অমানিশা❤️,পর্ব-১৫,১৬
লেখিকা_মালিহা খান❤️
পর্ব-১৫
[বর্ধিতাংশ]
রান্নাঘরের ভ্যাপসা গরমে ছাইরঙা শাড়ি পরিহিত ঘর্মাক্ত রমণীকে দেখে কিছুক্ষণের জন্য যেনো বষীভূত হয়ে গেলো আরশাদ। পুরুষচোখের লাজহীন মনি যেয়ে সরাসরি আটকালো লালরঙা ভিজে ওঠা ব্লাউজে, কোমড়ের পিছের অনাবৃত অংশে, কাঁধে আচঁল উঠানো উন্মুক্ত উদরে, পিঠভর্তি ঘামের নহরে।
আরশাদ চোখ নামালো। তার বউটা সুন্দর মাশআল্লাহ।
এমন না মুনতাহা শাড়ি পরেনা। সে প্রায় প্রায়ই শাড়ি পরে থাকে। বিছনাজুড়ে আচঁল বিছিয়ে ঘুমিয়ে থাকে। কখনো কখনো ঘুমের ঘোরে আচঁল খসে পরলেও আরশাদ তুলে দেয়না। ঘুম ভাঙলে নিয়ম করে লজ্জা পায় মেয়েটা। আরশাদ তখন অনিচ্ছায় হলেও কাজে ডুবে থাকে। সেই লজ্জা পাওয়াটা তার দেখা হয়না। কিন্তু সে জানে মেয়েটা লজ্জা পায়। খুব লজ্জা পায়। এতো লজ্জা, লজ্জাবতী গাছও পায়না।
মনে মনে শাড়ি পোশাকটাকে সবচাইতে অশালীন পোশাকের তকমা লাগিয়ে এগুলো আরশাদ। গলা বাড়িয়ে ডাকে,
—“মুনতাহা? একা একা কি করছেন? আম্মা কোথায়?”
মুনতাহা তড়িঘড়ি করে আচঁল নামায় কাঁধ থেকে। উল্টোদিকে ফিরে ছিলো বলে বুঝতেই পারেনি পেছনে কেও আছে। আরশাদ সুক্ষ্ন চোখের দেখে তার ঠোঁটকাঁপানো লজ্জা। মুনতাহা আমতাআমতা করে বলে,”একা একা না, মা ছিলো সাথেই। এইযে, একটু আগে ঘরে গেছে।”
—“কি করছেন?”
মুনতাহা বঁটির দিকে তাকায় একবার। মুখ তুলে উওর দেয়,”শসা কাটছিলাম।”
—“কাটা হলে ঘরে আসেন।” সংক্ষিপ্ত কথাটা বলে একমূহুর্ত দাড়ায় না আরশাদ। ঘরে ঢোকার আগে একবার ড্রইংরুমের সোফায় চোখ যায়। সাবিনা বেগম বসে আছেন। মুখ থমথমে। আরশাদের দিকেই নিবন্ধ চোখজোড়া। আরশাদ খেয়াল করেনি। দাদু এখানেই ছিলো এতক্ষণ।
—“কি হয়েছে দাদু? কিছু বলবে?”
সাবিনা বেগম হতাশ কন্ঠে বললেন,”এতটুকুন বউটারে কে আপনে কইরা কয়?”
আরশাদ হাসে। কয়েককদম এগিয়ে কাছাকাছি যেয়ে কন্ঠ নামিয়ে বলে,”চাঁদ বলে কথা দাদু, সম্মান তো করতেই হবে।”
–
বিছানায় হেলান দিয়ে হাঁটু ভেঙে বসা মুনতাহা। কোলে বই। খুব সম্ভবত কোনো ইংলিশ নোভেল পড়ছে। হাঁটুতে ঠেস দিয়ে পেটের উপর দাড় করানো বইটা, বিধায় নামটা দেখা যাচ্ছে না।
চুলগুলো এখনো খোলা। বাঁধার উদ্দেশ্য নেই বোধহয়। ঘড়িতে খুব রাত। চোখে ঘুম নেই মুনতাহার। আরশাদ বারান্দা থেকে এলো। দরজা বন্ধ ছিলো। সিগারেটের ধোঁয়ায় কাঁশতে থাকে মুনতাহা।
ঘরে টেবিল ল্যাম্প জ্বালানো। হলদে আলোয় ছাইরঙা চাঁদ। প্রিয় মানুষকে নাকি সবাই নীলে দেখতে পছন্দ করে। কিন্তু তার চাঁদটাকে তো ছাইরঙেই মানিয়েছে। আকাশের চাঁদটার রং রুপালি বলেই হয়তো।
ওয়াশরুমে যেয়ে মুখ ধুয়ে এলো আরশাদ। বেরিয়ে দেখলো মুনতাহা তখনও বইয়ের কালো অক্ষরে চোখ বুলাচ্ছে। তার দিকে তাকানোর সময় কই?
আরশাদ গা থেকে শার্টটা ছাড়িয়ে বালিশের পাশে রাখলো। মুনতাহা আড়চোখে তাকালো একবার। আরশাদ সটান হয়ে শুয়ে পড়লো পাশে। মিনিটের ব্যাবধানে উঠে ল্যাম্পের সুইচ চাপতে চাপতে বললো,
—“বই রাখুন, সকালে পড়েন। বাতি নিভিয়ে দিলাম।”
বাতি নিভে গেলো। মুনতাহা অন্ধকারে থম ধরে বসে রইলো কিছুক্ষণ। আরশাদ কপালে হাত ঠেকিয়ে চোখ বুজেছে। মুনতাহা বইটা বন্ধ করে পাশে ঝুঁকে পাশের টেবিলের ড্রয়ার খুললো। ড্রয়ের আটকে ঘুরবে তার আগেই বুঝলো একটা দীর্ঘদেহী উষ্ণতায় আবৃত হয়েছে সে।
কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার ঠোঁটের উপর হাত রেখে হাতের পিঠেই চুমু খেলো আরশাদ। মুনতাহা আচঁল খামছে ধরলো। শরীরের পশম শিরশিরিয়ে উঠলো সেই অস্পর্শ চুমুতেই।
–
গভীর রাত। আরশাদ বুকে ভর দিয়ে ঘুমাচ্ছে। শ্রান্ত- অবশান্ত দেহ। আচমকাই ঘুম ভাঙলো। চকিতে চোখ মেললো সে। মুখে হতভম্বতা, ভয়, আশঙ্কা। ঘাড় গলা ভিজে উঠেছে।
নাহ্, এইতো…মুনতাহা তো ঘুমাচ্ছে পাশেই। আরশাদ এলোমেলো চেয়ে রইলো, উঠে বসলো। টেবিল থেকে গ্লাসভর্তি পানি নিয়ে ঢকঢক করে গিলে নিলো পুরোটা। মুনতাহা গভীর ঘুম।
আরশাদ বুকের চাদরটা ঠিক করে দিলো, বারদুয়েক মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। মেয়েটা ক্লান্ত। শুয়ে পড়লো আরশাদ।
ঘরটা খুব অন্ধকার। আলো নেই। কিচ্ছু নেই। নৈশব্দ্যর মতো নিশ্বাস বাড়ি খাচ্ছে ইটের দেয়ালে। মুনতাহা ডাকলো,”আব্বু?” সাড়া এলোনা। মুনতাহা আবার ডাকলো,”আব্বু কই তুমি?” এবারো সাড়া নেই। মুনতাহা ভয় পেলো। আঁধার হাতরিয়ে হাতরিয়ে চিৎকার করে উঠল,”আব্বু?”
—“আলো জ্বালান। আলো জ্বালান।” রুদ্ধ কন্ঠ।
মুনতাহা ধরফরিয়ে উঠে বসেছে। আরশাদ মাত্র দু’চোখ এক করেছিলো। মুনতাহার চিৎকারে ঘুম ভেঙে গেলো আবার। মুনতাহা উদ্ভ্রান্তের মতো বাহু ঝাঁকিয়ে বলল,”আলো নেই কেনো? আলো জ্বালাননা।”
আরশাদ উঠে বসলো, ল্যাম্প জ্বালিয়ে দিলো। হলদে আলোয় ভরে উঠলো ঘর। মেয়েটা কাঁপছে রীতিমত। খিঁচুনি রোগীর মতো হাত- পা কাঁপছে। একপলক আরশাদের দিকে চেয়ে বুকের চাদরটা খামছে ধরলো সে। থমকানো কন্ঠে বলল,”আমার ফোন কোথায়? আমার ফোন..আব্বু।”
আরশাদ জ্ঞানশূন্যর মতো চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নরম গলায় বলল,”খারাপ সপ্ন দেখেছেন? এইতো আমি, কিচ্ছু হয়নি।”
মুনতাহা অসহায়ের মতো চাইলো। এদিক ওদিক দেখে বুকের পাশ ঘেঁষে বলল,
—“আব্বু… আমি আব্বুকে…আমি ডাকলাম। আব্বু শুনলোনা।….আমার ফোনটা দিননা।”
আরশাদ গলা পরিষ্কার করল। একহাতে জড়িয়ে ধরলো মুনতাহাকে। ঘড়ি দেখে বলল,” ভোর চারটা বাজে মুনতাহা। এখন ফোন করবেন? আংকেলের সাথে তো রাতেই কথা হলো।”
—“আমি কথা বলবো।”মুনতাহা কেঁদে উঠলো।
আরশাদ মানা করলোনা আর। বালিশের পাশ থেকে ফোন নিয়ে তক্ষুনি ফোন দিলো মুনতাহা। দুবার রিং হয়ে হয়ে কেটে গেলো। মুনতাহা ফোঁপাচ্ছে তখন। আরশাদ নিজেও খানিকটা শঙ্কিত।
তৃতীয়বারে ফোন ধরলেন মাহতাব সাহেব। ঘুম জড়ানো কন্ঠে বললেন,”হ্যাঁ, আম্মা? কি হয়েছে, ঠিক আছিস?”
মুনতাহা কেঁদে কেঁদেই ডাকলো,”আব্বু, আব্বু তুমি…”কথা বলতে পারলোনা।
মাহতাব সাহেব চিন্তিত কন্ঠে বললেন,”কাঁদছিস কেনো? দেখি, আরশাদ কে দে। কি হয়েছে?”
ফোন কেটে বাতি নিভিয়ে দিলো আরশাদ। মুনতাহাকে শুইয়ে দিয়ে বলল,
—“ঘুমান, আংকেল ঠিক আছে। বেশি চিন্তা করছেন, সেজন্যই সপ্নে উল্টোপাল্টা দেখছেন মুনতাহা। নিশ্চিন্তে ঘুমান তো। আমি আছি।”
মুনতাহা ঘুমিয়ে পড়লো কিছুক্ষণের মধ্যই। বাইরে তখন ভোর হয়ে গেছে।
মুনতাহা ঘুমালেও আরশাদ ঘুমালোনা। বাকিটা রাত স্ত্রীর মাথায় হাত বুলিয়েই কাটলো তার। কানে অবিশ্রাম বেজে চলল, স্বপ্নে শোনা সেই ডাহুক পাখির ডাক। বিরহের করুণ ডাক। অবচেতন মস্তিষ্ক খুঁজে বেড়ালো সপ্নের ব্যাখ্যা।
আরশাদ চোখের পাতা এক করতে পারলোনা। কিছুতেই পারলোনা।
চলবে
#অমানিশা❤️
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
#পর্ব-১৬
ময়ুখের তপ্ত ছটায় ভোর কেটেছে অনেকক্ষণ।
সেদিন সকালে আরশাদকে আর খালি গায়ে ঘুরে বেড়াতে দেখা গেলো না। ফুলহাতা ধবধবে শার্টে আগাগোড়া আঁটসাঁট পোশাকে নাস্তার টেবিলে বসল সে।
মিনিটদশেকের মধ্য নাস্তা সেড়ে উঠেও গেলো। মুনতাহা বিছানা ঝাড়ছিলো তখন। আরশাদ ঘরে ঢুকল। একপলক দেখে ড্রয়ার খুলে ঘড়ি বের করল। হাতে পরতে পরতে বলল,”আপনি একা একা ছাদে যাবেন না। যেতে হলে, আম্মাকে সাথে নিয়ে যাবেন। ঠি কাছে?”
মুনতাহা মাথা নাড়ালো। মুখে বলল,”আচ্ছা।”
আরশাদ যাবার আগে একবার আনতারা কেও ডেকে বলে গেলো,”আম্মা, ওকে তোমার কাছে কাছেই রাখবে। একা বাইরে যেতে দিবে না। ওই ফ্ল্যাটেও না।”
আনতারা কি যেনো দেখলেন ছেলের চোখে। সন্ধানী কন্ঠে বললেন,”কিছু হয়েছে বাবা?”
আরশাদ কি যেনো ভাবে। সাবিনা বেগমের পাশে বসে লাজুকভাবে হাসতে থাকা মুনতাহার দিকে চেয়ে কি যেনো দেখে। নিশ্চিত দাদি উল্টোপাল্টা কিছু বলছে। আরশাদ চোখ সরায়।
অত:পর মৃদু গতিতে মাথা নাড়িয়ে বলে,”না, কিছু হয়নি। সাবধানে থেকো।”
–
সপ্তাহ-র বেশি কেটে গেলো যেনো চোখের পলকে।
মাহতাব সাহেব ফিরবেন আজ। মেয়েকে ফোন করেছিলেন বিকেলেই। কাজ শেষ তার। রাতের মধ্য পৌছে যাবেন। সেই বিকেল থেকেই একগাল হাসি নিয়ে বসেছে মুনতাহা। সরছেইনা।
আরশাদ ফিরলো সন্ধ্যার দিকে। মুনতাহা দরজা খুলতেই তার হাসি দেখে নিজেও হেসে ফেলল। ঢুকতে ঢুকতে বলল,”যাক, হেসেছেন তবে। কেঁদেকেঁদেই তো সপ্তাহ কাটিয়েছেন।”
মুনতাহার হাসি চওড়া হলো। হাত বাড়িয়ে আরশাদের ব্যাগটা নিলো সে। আরশাদ আশেপাশে তাকালো। ড্রইংরুমে কেউ নেই। দাদির ঘরের দরজা বন্ধ। আম্মার ঘরেরও।
চট করে মুনতাহার কপাল টেনে ছোট্ট একটা চুমু খেয়ে নিয়ে বলল,”আমার থেকে দূরে যেতে আপনার এতো হাসি চাঁদ?”
মুনতাহা লাজুক ভঙ্গিতে মুখ ঝুঁকিয়ে নিলো। চাঁদ ডাকায় সে লজ্জা পেয়েছে। আরশাদ জুতো খুলতে ব্যস্ত হলো। মুনতাহা চুপটি করে দাড়িয়ে রইলো পাশে। রোজই থাকে। আরশাদ জুতো খুলে পাশে তুলে রেখে ধীরকন্ঠে বলল,”পানি দিয়েন তো মুনতাহা।”
–
একনিশ্বাসে ঠান্ডা পানিটা ঢকঢক করে গিলে নিয়ে ক্লান্ত ভঙ্গিতে গ্লাসটা বিছানার উপর রাখলো আরশাদ। মুনতাহা তার ঘেমে নেতিয়ে যাওয়া শার্টটা বারান্দায় মেলতে গিয়েছে। আরশাদ মাথার নিচে হাত দিয়ে সটান হয়ে শুয়ে পড়লো বিছানার মাঝখানে। ফ্যান ঘুরছে ভনভন করে। বা হাতটা মেলে বিছানার বা পাশে রাখলো।
মেয়েটা আজ ঘুমাবেনা এখানে। খালি খালি লাগবে। তার অভ্যাস হয়ে গেছে।
মুনতাহা ফিরে এলো। একপলক আরশাদকে দেখে পানির গ্লাসটা বিছানা থেকে সরিয়ে সাইড টেবিলে রাখলো। ঝুঁকে ড্রয়ের খুললো। ঘড়িটা ঢুকিয়ে রাখলো ভেতরে।
আরশাদ উঠে বসেছে। মুনতাহা ড্রয়ের আটকে সোজা হতেই ভরাট কন্ঠে ডাকলো সে,”এদিক আসেন।”
মুনতাহা ঘাড় ঘুরালো। দৃষ্টি বিনিময় হলো। আরশাদের চোখে স্পষ্ট আহব্বান।
মুনতাহা বুঝে। চোখ নামিয়ে নেয়। ধীরপায়ে কাছাকাছি যেয়ে দাড়াতেই বাহু টেনে কোলের উপর বসিয়ে নেয় আরশাদ। মুনতাহা মুখ তুলেনা। আরশাদ বামগালে হাত রেখে বিষাদ নিয়ে বলে,
—“এই ঘরটা অমাবস্যায় ডুবে যাবে।”
মুনতাহা আরো একটু নতজানু হয়। আরশাদ সময় নিয়ে গাঢ় স্পর্শ আঁকে। মুনতাহা মিনমিন করে বলে,
—“দু’একদিন আব্বুর কাছে থাকি?”
আরশাদ থামে। গালের হাতটা সরিয়ে কপালের চুল গুছিয়ে দেয়। বলে,”আমি আপনাকে কিছু বলেছি? আপনার যতদিন ইচ্ছে থাকেন। ইচ্ছে হলে আসবেন, না আসলেও আমি কিছু বলবোনা।”
মুনতাহা তাকায় এতক্ষণে। আরশাদের চোখে মুগ্ধতা। সে আজকাল দেখতে পায়। বুঝতে পারে।
মুনতাহা মনে মনে স্বগতোক্তি করলো,”আচ্ছা, আপনিও কি বুঝেন? আপনি ওই চোখে যতটুকু মুগ্ধতা নিয়ে তাকান, তার থেকে হাজার গুন বেশি মুগ্ধতা নিয়ে আমি আপনার দিকে তাকাই?”
–
মাহতাব সাহেব ফিরেছেন গুনে গুনে এগারো দিন পর। সাতদিনের জা’গায় এগারো দিন। মেয়ে নিশ্চিত অভিমানে রুষ্টপুষ্ট হয়ে আছে। রাস্তা শুনশান। রাত অনেক। সি এন জি থেকে নামতেই আরশাদ এগিয়ে এলো। মাহতাব সাহেব বিস্তর হেসে জড়িয়ে ধরলেন স্বস্নেহে। পিঠ চাপড়ে বললেন,”কষ্টে করে আবার নামতে গেলে কেনো বাবা?”
আরশাদ হেসে ফেলল,”আপনার মেয়ে আমাকে নিশ্চিত শুলে চড়াতো এখন নিচে নিয়ে না আসলে।”
—“মুন এসেছে? কোথায়?”
আরশাদ সি এন জি থেকে ব্যাগ তুলতে তুলতে বলল,”ভেতরেই দাড়িয়ে আছে। রাত হয়েছেতো। বাইরে আসতে মানা করেছি।”
–
মুনতাহা গুটিগুটি হয়ে দাড়িয়ে ছিলো। পরণে শুভ্ররঙা শাড়ি। ভেতরে ঢুকতেই নিকষমেঘে পূর্ণিমা খেলে গেলো যেনো। মাহতাব সাহেব নিজ থেকেই দু’হাত মেলে দিলেন। মুনতাহা ঝাঁপিয়ে পড়লো বুকে। ফুঁপিয়ে উঠলো সশব্দে। মাহতাব সাহেব চুলে হাত বুলালেন সবসময়ের মতো, “কাঁদেনা আম্মা। আব্বু এসে পড়েছিতো।”
—“আপনার মেয়ের কাঁদা ছাড়া কোনো কথা নেই।”আরশাদ ফোড়ন কাটলো।
মাহতাব সাহেব হাসলেন। মুনতাহা তখনো কাঁদছে।
–
তখন গভীর রাত। শুক্ল মেঘের আড়ালে সেদিন ঘুটঘুটে অমাবস্যা। হলুদ ল্যাম্পপোস্টের আলোতে ঝিঁ ঝিঁ পোকা ঝাঁক বেঁধেছে।
মুনতাহা প্লেটবাটি ধুচ্ছে রান্নাঘরে। বাবা ভাত খেয়েছে কিছুক্ষণ আগে। গোসল সেড়ে, ব্যাগের জিনিসপত্র বের করে গোছাতে গোছাতে দেরি হয়ে গেছে।
মাহতাব সাহেব ঘর থেকে ডাক দিলেন,”মুন? এদিকে আয়।”
মুনতাহা প্লেটবাটি সেভাবে রেখেই ঘরে ছুটে গেলো। ওইযে, বাবার ডাকই যে তার প্রথম প্রাধান্য। মাহতাব সাহেবের হাতে প্যাকেট। চারকোনা প্যাকেট। মুনতাহার দিকে বাড়িয়ে দিলেন তিনি। মুনতাহা শাড়ির আঁচলে ভেজা হাত মুছল। ধরার আগেই মাহতাব সাহেব হাত নামালেন হঠাৎই। চুপ করে রইলেন কিছুক্ষণ। চোখের শান্ত দৃষ্টি মেঝের দিকে। অত:পর আবার হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,”ধর মা, তোর উপহার।”
মুনতাহা কপাল কুঁচকালো। বলল,
—“উপহার কিজন্য আব্বু?”
মাহতাব সাহেব জোরপূর্বক হাসলেন বোধহয়। স্বাভাবিক থেকে বললেন,
—“এইযে আমার মেয়েটা এগারোটা দিন আমাকে ছাড়া থেকে ফেলল সেজ…” মাহতাব সাহেব চুপ করলেন। মুনতাহা প্যাকেট খুলছিলো। বাবার চুপ হয়ে যাওয়ায় হাত থামলো তার। মাহতাব সাহেব আবার হাসলেন। হাসার চেষ্টা করলেন। বললেন,”খোল খোল। খুলে দেখ।”
মুনতাহা প্যাকেট খোলায় মনোযোগ দিলো। ভেতরে শাড়ি। জামদানী শাড়ি। সাদা জামদানী। অদ্ভুত সুন্দর।
মাহতাব সাহেব থেমে থেমে বললেন,
—“তোকে… তোকে শাড়িতে খুব সুন্দর দেখায় আম্মা। সবসময়..সবসময় শাড়ি..পড়বি।”
মুনতাহা কি যেনো দেখল। বাবা কেমন করছেনা? একটু অন্যরকম করে কথা বলছেনা? শাড়িটা পাশে রেখে তাড়াহুড়ো করে বলল,”আব্বু কি হয়েছে?”
মাহতাব সাহেব উওর দিলেননা। চুপ করে রইলেন। চোখ তুলে একবার তাকালেন মেয়ের দিকে। আবার চোখ নামালেন। বোঝা যাচ্ছে, নীরবে কিছু একটা সহ্য করার চেষ্টা করছেন। মুনতাহা ভীত কন্ঠে বলল,”আব্বু? আব্বু কি হলো? খারাপ লাগছে? পানি খাবে?”
মাহতাব সাহেব এবারো উওর দিলেননা। মুনতাহা ঘাবড়ে গেলো। ভড়কে গেলো। ভয় জেঁকে বসলো। মুখের রং ফ্যাকাশে হয়ে গেলো মূহুর্তেই। টেবিল থেকে পানির গ্লাস নিলো সে। মাহতাব সাহেব মেয়ের হাতেই পানি খেলেন। কষ্ট করে বললেন,”আম্মা, আরশাদকে ডাক তো।”
ঘরের বাতি নিভানো। আরশাদ ঘুমোয়নি। কপালে হাত ঠেকিয়ে চোখ বুজে আছে শুধু। মুনতাহা পাশে নেই। ঘরে শূন্যতার আসর। তার ঘুম আসছেনা। ফোন ভাইব্রেট করল তখনই। আরশাদ চোখ মেলল চকিতে। স্ক্রীনে মুনতাহার নাম্বার। কি হয়েছে? কি হয়েছে? ভাবতে ভাবতেই ফোন রিসিভ করলো সে। কিছু বলার আগেই ওপাশ থেকে কান্নামাখা কন্ঠস্বর ভেসে এলো,
—“আপনি একটু আসেন। আব্বু কেমন যেনো করছে।”
–
মাহতাব সাহেব চোখ বুজতেই মুনতাহা কাঁপা কাঁপা গলায় ডাকলো,”না আব্বু, আব্বু না। আব্বু? তাকাও না।”
মাহতাব সাহেব তাকালেন। মেয়ের আবদার! রাখতে হবে যে!
চোখজোড়া ভীষণ লাল তবে পানি নেই। আরশাদ ক্ষীণ ভরসায় তার হাত ধরে বলল,”কিছু হবেনা আংকেল। আর একটু.. এম্বুলেন্স চলেই এসেছে।’
মাহতাব সাহেব ঢোঁক গিললেন বোধহয়। শরীরটা একটু কেঁপে উঠলো। আরশাদ বুঝতে চেয়েও বুঝতে চাইছেনা।
মাহতাব সাহেব হঠাৎই পূর্ণদৃষ্টিতে তাকালেন। পরিষ্কার কন্ঠে ডাকলেন,”আরশাদ, শোনো।”
আরশাদ ঝুঁকলো। মুনতাহা বুকে জাপটে ধরে কাঁদছে। মাহতাব সাহেব শেষবারের মতো কাঁপা হাতে মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে আরশাদের দিকে তাকালেন। ফিসফিসেয়ে বললেন,”এটাই যেনো ওর শেষ কান্না হয়।”
—“আংকেল?”আরশাদের চোখে পানি। কন্ঠ কাঁপা কাঁপা।
—“মনে রেখো।”
মাহতাব সাহেবের চোখের কোঁণা বেয়ে জল গড়ালো নিরবে। মেয়েকে আর দেখা হবেনা। আফসোস যে এই একটাই!
কিছুক্ষণের মধ্যই শরীরটা নিস্তেজ হয়ে গেলো। মাথায় বুলাতে থাকা হাতটা থেমে গেলো হুট করে। মাহতাব সাহেব চোখ বুজলেন। আরশাদ নিজেকে শক্ত করতে চাইলো। পারলোনা। মুনতাহা বুক থেকে মুখ তুলল। টিপ টিপ আওয়াজ টা থেমে গেলো কেনো? শিশুর মতন একবার আরশাদের দিকে চাইলো সে। পরক্ষণেই বাবার গালে হাত রেখে অবুঝ স্বরে ডাকলো,”আব্বু? আব্বু কথা বলো। আব্বু?”
মাহতাব সাহেব কথা বললেন না। মুনতাহা চিৎকার করলো। গলা দিয়ে রক্ত বেরিয়ে যাবার উপক্রম। কন্ঠে আহাজারির আবদার,
—“আব্বু? আব্বু তাকাও। আব্বু? ও আব্বু তাকাও।”
চলবে