টপ_টেন_মডেল,পর্বঃ ৮

0
2811

টপ_টেন_মডেল,পর্বঃ ৮
ঋতু_পান্না

রাজের বাড়িটা বিশাল বড়। বাড়িটা সাজানো হয়েছে একেবারে রাজকীয় ভাবে। বাড়ির প্রতিটি জিনিসেই আভিজাত্যের ছোঁয়া। পার্টিতে অনেকেই ইতোমধ্যে এসে পৌঁছে গেছে। তনিমা এক সাইডে নীরবে দাঁড়িয়ে ছিল। অন্যদিকে সবাই নিজেদের মতো পার্টিতে কথাবার্তা চালিয়ে যাচ্ছিল। একজন ওয়েটার এসে তাকে ডিঙ্কস নেওয়ার জন্য অফার করতেই সে বিনয়ের সাথে নাকচ করে দেয়।

পার্টির মধ্যমণি এখন একজন বয়স্ক ব্যাক্তি। তিনি হলেন রাজের দাদা রায়হান চৌধুরি। এই দাদা ছাড়া এই দুনিয়াতে রাজের আপন বলতে আর কেউ নেই। এই মানুষটির বয়স অনেক হলেও তার পরনে প্রতিটি জিনিসে আভিজাত্য ফুটে উঠে।
পার্টিতে সবাই চলে এলেও রাজের কোনো দেখা নেই। সবাই তখন রাজ চৌধুরিকে দেখা করার জন্য অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিল। শবনমও খুব অস্থির হয়ে আছে। সে প্রথমবারের মতো সরাসরি এত কাছ থেকে রাজকে দেখবে! সে জানে রাজ চৌধুরি সেই সব মানুষদের একদমই পছন্দ করেন না, যারা অন্যের নাম ব্যাবহার করে উপরে উঠতে চাই। তাই সে ইতোমধ্যেই তনিময়কে কি করে বদনাম করা যায়, সেই প্ল্যান করে ফেলেছে।

-“বিষয়টা খুব রিস্কি হয়ে যাবে না তো?” শবনমের কানের কাছে ফিসফিস করে জানতে চাইল আবির।
-“আরে ডার্লিং, ডোন্ট ওয়ারি! রাজ চৌধুরি যেরকম মানুষ তাতে আমাদের প্ল্যান সাকসেসফুল হলে তনিমা শেষ। তুমি টেনশন নিও না। আর তোমাকে যেটা ম্যানেজ করতে বলেছিলাম সেটা এনেছ?”

এটা বলতেই আবির নিজের পকেট থেকে লুকিয়ে কোনো কিছুর একটা ছোট্ট শিশি বের করে দিল।
হঠাৎ ড্রয়িংরুমের সমস্ত লাইট, মিউজিক বন্ধ হয়ে গেল। সাথেসাথেই সিঁড়ির উপর নীলরঙা এক ফালি আলো এসে পড়ল এবং সফট্ মিউজিকের টিউন বেজে উঠল। স্বাভাবিকভাবেই সবাই সেদিকে নজর দিল।

তনিমা তখন পার্টিতে আসা কিছু মানুষের সাথে টুকটাক কথা বলছিল। সেও সিঁড়ির দিকে নজর দিল। আর তখন সবাই দেখতে পেল কালো আর সাদার কম্বিনেশনে তৈরি সু্ট পড়া, দারুন হ্যান্ডসাম দেখতে সুদর্শন একজন ব্যাক্তি সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছে। কারো আর বুঝতে বাকী রইল না উনি আর কেউ নই ওয়ান এন্ড অনলি রাজ চৌধুরি।
পার্টিতে উপস্থিত সকলেই যেন তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। তনিমাও চোখ ফেরাতে পারছিল না। এদিকে শবনমের তো যায় যায় অবস্থা! তার কাছে মনে হতে লাগল, রাজকে ছবির চাইতে সরাসরি আরো বেশী হ্যান্ডসাম লাগে। এই রাজের কাছে তো আবির কিছুই না। ইশ্ সে যদি রাজের কাছের কেউ হতে পারত! এসব ভেবে নিজের মনেই ব্লাশিং হচ্ছিল সে।

রাজ বারবার আড়চোখে তনিমাকে দেখছিল। যখন তাদের চোখাচোখি হতো তনিমা নিজের চোখ নামিয়ে নিত আর রাজ মুচকি মুচকি হাসত। তনিমা আজকে কালো রঙের একটা গাউন পড়েছে, গাউনটার মাঝে মাঝে সাদা স্টোন দিয়ে খুব সুন্দরভাবে ডিজাইন করা ছিল। চোখে কাজল, ঠোঁটে গোলাপি লিপস্টিক, চুলগুলো স্ট্রেইট করে একদিকে ছেড়ে দেওয়া ছিল। সবমিলিয়ে রাজের কাছে তাকে কোনো আসমান থেকে নেমে আসা পরী মনে হচ্ছিল। চোখ ফেরানো দায় হয়ে যাচ্ছিল।

কিছুক্ষণ পরে তনিমা আর রাজকে কোথাও দেখতে পাচ্ছিল না। তার অবাধ্য চোখ রাজকে দেখতে চাইলেও সেটা সম্ভব হচ্ছিল না। কারন আআশেপাশে কোথাও রাজ ছিল না।

তখনই তনিমার ফোনে একটা মেসেজ আসল। মেসেজটি ওপেন করতেই দেখল সেখানে লেখা,
-“তনিমা, তুমি মিস্টার চৌধুরির বাড়ির ছাদে এসো। ইতি অন্বেষা।”
মেসেজটি পড়ে সে ভাবতে লাগল অন্বেষা এখানে কী করছে! আর অন্বেষার নাম্বার তার ফোনে সেইভ করা নাই কেন? পরে আবার ভাবল সেদিন তো ওর ফোনটা ভেঙে গিয়েছিল তাই হয়তো ও নতুন সেট নিয়েছে। আর সাত পাঁচ না ভেবে সে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে গেল।
তার ভিতরটা খুব অস্হির লাগছিল।
কিন্তু ছাদের উপর উঠে সে খুবই অবাক হলো। কারন শত রঙা ফেরি লাইট দিয়ে পুরো ছাদ খুব সুন্দর ভাবে সাজানো ছিল। সে সামনের দিকে এগিয়ে গেল। দেখতে পেল একটা টেবিলের উপর গোলাপের পাপড়ি দিয়ে ঘিরে একটা লাভ শেইপ কেক রাখা। চারপাশে মোমবাতি জ্বালানো। পাশে আরেকটা টেবিলে কিছু ডিঙ্কসের বোতল সাথে দুইটা গ্লাস রাখা। টেবিলের দুই পাশে দুটি চেয়ার পাতা।
এসব দেখে তনিমা কিছুই বুঝে উঠতে পারল না। আশেপাশে কাউকে দেখতেও পাচ্ছিল না। সে কী তাহলে এখানে ভুল করে চলে এল!
তখন একটা গিটারের ঢুং ঢাং শব্দ ভেসে এলো। কেউ খুব ভালোবাসা দিয়ে গিটারে খুব মায়াবী একটা সুর ফুটিয়ে তুলল। তনিমা গিটারের সুর অনুসরণ করে এগিয়ে গেল। কিন্তু ঠিক ধরতে পারল না কোথা থেকে সুরটা ভেসে আসছে। আরেকটু সামনে এগিয়ে যেতেই দেখল কেউ পিছন ফিরে চেয়ারে বসে এক হাটু ভাঁজ করে আরেক হাটু সামনে বাড়িয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে গিটার বাজাচ্ছে।

কয়েক সেকেন্ড পর গিটার বাজানো থামিয়ে মানুষটি সামনে ঘুরল। তনিমাকে দেখে পলকহীনভাবে তাকিয়ে রইল রাজ। তনিমাও একদৃষ্টে তার দিকে চেয়ে রইল। কিছুসময় দুজন দুজনের দৃষ্টিতে নিবদ্ধ হয়ে রইল। শব্দহীন পদধ্বনি তুলে রাজ তনিমার কাছে এসে দাঁড়াল।
ততক্ষণাৎ তনিমা নিজের দৃষ্টি সরিয়ে নিল। কিছু বলতে যাওয়ার জন্য মুখ খুলতে যাবে তখনই রাজ তার হাত ধরে টেবিলের সামনে এনে দাঁড় করালো। তনিমা অবাক হয়ে গেল। সে আবার কিছু বলতে যাবে তার আগেই রাজ নিজের হাতের আঙুল উঠিয়ে তনিমাকে চুপ করতে ইশারা করল। এই ইশারাটি তনিমার অন্তর ছুঁয়ে গেল। সে রাজের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

রাজ নিজের হাত আকাশের দিকে তাক করে আঙুল উঠিয়ে কিছু ইশারা করল, তনিমার মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে ভ্ব নাচিয়ে চোখের ইশারায় তনিমাকে উপরে তাকানোর আহ্বান জানাল। তনিমা এবার উপরে থাকালে দেখতে পেল সন্ধ্যার গোধূলি আকাশে কিছু লেখা আলো ছড়াচ্ছে। আতশবাজির হল্কায় সে স্পষ্ট পড়তে পারল ‘আই লাভ ইউ তনিমা’, ‘উইল ইউ বি মাইন’, ‘ভালোবাসি প্রিয়’ এরকমই আবেগময় কিছু শব্দচয়ন। কয়েক মিনিট ধরে সে আকাশে দিকে তাকিয়ে আতশবাজির রোশনাই এ নিজের জন্য প্রেম নিবেদন দেখল।
আতশবাজি শেষ হতেই সে পিছন ফিরল দেখল রাজ নামক মানুষটি তার সামনে হাটু মুড়ে বসে আছে। হাতে তার টকটকে লাল রঙের গোলাপগুচ্ছ। তনিমার চোখে চোখ রেখে একনাগাড়ে বলে গেল,
-” আই লাভ ইউ, তনিমা। আমি জানিনা তুমি লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইড এ বিশ্বাস করো কী না! তবে তোমাকে দেখে, তোমার সরলতা দেখে মনে হয়েছে তুমিই সেই মেয়ে যার সাথে আমি আমার সারাটি জীবন কাটাতে চাই। তোমার মায়াবী মুখটি দেখে আমার প্রতিটি সকাল শুরু করতে চাই, তোমার কোলে মাথা রেখে নিজের ফিলিংসগুলো শেয়ার করতে চাই, পৃথিবীর সব সুখ তোমার কাছে এনে দিতে চাই, তোমার সমস্ত অতীত স্মৃতি আমি ভুলিয়ে দিতে চাই, বৃদ্ধ বয়সে তোমার সাথে গল্প করতে করতে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করতে চাই। তুমি কি আমাকে সেই সুযোগ দিবে? খুব যত্ন করে এই বুকের বা পাশটায় আগলে রাখব তোমায়। খুব ভালোবেসে ফেলেছি তোমায়। উইল ইউ ম্যারি মি?”
রাজের প্রতিটি কথা তার ভিতরের ভালোবাসার জানান দিচ্ছিল। ভিতরটায় কাউকে কাছে পাওয়ার আকুল আবেদন ছিল।
কিন্তু সে তনিমার মনের ভিতরটা পড়তে পারল না। তনিমার মুখ দেখে কিছুই বুঝতে পারল না। তনিমা উদাস চোখে রাজের দিকে তাকিয়ে ছিল। রাজ আবারও বলতে লাগল,
-“তনিমা আমি চাইলে এখনই তোমাকে বিয়ে করে নিতে পারি। এটা করতে আমার দু’সেকেন্ড সময়ও লাগবে না। কিন্তু আমি চাই, আমি চাই তুমি আমাকে ভালোবেসে আমার কাছে এসো। আমি তোমার মনটা জয় করতে চাই। আমার জন্য তোমার চোখে ভালোবাসা দেখতে চাই। আমি..”

-“মাফ করবেন। আমি আপনার প্রোপোজাল একসেপ্ট করতে পারব না। আপনি যেটাকে ভালোবাসা বলছেন, সেটা আসলে ভালোবাসা না, সেটা ‘মোহ’। আর ‘মোহ’ কেটে গেলেই আমাকে ছুঁড়ে ফেলে দেবেন, তাইতো? এগুলো ভালোবাসা না। এগুলো নাটক, অভিনয়।”
বলেই কাঁদতে কাঁদতে ছাদ থেকে দৌড়ে নেমে গেল। রাজের প্রচন্ড রাগ হলো, তনিমা তার ভালোবাসাকে নাটক ভাবল! তার ভালোবাসা ওর কাছে মোহ মনে হয়!
এগুলো ভাবতে ভাবতেই রাগে পরপর কয়েক গ্লাস মদ খেয়ে ফেলল। এগুলো যতই ভাবছে ততই ওর রাগ হচ্ছে আর মদ খাচ্ছে।

এই রাজের কথা শুনে তার খুব কান্না পাচ্ছে। আবিরও তো থাকে এমন করেই ভালোবাসার, ভালো রাখার প্রতিশ্রুতি দিত।
নাহ, সে আর কাঁদবে না। চোখের পানি মুছে ড্রয়িংরুমে নেমে আসল।

শবনম পার্টি নিয়ে এতই ব্যাস্থ ছিল যে তনিমার কথা প্রায় ভুলতেই বসেছিল। হঠাৎ তনিমাকে দেখে সে একজন ওয়েটারকে ডাক দিল। ওয়েটারকে কিছু বোঝাতেই সে মাথা নেড়ে সায় দিল।
-“ম্যাম, মে আই অফার ইউ আ গ্লাস অফ ডিঙ্ক অর সফট ডিঙ্কস?”
বলেই ওয়েটারটি তার সামনে একটি ট্রেতে করে এক গ্লাস তরল এগিয়ে দিল। তনিমার গলাটাও শুকিয়ে গেছে তাই সে গ্লাসটি নিল।
কয়েক চুমুক খাওয়ার পরই তার চোখজোড়া কেমন ঝাপসা হয়ে এলো, মাথাটা ঘুরতে লাগল।

রাজ এখন নিজের হুঁশে নেই। অতিরিক্ত মদ খেয়ে ফেলায় সে নিজকে কোনো রকম সামলে নিজের রুমে চলে আসল। ড্রয়ার থেকে কয়েক পাতা ট্যাবলেট বের করে কয়েকটা খেয়ে বিছানার উপর ঢলে পড়ল।

তনিমা পড়ে যেতে নিলেই শবনম তাকে ধরে ফেলল। আস্তে আস্তে খুব সাবধানে ও’কে আবির আর শবনম মিলে একটি রুমে নিয়ে গেল। রুমটি ছিল রাজের রুম। রাজের রুমে ঘুমন্ত রাজকে দেখে তারা দুজনেই অবাক এবং খুশি হয়ে গেল।
তনিমাকে ধরে তারা রাজের পাশে বিছানায় শুয়িয়ে দিল। আবির রাজের সামনে এসে খুব সাবধানে ওর শার্টের প্রথম তিনটা বোতাম খুলে দিল। পুরো নাটকটা এমন ভাবে সাজানো হলো যেন মনে হচ্ছে তনিমা রাজের খুব কাছাকাছি আসার চেষ্টা করছে।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here