অন্য বসন্ত ( পঞ্চম পর্ব )
ঈপ্সিতা মিত্র
<৪>
কিন্তু কেউ কি আস্তে আস্তে দূরে সরে যাচ্ছে ! আর দূরে সরে যাচ্ছে বলেই কাছে ধরে রাখার এতো বেশি চেষ্টা ! কৃষ্ণেন্দুকে নিয়ে দীপ্তির আজকাল মাঝের মধ্যে এরকমই মনে হয় | ঠিক বুঝতে পারে না কিভাবে অল্প অল্প করে দুজনের মাঝে একটা ছায়াপথ তৈরী হচ্ছে ! কিভাবে কিলোমিটারের পর কিলোমিটার ধরে শূন্যতা এসে জড়ো হচ্ছে সেই ছায়াপথে ! দীপ্তি মেলাতে পারে না আজকাল কিছু | এর কারণ খুঁজে পায় না কোনোভাবেই ! কৃষ্ণেন্দু এতো বেশি বদলে যাচ্ছে ওর চোখের সামনে , প্রত্যেকদিন ! যে সব কিছুই আজকাল অচেনা লাগে ওর | এই যেমন সেইদিন , শুক্রবার , ওদের অফিসের ওই ছোট্ট ক্যান্টিনটায় , দীপ্তি রোজকার মতন ওই দুপুরের দিকে এক কাপ কফি নিয়ে বসেছিল আনমনে | তখনই হঠাৎ অনিকেত এসে হাজির | ও প্রথমে খেয়াল করেনি ! তবে অনিকেত যখন ওর সামনে এসে বলে উঠলো , ——— ” কফিহাউস তো মিস হয়ে গেলো ! তবে ক্যান্টিনের কফিটা একসঙ্গে খাওয়া যেতেই পারে | আপত্তি নেই তো কোনো ?”
দীপ্তির এতগুলো কথা শুনে সেদিন সম্ভিত ফিরেছিল হঠাৎ | ও একটু হেসে বলে উঠলো , ———– ” আপত্তির কি আছে ! প্লিজ বসো | ”
কথাটা শুনে অনিকেতও আর অপেক্ষা না করে সামনের চেয়ারটার বসে পড়লো হাসি মুখে | তারপর বেশ ক্লান্ত সুরে বলে উঠলো , ———— ” এতো হিসাব মেলাতে হয় রোজ ! আর ভালো লাগে না সব সময় | মাঝে মাঝে মনে হয় বাংলা নিয়ে পড়লেই বোধ হয় ভালো হতো | ইকোনমিক্স একটা কাঠখোট্টা সাবজেক্ট | ”
দীপ্তি এর উত্তরে আর একটা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে উঠলো ওকে , ————- ” তাহলে পড়লে কেন এই কাঠখোট্টা সাবজেক্ট নিয়ে ? বাংলা নিয়ে পরে লেখক হতে পারতে !”
অনিকেত এরকম প্রশ্ন শুনে একটু আফশোস করেই বললো এবার , ——— ” আরে , ইচ্ছে তো তাই ছিল | কিন্তু বাবা হতে দিলো কই ! ক্লাস টেন থেকেই কমার্স কমার্স করে মাথা খারাপ করে দিলো আমার | বাবার যেহেতু কমার্স ছিল , আমাকেও তাই নিতে হবে | বিধির বিধান |”
দীপ্তির কথাটা শুনে হাসি পেয়ে গেলো এবার | ওর হাসিটা দেখে অনিকেত একটু দুঃখী মুখেই বললো , ———— ” আমার ট্র্যাজেডিতে এই ভাবে হাসছো তুমি ! আমার লাইফটা তো লাভ ক্ষতির হিসেবের মাঝেই কেমন ঘেঁটে ঘ হয়ে গেলো !”
দীপ্তি এই কথাটা শুনে এবার আরো জোরে হেসে ফেললো | এই মুহূর্তে ও ঠিক খেয়াল করেনি কখন ক্যান্টিনের দরজার পাশ দিয়ে কৃষ্ণেন্দু যাচ্ছিলো ! বোঝেনি কখন কৃষ্ণেন্দু ওদের দুজনকে গল্প করতে , হাসাহাসি করতে দেখে ফেলেছিলো ! বোঝেনি যে এই দৃশ্য দেখে কৃষ্ণেন্দুর রাগের পারদটা হঠাৎ কেন চড়েছিল ! কেন ও আচমকা এসে অনিকেতকে ঐভাবে সবার সামনে অপমান করে দিয়েছিলো কিছু না ভেবেই ! দীপ্তির এখনও কথাগুলো যেন কানে বাজছে ! কৃষ্ণেন্দু ওদের কথার ভিড়ে হঠাৎ এসে দাঁড়িয়েছিল ক্যান্টিনে | তারপর খুব কঠিন গলায়ই অনিকেতকে বলে উঠেছিল , ———– ” তোমাকে কি অফিসে মাইনে দিয়ে রাখা হয়েছে এইভাবে ওয়ার্কিং আওয়ার্স এ টাইম পাস্, হাসাহাসি করার জন্য ? একটুও কাজের ব্যাপারে সেন্স অফ রেসপন্সিবিলিটি কাজ করে না ! এইরকম চললে আমাকে তোমার ব্যাপারে ভাবতে হবে | তোমাকে আর এই অফিসে রাখবো কি রাখবো না ! এন্ড ভুলে যেও না , তোমার মতন হাজার হাজার ছেলে সিভি নিয়ে অপেক্ষা করে আছে এইরকম একটা চাকরির জন্য | দু মিনিটও লাগবে না কিন্তু আমার তোমার জায়গায় অন্য একজনকে এপয়েন্ট করতে |”
কৃষ্ণেন্দুর এক টানা কথাগুলো শুনে দীপ্তির যেন ধাক্কা লেগেছিলো হঠাৎ | কৃষ্ণেন্দুর এইরকম রূপ যে কোনোদিনও ও দেখবে , ভাবেনি জীবনে ! কিভাবে বললো এই কথাগুলো ও একজনকে ! দীপ্তি এই মুহূর্তে অবাক হয়েই ওকে থামানোর জন্য বলে উঠলো , ———- ” কৃষ্ণেন্দু প্লিজ ! অনিকেত এই মাত্র এই ক্যান্টিনে এসেছে | আর সারাদিন এতো কাজের মধ্যে কি কারোর এক কাপ কফি খাওয়ারও স্বাধীনতা থাকবে না !”
কৃষ্ণেন্দু এই কথাটা শুনে যেন আরো বেশি রেগে গেলো এখন | ও বেশ ঝাঁঝিয়েই দীপ্তিকে বললো এবার , ———- ” এটা আমার অফিস | অফিসের বাইরে তোর আর আমার যেই রিলেশনই থাকুক না কেন , সেটা পার্সোনাল | কিন্তু সেটার জন্য তুই আমাকে এটা বোঝাতে পারিস না যে আমি অফিসে আমার এমপ্লয়িদের সাথে কিভাবে বিহেভ করবো | আফটার অল স্যালারিটা আমিই দিচ্ছি | তাই কাজ বুঝে নেয়াটা আমার রাইট | তাই প্লিজ ইন্টারফেয়ার করিস না | আর করলেও আমি শুনবো না |”
দীপ্তি এতো কথা শোনার পর ঠিক কি উত্তর দেবে বুঝতে পারলো না ! কৃষেন্দু এতদিন বাদে এসেছে ওকে ওর এক্তিয়ার বোঝাতে অফিসে ! এটাই কি বাকি ছিল তাহলে শুধু ! কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই কৃষ্ণেন্দু ওর চোখের পলকে ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে গেলো সেই মুহূর্তে | দীপ্তি কিরকম নিশ্চুপ অসাড় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষন এক জায়গায় | অনিকেতও এবার কিছু না বলে আস্তে আস্তে ক্যান্টিনটা খালি করে নিজের ডেস্কে চলে গেলো | দীপ্তি খেয়াল করলো ছেলেটার মুখটা অপমানে লাল হয়ে গেছে যেন | কৃষেন্দু জানতো , এই ছেলেটা দীপ্তিকে ওর বিপদে কিভাবে সাহায্য করেছিল সেইদিন ! তা ও এইভাবে কথা শোনালো ওকে ! কিছু আর বলার নেই | সব যেন আস্তে আস্তে শেষ বলে মনে হচ্ছে দীপ্তির |
তবে কৃষ্ণেন্দু সেদিন নিজের কেবিনে ফিরেও রাগটা কিছুতেই ভুলতে পারছিলো না নিজের | সকালের শোনা কথাগুলো আর ক্যান্টিনের দৃশ্যটা কেমন মিলেমিশে এক হয়ে যাচ্ছিলো ওর কাছে | সকালবেলা আজ অফিসে আসার পরই তৃষা ওকে আলাদা করে ডেকে বলেছিলো ব্যাপারটা | তৃষা ওর ভালো চেয়েই হয়তো কথাগুলো শেয়ার করেছিল ! এখনো যেন প্রত্যেকটা শব্দ কানে বাজছে কৃষ্ণেন্দুর | তৃষা হঠাৎ অফিশিয়াল কথার বাইরে বেরিয়েই ওকে বলে উঠেছিল , ———— ” কৃষ্ণেন্দু , কিছু মনে কোরো না ! তোমাকে একটা কথা বলা উচিত বলে আমার মনে হয়েছে এজ এ ফ্রেন্ড | তাই বলছি | আসলে দীপ্তি আর ওই নতুন অফিসে আসা ছেলেটা , কি যেন নাম ! হ্যাঁ , অনিকেত | ওদের দুজনের মধ্যে এখন একটু বেশিই বন্ধুত্ব হয়েছে বলে আমার মনে হয় | একচুয়ালি আমার না , অফিসে সবাই ব্যাপারটা খেয়াল করেছে | এই নিয়ে কথাও বলছে লোকজন টুকটাক | ওরা তো এখন রোজ অফিস থেকে একসাথেই বেরোয় | মাঝে মাঝেই সামনের কফিশটায়ও হয়তো যায় ! না , আমি বলছি এতে দীপ্তির কোনো দোষ আছে | হয়তো ছেলেটাই একটু বেশি ইন্টারেস্ট দেখাচ্ছে ! আর অফিসে তো সবাই জানে তোমার আর দীপ্তির রিলেশনের ব্যাপারে | কিছুদিন বাদে তোমরা আবার বিয়েও করবে ! তাই এই একটা ছেলের সঙ্গে ওর এতো ইনভল্ভমেন্ট দেখে স্বাভাবিকভাবেই অফিসের বাকিরা কথা বলছে এই ব্যাপারটা নিয়ে | তুমি দীপ্তিকে বুঝিয়ে আলাদা করে | নইলে ছেলেটাকে বুঝিয়ে দিয়ো ওর জায়গাটা এই অফিসে কি ! কেন ও এখানে আসে ! এজ এ বস , তুমি এইটুকু তো বলতেই পারো | ”
হ্যাঁ , ঠিকই তো | কৃষ্ণেন্দু পারে | অনিকেতকে নিজের জায়গাটা ভালো করে বুঝিয়ে দিতে পারে ও | আর সেটাই করেছে আজ | আর শুধু আজ কেন , এরপর যখন প্রয়োজন মনে করবে , তখনই করবে | এই ভেবেই আজ জেনে বুঝে অপমানটা করেছে কৃষ্ণেন্দু অনিকেতকে | কিন্তু দীপ্তি ! দীপ্তি দুদিনের চেনা এই ছেলেটার জন্য ওর সঙ্গে তর্ক করলো ! সবার সামনে ওকে প্রশ্ন করলো ! কি ব্রেন ওয়াশ করেছে এই অনিকেত কে জানে ওর ! আর কৃষ্ণেন্দু নিজের কাজের মধ্যে এমন হারিয়ে থাকে যে এইসব তো খেয়াল ও করে না কখনো ! যদি আজ তৃষা ব্যাপারটা ওকে না জানাতো , তাহলে হয়তো কোনোদিনই নোটিশ করতো না কিছু ! হ্যাঁ , মানছে | ও সময় কম দেয় দীপ্তিকে | এতো কাজের চাপে টাইম স্পেন্ড করা হয় না একসঙ্গে বিশেষ | কিন্তু কৃষ্ণেন্দু আজ যা করছে , সেটা তো ওদের দুজনের জন্যই করছে ! একটা ভালো লাইফস্টাইল , বড়ো বিজনেস , এইসব করে তো ও ওদের দুজনের লাইফটাই সিকিয়োর করার চেষ্টা করছে | শুধু প্রেম দিয়ে তো আর জীবন চলে না | প্র্যাকটিকাল লাইফে বাঁচতে গেলে হিসাব করেই বাঁচতে হয় | কিন্তু দীপ্তি কি এইসব বোঝে না ! ও কি শুধু আজকাল বাইরেটাই দেখে ! কোনো ছেলে দুদিন ভালোভাবে কথা বললে , হাসি মজা করলেই সে ওর চোখে ভালো হয়ে যায় ! আর যেই ছেলেটা ওদের ফিউচারের কথা ভেবে সারাদিন কাজ করছে , সে ওর কাছে দামহীন হয়ে যাচ্ছে ! প্রশ্নগুলো আনমনেই এসে ভিড় করলো আজ কৃষ্ণেন্দুর মনে | আর ভেতরে ভেতরে রাগ আর কষ্টের জ্বালাটা যেন বেড়ে গেলো হঠাৎ কেমন | মনে হচ্ছে , যা হচ্ছে , সব কিছুর জন্য ওই ছেলেটাই দ্বায়ী | ওই অনিকেত | একদিন হেল্প করে দীপ্তির চোখে মহান সেজে ঘুরে বেড়াচ্ছে রোজ ওর সামনে | কিন্তু না | এইরকম করে আর চলবে না | কৃষ্ণেন্দু শেষ করে দেবে ওর গেমটা | জিততে দেবে না ওকে |
সেদিন এরপর কৃষ্ণেন্দু বাড়ি ফিরে সোজা দীপ্তির ঘরে গিয়েছিলো | ও বই পড়ছিলো একটা | এখন সন্ধ্যে সাতটা বাজে | এতো তাড়াতাড়ি কৃষ্ণেন্দু বাড়ি এসেছে দেখে ও বেশ অবাক হয়ে গিয়েছিলো যেন | বইটা টেবিলে রেখে নিজেই তাই জিজ্ঞেস করেছিল , ———- ” তুমি ? এতো তাড়াতাড়ি বাড়িতে এলে ? কি হয়েছে ?”
কৃষ্ণেন্দু এর দৃঢ় গলায় উত্তর দিয়েছিলো , ————- ” কেন ? আজকাল আমার জায়গায় অন্য কাউকে এক্সপেক্ট করিস ?”
দীপ্তির কথাটা শুনে আর একবার ধাক্কা লাগলো | ও নিজেও এবার বেশ দৃঢ় গলায় বললো , ———– ” কি বলতে চাইছো ? ডিরেক্টলি বলো | ঘুরিয়ে কথা বলার দরকার নেই কোনো |”
কৃষ্ণেন্দু এবার ওর চোখে চোখ রেখেই উত্তর দিলো , ————– ” অনিকেতের সঙ্গে কি চলছে তোর ? আজকাল না কি ওর সঙ্গেই অফিস থেকে বেরোস রোজ | একসাথে কফি শপে যাস | না , ভাবিস না আমি তোর ওপর স্পাই করছি | অতো সময় নেই আমার | আসলে অফিসে এই নিয়ে এখন সবাই কথা বলছে | তৃষা এসে বললো আজ সকালে | নইলে হয়তো জানতেই পারতাম না এতো কিছু !”
দীপ্তি কথাগুলো শুনে কয়েক সেকেন্ড যেন নিঃস্তব্ধ ছিল | সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে সে কৃষ্ণেন্দুই তো ! সন্দেহ হচ্ছিলো ওর | তা ও কয়েক মুহূর্তে নিজেকে সামলে ও কিছু কথা ভেবে বলে উঠলো ,
———- ” একজন বাইরের লোকের কথা শুনে যদি তোমার এটাই মনে হয় যে আমার কারোর সঙ্গে কিছু চলছে , তাহলে এই নিয়ে কোনো রকম এক্সপ্লিনেশন দেয়ার মতন কিছু নেই আমার | তোমার যদি এটা ভেবে ভালো লাগে , মনে হয় যা বিশ্বাস করছো সেটা ঠিক , তাহলেই সেটাই করো | আমি কিছু বলবো না |”
কৃষ্ণেন্দু দীপ্তির এইরকম কথা শুনে অবাক হয়ে গিয়েছিলো যেন ! দীপ্তি নিজের মুখে একবারও বললো না যে ও যেটা ভাবছে সেটা ভুল ! ওর কাছে কি তাহলে এই রিলেশনটার কোনো দাম নেই এখন ! কৃষ্ণেন্দু এইভাবে ওর থেকে দূরে সরে গেলেও ওর কিছু যায় আসে না ! এইসব ভাবনার ভিড়েই ও এবার বলে উঠলো দীপ্তিকে খুব কঠিন গলায় ,
————- ” তুই যদি আমাকে ইম্পরট্যান্ট ভাবিস তোর লাইফে , যদি আমার কোনো রকম ভ্যালু থেকে থাকে তোর কাছে , তাহলে তুই আর কাল থেকে ওই ছেলেটার সাথে কথা বলবি না | আমি চাই না তুই ওর সঙ্গে আর একটা ওয়ার্ডও এক্সচেঞ্জ করিস | আমাদের রিলেশনটা যদি তোর কাছে দামি হয় , তাহলে আমি যেটা বললাম সেটাই তুই করবি |”
কথাটা শেষ করেই কৃষ্ণেন্দু এবার চলে যেতে যাচ্ছিলো ওই ঘরটা ছেড়ে | মনে হচ্ছে যা বলার ও বলে দিয়েছে | এরপর আর শোনার মতন কিছু নেই কৃষ্ণেন্দুর | কিন্তু দীপ্তির কথায় ও থমকে গেলো হঠাৎ | দীপ্তির কাছ থেকে এরকম কিছু কথা ও আজ এক্সপেক্ট করেনি একদম | তবে দীপ্তিও হয়তো হার্ট হতে হতেই সেইদিন এই কথাগুলো বলে দিয়েছিলো কৃষ্ণেন্দুকে | মনে হয়েছিল আজ না বললে ওর আত্মসম্মানটা শেষ হয়ে যাবে | যেটা দীপ্তি কিছুতেই হতে দেবে না | তাই খুব দৃঢ় গলায় বলেছিলো ও , ———– ” আমি এতোদিনেও যদি তোমাকে এটা প্রমাণ করতে না পারি যে তুমি আমার লাইফে কতটা ইম্পরট্যান্ট ! আমাদের এই রিলেশনটা আমার কাছে ঠিক কি ! তাহলে সরি , হয়তো কোনোদিনওই সেটা আমি তোমাকে বিশ্বাস করাতে পারবো না | আর হ্যাঁ , অনিকেতের সাথে আমি নিশ্চই কথা বলবো | যেরকম এতদিন বলে এসেছি , সেইভাবেই বলবো | এবার তুমি ঠিক কোরো তুমি কাকে বিশ্বাস করবে ! যাকে দুদিন চেনো , তাকে : না কি যাকে বছরের পর বছর ধরে দেখেছো , তাকে |”
কৃষ্ণেন্দুর কথাটা শুনে আর কিছুই ঠিক বলার ছিল না সেই মুহূর্তে | দীপ্তি এই প্রথম জীবনে ওকে মুখের ওপর ‘না’ বললো কোনো ব্যাপারে | তা ও ওই অনিকেতের জন্য | দীপ্তি বুঝিয়ে দিলো কে বেশি দামি | কৃষ্ণেন্দু এরপর আর একটাও কথা না বলে বেরিয়ে গেলো ঘরটা থেকে | তবে দীপ্তি অনেকক্ষন দাঁড়িয়ে রইলো সেইদিন স্থিরভাবে এক জায়গায় | কিছুতেই আর এক পা ও এগোতে পারলো না যেন ও | ভেতর থেকে ভাঙছিল কিছু একটা খুব জোরে জোরে আজ | কাঁচের টুকরোগুলো ছড়িয়ে পড়ছিলো চারদিকে ওর | আর দীপ্তি সেই ভাঙা টুকরোগুলোর মধ্যে দাঁড়িয়েছিল স্থিরভাবে | নিঃস্তব্ধভাবে দেখছিলো একটা অনেকদিনের পুরনো সম্পর্কের ভাঙ্গন |
এরপর কটা দিন কেটে গেছে ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে | তবে এই দিনগুলোতে দীপ্তি আর কৃষ্ণেন্দু দুটো বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতন হয়ে গেছে আস্তে আস্তে | যারা একে অপরকে দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখে শুধু | কিন্তু কেউ কারোর কাছে আর যায় না | কথা বলে না | দীপ্তির মাঝে মাঝে এটা ভেবে আশ্চর্য লাগে যে তৃষা সত্যি করে দেখালো ! দীপ্তি ভাবতো ওদের দুজনের সম্পর্কটা এতটা শক্ত , এতটা দৃঢ় , যে বাইরের কেউ কোনোভাবে কখনো ওদের মাঝে দেয়াল তুলে দিতে পারবে না | কিন্তু তৃষা ওকে স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দিলো , যে এতদিনের ভাবনাগুলো কতটা ভুল ছিল দীপ্তির | বুঝিয়ে দিলো কতটা পলকা ওদের সম্পর্ক , কৃষ্ণেন্দুর বিশ্বাস ! যেটা একটা ছোট্ট ধাক্কায়ই ভেঙে যায় | তবে দীপ্তি নিজে আর এই এই ভাঙাচোরা বিশ্বাসকে জোড়ার চেষ্টা করবে না | এইভাবে জোর করে , চেষ্টা করে , নিজেকে বার বার এক্সপ্লেন করে কারোর মনে নিজের জায়গা তৈরী করা যায় না | তাই দীপ্তি সেদিনের পর থেকে নিজেও দূরত্বটা মেপেই চলতো কৃষ্ণেন্দুর থেকে | তবে আজ যেটা হলো , সেটা দেখে দীপ্তি কিছুতেই আর চুপ থাকতে পারলো না যেন | আজ ওকে নিজে থেকে গিয়ে কৃষ্ণেন্দুর সঙ্গে কথা বলতেই হলো | এই কোম্পানির প্রায় পঁচিশ জন পুরোনো এমপ্লইকে কৃষ্ণেন্দু স্যাক করেছে | যেই মানুষগুলো ওর বাবার আমল থেকে কৃষ্ণেন্দুদের কোম্পানিতে কাজ করতো , যারা যেভাবে হোক , কৃষ্ণেন্দুর বাবা মারা যাওয়ার পর এই কোম্পানিটাকে ভীষণ ছোটোভাবে হলেও বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করেছিল , যারা একরকম চেয়েচিন্তে কোম্পানির ওই ভীষণ খারাপ সময়ে অর্ডার জোগাড় করে নিয়ে আসতো , যাতে এই ব্যবসায় তালা না পরে কখনো , কৃষ্ণেন্দু সেই বয়স্ক মানুষগুলোর কাছ থেকে তাদের কাজ নিয়ে নিলো আচমকা ! খবরটা যখন সকালে অফিসে এসে পেয়েছিলো দীপ্তি , ও বুঝতে পারছিলো না কিভাবে রিয়াক্ট করবে ! কৃষ্ণেন্দু তো এদের পুরো নিজের বাবা কাকার মতন করে ব্যবহার করতো | এমন কি কোনোদিনও ওদের নিজেকে ‘স্যার’ বলে ডাকতেও দেয়নি | এতদিন ওই অমল জেঠু , পরিতোষ জেঠুরা ওকে কৃষ্ণেন্দু বলে ডেকে এসেছে | আর আজ কি করে সেইসব লোকগুলোকে ও কোম্পানি থেকে চলে যেতে বললো ! কোন মুখে বললো ! ভাবতে পারছে না দীপ্তি | তাই ও নিজে আজ কৃষ্ণেন্দুর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো | কৃষ্ণেন্দু নিজের কেবিনে কিছু ফাইল চেক করছিলো | দীপ্তিকে হঠাৎ দরজা খুলে ওর দিকে এগিয়ে আসতে দেখে ও একটু গম্ভীর হয়ে বলে উঠলো এবার , ———– ” কি ব্যাপার ? হঠাৎ আমার কেবিনে ? দরকার ছিল কোনো ? এমনি কথা তো মনে হয় আজকাল নেই আর আমাদের মধ্যে | সেইসব তো একটা বাইরের ছেলের সাথে হয় আজকাল |”
দীপ্তির এই শেষের কথাগুলো কানে ভীষণ লাগলেও ও আর সেই নিয়ে কোনো তর্কে গেলো না | ও খুব দৃঢ়ভাবে আজ কৃষ্ণেন্দুর সামনে দাঁড়িয়ে | আর সেই দৃঢ়তা নিয়েই ও জিজ্ঞেস করে উঠলো ,
———— ” ঠিকই বলেছো | দরকার ছাড়া আমার সত্যি তোমার সাথে আর বিশেষ কোনো কথা নেই | আর দরকারটা এটাই যে তুমি কেন অমল জেঠু , পরিতোষ জেঠু , নির্মাল্য জেঠু , শিশির কাকা , এদের সবাইকে একসঙ্গে কোম্পানি থেকে স্যাক করে দিলে ? কি করে করলে তুমি এটা ? তুমিও জানো এই কোম্পানির যখন প্রচন্ড খারাপ অবস্থা ছিল , ওরা কিভাবে এসে পাশে দাঁড়িয়েছিল | কিভাবে ওরা এক একটা ছোট ছোট অর্ডার জোগাড় করে ব্যবসাটাকে বন্ধ হতে দেয়নি | তাহলে কি করে তুমি ওদের চাকরিটাকে নিয়ে নিলে কৃষ্ণেন্দু ?”
দীপ্তি প্রায় এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে গেলো কৃষ্ণেন্দুকে | কৃষ্ণেন্দু এবার কিছুক্ষন সময় নিয়ে ওকে বলে উঠলো , ——– ” দ্যাখ , তোর প্রব্লেমটা এটাই যে তুই সব কিছুকে ভীষণ ইমোশনালি দেখিস | আর এটা একটা ব্যবসা | আমাকে এখানে ব্রেনটা খাটিয়েই কাজ করতে হবে | নইলে টিকে থাকতে পারবো না | আর এই ডিসিশনটা আমি আর তৃষা দুজনে মিলে নিয়েছি | ওরা কেউ কম্পিউটারের ইউজ জানে না | পুরোনো দিনের লোক | ওদের কারোর কাছেই ঠিকঠাক ডিগ্রি অব্দি নেই এই কোম্পানিতে কাজ করার মতন | হ্যাঁ , প্রথমে এই কথাগুলো আমার মাথায় আসেনি | তবে তৃষা যখন পয়েন্টগুলো বললো , আমি সেটা না ও করতে পারলাম না ! আর ওরা আমাদের কোম্পানির জন্য সত্যি অনেক কিছু করেছে | সেটাকে তো আমি অস্বীকার করছি না | ওদের তিন মাসের এডভান্স স্যালারি দিয়েই আমি রিলিস করেছি | এরপর তো কোম্পানি ওদের সারা জীবনের দ্বায়িত্ব নিতে পারবে না | ওদের জায়গায় কোনো ঠিকঠাক এফিশিয়েন্ট লোককে হায়ার করলে আমাদের কোম্পানির অনেক বেশি লাভ হবে | ”
দীপ্তি কৃষ্ণেন্দুর কথাগুলো শুনে দু মিনিট নিঃস্তব্ধ ছিল যেন | এতো যুক্তির কি উত্তর দেবে ও ! একটা পুরোপুরি হিসেব কষা মানুষের সামনে কিভাবে একটু মন থেকে ভাবার কথা বলবে ! তা ও শেষ বারের মতন চেষ্টা করলো দীপ্তি | কিছু কথা ভেবে উত্তর দিলো , ———– ” কৃষ্ণেন্দু , একবার একটু পুরোনো দিনগুলোর কথা ভাবো | এরকম এমপ্লয়ি তুমি হাজার সার্টিফিকেট দেখে , হাজার ইন্টারভিউ নিয়েও পাবে না | এরা টাকার জন্য এই কোম্পানিতে কাজ করেনি | তার থেকেও বেশি তোমার বাবাকে ভালোবেসে , তোমার কোম্পানিকে ভালোবেসে কাজ করেছে | আর কম্পিউটার জানে না ঠিকই , কিন্তু সেটা জানতেই বা কতক্ষন | একটা ছোট ওয়ার্কশপ করলেই সেটা শিখে নেয়া যায় | এর মানে তো এই না যে তাদের কাছ থেকে তাদের কাজটাই নিয়ে নিলাম ! আর যারা খারাপ সময়ে পাশে ছিল , তাদেরকে এইভাবে নিজের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিয়ো না | তৃষা এই কোম্পানিতে তো এই হালে এসেছে ! কত টুকু চেনে ও এখানকার লোকেদের ! কত টুকু জানে ও এই কোম্পানির স্ট্রাগলের ব্যাপারে ! মানছি , ওরা ফিন্যান্স দিচ্ছে কোম্পানিকে | কিন্তু তার মানে এই না যে ওদের কথায় এতো পুরোনো পুরোনো লোকগুলোকে সরিয়ে ফেলতে হবে ! রিপ্লেসমেন্ট খুঁজতে হবে !”
দীপ্তি প্রায় এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে গেলো কৃষ্ণেন্দুকে | ভেবেছিলো এতো কিছু শুনে অন্তত কৃষ্ণেন্দুর ডিসিশনটাকে বদলাতে পারবে ও | তবে আজকাল এই ছেলেটাকে নিয়ে ওর কোনো ভাবনাই মেলে না বিশেষ | আর সেই একই জিনিসটা আজও হলো | কৃষ্ণেন্দু এতকিছু শোনার পরও ওকে সেই হিসেবের উত্তরই দিলো | দীপ্তির চোখে চোখ রেখেই বলে উঠলো ,
————- ” এটা পসিবল না | আমি এখন কজন এমপ্লইকে রাখার জন্য আলাদা করে ওয়ার্কশপের খরচ করতে পারবো না | হ্যাঁ , আমি ওদের খুব রেসপেক্ট করি | আমি গ্রেটফুল ওদের কাছে , যে বাবা মারা যাওয়ার পরেও ওরা প্রচন্ডভাবে এই কোম্পানির সাথে ছিল | কিন্তু তার মানে এই না যে আমি কোম্পানির লস করে ওদের রেখে দেব দিনের পর দিন | আর তৃষা শুধু আমাকে পয়েন্ট গুলো বুঝিয়েছে | ডিসিশনটা আমি নিজেই নিয়েছি | আর এই নিয়ে আমি আর কোনো কথা বলতে চাই না |”
না , দীপ্তিরও এরপর আর কিছু বলার ছিল না | কৃষ্ণেন্দুর এতো অংকের ভিড়ে ওর যুক্তিগুলো সত্যি ভীষণ ঠুনকো | আর এ তো এখন পুরোপুরি একজন কর্পোরেট ম্যান | এর কাছে দীপ্তি আর কি পুরোনো সময়ের কথা বোঝাবে ! এই কৃষ্ণেন্দু তো শুধু ব্যবসা বোঝে | হিসেব বোঝে | মানুষকে না | তাই দীপ্তি আর কোনো কথা না বাড়িয়ে কেবিনটা খালি করে চলে গেলো আজ | তবে একটা কথা এখন মনে হচ্ছে ভীষণ দীপ্তির কৃষ্ণেন্দুর জন্য | যেইভাবে ও কাছের মানুষদের অন্ধের মতন দূরে সরিয়ে দিচ্ছে নিজের কাছ থেকে , তাতে খুব বেশি দেরি নেই কৃষ্ণেন্দুর একেবারে নিঃস্ব হয়ে যেতে ! টাকা পয়সা সাকসেসের ভিড়ে একদম একলা হয়ে যেতে | দিপ্তিও সেইদিন হয়তো আর সঙ্গে থাকতে পারবে না | কারণ ও জানে , যে ভেতর থেকে কৃষ্ণেন্দুর জন্য মনের দরজাগুলো এক এক করে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ওর | আর কিলোমিটারের পর কিলোমিটার দূরত্ব এসে জমা হচ্ছে ওদের মধ্যে |
সেই ঘটনার পর দুটো দিন কেটে গেছে এরপর | এখন ঘড়িতে রাত পৌনে একটা বেজে গেছে | দীপ্তি তা ও জেগে বসে আছে নিজের ঘরে | কৃষ্ণেন্দু এখনো ফেরেনি অফিস থেকে | মা ও এই নিয়ে চিন্তা করছিলো অনেকক্ষণ ধরেই | মোবাইলে কলও করেছিল বেশ কিছুবার ওকে | তবে ফোনটা অধরাই থেকে গেছে | না , দীপ্তি ওর মায়ের মতন কৃষ্ণেন্দুকে ফোন করে উঠতে পারেনি ! এখন যেরকম সম্পর্ক এসে দাঁড়িয়েছে ওদের , সেখানে ফোন কল হয়তো আর সম্ভব না নিজে থেকে | তবে ও মা কে চিন্তা করতে বেশি না দিয়ে বুঝিয়ে শুনিয়ে ঘুমের একটা হালকা ডোজের ওষুধ খাইয়ে দিয়েছে | আসলে আলো তো হাইপার টেনশনের পেশেন্ট | তাই দীপ্তির ভয় হয় সব সময় মা কে নিয়ে | সেদিনের মতন কিছু না হয়ে যায় আবার একটা | তাই ইচ্ছে করে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দিয়েছে মা কে | কাল সকালে কৃষ্ণেন্দুকে দেখলে সব ঠিক হয়ে যাবে | কিন্তু মা কে যতই বোঝাক , ঘুম পারাক , কিন্তু কৃষ্ণেন্দু যতক্ষণ না ফিরছে ওর নিজের তো কিছুতেই শান্তি হচ্ছে না | অফিসে ফোন করেছিল এর মধ্যে দুবার | কিন্তু কৃষ্ণেন্দু না কি আজ রাত আটটায় বেরিয়ে গেছে অফিস থেকে | তাহলে এতক্ষন কি করছে ও ! দীপ্তি ঠিক বুঝতে পারছিলো না | ও নিজে আজকের স্কেডিউল ফিক্সড করেছিল কৃষ্ণেন্দুর | কোনো আলাদা মিটিং , কিছুই তো ছিল না আজ ! তাহলে কোথায় কৃষ্ণেন্দু ! প্রশ্নটা বার বার মনে এসে ভিড় করছিলো | আর অদ্ভুত একটা চিন্তা হচ্ছিলো ওর | ঠিক আছে তো ছেলেটা ! অনেকদিন তো ভালো করে কথাও হয় না ! ওর শরীর ঠিক আছে তো ! নার্ভের ওষুধগুলো ঠিকভাবে খাচ্ছে তো আজকাল ! এইসবই ভাবছিলো আনমনে , তখনই হঠাৎ কলিং বেলের আওয়াজ কানে এলো | দীপ্তি হঠাৎ যেন চিন্তাটা থেকে বেরিয়ে এলো কৃষ্ণেন্দুর | যাক , তার মানে এসে গেছে ছেলেটা | ভেবেই একটা হাসি এসে জমা হলো মুখে | আজ দীপ্তি আরেকবার চেষ্টা করবে কৃষ্ণেন্দুর সাথে কথা বলার | নিজে খাবার সাজিয়ে খেতে দেবে ওকে | যদি এইভাবে একটু চেষ্টা করে সব ঠিক হয় ! আগের মতন হয় ! এইসব ভেবেই ও নিচে নামলো দরজা খোলার জন্য | কিন্তু তার আগেই হরি এসে দরজাটা খুলে দিয়েছে কৃষ্ণেন্দুকে | কিন্তু কৃষ্ণেন্দু ড্রইং রুমে আসতেই দীপ্তির ওকে দেখে পা টা থমকে গেলো হঠাৎ | সমস্ত ভাবনাগুলো এক মুহূর্তে মিলিয়ে গেলো মনে | কৃষ্ণেন্দু যে এইভাবে ওর সামনে এসে দাঁড়াবে ও কোনোদিনও ভাবেনি স্বপ্নেও | আজ এই ছেলেটার পা টলছে , নেশায় এমনভাবে চুর হয়ে আছে ও , যে ঠিকভাবে দাঁড়াতেও পারছে না নিজে | তৃষার কাঁধে ভর দিয়ে বাড়ি ফিরতে হয়েছে আজ | দীপ্তি এইসব দেখে কিভাবে রিয়্যাক্ট করবে ঠিক ভেবে পাচ্ছিলো না | কৃষ্ণেন্দু এইরকম ড্রিংক করে জীবনে প্রথম বাড়ি ফিরলো | তা ও একটা অন্য মেয়ের সঙ্গে | এরপর আর কি বাকি থাকতে পারে ! এইসব ভেবেই ড্রইংরুমে দাঁড়িয়েছিল কয়েক মিনিট ও | এর মধ্যে তৃষা আর হরি মিলে কৃষ্ণেন্দুকে ওর ঘরে শুইয়ে এসেছে | তারপর তৃষা ওর চোখের সামনে দিয়েই বেরিয়ে যেতে যাচ্ছিলো | কিন্তু দীপ্তি এই মুহূর্তে আর চুপ থাকলো না | ও তৃষাকে থামিয়ে দিয়ে এই প্রথম নিজে থেকে বলে উঠলো কিছু | তৃষাও ভাবেনি , দীপ্তি ওকে এইভাবে ডিরেক্ট প্রশ্ন করতে পারে | তাই একটু অবাক হয়েছিল যখন দীপ্তির গলার আওয়াজ পেছন থেকে কানে এসেছিলো ওর ,
——— ” তোমরা কোথায় ছিলে এতক্ষন ? কৃষ্ণেন্দুকে নিয়ে কোথায় গিয়েছিলে তুমি ?”
তৃষা প্রশ্নগুলো শুনে ফিরে তাকিয়ে দীপ্তিকে এক কথায় উত্তর দিয়েছিলো এবার , ———— ” নাইটক্লাবে গিয়েছিলাম | কেন ? এনি প্রব্লেম ?”
দীপ্তি এবার তৃষার খুব কাছে এসে ওকে উত্তরটা দিয়েছিলো | দৃঢ় অথচ শান্ত গলায় বলেছিলো , ———– ” প্রব্লেম নেই আমার কোনো | তবে তুমি যেই হারে কৃষ্ণেন্দুকে বদলে দিচ্ছ , যেইভাবে ওর ঠিক ভুল গুলোকে ওলোট পালট করে দিচ্ছ , ওকে দিনের পর দিন নিজের মতন বানিয়ে ফেলছো , তাতে আমার মনে হয় কৃষ্ণেন্দুর একদিন হঠাৎ নিজেকে আয়নায় দেখে ভীষণ প্রব্লেম হবে | ও আর চিনতে পারবে না নিজেকে | মেলাতে পারবে না ওই পুরোনো ছেলেটার সাথে | শেষ হয়ে যাবে ও | ”
দীপ্তির কথাগুলো শুনে তৃষা এবার হালকা হাসলো যেন আপনাআপনি | তারপর একটু অবাক হয়ে বললো , ——— ” তুমি সত্যি এম.বি.এ পড়েছো ! দেখে মনে হয় না জানো | কিরকম সোশিওলজির স্টুডেন্ট লাগে | আর খেলাটা একদম ভালোভাবে খেলতে জানো না তুমি | শুরু থেকে তো আমি একতরফাই খেলে গেলাম ! আর পর পর জিতেও যাচ্ছি | কৃষেন্দু দেখো , আজকাল ঠিক আমার মতন করে ভাবে | ইনফ্যাক্ট , আমি যা চাই , যেভাবে চাই , সেইভাবেই ভাবে | আর চিন্তা কোরো না | ওর হঠাৎ করে কোনো একদিন নিজেকে আয়নায় দেখে একদম কোনো প্রব্লেম হবে না জানো | কারণ কৃষ্ণেন্দু নিজের ‘পুরোনো আমি’ টা কে ততদিনে একেবারেই ভুলে যাবে | আর সেই গ্যারান্টি আজ আমি তোমাকে দিয়ে গেলাম | এনিওয়েজ , গুড নাইট … আসি আজ |
ওহ , আর হ্যাঁ , আরেকটা কথা , সবাইকে সব সময় নিজের মতন ভেবো না | যার কোনো এম্বিশন নেই , গোল নেই লাইফে | যে একটা বোকা বোকা ফিলিংসের জন্য দিনের পর দিন একটা অফিসে একজন সাধারণ পি.এ হয়ে কাটিয়ে দিতে পারে ! কৃষ্ণেন্দু তোমার মতন না | ও নিজের জন্য সব সময় বেস্ট টা চায় | সবার ওপরে থাকতে চায় | আর সিলি ইমোশনকে বাদ দিয়ে বিজনেসটাকে বোঝে | আমি তো শুধু ওকে একটু গাইড করছি , আর একটু বেশি ভালো বিজনেসম্যান হওয়ার জন্য | মানবিকতার লেকচারটা আসলে ঠিক আসে না আমার | যাইহোক , বাই … ”
কথাটা বলেই তৃষা সেদিন চলে গেছিলো দীপ্তির সামনে থেকে | তবে দীপ্তি ওকে মুখে কোনো উত্তর না দিলেও এটা মনে মনে জানতো, যে একদিন সময় ঠিক উত্তরটা দিয়ে দেবে ওকে | তবে সেইদিন সব থেকে বেশি খারাপ লাগবে কৃষ্ণেন্দুর | নিজের অচেনা একটা রূপ দেখে হয়তো আঁতকে উঠবে ও | মেলাতে পারবে না নিজেকে একদম ! এই এতো বড়ো পৃথিবীতে হয়তো একা হয়ে যাবে ভীষণ | নেশার ঘোরে আচ্ছন্ন কৃষ্ণেন্দুর ঘুমন্ত মুখটা দেখতে দেখতে আজ দীপ্তির ঠিক এই কথাগুলোই মনে হচ্ছিলো কেমন ! হাসি পাচ্ছিলো ভীষণ নিজের বোকামির ওপর | কি ভেবেছিলো আজ ও ! আরেকবার চেষ্টা করবে ! আরেকবার ওদের দুজনের জন্য ও কৃষ্ণেন্দুর সাথে কথা বলবে ! একসঙ্গে ডিনার করবে ! আরেকবার ! হয়তো সেই আরেকবারের আর কোনো সুযোগ নেই ওদের দুজনের মাঝে | হয়তো এখন শেষটুকুই বাকি আছে ব্যাস | দীপ্তি নিঃশব্দ ঘরে অন্ধকারের ভিড়ে চুপচাপ একা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যেন অপেক্ষা করছিলো আজ , সেই শেষটা দেখার |
চলবে