ভালোবাসার শহরে ( সপ্তম পর্ব )
ঈপ্সিতা_মিত্র
<২০>
এই সময়টা ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহ । বেশ মিষ্টি একটা ঠান্ডা ওয়েদার চারিদিকে । হালকা রোদ আর কুয়াশার মাঝে ঘিরে আছে সোনাঝুরি । তবে আজ বেশ চাপে পড়েছে পরিণীতা । বিল্টু আসেনি কাজে । ও বেশ কয়েকটা বাড়ি খাবার ডেলিভারি দেয় । তাই আজ ওর এবসেন্স এ বাকি যারা ডেলিভারি করে তাদের জায়গা ভাগ করে দিতে হচ্ছে পরিণীতা কে । তবে একটা বাড়ি খুব অফ্ রুটে । নতুন কাস্টোমার সে । সোনাঝুরি কলেজের প্রফেসর না কি ! নতুন এসেছে এখানে । কিন্তু তার বাড়ি খাবার পৌঁছে দেয়ার মতন কাউকেই পাচ্ছে না পরিণীতা ! তাই বাধ্য হয়ে ঠিক করলো নিজেই যাবে । যদিও আগের মাসের হিসেব নিয়ে বসতে হতো ওকে ! কটা বাড়ি থেকে পেমেন্ট আসা বাকি দেখার ছিল । কিন্তু সেসব কাজ পরে এসেই করতে হবে । এই ভেবেই খাবারগুলো নিয়ে স্কুটিতে স্টার্ট দিয়েছিল । তারপর কিছুক্ষণ এর মধ্যে পৌঁছে গেছিল এক তলা সুন্দর সাজানো বাগান বাড়িটায় । এখানে আসলে কলকাতার অনেকে বাড়ি করে রাখে । শান্তিনিকেতনে দোলের সময় আসে অনেকে । বছরের বাকি সময়টা ফাঁকাই পরে থাকে বাড়ি । তাই এরা ভাড়া দেয় অনেক সময় । এই বাড়িটাও হয়ত তাই হবে ! কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই কলিংবেল বাজিয়েছিল পরিণীতা । তারপর দু মিনিট অপেক্ষা করার পর দরজাটা খুলেছিল সে । আর পরিণীতা একদম থমকে গেছিল হঠাৎ । উল্টো দিকে পাঁচ বছর আগের ফেলে আসা মানুষটা দাঁড়িয়ে ! অনির্বাণ । মুখে হালকা দাঁড়ি , একটা ব্ল্যাকফ্রেম এর চশমা , আর এক রাশ বিস্ময় নিয়ে সে ও এখন অপলক দৃষ্টিতে পরিণীতা কে দেখছে ! দুজনেরই যেন এই সময়ে শব্দ নেই কোন বলার মতন ! সময় যেন কেমন স্থির হয়ে গেছে হঠাৎ । অতীত যে এইভাবে বর্তমানে চলে আসবে এটা আসলে ভাবতে পারেনি কেউই ! তাই চুপ হয়ে গেছিল দুজনেই ।
তবে পরিণীতা কিছুক্ষণ পর নিজেকে সামলে শুধু বলেছিল , ———- ” খাবারটা রাখো ।”
তারপর অনির্বাণের হাতে প্যাকেটগুলো ধরিয়েই ও বারান্দা ধরে হাঁটতে শুরু করেছিল । এই সামনেই সিঁড়ি পেরিয়ে বাগানের সরু রাস্তাটা । তারপর কয়েক পা হাঁটলেই বাইরে বেরোনোর গেট । কথাটা ভেবেই জোরে পা চালিয়েছিল পরিণীতা । যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অনির্বাণের থেকে দূরে চলে যেতে চাইছিল ও ।
কিন্তু পারলো না এত চেষ্টার পরেও । অনির্বাণ ওর নাম ধরে ডাকতেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো হঠাৎ আনমনে । অনির্বাণ সেই মুহূর্তে প্রায় দৌড়েই ওর কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলো ,
———- ” কেমন আছো তুমি ?”
গলাটা খুব ভারী লাগলো যেন ওর । মনে হলো অনেক টা জমা কষ্ট নিয়ে জিজ্ঞেস করছে কথাটা অনির্বাণ । এই সময়ে পরিণীতা ওর দিকে এক পলক না তাকিয়ে পারলো না ! তারপর স্থির গলায় বললো , ———— ” ভালো আছি ।”
না , আর দাঁড়ালো না এরপর ! পরিণীতা আগের মতনই তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে বেরিয়ে এলো বাড়ি টা থেকে । নিজের অতীত থেকে ।
কিন্তু অনির্বাণ কিরকম স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে রইলো এই মুহূর্তে ! বিশ্বাস হচ্ছিল না ঠিক যে সত্যি এতদিন পর ও পরিণীতা কে খুঁজে পেয়েছে ! আবার ওই সরল নিষ্পাপ মুখটার মুখোমুখি হতে পেরেছে । কত খুঁজেছে ও এই কবছরে এই মেয়েটা কে ! হঠাৎ করে নিউইয়র্ক এ যখন পরিণীতার মেল আসা বন্ধ হয়ে গেল ! ওই নাম্বারে ফোন করলে আর পাওয়া যেত না , তখন অনির্বাণের চারিদিকটা কিরকম অন্ধকার হয়ে আসতো ! দম বন্ধ করা কষ্ট শুরু হতো যেন বুকে । এইভাবে দু মাস কাটিয়ে অনির্বাণ আর থাকতে পারেনি নিউইয়র্ক এ । ফিরে এসেছিল কলকাতা । তারপর এয়ারপোর্ট থেকে সোজা চলে গেছিল কলেজ । কিন্তু কলেজে গিয়ে একটা ধাক্কা লেগেছিল ওর অর্নার কথা শুনে । অর্না বেশ অবাক হয়েই বলেছিল অনির্বাণ কে ,
———– ” তুমি জানো না পরিণীতা কলেজ ছেড়ে দিয়েছে ! দু মাস আগেই তো টিসি নিতে এসেছিল প্রিন্সিপাল স্যার এর কাছে । তবে ও আর আমার সঙ্গেও যোগাযোগ রাখে না ! ফোন নাম্বার চেঞ্জ করে দিয়েছে মনে হয় । কোথায় আছে ! কি করছে ! কিছুই জানি না । আর ও যেদিন টিসি নিতে এসেছিল সেদিন আসলে আমি আসিনি কলেজ এ । সেই জন্য দেখাও হয়নি আর ! ”
কথাগুলো শুনে অনির্বাণ স্থির থাকতে পারেনি আর । গলার আওয়াজ বাড়িয়েই বলে উঠেছিল , ———– ” দেখা হয়নি মানে ! তুমি ওর বাড়ি গিয়ে খোঁজ নাওনি আর ! ও তো কলকাতাতেই আছে না কি ?”
এই কথার উত্তরে অর্না একটু স্থির গলায় বলেছিল , ———- ” না, পরিণীতা ওর মামার বাড়িতে নেই । আমি গিয়েছিলাম ওখানে খোঁজ নিতে । কিন্তু ওর মামা বললো যে পরিণীতা আর ওর মা না কি বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে । কোথায় গেছে সেসব ওরা জানে না । কথাটা বলেই ওরা মুখের ওপর দরজা দিয়ে দিয়েছিল আমার ! খুবই অভদ্র লোকটা ! শুনেছি পরিণীতা দের সঙ্গেও খুব খারাপ ব্যবহার করতো । সেই জন্যই কি চলে গেল ! না কি তোমার মা দেখা করে সেদিন !”
শেষ কথাগুলো সেদিন নিজের মনেই বলেছিল অর্না । কিন্তু অনির্বাণ খুব অবাক হয়ে ওকে মাঝখানে থামিয়েই জিজ্ঞেস করেছিল ,
———– ” মা দেখা করেছিল মানে ? মা তো পরিণীতাকে চেনে না !”
এর উত্তরে অর্না একটু জোর দিয়েই বলেছিল ,
———- ” চেনে না মানে ! সেদিন কলেজের বাইরে এসেছিল তো তোমার মা । পরিণীতাকে গাড়িতে উঠতে বলেছিল নিজের । তবে ওদের মধ্যে কি কথা হয়েছে সেটা আমি জানি না !”
<২১>
সেদিন অর্নার কথাটা শুনে কিছুটা এলোমেলো হয়ে গেছিলো অনির্বাণ হঠাৎ | পরিণীতার এইভাবে চলে যাওয়া , মায়ের ওর সঙ্গে দেখা হওয়া , সব কিছু কনেক্টেড না তো ! আর ও তো চেনে ওর মা কে | মা সব সময়ই নিজের ক্লাস , স্ট্যান্ডার্ড এইসব নিয়ে ভেবে চলা মানুষ | তাহলে কি মা ই পরিণীতাকে কিছু বলেছিলো ! যার জন্য পরিণীতা ওর সঙ্গে সব কন্ট্যাক্ট শেষ করে দিলো ! কিন্তু মা পরিণীতাকে চিনবে কি করে ! মা তো জানতো না কিছু ওর ব্যাপারে | অনির্বাণ নিজের পা এ দাঁড়িয়ে পরিণীতার কথাটা বাড়িতে বলবে ভেবেছিলো | তাহলে যদি মা বাবা আপত্তি করেও ওর একটা জোর থাকবে আলাদা থাকার | কিন্তু তাহলে পরিণীতার ব্যাপারে মা জানলো কি করে ! স্নেহা কি কিছু বলেছে ! বললে ওই মেয়েটাই বলতে পারে | ওর মতন মেয়ে যা ইচ্ছে তাই করতে পারে | কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই সেদিন অনির্বাণ মায়ের কাছে গেছিলো | ড্রইং রুমে মা তখন একটা ম্যাগাজিন পড়ছিলো | হঠাৎ করে অনির্বাণকে আসতে দেখে তো খুব অবাক হয়ে গেছিলো সেদিন ! ছেলেটার তো এখন নিউইয়র্ক এ থাকার কথা | ও এখানে কলকাতায় কি করছে ! কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই বলেছিলো চিন্তা নিয়ে ,
———– ” তুই ! তুই এখানে কি করছিস ? তুই আসবি যে জানাসনি তো কিছু !”
কথাটায় অনির্বাণ কোনো উত্তর না দিয়ে অন্য একটা প্রশ্ন করে উঠলো একদম ওর মার্ কাছে এসে ,
———— ” তুমি পরিণীতার সঙ্গে কেন দেখা করেছিলে ? কি বলেছো ওকে ?”
অনির্বাণের মা এর উত্তরে আকাশ থেকে পড়ার মতন মুখ করেই বলেছিলো ,
————- ” ওহ ! তার মানে বলা হয়ে গেছে তোকে ! কি অসভ্য মেয়ে | কোনো ভয়ও নেই | বললাম যে কলেজ থেকে সাসপেন্ড করে দিতে পারি ! তারপরেও ওর এতো সাহস !”
শেষ কথাগুলো নিজের মনেই বলে গেছিলো অনির্বাণের মা | রাগে মুখটা লাল হয়ে গেছে এখন যেন অন্তরার | অনির্বাণ তবে এই মুহূর্তে সবটা বুঝে গেছিলো খুব স্পষ্টভাবে | ও প্রায় চিৎকার করে উঠেছিল এবার | মা কে ধরে ও চেঁচিয়ে বলেছিলো , ————- ” কি বলেছো তুমি পরিণীতাকে ? কেন বলেছো ? ও কি ক্ষতি করেছিল তোমার ? আর ওর সঙ্গে কথা বলার আগে একবার আমাকে কিছু বলার প্রয়োজন মনে করলে না ! এতটা ইনসেন্সিটিভ তুমি ?”
কথাগুলো শুনে এবার অনির্বাণের মা ও উত্তেজিত হয়ে ওর হাতটা নিজের কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলেছিলো ,
————- ” তুই বলেছিলিস আমাকে ওরকম একটা লো স্ট্যান্ডার্ড মেয়ের সঙ্গে রিলেশন এ যাওয়ার আগে ? কোনো ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড নেই ! কোনো ক্লাস নেই ! কোথাকার একটা ছোটোলোক মেয়ে | তুই যেহেতু বলিসনি , তাই আমিও বলার প্রয়োজন মনে করিনি কিছু তোকে | ”
কথাগুলো ভীষণ কানে লেগেছিল অনির্বাণের। নিজের ধৈর্য্যটা তাই হারিয়ে ফেলেছিল ও । প্রচণ্ড রাগ নিয়েই বলেছিল ,
————– ” তুমি ওকে কতটুকু চেনো ? কতটুকু দেখেছ ওকে ? কাউকে না চিনে না জেনে এইভাবে ছোটলোক বলে দিলে ! আর তুমি কি এইসব কথাগুলো ওর সামনে ও বলেছ ! তুমি কি ওকে এই ভাষায় ইনসাল্ট করেছ মা ?”
এই প্রশ্নের উত্তরে অনির্বাণের মা বেশ তাচ্ছিল্য দেখিয়েই বলেছিল ,
————— ” হ্যাঁ , ওকে ঠিক এই ভাষাতেই অপমান করেছি । এরা যেরকম ল্যাঙ্গুয়েজ বোঝে , ঠিক সেই ভাবেই কথা বলেছি আমি । ভীষণ ভালো করে বুঝিয়ে দিয়েছি ওর সাথে আমাদের ডিফরেন্স টা কতটা ! বুঝিয়ে দিয়েছি তোকে ফাঁসানো এত সহজ হলেও আমাদের কে নিজের ট্র্যাপে ফেলা ইজি না । আসলে দোষটা তোর ও না ! দোষটা তোর ঠাকুমার ! ছোটবেলা থেকে কোন হোস্টেল এ দিয়ে দিলে ভালো হতো । ওই মহিলার কাছে রেখে মানুষ করেই এই অবস্থা ! নিজের মতন একটা ইমোশনাল ফুল তৈরি করেছে ছেলেটাকে । আচ্ছা , তোর চোখে স্নেহার মতন মেয়ে পরে না না ? এত সুন্দর , স্মার্ট , আমাদের স্ট্যান্ডার্ড এর ! সেখানে কোথাকার কে একটা চালচুলোহীন মেয়ের সঙ্গে ..”
না , আর কথাটাকে শেষ হতে দেয়নি সেদিন অনির্বাণ । ওর আর সহ্যশক্তি নেই এইসব কথাগুলো কে শুনে এখানে দাঁড়িয়ে থাকার ! তাই মাঝপথে থামিয়ে দিয়েই বলেছিল নিজের কথাগুলো কেটে কেটে ,
———— ” এবার একটু থামো । আর না । আর একটা শব্দও বলবে না । দিনের পর দিন পার্টি করে , ঘুরে বেড়িয়ে , আমাকে ঠাম্মার ভরসায় ছেড়ে রেখে তো ভীষণ ভালো করেই নিজের জীবনটা কাটিয়েছ । আর এখন যখন সেই মানুষটা নেই , তখন তার নামেই যা ইচ্ছে তাই বলছো ! আর সত্যি আমি খুব খুশি যে আমি আমার ঠাম্মার মতন হতে পেরেছি । তোমাদের মতন মানুষকে টাকা দিয়ে মাপতে শিখিনি । আর হ্যাঁ , পরিণীতা কেমন মেয়ে সেটা বোঝার ক্ষমতা তোমার আর বাবার কোনদিন হবে না ! কারণ তোমাদের সেই চোখ নেই যে একটা মানুষের মন বুঝতে পারবে । তোমাদের চোখে স্নেহা রাই পরবে । ওই যারা নিজেদের শো অফ্ করতে জানে ! লোকজনকে ইনসাল্ট করতে পারে ভালোভাবে ! যাইহোক , এত কিছুর পর এই বাড়িতে আমার পক্ষে আর থাকা সম্ভব না । তোমরা তোমাদের স্ট্যাটাস , আর মিথ্যে অহংকার নিয়ে ভালো থেকো ।”
কথাগুলো শেষ করেই সেদিন অনির্বাণ জোরে পা চালিয়ে বেরিয়ে এসেছিল ঐ বাড়ি থেকে । তবে সেই মুহূর্তে ওর মা ওকে আটকানোর অনেক চেষ্টা করেছিল ! অনেকবার ডেকেছিল ওর নাম ধরে ! কিন্তু অনির্বাণ আর পিছনে ফিরে তাকায়নি।
এরপর অনির্বাণ আর নিউইয়র্ক ফিরে যায়নি কখনো । ভীষণ অপরাধবোধ হতো আসলে ওর । মনে হতো ওর কলকাতা ছেড়ে যাওয়াটাই একটা ভুল ছিল ! যদি এই রূপকথার শহরেই থেকে যেত , তাহলে আজ এইভাবে জীবন ওকে বাস্তব চেনাতো না । এর মধ্যে অনির্বাণ নিজেও গিয়েছিল রাসবিহারী , পরিণীতার মামার বাড়িতে । কিন্তু সেখানে গিয়ে জানতে পারলো যে মামারা বাড়ি বিক্রি করে দিয়ে অন্য জায়গায় শিফ্ট করেছে কদিন আগে । পাড়ার কোনো লোক সেই বাড়ির এড্রেস বলতে পারেনি । তাই পরিণীতার বর্তমান ঠিকানা জানার শেষ আশা টুকুও অনির্বাণের মন থেকে মুছে যায় । কিন্তু ও সোনাঝুরিও এসেছিল পরিণীতাকে খুঁজতে । কারণ পরিণীতা কথায় কথায় বলতো সোনাঝুরির কথা । কিন্তু ওর বাবার নাম, এড্রেস কিছুই জানা না থাকায় তখনও অনির্বাণ কে খালি হাতেই ফিরে যেতে হয়েছে কলকাতা ।
এরপর এই ভেঙে যাওয়া টুকরো মনটাকে নিয়েই ও শুরু করেছিল বাঁচার লড়াই । টিউশনি করে নিজের পড়াশোনা চালিয়েছে । নেট পাশ করে যাদবপুর থেকে পিএইচডি করেছে । থেকেছে মেসে , হোস্টেল এ । এর মধ্যে মা বাবা অনেকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিল যদিও অনির্বাণের সঙ্গে ! কিন্তু অনির্বাণ আর কখনো ফিরে যায়নি । আসলে ওর ধাক্কা লেগেছিল খুব । পরিণীতার এইভাবে ওর জীবন থেকে চলে যাওয়াটা একসেপ্ট করতে পারেনি কিছুতেই ! বার বার এই পাঁচ বছরে মেয়েটার মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠেছে শুধু । মনে হয়েছে কতটা অপমান , কতটা যন্ত্রণা নিয়ে পরিণীতা ওর থেকে দূরে সরে গেছে ! কিভাবে নিজেকে আলাদা করে নিয়েছে বিচ্ছিন্ন কোন দ্বীপের মতন ! আর এইসব যাদের জন্য হয়েছে তাদের দোষটা অনির্বাণ কোনোদিনও ভুলতে পারবে না । তাই নিজেকেও আলাদা করে রেখেছে এই পাঁচ বছর মা বাবার থেকে ।
তবে সোনাঝুরি কলেজে পোস্টিং পাওয়ার পর অনেকদিন বাদে ওর মনে একটা আশার আলো জেগেছিল । যে যদি এবার পরিণীতার এড্রেসটা খুঁজে পায় ও ! সোনাঝুরি তে থেকে ! কিন্তু সবটা যে এতটা সহজ করে দেবে নিয়তি ! পরিণীতা নিজে ওর কাছে আসবে এইভাবে ! এটা কল্পনাও করেনি ।
সেদিন যেন অনির্বাণের মনে হয়েছিল অনেকদিনের নির্বাসন থেকে মুক্তি পেয়েছে অবশেষে । এবার হয়ত ও অভিমানের পাহাড়টা গলাতে পারবে ! দূরত্ব টা কে শেষ করতে পারবে দুজনের ।
<২২>
তবে সেদিন অনির্বাণ নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে ‘ সোনাঝুরি হেঁশেল ‘ এর রিপ্লেটে লেখা নাম্বারটাতে ফোন করেছিল সন্ধ্যেবেলা । একবার দুবার রিং হয়ে সেই চেনা গলার আওয়াজটা ফোন ধরেছিল ওর অবশেষে। হঠাৎ সেই মুহূর্তে মনে হয়েছিল ইস , কালকে যদি এসএমএস এ খাবার অর্ডার না করে ফোন করতো একবার , তাহলে হয়তো গলার আওয়াজ টুকু চিনে ফেলতো ও ! জীবন থেকে আরো একটা দিন বাদ হয়ে যেত না পরিণীতাকে ছেড়ে ! একা একা । কথাগুলো ভাবতেই ওপারের গলাটা হ্যালো হ্যালো করতে করতে একটু যেন অধৈর্য্য হয়ে বলেছিল , ———– ” আপনার কি কোন দরকার নেই কথা বলার ? তাহলে শুধু শুধু ফোন করেছেন কেন ? অদ্ভুত তো !”
এই কথাগুলোর উত্তরে অনির্বাণ সেই মুহুর্তে শুধু দুটো শব্দই বলতে পেরেছিল । আস্তে গলায় থমকে উত্তর দিয়েছিল ,
————- ” আমি বলছি। অনির্বাণ ।”
না , পরিণীতা আর কোন কিছু বলেনি এরপর । আসলে কিছু কথা এক জীবনে একটা মানুষের সাথে শেষ হয়ে যায় হঠাৎ । তাই আর অনির্বাণ কে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ফোনটা কেটে দিয়েছিল পরিণীতা ।
আর কি হবে কথা বাড়িয়ে ! এই পাঁচ বছরে অনির্বাণ নিশ্চয়ই স্নেহার সাথে বিয়ে করে ফেলেছে ! আর যদি না ও করে থাকে, খুব তাড়াতাড়ি করবে নিশ্চয়ই । ওর মা তো সেরকমটাই বলেছিল । আর বলেছিল অনির্বাণের সঙ্গে পরিণীতার তফাৎ কতটা ! কথাগুলো আজও ভুলতে পারেনি ও । প্রত্যেকটা লাইন এখনও কানে বাজে যেন পরিণীতার । সেই তাচ্ছিল্য ভরা দৃষ্টি , সেই নোংরা চাহুনি আজও শেষ করে ওকে অকারণে , ব্যস্ত সময়ের ভিড়ে । তাই আর পারবে না , সেই অপমানের কাছে ফিরে যেতে । কখনো পারবে না । কথাগুলো ভেবে তাই সুইচ অফ করে দিলো সেদিন ফোনটা পরিণীতা ।
কিন্তু অনির্বাণ পারলো না নিজের চেষ্টাটা থামাতে আজও । ওই বন্ধ হওয়া ফোন নাম্বারে কল করলো তাই বেশ কয়েক বার । যদি একবার পরিণীতা কিছু বলে ! কিছু জিজ্ঞেস করে ওকে । কিন্তু বার বার নিঃস্তব্ধতা ফেরৎ পেতে পেতে শেষে ও নিজেও কেমন ক্লান্ত হয়ে গেলো যেন ! ফোনটা রেখে বসে পরলো সোফায় । মনে হলো যতদিন না অনির্বাণ শেষ হচ্ছে ততদিন পর্যন্ত কি এই দূরত্ব শেষ হওয়া সম্ভব নয় ! পরিণীতা কি আর কখনও ফিরবে না ওর কাছে ! এইভাবেই আড়ালে রাখবে নিজেকে সারা জীবন !
এইসব এলোমেলো চিন্তার ভিড়েই পরেরদিনের সকাল হয়েছিল সোনাঝুরি তে । তবে আজ রাতের খাবার দিতে বিকেল বিকেল ছোটু এসেছিল অনির্বাণের বাড়িতে । অনির্বাণ তবে অবাক হয়নি অন্য একজনকে দেখে ! পরিণীতা যে আর কোনদিন এই বাড়ির দরজায় দেখা দেবে না , এটা ও খুব ভালোভাবেই জানে । তাও যে ওর অর্ডারটা ক্যানসেল করেনি ‘ সোনাঝুরির হেঁশেল ‘! পরিণীতা যে অন্যের হাত দিয়ে হলেও খাবারটা পাঠিয়েছে ওর , এটা দেখে ভালো লাগলো অনির্বাণের । মনে হলো আজও হয়ত কিছু বাকি আছে ! অনির্বাণ তবে এত সহজে হাল ছাড়ার ছেলে নয় । আর পরিণীতা কলকাতা থেকে চলে এসে এখানে এই ক বছর কেমন আছে , এটা জানার ইচ্ছেও ওর আছে । তাই চুপ না থেকে এই বাচ্চা ছেলেটাকেই প্রশ্ন করলো , ———– ” কি নাম তোমার ? আর কাল যে এসেছিল আজ সে কেন এলো না খাবার দিতে ?”
কথাটা শুনে ছেলেটা মাথা নেড়ে বললো ,
————- ” কে ? পরিণীতা দিদি ! না না । দিদি কেন আসবে ! এত বড় ব্যবসাটা তো দিদিদেরই। ওর অনেক কাজ থাকে ! ডেলিভারি করার জন্য তো আমরা আছি । কাল আমি ছুটি নিয়েছিলাম , এই রুটে আসার মতন ছেলে পাচ্ছিল না বলে দিদি নিজে এসেছিল ।কিন্তু আজ থেকে রোজ আমিই আসবো খাবার দিতে । আমার নাম ছোটু ।”
কথাগুলো শুনে অনির্বাণ বেশ অবাক হয়ে ছিল মনে মনে । পরিণীতা এরকম একটা ব্যাবসা চালায় ! ওর তৈরি খাবার এই এলাকার সবাই চেনে ! ওই শান্ত , কম কথা বলা মেয়েটার যে ব্যাবসা চালানোর মতন গুণও আছে , এটা জানা ছিল না অনির্বাণের । খুব নতুন লাগছিল পরিণীতা কে আজ ! এইসব শুনে ।
তবে এইসব চিন্তার ভিড়েই ও আবার জিজ্ঞাসা করে উঠেছিল ছোটুকে ,
———— ” তোমার দিদি একাই এই ব্যাবসা চালায় ? কতদিন হলো এই ‘ সোনাঝুরির হেঁশেল ‘ এর ? ”
এর উত্তরে ছোটু একটু ভেবে বললো ,
———— ” মনে হয় চার বছর । আমি তবে তিন বছর ধরে কাজ করি । এখানে যে কত বাড়িতে আমাদের খাবার যায় ঠিক নেই ! তবে দিদি এর মধ্যে আবার একটা টিউটোরিয়াল হোমও চালায় । আমাদের মতন যাদের বাইরে মাস্টার এর কাছে পড়ার টাকা নেই , তাদের পড়ায় । দিদি খুব ভালো জানো ! আমার স্কুলে পড়ার সব খরচ দিদি দেয় ।”
কথাগুলো খুব সরল মনে বলে গেল ছোটু । আসলে ওর শুধু একটা সুযোগ চাই ! পরিণীতার সুনাম করার ! ওর মনে হয় ওর দিদির মতন কেউ এই পুরো পৃথিবীতে হয় না ! আসলে এই তিন বছরে পরিণীতা ওকে একদম নিজের ভাই এর মতন ভালোবাসে । তাই হয়ত ছেলেটা ওর দিদির কথা বলতে পারলে আর কিছু চায় না !
তবে কথাগুলো শুনে অনির্বাণেরও ভালো লাগলো ভীষণ ! মনে হলো এইভাবে হিসেব না করে শুধু পরিণীতাই ভাবতে পারে ! মানুষ হিসেবে ওকে চিনতে ভুল হয়নি অনির্বাণ এর । কথাটা ভেবেই ও ছোটুকে বলে উঠলো আস্তে গলায়,
———— ” আমি যেতে পারি তোমাদের ওই টিউটোরিয়াল হোম এ ? তোমার দিদির সাথে আলাপও হয়ে যাবে ! নিয়ে যাবে আমাকে ?”
এটা শুনে ছোটু আসল কারণটা বুঝতে না পেরেই লাফিয়ে বললো ,
———- ” তুমি যাবে ? তুমি কলেজে পড়াও না ? শুনেছি । দিদিরও তোমার সাথে আলাপ হয়ে ভালো লাগবে । ঠিক আছে । আমি কাল এসে নিয়ে যাবো তোমাকে । বিকেলে আসবো ।”
কথাগুলো এক গাল হেসে বললো ছোটু । অনির্বাণের মুখেও এবার হাসি । মনে হলো একটা ব্রিজ পাওয়া গেছে । এই ছেলেটার জন্যই হয়তো দূরত্ব ভেঙে কাছে আসবে ওরা ! আরেকবার ।
চলবে