ভালোবাসার শহরে ( তৃতীয় পর্ব )

0
1250

ভালোবাসার শহরে ( তৃতীয় পর্ব )
ঈপ্সিতা_মিত্র

<৬>

সেই সূর্যাস্তের পর একটা সপ্তাহ কেটে গেছে শহরে । পরিণীতা আজ ক্লাস শেষ করে সবে বাস স্টপে এসে দাঁড়িয়েছিল । আজ অর্না আসেনি কলেজ । বিয়ে বাড়ির নেমন্তন্ন আছে না কি ! কথাটা ভেবে একটা আলগা মন খারাপ এসে জমা হলো এখন । আসলে এই অর্না না আসলে একা একা ক্লাস করতে মোটেও ভালো লাগে না পরিণীতার । আর নিজে একটু শান্ত স্বভাবের চুপচাপ বলে খুব সহজে বন্ধুত্ত্ব ও করে উঠতে পারে না নতুন কারোর সাথে । তাই অর্না না আসলে খুব খালি খালি লাগে ওর । সেই স্কুল লাইফের বন্ধু তো ! সোনাঝুড়ি থেকে যখন মাধ্যমিক পাশ করে প্রথম এসেছিল কলকাতায় , ইলেভেনে ভর্তি হয়েছিল নতুন স্কুলে , সেই তখন থেকে অর্না বন্ধু ওর ।

বেশ অন্যমনস্ক হয়ে এইসবই ভাবছিল পরিণীতা একা দাঁড়িয়ে সেদিন । তবে হঠাৎ এই একাকীত্বের ভিড়ে সেই চেনা গলার আওয়াজটা এসে হাজির ওর কাছে ।

অনির্বাণ আজ কলেজ থেকে বেরিয়েই খেয়াল করেছিল পরিণীতাকে । তাই একটু তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে ওর পাশে এসে বলে উঠেছিল নিজে থেকে , ——— ” হাই , কেমন আছো ? ক্লাস শেষ?”

পরিণীতা কথাটা শুনে যেন সেদিন নিজের ভাববার জগৎ থেকে বেরিয়ে এসে কিছুটা অবাক হয়েই গেছিল অনির্বাণ কে দেখে । কলেজে কদিন আগে শুনেছিল একজনের মুখে , খুব বড়োলোকের ছেলে না কি অনির্বাণ ! তার ওপরে সিনিয়র ! তাই সে নিজে থেকে কথা বলতে আসবে , এটা ঠিক এক্সপেক্ট করেনি । হ্যাঁ , যদিও অনির্বাণ ওকে স্টেজে গাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিল । কিন্তু সেসব টুকটাক সমাজ সেবামূলক কাজ তো অনেকেই নিজের মর্জি মতন করে । ভেবেছিল অনির্বাণ ও সেরকমই । তারপর হয়ত আর মনেও রাখবে না ! কিন্তু ভাবনাটা এবারও ঠিক মিললো না পরিণীতার ।যাইহোক, কথাটা ভাবতে ভাবতে একটু সময় নিয়ে অল্প হেসে উত্তর দিল ও,

———- ” হ্যাঁ ভালো আছি । ক্লাস শেষ । বাড়ি ফিরছি ।”

এই উত্তরে অনির্বাণ আর একটা নতুন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে উঠলো আবার ওকে ,

———- ” তোমার কি সাবজেক্ট ? কোন ডিপার্টমেন্ট তোমার ?”

এর উত্তরে পরিণীতা এক কথায়ই বললো,

————- ” বাংলায় অনার্স । ফার্স্ট ইয়ার ।”

অনির্বাণ কথাটা শুনে চোখটা একটু বড় করেই বললো , ———–” ওরে বাবা ! বাংলা অনার্স ! মানে বঙ্কিমচন্দ্র ! স্কুললাইফে পড়েছিলাম একবার , সাগর সঙ্গমে নবকুমার ! মাথাটা ঘুরতো মাঝে মাঝে ওনার শক্ত শক্ত বাংলা পড়ে ! তুমি এইসব মনে রাখো কি করে ?”

এই প্রশ্নের ঠিক কি উত্তর দেবে পরিণীতা ঠিক বুঝতে পারেনি প্রথমে । তাই অল্প সময় নিয়ে আলতো হেসে বলেছিল সেই এক কথায় ,

———- ” জানি না ! অভ্যাস হয়ে গেছে ।”

তবে সেদিন এই কথার ভিড়েই ওদের সামনে স্নেহার গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছিল হঠাৎ । পরিণীতা একটু হকচকিয়ে খেয়াল করেছিল লাল রঙের মার্সিডিজ গাড়ির জানলার কাঁচ খুলে বেশ সুন্দর একটা মেয়ের মুখ বেরিয়ে এলো সামনে । সে বেশ আন্তরিক ভাবেই এবার অনির্বাণ কে বলে উঠলো নিজে থেকে ,

———- ” তুই স্যারের ব্যাচে যাচ্ছিস তো ? আমিও যাচ্ছি । চল একসঙ্গেই গাড়িতে যাই আজ । আর কিছু নোটস বোঝারও আছে তোর থেকে । গাড়িতেই বুঝে নেব সেসব । কতক্ষণ আর এই গরমে রাস্তার মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকবি বাসের অপেক্ষায় ! আর তুই তো কলেজে নিজের গাড়িটা নিয়েই আসতে পারিস রে । এইসব পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যাবহার করার দরকার কি অন্যদের মতন ! বুঝি না !”

অনেকগুলো কথা এক নিঃশ্বাসে বলে গেল সেদিন স্নেহা । আর পরিণীতা খেয়াল করলো এতক্ষণ অনির্বাণের মুখটা যেরকম হাসি খুশি ছিল , সেখানে হঠাৎ অল্প গাম্ভীর্য এসে জড়ো হয়েছে কেমন । আর সেই গাম্ভীর্য নিয়েই অনির্বাণ বলে উঠলো একটু আস্তে গলায় ,

———– ” তুই একটু ভুল বলছিস । ওটা আমার গাড়ি না । আমার বাবার গাড়ি । আমি এখনও কিছু ইনকাম করি না যে নিজের একটা গাড়ি কিনবো ! তাই আমার জন্য বাস অটোই ঠিক আছে । যাইহোক , তোর যা নোটস বোঝার , আমি স্যারের ব্যাচে গিয়েই বুঝিয়ে দেবো । আর ব্যাচ অব্দি আমি বাসেই যাবো । কারোর গাড়িতে না।”

কথাটা বেশ দৃঢ় ভাবেই বললো অনির্বাণ এই মুহূর্তে । তাই স্নেহাও আর কথা বাড়ানোর মতন কিছু খুঁজে পেল না যেন । একটু থতমত ভাবেই অনির্বাণ কে বললো ,

———– ” ঠিক আছে, আমি আসছি । ব্যাচে দেখা হবে ।”

তারপর এক পলক পরিণীতাকে দেখে গাড়ির কাঁচটা তুলে নিল নিজের । হারিয়ে গেল দুর রাস্তার ভিড়ে ।

তবে এইসবের মধ্যে পরিণীতাও কয়েক পলক স্থিরভাবে তাকিয়ে রইলো আনমনে অনির্বাণের দিকে । বেশ অন্যরকম লাগলো হঠাৎ ছেলেটাকে যেন ! হালকা দাঁড়ি , শান্ত চোখের আড়ালে একটা দৃঢ় ছেলে মনে হল অনির্বাণকে কেমন।

<৭>

সেদিন বাসে এরপর অনির্বাণই আবার কথা শুরু করেছিল নিজে । আসলে পরিণীতার বাড়ি আর অনির্বাণের পড়ার ব্যাচ দুটোই এক জায়গায় । সেই জন্য একই বাসে ওঠা । তবে সেদিন পরিণীতা নিজের টিকিটের দাম দিতে গিয়ে থমকে গেলো অনির্বাণের কথায় | অনির্বাণ ওর পাশের সিটেই বসেছিল | পরিণীতাকে টিকিটের ভাড়া দিতে দেখে বেশ গম্ভীর হওয়ার মতন গলা করেই বলেছিলো ও , —————- ” এসব কি করছো ? জানো না , সিনিয়র সামনে থাকলে এইভাবে নিজের টিকিটের দাম দিতে নেই ! আর এরকম কখনো করবে না |”

কথাটা বলেই ও কন্ডাক্টারকে একটু দৃঢ় গলায় টাকাটা বার করে বলে উঠলো , ———- ” দুটো রাসবিহারী কাটুন |”

পরিণীতা তবে একটু ইতঃস্তত হওয়া ছাড়া সেদিন আর কিছু বলতে পারেনি তারপর | কিন্তু অনির্বাণ চুপ না থেকে বলে উঠেছিল ,

————— ” তোমার গানের কিন্তু সবাই ফ্যান হয়ে গেছে কলেজে | পরেরদিন আমাদের ক্লাসের অনেকে তোমার কথা বলছিলো ! বলছিলো এরপর কলেজ সোশ্যালেও তোমাকে দিয়ে গান গাওয়াবে না কি |”

কথাটা শুনে পরিণীতা চোখ দুটো কিছুটা বড়ো করেই বলেছিলো , ———– ” কি ! কলেজ সোশ্যাল এ আবার গাইতে হবে ! কিন্তু এসবের তো কোনো দরকার ছিল না | মানে !”

কথাটাকে ঠিক আর ও শেষ করতে পারলো না যেন | নিজের মনেই একটু মুষড়ে পড়লো নিজে | ব্যাপারটা দেখে অনির্বাণ অবাক হয়েই বলে উঠলো ,

————— ” তুমি এটা শুনে খুশি না ? কলেজে তুমি ফেমাস হয়ে যাচ্ছ ! সবাই তোমার গান শুনতে চায় | আর সোশ্যাল এ বাইরের আর্টিস্টরাও পারফর্ম করতে আসবে | তাদের সঙ্গে তুমিও স্টেজ শেয়ার করবে | এটা শুনে তো যে কেউ খুশি হয়ে যাবে !”

এক নিঃশ্বাসেই বলে গেলো অনির্বাণ কথাগুলো | কিন্তু খেয়াল করলো পরিণীতার এসব শুনে কোনো আনন্দ নেই মনে | বরং ও কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে একটু অন্য কথা বলে উঠলো | আস্তে গলায় চোখ নামিয়ে কিছুটা যেন নিজের মনেই বললো , ————- ” আমি তো ভিড় থেকে আলাদা হতে চাই না ! আমি ভিড়ের মধ্যেই থাকতে চাই | আর গানটা আসলে আমার খুব নিজের | সেটা কাউকে শুনতেই হবে এরকম কোনো ব্যাপার নেই | সেদিন কলেজের ফাউন্ডেশন ডে তে ও , আমি নিজে নাম দিইনি | অর্না দিয়েছিলো আমার হয়ে | ও খুব চাইছিলো আমি গান গাই | আগেরদিন রিহার্সেলেও আমাকে জোর করে নিয়ে গিয়েছিলো | ”

কথাগুলো শেষ হতেই তারপর ও খেয়াল করেছিল বাসটা রাসবিহারীর আগের স্টপেজ ক্রস করে গেছে | তাই সঙ্গে সঙ্গেই বলে উঠেছিল আনমনে ,

————– ” আমাদের মনে হয় ওঠা উচিত | চলে আসবে এরপর রাসবিহারী |”

কথাটা বলেই পরিণীতা উঠে দাঁড়িয়েছিল এরপর | কিন্তু অনির্বাণ এক দু সেকেন্ডের জন্য স্থির হয়ে গেছিলো যেন | আসলে খুব অদ্ভুত লাগছিলো ওর পরিণীতাকে হঠাৎ | আজকালকার দিনে কে এইভাবে বলে যে সে ভিড় এর মধ্যে থাকতে চায় ! সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে সবাই তো শুধু এটেনশন পেতে চায় | লোকের নজরে আসতে চায় | আর সেখানে পরিণীতা এতটা অন্য রকম কি করে ! কথাটা ভাবতে ভাবতেই সেদিন বাস থেকে নেমেছিল ও | তারপর পরিণীতা ওর দিকে তাকিয়ে আলতো হেসে বলেছিলো , ———- ” আসছি | আপনি ! মানে সরি ! তুমি, সাবধানে যেও |”

কথাটা শুনে অনির্বাণ এবার হেসে ফেলেছিলো নিজে | তারপর অল্প কথায় বলে উঠেছিল , ———– ” হ্যাঁ , তুমিও | কলেজে দেখা হবে | আর থ্যাংকস , তুমি করে বলার জন্য |”

পরিণীতা এই শেষ কথাটার আর কোনো উত্তর খুঁজে পায়নি ঠিক | তাই আলতো হেসেই নিজের বাড়ির রাস্তায় পা বাড়িয়েছিল | তবে অনির্বাণ এই প্রথম কারোর চলে যাওয়াটা দেখেছিলো শেষ পর্যন্ত | গোধূলি বিকেল ছিল তখন চারিদিকে | অদ্ভুত একটা লালচে রঙের শহর মুড়িয়ে ছিল ওকে ঘিরে | তার মধ্যে এই প্রথম কারোর চলে যাওয়াতে ও স্থির হয়ে গেলো | মনে মনে আপনাআপনিই হেসে ফেললো ! পরিণীতার আপনি থেকে তুমি বলার চেষ্টার কথাটা কেন জানে না একটা নতুন ভালো লাগা নিয়ে এলো অনির্বাণের মনে | যেই ভালো লাগাটা একদম অচেনা | খুব নিজের |

<৮>

এই অচেনা ভালো লাগার বিকেলটা পেরিয়ে এরপর কটা দিন কেটে গেছে কলকাতায় | এর মাঝে অনির্বাণ নিজের অজান্তেই কলেজের ক্যান্টিনে , তো কখনো ফাঁকা করিডোরে , অথবা বাস স্ট্যান্ডের ভিড়ে , পরিণীতাকে আনমনে খুঁজেছে মাঝে মাঝে | আসলে ঠিক প্ল্যান করে দেখা করবে মেয়েটার সঙ্গে , এটা ঠিক ওর মনে হয়নি কখনো | তবে ক্লাস করতে করতে , কখনো লাইব্রেরীতে বসে বই এর পাতা ওল্টানোর সময় , অথবা প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসে দুটো কেমিক্যালের রিয়াক্সন দেখার সময় , অনির্বাণের অকারণে মনে হয়েছে পরিণীতাকে | মনে হয়েছে , এরপর কলেজ শেষে বাইরে বেরিয়ে বাসের জন্য অপেক্ষা করতে করতে , যদি আরেকবার পরিণীতার সঙ্গে দেখা হয় , তাহলে মন্দ হবে না ! ওই আস্তে কথা , আলতো হাসি , নিজের মনে হারিয়ে যাওয়া মেয়েটাকে দেখে অনির্বাণ খুশিই হয়ে যাবে মনে মনে |

তবে এরপর এক সপ্তাহ কাটিয়ে শেষে কলেজের ক্যান্টিনে দেখা হয়েই গেছিলো অনির্বাণের পরিণীতার সঙ্গে , একদম হঠাৎ করে | পরিণীতা যদিও খেয়াল করেনি ! ও এক মন দিয়ে কিছু খাতা চেক করছিলো স্টুডেন্টসদের | তখনই আচমকা অনির্বাণ ওর কাছে এসে বলে উঠেছিল , ————- ” হাই , কি খবর ?”

পরিণীতা কথাটা শুনে চোখ তুলতেই খেয়াল করেছিল কলেজের সার্বজনীন ক্রাশ ওর দিকে হাসি মুখে তাকিয়ে | পরিণীতা এই মুহূর্তে না চাইতেও নোটিশ করেছিল অনির্বাণের শান্ত চোখ দুটো | চশমার আড়ালে থাকা এই চোখ দুটো আগেও ওর নজর কেড়েছে ! অজান্তে মনে দাগ কেটেছে | কথাটা ভাবতেই নিজেকে সামলে নিলো পরিণীতা | তারপর একটু সাজিয়ে বললো , ———– ” এই তো ক্লাস করে এলাম | তোমার কখন ক্লাস ? ”

এর উত্তরে অনির্বাণ ওর উল্টোদিকের চেয়ারটায় বসে বললো , ———— ” এখন দুটো অফ | তারপর আছে একটা ক্লাস | কিন্তু তুমি এটা কি করছো ? কিসের খাতা এগুলো ?”

কথাটা বলতে বলতেই ও আনমনে একটা খাতা তুলে নিয়েছিল নিজের হাতে | তারপর বেশ অবাক হয়ে বলেছিলো , ————- ” এইগুলো তো বাচ্চাদের অংক খাতা ! এগুলো তুমি চেক করছো !”

এর উত্তরে পরিণীতা একটু আস্তে গলায় বলে উঠলো ———– ” আসলে আমি টিউশন পড়াই | এগুলো আমার স্টুডেন্টসদের খাতা | ”

কথাটা শুনে অনির্বাণ এক সেকেন্ড চুপ করে কিছুটা ভেবে বললো , ———- ” এতো পড়াশোনার চাপে টিউশন পড়ানোর টাইম পাও ? মানে এমনিই অনার্সের এতো চাপ , তারপর !”

এর উত্তরে পরিণীতা আলতো গলায় বলে উঠলো , ———- ” আমার বাবা নেই | ক্লাস ইলেভেনে যখন পড়তাম , মারা গেছে | তারপর আমরা কলকাতায় মামার বাড়িতে এসে থাকি | মানে আমি আর মা | মামা আমাদের খাওয়ার খরচাটা দিলেও পড়াশোনার জন্য আলাদা করে কখনো কিছু দেয় না | তাই আমি ক্লাস টুয়েলভ থেকেই টিউশন পড়াই | এতে যা ইনকাম হয় , তাতে আমার বই খাতা , টিউশনের টাকা উঠে যায় |”

কথাগুলো বলে কয়েক মুহূর্ত যেন একটু স্থির হয়ে গিয়েছিলো পরিণীতা নিজের খেয়ালে | অনির্বাণ খেয়াল করেছিল ওর মুখটা এক পলকে অন্ধকার হয়ে গেছে অল্প | তবে এটাও বুঝেছিলো পরের মুহূর্তে নিজের অন্ধকারটাকে ঢাকার জন্য পরিণীতা একটা মিথ্যে ভদ্রতার হাসি হেসে আবার খাতার দিকে চোখ দিয়েছিলো | তবে অনির্বাণ যেন এরপরও ঠিক পরিণীতার থেকে চোখ সরাতে পারছিলো না নিজের | আসলে পরিণীতার কথা বার্তা , সাজ পোশাক , কিছুতেই কোনো নজর কারবার মতন কিছু নেই ! সবার মাঝে ও সত্যি খুব সাধারণ , চুপ করে থাকা মেয়ে , যে কেউ না জিজ্ঞেস করলে কখনো কারোর সঙ্গে কথা বাড়াতে যায় না ! নিজের কথা বলতে যায় না | তবে এতটা সাধারণ বলেই হয়তো অনির্বাণের খুব আলাদা লাগছে পরিণীতাকে ! এতো মেকিনেসের পৃথিবীতে সহজ লাগছে ওকে | ওর সাধারণ হয়াটাকেই খুব অসাধারণ বলে মনে হচ্ছে অনির্বাণের ! কথাটা ভাবতে ভাবতেই অনির্বাণ হঠাৎ পরিণীতার কাছ থেকে তিনটে খাতা নিয়ে নিলো নিজে | পরিণীতা ঠিক কি হলো বুঝতে না পেরে প্রশ্ন চোখে তাকালো তাই ওর দিকে ! তখন অনির্বাণ অল্প হেসে বললো ,

———— ” এ কটা খাতা আমি চেক করে দিচ্ছি | তুমি বাকিগুলো করো | তাড়াতাড়ি হবে | আর ডোন্ট ওরি .. আমি পড়াশোনায় ভালোই | ভুল কিছু চেক করবো না |”

কথাটা বলেই পরিণীতার ‘না’ এর অপেক্ষা না করেই অনির্বাণ খাতা করেকশনে মন দিলো | পরিণীতাও ঠিক আপত্তি করে উঠতে পারলো না যেন অনির্বাণকে | একে তো কলেজের সিনিয়র , তার ওপরে অদ্ভুত পার্সোনালিটি , তাই মুখের ওপর ঠিক কিছুই বলা যায় না ! তবে একটা কথা ভেবে অবাক হচ্ছিলো একটু পরিণীতা যদিও | শুনেছে অনির্বাণ না কি ইন্ট্রোভার্ট | নিজের ব্যাচেই খুব কম বন্ধু ওর | সেখানে পরিণীতা তো ফার্স্ট ইয়ারের স্টুডেন্ট ! অনির্বাণ কেন তারপরেও ওর সঙ্গে এতটা সহজভাবে কথা বলতে আসে নিজে থেকে ! প্রশ্নটা কিরকম আনমনেই উঁকি দিলো পরিণীতার মনে | অবশ্য শুধু পরিণীতা না , ক্যান্টিনের দূরের টেবিলে বসা অনির্বাণের কিছু ব্যাচ মেট আর স্নেহাও ব্যাপারটা খেয়াল করলো সেদিন | সবাই বেশ সারপ্রাইজড ছিল পুরো দৃশ্যটা দেখে | আর অনির্বাণ যে ওদের কাউকে ক্যান্টিনে খেয়ালই করেনি এসে থেকে , শুধু এই মেয়েটার সঙ্গেই কথা বলে গেলো ! এই ঘটনাটাও খুব অদ্ভুত লাগলো প্রত্যেকের | একজন তো বলেই ফেললো সবটা দেখে সোজাসুজি , ———— ” বাবা ! অনির্বাণকে এতটা কারোর সঙ্গে ইনভল্ব হতে দেখিনি তো আগে ! কি হলো হঠাৎ ছেলেটার ! প্রেমে টেমে পড়লো না কি !”

কথাটা শুনে স্নেহা যেন জ্বলে গেলো ভেতরে | ও গলাটাকে খুব কঠিন করেই বললো এবার , ————- ” থামবি তুই | অনির্বাণ এরকম লো স্ট্যান্ডার্ডের কারোর সঙ্গেই ইনভল্ব হবে না কখনো | শুধুমাত্র আমার মতন মেয়েকেই ওর সঙ্গে মানায় | কারণ আমাদের স্ট্যাটাস ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড , সবটাই সেম | আর অনির্বাণও এই কথাটা খুব ভালো করেই জানে |”

শেষ কথাগুলো ও যেন বেশ জোর দিয়ে বলে নিজেকেই বোঝানোর চেষ্টা করলো | মনে এই মুহূর্তে রাগের সাথে যন্ত্রণাটাও চেপে ধরেছে ওকে | অনির্বাণকে সেই স্কুল লাইফ থেকে পছন্দ স্নেহার | আর অনির্বাণ নিজে থেকে ওর কাছে আসে না বলেই হয়তো কখন এই ভালো লাগাটা একটা জেদ হয়ে গেছে স্নেহার , ও বোঝেনি ! তবে আজ অনির্বাণকে অন্য একটা মেয়ের সঙ্গে বসে থাকতে দেখে স্নেহা বুঝতে পারলো , ভালো লাগার মধ্যেও একটা জ্বালা আছে ! একটা বিষ আছে কেমন | যেটা হয়তো বেশিদিন স্নেহা নিজের মধ্যে রাখবে না ! অনির্বাণ যদি সহজভাবে ওর না হয় , তাহলে হয়তো এই বিষটাকেই ও ছড়িয়ে দেবে চারিদিকে | শেষ করে দেবে সব কিছু | কথাটা আজ না চাইতেও মনে হলো স্নেহার , আর চোখটা হঠাৎ কড়কড় করে জ্বলে উঠলো যেন ,দু ফোঁটা জল এসে জমলো সেখানে |

<৯>

তবে এরপর মাঝে মাঝেই কলেজে কখনো করিডোরে , কখনো ক্যান্টিনে , অথবা কখনো এমনি রাস্তায় , দেখা হয়েই যেত অনির্বাণের সাথে পরিণীতার | টুকটাক কথাও হতো মাঝেমধ্যে | খুচরো আলাপ জমতো দুজনের | এই যেমন সেদিন ছিল আগস্টের শেষ সপ্তাহ | শহর জুড়ে বৃষ্টি , আর কালো মেঘ | সব সময় আকাশের মুখ অন্ধকার | তার মধ্যেই অনির্বাণ নিজের ছাতাটা বাসের মধ্যে হারিয়ে এসেছিলো একদম | আসলে আসার সময় এতো তাড়া ছিল ! এমনিতেই উঠতে দেরি হয়ে গেছিলো ঘুম থেকে | তাই মনের ভুলে ছাতাটা বাসের সিটে ফেলেই নেমে পড়েছিল কলেজের গেটে | আর মনে পড়লো যখন , তখন বাসটা কলেজ ছাড়িয়ে অনেক দূর রাস্তায় হারিয়ে গেছে | তাই পুরোই কেস হয়ে গেছিলো ক্লাস শেষ হয়ে যাওয়ার পর | আবার পাঁচটা থেকে ব্যাচে পড়তে যাওয়া আছে ওর | তাই আর বৃষ্টি থামার অপেক্ষা করার উপায় ছিল না ওর | ভিজতে ভিজতেই বাস স্টপের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল ও | কিন্তু সেদিন বেশিক্ষণ এইভাবে বৃষ্টির মধ্যে হাঁটতে হয়নি ওকে ! হঠাৎ একটা ছাতা সমেত পরিণীতা এসে হাজির হয়েছিল কাছে | অনির্বাণ তো এরকম হঠাৎ পরিণীতা দর্শনে একটু অবাকই হয়েছিল কয়েক সেকেন্ড | তখন পরিণীতা বলে উঠেছিল ওর ঘোর কাটিয়ে ,

———— ” কি হলো দাঁড়িয়ে পড়লে কেন ? চলো ! ”

কথাটা শুনে অনির্বাণের যেন সম্ভিত ফিরেছিল | তবে তার মধ্যেই ও খেয়াল করেছিল বৃষ্টির ছাঁট লেগে পরিণীতার কপালে বিন্দু বিন্দু জল জমেছে | তার মধ্যে ওর বড়ো বড়ো চোখ দুটো খুব গভীর লাগলো যেন | একদম আকাশের জমা মেঘেদের মতন |

যাইহোক , এরপর ওরা বৃষ্টির ছাঁট মেখে বাস স্টপে এসে দাঁড়িয়েছিল সেদিন | কিন্তু বাসের অপেক্ষা করতে হয়নি বেশিক্ষণ | তবে বাসে উঠে দু মিনিট বসতে না বসতেই পরিণীতা খেয়াল করেছিল অনির্বাণ নাক টানছে | চোখগুলো লাল হয়ে এসেছে ওর | দু একবার হাঁচ্ছো হাঁচ্ছো ও করলো ছেলেটা ! পরিণীতা তো এইসব দেখে জিজ্ঞাসা করেই উঠলো ,

———— ” কি হয়েছে তোমার ? এমন কিছু তো বৃষ্টিতে ভেজোনি ! তাতেই সর্দি হয়ে গেলো ?”

কথাটায় অনির্বাণ নাক টানতে টানতেই অল্প হেসে বললো , ———- ” এটা আমার ছোটবেলা থেকেই | বৃষ্টির জল একটু গায়ে লাগলেই এরকম হবে | সর্দি কাশি ! নর্মাল এটা আমার !”

কথাটা বলে অনির্বাণ খেয়াল করলো পরিণীতা যেন অল্প কিছু চিন্তা করলো এইসবের পর | তবে এর মধ্যে ওদের স্টপেজ আসতে আর মাত্র পাঁচ মিনিট বাকি | তখনই পরিণীতা নিজের ছাতাটা অনির্বাণের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো , ———— ” এই নাও | তুমি রাখো ছাতাটা | আর বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে ব্যাচে যেতে হবে না | তাহলে আরো শরীর খারাপ করবে |”

অনির্বাণ তো কথাটা শুনে না না করে উঠলো | ছাতাটা আবার ওকে ফিরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে বললো , ——— ” এ বাবা ! না না | দরকার নেই আমার ছাতার | আর আমাকে ছাতা দিলে তুমি নিজে তো ভিজে ভিজে বাড়ি যাবে ! তুমি রাখো ছাতাটা |”

এই কথায় পরিণীতা আবার অনির্বাণের হাতেই ছাতাটা ধরিয়ে ওকে আশ্বস্ত করে বললো যেন , ————- ” আমার বাড়ি কাছেই | আমি ওড়না মাথায় দিয়ে চলে যাবো | কোনো প্রব্লেম হবে না | কিন্তু তুমি আর বৃষ্টিতে ভিজো না |”

কথাটা বলেই ও অনির্বাণকে কিছু বলার আর সুযোগ না দিয়েই উঠে দাঁড়ালো , কারণ ততক্ষণে রাসবিহারী চলে এসেছে | অনির্বাণও তাই উঠলো এবার | তারপর রাস্তায় নেমেই পরিণীতা নিজের মাথায় ওড়নাটা জড়িয়ে আলতো হেসে বললো , ———– ” আসলাম | আর বাড়ি গিয়ে ওষুধ খেয়ে নিও | তাহলে আর জ্বর হবে না |”

কথাটা বলেই অনির্বাণকে কোনো উত্তরের সময় না দিয়ে পরিণীতা এই বৃষ্টি ভেজা শহরে কেমন আবছা হয়ে গেলো চোখের পলকে | তবে ওর ফুল প্রিন্টের গোলাপি ছাতাটা রয়ে গেলো অনির্বাণের কাছে এই মুহূর্তে | অনির্বাণ তবে থমকে গেলো যেন কিছুক্ষণ | পরিণীতা সামনে না থাকলেও ওর আলতো হাসি , হালকা বৃষ্টি ভেজা এক টুকরো কপাল , ওড়না জড়ানো মিষ্টি মুখটাস্পষ্ট দেখতে পেলো ও হঠাৎ , সাদা হয়ে যাওয়া , বৃষ্টিতে আবছা হয়ে যাওয়া কলকাতায় |

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here