জান্নাহ্,পর্বঃ৬৭,৬৮
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
পর্বঃ৬৭
ভেজা চুলগুলো মুছে বিছানায় বসে ইহতিশাম।চোখে,মুখে অরন্যের ন্যায় ক্লান্তি।বুক ফুলিয়ে একটা শ্বাস ফেলে স্থির হয়ে বসে।একটু আগেই সরফরাজের সাথে কথা কাটাকাটি করে এসেছে জান্নাহ্ এর কেস নিয়ে।ইহতিশামের জুনিয়রের সন্দেহ ইহতিশাম ইচ্ছে করেই কেস ধামাচাপা দিতে চাইছে।সরফরাজ ব্যাকুল হয়ে আছে নিজের মেয়ের খুনিকে স্বচক্ষে দেখার জন্য।দরজার পর্দা সরিয়ে ভেতরে ঢুকে মেহনাজ।ইহতিশামের কপালে চিন্তার রেখা দেখে জিঙ্গাসু গলায় বললো–
“কী নিতে এতো চিন্তিত তুমি?
চোখ তুলে নির্জীব চাহনিতে তাকায় ইহতিশাম।খসখসে গলায় বললো–
“কিছু না।”
ইহতিশাম চায় না এই ব্যাপারে আর ঝামেলা হোক।সারহানকে কথা দিয়েছে সে।মেহনাজ ইহতিশামের পাশে বসে স্বাভাবিক গলায় বললো—
“একটা কথা বলবো?
“হুম।”
“ইয়াস বোধহয় স্মোক করে!
ঝট করেই বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকায় ইহতিশাম।তীর্যক গলায় বললো—
“কী বলছো এইসব?
মেহনাজ মিহি গলায় বললো—
“আসলে তোমাকে কয়েকদিন ধরে বলবো ভাবছিলাম।সেদিন ওর ঘর গিয়ে দেখলাম সিগারেটের উটকো গন্ধ।আর আজ যখন ও কলেজে গেলো তখন ঘর গুঁছাতে গিয়ে দেখি বালিশের তলায় সিগারেটের প্যাকেট।”
ফোঁস করে তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে ইহতিশাম।কটমটিয়ে উঠে দাঁড়ায়।ভারী গলায় বললো—
“এখন কোথায় ও?
“ঘরেই আছে।গেম খেলছে।”
ইহতিশাম রাগ নিয়ে দু’কদম বাড়াতেই মেহনাজ নরম গলায় বললো—
“বেশি ঝামেলা করো না।মা,বাবা নেই এখন বাসায়।আর ও এখনো ছোট।বন্ধুদের সাথে মিশে হয়তো কৌতূহল বশত নেশায় পড়েছে।বুঝিয়ে বলো।”
দরজায় করাঘাত পড়ে তখনি।মেহনাজ কথা শেষ না করেই সেদিকে তাকায়।ইয়াস তার ছোট্ট মুখটা মলিন করে দাঁড়িয়ে আছে।ইহতিশাম তাকাতেই সপ্রতিভ হয়ে বললো—
“কেউ এসেছে তোমার সাথে দেখা করতে।”
ইহতিশাম রাগাম্বিত গলায় বললো—
“তুই যা।আমি আসছি।”
বসার ঘরে নিমগ্নচিত্তে বসে আছে রাফাত।তাকে দেখেই পুরু ভ্রু জোড়া কুঞ্চি করে ইহতিশাম।চোখে জমা হয় উদ্বিগ্ন প্রশ্ন।রাফাতের দিকে তাকিয়ে জোর গলায় বিস্ময় নিয়ে বললো—
“তুমি !এখানে?
রাফাত ফ্যাকাশে দৃষ্টিতে তাকায়।নিষ্প্রাণ গলায় বললো—
“গতকাল সকালে জান্নাহ্ কল করেছিলো আমাকে।”
ইহতিশাম সানন্দে আগ্রহপূর্ণ হয়ে শুনতে চাইলো।
“তাই নাকি!কেমন আছে জান্নাহ্?
রাফাত নিষ্প্রভ চোখে মেহনাজের দিকে তাকায়।ভারাক্রান্ত গলায় বললো—
” জান্নাহ্ প্রেগন্যান্ট।ফাইভ মানথ রানিং।”
ইহতিশাম প্রসন্ন হেসে উচ্ছলিত গলায় বললো—
“রিয়েলী!ইটস আ গুড নিউজ।”
তৎক্ষণাৎ মেহনাজের তীক্ষ্ম স্বর ভেসে আছে।
“ও,তাহলে সারহান জেইদি তার আসর রঙ দেখিয়েছে!
ভরাট দৃষ্টিতে তার দিকে তাকায় রাফাত।কৌতূহলী গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে—
“কী বললে?
মেহনাজ তাচ্ছিল্য হাসে।ক্ষুব্ধ গলায় বললো—
“এই জন্য জান্নাহ্কে সবার কাছ থেকে লুকিয়ে রেখেছে!যেনো ওর জঘন্য সত্য জান্নাহ্ এর সামনে না আসে।”
রাফাত তিক্ত শ্বাস ফেলে হতাশ গলায় বললো—
“জান্নাহ্ সব জানে মেহনাজ।তবুও ও…।”
খলবলিয়ে বলে উঠে মেহনাজ—
“কী জানে জান্নাহ্?ওর স্বামীর জঘন্য সত্য।যে শুধু নারী দেহেই সুখ খুঁজে বেরিয়েছে।মেয়েদের ধোঁকা দিয়ে তাদের সাথে…।”
মেহনাজের কথা শেষ হওয়ার আগেই জ্বলে উঠে ইহতিশাম।অধৈর্য গলায় বললো—
“কিপ কোয়াইট মেহনাজ।স্টপ দিস ননসেন্স।”
খটমটিয়ে উঠে মেহনাজ।জোর গলায় বলে উঠে—
“কেন চুপ করবো আমি।আমার পুরো জীবনটা নষ্ট করে দিয়েছে ওই সারহান।আর ও নিজেকে সুখী করায় ব্যস্ত!এতো মেয়ের জীবন নিয়ে খেলে এখন ভালোবাসা দেখানো হচ্ছে জান্নাহ্কে!সারহান কখনো জান্নাহ্কে ডিজার্ব করে না।”
ইহতিশাম প্রদৃপ্ত গলায় বললো—
“কে কাকে ডিজার্ব করে তা নিয়ে তোমাকে না ভাবলেও চলবে।”
কলের পুতুলের মতো সব গ্রোগ্রাসে গিলছে রাফাত।তার মস্তিষ্কের নিউরণে ছুটতে লাগলো একটি কথা,সারহান মেহনাজের জীবন নষ্ট করেছে!তার মানে সারহান মেহনাজের সাথে এমন কিছু করেছে।রাফাতের ভেতরকার প্রেমিকপুরুষ এক মুহূর্তে ছলকে উঠলো।সে কিছুতেই তার রেড চেরিকে এমন একটা নিচু মানুষের সংস্পর্শে থাকতে দিবে না।
রাফাতকে লক্ষ্য করে মেহনাজ তিরিক্ষি গলায় বললো–
“ভালো তো তুমি জান্নাহ্কে বাসতে।ফুফু,ফুপা তো তোমার সাথে জান্নাহ্ এর বিয়ে দিতে চেয়েছিলো।তাহলে ওই সারহান এলো কী করে এইসবে মধ্যে?আর তুমি এতো মেরুদণ্ডহীন কেন?কেউ এসে জান্নাহ্কে বিয়ে করে ফেললো আর তুমি হাত গুঁটিয়ে বসে রইলে?
অসহায় চোখে তাকিয়ে রয় রাফাত।তার ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে।এতোদিনকার চাপা রাখ মুহূর্তেই যেনো আগ্নেয়গিরির মতো ফুটতে শুরু করলো।
দমদমিয়ে বের হয়ে যায় রাফাত।
ইহতিশাম ক্ষেপা গলায় বলে উঠে—-
“কী শুরু করলে তুমি?রাফাতের সামনে এইসব বলার কী দরকার ছিলো?
ঝামটা মেরে বলে উঠে মেহনাজ—
“ছিলো।দরকার ছিলো।সারহানকে আমি কখনো ক্ষমা করবো না।আমাকে কষ্ট দিয়ে ও কী করে সুখী হতে পারে?
ইহতিশামের তপ্ত রাগ নিমিষেই বিগলিত হয়।অসহায় চোখে তাকিয়ে নিরাস গলায় বললো—
“তার মানে আমি তোমাকে সুখী করতে পারি নি?তুমি খুশি নও আমার সাথে?
ব্যস্ত হয়ে উঠে মেহনাজ।নিজের স্বীকারোক্তিতে বললো—
“ইহতিশাম,আমি তা মিন করি নি।”
“তুমি কি মিন করেছো তা আমার বোঝা হয়ে গেছে।আফসোস হচ্ছে আমার মেহনাজ।তোমাকে ভালোবাসা হয়তো আমার জীবনের দ্বিতীয় ভুল।যার খেসারত এইবার জান্নাহ্কে দিতে হবে।আমাকে তুমি আবার অপরাধি করলে সারহানের কাছে।যদি তাই হয় আমি নিজেকে কখনো ক্ষমা করতে পারবো না মেহনাজ।কখনো না।”
বার কয়েক করুণ গলায় ডেকে উঠে মেহনাজ।শুনেও শুনলো না ইহতিশাম।রাতের মায়ায় নেমে গেলো নিজের ভুলের মাশুল গুনতে।আদৌ কী তা পারবে তা ইহতিশাম?
চলবে,,,
#জান্নাহ্
#পর্বঃ৬৮
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
নিশুতি রাতের মায়ার আচ্ছন্ন চারপাশ।আকাশে জুড়ে আছে অর্ধচন্দ্র।ম্রিয়মান আলো ক্রমশ প্রস্ফুটিত হচ্ছে।গাঢ় হচ্ছে চন্দ্রের আলোর বর্ষণ।বারান্দার পাশের জবা ফুলের গাছে ফুটে রয়েছে রক্তিম জবা।
বিছানায় আধশোয়া বসে পা বিছিয়ে রেখেছে জান্নাহ্।তলপেটে ভারী অনুভূত হওয়ায় পিঠটা ঠেসে রেখেছে বালিশের সাথে।তার মুখে খাবার তুলে দিচ্ছে সারহান।খানিক সময় পর অনাগ্রহ নিয়ে বললো—
“আমি আর খাবো না।”
সারহান গাঢ় গলায় বললো—
“আরেকটু খেয়ে নিন।দুপুরে কিছুই খান নি।”
জান্নাহ্ অরুচি নিয়ে মুখ বিকৃত করে বললো—
” আর ইচ্ছে করছে না সারহান।ভালো লাগছে না।”
ফোঁস করে শ্বাস ফেললো সারহান।প্রশ্রয়ের সুরে বললো—
“ওকে।”
সারহানের মোবাইল বেজে উঠতেই চকিত হয় সে।আবারো আননোন নাম্বার।সারহান চিন্তিত ভাবনায় রিসিভ করলো।ওপাশ থেকে ব্যগ্র হয়ে কেউ বললো—
“হ্যালো,হ্যালো!
সারহান জেইদি বলছেন?
সারহান ভ্রু কুঞ্চি করে।কয়েকটা শ্বাস ফেলে নির্বিকার গলায় বললো—
“আসসালামু আলাইকুম। ইয়েস,সারহান বলছি।আপনি কে?
অর্নিশ মুখ ফুলিয়ে শ্বাস ফেললো।ব্যগ্র হয়ে বললো–
“আমি অর্নিশ।চিনতে পারছেন?
সারহান পূর্ণ নজরে তাকায় জান্নাহ্ এর দিকে।তার উৎসুক দৃষ্টি আবদ্ধ সারহানের কুঞ্চিত কপালে।চোখের পল্লব ধীরে ধীরে উঠানামা করছে।সারহান নাক ফুলিয়ে শক্ত কন্ঠে বললো—
“না চেনার কারণ নেই।কেন কল করেছেন?
মৃদু হাসে অর্নিশ।মোলায়েম গলায় বললো—
“রাগ করলেন নাকি!জান্নাহ্ আছে?
সারহান অধর কোণে হাসলো।তপ্ত গলায় বললো—
“না থাকার কথা?
অর্নিশ গালভর্তি হাসে।সহজ সুরে বললো–
“আপনার রাগ প্রকাশ পাচ্ছে।”
সারহান চোয়াল শক্ত করে বিতৃষ্ণা গলায় বললো—
“ওয়েট।”
কান থেকে মোবাইল সরিয়ে জান্নাহ্ এর দিকে এগিয়ে দেয় সারহান।জান্নাহ্ কৌতূহলী গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে–
“কে?
সারহান তাচ্ছল্য চোখে তাকিয়ে বললো—
“হয়তো আপনার পরিচিত।”
উঠে চলে যায় সারহান।জান্নাহ্ কাঁপা হাতে সাবধানে কানে স্পর্শ করায় মোবাইল।দ্বিধান্বিত গলায় বললো—
“হ্যাআআলো!
মুক্ত শ্বাস ফেললো অর্নিশ।নরম সুরে বললো—
“কেমন আছো জান্নাহ্?
জান্নাহ্ আকাশ ছোঁয়া বিস্ময় নিয়ে বললো—
“অর্নিশ!
“কন্ঠ চিনতে কষ্ট হয়নি তোমার।”
“কেমন আছো?
“ভালো।”
“কল কেন করেছো?
“জিঙ্গেস করলে না নাম্বার কোথায় পেলাম?
জান্নাহ্ ভাবলেশহীন গলায় বললো—
“বোকা নই আমি।”
ফিচেল হাসে অর্নিশ।থমথমে গলায় বললো–
“রাইট।যাকে বলে মাত্রাতিরিক্ত চালাক।”
জান্নাহ্ গুমোট গলায় বললো—
“কী চাও তুমি?
শীতল শ্বাস ফেললো অর্নিশ।উপহাসমিশ্রিত গলায় বললো—
“বিয়ে করে ফেললে!
আমার চেয়েও যার এজ বেশি তাকেই?তাহলে আমাকে কেন রিফিউজড করলে?আমার খামতি কী ছিলো জান্নাহ্?
জান্নাহ্ উষ্ণ গলায় বললো–
“সংযুক্তাকে ভুলে গেলে?
অর্নিশ সাবলীল গলায় বললো–
“ওকে ভোলার জন্য ভালোবাসি নি।কিন্তু তোমাকে নতুন করে জায়গা দিয়েছি।”
জান্নাহ্ কঠিন গলায় বললো—-
“আমি কী তোমাকে তেমন কিছু বলেছি?
“চার বছর কী অনেক সময়?
হয়তো।তবুও তো বুঝতে তুমি।”
জান্নাহ্ দৃঢ় গলায় বললো—-
“মাম্মা যা বলেছে তা ঠিক ছিলো অর্নিশ।”
“তাহলে সারহান!সে কেন এলো?রাফাত থাকার কথা।কোথায় সে?
“রাফাত আমার বেস্ট ফ্রেন্ড।আমি কখনো রাফাত কে ভালোবাসি নি।”
নীরস হাসলো অর্নিশ।জিঙ্গাসু গলায় শুধায়—
“বিয়েটা আন্টি থাকলে হতো না।তাই না জান্নাহ্?
জান্নাহ্ থম মেরে রইলো।নিথর,নিস্তব্ধ,নির্বিকার।অর্নিশ বলে উঠে—
“ওকে।তুমি আমার জন্য যা করেছো আমি ঋণী তোমার কাছে।হয়তো আমাদের ভাগ্য আলাদা ছিলো।একটা রিকোয়েস্ট করতে পারি।”
“হুম।”
“মম তোমাকে দেখতে চেয়েছে।তার হার্ট সার্জারী করা হয়েছে।সময় করে এসো।ভালো থেকো।”
জান্নাহ্ ভেজা গলায় বললো—
“হুম।আসবো।তুমিও ভালো থেকো।থেমে থেকো না।জীবন কারো জন্য থেমে থাকে না অর্নিশ।অল দ্যা বেস্ট।”
দরজায় দাঁড়ানো সারহান।তার অনিমেষ চাহনি দৃষ্টি কাড়লো জান্নাহ্ এর।ধীরপায়ে ড্রেসিং টেবিলের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়।ক্ষীণ গলায় বললো–
” সৈয়দ অর্নিশ।সাতাশ বছরের একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার।যার সাম্প্রতিক তৈরি করা সফটওয়্যার বর্তমান বাজার মূল্য থেকে দ্বিগুণ দামে কিনে নিচ্ছে অস্ট্রেলিয়ার একটি আইটি কোম্পানি।”
জান্নাহ্ নরম দৃষ্টিতে তাকায়।তার চোখে নির্লিপ্ততা।সারহান বাঁকা হেসে তার হাত দুটো পকেটে ঢুকিয়ে নিলো।পেছন দিকে হেলান দিয়ে বাম পায়ের গোড়ালির উপর ডান পা উঠিয়ে দৃঢ় হয়ে দাঁড়ায়।নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে সারহান।মুচকি হাসে সেভাবেই।কৃত্তিম আলোয় সারহানের মুখের দিকে ফ্যাকাশে দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো জান্নাহ্।সারহান অদ্ভুত সুরে বললো—-
“আফসোস!
একজন ডক্টর আর একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারকে ছেড়ে আমার মতো একজনকে কেন বেছে নিলেন রজনীগন্ধা?আজ সত্যিই আপনার জন্য আফসোস হচ্ছে আমার।”
জান্নাহ্ দুম ধরে রইলো।ক্ষীণ শ্বাস ফেলছে সে।সারহান আবারও বললো—
“একদিকে রাফাত,একদিকে অর্নিশ।আরও কেউ আছে রজনীগন্ধা?তবে রাফাত ছেলেটা কিন্তু একদম পার্ফেক্ট ছিলো আপনার জন্য।ছেলেটাকে কষ্ট দিলেন।”
রাগে চোখে জল ছেপে এলো জান্নাহ্ এর।থিতিয়ে থাকা রাগ তরতর কে উঠে এলো মস্তিষ্কের কোণে কোণে।গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ায় জান্নাহ্।তার নিঃশ্বাসের ভয়াল আওয়াজ নৈঃশব্দ বাতাসে আলোড়ন তুলে।তীক্ষ্ম গলায় বলে উঠে জান্নাহ্—
“কী সমস্যা আপনার?কেন বারবার একই কথা বলেন? আপনার আফসোস হচ্ছে আমাকে বিয়ে করে?নাকি এখন আর বাইরে মেয়েদের নিয়ে রাত কাটাতে পারছেন না তাই কষ্ট হচ্ছে!কীসের এতো সন্দেহ আপনার?কী করি নি আমি আপনার জন্য।পনেরো বছর।মাত্র পনেরো বছর ছিলো আমার।তবুও আমাকে ছেড়ে দিয়েছেন আপনি!নাহ।নিজের খায়েশ ঠিকই মিটিয়ে নিয়েছেন।আমার কষ্ট একবারো চোখে পড়েছিলো আপনার?পড়েনি।সব সয়ে নিয়েছি আমি।কেন জানেন?শুধু আপনাকে ভালোবাসি বলে।সব,সব মেনে নিয়েছি আমি।
একজন স্ত্রী হয়ে আপনার সব চাহিদা পূরণ করেছি আমি।তবুও কীসের অভাবে এইসব করলেন আপনি? ইচ্ছেই যখন ছিলো না তখন বিয়ে কেন করেছিলেন আমাকে?শুধু আমার এই কচি শরীরের জন্য?
ঝমঝমিয়ে কাঁদে জান্নাহ্।একনাগাড়ে কথা বলে হাঁপিয়ে উঠে সে।সারহান দম বন্ধ করে শুনে যাচ্ছে।আজ এতোদিনে তার রজনীগন্ধার ভেতরকার ছাই চাপা আগুনের স্ফুলিঙ্গ তার চোখ জ্বালিয়ে দিচ্ছে।একটু সময় নিয়ে আবারো জান্নাহ্ বলে উঠে—
“আমার কষ্ট দেখেছেন আপনি?দেখেন নি।যদি দেখতেন তাহলে বুঝতেন।আপনার সব সত্য জেনেও চুপ করে ছিলাম আমি।তবুও একবিন্দু ঘৃণা কেন জন্মায় নি আমার আপনার প্রতি!শুধু আপনাকে ভালোবাসি বলে।নিজের স্বামীকে অন্য মেয়ের সাথে দেখেও তার ছোঁয়া কতটা কষ্টদায়ক তা আপনি কখনো উপলব্ধি করতে পারবেন না সারহান।সূঁচের ফলার মতো বিঁধেছে তা আমার শরীরে।তবুও চুপ করেছিলাম আমি।শুধু আপনাকে ভালোবাসি বলে।
রাফাতের সাথে এক ঘরেও রাত কাটিয়েছি আমি।তবুও কখনো আমার শরীরে কারো ছোঁয়া লাগতে দেই নি ।কিন্তু আপনি!কী করেছেন আপনি!ভালো তো শুধু আমি আপনাকে বেসেছে।আপনি ভালোবেসেছেন শুধু আমার শরীরকে।”
ঝরঝর করে নিজের চোখের অশ্রু বিসর্জন দেয় জান্নাহ্।ঠোঁট কামড়ে ধরে আবার বললো—
“অর্নিশ সংযুক্তাকে ভালোবাসতো।সংযুক্তার অ্যাকসিডেন্টে ডেথ হয়ে যায়।অর্নিশ ডিপ্রেশনে চলে যায়।রাফাত জাপান চলে যাওয়ায় সারাদিন বাসায় আমাকে একা থাকতে হত।বাবা আমাকে হসপিটালে নিয়ে যেতো।মাম্মা প্রায়ই আমাকে শোয়তা আন্টির বাসায় নিয়ে যেতো।সেখানেই কথা হয় অর্নিশের সাথে আমার।বাবা সবসময় বলতো,একজন সাধারণ রোগীকেও বাঁচানো সম্ভব নয় যদি না তার মধ্যে বাঁচার আগ্রহ থাকে।সেক্ষেত্রে একজন কোমার রোগীকে বাঁচানো সম্ভব যদি তার মধ্যে বেঁচে থাকার স্পৃহা থাকে।আমি শুধু অর্নিশকে সেই স্পৃহা দিয়েছি।শোয়েতা আন্টি মাম্মাকে বলেছিলেন আমাদের বিয়ের কথা।কিন্তু মাম্মা তা সাথে সাথেই না করে দেয়।
আমি কখনো ভাবি নি অর্নিশকে নিয়ে।কখনো না।তবুও কেন শুনতে হয় আমাকে বারবার একই কথা!কই এতোকিছুর পরও আমি তো আপনাকে কিছু বলি নি।আপনার কেন মনে হয় এইসব!
তবে একটা কথা মনে রাখুন সারহান।আমার সহ্যের সীমা শেষ।আর পারবো না আমি।এরপর যদি এমন কিছু হয় তাহলে আমি আমার সাথে সাথে আমার সন্তানকেও শেষ করে দিবো।কোন দরকার নেই ওর এই অশুদ্ধ পৃথিবীতে আসার।
তখন আপনার যা ইচ্ছে করবেন,যার সাথে ইচ্ছে রাত কাটাবেন।আই ডোন্ট কেয়ার।”
নিজেকে সামলে নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে যায় জান্নাহ্।প্রস্তরখণ্ডের মতো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সারহান।তার বুকের পিঞ্জিরায় ঝড় উঠেছে।
তার রজনীগন্ধা তাকে ছেড়ে যেতে পারে না।মেহনাজ নামের সেই ভুল এক ঝটকায় তার জীবন বদলে দেবে যেকোনো সময়।
বসার ঘরে অঝোরে কেঁদে যাচ্ছে জান্নাহ্।তার অতীত কেন বারবার তার সামনে এসে দাঁড়ায়।বিড়ালপায়ে তার পাশে এসে বসে সারহান।জান্নাহ্ এর মাথাটা বুকের সাথে আলগোছে চেপে ধরে।আনম্র গলায় বললো—
“থামুন রজনীগন্ধা।ক্ষমা করুন আমায়।”
বিনা সময় ব্যয়ে ধরা গলায় বলে উঠে জান্নাহ্—-
“কেন এমন করেন আপনি?কেন বলেন এইসব!আপনি তো বলেছেন অতীত ভুলে যেতে।তবুও কেন বারবার মনে করিয়ে দেন।”
সারহান কিছু বললো না।অতলস্পর্শী ভালোবাসায় জান্নাহ্কে নিজের সাথে চেপে ধরলো।অনুরক্তির গলায় জান্নাহ্ বললো—
“যদি আমি এমন করতাম তাহলে মেনে নিতেন আপনি আমাকে?পারতেন সব ভুলে যেতে?
সারহান বিক্ষিপ্ত হাসলো।জান্নাহ্ এর বুকে মাথা নুইয়ে মখমলে গলায় বললো—
“আমি তো আপনার সৌরভের ভাগও কাউকে দিতে পারবো না।সেখানে আপনার ভাগ কী করে দিবো?আমার রজনীগন্ধা শুধু আমারই।তার অন্তিম শ্বাস পর্যন্ত সে আমার।”
দু’হাত দিয়ে সারহানকে ঝাঁপটে ধরে জান্নাহ্।তার চোখ বেয়ে নেমে যাচ্ছে শীতল,নোনতা জলের প্রস্রবণ।জান্নাহ্ এর পিঠে হালকা হাত রেখে মিহি গলায় সারহান বললো—
“আপনি আমাকে যতটা ভালোবেসেছেন হয়তো ততটা ভালো আমি আমাকে বাসতে পারি নি।কিন্তু যেভাবে আপনি আমাকে ভালোবেসেছেন সেভাবে আমি আপনাকে ভালোবাসি নি।আমি তার বিপরীত রজনীগন্ধা।তাই দ্বিতীয়বার এই প্রশ্ন আমাকে করবেন না।আপনার অন্তিম শ্বাসও আমার জন্য।আপনার অন্তিম স্পন্দনও আমার জন্য।সেখানে আর কেউ নেই রজনীগন্ধা।কেউ না।”
চলবে,,,