জান্নাহ্,পর্বঃ৭৩,৭৪

0
2232

জান্নাহ্,পর্বঃ৭৩,৭৪
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
পর্বঃ৭৩

একটা পুরো ডিম অমলেট করে খাইয়ে দিচ্ছে তিতিকে জান্নাহ্।তার সামনেই প্রসন্ন দৃষ্টিতে বসে আছে জাবিন।তিতির মুখে লেপ্টে থাকা আধাসিদ্ধ কুসুমের হলুদাংশ টিস্যু দিয়ে মুছে দিতেই ফিক করে হেসে ফেলে তিতি।জান্নাহ্ চট করেই তিতির কপালে চুমু খায়।গ্লাসে রাখা পানি অতি সন্তর্পনে দুই হাত দিয়ে চেপে ধরে ঢকঢক করে গিলে তিতি।পানি পান করে অধর পল্লব দুটো বৃহৎ ফাঁক করে ভেতর থেকে শ্বাস বের করে।জাবিন আর জান্নাহ্ তিতির এই অদ্ভুত কান্ডে শব্দ করে হাসে।

আজ চারদিন তিতি আর জাবিন সারহানের বাসায়।কিন্তু সারহান!
সে নিরন্তর ঘুরে ফিরছে তার পরীর খোঁজে।সারাটা দিন খুঁজে ফেরে রাতে।কখনো আবার ফেরে না।কলিং বেল বাজতেই সপ্রতিভ হয় জান্নাহ্।হয়তো সারহান ফিরেছে।চঞ্চল পা দুটো চালিয়ে অনেকটা আশা নিয়ে দরজা খুলে সারহান।সারহান ত্রস্ত পায়ে ভেতরে ঢুকতেই নির্মল গলায় জান্নাহ্ বললো–

“সারহান,হাত-মুখ ধুয়ে আসুন।আমি খাবার দিচ্ছি।”

সারহান তার পা দুটো থমকে দেয়।ধমকে উঠে বললো–

“আপনি ভাবলেন কী করে আমি খাবো?লজ্জা করছে না আপনার?আর কী চান আপনি আমার কাছ থেকে?

জান্নাহ্ আহত নয়নে তাকিয়ে ভেজা গলায় বললো—

“সারহান!

“প্লিজ,রজনীগন্ধা।অনেক করেছেন আমার জন্য।আর নয়।এইবার অন্তত আমাকে আমার মতো বাঁচতে দিন।আপনার যা করার আপনি করেছেন।আমাকে শাস্তি দিলেন।আমার ভালোবাসা হেরে গেলো আপনার ঘৃণার কাছে।আমি ব্যর্থ।পারি নি আপনাকে ভালোবাসতে আমি যতটা আপনি চেয়েছেন।”

অসহায় চোখে তাকিয়ে রইলো জান্নাহ্।সারহান লম্বা লম্বা পা ফেলে বেডরুমে চলে যায়।সারহানের আক্রোশভরা স্বরে ভীত হয়ে উঠে তিতি।আঁতকে উঠে জাবিনের কোমর জড়িয়ে ধরে তার পায়ের কাছে মুখ গুঁজে দেয়।বেশ কিছুক্ষণ পর বের হয়ে আসে সারহান।কারো সাথে কোনো বাক্যলাপ হলো না তার।অসহিষ্ণু মনোভাব,উন্মাদ আচরণ,বেসামাল চলাফেরা।

ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে জান্নাহ্।জাবিন নিরুত্তাপ গলায় বললো–

“কেন করছো এইসব জান্নাহ্?কেন মামাকে কষ্ট দিচ্ছো?

জান্নাহ্ মিনমিনে গলায় বললো—-

“আমার কিছু করার নেই জাবিন।”

জাবিন দ্রুত তার পা দুটো বাড়ায়।নিজের রুমে গিয়ে কাপড়-চোপড় গুছাতে হাত থামিয়ে ধরে জান্নাহ্–

“কোথায় যাচ্ছো জাবিন?

ছোট্ট দম ফেললো জাবিন।অত্রস্ত গলায় বললো—

“বাড়ির কেউ ভালো নেই।বিষিয়ে উঠছিলো সব।তাই এখানে এসেছি।ভেবেছি এখানে এসে কয়েকদিন তোমার আর মামার সাথে ভালো থাকবো।কিন্তু তুমি যা করলে তা ঠিক করোনি জান্নাহ্।আমি জানি না তুমি কেন এইসব করেছো।শুধু একটা রিকোয়েস্ট করবো।মামাকে আর কষ্ট দিও না। আমি বয়সে তোমার বড় হলেও সম্পর্কে তোমার ছোট।তবুও আজ বলছি।মামি,যদি পারো মামাকে ক্ষমা করে দিও।”

হনহন করে তিতির হাত ধরে বেরিয়ে যায় জাবিন।জান্নাহ্ গলা ফাটিয়ে বললো—

“জাবিন,জাবিন।প্লিজ দাঁড়াও।যেয়ো না।”

জান্নাহ্ এর কোনো কথাই কর্ণকুহর হলো না জাবিনের।এক মুহূর্তের জন্য পেছন ফিরলো না সে।নিরস্ত্রের মতো মূর্তি হয়ে রইলো জান্নাহ্।গুটি গুটি পায়ে নিজের ঘরে আসে জান্নাহ্।ধীর হাতে মোবাইল হাতে নিয়ে বাগানের দিকে পা বাড়ায় জান্নাহ্।একটা নাম্বারে ডায়াল করে জান্নাহ্।ওপাশের ব্যক্তি রিসিভ করতেই জান্নাহ্ অতটস্থ গলায় বললো—

“কেমন আছো আপু?

মেহনাজ একরাশ খুশি নিয়ে বললো–

“ভালো।তুই কেমন আছিস?

জান্নাহ্ মৃদু হেসে ক্ষীণ গলায় বললো–

“আমার সারহানকে তুমি ক্ষমা করেছো তো আপু?

মেহনাজ উল্লাসিত গলায় বললো—

“করেছি।তুই আমাকে যা দিয়েছিস তার জন্য আমি সারাজীবন তোর কাছে কৃতজ্ঞ।”

নিজের অজান্তেই চোখের জল ছাড়ে জান্নাহ্।কান্নার তোড়ে শরীর কেঁপে উঠে তার।সজোরে কামড়ে ধরে ঠোঁট।জমে যাওয়া গলায় স্বাভাবিকতা এনে বললো–

“পুঁচকো কে একটু দেখতে দিবে আপু?

মেহনাজ আদুরে গলায় বললো—

“দেখবি?
দাঁড়া দেখাচ্ছি।পুঁচকো ঘুমোচ্ছে।”

কল কেটে ভিডিও কল করে মেহনাজ।একটা ছোট্ট লালচে গোলাপী হাওয়াই মিঠাই যেনো শুয়ে আছে।তার ভরাট কপালে একটা কালো চন্দ্রের মতো গোলাকার টিপ।জান্নাহ্ আলতো হাত বুলাতে থাকে মোবাইলের স্ক্রীনে।বুক কাঁপিয়ে কেঁদে উঠে জান্নাহ্।তার প্রাণ যেনো তাকে ছেড়ে যাচ্ছে।বুকের ভেতর অথৈ সাগরের প্রমত্তা ঢেউ।জান্নাহ্ এর মনে হলো তার হৃদপিন্ডটা কেউ টেনে ছিঁড়ে নিচ্ছে।

বাচ্চাটি নড়ে উঠে।কোমল দুই হাত লাল দুই অধর পল্লবের মধ্য ঢুকিয়ে দেয়।ছোট ছোট চোখ দুটি অর্ধ নিমীলিত।জান্নাহ্ তার দৃষ্টি গাঢ় করে।অতলান্তিক মায়ায় আচ্ছন্ন দুই চোখ দিয়ে টপ টপ করে পড়ছে শীতল শ্রাবণ ধারা।
এমন কেন হলো?

চলবে,,,

#জান্নাহ্
#পর্বঃ৭৪
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

বর্ষার নতুন আমেজ শুরু হয়েছে।থৈ থৈ জলে ভরেছে চারপাশ।প্রভাকরের প্রখর তীব্র তাপদাহে ঝলসে যাওয়া পত্রপল্লব সেজে উঠেছে নতুন প্রাণে।বৃষ্টির ফোঁটায় ফোঁটায় যেনো প্রাণের আহ্বান।প্রকৃতি তার রূপ সঞ্জীবনী ফিরে পেয়েছে নতুন আঙ্গিকে।

বর্ষার প্রথম পশলার বৃষ্টিতে ভিজে জবুথবু সারহান।বৃষ্টির আর্দ্রতা তার দেহপিঞ্জরের তপ্ততাকে হার মানাতে পারে নি।অরুণলোচনে তাকিয়ে আছে ইহতিশামের চক্ষু বরাবর।পাশে দাঁড়ানো ইহতিশামের মা,বাবা নির্বাক।ভীতসন্ত্রস্ত ইহতিশামের ছোট ভাই।সারহানের ক্রোধিত কন্ঠে দাপিয়ে উঠে বদ্ধ ঘর।বললো—

“কেন করছিস এইসব?কেন কেড়ে নিলি আমার মেয়েকে?

ইহতিশাম নিরুত্তর।সে অনিমেষ চেয়ে রইলো সারহানের ভেজা মুখটার দিকে।বৃষ্টির ফোঁটা জল চুইয়ে পড়ছে সারহানের এলোথেলো চুল দিয়ে সেই সাথে তার চোখের নোনতা জল।ইহতিশাম মৃদু গলায় বলে উঠে–

“বিশ্বাস কর আমি কিছুই জানি না।আমি ভাবতে পারি নি মেহনাজ এমন একটা কাজ করে বসবে।”

“কি জানতি তুই?কিছু না।কেন কেড়ে নিচ্ছিস আমার শান্তি।অামার মেয়েকে কেন কেড়ে নিলি?কোথায় খুঁজবো আমি ওকে?

ক্রন্দনরত সারহানের দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ইহতিশামের বাবা,মা।ইহতিশাম সরব গলায় বললো—

“আই এম সরি ইয়ার।আমি সত্যি বলছি আই ডোন্ট নো।গত কয়েক মাস ধরে মেহনাজের সাথে আমার সম্পর্ক ভালো যাচ্ছিলো না।ও বাড়ি ছেড়ে যেতেই ভেবেছি আমাকে ছেড়ে চলে গেছে রাগ করে ওর বাবার কাছে।কিন্তু ও যে এমন একটা কাজ করবে আমি ভাবনাতেও আনি নি।”

ধপ করে কাউচের উপর বসে সারহান।দুই হাতে মাথার চুল টেনে ধরে অসহায় গলায় বললো—

“তোরা সবাই আমার পেছনে কেন লাগলি বলতো?এই পৃথিবীতে কী কারো ভালোবাসার যোগ্য নই আমি?যাকে নিজের থেকেও বেশি ভালোবেসেছি সে মানুষটাও আমাকে ধোঁকা দিলো।কাকে বিশ্বাস করবো আমি বলতো?কাকে?

ইহতিশাম নিঃশব্দে সারহানের পাশে বসে।বাঁধাহীন সুরে বললো–

“জান্নাহ্ এর চেয়ে বেশি তোকে কেউ ভালোবাসেনি সারহান।মেয়েটা এই বয়সেও তোর জন্য কম কিছু করে নি।একবার ওর দিকটা ভাব।কতোটা কষ্ট চেপে রেখে নিজের সদ্য জন্ম নেওয়া সন্তানকে আরেকজনের হাতে তুলে দিয়েছে!

“এখন আমি কী করবো বলতো?মেহনাজ কেন এমন করলো?

ইহতিশাম নরম গলায় বললো–

“আমি ওকে কখনো ক্ষমা করবো না।জান্নাহ্ এর মেন্টাল কন্ডিশন ঠিক নেই।প্রেগন্যান্সিতেও মেয়েটা কম কষ্ট ভোগ করে নি।ডিপ্রেসড ও।মেহনাজ কী থেকে কী বলেছে।কে জানে!

সারহান কাতর গলায় বললো–

“এখন আমি কী করবো বলতো?আর কতো শাস্তি দিবি তোরা আমাকে। আমার মেয়েকে ফিরিয়ে দে ইহতিশাম।আমি ওকে এখান থেকে নিয়ে অন্য কোথাও চলে যাবো।আর কখনো আসবো না তোদের মাঝে।কথা দিলাম তোকে আমি।”

ইহতিশাম আশ্বস্ত গলায় বললো—

“ভরসা রাখ আমার উপর।আমি তোর মেয়েকে খুঁজে বের করবো।”

তাচ্ছিল্য গলায় সারহান বললো—

“কার উপর ভরসা রাখবো আমি!যখন যাকে ভরসা করেছি সেই সুযোগ নিয়েছে আমার।আমার এই নোংরা জীবনের জন্য কী শুধু আমিই দায়ী?
আমার পরীকে ফিরিয়ে দে আমায়।আমি সারাজীবন তোর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবো।”

ইহতিশাম নির্বিকার গলায় বললো–

“শান্ত হ সারহান।আমি কথা দিচ্ছি তোকে।তোর মেয়েকে আমি ফিরিয়ে আনবো।জান্নাহ্ নিশ্চয়ই জানে মেহনাজ কোথায় আছে?

সারহান বিতৃষ্ণা গলায় প্রত্যুক্তি করে–

“জানি না।জানি না আমি।আমি শুধু আমার মেয়েকে ফেরত চাই।চলে যাবো তোদের দৃষ্টি সীমার বাইরে।এখান থেকে অনেক দূরে।কখনো ফিরবো না আর।শুধু আমার রক্তকে ফিরিয়ে দে আমায়।আমি যদি ওকে না দেখে মরে যাই আমার আত্নাও যে শান্তি পাবে না ইহতিশাম।”
,
,
,
গাঢ় অন্ধকার ক্রমশ প্রগাঢ় হতে লাগলো।অন্ধকার রাত্রিতে এক বাবা তার সন্তানকে পাওয়ার আশায় ঘুরে বেড়ায় শহর রাস্তার অলিতে গলিতে।তার সঙ্গী হয় রাস্তার বেওয়ারিশ কুকুর।

শ্রান্ত-পরিশ্রান্ত সারহান মধ্য রাতে ফেরে ঘরে।নিমিঝিমি তার চোখ,ঢুলুঢুলু তার দেহ।গায়ে বিশ্রি মদের গন্ধ।নিজের কষ্ট ভুলতে নাকি মানুষ পানশালায় যায়।তাই আজ সারহানও তাই করলো।যে সারহান পাব,বার আর নৈশ হোটেলে কোনায় কোনায় জীবনের অর্ধেকটা সময় কাটিয়েও কখনো এইসব জিনিস ছুঁয়েও দেখেনি আজ সেই নিষিদ্ধ জিনিসই তার রাতের সঙ্গী।

বেডরুমে অগোছালো হয়ে গভীর তন্দ্রায় আচ্ছন্ন জান্নাহ্।ধীর পায়ে তার পাশে বসে সারহান।জান্নাহ্ এর মুখটা দেখে মনে হলো হাজার বছর পর সে তার রজনীগন্ধাকে দেখছে।নেশার্ত সারহান তার আঙুল ছোঁয়াতে থাকে জান্নাহ্ এর শুষ্ক ঠোঁটে।নড়ে উঠে জান্নাহ্।এতোটা কাছে সারহানকে দেখে ভড়কে উঠে সে।ভীত চোখ দুটো প্রশ্বস্ত করতেই তার অধর জুড়ে আর্দ্রতা মাখিয়ে দেয় সারহান।নেশার্ত সারহান বেসামাল।তার ছোঁয়ায় ক্রমশ সক্রিয় হয়ে উঠে জান্নাহ্ এর থিতিয়ে থাকা অনুভূতি।জান্নাহ্ এর অধর ছেড়ে তার গলার দিকটায় আর্দ্র অধরের স্পর্শ আঁকে সারহান।জড়িয়ে ধরে সারহানকে জান্নাহ্।

আচমকায় নেশায় বিভোর সারহান ধাক্কা মারে জান্নাহ্কে।হতচকিত জান্নাহ্ আঁতকে স্তব্ধ হয়ে যায়।সারহান নেশার্ত গলায় ক্ষীণ আওয়াজে বললো—

“চলে যান এখান থেকে,চলে যান।কাউকে চাই না আমার।কাউকে না।সারহান আর কোনোদিন কাউকে ভালোবাসবে না।কোনোদিনও না।যেখানে ইচ্ছে চলে যান আপনি।মুক্তি চেয়েছেন আপনি তাই না?দিলাম আপনাকে মুক্তি।আজ থেকে আপনি মুক্ত।আমার ভালোবাসা থেকে মুক্ত।আমার বুকের শ্বাস থেকে মুক্ত।আমার হৃদয়ের স্পন্দন থেকে মুক্ত।আমার দুঃখিত চোখের নহর থেকে মুক্ত।আমার অস্তিত্ব থেকে মুক্ত আপনি।সারহানের জীবন থেকে মুক্ত আপনি।তার রজনীগন্ধা থেকে মুক্ত আপনি।চলে যান এখান থেকে,চলে যান।”

হৃদয়ের রুদ্ধদ্বার ভেঙে কেঁদে উঠে জান্নাহ্।তার প্রাণের এই অবস্থার জন্য সেই দায়ী।শরীর কাঁপিয়ে কেঁদে উঠে জান্নাহ্।বেডরুম থেকে বেরিয়ে লিভিং রুমে আসে জান্নাহ্।উন্মাদের মতো কাঁদতে থাকে।নিজের প্রাণকে দায় মুক্ত করতে তার প্রাণপাখিকেই কেড়ে নিলো তার থেকে।হাঁপিয়ে উঠে জান্নাহ্।মাথাটা কাউচে এলিয়ে দিতেই চোখ বুজে আসে তার।
এ ঘুম না তার শেষ ঘুম হয়!

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here