অমানিশা❤️,পর্ব-৬,৭

0
1088

অমানিশা❤️,পর্ব-৬,৭
লেখিকা_মালিহা খান❤️
পর্ব-৬

আতর্নাদে দাপরাতে দাপরাতে একটাসময় থেমে গেলো মুনতাহা। দু’পা ভর্তি দহনযন্ত্রনা সহ্য করতে না পেরে জ্ঞান হারালো নিরুপদ্রব বাহুডোরে। একহাত তখনো বুকের শার্ট খামছিয়ে ধরে আছে। শরীর নিস্তেজ হলেও হাতটা নিস্তেজ হয়নি। আরশাদ ছাড়ানোর চেষ্টাও করলোনা। জ্ঞান হারিয়ে অবশ্য ভালোই হয়েছে। খুব ছটফট করছিলো। পা দুটো বারবার সরিয়ে নিতে চাচ্ছিলো। পানির নিচে দিয়ে শক্ত করে ধরে রেখেছে বিধায় হাজার চেয়েও সরাতে পারেনি। বোঝা যাচ্ছে ব্যাথা- যন্ত্রনায় সাথে খুব একটা সাক্ষাত ঘটেনি মেয়েটার। পা ভয়াবহ পুড়েনি। দ্রুত পিছিয়ে গিয়েছিলো বোধহয়। তবে যতটুকু পুড়েছে তাও অনেক।
মাহতাব সাহেব একটু ঠান্ডা পানি আনতে গিয়েছিলেন। গরমকাল হওয়ায় ট্যাংকির পানিও তেমন ঠান্ডা হয়না। সচরাচর গরম গরমই থাকে।
ঠান্ডা পানির বোতল হাতে ওয়াশরুমে ঢুকে মেয়েকে এমন নিষ্প্রান হয়ে পড়ে থাকতে দেখে দু’একটা হৃদস্পন্দন যেনো সেখানেই খোয়া গেলো তার। তাড়াহুড়ো করে গালে হাল্কা চাপড় মেরে ডাক দিতেই আরশাদ আস্তে করে বলল,”কিছু হয়নি আংকেল, জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। থাকুক এভাবেই। সহ্য করতে পারছিলনা।”
মাহতাব সাহেব প্রত্যুওর করতে পারলেননা। আরশাদ স্পষ্ট দেখলো তার চোখের কোঁণে চিকচিক করা নোনা পদার্থের আহাজারি।
বিশ- পঁচিশমিনিট পেরিয়ে গেলে পানির কলটা বন্ধ করলো আরশাদ। মেয়েটাকে দেখে মনে হচ্ছে ঘুমিয়ে গেছে অথচ কি অসহনীয় ব্যাথায়-ই না জ্ঞান হারিয়েছে সে। জামাকাপড় পানিতে ভিজে গেছে। আরশাদ কোলে তুলে নিলো আবার। মাহতাব সাহেব ঘরের লাইট ফ্যান চালিয়ে দিলেন। আরশাদ ভেজা অবস্থায়ই বিছানায় শুইয়ে দিলো মুনতাহাকে। সোজা হয়ে দাড়াবে তার আগেই টান পড়লো শার্টে। মুনতাহা ছাড়েনি। আরশাদ খুব টেনেটুনে ছাড়ালো। মাথাটা বালিশে সোজা করে দিয়ে বলল,
—“আম্মা কে আসতে বলি আংকেল। কাপড়গুলো বদলে দিয়ে যাক। জ্বর আসতে পারে আবার। ব্যাথায় তো এমনেই কাবু হয়ে গেছে।”

মাহতাব সাহেব সম্মতিসূচক মাথা নাড়ালেন। মাথা কাজ করছেনা একদম। আরশাদের মা আসলো একটু পর। আরশাদ পায়ে বার্নল লাগিয়ে গজ দিয়ে ঢেকে বালিশের উপর তুলে রেখেছে। পরিচিত এক বন্ধুকে ফোন করেছিলো। ডাক্তার সে। পায়ের ছবি পাঠিয়েছিলেন, দেখে জানিয়েছে হাসপাতালে নেয়া লাগবেনা। ঠান্ডা পানির সেক দিতে বলেছে আর জ্বালাপোড়ার ওষুধ।
মাহতাব সাহেব মাথার কাছে বসে আছেন। আরশাদের মা আসলে তিনি উঠে দাড়ালেন। নিষ্প্রভ কন্ঠে বললেন,”আলমারিতে ওর জামাকাপড় আছে আপা। এইযে চাবিটা।”

প্যারাসিটামল আর ঘুমের ওষুধটা আধোজাগ্রত মুনতাহাকে খাইয়ে দিয়ে তবেই স্বস্তির শ্বাস ফেললো আরশাদ। মাহতাব সাহেব কেমন একধ্যানে মেয়ের হাত ধরে রেখেছেন। আরশাদের মা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
—“আপনি এমন করলেতো ও আরো ভয় পেয়ে যাবে ভাই। বাচ্চা মানুষ। পুড়ে গেছে এভাবে
, একটু কষ্ট তো হবেই।”

—“আপা, আমার মেয়েটা অনেক আদুরে আপা। নখ কাটতে গেলে একটু বেশি কেটে ফেললেও চেঁচিয়ে বাড়ি এক করে ফেলে। আর ওর পা দুটো নাকি এমন পুড়ে গেলো?”

আরশাদের মা একটু চুপ থেকে বললেন,
—“আমি সাথে থাকি ভাই। রাতে ঘুম ভাঙলে তো উঠতে পারবেনা। কেউ একজনের থাকা দরকার।”

—“না সমস্যা নেই আপা। আমিই এসে এসে দেখে যাবোনে। আপনি অনেক করেছেন। ক’দিন হলো এসেছেন অথচ কতো ঝামেলায় ফেলে দিলাম।”

আরশাদের মা শুনলেননা। শেষমেষ মাহতাব সাহেব সম্মতি দিয়ে বললেন,”আচ্ছা ঠি কাছে। আপনি থেকেন সাথে।”

মুনতাহা ঘুমিয়ে পড়েছে। আরশাদের মা তার পাশে। আরশাদ বসে ছিলো সোফায়। মাহতাব সাহেব উঠে দাড়ালেন। টানটান কন্ঠে বললেন,

—“আরশাদ, একটু আমার ঘরে এসো।”

আরশাদ একধ্যান চেয়ে ছিলো পায়ের দিকে। ডাকে ঘোর কাটলো। স্বাভাবিকভাবেই উওর দিলো সে,”আসছি আংকেল।”

_

ঘরে ফ্যান চলছে মৃদু শনশনে শব্দ সহকারে। মাহতাব সাহেব বসে আছেন বিছানায়। চোখের দৃষ্টি স্হির। কি যেনো একটা ভেবে যাচ্ছে একাধারে। আঙুলের টোকার শব্দে ঘোর কাটলো। আরশাদকে দাড়িয়ে আছে। তিনি চাপা হাসলেন। আরশাদ বুঝলোনা সেই হাসির মানে। খানিকটা দ্বিধাগ্রস্ত হলো। মাথায় উঁকি দিলো কিছু জটিল প্রশ্ন।
মাহতাব সাহেব তার সুপ্ত দ্বিধার তাল কাটিয়ে বলল,

—“আসো আরশাদ, বসো।”

আরশাদ ভেতরে ঢুকলো। ধীরগতিতে যেয়ে বসলো সোফায়। বলল,

—“কিছু বলবেন আংকেল?”

মাহতাব সাহেব সরাসরি চাইলেন চোখের দিকে। আরশাদ কিন্চিৎ বিব্রত বোধ করলো। বোঝার চেষ্টা করলো তিনি এভাবে চেয়ে আছেন কেনো? মাহতাব সাহেব আবার একটু হাসলেন। চোখের মনির অবস্থান পরিবর্তন হলো। তিনি দৃষ্টি দিয়েই ইশারা করলেন,
—“গলায় তো কেটে গেছে অনেকখানি।”

আরশাদ পুনরায় একবার হাত বুলালো গলার এবড়োথেবড়ো খামছিতে। হাত দিলে জ্বলছে এখনো। নিচু গলায় বলল,
—“সমস্যা নেই।”

কয়েকমূহুর্ত নিরবতা। মাহতাব সাহেব চোখ থেকে চোখ সরালেন। ভনিতা ছাড়াই সূঁচালো তীরের মতো প্রশ্ন ছুঁড়লেন,

—“তুমি মুনকে পছন্দ করো?”

আরশাদ খানিকটা চমকালো। ভেতরে ভেতরে অনেকটা চমকালেও বাইরে তা প্রকাশ পেলোনা। এক সেকেন্ডও ভাবলোনা সে। ভদ্রভাবেই উওর দিলো,
—“জি। করি।”

মাহতাব সাহেব এবার বিস্তর হাসলেন। গলা পরিষ্কার করে বললেন,
—“দেখো আরশাদ, মুনের জন্য এপর্যন্ত কম প্রস্তাব আসেনি। মেয়েকে আমি দিনদুনিয়ার থেকে দূরে রাখতে চাইলেও পারিপার্শ্বির কারণবশত তা সম্ভব হয়নি। কলেজ, ভার্সিটি এমনকি ও যখন স্কুলে পড়তো তখনো এসব বিষয় নিয়ে খুব ঝামেলায় পড়তে হতো আমাকে। সেজন্য খুব বেশি প্রয়োজন না হলে ওকে আমি বাইরে যেতে দেইনা। সেসব পড়ে বলছি, তার আগে একটা কথা বলি।
মুনের জন্য প্রস্তাব নিয়ে আসা সব ছেলেদের সাথেই আমি যখন কথা বলতাম তখন তারা আমার চোখের দিকে তাকানো মাত্রই মাথা ঝুকিয়ে ফেলতো। তুমি হয়তো বলতে পারো তারা আদব- কায়দা বা ভদ্রতার জন্য তাকাতো না। কিন্তু না! তারা তাকাতোনা ভয়ে। আমি বুঝিনা, একটা মেয়ের দায়িত্ব চাওয়ায় জন্য এসে সে কিভাবে ভয় পায়? আবার অনেককে আমি যদি সরাসরি জিজ্ঞাসা করতাম,” মুনকে পছন্দ করে কিনা। অনেকে ভয়ে বলতো,”না,.. জি…মানে…আসলে…।”তাদের উওরটা সবসময় এসবেই আটকে থাকতো।
কিন্তু এই প্রথম, তুমিই প্রথম, যে কিনা চোখ নামাওনি। উল্টো কাটকাট উওর দিয়েছো,”জি, করি।”

চলবে

#অমানিশা❤️
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
#পর্ব-৭

মাহতাব সাহেব আচম্বিতে উঠে দাড়ালেন, ‘বসো, আসছি’ বলে বেরিয়ে গেলেন অরবে। আরশাদ প্রতিক্রিয়াহীন। ঘটনাগুলো যেনো খুব স্বাভাবিক। অহর্নিশ ঘটে যাওয়া কোন ধারা। একঝাঁক প্রশ্নের বিচরণ মস্তিষ্কজুড়ে কিন্তু মুখে সব চুপ। কেন যেনো মনে হচ্ছে, তার না করা প্রশ্নের উওরও উনি দিবেন। নিজ থেকে না জানতে চাইলেও উনি বলবেন। তবে আপাতত এসব নিয়ে মাথা ঘামছেনা!
বরং আম্মা মেয়েটাকে নিয়ে ঠি ক ঠাক ঘুমিয়েছে কিনা সেটাই একবার দেখে আসতে ইচ্ছে করছে পাশের ঘর থেকে।
মাহতাব সাহেব ফিরে এলেন মিনিটদুয়েক পর। হাতে দুটো কাপ। সাদা কাঁচের চায়ের কাপ। আরশাদের দিকে বাড়িয়ে দিলেন একটা। বললেন,” রান্নাঘরে রাখা ছিলো। কষ্ট করে বানিয়েছে মেয়েটা, যদিও এখন ঠান্ডা। তবু, খেতে তো সমস্যা নেই।”

আরশাদ মৃদু হেসে সম্মতি জানালো। দু’আঙ্গুলে হাতে তুলে নিয়ে হাল্কা বাদামী রংয়ের চায়ের দিকে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ। অত:পর চুমুক লাগালো ছোট্ট করে। খেতে ভালো। পরিপক্ক হাতের চা। রোজসকালে পাওয়া গেলে মন্দ হবে না।
মাহতাব সাহেব ডাকলেন,
—“আরশাদ?”

আরশাদ মুখের চা টুকু গিলে নিয়ে সোজা হয়ে বসলো। উওর দিলো,
—“জি, বলুন।”

মাহতাব সাহেব সুদীর্ঘ শ্বাস টেনে নিলেন এবার। আরশাদ বুঝলো লম্বা কিছু বলার প্রস্তুতি। তিনি সত্যি সত্যিই বলতে শুরু করলেন,

—“মুন যখন মাত্র পাঁচমাসের তখন হঠাৎ এক ভোরে সিদ্রা মারা যায়। ‘সিদ্রা’ আমার স্ত্রী, মুনের মা।
মৃত্যুর কারণটা ছিলো সাধারণ, কিন্তু খুব করুণ। করুণ কেনো শুনবে? কারণ, ও যখন মারা যায় তখন আমার দ্বিতীয় সন্তান সবে তার গর্ভে বেড়ে উঠছিলো। বয়স মাত্র কয়েক সপ্তাহ।
সেদিন শুক্রবার। মাত্র ভোর হয়েছে। মুনকে সবসময় বুকে নিয়ে একপাশে চেপে শুতাম আমি। সিদ্রা হাত মেলে ঘুমাতো বিধায় ওর জায়গা লাগতো বেশি।
সেদিনও ব্যাতিক্রম নয়। আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। আমার বুকে মুনও ঘুম। ঘর অন্ধকার। হঠাৎই একটা আওয়াজ। কিছু পড়ে যাওয়ার। আমি চমকে উঠলাম ঘুমের মাঝেই। শরীর কেঁপে গেলো অসম্ভব। মুন জেগে গেলো। কাঁচা ঘুম ভাঙায় গলা ফাটিয়ে কান্না শুরু করে দিলো তৎক্ষনাৎ। আমি দিশেহারার মতো উঠে বসলাম। ওয়াশরুমের দরজা খোলা। আলো জ্বালানো। তাজা রক্তস্রোতের ধারা আর একমাত্র সহধর্মিনীর নি:সাড় দেহ দেখে আমার পুরো পৃথিবীটাই যেনো ঘুরে গেলো চোখের পলকে। মুন তখনো গলা ফাটিয়ে কাঁদছে। মোমের মতো সাদা চেহারা রক্তের মতো লাল হয়ে গেছে। মেয়েটাও হয়তো বুঝেছিলো ওর মা আর নেই। আমি সহ্য করতে পারছিলামনা। মুনের ওমন কান্না, সিদ্রার মৃতদেহ, আগত সন্তানের মৃত্যু। সব একসাথে জট পাকিয়ে সৃষ্টিকর্তার কাছে মনে মনে নিজের মৃত্যুটাই কামনা করছিলাম আমি। আমিও মরে যাই। কিন্তু না! আমার চাওয়া পুরণ হলোনা।
মুনকে ভয়াবহ কান্নারত অবস্থায় বিছানায় শুইয়েই বাথরুমে গেলাম আমি। সিদ্রার চোখদুটো খোলা ছিলো। চিৎকার করার সময়টাও পায়নি মেয়েটা। ভোরের দিকে বাথরুম শুকনো থাকার কথা। ছিলোও। শুকনোর মধ্য সিদ্রা কিভাবে পড়ে গেলো আমার জানা নেই। মাথাটা নিচ দিয়ে রক্তের ধারা। লাল রক্ত। আমি হাত দিয়ে চোখদুটো বুজিয়ে দিলাম। পুরুষচোখের দু’ফোঁটা জল ওর ঠান্ডা গালের উপর পড়লো টুপ করে।”

মাহতাব সাহেব থামলেন। তার চোখে এখনও জল। আরশাদ শব্দ করলোনা। তিনি অতি সন্তর্পণে চোখ মুছলেন। ফের বলতে শুরু করলেন,”তারপর মুন…আমার অন্তসারশূন্য জীবনে রয়ে গেলো শুধুই মুন। আমার বড়মেয়ে। বড়মেয়েই বলি। আমার তো আরেকটা সন্তান ছিলো। হ্যাঁ, পৃথিবীতে আসেনি কিন্তু আসতো তো। আমি তখন দুধের ফিডারটাও ঠি ক ঠাক ধরতে পারতাম না ওর মুখে। ঠোঁটের আশপাশ মেখে যেতো। কোলে শোয়াতে পারতাম না। একদম ছোট্ট বাচ্চা। কিভাবে গোসল করাবো বুঝতাম না, পারতাম না। মাঝেমধ্য চোখেমুখে সাবান চলে যেতো। কান্না করতো খুব। আমি অসহায় হয়ে চেয়ে রইতাম। সিদ্রা পরিবারের অমতে বিয়ে করেছিলো। আর আমার পরিবার বলতে কেউই নেই। মা- বাবাহীন এতিম।
ব্যবসায় ছিলাম নতুন। মুনকে আশেপাশের কারো কাছে রেখে যেতেও ভয় পেতাম। যদি কিছু হয়ে যায়? এভাবেই এক পশলা খুশি আর এক সমুদ্র হাঁসফাঁস নিয়ে পার হলো পাঁচ বছর।
মুনের পাঁচবছর। হাঁটতে পারে। মুখ মাখিয়ে হলেও নিজের হাতে খেতে পারে। ব্যবসায় তখন একটু উন্নতি।
সময় না দিয়ে থাকা যাচ্ছিলোনা। আমি বেরোতাম মুন ঘুমালে। আবার ওঠার আগেই চলে আসতাম।
একদিন মুনকে রেখে গেলাম নিচের তলার এক খালার কাছে। বৃদ্ধ মহিলা। তখন অন্যবাসায় ভাড়া থাকতাম।
রাতে যখন ফিরলাম, আমার হাসিখুশি চন্চল মেয়ে কেমন চুপ হয়ে রইলো। সারারাত বুকের সাথে কুঁকড়ে রইলো। ভোরের দিকে দেখলাম ও ঘুমায়নি। বুকের মুখ গুঁজে চোখ মেলে রেখেছে।
আমি বুঝলামনা। আমার ব্যর্থতা। চরম ব্যর্থতা। পরেরদিন আবার রেখে গেলাম খালার কাছে। উনার ওখানেই সারাদিন। কাজ থেকে ফিরলাম রাত দশটায়। মুনকে নিয়ে আসলাম। মেয়েটা রাতে খেলোনা। ভাত মাখিয়ে মুখের সামনে ধরলাম তবু খেলোনা। জোর করিনি কখনো। তখনও করলামনা।
মুন সেদিনও রাতে জাগা। বোঝার পর বাকি রাত আমিও ঘুমালামনা। ঘুম আসলোনা। বিষন্ন মনে ভাবলাম, একা একা রেখে যাই তাই হয়তো রাগ করে। কি করবো? কাজ তো করতে হবে।
গাধার মতো তৃতীয়দিনও ওখানে রেখে গেলাম। তারপর দিন শুক্রবার। কাজে যাইনি। মুনের সাথেই থাকলাম। বিকেলে দোকান থেকে চকলেট, আইসক্রিম কিনে সিঁড়ি দিয়ে উঠছি তখন সেই খালার ছেলের সাথে দেখা। আমাকে বলছে,”আপনার মেয়েকে আজ রেখে গেলেননা ভাই?”
আমার একটু কেমন যেনো লাগলো সেই চোখের ভাষা। বললাম, ‘শুক্রবার বাসায়ই আছি। সেজন্যই আরকি।”
উপরে চলে এলাম। মুন আইসক্রিম, চকলেট নিয়ে বসে পড়লো। আমি বললাম খাইয়ে দেই। জেদ করলো, নিজে খাবে। জামাকাপড় মাখিয়ে ফেললো একটু পরেই। ভাগ্য ভালো জেদ করেছিলো। ও নিজের জামা নিজেই বদলায়। গোসলও একাই করতে পারতো তখন। সেদিন চকলেট মেখে যাওয়ায় আমিই হাত মুখ ধুইয়ে দিলাম, ফ্রক বদলে দেয়ার সময় দেখলাম পিঠে খামছির দাগ। গলার নিচে কামড়ের দাগ। নরম শরীরে দাগ বসে কালসিটে পড়ে গেছে। বুঝে গেলাম বাদবাকিটা। জীবনে দ্বিতীয়বারের মতো নিজেকে চরম অসহায় মনে হলো। চরম অধম মনে হলো। আমি কেনো আগে বুঝলাম না?
তারপর সেই বাসা ছেড়ে দেই। টাকাপয়সা জমানো ছিলো। পাঁচপছরে জমানো টাকা বেশ মোটা অংকে দাড়িয়েছিলো। এই বাড়িটা কিনলাম। আগে থেকেই উঠানো ছিলো। কম্প্লিট বাড়ি। এরপর এইযে পনেরো বছরের বেশি। এ বাসায়ই আছি। মেয়েটা আমার বড় হয়ে গেছে। আমার এতকষ্টে বড় করা মেয়ে। আমার সব কষ্টের সমাপ্তির কারণ।
কিন্তু কি জানো?
ছোটবেলার সেই ঘটনার পর থেকে মুন পুরুষমানুষ খুব ভয় পায়। এইযে কলেজ, ভার্সিটি। এখানে গেলেও ওর একটাই ভয়। পুরুষ মানুষের ভয়। কিন্তু,…. ও তোমাকে ভয় পায়না। কেনো পায়না আমি জানিনা। বা হয়তো জানি।
তুমি যখন প্রথমদিন চাবি নিয়ে গেলে আমি ভেবেছিলাম মুন হয়তো আমি বাড়ি ফেরার পর কিছু হলেও বলবে এই ব্যাপারে। ও বললোনা। সন্ধ্যার দিকে দেখলো পর্যন্ত তুমি পাশের ফ্ল্যাটে উঠেছো। ও তারপরও কিছু বললোনা। তোমরা যেই ফ্ল্যাটে থাকছো সেই ফ্ল্যাটটা মুন ভাড়া দিতে দিতোনা। ওর নাকি ভয় লাগে। একা থাকতে পছন্দ করে মেয়েটা। তাই এ তলায় অন্যকেউ থাকুক, ও চাইতোনা। তাও তোমাকে দিয়েছিলাম তোমার খুব প্রয়োজন ছিলো বলেই।
আবার পরদিন সন্ধ্যায়। মুন বললো, তুমি কাগজ দিয়ে গিয়েছো। বিশ্বাস করবেনা, আমি প্রচন্ড অবাক হয়েছিলাম ওর চেহারায় বিন্দুমাত্র ভয়ের ছাপ দেখতে না পেয়ে। অন্যকেউ হলে আমি নিশ্চিত ও কান্নাকাটি করতো। বলতো, আব্বু তুমি আর কখনো আসতে মানা করে দিবে। বা, তুমি এদের কে ফ্ল্যাট ছেড়ে দিতে বলবে। কিন্তু বললোনা।
ওর ভয় না পাওয়া দেখে সেদিন ঝড়ের দিন তোমাকেই আনতে পাঠাই আমি। ভেবেছিলাম, সেদিন হয়তো মেয়েটা বলবে,”না আব্বু, আমি যাবোনা উনার সাথে।” কিন্তু না, ও একবারেই মেনে নিলো আমার কথা। অথচ ওর মানার কথা ছিলোনা। ওর ভয় পাওয়ার কথা ছিলো। আপত্তি করার কথা ছিলো।
উল্টো এসে দেখলাম তোমার বাসায় ঘুমিয়ে আছে। কোনো সংকোচ, ভীতি নেই মুখে। অথচ আমাকে ছাড়া এই খালি বাসায়ও রাতে থাকতে ভয় পায় ও। অথচ ওখানে আস্ত তুমি ছিলে। অপরিচিত পুরুষ।
পরদিন সকালে অবশ্য একটু ভয় পেয়েছিলো কিন্তু সেটা হঠাৎ ঘুম ভেঙে নিজেকে একা একা দেখার কারণে। খানিকবাদেই ও ছিলো একদম স্বাভাবিক।
ও তোমাকে ভয় পায়না। একদম ভয় পায়না। বরং খুব ভরসা করে। কেনো বলোতো?

আরশাদ সম্মোহিত হয়ে শুনছিলো। হঠাৎ প্রশ্নে ঘোর কাটে তার। অবিন্যস্ত কন্ঠে উওর দেয়,”আমি… আমি জানিনা আংকেল।”

—“মুন আমার সবকিছু আরশাদ। আমার সব। ও তোমাকে ভরসা করে, তুমি ওকে পছন্দ করো। ঠি কাছে। কিন্তু তারপরও কোনরকম সম্পর্ক ছাড়া তুমি কিন্তু আমার মেয়ের দিকে সামান্য চোখ তুলে তাকানোর অধিকারটাও রাখোনা।”

আরশাদ বিচলিত হয়না। বরং শান্তভাবেই বলে,
—“আমি অধিকার নিয়েই তাকাবো আংকেল। আপনি চিন্তা করবেননা।”

মাহতাব সাহেব দূর্বোধ্য হাসলেন। আরশাদের মার উচ্চকন্ঠ শোনা গেলো,”আরশাদ? একটু দেখে যা তো। বা’পায়ের ব্যান্ডেজটা খুলে গেছে বোধহয়।”

আরশাদ উঠে দাড়ালো। বলল,”একটু দেখে আসি আংকেল।”
মাহতাব সাহেব ইশারায় অনুমতি দিলেন।
আরশাদ বেরিয়ে গেলো। দরজা খুলতেই সরাসরি চোখ পড়লো মেয়েটার দিকে।
বিছানায় ঘুমিয়ে আছে মুনতাহা। এক অসহায় বাবার রক্ত পানি করা সবচেয়ে দামি সম্পদ, তার বড়মেয়ে। এক দায়িত্ববান পুরুষের প্রথম ভালোবাসা, তার চাঁদ।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here