকিতে দরজার দিকে তাকায়।প্রাণখোলা হাসিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে শরীফ।স্মিতহাস্য অধরে জান্নাহ্ বললো—

“এসো মামা।”

শরীফ এসে ভাগ্নীর পাশে বসলেন।মোলায়েম গলায় বললেন–

“আপনি কী ব্যস্ত?

জান্নাহ্ সাবলীল ভাষায় প্রত্যুত্তর করে—

“নাহ মামা।রাফাতের সাথে কথা বলছিলাম।সারাদিন অ্যাসাইমেন্ট নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম তাই ওর সাথে কথা বলতে পারি নি।তোমাকেও সময় দিতে পারি নি।সরি।”

শরীফ একগাল হেসে বললেন—

“ইটস ওকে পরীজান।”

জান্নাহ্ তার অ্যাসাইমেন্টের পেপারগুলো ভাঁজ করে সমান্তরালের রাখে।নম্র গলায় প্রশ্ন করে—

“মামি কেমন আছে মামা?

“ভালো।”

জান্নাহ্ এর মুখটা হঠাৎই চুপসে যায়।নিষ্প্রভ চোখে তাকিয়ে ম্লান গলায় বললো—

“মামির এই অবস্থার জন্য আমিই দায়ী।”

শরীফ ভাগ্নীর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন—

“এতে আপনার কোনো দোষ নেই পরীজান।যা হওয়ার তা হয়েছে।”

জান্নাহ্ বিষন্ন গলায় বললো—

“আপুকে বলেছো?

শরীফ সরস গলায় বললেন—

“নাহ।তুমি তো জানো মেহনাজ ভালো নেই।তার উপর এইসব জানলে সে আরো ডিপ্রেসড হয়ে যাবে।”

জান্নাহ্ এর মনটা ভেঙে আসে।ছোটবেলা থেকেই তার মামি তাকে নিজের মেয়ের থেকে বেশি ভালোবাসে।এর জন্য জান্নাহ্ এর ব্যবহার অন্যতম।জাফিন নিজের মেয়েকে সেভাবেই গড়েছেন।চৌদ্দ বছরের জান্নাহ্ একজন পূর্ণ বয়সী নারীর মতো আচরণ করে।যেকোন পরিস্থিতি সামলে নেওয়ার দারুন ধৈর্য্য তার।মেহনাজ ছোটবেলা থেকেই একরোখা।ভীষণ অবাধ্য।যা একদম জান্নাহ্ এর বিপরীত।

শরীফ ক্ষীণ গলায় বললেন—

“আপনার বাবার সাথে এই বিষয়েই কথা বলতে এসেছি।তিনি বললেন আমাকে আসতে।আমি আপনার মামির সব রিপোর্ট নিয়ে এসেছি।”

জান্নাহ্ উচ্ছলিত হয়ে বললো–

“তাই!

“হুম।”

প্রসন্ন হলো জান্নাহ্। গালভর্তি হেসে বললো—

“আমি বিয়ে করছি মামা?

শরীফের মসৃণ কপালে হালকা ভাঁজ দেখা দিলো।পুরু ভ্রু জোড়া কিঞ্চিৎ কুঁকড়ে বললেন—-

“মানে?

জান্নাহ্ ঠোঁট চিপে হাসে।মুগ্ধ গলায় বললো—

“আই এম ইন লাভ।দাঁড়াও তোমাকে দেখাচ্ছি।”

চোখের পাতা প্রশ্বস্ত করে জান্নাহ্ এর দিকে নির্নিমেশ চেয়ে রইলেন শরীফ।জান্নাহ্ সারহানের পেইন্টিংটা শরিফের হাতে দিয়ে বললো—

“হি ইজ দ্যা ওয়ান।”

শরীফ চমৎকার হাসলেন।গাঢ় গলায় বললেন—

“কে সে?

“সারহান।সারহান জেইদি।একজন ক্রাইম স্পেশাল জার্নালিস্ট।আর একজন পরোপকারী।জাস্ট লাইক মাই বাবা।”

“রিয়েলী?

“ইয়েস মামা।”

“শরীফ অধর কোণে হেসে বললেন—

“ছেলে দেখতে তো রাজকুমার।বাবাকে বলা হয়েছে?

জান্নাহ্ মিটমিট করে হেসে বললো—

“শুধু বলেনি দেখিয়েওছি।এন্ড হি লাইম হিম।”

শরীফ যেনো সাত রাজার ধন পেলেন।গৌরবাণ্বিত হয়ে বললেন—

“এই নাহলে আমার পরীজান!রাফাতকে জানিয়েছো?

জান্নাহ্ ডিনাই করে বললো—

“নাহ।বাবা বলেছে আমার হাতে আরো চার বছর সময় আর রাফাত ফিরে আসতেও সময় আছে।তাই আমি ওকে ফিরে আসলেই বলবো।কজ হি ইজ মাই বেস্ট ফ্রেন্ড।”

ঝলমলে হাসে জান্নাহ্।শরীফ তার পরীজানকে দেখে।কত দ্রুত মেয়েটা বড় হয়ে যাচ্ছে!
জান্নাহ্ নরম গলায় প্রশ্ন করে—

“তুমি খেয়েছো মামা?

“নাতো।”

“উফ!তাহলে চলো।বাবা রাগ করবে।সাড়ে ন’টা বেজে গেছে।আজও লেট লতিফ হলাম।চলো,চলো।”
,
,
,
কোকেন নিয়ে দেয়ালের সাথে মাথা হেলিয়ে বসে আছে মৃণালিনী।চোখ দুটো নিমিঝিমি।হাতের আঙুলের ফাঁকে সিগারেট নিয়ে দীর্ঘ সময় নিয়ে তা ফুঁকে যাচ্ছে।মহাজাগতিক এক সুখ অনুভব করছে সে।আজ সাতদিন তার বাইরে যাওয়া বন্ধ।জাফিন সংক্ষুব্ধ চোখে তাকিয়ে আছে মৃণালিনীর দিকে।তার মধ্যে কোন ভাবাবেশ নেই।দিব্যি সিগারেটের ধোঁয়ার কুন্ডলিতে চোখের সুখবিলাস করছে সে।জাফিন রুষ্ট গলায় শুধায়—

“তুমি কী এইসব ছাড়বে না?

মৃণালিনী দেয়ালে ঠেকানো মাথাটা সোজা করলেন।ধোঁয়াতে স্পষ্ট নয় তার চোখের দৃষ্টি।লালিমায় ছেয়ে আছে তা।চোখের পাতা প্রশ্বস্ত করে তাকিতে বেগ পেতে হচ্ছে তাকে।ঘাড়টাও স্থির রাখতে পারছেন।নেশার্ত গলায় বললেন—

“ইউ নো দ্যাট,ফর দিস আই হেট ইউ।তোমার এই লোক দেখানো কেয়ারিং ইরেটেটিং লাগে আমার কাছে।”

জাফিন রেগে উঠে দাঁড়ান।কড়া গলায় চেঁচিয়ে উঠেন—

“এটাই আমার দুর্বলতা।তোমাকে আমি আজও ভালোবাসি।এই তোমার কারণে আমার মেয়েটা বোধ হওয়ার পর প্রথম বার কেঁদেছে।আজ পর্যন্ত তার গায়ে একটা ফুলের টোকা পড়তে দেই নি।কিন্তু তোমার কারণে ওই রৌশান আমার মেয়েকে বাজে ভাবে স্পর্শ করেছে।ভাগ্য ভালো সেদিন ওই ছেলেটা সেখানে ছিলো।নিউজ পেপারে দেখেছি আমি হি ইজ আ ব্ল্যাডি ক্রিমিনাল।আজকের যুব সমাজকে ধ্বংস করতে ওর মতো কতিপয় বাস্টার্ড ই দায়ী।”

মৃণালিনী থমকালেন।বা’হাতের উল্টো পাশ দিয়ে বেপরোয়া নাক ঘষে গ্যারগ্যারে গলায় বললেন—

“আমি রৌশান কে বলেছি যা বলার।আই নো,ইটস মাই ফল্ট।আমি বুঝতে পারি নি ও ডলের সাথে এমন কিছু করবে।আমার জানা ছিলো না রৌশান আ ফা** গায়।”

গর্জে উঠলেন জাফিন।

“কী বুঝতে পারো নি তুমি!আজ চব্বিশ বছরেরও তোমার বোধদয় হয়নি!আজ তুমি এইটিনের নও।আমার ওই চৌদ্দ বছরের মেয়েও তোমার থেকে বুঝদার।সে নিজের ভালোত বোঝে।”

মৃণালিনী জাফিনের কথা তোয়াক্কা না করে তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন—

“তোমার মেয়ে!হাউ ফানি জাফিন! ওকে জন্ম আমি দিয়েছি।”

বজ্র গলায় ঘোষণা করে জাফিন—

“জন্ম তুমি দিলেও ওকে মানুষ করেছি আমি।আগলে রেখেছি আমি।নিজের হাতে তিন বেলা খাইয়েছি আমি।জ্বর হলে সারারাত জেগে থেকেছি আমি।স্কুলে নিয়ে গিয়েছি আমি।আমার মেয়ের শিশু থেকে কিশোরীতে রূপান্তর হয়েছে আমার হাত ধরে।মা হয়ে তুমি কী করেছো?রাতদিন ক্লাব,পার্টি,ড্রাগস,ড্রিংস আর নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থেকেছো।জন্ম দিলেই মা হওয়া যায় না মৃণাল।”

মৃণালিনী সারা রুম কাঁপিয়ে চিৎকার করে উঠেন।বললেন—

“হ্যাঁ,হ্যাঁ,হ্যাঁ।চাইনি আমি ওকে জন্ম দিতে।সাজা দিতে চেয়েছি তোমাকে।আমাকে বন্দি করার সাজা।আমার স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়ার সাজা।আই জাস্ট হেট ইউ।”

জাফিন নিজের রাগ সংবরণ করতে পারলেন না।ক্রোশে ফেটে পড়লেন তিন।কড়া হাতে এক চড় বসিয়ে দিলেন মৃণালিনীর গালে।মৃণালিনী যেনো হিংস্র বাঘিনী হয়ে উঠলেন।জাফিনের বুকের দিকটা খামচে ধরে ঘি ঢালা আগুনে তেতে উঠে স্বর বিকৃত করে বললেন—

“ইউ….।কোন সাহসে তুমি আমার গায়ে হাত দিলে!শুধু এক বিছানায় রাত কাটালেই স্বামী হওয়া যায় না।ভালোবাসলে তার যত্ন করতে হয়।কী করেছো তুমি আমার জন্য।নিজের হসপিটাল,পেশেন্ট,ইমপ্লয়ী নিয়ে ব্যস্ত ছিলো।আমি কোথায় ছিলাম!কোথায় ছিলাম আমি!

মৃণালিনী রাগের বশে হিতাহিত ঞ্জানশূন্য হয়ে ধাক্কা মেরে বসলেন জাফিনকে।

বাবার চিৎকার কানে আসতেই সপ্রতিভ হয় জান্নাহ্।জান্নাহ্ এর পাশেই তার মায়ের ঘর।মাঝে করিডোর।তার পাশে জাফিনের।কোনো কিছু না ভেবেই উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে আসে জান্নাহ্।থমকে যায় তার পা।বন্ধ হয়ে আসে যেনো তার হৃদকম্পন।পা দুটো অসাঢ় যেনো।জান্নাহ্ এর উদ্ভাসিত দুই চোখ দিয়ে বর্ষণ শুরু হলো।থরথর করে কাঁপতে লাগলো জান্নাহ্।সেই কম্পিত শরীরে ধীম ধীম করে এগিয়ে আসছে সে তার বাবার নিষ্প্রাণ শরীরটার কাছে।ধপ করে নিচে বসে পড়ে জান্নাহ্।কম্পিত হাতটা দ্বিধা আর সাহসের সমন্বয়ে একটু একটু করে জাফিনের বুকের উপর রেখে হালকা ধাক্কা মেরে আদুরে গলায় বললো—-

“বাবা,ও বাবা।কী হয়েছে তোমার!বাবা,বাবা!
কথা বলো বাবা।”

মৃণালিনীর অতর্কিত ধাক্কা সামলাতে পারেনি জাফিন।ভারি সেন্টার টেবিলের কোনায় উল্টো হয়ে পড়ে যাতে করে তার মাথার পেছনে নরম জায়গায়টা টেবিলের কোনা এক ইঞ্চি গেঁথে যায়।গলগলিয়ে উষ্ণ লহুতে ভেসে যায় মেঝে।জাফিন সময় পায়নি তার মেয়েকে শেষ বারের মতো দেখতে।তার প্রশ্বস্ত দুই চোখ যেনো তৃষ্ণার্ত রয়ে গেলো।

পাশেই মৃণালিনী সমানতালে কেঁপে যাচ্ছে।মাথার চুল খামছে ধরে বোঝার চেষ্টা করছে কী করেছে সে।গলায় কথা আটকে গেছে তার।কথা বলতে গিয়ে অদ্ভুত গোঙানির আওয়াজ বের হচ্ছে।জান্নাহ্ বুক ক্ষনে ক্ষনে থরথরিয়ে যাচ্ছে।ততক্ষনে শরীফ এসে দাঁড়িয়েছে।

জান্নাহ্ নরম কিন্তু ভয়ংকর স্থির গলায় বললো—

“কেন মারলে তুমি বাবাকে মাম্মা?কেন মারলে?

মৃণালিনীর চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে শীতল জলের প্রস্রবণ।থমকে থমকে বললেন—

“আআআমি ইইইইচ্ছে করে করিনি ডল।বিইইইশ্বাস করো।আমি কককরিনি।”

জান্নাহ্ নিষ্কম্প চোখে তাকিয়ে ধরা গলায় বললো—

“বাবাকে মেরে ফেললে তুমি!কেন মারলে মাম্মা?

মৃণালিনী বড় বড় ঢোক গিলে নিজের সাফাই গাইতে লাগলেন।জান্নাহ্ ঝমঝমিয়ে কেঁদে উঠে।তার কান্নায় যেনো আজ বাতাসও কাঁদতে চায়।সমানতালে কেঁদে বললো—

“আই হেট ইউ মাম্মা।আই হেট ইউ।ইউ আর আ মার্ডারার।আই নেভার ফরগিভ ইউ।”

মৃণালিনী মেয়ের হাত ধরে বললেন—-

“আমার কথা শুনো ডল,আমি ইচ্ছে করে করিনি।জানি না আমার কী হয়ে গেলো।ধাক্কা লেগে…।”

মৃণালিনী দমকে দমকে কাঁদতে লাগলেন।জান্নাহ্ গা ঝাঁড়া দিয়ে বললো–

“একদম ছোঁবে না তুমি আমাকে।আই হেট ইউ।আমি এখনই পুলিশ কে কলে করবো।তুমি আমার বাবাকে মেরে ফেলেছো।আমি তোমাকে কখনো ক্ষমা করবো না।কখনো না।”

মৃণালিনী জোড়াজুড়ি করতে লাগলেন।ভ্যালভ্যাল চাহনিতে সবকিছু হজম করতে কষ্ট হচ্ছে শরীফে।নিজের প্রিয় ভগ্নিপতির এমন নির্দয় মৃত্যু তিনি একদম আশা করেন নি।
চাপা কষ্টে ভেতর দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে শরীফের।নিজেকে দোষ দিতে লাগলেন।আচমকা ঘটে গেলো আরেক ভয়াল কান্ড।জান্নাহ্কে থামাতে গেলে বেপরোয়া ধাক্কায় উল্টে পড়ে মৃণালিনী।পাশে থাকা ছোট টেবিলটার উপর ছিল একটা শ্বেত পাথরের মূর্তি যা একজন তীরন্দাজের।অতর্কিতে মৃণালিনী সেই মূর্তির উপর গিয়ে পড়ে।আর তাতেই সেই তীরের ফলা ঢুকে যায় মৃণালিনীর গলায়।

জান্নাহ্ এর পুরো দুনিয়ার উল্টে গেলো এক ঝটকায়।চিৎকার করে দম আটকে।

“মাম্মা!

শরীফ এসে বোনকে জড়িয়ে ধরলেন।বেশি সময় নিলেন না মৃণালিনী।চোখের ইশারায় মেয়েকে দেখালেন ভাইকে।জান্নাহ্ এর দিকে তাকিয়ে আলতো হাসলেন।মুহূর্তেই নিভে গেলো তার প্রাণ প্রদীপ।জান্নাহ্ তটস্থ পায়ে উপড়ে পড়লো নিজের মায়র উপর।

“মাম্মা,কথা বলো।মাম্ম,মাম্মা।”

মৃণালিনী চেয়ে রইলেন তার নিথর দুই চোখ দিয়ে।রক্তে ভেসে গেলো মেঝে।জান্নাহ্ উন্মাদের মতো বিলাপ করতে থাকে।তারা সারা শরীরে রক্ত জড়িয়ে যায়।থরথর করে কাঁপতে থাকে জান্নাহ্।নিজের দুই হাতে বাবা মায়ের রক্ত জান্নাহ্ দিকভ্রষ্টের মতো তাকাতে থাকে।
প্রলাপ বকতে থাকে—

“মামা,আমি আমার মাম্মাকে মেরে ফেলেছি।তুমি পুলিশকে কল করো।আমি খুনি মামা।আমি খুনি।”

হাত পা ছুঁড়ে কাঁদতে থাকে জান্নাহ্।শরীফ নিজের বুকের সাথে চেপে ধরলেন জান্নাহ্।তার মাথা কাজ করছে না।কী করবেন তিনি।জান্নাহ্ শরীফের বুকে আঁছড়ে পড়ে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে একসময় ঢলে পড়ে তার মামার কোলে।

শেষ হয়ে যায় জান্নাহ্ এর সুখের ঘর।তার বেস্ট বাবার আর দেখা হলো না তার মেয়ের সংসার।তার বেপরোয়া কিন্তু বুকের গহীনে চেপে রাখা ভালোবাসা পূর্ণ মায়ের জানা হলো না তার ছোট্ট ডল কাউকে ভালোবেসে প্রমাণ করবে ভালোবাসা থাকলে সব সম্ভব।জান্নাহ্ তার প্রাণকে বলতে পারলো না সে তাকে তার বেস্ট বাবার জায়গায় বসিয়েছে।তাই তো সে তাকে এতো ভালোবাসে।জান্নাহ্ এর ছোট্ট শরীরটা নিয়ে সেই লাল রঙের গাঢ় নোনতা লহুর সমুদ্রে বসে রইলো শরীফ।এখন শুধু ভোরের অপেক্ষা।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here