অমানিশা❤️,পর্ব-২,পর্ব-৩
লেখিকা_মালিহা খান❤️
পর্ব-২
এশার আজান দিয়ে দিয়েছে।
মুনতাহা একদৌড়ে নিচে নেমে এলো আধছেঁড়া ওড়না নিয়েই। ডানপাশের আচঁল নেই। সেখানটায় এবড়োথেবড়ো ছেঁড়া। বাকি অংশটুকু এখনো গাছেই ঝুলছে। একহাতে কাপড়ের স্তুপ। সেগুলো সামলে লকে চাবি ঢুকাতেই সিঁড়ি ভেঙে উপরে ওঠার পদচারণ শোনা গেলো। মুনতাহা ত্রস্ত চোখে তাকালো একবার। আপনমনেই বিরবির করলো ,”আল্লাহ! বাবা চলে এলো নাকি? এতোরাতে একা একা ছাদে গিয়েছি শুনলে নিশ্চিত তুলকালাম বাঁধিয়ে দিবে। ও খোদা, বাঁচাও!”
আরশাদ উঠে এসেছে। সিঁড়ি থেকেই চোখাচোখি হলো। বিগত কয়েকমিনিটে প্রথম স্বস্তির শ্বাসটা ফেললো মুনতাহা। চোখ ফিরিয়ে নিলো ধীরগতিতে। চাবি ঘোরালো। দরজা খুলে যেতেই সে ঢুকে গেলো তারাতারি।ভেতর থেকে আটকে দেয়ার আগেই একহাতে শক্তিশালী ঠেস দিয়ে বাঁধা দিলো আরশাদ। মুনতাহা ঘাবড়ে গেলো মূহুর্তেই। চেহারায় অনিচ্ছায়ও নিখুঁতভাবে ফুটে উঠলো সেই ভীতি। আরশাদের ঠোঁটের কোঁণে দূর্বোধ্য হাসি। মেয়েটা যে ঘনঘন শ্বাস ফেলছে বোঝা যাচ্ছে। মুনতাহা আচমকাই জোর দিয়ে আটকানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু পারলোনা। আরশাদের হাল্কা চাপেই দরজা খুলে গেলো বাদবাকিটা। ধুম করে বারি খেলো পাশের দেয়ালে।
চেহারাটা মূহুর্তেই অবিকল কাগজের মতো সাদা হয়ে গেলো মুনতাহার। আরশাদ তার আগত কাঁদো কাঁদো চোখ দুটোর দিকে চেয়ে আস্তে করে বললো,
—“আপনার আব্বুকে দিয়ে দিয়েন মু-ন-তা-হা।”
মুনতাহা বিচলিত ভঙ্গিতে দেখলো আরশাদ একটা কালো রঙের ফাইল এগিয়ে দিয়েছে। ভেতরে কাগজপত্র।সে ধরছে না দেখে আরো একটু সামনে এগিয়ে দিলো আরশাদ।
মুনতাহা চট করে হাতে নিলো। মিনমিন করে বললো,”আচ্ছা।”
আরশাদ দরজায় রাখা হাত সরিয়ে নিয়েছে ততক্ষনে। মুনতাহা একনজর দেখেই ধারাম করে লাগিয়ে দিলো মুখের উপর।
আরশাদ ঠোঁট কামড়ে কয়েকসেকেন্ড স্হির চেয়ে রইলো কাঠের দরজার দিকে। চোখের দৃষ্টি বরফের মতোন। কঠিন- শীতল। আচ্ছা, মেয়েটাকি জানে? তার একদুটো কাঁধের ধাক্কায়ই এই কাঠ ভেঙে গুড়িয়ে যাবে?
ফাইলটা পড়ার টেবিলের উপর রেখে বিছানায় যেয়ে বসলো মুনতাহা। জোড়ে জোড়ে শ্বাস টানলো কয়েকবার।
এই একুশ বছরের জীবনে কখনো এমন পরিস্থিতিতে পরেনি। লোকটা কিভাবে যেনো একটা চেয়ে ছিলো? একদম সরাসরি! মুখের দিকে! ছিহ্!
___________
সাবিনা বেগম জানালার ধারে বসে লবঙ্গ চিবাচ্ছেন। বয়স্ক মানুষ। জীবনভর্তি কাজ শেষে এবেলায় তার অফুরান ছুটি। আরশাদের মা রান্নাঘর থেকে গজগজ করছে,”আম্মা, আপনি একটু তো কথা শোনেন আমার। এমন ঠাট মেরে বসে আছেন সন্ধ্যা থেকে। পরেতো রাতভর পিঠের ব্যাথায় শুতে পারবেন না।”
সাবিনা বেগম আরো একটা লবঙ্গ মাড়ির ফাঁকে চালান করে দিয়ে বললেন,”আরে দেখ না, কেমন জোছনা উঠেছে। না দেখে, মটকা মেরে শুয়ে থাকা যায় নাকি?”
আরশাদের মা বিরক্তি নিয়ে তাকালেন। আপনমনেই বিরবির করলেন,”জোছনা উঠেছে! জোছনা দেখে ভাত পাওয়া যাবে?”
শাশুড়ি মানুষ কই তাকে শাসন করবে একটু। নাহ্! উল্টো তিনিই উনাকে শাসন করতে করতে মুখে ফেনা তুলে ফেলেন। চুলোর তেলে পিয়াজের কুঁচি ছেড়ে দিতেই বিশ্রি একটা শব্দ হলো। ঝাঁ ঝাঁ ঝাঁ।
সাবিনা বেগম ঘাড় ফিরালেন। এখানে থেকে রান্নাঘর দেখা যায়। মেয়েটাকে আরো একটু রাগিয়ে দিতে বললেন,”আচ্ছা বৌমা? তোর মতো একটা রসকষহীন মেয়ের সাথে আমার ছেলেটা এতগুলো বছর সংসার করলো কেমনে? বুঝিনা!
আরশাদের মা চোখমুখ কুঁচকালেন। তিক্ত গলায় বললেন,
—“আম্মা! আপনি কি আসলেই আমার শাশুড়ি? আপনাদের জামানায় না মেয়েমানুষ লজ্জায় মুখ তুলতো না? আপনি এমন হলেন কেনো?”
সাবিনা বেগম হেসে বললেন, তুই আমাকে এখনো শাশুড়ি ভাবিস নাকি? বাব্বাহ্! তুই আর আধুনিক হতে পারলি নারে বৌমা!”
—“আমার আধুনিক হওয়া লাগবেনা। আপনি চুপ করেনতো। আপনার কথার তালে আমার পিয়াজ পুড়ে গেলো। আর ভাল্লাগেনা! আর ভাল্লাগেনা আমার!”
আরশাদ জুতোর ফিতা খুলতে খুলতে সবই শুনছিলো। চাবি দিয়ে দরজা খুলেছে বিধায় ঝগড়ারত দুই রমণী তার আগমন টের পায়নি। জুতোর ফিতা খুলে র্যাকে রাখতে রাখতে দেখলো নিচে ছাপ ফুটে আছে সিগারেটের। কমতো না! বিশটা সিগারেট থাকে এক প্যাকেটে।
আরশাদকে দেখামাত্র সাবিনা বেগম ডাক দিলেন,”এই ছেলে, এদিক আয়। তোর মা যে আমার সাথে দিনরাত লেগে থাকে, সে খবর থাকে? সারাদিন শুধু বান্ডিল বান্ডিল টাকার পিছে ঘোরা। এক পা কবরে রাখা দাদি মরলো না বাঁচলো কোনো খেয়াল নেই। এ দিন দেখার জন্য তোর পায়খানার খাতা নিজহাতে পরিষ্কার করতাম? ওই গ্যাদাকালে আমি সরিষার তেল না মালিশ করলে তোর চামড়া এতো চকচক করতো? মেয়েরা পছন্দ করতো তোকে? একটা বউ পাইতি তুই? বল পাইতি?”
আরশাদ হেসে ফেললো,
—“বউ তো এখনো পাইনি দাদু।”
—“বউ পাবি কেমনে? মেয়ে দেখলেই তো তিনগজ দূর থেকে ‘আল্লাহ হাফেজ’ বলে পগারপার, তোর ছেলে বাচ্চার বাপ হয়ে গেলে তারপর বিয়ে করিস।”
আরশাদ এবারো হাসলো,
—“আমি বিয়ে না করলে আমার ছেলে হবে কোথ্থেকে?”
—“আসমান থেকে…আমার লবঙ্গের কৌটোটা দিয়ে তারপর যা।”
আরশাদ এগিয়ে এলো। কাঁচের টেবিলের উপর থেকে লবঙ্গের কৌটো নিয়ে হাতে নিলো। ঠান্ডাজনিত সমস্যার জন্য তিনি লবঙ্গ মুখে রাখেন। দাদিকে কৌটো দিয়ে আরশাদ একবার চাঁদের দিকে তাকালো। আচ্ছন্নের মতো বললো,
—“চাঁদকে বিয়ে করা যায় দাদু?”
সাবিনা বেগম আৎকে উঠলেন,
—“ধুরো! মাথা গেছে নাকি? চাঁদকে কেনো বিয়ে করবি? চাঁদ কি তোর পাশের ঘরে থাকে যে এই ধরলাম আর বিয়ে করে নিলাম?”
আরশাদ মৃদু হাসলো। ঝাপসা স্বরে বললো,”থাকেতো, আমি মাত্র দেখে এলাম।”
_____________
টিভিতে খেলা চলছে। ক্রিকেট খেলা। ধারাভাষ্যকারের অনবরত বকবকে ড্রইংরুম মেতে আছে। হাতে ধরা ঠান্ডাজল ভর্তি গ্লাসের গা বেয়ে চুইয়ে চুইয়ে পরা পানি দিয়ে হাত ভিজে গেছে। টিভি স্ক্রীনের দিকে চেয়ে ধীরস্থগতিতে গ্লাসটা সামনের টেবিলের উপর রেখে দিলো মাহতাব সাহেব। মুনতাহা ঘুমাতে গিয়েছে। কিন্তু এখনো ঘুমোয়নি। না দেখেই বলতে পারছে মেয়েটা আয়নার সামনে চুল আচরাচ্ছে। মায়ের মতো স্বভাব। রোজ রাতে ঘুমানোর আগে নিয়ম করে চুল আচরানো। দু’পাশে দুটো বিনুনি গাঁথা।
কিছু একটা স্বৃতিচারণ করতে করতে অন্যমনস্ক হলো মধ্যবয়স্ক মন। ভাটা পরলো মেয়ের কন্ঠে। মুনতাহা ডাকছে? চোখ খুললো চকিতে। মুনতাহা খোলা চুলে দাড়িয়ে আছে। তার দিকে কিছু একটা বাড়িয়ে ধরেছে। বারকয়েক চোখ পলক ফেলে দৃষ্টি পরিষ্কার করলেন তিনি। মেরুদন্ড সোজা করে বসলেন। বললেন,
—“কি এটা আম্মা?”
মুনতাহা ফাইলটা হাতে ধরিয়ে দিয়ে সরলকন্ঠে বললো,
—“তুমি কি ভাবছিলে আব্বু? আমি এ নিয়ে পাঁচবার ডেকেছি।”
মাহতাব সাহেব হাসলেন। চাপা হাসি। উওর না দিয়ে কাগজটা উল্টে পাল্টে বললেন,
—“কিসের ফাইল মা?”
—“ওইযে ওই লোকটা দিয়ে গেলো। সকালে এসেছিলো যে।”
মাহতাব সাহেব ভ্রু কুঁচকালেন। ভেতর থেকে কাগজ বের করে দেখলেন ব্যাংকের কাগজই। আরশাদই দিয়ে গেছে তারমানে। কাগজগুলো পুনরায় ঢোকাতে ঢোকাতে খানিকটা গম্ভীর কন্ঠে বললেন তিনি,
—“তুই দরজা খুলেছিলি কেনো? আমি মানা করেছিনা?”
মুনতাহা সাথেসাথেই উওর দিলো,
—“আমি দরজা খুলিনি আব্বু। ছাদ থেকে নামলাম যখন, তখন উনি উঠছিলেন। তখনই দিলেন। আমি নিয়েই দরজা আটকে দিয়েছি।”
মাহতাব সাহেব একপলক তাকালেন। মুনতাহা পাশে বসেছে। মেয়ের মাথায় হাত রেখে বললেন,
—“আমাকে ছাড়া আর কাউকে বিশ্বাস করবিনা আম্মা। কক্ষণো বিশ্বাস করবিনা। এই বিশ্বাস জিনিসটা খুব সেনসিটিভ একটা বিষয়। খুব স্পর্শকাতর। একবার পাকাপক্তভাবে হয়ে গেলেই এর ভাঙন টা তখন আর সহ্য হয়না। সবসময় মনে রাখবি, বিশ্বাসভঙ্গ জিনিসটার মতো বাজে জিনিস পৃথিবীতে আর দুটি নেই। তাই কখনো কাউকে?”
মুনতাহা গলা নামিয়ে উওর দিলো,”বিশ্বাস করবোনা।”
মাহতাব সাহেব হাসলেন। মুনতাহার শান্তশীতল চোখদুটিকে একটুখানি চমকে দিতে ধীরগলায় বললেন,
—“এতরাতে ছাদে যাবিনা আর। বিকেলেই কাপড় নিয়ে আসবি।”
যতখানি আশা করেছিলেন তার থেকে বেশি চমকালো মুনতাহা। মাহতাব সাহেব এবারো হাসলেন। তিনি জানেন, আরশাদ ফেরে রাত করে। তার ডিউটি টাইম কতটুকু তাও তিনি জানেন। ব্যাংক থেকে বাসার দুরত্ব সম্পর্কেও অবগত আছেন। আরশাদ তখন উঠছিলো তারমানে অফিস থেকেই ফিরেছে। আর মুনতাহা তখন ছাদ থেকে নেমেছে মানে সে রাত করে ছাদে গিয়েছে।
মুনতাহা আমতাআমতা করে বললো,”আমি আসলে..”
মাহতাব সাহেব তার অপরাধী চেহারার বিপরীতে নরম কন্ঠে বললেন,
—“আজকের টা মাফ। এখন ঘুমাতে যা আম্মা। শুভরাত্রি।”
মুনতাহা মিষ্টি হেসে “শুভরাত্রি আব্বু” বলে উঠে যেতেই মাহতাব সাহেব সন্ধানী গলায় প্রশ্ন করলেন,
—“চুল খুলে রেখেছিস কেনো? বেণি করলিনা?”
মুনতাহা সাবলীল কন্ঠে উওর দিলো,
—“কালতো ভার্সিটির প্রোগ্রাম আছে। সকাল সকাল যেতে হবে। বেণি করে ঘুমালে চুল ভাঁজ ভাঁজ হয়ে কুঁকড়ে থাকবে। তাই করিনি।”
_____________
শাড়িতে মেয়েদের অন্যরকম দেখায়। তবে এতো বেশি অনুমান করেনি আরশাদ।
এই পঁচিশ টাকা ডজনের লাল রেশমিতেও যে কারো হাত এতটা সুন্দর লাগতে পারে, ভাবেনি একদম। নরম তালুর মাঝবরাবর বৃত্তাকারে আলতা আঁকানো। নখে মেহেদি। ঢেউ খেলানো চুল কানের পিছে গোঁজা। আরশাদের ধারণা, অধিকাংশ মেয়েদের মাঝখানে সিঁথি কাটলে বাজে দেখায়। কিন্তু এই মেয়েটাকে দেখাচ্ছেনা। উল্টো, মনে হচ্ছে এই কপালে নাক বরাবর সিঁথি না কাটলেই বরং বিরাট কেলেঙ্কারি হয়ে যেতো।
মুনতাহা যখন একহাতে শাড়ির কুঁচি ধরে রিকশায় উঠলো আরশাদের ঈগল চোখ তার পায়ে লেপ্টে থাকা অযত্নের নুপুরজোড়াকেও চোখের নির্লজ্জ্ব ভাষায় উত্যক্ত করতে সময় নষ্ট করলো না। সেই চাহনীতে নুপুরগুলো বোধহয় লজ্জা পেলো খুব। মুনতাহা কুঁচি ছেড়ে দিতেই তারা ঝটপট লুকিয়ে নিলো নিজেদেরকে। পহেলা বৈশাখ না আজ? বাংলার নববর্ষ। নতুন বছর।
সদ্য ঘুম ভাঙা আরশাদের চোখ দিনের উজ্জ্বল আলোয় এ বছরের প্রথম লালগোলাপটাকেই দেখে নিলো যেনো।
মাহতাব সাহেব রিকশার হুট তুলে দিলেন।
আরশাদ চোখ সরিয়ে নিলো। নিজেকে বুঝ দিলো,”গোলাপে কাঁটা থাকে।”
চলবে
অমানিশা❤️
লেখিকা_মালিহা খান❤️
পর্ব-৩
সেদিন কেনো যেনো খুব ঝড় নামলো। একটা প্রকান্ড ঘন মেঘ পুরো শহরটাকে ঢেকে ফেললো সন্ধ্যে হতে না হতেই। কালবৈশাখীর আগাম বাতাস শুরু হলো। বস্তির টি-নের চালাগুলো লন্ডভন্ড হলো। আশেপাশে কেমন একটা রণ রণ ভাবমূর্তি ফুটে উঠতেই ঘটলো আরেক বিপত্তি। মহাবিপত্তি!
মাহতাব সাহেব একটা কাজে বেরিয়েছিলেন। ঝড়ের কবলে আটকা পরলেন তিনি। বড়রাস্তায় গাছ উপরে বাজে অবস্থা। চলাচলের জো নেই। তাছাড়া এমন ধুলোঝড় বের হবারও উপায় নেই। তুমুল বজ্রপাত হচ্ছে। জগত মহাজগত থরথর করে কেঁপে উঠছে। রিখটার স্কেল ধরে মাপলে বোধহয় ছয়- সাত ছাড়িয়ে যেতো।
ঘড়িতে তখন সাতটা দশ। মুনতাহাকে আনতে যাবার কথা সাড়ে ছ’টার দিকে। একা একা সে আসতে পারেনা। পারেনা বলতে আজ পর্যন্ত কখনো আসেনি। সবসময় তিনিই পৌছে দিয়ে আসেন আবার যেয়ে নিয়ে আসেন।
ফোন করছে ফোন বন্ধ।
অতিমাত্রার দুশ্চিন্তায় মাহতাব সাহেবের প্রেশার বেড়ে গেলো হুরহুর করে। শেষমেষ কোনরকম উপায়ন্তর না পেয়ে আরশাদকে ফোন লাগালেন তিনি। ব্যাংক বন্ধ আজকে। সরকারি ছুটি। বাসায়ই থাকার কথা।
পকেটে ফোন ভাইব্রেট হতেই ঠোঁট থেকে সিগারেট সরালো আরশাদ। সাদা ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বা’হাত থেকে চায়ের কাপটা নামিয়ে রাখলো কাঠের বেন্চির উপর। রাস্তার মাঝে পথশিশুদের ঝপাঝপ উত্তাম- মাত্তামের দিকে চেয়ে ফোন বের করলো। একঝলক নাম্বারটা দেখে রিসিভ করলো অলস ভঙ্গিতে। আঙ্গুলের অভিজ্ঞ টোকায় সিগারেটের ডগায় জমা ছাই ফেলতে ফেলতে সালাম দিলো।
মাহতাব সাহেব ভূমিকা না করেই বললেন,”তোমার তো আজকে অফিস নেই। তুমি কি বাসায় আছো আরশাদ?”
আরশাদ ভ্রু কুঁচকালো। বললো,”না আংকেল, বিকেলে একটা কাজে বের হয়েছি। এখনো ফিরিনি। কোনো দরকার?”
মাহতাব সাহেব বড়সড় শ্বাস ফেলে বললেন,”একটু দরকার তো ছিলোই” এটুকু বলে একটু থামলেন তিনি। একমূহুর্ত ভেবে বললেন,”আমি এক জায়গায় আটকা পরেছি। কেমন ঝড় দেখছোই তো। সমস্যা হলো আমার মেয়েটা এখনো ভার্সিটিতে। ওকে আনতে যাওয়ার কথা ছিলো। এখন তো বের হওয়াই সম্ভব হচ্ছেনা। ও একা আসতে পারেনা। এখনো অপেক্ষা করছে। বুঝোই তো, রাত হয়ে গেছে। ফোন করছি ফোন বন্ধ। তুমি যদি কাছাকাছি থাকো তাহলে ওকে একটু নিয়ে আসতে পারবে বাবা?”
আরশাদ আধখাওয়া সিগারেটটা ড্রেনে ফেলে দিলো। কালো পানির স্রোতে তরতর করে হারিয়ে গেলো জলন্ত ছোট্ট অগ্নিকুন্ডটা। বাইকের উপর রাখা গাঢ় বেগুনী ছাতাটা ভিজে গেছে। এখনো ভিজছে। ভিজেই যাচ্ছে বিগত আধঘন্টা যাবত।
চায়ের দাম মিটিয়ে দিলো আরশাদ। দোকানের ছাউনি থেকে বেরিয়ে হেলমেট পরতে পরতে বললো,” কোন ভার্সিটি আংকেল?”
____________
ইটের পিলারে কাঁধ ঠেকিয়ে শুষ্ক নয়নে মূলফটকের দিকে চেয়ে রয়েছে মুনতাহা। মাঝেমধ্য দমকা বাতাসে লম্বা আচঁল এলোমেলো উড়ে ফের শান্তশিষ্ট বিড়ালছানার মতন গায়ের সাথে লেপ্টে যাচ্ছে। ঘুম ঘুম পাচ্ছে। পরিবেশটাই কেমন ঝিঁমানো। তার মতে,এমন ঝড়বৃষ্টির দিনে কাঁথামুড়ি দিয়ে বিছানাজুড়ে সংসার পাতার মতো সুখ বোধহয় এ পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই। সাথে ফোনছাড়া কিছুই আনেনি। আর তাও এখন নিজের কার্যশক্তির সমাপ্তি ঘোষনা করে নিশ্চিন্তে হাতের মাঝে ঘুমিয়ে পড়েছে। অর্থ্যাৎ বন্ধ হয়ে গেছে। চার্জ নেই।
মুনতাহা অযথাই পাওয়ার বাটনে দু’তিনবার চাপ দিলো। নিষ্ফল অনর্থক চেষ্টা। বৃষ্টির গতিক আরো বেড়েছে। সারারাতেও থামবে বলে মনে হয়না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে এদিক ওদিক তাকালো সে। এখনো সবাই যায়নি। যদিও ওর ইয়ারের মেয়েরা নেই কিন্তু সিনিয়র ভলেন্টিয়াররা আছে। ওদের যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়নি। ঝড়ে মাঠের প্যান্ডেল ভেঙেচুরে গেছে। সে নিয়েই বোধহয় কোনো সমস্যা হয়েছে। ভেতরের দিকে আলো জ্বলছে
কিন্তু এপাশের বাতি বন্ধ।
মুনতাহা পিলারে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বুজলো। কানের পিছের চুলগুলো নিরুদ্দেশ উড়ছে। গুঁজে দেয়ার মতো শক্তিটাও পাচ্ছেনা হাত। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলোনা। সবেমাত্র একটুআধটু ঘুম ধরতেই কেউ মুখের উপর কৃত্রিম ওলোট ছুড়ে দিলো। ফ্ল্যাশলাইট। মুনতাহা বিরক্তিতে কপাল কুচকে পিটপিট করলো। মুনতাহাকে তাকাতে দেখে আঙ্গুলের ছোয়ায় লাইট নিভিয়ে দিলো আরশাদ। মুনতাহা তখন পুরোপুরি সজাগ না হলেও বিস্ময়ে সজাগ হতে বেশিক্ষণ লাগলোনা। আরশাদ সিঁড়ি ভেঙে উঠতে উঠতে গমগমে ভরাট গলায় মৃদু শাসনের স্বরে বললো,
—“আপনি কোন আক্কেলে এই কোণার মধ্যে দাড়িয়ে আছেন মুনতাহা?”
মুনহাতা অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে নড়েচড়ে সোজা হয়ে দাড়ালো। দেখার চেষ্টা করলো। স্পষ্ট না হলেও, বোঝা যাচ্ছে লোকটা পুরো কাকভেজা। সাদা শার্ট গায়ের সাথে সেঁটে আছে। মনের মতো অদ্ভুত প্রশ্ন জাগলো,”লোকটার কি একটাই শার্ট? যখন দেখে তখনই শুধু সাদা!”
আরশাদ ঝুঁকে হাতের বেগুনী ছাতাটা মুনতাহার পায়ের কাছে পিলারের সাথে ঠেকিয়ে রাখলো। মুনতাহা ত্রস্ত পায়ে একটু সরে গেলো। আরশাদ ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে সোজা হলো। বিনা নোটিশে মুনতাহার শাড়ির আচঁল টেনে হাত মুছতে মুছতে বললো,” ভয় পেয়েন না। আপনার আব্বুর পাঠিয়েছে আমাকে। বাসায় পৌছে দিতে বলেছে। আপনি নাকি একা একা যেতে পারেন না।”
মুনতাহা আরশাদের ভাবলেশহীন আচঁল টেনে হাত মোছা দেখে ওপরপাশের কাপড় খামছে ধরলো। চরম অসম্মতিতেও মিনমিন করে করে বললো,
—“আপনি আমার আচঁল দিয়ে হাত মুছছেন কেনো?”
—“দেখতে পাচ্ছেন না ভিজে গেছি? অন্ধ আপনি?”
মুনতাহা আমতা আমতা করলো। প্রত্যুওর করলোনা। আরশাদ তখনো হাত মুছে যাচ্ছে।
আচমকাই হৃদয়কাঁপানো বজ্রপাত হলো। মুনতাহা হুড়মুড় করে একটু ভেতরের দিকে চলে গেলো। আরশাদ পাশাপাশি থাকায় দুরত্ব ঘুঁচলো খানিকটা। বিদ্যুতের আলোয় জবজবে হওয়া আরশাদকে দেখে কেনো যেনো খুব খারাপ লাগলো। শিথিল হলো সে। খামছে ধরা আচঁল ছেড়ে দিলো। মিনমিন করে বললো,”আপনি ছাতা থাকতে এমনে ভিজেছেন কেনো?
—“বাইকের মধ্যে আমার মাথায় ছাতা ধরবে কে মুনতাহা? ওটা আপনার জন্য এনেছি।”
—“ওহ্।”
আরশাদ আচঁল ছাড়লো। পকেট থেকে ফোন বের করলো। পলিথিনে মোড়ানো সত্ত্বেও আংশিক ভিজে গেছে।
আরশাদ যখন ফোনটাও তার আঁচলেই মুছলো মুনতাহার একমূহুর্তের জন্য মনে হলো সে শাড়ির বদলে ঘর মোছার অতি অশোভনীয় ত্যানাটাই গায়ে জড়িয়ে এসেছে। যার কাজ শুধু এবং শুধুই মাত্র মোছামোছি করা।
ঘড়িতে আটটা পাঁচ। আরশাদ মাহতাব সাহেবের নাম্বারে ডায়াল করে মুনতাহার দিকে এগিয়ে দিলো। বললো,
—“আব্বুর সাথে কথা বলুন, টেনশন করছিলেন। আপনাকে ফোনে পায়নি।”
মুনতাহা ফোনটা হাতে নিয়ে মৃদুস্বরে উওর দিলো,
—“চার্জ শেষ হয়ে গেছে।”
মাহতাব সাহেব কল রিসিভ করলেন প্রথমবার রিং হতেই। মুনতাহা কিছু বলার আগেই রুদ্ধ কন্ঠে বললেন,” আরশাদ পৌঁছেছো? মুন ঠি ক আছে? ওকে পেয়েছো বাবা? ও তিন নাম্বার গেটেই দাড়িয়ে থাকে।”
মুনতাহা একঝলক আরশাদের সাথে দৃষ্টি বিনিময় করে নিমীলিত কন্ঠে বললো,”আমি ঠি ক আছি আব্বু।”
ওপাশের রুদ্ধশ্বাসে চাপা কন্ঠটা সরে গেলো,
—“ও আল্লাহ! আম্মু? আমি সরি মা। বুঝিইনি ঝড় ছেড়ে দিবে। তুই আরশাদের সাথে চলে আয়। ও বাসায় পৌছে দিবে। ভয়ের কিছু নেই।”
মুনতাহা সাথে সাথে প্রশ্ন করলো,
—আমি উনার সাথে কেনো যাবো আব্বু? তুমি না বলেছো কাউকে বিশ্বাস করতে না? উনাকে কেনো করবো?”
মাহতাব সাহেব একটু ভাবলেন। মেয়েকে কি বলবে? শেষমেষ বললেন,”কারণ, আমি বলেছি তাই?”
মুনতাহা মেনে নিলো একবারেই। বললো,”আচ্ছা, ঠি ক আছে।”
আরশাদ আড়চোখে দেখছিলো। বাতাসে ভেজা ভেজা ভাব। মুনতাহার উশৃঙ্খল বেয়াদব চুলগুলোকে ইচ্ছে করছে এক থাপ্পড়ে কানের পিছে গুঁজে দেয়। আঁচলটাকে মনে হচ্ছে টেনে সেফটিপিন দিয়ে কোমড়ের সাথে সিটিয়ে দেয়। কি চরম অসভ্য! উড়েই যাচ্ছে! উড়েই যাচ্ছে!
বাতাসটাকে থামিয়ে দেয়ার ক্ষমতা থাকলে হয়তো তাও করে দিতো।
মুনতাহা কান থেকে ফোন নামালো । আরশাদের দিকে এগিয়ে দিলো ধীরগতিতে। আরশাদ চোখের পলক ফেললো। মুগ্ধতাটা লুকিয়ে ফেললো যত্ন করে। ফোনটা হাতে নিয়ে না তাকিয়েই বললো,
—“বৃষ্টি একটু কমুক, তারপর যাই।”
মুনতাহা মাথা নাড়ালো শুধু। পরের সময়গুলো খুব অসস্তিময়, জটপাকানো এক একটা সেকেন্ড, এক একটা মূহুর্ত যেনো এক একটা মহাকাল।
বৃষ্টি কমলোনা। বরং বাড়লো আরো। শেষমেষ বৃষ্টি নিয়েই বেরিয়ে পড়লো আরশাদ। মুনতাহার উপর ছাতা ধরে ভার্সিটির গেট পেরিয়ে বাইরে এসে দাড়ালো। রিকশা নেই। বাইকে যাওয়া সম্ভব না।
মুনতাহা একহাতে বাহুর শার্ট টেনে ধরেছে।
অবিরাম হর্ণের আওয়াজে সে অন্যমনস্ক হয়ে পড়লো যখন আরশাদ ঠি ক সে সময়েই ডাকলো,
—“মুনতাহা?”
উওর এলো,”হু?”
আরশাদ কন্ঠ খাদে নামিয়ে ধীরগতিতে বললো,
—“আপনি জানেন? বছরে বিশেষ কিছু দিনে আকাশে ‘ব্লাড মুন’ দেখা যায়। বাংলায় বলতে পারেন,’লাল চাঁদ’। রুপালি চাঁদের রংটা সেদিন রক্তিম থাকে।…প্রশংসা কিনা জানিনা তবে আপনাকে এখন, এই মূহুর্তে ঠি ক ব্লাড মুনের মতন লাগছে। লাল চাঁদ।…একটা চাঁদ আমার পাশে দাড়িয়ে আছে। বিশ্বাস হয়?”
চলবে