ভালোবাসার শহরে ( চতুর্থ পর্ব )

0
1265

ভালোবাসার শহরে ( চতুর্থ পর্ব )
ঈপ্সিতা_মিত্র
<১০>

সেদিনের পর রবিবার কাটিয়ে সোমবার যেদিন কলেজ খুলেছিলো , অনির্বাণ ক্লাসের মাঝখানে এসে হাজির হয়েছিল পরিণীতার ডিপার্টমেন্টের সামনে | পরিণীতাদের যদিও তখনও ক্লাস চলছিল | তাই অনির্বাণ গোলাপি ছাতা হাতে অপেক্ষা করছিলো করিডোরে | তবে জানে না কেন , একটা অদ্ভুত ভালো লাগা এসে জমছিল ওর মনে এখন | মনে হচ্ছিলো সেদিন ছাতাটা নিয়ে ভালোই হয়েছে | তাই তো আজ ফেরত দিতে আসতে পারলো ! আরেকবার দেখা হয়ে যাবে এর জন্য পরিণীতার সঙ্গে | তবে কথাটা মনে আসতেই অদ্ভুত লাগছে খুব নিজেকে নিয়ে ওর ! আসলে স্কুল লাইফ থেকে এই এম.এস.সি পড়া অব্দি , কম প্রপোজাল পায়নি অনির্বাণ জীবনে ! কিন্তু কোনো মেয়েকেই কখনো আলাদা করে ভালো লাগেনি ঠিক | বন্ধুর থেকে বেশি কিছু মনে হয়নি কখনো | তবে এই প্রথম কাউকে আলাদা করে দেখতে ইচ্ছে করছে , সে না থাকলেও তার ছবি ভাসছে চোখে , নিজে থেকে কথা বাড়াতে ইচ্ছা করছে মেয়েটার সঙ্গে ! এই পুরো ব্যাপারটাই ভীষণ নতুন অনির্বাণের কাছে | কথাটা ভাবতে ভাবতেই ও খেয়াল করলো ক্লাস শেষ হয়ে গেছে | আর ক্লাসরুম থেকে ম্যাম বেরোনোর পর বেশ কয়েকজন মেয়েকে পার করে পরিণীতা বেড়োলো শেষে | সাদা চুড়িদার পড়েছে আজ ও | চুলটা আলগা করে বিনুনি বাঁধা | চোখে অল্প কাজল | আর কপালে ছোট্ট একটা টিপ্ | অনির্বাণ যেন না চাইতেও খেয়াল করলো সবটা | তবে পরিণীতা এই মুহূর্তে ওকে দেখে নিজেই এগিয়ে এলো আজ | সঙ্গে ওর ওই বন্ধুটাও আছে | কি যেন নাম মেয়েটার ! অর্না |কথাটা ভাবতেই পরিণীতা অনির্বাণের কাছে এসে বলে উঠলো , ———– ” কেমন আছো ? শরীর ঠিক আছে তো ?”

প্রশ্নটা শুনে অনির্বাণ অল্প হেসে বললো , ————- ” ভুল কি করে থাকবে ! ছাতাটা সঙ্গে ছিল যে |”

পরিণীতা এই উত্তরে আলতো হাসলেও খেয়াল করলো অর্নার চোখ দুটো এখন বেশ বড়ো বড়ো হয়ে গেছে বিস্ময়ে | ও যেন অনেক প্রশ্ন নিয়ে পরিণীতার দিকে তাকিয়ে | তবে এই সময়ই অনির্বাণ আবার বলে উঠলো , ————– ” তোমার ছাতাটাই ফেরত দিতে এসেছিলাম | আর থ্যাঙ্ক ইউ .. সেদিন আরো বৃষ্টিতে ভিজলে সত্যি জ্বর হয়ে যেত |”

এই কথায় পরিণীতা ছাতাটা নিয়ে বলে উঠলো , ————- ” একটা ছাতাই তো দিয়েছিলাম , থ্যাঙ্ক ইউ বলার দরকার নেই |”

অনির্বাণ এটা শুনে এক সেকেন্ড চুপ করে অন্য একটা প্রশ্ন করে উঠলো ওকে একটু নরম গলায় , ———– ” ক্লাস নেই আর ? শেষ আজ সব ?”

পরিণীতা এর উত্তরে সঙ্গে সঙ্গেই বললো , ———– ” হ্যাঁ শেষ | তোমার ?”

অনির্বাণ এই কথায় বললো , ————– ” আমার আছে এখনো | চারটের পর শেষ |”

পরিণীতা এবার আর কথা না বাড়িয়ে তাই বলে উঠলো , ——— ” ওহ আচ্ছা | ঠিক আছে , আসি তাহলে | পরে দেখা হবে |”

কথাটা শুনে অনির্বাণ ওর দিকে কয়েক সেকেন্ড থমকে তাকিয়ে শুধু একটা শব্দেই বললো , —— ” এস |”

পরিণীতা এরপর হালকা হেসে করিডোরের উল্টো দিকে পা বাড়ালো | কিন্তু অনির্বাণ জানে না কেন , সেই আগেরদিনের মতোই পরিণীতার চলে যাওয়াটার দিকে স্থিরভাবে তাকিয়ে রইলো যেন ! এগোতেই পারলো না কিছুতে , নিজের রাস্তায় | তবে পরিণীতাও আজ একবার চেনা করিডোরে পেছন ফিরে তাকিয়েছিলো আনমনে | অনির্বাণকে দেখার জন্যই হয়তো ! তবে দুজনের আরেকবার চোখাচোখি হতেই পরিণীতার চারিদিকটা স্তব্ধ হয়ে গেলো এক মুহূর্তে | অনির্বাণ স্থিরভাবে ওর দিকেই তাকিয়ে এখন , এটা দেখে পরিণীতার মনে কিছু ভালো লাগা খারাপ লাগা মিশে গেলো আজ | মনে হলো এই থমকে থাকা দৃষ্টিটা ওর জন্য হলেও এই ছেলেটা ওর নয় | দুজনের মধ্যে সাধারণ অসাধারণ এতো বড়ো দেয়াল , যে সেটা ভেদ করে পরিণীতা কখনোই অনির্বাণের কাছে যেতে পারবে না | কথাটা ভেবেই পরিণীতা মনটাকে ঘুরিয়ে নিলো নিজের | অনির্বাণের বিপরীতে চলা রাস্তাটায়ই এগিয়ে গেলো ও |

<১১>

কিন্তু সেদিন অর্না আর নিজেকে সামলাতে পারেনি | বাসে উঠেই ও পরিণীতার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল প্রায় প্রশ্নের ঝুলি নিয়ে | বেশ উত্তেজিত হয়েই বলেছিলো ,

————- ” কি চলছে রে তোদের ? আমি না তোর বেস্ট ফ্রেন্ড ! আমাকেই বলিস না কিছু ! এটা কি ঠিক ?”

কথাগুলো শুনে পরিণীতা বেশ অবাক হয়েই বলেছিলো , ———– ” কাদের কি চলছে ! কি বলিনি তোকে আমি ?”

অর্না এটা শুনে আরো উত্তেজিত হয়ে বলেছিলো , ———— ” কাদের মানে ! তোর আর অনির্বাণদার | ভাবা যায় ! ক্লাসের বাইরে পুরো কলেজের ক্রাশ অপেক্ষা করছে তোর জন্য ! সবাই তো পুরো হাঁ হয়ে গেছিলো আজ ! অনির্বাণদার ব্যাপারে শুনেছি বেশ সিরিয়াস টাইপের ছেলে না কি ! কত মেয়ে লাইন দেয় | কিন্তু অনির্বাণদা নিজের পড়াশোনা কাজ ছাড়া আর কিছুই বোঝে না ! আমি তো শুনেছি ওদের ব্যাচের স্নেহা , বিশাল বিজনেসম্যানের মেয়ে , সে ও অনির্বাণদাকে ভীষণ লাইক করে | অনির্বাণদা তাকেও এড়িয়ে এড়িয়ে যায় | সে কি না তোর সাথে যেচে যেচে কথা বলতে আসে ! সেদিন গানের চান্সটাও করে দিলো তোর | আর এতকিছুর পর বলছিস কিছু চলছে না তোদের ? আর এটা আমাকে বিশ্বাস করতে হবে !”

কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে গেলো অর্না | পরিণীতা এর উত্তরে মাথায় হাত দিয়ে বললো , ————– ” সত্যি ! তুই পারিসও | সারাদিন রোম্যান্টিক সিনেমা দেখে দেখে , রোম্যান্টিক গল্পের বই পড়ে পড়ে এই হাল | সব জায়গায় প্রেম খুঁজিস | “, কথাগুলো বলে দু সেকেন্ড থেমে নিজেকে আর একটু গুছিয়ে নিয়ে পরিণীতা আবার বলে উঠলো ,

———— ” কিছু নেই আমার সঙ্গে অনির্বাণদার | আর ভাবলি কি করে কিছু হতে পারে ! আমার ফ্যামিলির কন্ডিশন তো তুই জানিস | আর অনির্বাণদার বাবার যে কত বড়ো বিজনেস , এটাও নিশ্চই শুনেছিস | এরপরও এইসব মাথায় আসে তোর ! আর কারোর সাথে দুটো কথা বললেই কি তার সাথে প্রেম হয়ে যায় ! অনির্বাণদার সেদিন আমার গান শুনে ভালো লেগেছিলো , তাই হয়তো দেখা হলে কথা বলে | যেরকম রাস্তায় ঘাটে আমরা চেনা মুখ দেখলে কথা বলি ! ব্যাস | আর আমি একটা জিনিস বুঝেছি , অতো বড়োলোক বাড়ির ছেলে হলেও কোনো অহংকার নেই ওর | সহজভাবে কথা বলে তাই | ”

কথাগুলো বলে কয়েক সেকেন্ড চুপ করে গেলো পরিণীতা | কিন্তু অর্না এবার জোর হেসে ফেললো ওর সামনে | তারপর বেশ সুর করেই বললো ,

——— ” বাবা ! সুনাম করতেও শুরু করে দিয়েছিস ! আচ্ছা , তোর সব কথা মানলাম | তোর আর অনির্বাণদার মধ্যে কিচ্ছু নেই | আর কিছু হবেও না কখনো | কিন্তু একটা কথা সত্যি করে বল তো ? তুই পছন্দ করিস না অনির্বাণদাকে ? ভালো লাগে না তোর ওকে দেখলে ! ও কথা বলতে এলে ? একটুও স্পেশ্যাল ফিল হয় না ?”

শেষ প্রশ্নগুলো ওর চোখে চোখ রেখেই করলো অর্না | কিন্তু পরিণীতা এর ঠিক কোনো উত্তর দিতে পারলো না যেন | এতো প্রশ্নের কোনো মিথ্যে উত্তর হয় না আসলে | আর সত্যিটাও বলার নেই ঠিক ওর | বলার নেই যে অনির্বাণকে ওর প্রথম দিন থেকেই ভীষণ আলাদা লাগে ! থমকে থাকে ও যখন অনির্বাণ ওর কাছে আসে | ভালো লাগে যখন কথা বলে | কারণ এতো সত্যি যদি বলে তাহলে নিজের আড়ালটাই ভেঙে যাবে ! জোর করে নিজের মনকে বুঝিয়ে যেই দূরত্বটা বজায় রাখে ও ছেলেটার সঙ্গে , সেই দূরত্বটাও হয়তো কমে যাবে | তাই এইসবের কোনো উত্তর না দিয়েই পরিণীতা উঠে দাঁড়ালো | তারপর অর্নাকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য বলে উঠলো , ———– ” আমি আজ রাসবিহারীর আগেই নামবো রে | কিছু কাজ আছে আমার | হঠাৎ মনে পড়লো | পরে কলেজে দেখা হবে |”

কথাটা বলেই ও অর্নাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই নেমে পড়লো হঠাৎ বাস থেকে , অচেনা মুখের ভিড়ে ঠাসা একটা রাস্তায় |
তবে সেদিনের পর কয়েকটা দিন পার করে ছিল 5th সেপ্টেম্বর , টিচার্স ডে | আজ কলেজে একদম সাজো সাজো ব্যাপার প্রত্যেকটা ডিপার্টমেন্টেই | সব রুম থেকেই গান নাচ আবৃত্তি এইসবের আওয়াজ আসছে যেন | সব ডিপার্টমেন্টে চলছে অনুষ্ঠান | এর ফাঁকেই পরিণীতা এসেছিলো ক্যান্টিনে | ওদের ডিপার্টমেন্টের ফাংশনের জন্য প্রফেসররা খাওয়াচ্ছে | তাই অর্ডার দিয়েছে কিছু খাবারের | সেটা রুমে নিয়ে যাওয়ার দ্বায়িত্বই পড়েছে পরিণীতার ওপর | এর আগে একটা গানও গেয়ে এসেছে ফাংশনে | তবে এইসব ছাড়াও পরিণীতার মনটা আজ বেশ খুশি | কারণ আজ ওর স্টুডেন্টসরা মিলেও সকালে বাড়িতে এসে ওকে উইশ করেছে , গিফ্ট দিয়েছে | সব ওই ক্লাস টু থ্রি এর ছোট ছোট স্টুডেন্টস | কিন্তু ওরা সাধ্য মতন চেষ্টা করেছে পরিণীতাকে খুশি করার | ওর দিনটাকে স্পেশ্যাল বানিয়ে দেয়ার | এটা ভেবেই বেশ ভালো লাগছিলো আজ সারাদিন ওর | তবে এইসব কথা কলেজে কাউকে বলেনি ! সবাই শুনলে হয়তো হাসবে | ছোট ছোট বাচ্চাদের টিউশন পড়ানোটাকে এখন কেউ অতো ইম্পর্টেন্ট কাজ ভাবে না ! তাই ওকেও টিচার হিসেবে কনসিডার করার কথা কেউ ভাববেও না হয়তো | এইসবই ভাবছিলো মনে মনে , তখনই হঠাৎ সেই চেনা গলার আওয়াজে ঘোরটা কাটলো |———- ” হ্যাপি টিচার্স ডে ..”

অনির্বাণ বিনা নোটিশে পরিণীতার সামনে এসে বলে উঠলো কথাটা | পরিণীতা এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেলো যেন | আসলে এক সপ্তাহ পর দেখা হলো অনির্বাণের সাথে | যাইহোক , কথাটা শুনে ও কিন্তু একটু অবাক হয়েই বললো , ———— ” আমাকে হ্যাপি টিচার্স ডে ! কেন ?”

এর উত্তরে অনির্বাণ ওর সামনে চেয়ারটায় বসে অল্প হেসে বললো , ———– ” কারণ তুমিও তো অনেক টিউশন পড়াও | ছোট ছোট বাচ্চাদের | তাই তোমাকেও হ্যাপি টিচার্স ডে |”

কথাটায় পরিণীতা যেন স্থির হয়ে গেলো একটু | কিছুক্ষণের জন্য নিস্পলকভাবে তাকিয়ে রইলো অনির্বাণের দিকে | এভাবেও কেউ ভাবে ! এতো সহজভাবে কেউ কাউকে গুরুত্ব দিতে পারে , তার কাজের ইম্পর্টেন্সটা বুঝিয়ে দিতে পারে ! ভাবেনি আসলে | তবে এর মধ্যেই অনির্বাণ জিজ্ঞেস করে উঠলো ,

————— ” টিচার্স ডে তে উইশ করেনি স্টুডেন্টসরা তোমাকে ? কার্ড দেয়নি ?”

পরিণীতা এই প্রশ্নে আপনাআপনি হেসে ফেললো আনন্দে | তারপর বেশ উৎসাহ নিয়েই এই প্রথম বললো নিজে থেকে ,

————— ” হ্যাঁ দিয়েছে তো , সকাল সকাল এসে সবাই কত উইশ করলো ! নিজেদের হাতে বানানো কার্ড , ছবি এইসব গিফ্ট করেছে | দাঁড়াও , আমার ব্যাগেই আছে , দেখাচ্ছি তোমাকে |”

কথাটা বলেই ও ব্যাগ থেকে কতগুলো কার্ড , ছবি , পেন এইসব বার করে অনির্বাণের সামনে রাখলো | অনির্বাণ খেয়াল করলো পরিণীতার মুখের খুশিটা | কোনো দামি গিফ্ট না ! কোনো বড়োদের জিনিসও না ! এলোমেলো হাতে আঁকা কিছু ছবি , কিছু লেখা , সামান্য কয়েকটা পেন , এইসব পেয়েই পরিণীতা কি খুশি ! অনির্বাণের ব্যাপারটা দেখে আবার খুব অন্যরকম লাগলো মেয়েটাকে | মনে হলো শুধু ভালোবাসার দাম আজকাল কজন দিতে পারে ! সবাই তো আজকাল হিসেব করে খুশি হয় | দামি জিনিস , এক্সপেনসিভ গিফ্ট , এইসবের মধ্যেই তো লোকজন হারিয়ে যায় | কিন্তু পরিণীতা সেরকম না | ও বেহিসাবভাবে খুশি হতে জানে | সাধারণ কিছুর মধ্যেই আনন্দ খুঁজে নিতে পারে মেয়েটা | কথাটা ভেবেই অনির্বাণ বলে উঠলো ,

————– ” খুব মিষ্টি গিফ্ট গুলো তোমার | অনেকগুলো এতো কলরফুল ! খুব ভালো হয়েছে |”

পরিণীতা কথাটা শুনে হেসে উঠলো নিজের মনে | তখনই পাশ থেকে ক্যান্টিনের একজন লোক এসে বললো , ————- ” তোমার খাবারের প্যাকেটগুলো রেডি হয়ে গেছে | এসে নিয়ে যাও |”

না , এরপর আর পরিণীতা বসেনি সেদিন অনির্বাণের সামনে | তাড়াহুড়ো করে কার্ড ছবিগুলো নিজের ব্যাগে ঢুকিয়ে বলেছিলো , ———— ” আসি আজ | ডিপার্টমেন্টে টিচার্স ডের জন্য কিছু খাবার অর্ডার দেয়া আছে | সেগুলোই নিয়ে যেতে হবে |”

কথাটা শেষ করেই ও তারপর খাবারগুলো সমেত বেরিয়ে গিয়েছিলো ক্যান্টিন থেকে | তবে এইসব কিছুই আজ একজন একটু দূরে বসে দেখছিলো চুপচাপ | কিন্তু আজ সে আর চুপ করে বসে থাকতে পারলো না | স্নেহা পরিণীতা চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই অনির্বাণের কাছে এসে হাজির হলো | ভেতরটা রাগে জ্বলে যাচ্ছিলো ওর এই মুহূর্তে | একই ক্যান্টিনে বসে থেকেও অনির্বাণ ওকে নোটিশই করলো না এতক্ষণ ! কথাটা ভেবেই স্নেহা বলে উঠলো , ———- ” নতুন বন্ধু হয়েছে এই মেয়েটা ? দেখি মাঝে মাঝে কথা বলতে ! ”

অনির্বাণ এরকম অকারণ প্রশ্ন ঠিক আশা করেনি এই মুহূর্তে | বুঝলো না ও কার সাথে বন্ধুত্ব করবে না করবে না সেই নিয়ে স্নেহার এতো কৌতূহল কিসের ! তাই অল্প কথায়ই বলে উঠলো ,

————— ” হ্যাঁ , বন্ধু আমার |”

তবে এরপরও স্নেহা থামলো না , আবার জিজ্ঞেস করে উঠলো , ———— ” কি নাম মেয়েটার ? আমি যত দূর জানি ফার্স্ট ইয়ার |”

অনির্বাণের এবার একটু বিরক্তই লাগলো | তাও উত্তর দেয়ার ইচ্ছা না থাকলেও বললো শুধু , ——— ” পরিণীতা |”

না , স্নেহা এবার নিজের রাগটাকে আর লুকিয়ে রাখতে পারলো না যেন | গলাটাকে বেশ তীক্ষ্ণ করেই বলে উঠলো ও , ———- ” বুঝলাম | তবে একটা কথা ! মেয়েটা তোমার স্ট্যান্ডার্ডের নয় | তবে এইসব মেয়েরা ছেলেদের নিজের কাছে এট্র্যাক্ট করার জন্য অনেক কিছুই করতে পারে ! তাই একটু সাবধানে থেকো | ফেঁসে যেও না আবার কোনোভাবে | আফটার অল ক্লাসটা ম্যাটার করে !”

কথাগুলো একসঙ্গে বলে গেলো স্নেহা | তবে অনির্বাণও এইসব শুনে উঠে দাঁড়ালো চেয়ার ছেড়ে | হাত দুটো মুঠো হয়ে এসেছে ওর রাগে | তাই আর নিজেকে না সামলে চোয়াল শক্ত করে বললো ও , ————– ” শাট আপ … জাস্ট শাট আপ … পরিণীতার স্ট্যান্ডার্ড নিয়ে কথা বলার আগে নিজের স্ট্যান্ডার্ড কি সেটা ভেবে দ্যাখো | শুধু বাবার অনেক পয়সা থাকলেই স্ট্যান্ডার্ড হাই হয়ে যায় না | চিন্তাধারাটাকেও একটু উঁচু রাখতে হয় | এতো ছোট মন নিয়ে সব কিছু দেখলে কোনোদিনও লাইফে এগোতে পারবে না | আর পরিণীতাকে নিয়ে কিছু বলার আগে নিজের এই ছোট মেন্টালিটিটাকে একটু চেঞ্জ করো | আর হ্যাঁ , এরপর আমার সঙ্গে যদি কথা বলতে আসো , তাহলে একটু ভেবে চিন্তে কথা বলবে | আর সেই সেন্সটা যদি কাজ না করে , তাহলে কথা বলবে না |”

এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে অনির্বাণ ব্যাগটা নিয়ে বেড়িয়ে গেলো ক্যান্টিন থেকে চোখের পলকে | কিন্তু স্নেহা যেন অপমানে এগোতে পারলো না এক পা ও | অনির্বাণ যে ওর সঙ্গে এইভাবে কথা বলবে ! এই ভাবে মুখের ওপর ইনসাল্ট করে চলে যাবে , এটা আসলে ভাবতে পারেনি স্নেহা | তাই রাগে , জ্বালায় , যন্ত্রণায় টুকরো টুকরো হয়ে গেলো ও | চোখে জল এসে জমলো এখন | তবে এর মধ্যেই পরিণীতার ওপর খারাপ লাগাটা বেড়ে দ্বিগুন হয়ে গেলো যেন আজ স্নেহার | মনে হলো যার জন্য আজ অনির্বাণের কাছে ওকে এতো কথা শুনতে হয়েছে , তাকে একটা উত্তর স্নেহা দেবেই | খুব তাড়াতাড়ি দেবে | পরিণীতাকে নিজের জায়গাটা বুঝিয়েই ও ছাড়বে | কথাটা আজ নিজের মনেই বলে উঠলো হঠাৎ |

<১২>

শরতের রং কি সুন্দর হয় না ! সোনালী রোদের রং | নীল মেঘের রং | হালকা সাদা তুলোর মতন কাশফুলের রং ! সবটা মিলিয়ে বছরের সেরা সময় লাগে পরিণীতার এই শরৎকালকে | মনে হয় এই দিনগুলোকে যদি ধরে রাখা যেত সারা বছর ! যদি এই শহরের চারিদিকের সাজ সাজ ভাব , মায়ের জন্য দিন গোণা , সবার হাসি মুখ , পুজো নিয়ে উৎসাহ , ভালো কিছু হওয়ার আশা , এই সব কিছুই যদি মাত্র এই একটা মাসের জন্য না থেকে সারা বছরের জন্য থাকতো ! তাহলে কি ভালোই না হতো ! ও ছোটবেলায় বাবাকে বলতো মাঝে মাঝে এই কথাগুলো ! এখনো মনে আছে ! এইসব শুনে কি হাসতো বাবা ! তারপর বলতো , ———– ” সারা বছর ধরে যদি শরৎকাল থাকে , তাহলে শরৎকালকে আর এতো ভালো লাগবে না কারোর ! কম সময়ের জন্য থাকে বলেই সবাই এই সময়টা পাওয়ার চেষ্টা করে | এতো অপেক্ষা করে | আসলে এটাই নিয়ম , সহজে পাওয়া জিনিস , সময় , মানুষ , কোনো কিছুরই দাম থাকে না বেশি | যার জন্য অপেক্ষা করতে হয় , সে-ই দামি হয় | বুঝলি |”

না , কথাগুলোর মানে সেদিন না বুঝলেও আজকাল বোঝে পরিণীতা একটু একটু | এই যেমন অনির্বাণ ! ও এতো দূরের বলেই হয়তো ওর হঠাৎ হঠাৎ কাছে আসাটা ভালো লাগে পরিণীতার | মনে হয় যদি সত্যি ওদের কোনো গল্প সম্ভব হতো ! যদি মাঝের এই দেয়ালটা না থাকতো ! যদি অনির্বাণ এতো বড়োলোক , এতো অধরা না হয়ে ওর মতন সাধারণ কেউ হতো ! তাহলে হয়তো জোর করে এইভাবে মনকে ঘুরিয়ে রাখতে হতো না | চাপা দিতে হতো না এই ফিলিংসগুলোকে | কিন্তু এইসব ভাবনার ভিড়ে আবার এটাও মনে হয় , যদি অনির্বাণ এতটা দূরের না হয়ে ধরা ছোঁয়ার মধ্যে হতো , তাহলে কি এই টানটা থাকতো পরিণীতার ! তাহলে কি আলাদা করে অনির্বাণের জন্য মন কেমন করতো ! না কি বাবার কথা অনুযায়ী দাম কমে যেত ছেলেটার !

আজ এই শরতের নীল আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে বাসের অপেক্ষা করতে করতে পরিণীতার এইসবই মনে হচ্ছিলো কেমন | আজ চতুর্থী | কলেজের ছুটি পড়লো আজ | আবার এক মাস বাদে দেখা হবে এই ক্লাসরুমগুলোর সঙ্গে | তবে শুধুই কি ক্লাসরুম ! এক মাসের জন্য তো অনির্বাণও দূরে থাকবে ওর থেকে | ছেলেটার ওই হঠাৎ হঠাৎ কাছে আসা , টুকরো টুকরো কথা , কিছুই থাকবে না এই এক মাসে ! কথাটা ভেবে আনমনে একটা মন খারাপ এসে জমলো যেন মনে | কিন্তু তখনই পরিণীতাকে অবাক করে ওর সামনে অনির্বাণ এসে হাজির | ওর ডিপার্টমেন্টের সবাই যদিও আজ ঠাকুর দেখতে বেরিয়েছে | কিন্তু অনির্বাণ ইচ্ছে করেই যায়নি | ও জানতো পরিণীতার ক্লাস কটায় শেষ হবে আজ | তাই সময় মতন বাস স্ট্যান্ডে এসে দাঁড়িয়েছে | কিন্তু পরিণীতা এরকম হঠাৎ অনির্বাণকে দেখে নিজের আনন্দটাকে আর লুকিয়ে রাখতে পারলো না কিছুতেই ! দুটো উজ্বল চোখ নিয়েই বললো ,

————— ” তুমি ! তোমার ক্লাস শেষ হয়ে গেছে ? ”

কথাটা শুনে অনির্বাণ ওর দিকে স্থিরভাবে তাকিয়ে বললো , ———- ” না হয়নি | কিন্তু আমি আজ একটা ক্লাস না করেই বেরিয়ে এলাম |”

এটা শুনে পরিণীতা একটু প্রশ্নবোধক চিহ্নের মতন মুখ করেই বললো , ———– ” ওহ , কেন ?”

অনির্বাণ এই প্রশ্ন শুনে একটা দীর্ঘ্যশ্বাস ফেলে বললো , ————- ” আছে কারণ একজন ! আজ থাক , অন্য একদিন বলবো | কিন্তু তোমার সেই বন্ধুটা নেই আজ ? সে তো দেখি সারাক্ষণ তোমার সঙ্গে সঙ্গে ঘোরে !”

কথাটায় পরিণীতা একটু মুখটা অন্ধকার করেই বললো , ———— ” অর্না ! ও তো ওর মামারবাড়িতে | বর্ধমানে | পুরো পুজোটা ওখানে থাকবে | আমি যে কি করবো একা একা !”

এটার উত্তরে অনির্বাণ ওকে অন্য একটা প্রশ্ন করে উঠলো হঠাৎ , ———– ” কেন ? তুমি ঠাকুর দেখতে বেরোও না কোথাও ?”

পরিণীতা এর উত্তরটাও একটু ম্লান হয়ে দিলো | কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বললো , ———— ” বাবা যখন বেঁচে ছিল তখন ঘুরতাম অনেক | কিন্তু তারপর ! অর্না থাকলে তাও যাই টুকটাক এদিকওদিক | কিন্তু ও না থাকলে একা একা ভালো লাগে না | আর মা ও আসলে বাবা চলে যাওয়ার পর এই পুজোর দিনগুলোতে বেরোতে চায় না ঠিক !”

কথাগুলো নিজের মনেই বলে গেলো সেদিন পরিণীতা | কিন্তু খেয়াল করলো অনির্বাণও চুপ হয়ে গেছে হঠাৎ এইসব শুনে | আর তখনই বাসটাও চলে এলো | ওরা আর অপেক্ষা না করে বাসে উঠে বসলো | এখন রাস্তায় বেশ ভিড় | পুজোর মার্কেটিং নিয়ে সবাই ব্যস্ত | চলন্ত কলকাতাকে দেখতে দেখতে পরিণীতা এইসবই ভাবছিলো | তখনই অনির্বাণ বলে উঠলো ,

————- ” তুমি আমার সঙ্গে ঠাকুর দেখতে বেরোবে ? এইবার পুজোতে ?”

পরিণীতা কথাটা শুনে জানলা থেকে মুখ ফিরিয়ে বেশ অবাক হয়ে অনির্বাণের দিকে তাকালো এখন | কি বলছে ছেলেটা হঠাৎ ! কিছুই যেন বুঝলো না ঠিক পরিণীতা | মানে হ্যাঁ, ওদের মধ্যে এতদিন টুকটাক কথা হয় ঠিকই | কিন্তু অনির্বাণ কখনো ওর ফোন নাম্বারটা অব্দি চায়নি ! সে আজ একসঙ্গে ঠাকুর দেখতে যাওয়ার কথা বলছে !

কথাগুলো ভাবতেই অনির্বাণ আবার বলে উঠলো , ————— ” কি হলো ? কি ভাবছো ? যাবে ?”

পরিণীতা কথাটা শুনে নিজের মনেই বললো , ———— ” আমি ! ঠাকুর দেখতে ! তোমার সঙ্গে ?”

অনির্বাণ এই প্রশ্নটা শুনে একটু দৃঢ় গলায়ই বললো , ————– ” কেন ? যাওয়া যায় না ? প্রব্লেম আছে কোনো ?”

পরিণীতা এর উত্তরে কিছুটা ভদ্রতা করেই বললো , ———– ” না না ! প্রব্লেম কিসের ! কিন্তু মানে আমার সঙ্গে তুমি কেন ঠাকুর দেখবে ? তোমার তো অনেক সার্কেল আছে বন্ধুদের , বাড়ির লোকের | তাদের সঙ্গে দ্যাখো | আমার সাথে ঠাকুর দেখতে গেলে অতটা মজা হবে না |”

অনির্বাণ এবার যেন একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস নিলো নিজে | তারপর আলতো হেসে বললো , ————– ” তোমার সঙ্গে ঠাকুর দেখলে আমার ভালো লাগবে কি লাগবে না , সেটা তুমি নিজে বুঝবে না কি ! সেটা তো যে তোমার সঙ্গে যাচ্ছে সে বুঝবে | যাইহোক , তাহলে ওই কথাই রইলো | কবে কখন যাবো সেটা ফোন এ কথা বলে ডিসাইড করে নেয়া যাবে | তুমি আমার নাম্বারটা নাও |”

কথাটা বলেই অনির্বাণ পরিণীতার ফোন এ নিজের নাম্বারটা সেভ করালো সঙ্গে সঙ্গে | তবে ততক্ষণে রাসবিহারী চলে এসেছে | তাই রাস্তা আর কথা , দুটোই আজ এখানেই শেষ হলো দুজনের | কিন্তু পরিণীতার বাড়িতে এসেও ঠিক ঘোরটা কাটলো না | হঠাৎ অনির্বাণ ওর সঙ্গে ঠাকুর দেখতে যাওয়ার কথা বললো কেন ! ফোন নাম্বারও এক্সচেঞ্জ করলো ! ওই মাপা দূরত্বটাকে আজ ভাঙতে চেষ্টা করলো কেন অনির্বাণ ! কি কারণে এইভাবে কাছে এলো হঠাৎ ! তবে এইসব চিন্তার মধ্যেও মনে একটা আনন্দ না চাইতেও এসে জড়ো হচ্ছিলো ওর | ভেবেছিলো আবার এক মাস বাদে এই ছেলেটার সঙ্গে দেখা হবে হয়তো | কিন্তু ভাবনাটা মিললো না | অনির্বাণ নিজেই দূরত্বটা কমিয়ে দিলো |

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here