অন্য বসন্ত ( নবম পর্ব )

0
1276

অন্য বসন্ত ( নবম পর্ব )
ঈপ্সিতা মিত্র
<৫>
সেই সপ্তাহে আরো দুটো দিন কেটে যাওয়ার পর দীপ্তি সেদিন কৃষ্ণেন্দুর অফিসে গিয়েছিলো , এই প্রজেক্টটার জন্য কাজ শুরু করতে | মন থেকে না চাইলেও , শুধুমাত্র ওই ওয়ার্কার্সগুলোর কথা ভেবে গিয়েছিল ও | যদিও মনে তখনও অনেক কাটাকুটি খেলা চলছে | না চাইতেও ভেসে আসছিলো পুরোনো দিনগুলো চোখের সামনে | সেই অদরকারি দিনগুলোতে , যখন দীপ্তি এই অফিসে শুধুমাত্র একটা ড্রাফট লেখা , একটা ফাইল পৌঁছে দেয়ার মতন কাজ করে দিনটা কাটিয়ে দিতো ! কেউ আর দাম দিতো না ওর ভালো মন্দ ওপিনিয়ন গুলোর | তৃষা ওকে কারণে অকারণে যখন বার বার বুঝিয়ে দেয়ার চেষ্টা করতো , এই অফিসে ও একজন সাধারণ এমপ্লয়ি ছাড়া আর কিছুই না ! তখনকার সময়টা যেন উঁকি দিচ্ছে মনে | এইসব ভাবনার ভিড়েই সেদিন অফিসে এসে কয়েক সেকেন্ডের জন্য একটু যেন অবাক হয়ে গেছিলো ও | তৃষার কেবিনটা খালি পরে আছে | কেউ নেই সেখানে ! কথাটা ভাবতে ভাবতেই তারপর দেখা হয়েছিল হঠাৎ পরিতোষ জেঠুর সঙ্গে | ওর দিকেই এক গাল হেসে এগিয়ে আসছিলো লোকটা | দীপ্তি সেই মুহূর্তে চোখটা বড়ো বড়ো করেই জিজ্ঞেস করে ফেললো , ———– ” তুমি ? এখানে ? তুমি আবার জয়েন করেছো জেঠু ?”
কথাটা শুনে পরিতোষ জেঠু আলতো হেসেই উত্তর দিলো , ———– ” হ্যাঁ | শুধু আমি কেন | নির্মাল্য , শিশির , অমল সবাই জয়েন করেছে আবার | কৃষ্ণেন্দু নিজে প্রত্যেকের বাড়ি গিয়ে ক্ষমা চেয়েছে জানিস | আমাদের এতো করে রিকুয়েস্ট করেছে ও তারপর ফেরার জন্য , যে আমরা কেউই আর না করতে পারিনি | দু মাস আগেই জয়েন করেছি | তবে আজ তোকে দেখে খুব ভালো লাগছে | দেখবি , আমরা সবাই মিলে আবার আগের মতন কাজ করে এই কোম্পানিটাকে দাঁড় করাবো নতুনভাবে |”
কথাটা শুনে ও এই মুহূর্তে জোর করেও আর হাসতে পারলো না পরিতোষ জেঠুর সামনে | আগের মতন যে আর কিছুই নেই ! ভেতর থেকে যেটা শেষ হয়ে গেছে , সেটাকে নতুন করে আর কিভাবেই বা সাজাবে ! কথাটা মনে আসতেই ও অন্য একটা প্রশ্ন করে উঠলো , ———- ” আচ্ছা , জেঠু , তৃষাকে দেখছি না তো ? এই ক্রাইসিস এর সময় ওর বাবা যদি হেল্প করে তাহলে তো খুব সহজেই এই প্রজেক্টের ফান্ডিংটা পেয়ে যাবো আমরা |”
কথাটা শুনে পরিতোষ জেঠু আকাশ থেকে পড়ার মতন মুখ করেই এবার উত্তর দিলো যেন , ———- ” তুই শুনিসনি তৃষার কথা ! ওর সাথে তো আর এই কোম্পানির কোনোই লিংক নেই | কৃষ্ণেন্দু অনেকদিন আগেই তৃষার বাবার সঙ্গে সব রকম বিজনেস রিলেশন ভেঙে দিয়েছে | আমাদের সবার জয়েন করার আগেই | ”
এই কথাটা দীপ্তি সত্যি এই মুহূর্তে একদম এক্সপেক্ট করেনি ! কৃষ্ণেন্দুর সঙ্গে তৃষাদের আর কোনো বিজনেস রিলেশন নেই ! যার কথায় একদিন এই পুরো অফিস চলতো , যার ফিনান্সিয়াল হেল্প এর জন্য এই সেন টেক্সটাইল এতটা নাম করলো ! সেই তৃষাকে কৃষ্ণেন্দু সরিয়ে দিলো নিজের বিজনেস , প্রফিট এইসবের কথা না ভেবে ! এতটা বেহিসাবি কাজ করলো কি করে ছেলেটা ! আর তার ওপরে পুরোনো সব এমপ্লইয়ের বাড়িতে গিয়ে সরি বলে নিজে থেকে নিয়ে আসা ! কৃষ্ণেন্দুকে ও যতটা দেখেছে , সেখানে তো এগুলো কিছু মেলাতেই পারছে না | একটা ইমোশনহীন , হিসাবি বিজনেসম্যান হঠাৎ এই রকম এলোমেলো কাজ কবে থেকে শুরু করলো ! বিশ্বাস হচ্ছে না ঠিক | তাহলে কি মা সত্যি বলেছিলো ! মানুষ বদলায় ! কৃষ্ণেন্দু কি বুঝতে পেরেছে নিজের ভুলগুলো ! প্রশ্নটা আনমনে এসে জড়ো হলো যেন মনে | তবে দীপ্তি আরেকবার নিজের মনকে শক্ত করে বলে উঠলো যে না , কেউ বদলাক , কি আগের মতন থাকুক , তাতে ওর কিছু যায় আসে না | কৃষ্ণেন্দু একটা সময় যেই অপমানগুলো দীপ্তিকে করেছে ,সেগুলো তো আর এই বদলের ভিড়ে শেষ হয়ে যাবে না ! সারা জীবন মনের মধ্যে থেকে যাবে ওর | তাই কৃষ্ণেন্দুকে নিয়ে আর ভাবার মতন কিছু নেই | এই প্রজেক্টটা যতটা তাড়াতাড়ি সম্ভব শেষ করতে পারলেই শান্তি | তারপর তো এই ছেলেটা শর্ত মতন আর সামনে আসবে না ওর | সারা জীবনের দূরত্ব এসে জমবে জীবনে | আর সেটাই ঠিক | কিছু মানুষের সাথে দূরত্বটাই ঠিক | কথাটা ভেবেই ও অফিসের ভেতরে এগিয়ে গেলো আজ |
কৃষ্ণেন্দু সেই সময়ে নিজের কেবিনে ছিল | দীপ্তি যে আজ থেকে অফিসে আসবে সেই খবরটা জানতো কৃষ্ণেন্দু | তাই আনমনে যেন অপেক্ষাই করছিলো ওকে একবার দেখার ! সেই সময়েই দরজা খোলার আওয়াজ কানে এলো | অনেকগুলো দিন পেরিয়ে আবার দীপ্তি ওর ঘরে আসলো , সেই পুরোনো দিনগুলোর মতন | কৃষ্ণেন্দু এই আসাটাকে দেখে নিজে চেয়ারটা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো , তারপর কি রকম নিস্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে | দীপ্তি ব্যাপারটা খেয়াল করলেও ওকে কোনো রকম প্রশ্রয় না দিয়ে একেবারে কাজের কথা বলে উঠলো কৃষ্ণেন্দুকে ,
———— ” নতুন অর্ডারের ফাইলটা দাও | কত পিস্ অর্ডার আছে , ডেড লাইন কবে , কিছুই তো জানি না | তাই |”
কৃষ্ণেন্দুর কথাটা শুনে যেন ঘোর কাটলো হঠাৎ | ও সেই মুহূর্তে একটু কথা সাজিয়ে বলে উঠলো , ————– ” এই ফাইলের কপি আমি তোর কেবিনে অলরেডি রেখে দিয়েছি | সব ডিটেলস পেয়ে যাবি সেখান থেকেই |”
দীপ্তি কথাটা শুনে একটু যেন অবাক হয়েই বললো , ——— ” কেবিনে ! মানে ? আমি তো !”
কৃষ্ণেন্দু এর উত্তরে চোখটা নিচে নামিয়ে আস্তে গলায় বললো , ———– ” হ্যাঁ , আমি আসলে তোর জন্য একটা কেবিন রেডি করেছি | তুই এরপর থেকে যতদিন কাজ করবি , ওখানেই করবি | ”
কৃষ্ণেন্দুর কথাটা শেষ হতেই ও খেয়াল করলো দীপ্তির মুখটা কিরকম কঠিন হয়ে গেছে যেন | ও সেই মুহূর্তে দৃঢ় গলায়ই বললো ,
————– ” হঠাৎ এতো এটেনশনের আমার দরকার নেই কৃষ্ণেন্দু | এই অফিসে যখন আগে দিনের পর দিন কাজ করেছি , তখনই বুঝে গিয়েছি এই কোম্পানি আমাকে ঠিক কতটা দাম দিতে পারে, আমার পরিশ্রমের , আমার রাত জাগার জন্য | তাই ওই ছোট ডেস্কটাই ঠিক আছে | ওটাই আমার আসল জায়গা | আজ নতুন করে কেবিন সাজিয়ে দিয়ে আমি কতটা ইম্পরট্যান্ট সেটা প্রমাণ করতে হবে না | সেইসব আমি আগেই জেনে গিয়েছি | তাই আমি ওই পুরোনো ডেস্কটাতেই বসবো |”
কথাটা বলেই দীপ্তি আর অপেক্ষা করলো না কৃষ্ণেন্দুর কোনো উত্তরের | ঘরটা খালি করে দিয়ে চলে গেলো সেদিন | তবে কৃষ্ণেন্দু কিরকম নিঃস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষন | ও নিজে দীপ্তির কেবিনটা সাজিয়েছিল | পুরোনো ভুলটাকে ঠিক করার জন্যই | আসলে এই অফিসটা রিডেকরেট হওয়ার পরে দীপ্তি একটা ছোট্ট ডেস্কে বসতো দিনের পর দিন | তৃষা সেই সময় এই অফিসটাকে নতুন করে ডিসাইন করেছিল | কৃষ্ণেন্দু তখন দীপ্তির জন্য একটা কেবিনের কথা বলেছিলো ওকে | তবে তৃষার আর্কিটেক্ট না কি কোনো জায়গা খুঁজে পায়নি ওর কেবিন করার মতন ! সেই সময় কৃষ্ণেন্দুও অন্ধের মতন কথাটা বিশ্বাস করে নিয়েছিল | একবারও ভাবেনি দীপ্তির কিরকম লাগবে ওই ছোট্ট ডেস্কটা দেখে ! আসলে কৃষ্ণেন্দু যেন একটা ঘোরের মধ্যে থাকতো ওই দিনগুলোতে | নিজেরটা ছাড়া অন্যের ভালো খারাপ লাগা নিয়ে ও যেন ভাবতেই ভুলে গিয়েছিলো ! তবে এখন যখন ঘোর কেটেছে , তখন ও রোজ চেষ্টা করে , সেই পুরোনো ভুলগুলোকে ঠিক করার | তবে আজ দীপ্তির কথাগুলো শুনে মনে হলো অতো সহজ না | সময় একবার হাত থেকে চলে গেলে কোনো ভুলই ঠিক করা অতটা সহজ না |
সেইদিন এরপর বিকেলবেলা দীপ্তি আরেকবার কৃষ্ণেন্দুর কেবিনে এসেছিলো , একটু চিন্তা সঙ্গে নিয়েই | এই নতুন অর্ডারের ফাইলটা ও ভালো করে পরে ফেলেছে এতক্ষনে | সেই নিয়েই কথা বলতে এসেছে এখানে | কৃষ্ণেন্দুকে ও এই মুহূর্তে সোজাসুজিই বলে উঠলো ,
————— ” এক মাসের মধ্যে দু লাখ শার্টের অর্ডার কমপ্লিট করা এই পরিস্থিতিতে খুবই টাফ | ইন্সিওরেন্সের টাকার কি হলো ? ওটা কতদিনে পাবে ?”
কৃষ্ণেন্দু এর উত্তরে একটু অন্ধকার মুখেই বললো ,
———– ” ওরা ইনকোয়ারি বসিয়েছে | আগুনটা যে এক্সিডেন্টালি লেগেছে , এটা প্রুভ হওয়ার পর টাকা পেতে পেতে দু তিন মাস তো লেগেই যাবে ! ”
কথাটা শুনে দীপ্তি কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে এবার বলে উঠলো , ————- ” যদি আমরা ওয়ার্কার্সদের এক মাসের মাইনে না দিয়ে কাজ করার জন্য রিকোয়েস্ট করি , আর কোনো রকম এডভান্স না দিয়ে সুতোর সাপ্লাই নিই , তাহলে অনেক টাকা সেভ হয়ে যাবে | তুমি ওই অয়ন কাঞ্জিলাল লোকটার সঙ্গে কথা বলো একবার | উনি তোমার এতদিনের চেনা | এই টুকু কনসিডার করতেই পারে |”
দীপ্তির এক নিঃশ্বাসে বলা কথাগুলো শেষ হয়ে গেলে কৃষ্ণেন্দু এবার একটু সময় দিয়ে উত্তর দিলো , ———- ” লাস্ট কয়েক মাস ধরে আমরা আর অয়ন কাঞ্জিলালের কাছ থেকে সুতো কিনি না | আগে যেরকম বাঁকুড়ার ফ্যামিলিগুলোর কাছ থেকে নিতাম , ওখান থেকেই নিই | ”
কথাটা শুনে দীপ্তি এখন যেন একটু থমকে গেলো ! এতো বদল কৃষ্ণেন্দুর মধ্যে ! আগে যখন ও অতো করে বুঝিয়েছিল , বাঁকুড়ার ওই গ্রামের লোকগুলোর কথা , ওদের অভাবের কথা , তখন তো কৃষ্ণেন্দু ঠিক কানই দেয়নি | একদিনে ডিসিশন দিয়ে নিয়েছিল অয়ন কাঞ্জিলালের সঙ্গেই ব্যবসা করবে | কিন্তু এরপর হঠাৎ কি হলো ! লাভ ক্ষতির হিসাব ভুলে কৃষ্ণেন্দু আবার ওই পুরোনো জায়গাতেই ফিরে গেলো ! কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই কৃষ্ণেন্দু এবার দীপ্তিকে আর একটু অবাক করে দিয়ে অন্য একটা কথা বলে উঠলো হঠাৎ ,
—————- ” কিন্তু দীপ্তি , আমি আমার ওয়ার্কার্সদের এই রকম একটা রিকোয়েস্ট করতে পারবো না ! এক মাস মাইনে না পেলে ওদের ভীষণ অসুবিধা হয়ে যাবে | সবারই তো একটা ফ্যামিলি আছে | আর বাঁকুড়ার গ্রামের ফ্যামিলিগুলোও , ওদেরও তো প্রচন্ড অভাবের সংসার | ওদেরও এডভান্স না দিলে ভীষণ প্রব্লেম হয়ে যাবে | এমনিই দিন আনা , দিন খাওয়া লোকজন | ওই মানুষগুলোর সামনে গিয়ে তারপর এই রকম একটা কথা আমি বলতে পারবো না | যদিও জানি , এরা সবাইই কোম্পানির ক্রাইসিসের কথা ভেবে আমাকে হেল্প করবে | কিন্তু এটার সুযোগ আমি নিতে পারবো না |”
কথাগুলো শুনে দীপ্তি কি বলবে ঠিক বুঝতে পারলো না | হঠাৎ মনে হলো ওর অনেকদিনের চেনা সেই পুরোনো কৃষ্ণেন্দু যেন কথা বলে উঠছে | যার কাছে ব্যবসা , প্রফিট এইসবের অনেক আগে ছিল ঠিক ভুলের তফাৎটা | যে কখনো কাউকে ছোট করে বড়ো হতে চায়নি | কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই দীপ্তি এবার বলে উঠলো ,
—————— ” কিন্তু তুমি এতো টাকা এখন পাবে কোথা থেকে ? কোম্পানির একাউন্টে এখন যা টাকা আছে , সেটা তো ওই পুরোনো অর্ডারগুলো , মানে এই আগুন লেগে যাওয়ার জন্য যেইসব অর্ডার গুলো আমরা কমপ্লিট করতে পারিনি , তাদের এডভান্স ফেরত দিতে দিতেই শেষ হয়ে যাবে | তাহলে টাকাটা এরেঞ্জ করবে কোথা থেকে ?”
দীপ্তির কথার উত্তরে কৃষ্ণেন্দু একটু ভেবে বললো , —————— ” করবো কিছু একটা করে | কিন্তু আমি এডভান্স না দিয়ে কারোর কাছ থেকে কোনো র মেটেরিয়াল কিনবো না | আর কোম্পানির ওয়ার্কার্সদের অন্তত হাফ মাইনে দেয়ার চেষ্টা আমি করবো | যেভাবেই হোক করবো | কিন্তু প্রব্লেম তো আরো একটা আছে | আগুন লেগে আমাদের সব নতুন স্টিচ মেশিনগুলো খারাপ হয়ে গেছে | আর এখন যা ফিনান্সিয়াল কন্ডিশন , সেখানে নতুন মেশিন কেনো আর পসিবল না | ওরা কাজটা কিভাবে করবে আমি সেটাই ভাবছি !”
কৃষ্ণেন্দুর কথাটা শেষ হতেই দীপ্তি বলে উঠলো এবার , ———— ” সেটা আমি ভেবেছি | তুমি মনে হয় ভুলে গেছো , তোমার বাবার আমলের সব স্টিচ মেশিন গুলোর কথা | তৃষা আসার পর যেগুলো স্টোর রুমে তুলে রাখা হয়েছিল , আর তার বদলে নতুন মেশিন বসানো হয়েছিল ফ্যাক্টারিতে | কিন্তু এখন যেহেতু কোনো উপায় নেই , তাই ওই পুরোনো মেশিনগুলোকেই আবার কাজে লাগাতে হবে | আমার মনে হয় পুরোনো মেশিনগুলো ইউজ করে ইজিলি কাজটা কমপ্লিট করা যাবে |”
দীপ্তির কথায় কৃষ্ণেন্দু একটু অবাক হয়েই বললো যেন , ————- ” সত্যিই তো ! এই পুরোনো স্টিচ মেশিনগুলোর কথা তো আমার মাথাতেই ছিল না ! ঠিকই বলেছিস | ওগুলো দিয়ে ইজিলিই এখন কাজ চালিয়ে নেয়া যাবে |”
দীপ্তি এর উত্তরে আলতো হেসে দৃঢ় গলায় বললো , ———- ” আসলে পুরোনো হয়ে যাওয়া মানেই বাতিল না | কিন্তু এই কথাটা সবাই বোঝে না | এই যা !”
দীপ্তি যে কথাটা কৃষ্ণেন্দুর জন্যই বললো , এটা বুঝতে ওর কোনো অসুবিধা হলো না | তবে কথা শোনাটা তো ও ডিসার্ভ করে | ঠিকই বলেছে দীপ্তি ! কৃষ্ণেন্দু একটা সময়ে তো নতুনের ভিড়ে এতটাই হারিয়ে গিয়েছিলো , যে পুরোনো মানুষগুলোকে দেখেও দেখেনি | পুরোনো জিনিস , পুরোনো অভ্যাস , পুরোনো কাছের লোকগুলোকে এক রকম স্টোর রুমেই বন্ধ করে রেখেছিলো দিনের পর দিন | তাই দীপ্তির কথাটা ওর জন্য একদম ঠিক | কথাটা ভাবতে ভাবতেই কৃষ্ণেন্দু খেয়াল করলো দীপ্তি এবার নিজের ব্যাগটা কাঁধে দিয়ে উঠলো চেয়ার থেকে | তার মানে নিশ্চই বাড়ি যাবে এখন | সন্ধ্যে তো হয়েই গেছে প্রায় | কথাটা মনে আসতেই কৃষ্ণেন্দু বলে উঠলো , ————- ” তুই বাড়ি যাচ্ছিস ? আমি আমার ড্রাইভারকে বলে দিচ্ছি | পৌঁছে দেবে তোকে |”
কৃষ্ণেন্দুর কথাটা শুনে দীপ্তি একটু স্থির হয়ে গেলো যেন | তারপর খুব কঠিন গলায় উত্তর দিলো , ———— ” লাগবে না | তোমার গাড়ি , তোমার হেল্প আমার লাগবে না | আর এই এক মাস আমি এই অফিসে কাজ করছি মানেই যে সব ঠিক হয়ে গেছে সেটা না ! এই অফিসের বাইরে না তুমি আমাকে চিনবে , না আমি তোমাকে চিনবো | যেইরকম অচেনা ছিলাম এতদিন , সেইরকমই থাকবে সব কিছু , আগের মতন | ”
কথাটা শেষ করেই দীপ্তি কৃষ্ণেন্দুর চোখের সামনে হারিয়ে গেলো আর একবার | কৃষ্ণেন্দুর এই মুহূর্তে ভেতর থেকে লাগলো ভীষণ | কাঁচ ভাঙা যন্ত্রনা শুরু হলো মনে | কেউ যখন বার বার এইভাবে ভুলগুলো মনে করিয়ে দেয় , এক্তিয়ারটা বুঝিয়ে দেয় , তখন তো এইভাবেই কাঁচ ভাঙে মনে | টুকরো গুলো বিঁধতে থাকে একটু একটু করে | কাঁটাছেড়ার যন্ত্রনা শুরু হয়ে যায় বুকে | কৃষ্ণেন্দু সেই যন্ত্রণার মাঝেই আজ ঠিক করলো , যে ও সত্যি আর ভুলবে না নিজের এক্তিয়ারটা | আর কখনো দীপ্তিকে প্রয়োজনের বাইরে একটা কথা বলেও বিরক্ত করবে না | এই একটা মাস তো ! কৃষ্ণেন্দু দূরেই থাকবে |
<৬>
এরপর কটা দিন কেটে গেছে | এর মধ্যে একদিন মাঝখানে দীপ্তিকে বাঁকুড়া যেতে হয়েছিল | তবে সেদিন সকালে বেরোনোর আগে ও ভীষণ অবাক হয়েছিল , যখন কৃষ্ণেন্দু এডভান্সের টাকাটা দীপ্তির হাতে দিয়েছিলো নিজে থেকে | ত্রিশ হাজার টাকা কৃষ্ণেন্দু ওকে দিয়েছিলো গ্রামের লোকেদের দেয়ার জন্য ! এর মাঝে এই মাসের হাফ স্যালারির ব্যবস্থাও করেছে কারখানার ওয়ার্কার্সদের জন্য | দেড়শো জন ওয়ার্কার্সকে পনেরো হাজার টাকা স্যালারি দিয়েছে ও | কোথা থেকে যে এতো টাকা জোগাড় করেছে কৃষ্ণেন্দু এটাই দীপ্তি ঠিক বুঝতে পারছে না | কোনো নতুন ইনভেস্টর যে ওরা পায়নি , এটা দীপ্তি জানে | তাহলে এতগুলো টাকা আসছে কোথা থেকে ! ওর পার্সোনাল সেভিংস এর সব টাকাও তো শেষ না কি ! আগের ক্লাইন্টদের টাকা ফেরত দিতে দিতে ! আনমনে এইসব কথাগুলো ভেবেই সেইদিন ও এসেছিলো অফিসের পার্কিং এরিয়ায় | কলকাতা থেকে বাঁকুড়া যেতে ভালোই টাইম লাগে | তাই এই সকাল আটটার মধ্যেই বেরিয়ে যাচ্ছে ও | এইসব ভেবেই গাড়িতে উঠতে যাবে তখন একটা ঘটনা ঘটলো | ড্রাইভারের হঠাৎ একটা ফোন এলো বাড়ি থেকে | ওর মা না কি অসুস্থ হয়ে গেছে ! হসপিটালে নিয়ে গেছে পাড়ার লোকজন | কথাটা শুনে লোকটা যেন ঠিক রাখতে পারলো না নিজেকে | দীপ্তিকে মুখের ওপরই বলে দিলো যে যেতে পারবে না আজ | দীপ্তি তো কথাটা শুনে প্রথমে বুঝতে পারছিলো না কি করবে ! এটা অফিসের গাড়ি ছিল | জার্নিটা সহজ হতো গাড়ি করে গেলে | এখন কটায় ট্রেন কে জানে ! আর এদিকে আজ আবার রবিবার | অফিস বন্ধ | অন্য ড্রাইভারও পাওয়া যাবে না তাই সহজে | কথাটা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ সেই মুহূর্তে কৃষ্ণেন্দু এসে হাজির হয়েছিল ওর সামনে | এই ড্রাইভার না কি ওকে ফোন করে বলেছে সবটা , যে ও যেতে পারবে না আজ | এই কথাটা শুনেই কৃষ্ণেন্দু পার্কিং এরিয়ায় নেমে এসেছে | কথাগুলো শুনে দীপ্তির হঠাৎ মনে হলো কৃষ্ণেন্দু কি ইচ্ছে করে এইসব করছে ! যাতে ওর সঙ্গে বাঁকুড়া যেতে পারে ! ভাবনাটা মনে জমতেই দীপ্তি একটু গম্ভীর মুখে বলে উঠলো ,
————— ” আমি ট্রেনে চলে যাবো বাঁকুড়া | তোমার ভাবার দরকার নেই | নিজের কাজ করো |”
কথাটা বলে দীপ্তি বেরোতে যাবে তখন কৃষ্ণেন্দুর একটা কথায় থমকে গেলো যেন | কৃষ্ণেন্দুও আজ দৃঢ় গলায় বললো ,
————- ” ভাবার দরকার আছে | যেহেতু তুই আমার কোম্পানির কাজ করতেই অতো দূর যাচ্ছিস , তাই তোর সুবিধা অসুবিধার কথা আমাকেই ভাবতে হবে | আর জানি , তোর হয়তো মনে হচ্ছে এই ড্রাইভারের হঠাৎ চলে যাওয়াটা আমার প্ল্যান করা | যাতে আমি নিজে তোর সাথে বাঁকুড়া যেতে পারি | কিন্তু তোকে আমি ওর ফোন নাম্বার , বাড়ির এড্রেস সব দিয়ে দেব | ফিরে এসে খোঁজ নিতে পারিস | ওর মা সত্যি অসুস্থ কি না ! যাইহোক , এখন যখন ড্রাইভার নেই , তখন আমি নিজে ড্রাইভ করে তোকে বাঁকুড়া নিয়ে যাবো , আর কলকাতা ফিরিয়ে আনবো | আর চিন্তা করিস না , আমরা এই পুরো রাস্তা অচেনাই থাকবো | ”
কথাটা শেষ করেই কৃষ্ণেন্দু ওর সামনে গাড়ির দরজাটা খুলে দাঁড়ালো | দীপ্তি এই মুহূর্তে কিছুতেই যেন আর না বলতে পারলো না ওকে ! অদ্ভুত একটা দৃঢ়তা ছিল আসলে কৃষ্ণেন্দুর গলায় | মনে হচ্ছিলো সেই পুরোনো ছেলেটা যেন ওর সঙ্গে কথা বলছে , যাকে দীপ্তি কিছুতেই মুখের ওপর কোনো ব্যাপারে না বলতে পারে না | তাই নিঃস্তব্ধভাবে গাড়িতে উঠে বসলো ও | কিন্তু এরপর কৃষ্ণেন্দু নিজের কথা রেখেছিলো সারা রাস্তা জুড়ে | ও সত্যি দীপ্তির সঙ্গে একটা শব্দও বলার চেষ্টা করেনি | কিরকম কথাহীনভাবে মাইলের পর মাইল গাড়ি চালিয়ে নিয়ে গিয়েছিলো ওকে | চলন্ত রাস্তার ভিড়ে এই প্রথম দীপ্তি খেয়াল করেছিল ওই নিঃস্তব্ধ কৃষ্ণেন্দুকে প্রথমবার | হালকা না কাটা দাঁড়ি , ক্লান্ত দুটো চোখ , আর অদ্ভুত একটা থমকে থাকা চেহারার মাঝে চুপ হয়ে যাওয়া একটা ছেলেকে ! সেদিন আনমনে হঠাৎ যেন খেয়াল করেছিল কৃষ্ণেন্দু যেন আগের থেকে রোগা হয়ে গেছে একটু ! তবে কথাটা কয়েক সেকেন্ডের জন্য মনে আসার পরেই আবার স্তম্ভিত ফিরে এসেছিলো দীপ্তির | খেয়াল হয়েছিল ও অনেক বেশি হিসাবের বাইরের কথা ভেবে ফেলছে ! যাকে নিয়ে অনেকদিন আগেই সব ভাবনা শেষ হয়ে গেছে , তার জন্য আর নতুন করে চিন্তা করে লাভ নেই | কথাটা সেদিন মনে আসতেই এরপর ও চোখটা জানলার কাঁচে সরিয়ে নিয়েছিল নিজের | চলন্ত রাস্তার ভিড়ে মনটাকে আড়াল করার চেষ্টা করেছিল সারাক্ষন |
তবে সেদিন গ্রামে পৌঁছেও ও যেন একটা অন্য কৃষ্ণেন্দুকে দেখেছিলো হঠাৎ | ওই অহং থেকে বেরিয়ে আসা পুরোনো ছেলেটাকে | কৃষ্ণেন্দু কখন যে কাজ শেষ করে গ্রামের বাচ্চাদের সাথে খেলতে গল্প করতে শুরু করেছিল , ও বুঝতে পারেনি | খেয়াল হলো যখন দুপুরে একজন তাঁতির বাড়িতে খাওয়ার জন্য ডাক পড়লো ওদের | দীপ্তি সেই সময় সুতোর কোয়ালিটি চেক করছিলো একজনের বাড়িতে | ওকে সেইদিন সহজে খুঁজে পাওয়া গেলেও কৃষ্ণেন্দুকে খোঁজার জন্য লোক পাঠাতে হয়েছিল গ্রামে | ওই রাস্তার শেষ প্রান্তে পুকুরের ধারের ছোট মাঠটায় ছিল কৃষ্ণেন্দু বাচ্চাদের সঙ্গে | আর যখন ফেরত এলো গ্রামে তখন ওর জামায় হালকা ধুলো লেগে , কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে | দীপ্তি আনমনে খেয়াল করেছিল সেই সময়ে, ওই কর্পোরেট ম্যান , ব্র্যান্ডেড জামা কাপড় পড়া সাজানো গোছানো ছেলেটা যেন কিরকম বদলে গেছে এখন | এ তো যেন মাটির সঙ্গে মিশে থাকতে ভালোবাসে | গ্রামের লোকেদের সঙ্গে নিজেকে আলাদা মনে করে না | বরং কিরকম এক হয়ে যায় | তারপর কৃষ্ণেন্দু যখন আগের মতন ওই মাটির বাড়িতে বসে দুপুরের খাবারটা খেলো , তখন দীপ্তির মনে সত্যি একটা দাগ কাটলো | না চাইতেও মনে হলো কথাটা আর একবার , যে কৃষ্ণেন্দু বদলে গেছে | সত্যি বদলে গেছে |
তবে সেদিন ফেরার সময় হঠাৎ কৃষ্ণেন্দুর হাতটা কেটে গেলো আচমকা | যেই বাড়িতে ওরা দুপুরে খেয়েছিলো , তার ব্যাড়ার দরজায় একটা প্রেক লাগানো ছিল | কৃষ্ণেন্দু ব্যাপারটা খেয়াল না করে দরজাটা খুলে বেরোতে গিয়েছিলো , তখনই ওই প্রেকের খোঁচায় হাতটা কেটে গেলো ওর | দীপ্তি আচমকা ওর হাতে রক্ত দেখে কিছুক্ষনের জন্য যেন পুরোনো সব কিছু ভুলে গিয়েছিলো ! ও তাড়াতাড়ি গিয়ে গাড়ি থেকে ফার্স্ট এড বক্সটা বার করে কৃষ্ণেন্দুর কাছে এসেছিলো | তারপর কিছু না বলেই ওর হাতটা নিজের হাতে তুলে নিয়ে জায়গাটা পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ করে দিয়েছিলো | কৃষ্ণেন্দু এই মুহূর্তে যেন কিরকম নিঃস্পলকভাবে তাকিয়েছিলো দীপ্তির দিকে | ওর মুখে জমা হওয়া নিজের জন্য চিন্তাটা খেয়াল করছিলো মন দিয়ে | আজও তাহলে দীপ্তির মনে চিন্তা আসে ওর কথা ভেবে ! মুখটা অন্ধকার হয়ে যায় ওর রক্ত দেখে ! কথাটা ভাবতে ভাবতেই দীপ্তি হঠাৎ জিজ্ঞেস করে উঠেছিল ওকে ,
———– ” ঠিক আছে তো ? লাগছে না তো ? অনেকটা কেটে গেছে ! ”
কৃষ্ণেন্দু সেই মুহূর্তে এক কথায়ই উত্তর দিয়েছিলো দীপ্তিকে , ———- ” না , লাগছে না আর | ”
আসলে সত্যি এই মুহূর্তে যন্ত্রনাটা একটু যেন কমেছে | এতগুলো দিনের জমে থাকা যন্ত্রনা | কাঁচ বিঁধে থাকা যন্ত্রনা | যদিও জানে, দীপ্তির মুখে এই চিন্তার রেশটা কয়েক মিনিটের জন্যই থাকবে ! তারপর আবার সেই পুরোনো দেয়ালটা উঠে যাবে ওদের মাঝে | আবার লক্ষ লক্ষ মাইল দূরত্ব এসে জমা হবে দুজনের মধ্যে | কিন্তু তা ও , এই কিছু মিনিটের জন্য হলেও , কৃষ্ণেন্দু যেন একটু শান্তি পেলো ভেতরে | অনেকদিন বাদে হালকা একটা হাসির রেশ চলে এলো মুখে | হারানো মানুষটাকে খুব কাছে পাওয়ার আনন্দ এসে জমা হলো মনে |
এরপর সেদিন আবার নিঃস্তব্ধতার আড়ালে সারাটা রাস্তা কাটিয়ে ফিরেছিল ওরা কলকাতা | কৃষ্ণেন্দু সেই সময় মাঝে মাঝে আড়চোখে খেয়াল করছিলো দীপ্তির হাওয়ায় উড়তে থাকা চুলগুলোকে | ওর শরীর থেকে ভেসে আসা মিষ্টি জুঁই ফুলের গন্ধটাকে | ওর গভীর চোখের মাঝে লুকিয়ে থাকা অনেকদিনের জমানো অভিমানকে | আজ সাত তারিখ | আর মাত্র চব্বিশ দিন বাকি এই মাস শেষ হতে | এর মাঝে প্রজেক্টটা কমপ্লিট হয়ে গেলেই তো সব শেষ | কৃষ্ণেন্দু আর চাইলেও এতো কাছ থেকে দেখতে পাবে না দীপ্তিকে | তবে একটা কথা ঠিক , আজকের স্পর্শটা কিন্তু রয়ে যাবে কৃষ্ণেন্দুর কাছে সারা জীবন | ড্রাইভ করতে করতে তাই মাঝে মাঝেই দেখছিলো ও নিজের হাতের ব্যান্ডেজটাকে | যন্ত্রনা হচ্ছিলো অল্প কাটা জায়গাটায় | কিন্তু এটা একটা অদ্ভুত মিষ্টি যন্ত্রনা | এই রকম যন্ত্রনা পাওয়ার জন্য কৃষ্ণেন্দু হাজারবার রক্তাত্ব হতে পারে | এই স্পর্শটার জন্য কৃষ্ণেন্দু আজ সব করতে পারে | এইসব এলোমেলো ভাবনার ভিড়েই রাস্তাটা হঠাৎ শেষ হয়ে গেলো দুজনের | দীপ্তির বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো গাড়িটা | দীপ্তি এই সময় গাড়ি থেকে নামার আগে কৃষ্ণেন্দুকে নিজে থেকেই বলে উঠলো হঠাৎ , ———- ” সাবধানে ফিরো | আর হাতে জল লাগাবে না |”
কথাটার উত্তরে সেই মুহূর্তে কৃষ্ণেন্দু কিছু বলতে পারেনি | আসলে ওর জন্য যে দীপ্তি এই দুটো লাইন বলেছে ! এটাই ঠিক যেন বিশ্বাস হচ্ছিলো না | কেমন একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেছিলো ও | মনে হচ্ছিলো কারখানায় আগুন লাগা , আজকের এই হাত কেটে যাওয়া , এইসবই কোনো খারাপ ঘটনা হতেই পারে না | এগুলোই তো কৃষ্ণেন্দুকে একটা মাসের জন্য হলেও দীপ্তির কাছে নিয়ে এসেছে | ওকে সুযোগ করে দিয়েছে , শেষ বারের মতন এই মেয়েটাকে নিজের সব টুকু দিয়ে ভালোবাসার | সেই রাতে এরপর আর ঘুম আসেনি ওর বাড়ি ফিরে | শুধু সেই স্পর্শটার কথা মনে পড়ছিলো খুব | আঁকড়ে ধরতে ইচ্ছে করছিলো ওই নরম হাতের ছোঁয়াটাকে | আরেকবার খুব নিজের করে পেতে ইচ্ছে করছিলো দীপ্তিকে |
এরপর আরো কটা দিন কেটে গেছে | সেদিন দীপ্তি সকাল আটটার মধ্যে অফিস চলে এসেছিলো | একটা ব্যালেন্স চার্ট রেডি করতে হবে ওকে | আসলে এতো কম সময় , আর এতো কাজ হাতে ! এই সময়ে অফিসটা একদম ফাঁকা থাকে | শান্তিতে বসে হিসেব করতে পারবে | এইসব ভেবেই নিজের ডেস্ক এ বসে বিশুদাকে ডেকেছিল | এই কোম্পনীর পিয়ন | এদিক ওদিক ফাইল পৌঁছে দেয়ার সঙ্গে খুব ভালো কফি , স্যান্ডউইচ এইসবও বানাতে পারে লোকটা | ওদের অফিসের ওই ছোট ক্যান্টিনে বিশুদা তাই ভীষণভাবে একটিভ | যাইহোক , সেই মুহূর্তে বিশুদা ওর সামনে আসতেই দীপ্তি আলতো হেসে বলে উঠলো , ———- ” প্লিজ এক কাপ কফি দেবে গো ? এখন অনেক কাজ | কফিটা না হলে চলবে না তাই |”
দীপ্তির কথাটা শুনে বিশুদা অল্প হাসি ফেরত দিয়ে বললো , ———- ” আচ্ছা, তোমার জন্যও এক কাপ কফি ! আনছি এক্ষুনি |”
দীপ্তি এটা শুনে একটু অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করলো , ———— ” আমার জন্যও মানে ? আর কে আছে অফিসে ! এতো সকাল সকাল !”
বিশুদা এর উত্তরে একটু অন্ধকার মুখেই বললো , ——————- ” কে আবার ! কৃষ্ণেন্দু স্যার | কাল বাড়ি ফেরেনি রাতে | সারা রাত জেগে কাজ করছিলো | এরকম তো মাঝে মাঝেই হয় | কতদিন যে বাড়ি ফেরে না ! এমন কি রাতের খাবারটাও খায় না ! কিছু বললেও শোনে না | আসলে সেই ওর বাবার আমল থেকে আছি তো ! ছেলেটাকে এইভাবে দেখলে চিন্তা হয় খুব | যাইহোক কফি করে আনছি এক্ষুনি | কাজ করো তুমি |”
কথাটা শেষ করেই বিশুদা চলে গেলো এই মুহূর্তে | তবে দীপ্তি থমকে গেলো হঠাৎ | কদিন ধরেই ও খেয়াল করছিলো যদিও আনমনে , কৃষ্ণেন্দুর চোখগুলো আজকাল ভীষণ ক্লান্ত লাগে ! মুখটা কিরকম ফ্যাকাসে লাগে ওর | কিন্তু এইভাবে যে বাড়ি না ফিরে রাত জেগে জেগে কাজ করে ! তাও আবার কিছু না খেয়ে , সেটা জানতো না এতদিন | কথাটা ভেবে না চাইতেও অদ্ভুত একটা খারাপ লাগা এসে ভিড় করলো মনে | সেদিন এরপর ব্যালেন্স চার্ট তৈরী করে কৃষ্ণেন্দুর কেবিনে জমা দিতে গিয়ে ও কিছুতেই আর না জিজ্ঞেস করে পারলো না থাকতে ! সমস্ত কাজের কথা শেষ হয়ে যাওয়ার পর দীপ্তি চলে যাওয়ার সময় আরেকবার কৃষ্ণেন্দুর দিকে ফিরে তাকিয়ে বলে উঠলো হঠাৎ , একটু আস্তে গলায় , ———- ” তুমি বাড়ি ফেরো না কেন রোজ ? সারা রাত জেগে কাজ করো এইভাবে একা একা অফিসে ! কেন ? ডেড লাইন সামনে আমি জানি | কিন্তু তার জন্য এতটা চাপ নেয়ার দরকার নেই | আমরা তো সবাই কাজ করছি | হয়ে যাবে কমপ্লিট অর্ডার |”
দীপ্তির এই একসঙ্গে বলা অনেকগুলো প্রশ্নের উত্তরে কৃষ্ণেন্দু কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে এক কথায় উত্তর দিলো , ওর দিকে স্থিরভাবে তাকিয়ে ,
—————– ” আমার আর ওই বাড়িতে ফিরতে ভালো লাগে না | একা একা নিজেকে কিরকম যেন একটা ফার্নিচারের মতনই লাগে ওখানে | তাই যাই না রোজ | আমার জন্য কাজটাই ভালো | কাজটাই আমার নিজের |”
দীপ্তি কথাগুলো শুনে কিরকম নিঃস্তব্ধ হয়ে গেলো এখন | কোনো কথা বলতে পারলো না ঠিক | কৃষ্ণেন্দু যে ভালো নেই , এটা মন থেকে এই মুহূর্তে বুঝতে পারলো ও | ওই স্থির দুটো চোখ , ফ্যাকাসে মুখটাই যেন বুঝিয়ে দিলো সব কিছু | কিন্তু এইসব বুঝেও যে ওর কিছু করার নেই আর ! একটা সময় যখন ও মন থেকে কৃষ্ণেন্দুর পাশে থাকতে চেয়েছিলো , রোজ , প্রত্যেকটা দিন , তখন তো ছেলেটা ধরা ছোঁয়ারই বাইরে ছিল | ওই বাড়িতে কত রাত জেগে জেগে শুধু অপেক্ষা করেছে দীপ্তি , কৃষ্ণেন্দুর ফেরত আসার অপেক্ষা | একবার ওর কাছ থেকে কিছু সময় পাওয়ার অপেক্ষা | কিন্তু সেইদিনগুলোতে তো ওর থাকা না থাকার দাম কেউ দেয়নি | ওর অপেক্ষার দামও ছিল না কারোর কাছে | তাহলে আজ , এতদিন বাদে ওরও কাউকে দেয়ার মতন কিছুই নেই | আর তাছাড়াও, মাত্র সাতদিন বাকি | এই প্রজেক্টের কাজটা শেষ হয়ে যাবে তারপর | আর এই কাজটা শেষ হলেই দীপ্তিরও এই অফিসে আসার দিন শেষ | ব্যাঙ্গালোরের চাকরির এপয়েন্টমেন্ট লেটারটা চলে এসেছে কদিন আগে বাড়িতে | এই শহর ছেড়ে চলে যাওয়ার দিনটাও তাই খুব কাছে চলে আসছে ধীরে ধীরে | এখন পুরোনো কোনো ফিলিংস এর সাথেই আর নিজেকে জড়ালে চলবে না | আর কোনো ভুল মানুষের জন্য ভাববে না দীপ্তি | কথাগুলো ভেবে ও আর সেদিন দাঁড়ালো না কৃষ্ণেন্দুর সামনে | চলে গেলো কিছু না বলে | তবে একটা অদ্ভুত খারাপ লাগার রেশ রয়েই গেলো মনে কেমন ! আসলে এই ছেলেটা খারাপ থাকুক , এটা তো দীপ্তি কখনোই চায়নি | তাই হয়তো এরকম মনে হচ্ছে ! জানে না | আর বেশি জানতেও চায় না | কারোর জন্য বেশি ভাবা মানেই বেশি জরিয়ে পরা | আর দীপ্তি সেই ভুলটা করবে না কখনো | কথাগুলো ভেবেই সেদিন বাড়ি ফিরলো ও | ক্লান্ত লাগছে খুব আজ | সারাদিন অফিসে চাপ ছিল প্রচুর | না কি মনে চাপ বাড়ছে ওর ! কৃষ্ণেন্দুকে দিনের পর দিন সামনে দেখে ! কথাটা মনে আসতেই ঘরের টেবিলে পরে থাকা এপয়েন্টমেন্ট লেটারটা চোখে পড়লো ওর | আরেকবার খুলে সেটাকে চোখ বুলিয়ে নিলো দীপ্তি | এই শহর ছেড়ে অনেক দূরে চলে যাওয়ার ইনভিটেশন কার্ড যেন এই কাগজটা ! যেখানে আর ওই মুখটাকে দেখতে হবে না কখনো | আর পুরোনো স্মৃতির ভিড় আঁকড়ে ধরবে না ওকে | আর একবার যেন নিজের মনেই বলে উঠলো কথাগুলো এই মুহূর্তে |
এরপর ধীরে ধীরে সাতটা দিন যেন চোখের পলকে কেটে গেল | আজ দু লাখ শার্টের অর্ডার কমপ্লিট হয়েছে অবশেষে | অনেক লড়াই , অনেক পরিশ্রমের পর আজ সবার মুখেই একটা খুশির ঝলক | তিন লরি শার্ট যখন ফ্যাক্টরি থেকে রওনা হলো আজ তখন যেন কোম্পানির প্রত্যেকটা এমপ্লয়ি , প্রত্যেকটা ওয়ার্কার্স এর মনে স্বস্তি ফিরে এলো | ডাবল শিফ্ট এ কাজ করেছে ওরা , শুধুমাত্র এই কোম্পানিটাকে বাঁচানোর জন্য | এতো পরিশ্রমের পর এই হাসিটার খুব দরকার ছিল সবার | এইসবই ভাবছিলো ফ্যাক্টারীর গেটে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে | তখনই খেয়াল করলো , ওয়ার্কার্সদের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা কৃষ্ণেন্দু যেন হঠাৎ একটু টাল খেয়ে গেলো | মাথায় হাত দিয়ে কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়েছিল ও | তারপরেই যেন টাল সামলাতে পারলো না | পাশের দেয়ালটা ধরে ফেললো | মনে হয় শরীর ঠিক নেই ওর | চোখ মুখটা তো অনেকদিন ধরেই ফ্যাকাসে কেমন ! তাহলে কি মাথা ঘুরছে ! যদিও দীপ্তি ছাড়া ব্যাপারটা আর কেউই খেয়াল করেনি | কৃষ্ণেন্দু যেন জোর করেই হাসার চেষ্টা করছিলো সবার সামনে | দেখানোর চেষ্টা করছিলো ও ঠিক আছে | কথাগুলো আনমনে মনে হলো দীপ্তির এখন | আসলে এতদিন এতো রাত জেগে কাজ করেছে বলেই হয়তো ! যাইহোক , এখন তো আর চাপ নেই | অর্ডার কমপ্লিট হয়ে গেছে আজ | এরপর রেস্ট নিলে ঠিক হয়ে যাবে | কথাটা ভেবেই দীপ্তি চোখটা ঘুরিয়ে নিলো নিজের | না , এতো বেশি এই ছেলেটাকে নিয়ে ভাবলে আর চলবে না | আজ তো রেজিগনেশনটা জমা দিয়ে সব শেষ করে দেয়ার দিন | আর কৃষ্ণেন্দুও কথা দিয়েছে , এরপর আর কখনো কোনো রকম যোগাযোগ করার চেষ্টা করবে না ওর আর মায়ের সাথে | যদিও যোগাযোগ করার সুযোগও পাবে না | দীপ্তিরা সামনের সপ্তাহেই ব্যাঙ্গালোর চলে যাচ্ছে | নতুন চাকরির কথাটা ও বলে দিয়েছে মা কে | দুদিন ধরে সেই জন্য মায়ের মুখটা অন্ধকার হলেও কিছু বলেনি ওকে | বরং ব্যাগ গোছাতে শুরু করে দিয়েছে দুজনের | এইসব এলোমেলো ভাবনার ভিড়েই সেদিন ও এসে হাজির হয়েছিল কৃষ্ণেন্দুর কেবিনের সামনে | রেজিগনেশন লেটারটা ওর হাতেই আছে এখন | সেটা সমেতই ও দরজায় নক করে ভেতরে ঢুকলো |

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here