অন্য বসন্ত ( ষষ্ঠ পর্ব )
ঈপ্সিতা_মিত্র
<৫>
কখনো কখনো ভাবনার সঙ্গে জীবনটা মিলে যায় অদ্ভুতভাবে | দীপ্তি সেইদিন রাত্রে যেই শেষটার জন্য অপেক্ষা করছিলো চুপচাপ , সেই শেষটা হতে আর বেশি দেরি লাগলো না | আজ একুশে জুলাই | অনেক বছর আগে এই দিনেই কৃষ্ণেন্দুর বাবা এই কোম্পানির ইনগ্রেশন করেছিল | আজ তাই খুব বড়ো একটা পার্টির ব্যবস্থা করেছে কৃষ্ণেন্দু | যদিও এই পার্টির ভেনু ডিসাইড থেকে , ডেকরেশন , ফুড , সব কিছুই তৃষা নিজের পছন্দ মতন এরেঞ্জ করেছে | দীপ্তি সাতদিন ধরে এইসব আয়োজনই দেখছিলো কিছু না বলে | তবে এইসবের মধ্যে একটা ব্যাপার সব থেকে বেশি যেটা চোখে লেগেছিলো ওর , যে এই পার্টির গেস্ট লিস্টে পরিতোষ জেঠু , নির্মাল্য জেঠুদের মতন কোনো এক্স এমপ্লয়িদের নাম নেই | যদিও এই কোম্পানিটা আজ ওদের জন্যই টিকে আছে | তা ও কেউ একবারও প্রয়োজন মনে করলো না আজকের দিনে ওদের একবার মনে করার, মিনিমাম সম্মানটুকু দেখানোর ! তবে দীপ্তি এই নিয়ে আর কাউকে কিছু বলতে যায়নি | এদের কাছে পুরোনোদের দাম নেই , এটা দীপ্তি বহুদিন আগে থেকেই বুঝে গেছে | আর কিছুদিন বাদে হয়তো দীপ্তি নিজেই এই পুরোনোদের লিস্টে নিজের নামটা লিখিয়ে নেবে ! আর আজকাল এই কোম্পানিতে ও একজন আউট সাইডার ছাড়া আর তো কিছুই নয় ! বিশ্বাস হয় না নিজেরই যে একটা সময় দীপ্তি কৃষ্ণেন্দুর সঙ্গে রাত জেগে জেগে প্রেজেন্টেশন তৈরী করতো , সুতোর কোয়ালিটি থেকে মার্কেটিং , ছোট বড়ো সব ব্যাপারে কৃষ্ণেন্দু ওর সঙ্গে আলোচনা করে ডিসিশন নিতো ! আর এখন , কৃষ্ণেন্দুর কাছে দীপ্তি হলো একজন ইমোশনাল , বেহিসেবি মানুষ | যে বিজনেসের কিছুই বোঝে না ! যার কথা শুনলে এই বাজারে টিকে থাকা যাবে না | কথাগুলো ভেবে এই মুহূর্তে আনমনে একটা কষ্টের হাসি চলে এলো হঠাৎ মুখে | দীপ্তি কতগুলো পুরোনো গল্পের বই নিয়ে নাড়াচাড়া করছে এখন | সন্ধ্যের সময় পার্টি শুরু হয়ে যাবে | কিন্তু তাতে ওর কি ! দীপ্তি আজ বাড়িতে থাকবে | আর ওকে তো কেউ একবারও আলাদা করে পার্টিতে যাওয়ার কথা বলেনি ! তবে একদিকে না বলে ভালোই হয়েছে | এইসব জায়গায় মেকি লোকেদের সংখ্যা খুব বেশি | আর দীপ্তি না ড্রিংক করে , না তাদের মতন ফ্যাশনেবল ড্রেস পড়তে পারে , না বিদেশী একসেন্টে সাজিয়ে গুছিয়ে বাংলা বলতে পারে ! এইসব জায়গায় ওর মতন সাধারণ , মধ্যবিত্তর তকমা লাগা , একটু সেকেলে মানুষের খুব প্রয়োজন নেই | এইসব ভেবেই বইয়ের পাতা উল্টোচ্ছিলো | তখনই হঠাৎ দরজায় টোকা | দীপ্তি চোখ ফেরাতেই কৃষ্ণেন্দুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো | ও হঠাৎ এই ঘরে কি করছে ! আজকে তো আরো সময় থাকার কথা না | এইসবই ভাবছিলো ছেলেটাকে দেখে , তখন কৃষ্ণেন্দু নিজে থেকেই বলে উঠলো , ————- ” কি করছিস তুই ? রেডি হোসনি কেন ? যাবি না পার্টিতে ?”
দীপ্তি কথাটা শুনে দু সেকেন্ড ভেবে উত্তর দিলো , ———— ” কেন ? কোনো কাজ আছে ?”
কৃষ্ণেন্দু এইরকম প্রশ্ন শুনে অবাক হয়ে গেলো হঠাৎ ! তারপর কিছু না ভেবেই বলে উঠলো , ———- ” তোর কি মনে হয় , শুধু দরকার হলেই মনে করি তোকে ? ”
দীপ্তি এর উত্তরে হালকা হেসে বললো , ———— ” দরকারটাই তো আজকাল আর হয় না তোমার আমাকে ! এই বাড়িতে মাঝে মাঝে নিজেকে একটা ফার্নিচারের মতন লাগে | আর অফিসে তো এমনিও এখন আমার কথার দাম নেই বিশেষ | যাইহোক , কাজ না থাকলে আমার তোমাদের পার্টিতে না গেলেও চলবে | অনেকে আছে | যারা এখন খুব ইম্পরট্যান্ট | তাদের থাকাটাই আসল |”
কৃষ্ণেন্দুর কথাগুলো লাগলো হঠাৎ একটু | দীপ্তিকে এই পার্টির ব্যাপারে আসলে কিছুই এতদিন বলা হয়নি | আসলে তৃষা নিজে দ্বায়িত্ব নিয়ে সব এরেঞ্জমেন্ট করছে | ও কারোর ইন্টারফিয়ারেন্স চায় না | আর তৃষার বিজনেস ডিসিশনগুলো এই কোম্পানিকে এতটা প্রফিট এনে দিয়েছে ! যে আজকাল কৃষ্ণেন্দু ওকে কিছুতেই মুখের ওপর না বলতে পারে না | তবে দীপ্তিকে আজকের সন্ধেতেও এইভাবে দূরে থাকতে দেখে কিরকম খারাপ লাগছে ওর ! মনে হচ্ছে এই নিঃস্তব্ধতার আড়ালে হয়তো পুরোনো সব কিছুই কিরকম শেষ হয়ে যাচ্ছে ওদের | তাই আজ বিকেলবেলা গিয়ে নিজে পছন্দ করে শাড়ি কিনে এনেছে একটা | দীপ্তি প্রথমে খেয়াল করেনি ওর হাতের প্যাকেটটা | এই কথাগুলো বলে হঠাৎ চোখে পড়লো ওর | তবে দীপ্তির কিছু বলার আগেই এবার কৃষ্ণেন্দু বলে উঠলো ,
————– ” তুই একটা সময় আমার সঙ্গে ভীষণভাবে ছিলিস | জানি , এখন আমার সঙ্গে তোর থিঙ্কিং , পয়েন্ট অফ ভিউ মেলে না বিশেষ | তোর ঠিক আর আমার ঠিকগুলো আলাদাই আজকাল | কিন্তু এটাও সত্যি , এই কোম্পানিটা আজ যেই জায়গায় , সেটার জন্য তোরও অনেক পরিশ্রম , রাত জাগা ছিল একটা সময়ের | আমি তোকে জোর করবো না আজ , তবে রিকুয়েস্ট করবো , এই ‘সেন টেক্সটাইলের’ জন্য আসিস আজ পার্টিতে , আমার সঙ্গে | আর এই শাড়িটা তোর জন্য এনেছিলাম | যদি ভালো লাগে , তাহলে এটা পরেই আসিস |”
কথাটা শেষ করে কৃষ্ণেন্দু দীপ্তির সামনে শাড়িটা রেখে চলে গেলো এই মুহূর্তে | কিন্তু দীপ্তি কিছুতেই আর কোনো উত্তর দিতে পারলো না ওকে ! পুরোনো টান , পুরোনো ভালোবাসা এসে ঘিরে ধরলো আরেকবার দীপ্তিকে | আজও ‘না’ বলতে পারলো না ও | কৃষ্ণেন্দুর জন্য দিনটা সত্যি খুব বড়ো | তাই দীপ্তি শুধুমাত্র এই ছেলেটার মন রাখতে যাবে আজ পার্টিতে | পরবে ওর কিনে দেয়া শাড়ি | আসলে ভালোবাসলে হয়তো এইরকমই হয় | যতই নিজের চারিদিকে ভীষণ শক্ত দেয়াল তুলে রাখা হোক না কেন , সেটায় সারাক্ষন আটকে থাকা যায় না | দীপ্তি তাই অনেকদিন বাদে আবার সাজলো কৃষ্ণেন্দুর জন্য | ভাঙা মন নিয়ে নতুনভাবে শুরু করার চেষ্টা করলো আরেকবার |
সেদিন এরপর কৃষ্ণেন্দুর সঙ্গেই এসেছিলো দীপ্তি পার্টিতে | তবে বাড়ি থেকে ভেনু অব্দি পুরো রাস্তাটাই কিরকম চুপচাপ , কথাহীনভাবে কেটে গেলো দুজনের ! দীপ্তির এটা ভেবে অবাক লাগে মাঝে মাঝে , যে একটা সময় এরকমও ছিল , যখন ওদের মধ্যে এতো কথা , এতো গল্প ছিল , যে রাস্তাটা কখন শেষ হয়ে যেত ! বুঝতেই পারতো না কেউ | আর আজ এই রাস্তাটা যেন অন্তহীন বলে মনে হচ্ছে কেমন | দীপ্তির এইসব এলোমেলো ভাবনার ভিড়েই সেদিন ওরা এসে হাজির হয়েছিল পার্টিতে | ফাইভ ষ্টার হোটেলের রুফ টপে তৃষা এরেঞ্জ করেছিল পার্টিটা | চারিদিকে ঝলমলে আলো , ওয়েটারদের ভিড় , ড্রিঙ্কস এর জন্য আলাদা একটা সেকশন , ওয়াইন শ্যাম্পেনের হালকা একটা গন্ধ চারদিকে ছড়িয়ে, তার মধ্যে দীপ্তির নিজেকে কিরকম আলাদা , একা মনে হচ্ছিলো আজ | মনে হচ্ছিলো এটা কি সত্যি ওর জায়গা ! কিসের জন্য এসেছে আজ এখানে ! কৃষ্ণেন্দু , এই অফিস , কোনোকিছুই কি আর ওর নিজের আছে ! এইসব ভাবনার ভিড়ে একটা কোনায় সবার থেকে আলাদা নিজের মতন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই কেটে যাচ্ছিলো সন্ধ্যেটা | এর মধ্যে একবার অনিকেতের সাথে দেখা হয়েছিল ওর | একটু হাসি , গল্প হয়েছে কয়েক মিনিট | তবে আজ কি জানি কেন , কিছুতেই আর জোর করেও খুব কথা আসছে না ওর কারোর সঙ্গে | কিছু একটা ভেতর থেকে খুব লাগছে যেন ! ভাঙা কাঁচের টুকরোটা বিঁধছে ভীষণ মাঝে মাঝেই | কৃষ্ণেন্দুকে যখন তৃষার সঙ্গে হাসতে , কথা বলতে , আলাদা হয়ে যেতে দেখছে ভিড়ের মধ্যে , তখন মনে হচ্ছে এখানে ওর জায়গাটা কোথায় ! কেন নিজের ডিসিশনটা চেঞ্জ করে এলো আজ এখানে ! নিজের ওপরই রাগ হচ্ছে এখন | এইসবের মধ্যেই ঘড়ির কাঁটাটা আস্তে আস্তে এগিয়ে যাচ্ছিলো সেদিন | তবে মিনিট সেকেন্ডটা হঠাৎ থমকে গেলো একটা ঘটনার পর | দীপ্তি সেদিন চুপচাপ এক কোণায় দাঁড়িয়েছিল নিজের মতন প্রথম থেকে | তবে কিছুক্ষন পরই পার্টিতে ডান্স শুরু হলো | অনেকেই ডান্স ফ্লোরে গিয়ে মিউজিকের তালে পা মেলাতে শুরু করলো আস্তে আস্তে | তবে এই সময়েই হঠাৎ একটা ঘোলা চোখ যে অনেক্ষন ধরে দীপ্তিকে দূর থেকে দেখছিলো মন দিয়ে , সেটা দীপ্তি খেয়াল করেনি একদম | কিন্তু সেই ঘোলা চোখের মানুষটা যখন মদের নেশায় টলতে টলতে হঠাৎ দীপ্তির কাছে এসে হাজির হলো , তখন দীপ্তির সম্ভিত ফিরলো | মিস্টার ভট্টাচারিয়া না ! লোকটার বয়স প্রায় ষাট তো হবেই | লাস্ট এক বছর ধরে ওদের রেগুলার ক্লায়েন্ট | তৃষার রিলেটিভও হয় মনে হয় দূর সম্পর্কের ! কিন্তু লোকটা হঠাৎ ওর দিকে এইভাবে এগিয়ে আসছে কেন ! বুঝতে পারছিলো না দীপ্তি | কিন্তু বুঝলো খুব পরিষ্কার ভাবে , যখন লোকটা হঠাৎ ওর খুব কাছে এসে আচমকা কিছু না বলেই ওর কোমরটা ধরে নিলে শক্ত করে | আঙ্গুল দিয়ে সাপের মতন ওর কোমরে হাত বোলাতে শুরু করলো নিজে থেকে | ঘোলাটে নোংরা চোখ দিয়ে ওর শরীরটাকে মাপতে শুরু করলো নির্লজ্জভাবে | দীপ্তি যেন কয়েক সেকেন্ডের জন্য নির্বাক হয়ে গিয়েছিলো অদ্ভুত একটা ভয়ে | একটা লজ্জা , অস্বস্তি , জড়তা এসে ঘিরে ধরেছিলো ওকে | গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোচ্ছিল না কোনো এই নোংরা স্পর্শটাকে ফিল করে | তা ও কয়েক সেকেন্ডে নিজেকে সামলে দীপ্তি নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলে উঠলো , ———- ” প্লিজ , কি করছেন কি আপনি ? ছাড়ুন আমাকে !”
মিস্টার ভট্টাচারিয়া ওর জোর করে ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টাটায় সাড়া না দিয়ে এবার দু হাত দিয়ে দীপ্তিকে জাপ্টে ধরলো হঠাৎ | ওর ভারী শরীরটা দীপ্তির ওপর ফেলে দিলো যেন | দীপ্তি ওই শরীরটার ভারে ছটফট করতে শুরু করলো | চারিদিকের আঁধো অন্ধকার পার্টি লাইটে মনে হচ্ছিলো হারিয়ে যাচ্ছে কোথাও| মিশে যাচ্ছে অন্ধকারে | আর ওর আশেপাশের লোকজন নিজেদের নিয়ে এতোই মত্ত যে দীপ্তির এই হারিয়ে যাওয়াটা কেউ খেয়ালই করছে না | ওর দম বন্ধ হয়ে যাওয়া শরীরটাকে কেউ নোটিশই করছে না বিশেষ | দীপ্তি তাও গলার জোর বাড়িয়ে হাঁসফাঁস করতে করতেই বলে উঠলো আরেকবার , ———— ” কি করছেন আপনি ! ছাড়ুন আমাকে | ছাড়ুন বলছি |”
যদিও চারিদিকে এতো লাউড মিউজিক বাজছিলো যে চিৎকারটা আশেপাশের কেউই বিশেষ শোনেনি | আর এই সময় দীপ্তির কথাটাকে বিশেষ পাত্তা না দিয়ে মিস্টার ভট্টাচারিয়া মদের নেশা জড়ানো গলায় বলে উঠলো , ———- ” লেটস ডান্স বেবি .. এনজয় দ্যা পার্টি .. এন্ড লেট্ মি এনজয় ইয়োর বডি টু … ”
দীপ্তি এই কথাটা শুনে যেন ভেতর থেকে কেঁপে উঠলো | দম বন্ধ হয়ে গেলেও মিস্টার ভট্টাচারিয়াকে নিজের ওপর থেকে সরানোর জন্য ওই আঁধো অন্ধকারের মধ্যে ও প্রানপন চেষ্টা করতে থাকলো | ভয় , ঘেন্নায় গলার আওয়াজটা বুজে এলো ওর | এই সময়েই হঠাৎ কেউ যেন মিস্টার ভট্টাচারিয়ার কলারটা ধরে আচমকা ওকে দীপ্তির ওপর থেকে টেনে নিয়ে ধাক্কা মেরে ফেলে দিলো ফ্লোরের মধ্যে | দীপ্তি দু সেকেন্ডের ভিড়ে নিজের ঘোরটা কাটিয়ে দেখলো ওর সামনে অনিকেত দাঁড়িয়ে আছে | রাগে মুখটা লাল হয়ে আছে ওর | তার মানে অনিকেতই ঠিক সময়ে এসে আজ ওকে আবার হেল্প করলো ! এতো বড়ো একটা বিপদ থেকে বাঁচালো ওকে ! কথাটা ভাবতেই তৃষার গলার আওয়াজ হঠাৎ কানে এলো | ও প্রায় চিৎকার করতে করতে ওদের সামনে এসে হাজির হয়েছে | মদের নেশায় টোলে পড়া মিস্টার ভট্টাচারিয়াকে ফ্লোর থেকে তুলতে তুলতে ও বলে উঠলো অনিকেতকে ঝাঁঝালো ভাবে , ———— ” হাও ডেয়ার ইউ .. কি করে করলে তুমি এটা ? এতো সাহস তোমার ! আমাদের কোম্পানির একজন এতো বড়ো ক্লাইন্টকে তুমি এইভাবে ইনসাল্ট করলে !”
অনিকেত কথাটা শুনে দৃঢ় অথচ শান্ত গলায়ই বললো , ———– ” এই লোকটা যত বড়োই ক্লাইন্ট হোক না কেন ! ভীষণ নোংরা একজন মানুষ | দীপ্তির সাথে উনি অসভ্যতামি করছিলেন | আমি নিজে দেখেছি |”
অনিকেতের কথাটা মিস্টার ভট্টাচারিয়ার কানে আসতেই উনি হঠাৎ ভালো মানুষ সেজে বেশ প্রোটেস্ট করে বলে উঠলেন , ——– ” কে বললো এইসব ! আই জাস্ট আস্কড হার ফর এ ডান্স .. এটা অসভ্যতা !”
কথাটা শুনে অনিকেত এবার বেশ রাগের গলায়ই বলে উঠলো , ———- ” একদম মিথ্যা বলবেন না | আমি খুব ভালোভাবে দেখেছি আপনি ঠিক কি করছিলেন এতক্ষন !”
তবে অনিকেতের কথাটা শেষ হতেই তৃষা আবার সেই ঝাঁঝালো গলায় বলে উঠলো , ———- ” তুমি দীপ্তির চোখে হিরো সাজার জন্য এইসব নাটক করছো পার্টিতে ! আমাদের এতো বড়ো একজন ক্লাইন্ট কে তুমি ধাক্কা মেরে ফেলে দিলে ? লোয়ার ক্লাস হলে আসলে যা হয় | কখনো এইরকম পার্টিতে আসোনি | জানোই না এখানে কি হয় ! আর ডান্স করতে জিজ্ঞাসা করাকে কোনো অসভ্যতা করা বলে না | বুঝেছো |”
তৃষার কথাগুলো যেন ভেতর থেকে লাগলো দীপ্তির এই মুহূর্তে | ও লাস্টে ক্লাস তুলে কথা বললো ! আর অনিকেত আজ যা করেছে , সব দীপ্তির জন্য করেছে | তাও ওকে এইভাবে সবার সামনে অপমানিত হতে হচ্ছে ! কথাটা ভেবেই দীপ্তি আর চুপ থাকলো না | সমস্ত থমকে থাকা ভিড়ের মধ্যে এবার দৃঢ় গলায় বলে উঠলো তৃষাকে , ———— ” শুধু ডান্স এর জন্য জিজ্ঞাসা করাকে যে অসভ্যতা বলে না , এটা বোঝার সেন্স সব ক্লাসেরই থাকে | উনি তার থেকে অনেক বেশি কিছু করেছেন | আর আজ যদি অনিকেত না থাকতো , হয়তো আমার সাথে খুব খারাপ কিছু একটা হয়ে যেত |”
দীপ্তির কথাটাকে তৃষা বিশেষ পাত্তা না দিয়েই বললো এবার , ——— ” প্লিজ .. ক্লাস তো তোমারও নেই | একটা সিম্পল জিনিসকে তাই হ্যান্ডেল করতে পারো না ! আসলে কখনো আসোনি এইরকম পার্টিতে ! জানবে কি করে ! হুট্ করে একটা ভালো হাই স্ট্যান্ডার্ডের ছেলেকে পটিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছ , তার বাড়িতে থাকছো ! তবে এইসব করেও তো আর নিজের মিডলক্লাস নেচারটাকে ভুলতে পারবে না | এটাই তোমার প্রব্লেম আসলে |”
দীপ্তির কথাগুলো শুনে মুখটা যেন অন্ধকার হয়ে এলো সেই মুহূর্তে | লজ্জায় অপমানে মিশে যেতে ইচ্ছে করলো মাটিতে | ততক্ষনে পার্টিটা কেমন যেন থমকে গেছে | ওদের এই কথা কাটাকাটি দেখতে লোকজন ভিড় জমিয়েছে ওই আলোআঁধারীর মধ্যে | তবে তৃষার কথাগুলো শুনে দীপ্তি কোনো উত্তর দেয়ার মতন অবস্থায় না থাকলেও অনিকেত রাগে লাল হয়ে বলে উঠলো ,
——— ” একদম দীপ্তির সঙ্গে এইভাবে কথা বলবেন না আপনি |কিছুক্ষন আগে যেটা দীপ্তির সাথে হয়েছে সেটা তো আপনার সাথেও হতে পারতো ! আর একটা মেয়ে হয়ে আরেকটা মেয়ের ক্যারেক্টার এনালাইসিস করতে লজ্জা করছে না আপনার ! এর থেকেই বোঝা যাচ্ছে আপনি নিজে কি মেন্টালিটির মানুষ | নইলে এই নোংরা লোকটাকে এইভাবে সাপোর্ট করতে পারতেন না ! আপনাদের মতন মানসিকতার লোকজনের জন্যই এই ধরণের লোকেদের সাহস বাড়ে নোংরামো করার | দীপ্তিকে কিছু বলার আগে আপনি নিজেকে ঠিকভাবে আয়নায় দেখে আসুন মিস তৃষা..”
অনিকেত কথাগুলো প্রায় এক নিঃশ্বাসে বলে গেলো | তবে খেয়াল করেনি ও তখনও যে এই মুহূর্তে কৃষ্ণেন্দু এই ভিড়ের মাঝে এসে হাজির হয়েছে | একটা ইম্পর্টেন্ট ফোন কল এটেন্ড করার জন্য ও রিসেপশনে গেছিলো কিছুক্ষন আগে | তার মাঝে কি হয়েছে হঠাৎ ওর সত্যি জানা ছিল না ! পার্টিতে আবার ফিরে এসেই কৃষ্ণেন্দু দেখলো মিস্টার ভট্টাচারিয়ার এলোমেলো উস্কো খুস্ক চেহারা | আর কানে এলো অনিকেতের শেষ কথাগুলো | ভাবতে পারছে না একজন সাধারণ এমপ্লয়ি হয়ে ও কোথা থেকে এতো সাহস পায় তৃষার সাথে এইভাবে , এই টোনে কথা বলার ! কথাগুলো মনে হতেই কৃষ্ণেন্দুর মাথাটা গরম হয়ে গেলো | কৃষ্ণেন্দু তাই আচমকা ওই ভিড় কাটিয়ে কোনো কিছুর শুরু না জেনেই অনিকেতের ওপর প্রচন্ড চিৎকার করে উঠলো ,
————— ” তোমার এতো বড়ো সাহস ! তুমি আমাদের কোম্পানির একজন ম্যানেজিং হেডের সাথে এইভাবে কথা বলছো ! অনেকদিন তোমার অনেক কিছু সহ্য করেছি আমি | যেহেতু তুমি দীপ্তির বন্ধু | তবে আর না | তোমার মতন অভদ্র , অসভ্য ছেলের কোনো জায়গা নেই আমার কোম্পানিতে | খুব বড়ো ভুল করেছিলাম আমি তোমাকে এপয়েন্ট করে | তবে আর সেই ভুলটা কন্টিনিউ করবো না | এন্ড গেট আউট ফ্রম আওয়ার পার্টি ! রাইট নাও .. ”
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে গেলো কৃষ্ণেন্দু | এই ভিড়ে ওর এইসব কথা শুনে অনিকেতের মতন দীপ্তিও যেন অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো কয়েক সেকেন্ড থমকে ! কৃষ্ণেন্দু শেষে অনিকেতের চাকরিটা কেড়ে নিলো ! বিশ্বাস হচ্ছিলো না দীপ্তির | কিন্তু দীপ্তি এই মুহূর্তে চুপ না থেকে জোর গলায় বলে উঠলো কৃষ্ণেন্দুকে , ————- ” তুমি কিছু না জেনে ভুল করছো কৃষ্ণেন্দু | এতক্ষন কি হয়েছে তুমি জানোই না | এই লোকটা , মিস্টার ভট্টাচারিয়া , উনি আমার সাথে নোংড়ামো করছিলো , মলেস্ট করছিলো আমাকে | অনিকেত যদি ঠিক সময়ে ওকে ঠেলে ফেলে না দিতো , তাহলে এটা চালিয়েই যেত উনি | আর এইসব দেখেই তৃষা আমাকে অনিকেতকে উল্টো পাল্টা কথা বলতে শুরু করে | আর সেই জন্যই !”
না , ওর কথাটাকে কমপ্লিট করতে না দিয়েই এবার মিস্টার ভট্টাচারিয়া আর তৃষা একসঙ্গে প্রতিবাদ করে উঠলো যেন | মিস্টার ভট্টাচারিয়া রাগি রাগি মুখ করেই বলে উঠলো এবার , ————- ” অনেক্ষন ধরে শুনছি এইসব ফালতু কথা ! সব কিছুর একটা লিমিট আছে | একজন মেয়েকে পার্টিতে এসে ডান্স এর জন্য জিজ্ঞেস করাকে কি মলেস্ট করা বলে ! এইরকম মিডলক্লাস মাইন্ডের লোকজনকে আপনি নিজের পার্টিতে এনেছেন জানলে আমি কখনোই আসতাম না এখানে ! এইভাবে ডেকে অপমান করার কি আছে আমাকে ! আমি আপনাকে কত টাকার প্রফিট দিয়েছি খেয়াল আছে তো মিস্টার কৃষ্ণেন্দু | তারপরেও এই রকম ইনসাল্ট আপনার লোকজন আমাকে করবে ? এইরকম হলে তো আপনাদের সাথে কোনো বিজনেস রিলেশনই রাখা যাবে না !”
মিস্টার ভট্টাচারিয়ার কথাটা শেষ হতেই এবার একই সুরে তৃষাও বলে উঠলো কৃষ্ণেন্দুকে , ———— ” প্লিজ তুমি দীপ্তিকে বোঝাও | অলরেডি যথেষ্ট ইনসাল্ট হয়ে গেছে আমাদের | এরপর এই সিলি রিসনের জন্য বিজনেসের কোনো ক্ষতি হোক , সেটা আমি এলাও করবো না | আর মিস্টার ভট্টাচারিয়াকে তো তুমি এক বছর ধরে চেনো | বয়স্ক একটা মানুষ ! উনি কখনো মলেস্ট করতে পারে কাউকে ? আসলে দীপ্তির এইরকম হাই সোসাইটি পার্টিতে আসার অভ্যেস নেই বলে সামান্য একটা ডান্সের জন্য জিজ্ঞেস করাকে ওর নোংরামি বলে মনে হয়েছে | এটা ওর মেন্টাল ব্লকেজ | আর ওর এখুনি মিস্টার ভট্টাচারিয়ার কাছে ক্ষমা চেয়ে ম্যাটারটাকে এখানেই সল্ভ করে দেয়া উচিত , আমাদের বিজনেসের কথা ভেবে দীপ্তির এটা করা উচিত |”
তৃষার কথাগুলো যেন বিঁধছিলো দীপ্তিকে | এতো লোকের মাঝে এইভাবে অপমান একজন ওকে করতে পারে ! মানতে পারছিলো না যেন ! তবে এই মুহূর্তে কৃষ্ণেন্দুর কথা শুনে ওর সব থেকে বড়ো ধাক্কাটা লাগলো | কৃষ্ণেন্দু দীপ্তিকে এতো কিছু শুনে খুব কঠিন গলায় বললো হঠাৎ , ———— ” সরি বল তুই মিস্টার ভট্টাচারিয়াকে এখনই | দ্যাখ , তোর কোনো মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়েছে | এই রকম পার্টিতে একটা ডান্সের জন্য জিজ্ঞেস করাটা খুব নরমাল | আসলে আমারই ভুল ! তোকে এখানে আনার আগে এইসব বুঝিয়ে দেয়া উচিত ছিল | যাইহোক, তুই প্লিজ আর সিন্ ক্রিয়েট না করে সরি বলে দে মিস্টার ভট্টাচারিয়াকে এখনই | আর এই ম্যাটারটাকে শেষ কর এখানে | ”
দীপ্তি এর উত্তরে কিছুক্ষনের জন্য যেন নিঃস্তব্ধ হয়ে গেলো সবার সামনে | মানে ওর কথার কোনো দামই নেই কৃষ্ণেন্দুর কাছে ! ও এতো বড়ো একটা কথা বললো কৃষ্ণেন্দুকে , আর সেটা বিশ্বাস না করে কৃষ্ণেন্দু তৃষার কথা বিশ্বাস করলো আজ ! এতো কিছুর পর শেষে ওকে ঝুঁকতে বললো ! মিস্টার ভট্টাচারিয়ার মতন লোকের কাছে ক্ষমা চাইতে বললো ! এমনকি অনিকেতের চাকরিটা অব্দি নিয়ে নিলো ও | কথাগুলো ভেবে দীপ্তি কয়েক মুহূর্তের জন্য যেন এলোমেলো হয়ে গিয়েছিলো এই লোকের ভিড়ে | কিন্তু তারপর নিজেকে প্রথমবার ভীষণ কঠিন করে ও দৃঢ় গলায় কৃষ্ণেন্দুর চোখে চোখ রেখে উত্তর দিলো আজ , ————– ” আর আমি যদি সরি না বলি কৃষ্ণেন্দু ! তাহলে ? আমাকেও চাকরি থেকে বার করে দেবে ? না কি নিজের লাইফ থেকে ?”
কৃষ্ণেন্দুর মুখের ওপর দীপ্তি আরেকবার না বললো ! একটা সাধারণ ভুলকে ও স্বীকার করতে পারলো না ! এটা জেনেও যে মিস্টার ভট্টাচারিয়া ওদের কোম্পানির কত বড়ো একজন ক্লাইন্ট | কথাগুলো ভেবেই ও অবাক চোখে দীপ্তির দিকে তাকিয়ে বললো , —————- ” তুই লাস্টে এইসব বলছিস ? জানিস আজকের দিনটা আমাদের কোম্পানির জন্য কতটা ইম্পরট্যান্ট ! আর মিস্টার ভট্টাচারিয়া একজন বয়স্ক লোক | তোর ভুল হচ্ছে | উনি কখনোই এইসব কিছু করতে পারেন না | তৃষা ঠিকই বলেছে , তোর এইসব পার্টিতে আসার অভ্যেস নেই বলে এটাকে একটা ইস্যু বলে মনে হয়েছে | আর তুই সরি বললে ছোট হয়ে যাবি না দীপ্তি ! আর তোর একটা ছোট্ট মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং এর জন্য আমি আমার কোম্পানির এতো বড়ো একজন ক্লাইন্টকে হারাতে পারবো না , সরি |”
দীপ্তির কৃষ্ণেন্দুর বলা কথাগুলোকে সেদিন শেষ বারের মতন শুনলো | আজ ও সত্যি শেষ | ওর ভেতরের ফিলিংস , জমানো অভিমান , রাগ , কষ্ট , যন্ত্রনা , সব এই ছেলেটার ওপর শেষ | আজ আর কিছু ফিরে পাওয়ার নেই | কিছু হারানোর নেই | আজ শুধু পুরোপুরি শেষ করে দেয়া বাকি আছে | তাই দীপ্তি এবার কৃষ্ণেন্দুকে ভেজা চোখে আলতো হেসে উত্তর দিলো , ————– ” চিন্তা কোরো না | আমার জন্য তোমার কোম্পানির কোনো লস হবে না | কোনো ক্লাইন্ট যাবে না | কারণ আমি নিজে এই কোম্পানিটা আজ ছেড়ে দিলাম | আর তোমাকেও | আশা করি মিস্টার ভট্টাচারিয়ার আর এই কোম্পানির সাথে কাজ করতে কোনো প্রব্লেম হবে না ! কারণ যে ওনাকে মিসআন্ডারস্ট্যান্ড করে সবার সামনে অকারণে অপমান করেছে , সে নিজেই এই কোম্পানিটা ছেড়ে চলে যাচ্ছে | যাইহোক , সরি , তোমার পার্টিটাকে এইভাবে ডিস্টার্ব করার জন্য | সিন্ ক্রিয়েট করার জন্য | আর হবে না কখনো এইরকম | ভালো থেকো |”
কথাটা শেষ করেই দীপ্তি এবার ঘুরে তাকালো | আলো আঁধারি রুফ টপের শেষ প্রান্তে দরজাটা | দীপ্তি আর কোনো কথা না বলে সেইদিকে এগিয়ে গেলো চুপচাপ | সব ছেড়ে বেরিয়ে আসার জন্য | অনিকেতও আর এই মুহূর্তে দাঁড়ালো না ওখানে | ও নিজেও দীপ্তির সঙ্গে পা মেলালো | কৃষ্ণেন্দু এই সময় যেন নির্বাক হয়ে গিয়েছিলো | বিশ্বাস হচ্ছিলো না দীপ্তি শেষে নিজের জেদটা বজায় রাখার জন্য চাকরি ছেড়ে দিলো ! এমনকি সবার সামনে ওদের রিলেশনটাও ভেঙে দিলো ! এইসবই কি শুধুই একটা মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং ! না একটা অজুহাত মাত্র ! অনিকেতের সাথে নতুন করে সব কিছু শুরু করার অজুহাত ! কথাগুলো ভেবেই ও শেষবারের মতন বলে উঠলো দীপ্তিকে ,
————- ” তুই ভুল করছিস দীপ্তি ! তুই খুব বড়ো একটা ভুল করছিস | ”
কথাটা যেন বুকে এসে লাগলো দীপ্তির এই মুহূর্তে | ও থমকে দাঁড়িয়ে গেলো হঠাৎ সবার মাঝে | তারপর কৃষ্ণেন্দুর দিকে ফিরে তাকিয়ে একটাই উত্তর দিলো , ————- ” না , আমি ভুল করছিলাম , এতদিন ধরে | তোমাকে ভালোবাসার ভুল ! কিন্তু আর না | আজকে ভুলটা শুধরে নিলাম | আর এরপর কোনোদিনও আমি থাকবো না | ”
কথাটা বলেই দীপ্তি আর এক সেকেন্ডও দাঁড়ালো ওখানে | পা দুটোকে যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি চালিয়ে বেরিয়ে এলো পার্টিটা থেকে | ওই দম বন্ধ করা পরিবেশটা থেকে | হয়তো সারা জীবনের জন্য কৃষ্ণেন্দুর কাছ থেকেও ! তবে কৃষ্ণেন্দু সেই মুহূর্তে এক পা ও এগোতে পারলো না ঠিক | দীপ্তি কি সত্যি সব শেষ করে দিলো ! ও কি সত্যি ছেড়ে চলে গেলো কৃষ্ণেন্দুকে ! আর এর কারণটা কি অনিকেত ! না কি ও নিজে ! শেষ প্রশ্নটা একবার উঁকি দিয়েই মিলিয়ে গেলো যেন | আর নিঃস্তব্ধতার আড়ালে দাঁড়িয়ে রইলো কৃষ্ণেন্দু নিজে ভিড়ের মধ্যে , এই প্রথম একদম একলা হয়ে |
( নতুন শুরুর অধ্যায় )
<১>
কৃষ্ণেন্দুর সেদিন একলা হয়ে প্রায় দু মাস কেটে গেছে এরপর | আসে পাশের পৃথিবীটাই এখন কেমন বদলে গেছে ওর ! একা থাকা কাকে বলে , সেটা যেন সময় হঠাৎ এসে বুঝিয়ে দিয়েছে ! সেদিন দীপ্তি পার্টি থেকে ফিরে আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা করেনি আসলে | সোজা মায়ের ঘরে গিয়েছিলো | বাইরে ঝড় উঠেছিল খুব সেই সময়ে | বৃষ্টি , মেঘ ডাকার আওয়াজ ভেসে আসছিলো ভীষণ ঘরে | আলো সেই সময়ে এক মন দিয়ে উপন্যাস পড়ছিলো একটা | মেয়ের পায়ের শব্দে স্তম্ভিত ফিরলো হঠাৎ | এলোমেলো , ছন্নছাড়া , বৃষ্টি ভেজা দীপ্তিকে দেখে আলো নিজেও যেন থমকে গেছিলো সেই মুহূর্তে ! বুঝতে পারছিলো না কি হয়েছে ! তবে দীপ্তি যে ঠিক নেই , সেটা নিশ্চিত ছিল | আলো এইসব দেখে দীপ্তিকে কিছু জিজ্ঞেস করতে যাওয়ার আগেই মেয়েটা ওর পায়ের কাছে বসে পড়লো আচমকা | তারপর খুব শক্ত করে ওর হাত দুটো ধরে স্থির চোখে বলে উঠলো , ———- ” এবার ঠিকানাটা বদলাতে হবে আমাদের | কৃষ্ণেন্দুর আর আমাদের দরকার নেই | এটাই সত্যি | আর আজ যা হয়েছে এরপর আমার পক্ষেও এই বাড়িতে থাকা সম্ভব না | আমি কোনোদিনও তোমায় কিছু রিকোয়েস্ট করিনি মা | কিন্তু আজ করছি , প্রথমবার | কৃষ্ণেন্দুকে এবার ছেড়ে দাও ওর মতন | অনেক তো করলে ! অনেক থেকেছো | আর না | আজ থেকে শুধু আমার জন্য থাকো মা | ফিরে চলো আমার সঙ্গে | আমাদের বাড়িতে |”
দীপ্তির ভেজা চোখ আর দৃঢ় গলায় কিছু একটা ছিল সেদিন , যার জন্য আলো আর না বলতে পারেনি ওকে | অনেকদিন ধরেই ও দেখেছে কৃষ্ণেন্দুর বদলগুলো | কিন্তু দেখেও চুপ থেকেছে সব সময় | টাকার নেশা আসলে এমনই একটা জিনিস , যেটা একবার শুরু হলে কারোর বারণে শেষ হয় না | সে তখন আরো চায় | আরো ব্যস্ততা , আরো কাজ , আর আরো অনেক টাকা | আলো এই বদলের ভিড়ে জানতো একদিন দীপ্তি ক্লান্ত হয়ে যাবে | পারবে না আর থাকতে কৃষ্ণেন্দুর সঙ্গে | আর ছেলেটা তো কোনোদিনও দীপ্তিকে সময় দেয়নি সেইভাবে | একতরফা আর কতদিনই বা থাকতো মেয়েটা ! কথাগুলো ভেবে আলোও আর কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলো না দীপ্তিকে | কিছু সময় কোনো প্রশ্ন ছাড়াই সঙ্গে থাকতে হয় | আর কোনো বড়ো ঘটনা না ঘটলে দীপ্তি যে এতো কঠিন একটা ডিসিশন নিতো না , এটা আলো জানে | তাই সেইদিন নিশ্চুপ ভাবেই নিজের ব্যাগ গুছিয়ে নিয়েছিল | আর সত্যি কথা বলতে কি , এই বাড়িতে ও জোর করেই থেকেছে | ভেবেছে কৃষ্ণেন্দুর মাথার ওপর কারোর একটা থাকা দরকার, তাই | তবে এই এতগুলো দিন এই বাড়িতে আসার পর থেকে কৃষ্ণেন্দু কেমন ধরা ছোঁয়ার বাইরেই হয়েছিল | রাত্রে একই টেবিলে বসে খেত না , কখনো আলাদা করে এসে কথা বলতো না , কেমন যেন নিজের একটা জগতে থাকতো সব সময় | যেখানে কাজ ছাড়া নিজের লোকেদের জন্য আর কোনো জায়গা নেই | তাই প্রয়োজন যখন শেষ , তখন আর থেকে কি লাভ ! পুরোনো ঠিকানায় ফিরে যাওয়াই ভালো |
এই ভাবনার ভিড়ে ওরা এক এক করে নিজের দরকারি , অদরকারি সব জিনিসগুলো গুছিয়ে নিয়ে বাড়ি ছেড়েছিলো চুপচাপ | কৃষ্ণেন্দু সেদিন এতো ড্রিংক করেছিল যে বাড়ি এসে আলাদা করে বোঝেনি কারোর থাকা না থাকার তফাৎটা | নিজের ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল নেশার ঘোরে | পরেরদিন সকালে যখন উঠেছিল তখন হরি এসে বলেছিলো ওকে সবটা | কথাগুলো শুনে প্রথমে যেন ঠিক বিশ্বাস হয়নি কৃষ্ণেন্দুর সেই মুহূর্তে | প্রায় লাফ দিয়ে খাট থেকে উঠে ও গিয়েছিলো আলো আর দীপ্তির ঘরে | ফাঁকা আলমারি , শূন্য ঘরগুলো দেখে তারপর স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলো কিছুক্ষন | সত্যি ওরা কিছু না বলে চলে গেলো ! ছেড়ে দিলো এই বাড়িটা ! আলো মা কি করে পারলো এটা ! ঠিক ভুলটা শুধু নিজের মেয়ের মুখ থেকেই শুনলো ! ওকে কিছু জিজ্ঞেস করার চেষ্টাও করলো না ! আর দীপ্তি ; কিসের জন্য করলো এরকম ! একটা সরিই তো বলতে বলেছিলো কৃষ্ণেন্দু মিস্টার ভট্টাচারিয়াকে | একজন অতো বয়স্ক মানুষকে ওই অনিকেত পার্টিতে সবার সামনে ধাক্কা মেরে ফেলে দিলো ! দীপ্তি একটা সাধারণ ঘটনাকে এতটা বড়ো ইস্যু বানিয়ে ফেললো যে কৃষ্ণেন্দুর ব্যবসার হয়তো খুব বড়ো একটা ক্ষতি হয়ে যেতে পারতো ! এই সবের জন্য বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে ! কৃষ্ণেন্দু কিরকম দিন রাত পরিশ্রম করে এই বিজনেসটাকে আজ এই জায়গায় নিয়ে এসেছে , সেটা তো দীপ্তি নিজের চোখে দেখেছে | তাহলে কাল নিজের ইগোটা কে সাইডে রেখে একটা সরি কি বলা যেত না ! না কি এইসবটাই আসলে মিথ্যে কারণ | আসল কারণ অনিকেত | এখন তো দীপ্তির কাছে ওই ছেলেটাই সব ব্যাপারে ঠিক | সব থেকে বেশি ইম্পরট্যান্ট | হয়তো দীপ্তি মনে মনে ঠিকই করে রেখেছিলো যে ছেড়ে চলে যাবে ওকে | শেষ করে দেবে রিলেশনটা | শুধু একটা ছোট্ট কারণ খুঁজছিলো এই শেষের | কাল সেই সুযোগটা আসায় স্বদব্যবহার করে ফেললো, ব্যাস | কথাগুলো ভেবে কষ্টে গলাটা বুজে আসছিলো কৃষ্ণেন্দুর | এই প্রথম প্রচন্ড কান্না পাচ্ছিলো ওর | সঙ্গে অদ্ভুত একটা রাগ হচ্ছিলো যেন | চারিদিক অন্ধকার লাগতে শুরু করেছিল এক সেকেন্ডে | কৃষ্ণেন্দু এই ফাঁকা ঘরে , এই অন্ধকারের ভিড়ে কেমন পাগলের মতন বিছানার বালিশ , চাদর , ঘরের তাকে রাখা বইগুলো , টেবিলে পরে থাকা ছোট্ট ঘড়ি , ছোট ছোট শোপিসগুলো , খাটের পাশে সাজানো ল্যাম্পটা , সব আঁছড়ে আঁছড়ে ফেলে দিতে শুরু করলো মেঝেতে | ভাঙতে শুরু করলো সবকিছু | একটা অন্য ছেলের জন্য দীপ্তি কৃষ্ণেন্দুকে ছেড়ে চলে গেছে এটা মেনে নিতে ওর ভেতরটা শেষ হয়ে যাচ্ছিলো বার বার | রাগটা ঘরের জিনিসপত্রের ওপর বার করেও ঠিক মিটলো না যেন | এখন মনে হচ্ছে সব কিছু ভুলে যাওয়াটা খুব দরকার | এতো সত্যির ভিড়ে নিজেকে আড়াল করার জন্য নেশার খুব দরকার | তাই রাগ , কষ্ট , অভিমানের মধ্যে ও প্রায় দৌড়ে নিজের ঘরে গেলো | ফ্রিজটা খুলে নেশার বোতলগুলোকে আঁকড়ে ধরলো তারপর | এখন এই নেশার ঘোরটাই ওকে একটু শান্তি দেবে হয়তো ! ভুলিয়ে দেবে যন্ত্রণাগুলো |
কিন্তু সেইদিন কৃষ্ণেন্দু বোঝেনি যে নেশা কিছুক্ষনের জন্য মুক্তি দেয় | মরীচিকার শান্তি দেয় | যেটা কয়েক মুহূর্তেই চোখের পলকে মিলিয়ে যায় | নেশা কেটে গেলেই পুরোনো যন্ত্রনা , কষ্টগুলো আঁকড়ে ধরে আবার আগের মতন | বুকের কাছে অদ্ভুত একটা জটলা করে থাকে পুরোনো স্মৃতিরা একসাথে | ঘুমিয়ে , জেগে থেকে , কাজের মধ্যে , একাকিত্বে , কিছুতেই , এই স্মৃতি , এই দুঃখটা ভোলা যায় না | দীপ্তি , আলো মা আসলে ওর কাছে কি , সেটা মনে হয় এই খালি বাড়িতে রোজ না ফিরলে বোঝাই হতো না কখনো ওর ! এই নিঃস্তব্ধ ফার্নিচারগুলোর সঙ্গে দিন না কাটালে মানুষের গুরুত্বটা হয়তো কৃষ্ণেন্দু জানতে পারতো না আজও | যেমন এখন যখন আর কেউ খাবার টেবিলে ওর জন্য অপেক্ষা করে না , দেরি করে বাড়ি ফেরার জন্য কখনো কেউ আর কনসার্ন দেখিয়ে ফোন করে না , কেবিনের উল্টোদিকের দীপ্তির বসার জায়গাটা খালি পরে থাকে রোজ , কেউ আর ওর কাছ থেকে সময় চেয়ে নেয় না নিজের জন্য , তখন যেন ভেতর থেকে ভাঙে কৃষ্ণেন্দু | দিনের পর দিন এই নিঃস্তব্ধতা , কারোর সঙ্গে না থাকার মধ্যে ও একাকিত্বকে চিনছে যেন নতুন করে ! আগে যেই ভুলগুলোকে চোখে দেখেও দেখেনি কখনো নিজের , আজ সেইসব ভুলগুলো যেন মাঝে মাঝেই আয়নায় ওর সামনে পরিষ্কার হয়ে যায় | পুরোনো ঘটনাগুলো বার বার যেন ভাবিয়ে তোলে ওকে , না চাইতেও |
চলবে