দূর আলাপন
১৮(শেষ পর্ব)
অদ্রিজা আশয়ারী
দুর্দমনীয় দৃঢ়তার সঙ্গে শিউলি বেগম শুনে গেলেন সবটা। শুনে কিছুক্ষণ বসে রইলেন বজ্রাহত হয়ে। তিতিক্ষা কম্পিত দৃষ্টিতে তাকাল সেদিকে। দেখল শিউলি বেগমের ঠোঁট কাঁপছে। মাথায় বাজ ভেঙে পরলেও বোধহয় এতটা অবাক তিনি হতেন না। নিনাদ, তার নিনাদ। সমাজেরকথা ভুলে, আত্মীয় অনাত্মীয় সবার নিষেধ অমান্য করে যাকে কিনা তিল তিল করে বড় করেছেন তিনি নিজের রক্ত দিয়ে। সে তাকে এভাবে ঠকালো! এত বড় একটা কথা তার কাছে গোপন করে গেল এত অনায়াসে? ভাবল ফুফু জানলে কখনো মানতে পারবে না। ফুফুর মন এত ছোট মনে হল তার কাছে?
শিউলি বেগম শীতল দৃষ্টি হানলেন তিতিক্ষার দিকে। তারপর ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন দ্রুত পদক্ষেপে।
তিতিক্ষা একদৃষ্টে সেই গমন পথের দিকে তাকিয়ে রইল। নিশ্বাস ফেলল জোরে। মনপিঞ্জরে থাকা সব দ্বিধাকে মুক্ত করেছে সে আজ, এবার তারা যেদিকে খুশি উড়াল দিক। তার হাত পা বাঁধা। তাকিয়ে দেখা ছাড়া আর কিছু করতে পারে না সে।
সেদিন বিশেষ তেমন কিছুই আর ঘটল না। তবুও সারাটা দিন তিতিক্ষা কেমন বিবশ হয়ে রইল। নিনাদের সাথে তার দূরত্ব কমবে নাকি আজন্ম এই বিচ্ছেদ এখন চিরতর হবে সে জানে না। নিজের অনুভূতির দ্বার গুলোকে কখনো খোলার সুযোগ সে দেয়নি। জানে না সে দ্বারের অভ্যন্তরে কাদের আনাগোনা, নিনাদ নামের কারো অস্তিত্ব সেখানে আদৌও আছে কিনা! আজ এই-যে আলস্যভরা একটা বিবশ ভাব চক্রাকারে ঘিরে রেখেছে তাকে, এর কারণ নিনাদ নয়। এই বিয়ের ব্যাপার টা উত্থিত হওয়ার পর থেকে বাবা যে হারিয়ে যাওয়া প্রাণটা ফিরে পেয়েছেন, সেটা ফের হারিয়ে ফেলার ভয়ই তার বাজছে বেশি। বেপরোয়া ঢেউগুলো একের পর এক এসে বাড়ি খাচ্ছে। প্রতিবার তিনি আঘাতে জর্জরিত হচ্ছেন। ফের যদি একটা ঢেউ আসে, আর কি পারবেন তিনি সামাল দিতে?
ঠিক যেই ক্ষনে পরবর্তী ঢেউ টা এল, আবারও কূল ভাসিয়ে সব চুরমার করে নিয়ে যাবার লক্ষ্যে। সেই সময়ের বর্ণনা একটু দেয়া আবশ্যক।
তখন সকাল। তিহা রুটি বেলছিল রান্নাঘরে। মারুফ সাহেব সবে চায়ের কাপ টা হাতে নিয়ে সদর দরজা পেরিয়ে উঠোনে নেমেছেন। উদ্দেশ্য রোজ সকালের মতো আজও ঘুরে ঘুরে গাছ দেখবেন আর মাঝে মাঝে চুমুক দেবেন চায়ের কাপে। তিনি তখন দেখলেন বেশ হন্তদন্ত হয়ে শিউলি বেগম তাদের লোহার গেট পেরিয়ে বাড়িতে এসে ঢুকছেন। মারুফ সাহেবের সামনে এসে তিনি দাঁড়িয়ে পড়লেন। থমথমে মুখে বললেন, ‘মারুফ সাব। কিছু কথা আছে আমার আপনের লগে। আপনের মাইয়াগো লগেও। ‘
মারুফ সাহেব ব্যাস্ত হয়ে বললেন,’হ্যাঁ হ্যাঁ। ভেতরে আসুননা।’
শিউলি বেগম ভেতরে এলেন। ততক্ষণে তিহাও রান্নাঘর ছেড়ে বসার ঘরে এসে দাঁড়িয়াছে। আশেপাশে তাকিয়ে কোনরকম ভনিতা না করে তিনি সরাসরি এগোলেন তিতিক্ষার ঘরের দিকে। তিতিক্ষা সবে মাত্র দরজা খুলে ঘরের বাইরে এক পা রেখেছে। তিনি গিয়ে তাকে অবাক করে দিয়ে তার হাত চেপে ধরলেন। গম্ভীর স্বরে বললেন, ‘আমার সাথে আসো।’
পুরো ঘরজুড়ে সুনসান নীরবতা। চারজন মানুষ সেখানে বসে আছেন নিস্তব্ধ হয়ে। মারুফ সাহেবের মুখ সর্বাপেক্ষা নীচু। মাথা তোলার মত মনোবল আর বেঁচে নেই তার। নিরবতা ভেঙে শিউলি বেগম বললেন, ‘মারুফ সাব। আপনে পেরেশান হইয়েন না। আমি বিয়া ভাঙ্গতে আসি নাই। সেইটা আমার উদ্দেশ্য না। আমি শুধু বলতাছি, বিয়ার যাবতীয় দায়িত্ব থাইকা আমি অব্যহতি নিলাম। এহন নিনাদ লায়েক হয়েছে, বুঝদার হইছে। তার জীবনের সিদ্ধান্ত এহন সে নিজেই নিবার পারে। সেই কথাটাও ইঙ্গিতে বুঝায়া দিসে আমারে। আচ্ছা থাউক। যা হইছে ভালাই হইছে। আল্লাহ মুক্তি দিসে আমারে। এইবার নিশ্চিন্তে বাড়িত গিয়া থাকবার পারুম আমি। দুইদিন পরপর ঢাকায় আয়া হাঙ্গামা করন লাগব না। ‘
সহসা তিনি ফিরলেন তিতিক্ষার দিকে। হেসে বললেন,’ তোমার সাথে যাই ঘটুক না কেন মায়াজান। দায় তুমার না, তুমি খুব ভালা মাইয়া। আমি জানি। দুয়া করি, তুমরার বিয়াটা ভালোয় ভালোয় হউক। দুইজনে টোনাটুনির সংসার জুরো। মারুফ সাহেব আমি এইবার আসি।’ বলে সোফা ছেড়ে উঠতেই সহসা কোথা থেকে নিনাদের আগমন ঘটল। সে খোলা দরজা পেরিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে এসে দাঁড়ালো শিউলি বেগমের সামনে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,’ ফুআম্মা….’
আর সবাই কিছুটা অবাক হলেও নির্বিকার রইলেন শিউলি বেগম। শান্তভাবে পাশে রাখা ব্যাগটা কাঁধে তুলে নিয়ে নিনাদকে পাশ কাটিয়ে এগোতে লাগলেন বাইরের দিকে।
সদর দরজা পেরিয়ে সবে উঠোনে নেমেছেন। নিনাদ আশেপাশের সব ভুলে দৌড়ে গিয়ে তার দুহাত জড়িয়ে ধরে বসে পরল সামনে। অসহায়ের মত বলল,’ফুআম্মা, তুমি যেও না। এখানে থেকেই আমাকে শাস্তি দাও। সত্যি বলছি। তোমাকে কষ্ট দেয়ার প্রবৃত্তি আমার ছিল না। তুমি থাকো ফুআম্মা।’
নিনাদের আর্তস্বর তার ফুআম্মার কানে পৌঁছাল কিনা বোঝা গেল না। তিনি হাত ছাড়িয়ে শান্ত পদক্ষেপে চলে গেলেন। নিনাদ শরাহতের ন্যায় অসহায় হয়ে বসে রইল সেখানে কয়েক মুহূর্ত। তিহা ছুটে কাছে এসে দাঁড়াল। আতঙ্ক মেশানো চাপা স্বরে বলল, ‘কি হচ্ছে এসব নিনাদ? ফুআম্মা কোথায় চলে গেলেন। তাহলে কি বিয়েটা …..? ‘
-‘হবে। আমার দেয়া কথা আমি অবশ্যই রাখবো।’
ভাঙা স্বরে কথাটা বলে নিনাদ ধীরে উঠে চলে গেল। একবারও পেছন ফিরল না। ফিরলে হয়ত একটা অকল্পনীয় দৃশ্য সে দেখত। যে কোনদিন তাকে ভালোবাসেনি, সারা দেয়নি তার ইশারায়। বারবার শুধু প্রত্যাখ্যান করে গেছে। আজ সে তারই গমন পথের দিকে তাকিয়ে কাঁদছে। মনে যে তারও ভীষণ অপরাধবোধ। দুটো কাছের মানুষের মাঝে হঠাৎ সৃষ্টি হওয়া এই যে দূরত্ব, এ তো তারই জন্য। সে তো শুধু চেয়েছিল সব আঁধার ধুয়ে মুছে দিতে। স্বচ্ছতার মাঝে একটু আঁধার রয়ে গেলে যে কখনো ভালোবাসা হয় না। সেই আঁধার ক্যান্সারের মত পুরো স্বচ্ছতা টাকে নিয়ে একসময় অবগাহন করে। যেটুকু রয়ে যার, সেটুকু শুধুই ছলনার নিঙড়ানো বিষ!
ওদের বিয়েটা হল শুক্রবারে। সেদিন শেষ মধ্যাহ্নে আকাশ অন্ধকার ভীষণ। গুড়ুম গুড়ুম শব্দ তুলে কালো মেঘেরা গজরাচ্ছে। খরশাণ বাতাসের সাথে সেই মেঘেদের দল ছুটে যাচ্ছে আকাশের এমাথা থেকে ওমাথা।
যেন হঠাৎ ভীষণ ক্রুদ্ধ হয়ে আকাশ আজ বান ডেকে বসবে যেকোনো সময়, তার নিয়ম ছাড়িয়ে। আর তো দেরি করা যাচ্ছে না। বিয়েতে যে দুজন মাত্র অতিথি এসেছিল। নিমি আর নিনাদের গুড স্ট্রিটের বাড়ির সেই রুমমেট তৌহিদ। তারা বেরিয়ে পরল আগে আগে।
নিনাদ তিতিক্ষার সঙ্গে সদর দরজা পর্যন্ত একসাথে গিয়ে মারুফ সাহেব থামলেন। নিনাদ নম্র স্বরে বলল, ‘আসি বাবা।’
মারুফ সাহেব কথা বলতে কিছুটা সময় নিলেন। ডানদিকে মাথাটা হালকা কাৎ করে চাপা স্বরে বললেন,’এসো।’
আবার নিরবতা। তিহা রওশান দাঁড়িয়ে আছে বাবার পেছনে। তাদের সামনে, সিড়ির প্রথম ধাপে নিনাদ, তার পাশে তিতিক্ষা।
দীর্ঘ শ্বাসটা চেপে, প্রচন্ড গম্ভীর মুখটাতে বহুকষ্টে খানিক হাসি ফুটিয়ে মারুফ সাহেব ডাকলেন, ‘নিনাদ।’ নিনাদ সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাতেই তিনি নিনাদের হাত ধরলেন। সাথে সাথে অপর হাত দিয়ে তিতিক্ষার হাতটাকেও টেনে আনলেন। থেমে থেমে বললেন, ‘আমার মা মরা মেয়ে… জীবনে কখনো দারুন সুখ সে পায়নি। তবুও অনুযোগ করেনি কোনদিন। ধৈর্য ধরে গেছে সব সময়। সেটুকুর পরও……..আল্লাহর বোধহয় অন্যকিছু ইচ্ছা ছিল। যে অভিশপ্ত দিনের কথা ভাবলেও বুক কাঁপে, জীবনে তাকে সেইদিনও দেখতে হলো।…….ওর’ পরে সবসময় ক্ষমার পরোয়ানা জারি করে রেখো তুমি। যদিও স্বইচ্ছায় অপরাধ করার মেয়ে সে নয়। তবুও নাহয়……আমার বিশ্বাস তুমি ঠকবে না। পারানী হিশেবে আমার এই মহামূল্যবান সম্পদটি ছাড়া কিছুই দিতে পারলাম না আমি তোমাকে।’ বলে নিনাদের হাতে তিতিক্ষার হাত রেখে নিজের হাতটাকেও তিনি তার ওপর রাখলেন। মৃদু হেসে আস্বস্ত করলেন তাদের।
মধ্যাহ্ন শেষের সেই ভীষণ অন্ধকার আকাশের নিচে পুরো পৃথিবীটাতে যেন হঠাৎ সন্ধ্যা নেমে এল। ধূলো উড়ছে বাতাসে, আকাশে গজরাচ্ছে মেঘ। তিতিক্ষা মাঝ উঠোনে দাঁড়িয়ে নিকাবটা উঁচিয়ে ধরে শেষ বারের মতো তাকাল দরজা ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা তার সবচেয়ে কাছের, সবচেয়ে ভালোবাসার মানুষ গুলোর দিকে। তার চোখ জলে টইটম্বুর। ধূলোময় বাতাসে চোখ বারবার বুজে আসছে। গালে জল গড়াচ্ছে। তার মন চাইছে একটা গগনবিদারী চিৎকার করে, সব ছেড়ে সেদিকে ছুটে যেতে। কিন্তু পারল না। অদৃশ্য এক শিকল যে তার পায়ে বাঁধা। তাই সে শুধু চেয়ে রইল। ঠোঁটের কোণে তার মলিন হাসি ফুটল। আজ সে মুক্তি দিয়েছে। সেথায় দাঁড়ানো তার সব প্রিয় মানুষ গুলোকে। এইবার জীবনে তার যাই ঘটুক। আর ভয় নেই বাবার প্রেসার বেড়ে যাওয়ার, বোনের গুমরানো কান্নার চাপা আর্তনাদের। লম্বা একটা শ্বাস ফেলে সে ঘুরে দাঁড়ালো। নিনাদ তখনো তার হাত ধরে আছে। সে হাটতে শুরু করল নিনাদের সাথে পায়ে পা মিলিয়ে।
***
সময়ের মত দূরত্বও নির্ধারণ করে দেয় অনেক কিছু। সময়ের সাথে সাথে প্রিয়জনকে হারানোর শোকটাও একদিন যেমন লঘু হয়ে আসে। তেমনি অঙ্ক কষা বাহ্যিক দূরত্বও জানে শূন্য অনুভুতিকে পূর্ণ করতে। যাকে ছাড়া একসময় নিশ্বাসটাও ভারি মনে হত, সে দূরে চলে গেলে ভারি নিশ্বাসেই আরাম পেতে শিখে যায় ব্যাক্তিটি। শূন্যতার শোক থিতু হয়ে আসে একসময়। মারুফ সাহেবেরও তাই হল একদিন। স্ত্রীর মৃত্যুর পর থেকে, তিতিক্ষা ছিল তার অসমবয়সী সঙ্গী, তার বিহনে একটি দিনও কল্পনা করতে পারতেন না তিনি! অথচ তিতিক্ষা চলে গেছে মাস দেড়েক হতে চলল। মোহাম্মদপুরের দিক থেকে তিনি কঠিন ভাবে মুখ ফিরিয়ে রেখেছেন। নিজেও যাচ্ছেন না। যেতে দিচ্ছেন না তিহা রওশানকেও। হঠাৎই যেন ভীষণ নির্দয় হয়ে উঠেছে মারুফ সাহেবের মন। তিহা ও তার স্বামীকে তিনি কড়া ভাষায় বলে দিয়েছেন ওদিকের পথ যেন তারা ভুল করেও না মাড়ায়।
বহু বাধা বিপত্তি পেড়িয়ে অবশেষে বিয়ে হয়েছে মেয়েটার। কিছুটা সময় তাদের দেয়া উচিত খানিকটা থিতু হওয়ার জন্য। তিতিক্ষার উড়ো মন হয়তো তাদের দেখলেই অস্থির হয়ে পড়বে। চলে আসতে চাইবে সে এখানে। এরচেয়ে আরও কিছুদিন যাক। মেয়েটা খাপ খাইয়ে নিক সেখানে। তারপর নাহয় যাবেন তারা সবাই।
***
রান্নাঘর থেকে ব্যাস্ত হাতে কাজ করার নানান উদ্ভট শব্দ ভেসে আসছে। তিতিক্ষা কাথা মুঁড়ি দিয়ে বিছানায় বসে তাকিয়ে রইল জানালার বাইরে। আজও আকাশ বিস্তীর্ণ কালো মেঘেদের দখলে। এখনো অপরাহ্ন শেষ হওয়ায় কিছু সময় বাকি। সন্ধ্যায় বোধহয় বৃষ্টি নামবে। সেদিকে তাকিয়ে ভাবল সে।
অকারণে তার মেজাজটা বিগড়ে আছে। প্রচন্ড খিদে পেটে নিয়ে কোন কালেই মেজাজ ঠিক রাখতে পারে না সে। তাছাড়া এভাবে ধৈর্য ধরে বসে খাবারের অপেক্ষা করাটাও তখন কষ্টকর, যখন সে জানে দু কদম হেটে সেখানে গেলে নিজের খাবার ব্যাবস্থা নিজেই করে নিতে পারে সে। কিন্তু তিতিক্ষা কখনোই ও-কাজ করবে না। যাবে না সে রান্নাঘরে। খিদেয় মরে গেলেও না। যা খুশি করুক ওই লোকটা। খাবার বানাতে গিয়ে রান্নাঘর জ্বালিয়ে ফেলুক আগুন ধরিয়ে! তাতে ওর কি?
কিছুদিন হল নিনাদ একটা বেসরকারি কোম্পানিতে চাকুরী নিয়েছে। পদমর্যাদাও খারাপ নয়। কিন্তু সে নিজে এই নিয়ে খুশি নয়। তার স্বপ্ন অনেক বড়। এখন যাই হোক একটা কাজ তার দরকার ছিল। পেয়েও গেল তখনই। তাই চোখ বুজে জয়েন করে ফেলল। সকাল আটটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত অফিস করে আবার বাড়িতে এসে রান্না। তাড়াহুড়ো করে দু একটা পদ রেঁধে কোনমতনে নিয়ে গিয়ে তার’ সামনে ধরা। তারপর নিজের উদরও তো পূর্ণ করতে হয়! এভাবেই চলছে তার দিন আজকাল।
তিতিক্ষা যেন এই ক্ষুদ্র রাজ্যের অঘোষিত মহারাণী। আর তার সকল অনুচ্চারিত হুকুম পালন করাই যেন নিরীহ সেবক নিনাদের একমাত্র কাজ। সে-কাজ সে যথাযথই পালনের চেষ্টা করে। তবুও মহারাণীর মন পাওয়া যায় না। সারাদিন নিজের নানান কাজ নিয়েই তিনি মশগুল। কারো দিকে ফিরে দেখার সময় তার কৈ?
নিনাদকে সে অপরিচিতের মতোই মূল্যায়ন করে এখনো। অদরকারে কথা বলে না, দরকারের দু একটা কথাও বলে খুব গম্ভীর হয়ে। এবাড়িতে এসেই একটা ঘর সে নিজের দখলে নিয়েছে। নিজের সবকিছু নিয়ে সেখানে সে বসেছেও খুব শক্ত খুঁটি গেড়ে। অহরাত্র বন্ধ থাকে সেই ঘরের দরজা। খোলে শুধু তিনবেলা খাবার সময় হলে। যখন নিনাদ একা থাকত এবাড়িতে, তখন বেশিরভাগ সময়ই হোটেল থেকে খাবার আনিয়ে চালিয়ে দিত দিনের পর দিন। কিন্তু এখন সেসব বন্ধ। হোটেলের রান্না মহারাণীর গলা দিয়ে নামে না। আবার তিনি নিজে পথ ভুল করেও মাড়ান না রান্নাঘরের দোর! অগত্যা নিনাদকে এখন ঘর বাহির সব সামলাতে হয় একা।
তিতিক্ষা এভাবে নানা উপায়ে, নানান দিক থেকে অত্যাচার জারি করে রেখেছে নিনাদের ওপর। আজকাল সে কথায় কথায় মেজাজ হারায়। সবার ওপরই যেন তার ভীষণ ক্ষোভ! এই দুনিয়াটা যে সার্থের কারখানা, দুনিয়ার যাবতীয় কার্যক্রম যে টিকে আছে একমাত্র সার্থের ওপরই। একথা এখন সে শতভাগ নিশ্চিত। তা নাহলে কি আর বাবাও আজকাল তার সাথে যোগাযোগ করেন মেপে মেপে?
কখনোই তিনি ছাড়িয়ে যান না নিজের মাত্রা। রোজ বিকেলে একবার কল করেন। এই নিয়মের কোন হেরফের নেই। এখানে আসার কথা বললে, কথাবার্তাকে দ্রুত অন্য প্রসঙ্গে নিয়ে আসল ব্যাপারটা আড়াল করে ফেলেন। ‘আমাকে এসে নিয়ে যাও’ একথা বলতে তিতিক্ষার তাই এখন মুখে বাঁধে। অন্য সবাই যা খুশি করুক। কিন্তু তাই বলে বাবাও! তিনিও পারলেন এভাবে দুদিনে পর করে দিতে নিজের মেয়েকে! তবে সে আর কাকে বিশ্বাস করবে? তাই আজকাল তার এই ভীষণ নির্দয়তা!
সন্ধ্যার পর বই পড়তে পড়তে চোখটা লেগে এসেছিল তিতিক্ষার। বেল বাজছে, সেই সাথে দরজায় অনবরত কড়া নাড়ার শব্দও ভেসে আসছে। তিতিক্ষা আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসল। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে ধীর পায়ে হেটে গিয়ে দাঁড়াল দু’ঘরের সামনে বরাবর লম্বা প্যাসেজে। রোজ এই সময় নিনাদ ফেরে। তবে বেল কখনো বাজায় না। দরজার একটা চাবি তার কাছেই থাকে সবসময়। দরজার পাশেই তাকে চাবিটা রাখা। আজ বোধহয় চাবি ছাড়াই বেড়িয়ে গেছিল।
তিতিক্ষা দায়সারা ভাবে ঘরে ফিরে এল। জগ থেকে গ্লাসে খানিকটা পানি ঢেলে বিছানায় বসে ঢকঢক করে পান করল সবটা। তারপর আনমনেই আয়নার সামনে এসে ওড়নাটা ঘুড়িয়ে ঘুড়িয়ে পেঁচাতে লাগল মাথায়। কোন তাড়া নেই তার। বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা নিজের স্বামীর কথা যেন সে ভুলেই গেছে। এসব অনর্থক কাজে অনেকটা সময় ব্যায় করে অবশেষে দরজা খুলল সে। দাঁড়িয়ে ভাবল নিনাদ হয়তো কথা শোনাবে তাকে। শোনাক না একবার! উত্তর তো তার তৈরিই থাকে সবসময়। কিন্তু আফসোস! সবসময়ের মত আজও লোকটা নির্বিকার। চুপচাপ চলে গেল নিজের ঘরে। তারপর খানিক বাদে ফ্রেশ হয়ে রান্নাঘরে।
একরাতে তিতিক্ষা ঘুমাচ্ছিল নিজের ঘরে। গভীর রাত। ঘরের বাতি নিভিয়ে, পুরো ঘর ঘুটঘুটে অন্ধকার করে ঘুমানো তার অভ্যাস। সেদিন রাতেও তার ব্যাতিক্রম ঘটেনি। হঠাৎ মৃদু একটা ভোঁতা শব্দে ঘুম ছুটে গেল। বাইরের ল্যাম্পপোস্টের আলো জানালার পর্দার ফাঁক গলেও কিছুটা ঘরে এসে পড়ছে। খুবই ক্ষীণ সে আলোর রেখা। না থাকার মতই। ঘুম ভাঙার কারণটা প্রথমে সে ঠিক ধরতে পারল না। কান খাড়া করে রইল। জানালার বাইরে থেকে মৃদু থাবা দেয়ার মতো একটা শব্দ ভেসে আসছে থেমে থেমে। ব্যাপারটা ভালো করে বোঝা মাত্র মুহূর্তে তিতিক্ষার শিরদাঁড়া বেয়ে একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল। সে উঠে দাঁড়ালো একলাফে। সবকিছু ছাপিয়ে চোখের সামনে ভেসে উঠল সেই অভিশপ্ত রাতের দৃশ্যটা। কেউ চাইলেই জানালা ভেঙে ঘরে ঢুকে পরতে পারবে কি না এসব ভাবার মত স্থির বুদ্ধি তখন আর রইল না তার। স্বাভাবিক চিন্তা ভাবনার ক্ষমতা হারিয়ে চোখের সামনে সে দেখতে লাগল অতিপ্রাকৃত দৃশ্য। জানালার বাইরে একটা বিকটাকৃতি কুৎসিত ছায়া, সেই ছায়া নিজের থাবা দিয়ে ভাঙতে চাইছে জানালার কাঁচ টাকে……..।
বরফের মতো জমে গেল সে। পরক্ষণেই জায়গা ছেড়ে শীতল পদক্ষেপে পিছু হেটে একটানে দরজাটা খুলে ছুটে বেরিয়ে গেল। জোড়ালো ভাবে করাঘাত করতে লাগল নিনাদের ঘরের দরজায়। কয়েক মিনিট যেতেই ঘুম ভেঙে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে দরজা খুলল নিনাদ। তিতিক্ষা এক মুহূর্ত দেরি না করে ভেতরে ঢুকে পরল। নিনাদের পাশে গিয়ে তার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে কাঁপতে লাগল থরথর করে। কিছুক্ষণ আগেই বেচারা শুয়েছিল। কাঁচা ঘুম ভেঙে উঠে এল ঠিকি কিন্তু আদতে সে কিছুই বুঝতে পারল না। চোখ কচলিয়ে সে বলল,’ কি হয়েছে? ‘ তিতিক্ষা উত্তরে কিছু বলছে না দেখে ঘরের বাতি জ্বালানোর জন্য এগোতেই তিতিক্ষা তার হাত ধরে আটকে ফেলল। ফিসফিস করে বলল,’আপনি আমাকে ছেড়ে কোথাও যাবেননা, প্লিজ…..’
নিনাদ বিরস মুখে বলল, ‘বাতি জ্বালাতে যাচ্ছি। নাহয় এই মাঝরাতে তো চাইলেও আর কোথাও যাওয়া সম্ভব না।’বলে সে এগোলে তিতিক্ষাও হাত ধরে তার পেছন পেছন এগোল।
সুইচ টিপতেই মুহুর্তে ঘর আলোয় ভরে গেল। তিতিক্ষা তবুও ছাড়ল না নিনাদের হাত। কপাল কুচকে সেদিকে একবার তাকিয়ে নিনাদ ভ্রু উঁচিয়ে গম্ভীর স্বরে বলল,’কি সমস্যা?’
তিতিক্ষা কি বলবে ভেবেই পেল না। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে শুধু আমতাআমতা করে নিজের ঘরের দিকে দেখাতে লাগল বারবার। নিনাদ সেদিকে এগোলে সে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিল এবার। ও’ঘরে আর কোনমতেই যাবে না সে। ঘরে গিয়ে বাতি জ্বাললো নিনাদ। বোঝার চেষ্টা করল কি দেখে ভয় পেয়েছে মহারাণী। তারপর জানালার দিকে স্থির চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সেদিকে এগোল সে। ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে তিতিক্ষা শুধু একটা ‘ক্যাঁচ’ শব্দ শুনতে পেল। আরও ঘাবড়ে গেল সে। মুহূর্ত পরেই ফিরে এল নিনাদ। বলল,’এসো আমার সাথে।’ তিতিক্ষা তবুও জায়গা ছেড়ে নড়ল না। নিনাদ এবার তাকে জোর করেই টেনে নিয়ে গেল সেদিকে। খোলা জানালার সামনে দাঁড় করিয়ে বাইরে দেখিয়ে বলল,’আজ ঝড় হবে। বাইরে খুব বাতাস হচ্ছিল। আর বাতাসেই সুপারি গাছের পাতা বাড়ি খাচ্ছিল জালানার কাঁচে। তাই অমন শব্দ হচ্ছিল। এদিকে এসে দেখে যাও। বোকা মেয়ে।’ বলে সে হাসল।
তিতিক্ষা অবিশ্বাসী চোখে তাকাল সেদিকে। দেখল এখনো খোলা জানালার গ্রিলে বাড়ি খাচ্ছে গাছের পাতা।
সেদিকে সে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। গা ছমছমে ভাবটা তখনো তার রয়ে গেছে। নিনাদ কখন ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেছে টের পায়নি। হঠাৎ পাশ ফিরে নিনাদকে না দেখে সে চমকে উঠল। অজানা একটা আতঙ্কে আবারও কাঁপতে লাগল তার হাত-পা। ঘুরেফিতে কেবলই মনে পড়তে লাগল সেই অভিশপ্ত রাতের কথা। সেদিনও এমন ঝড় উঠেছিল। প্রকৃতি প্রলয় ডেকেছিল আপন খেয়ালে..।
তিতিক্ষা দৌড় লাগাল। পাছে নিনাদের দ্বার রুদ্ধ হয়ে যায়..। একি! বাতি নেভানো। তবে কি ফের শুয়ে পড়েছে লোকটা?
-‘আবার কি…. হল? ‘ নিনাদের কথায় সম্বিৎ ফিরে পেল সে। খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে পরল মুহুর্তেই। ইতস্তত করে বলল,’কিছু না। আপনি ওখানে ঘুমান। এই…..এই মাঝের দরজাটা খোলা থাক আজ।’ বলে অন্ধকারে বিছানায় শুয়ে থাকা নিনাদের দিকে আন্দাজে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল সে। নিনাদ উত্তরে শুধু একটা ‘হু’ বলে শুয়ে পরল পাশ ফিরে।
যে ভয়টা হঠাৎ একরাতে জেগে বসেছিল তিতিক্ষার মনে, সেটা হঠাৎ চলে গেল না। সারাদিন পুরো বাড়িতে একা থাকতে হয় তাকে। আলস্য ঘেরা সময়ে তাই ঘুরে ফিরে সেই ভাবনাটাই ফিরে আসে বারবার। অভয় পেয়ে পেয়ে তার একরাতের সামান্য ভয়ের ব্যাপারটা একসময় রূপ নিল গুরুতর আতঙ্কে। রাত বাড়ার সাথে সাথে বাড়তে থাকে তার উদ্বেগ। মারুফ সাহেব কিংবা তিহার সাথেও সম্পর্কটা আগের মত সহজ নেই যে, যখন তখন কল করে কথা বলে হালকা করবে মন। অগত্যা নিজের শখের আত্মভাবকে ধূলিসাৎ করে সে নিজেই একদিন নিনাদকে অনুরোধ করল যেন রাতে মাঝের দরজাটা সবসময় খোলা রাখে সে। এরপরও রাত বাড়লে জেগে বসে সে নজর রাখত ঘরে। বারবার গিয়ে দেখে আসত মাঝের দরজাটা খোলা আছে কিনা!
তিতিক্ষার এসব অদ্ভুত কীর্তিকলাপে নিনাদের রাগ হয়না আবার আহ্লাদও হয়না। তার সব ভাবনা গিয়ে এখন মিশেছে ওই একদিকে। চিরকাল যাকে মায়ের মত ভেবে এসেছে, সেই শিউলি বেগমের এভাবে হঠাৎ অভিমান করে চলে যাওয়া। সেই ক্ষত এখনো তার মানসপটে সতেজ হয়ে আছে। সেখান থেকে রক্তক্ষরণ হয় অহর্নিশ। কিছুতেই আফসোস মেটে না তার। সে শুধু ভাবে একবার যদি ফুআম্মা ফিরে আসতেন… তবে খুব করে মাফ চেয়ে নিত সে। আর কখনো করত না এমন ভুল!
একদিন তাদেরকে অবাক করে দিয়ে সত্যিই ঢাকায় এসে হাজির হলেন শিউলি বেগম। পড়নে মলিন কাপড়, মুখের আদল শুষ্ক। নিনাদকে দেখে কেঁদে কেটে হুলুস্থুল অবস্থা করলেন তিনি। এই কয়েকদিনেই তার চেহারায় আমূল পরিবর্তন এসেছে। মুখ শুকিয়ে চোখ দুটো কোটরে ঢুকে গেছে, কালি পড়েছে চোখের কোলে। নিনাদকে ছাড়া তিনি কতটা অসুখী বুঝতে বাকি রইল না কারো। এত কষ্ট করে যাকে গড়ে তুলেছেন। তার আদরের নিনাদ। অভিমান করে চলে যাওয়ায় বিয়েতেও উপস্থিত থাকা হয়নি সেই ছেলের। শিউলি বেগম জানালেন সেজন্য সবকিছু নতুন করে করতে চান তিনি।
সেদিন ফুআম্মার কথা রাখতে আবার বর বউ সাজতে হল নিনাদ তিতিক্ষাকে। তিতিক্ষার বাড়ি থেকেও এল সবাই। শিউলি বেগম তাদের দুজনকে একসাথে দাঁড় করিয়ে দেখে নিজের চোখ জুড়ালেন।
সেরাতে ওদের থাকা নিয়ে একটা বিপত্তি বাধল। ঘরে বিছানা যে কেবল একটা। কিভাবে থাকা হবে তাহলে? পাশের ঘরে তো ফুআম্মা রয়েছেন। নিনাদ অবশেষে সিদ্ধান্ত নিল রাতটা সে বাইরে কাটাবে। ফিরে আসবে ভোর হওয়ার আগেই। তিতিক্ষা বুঝল তাহলে অনর্থের যেটুকু বাকি আছে সেটুকুও পূর্ণ হবে। ব্যাপারটা কোনক্রমে শিউলি বেগমের কানে গেলে আর রক্ষে থাকবে না। তারচেয়ে বরং একজন নিচে চাদর বিছিয়ে শুলেই মিটে যায় সব!
এভাবে একঘরে বসে কথা বলতে তিতিক্ষার অস্বস্তি হচ্ছিল। সে ইতস্তত করে বলল,’ এখানে… খুব গরম। ছাদে গেলে….।’
অতঃপর তারা ছাদেই গেল। সেখানে বসার জায়গা বলতে একটি মাত্র সিমেন্টের বেঞ্চি। তারা বসল পাশাপাশি। শুক্লপক্ষের রাত। ভরা জোৎস্নার আলোয় পূর্ণ চারিদিক। তিতিক্ষা চোখ ঘুরিয়ে দেখছে এদিক সেদিক। এবাড়িতে এতদিন ধরে থাকলেও আজ সে প্রথম এল ছাদে।
দুজনেই নিরব। বলার মত কোন কথাই এখন আর খুঁজে পাচ্ছে না কেউ। তখন নিনাদের ফোন হঠাৎ বেজে উঠল। স্ক্রিনে নামটা দেখে সাথে সাথে ফোন কেটে দিল সে। তিতিক্ষা ভ্রু কুচকে আড়চোখে তাকাল সেদিক। মুহুর্তে মেজাজটা বিগড়ে যেতে শুরু করল তার। এইলোক জীবনেও ভালো হবে না। অযথাই সে দয়া দেখাচ্ছিল এতক্ষণ। ললিতার সাথে এখনো যোগাযোগ রয়েছে এর। সেদিনও সে দেখেছে এই বেহায়া মেয়েটার লুতুপুতু মার্কা টেক্সট মেসেজ। তাছাড়া ভার্সিটিতে তাদের বিশ্বখ্যাত প্রেমের কথা কে না জানত!
আবার কল এল। নিনাদকে এবার ফোন সাইলেন্ট করতে দেখে তিতিক্ষা মুখে কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে বলল,’আপনি কথা বলুন। এত রাতে বারবার কল করছে বেচারি। নিশ্চয়ই কোন বিশেষ দরকার। আমি নাহয় ওদিকটায় যাচ্ছি।’
-‘না না। কোন সমস্যা নেই। ও আর কল করবে না। তুমি বসো।’ নিনাদ অপ্রস্তুত হয়ে বলল।
তিতিক্ষা মনেমনে ভাবল ‘বাহ! এত চেনাজানা। কখন কয়বার কল করবে সে হিশেবও মুখস্থ!’ মুখে বলল,’এত বছর পরও আপনাদের প্রেমটা টিকে আছে তাহলে?’
-‘মানে? কিসের প্রেম? অনেক বছর আগে ওই ছিল একটা সম্পর্ক…….। সেটাও একটা ভুল বোঝাবুঝি থেকে……। কিন্তু তোমাকে কে বলল এসব? ‘
তিতিক্ষা কাটা কাটা স্বরে বলল,’এসব কথা জানতে গোয়েন্দা লাগাতে হয়না। বাতাসেই ভেসে বেড়ায়….’
-‘আমার ব্যাপারে দেখছি অনেক আগে থেকেই তোমার খুব ইন্টারেস্ট! কিন্তু এত খবর রেখে কি লাভ। তুমি আর আমার সাথে সংসার করবে না। বাবার বাড়ি ফিরে যাওয়ারই যা অপেক্ষা এখন। তারপর আর এমুখো হলে তো!’
তিতিক্ষা চোখ মুখ কঠিন করে বলল,’আপনাকে কে বলেছে আমি চলে যাবো? এখান থেকে আমি কোথাও যাবো না। এই বাড়ি, বারান্দা, ছাদ, বাগান… সব আমার। আমিও চলে যাই আর আপনিও জমিয়ে প্রেম করার সুযোগ পান ওই অসভ্য মেয়ের সাথে। তাই না? কক্ষনো যাবো না আমি।’
-‘আমার বাড়ি, বারান্দা, ছাদ, বাগান…সবই তোমার? শুধু আমিই বাদ। আমার জায়গা কোথায়? তাহলে ললিতার কাছেই নাহয় ফিরে যাই……..’
এই কথার এক অদ্ভুত প্রতিক্রিয়া হল তিতিক্ষার মাঝে। সে রাগে ফোসফাস করতে করতে হঠাৎই হাউ মাউ করে কাঁদতে শুরু করল। বলল,’চলে যান। আপনারা সবাই আমাকে ছেড়ে চলে যান। আমার মাও চলে গেছে, বাবাও আর ভালোবাসে না আমাকে। এখন বুবু, আপনি আপনারাও সবাই চলে যান। আমি একাই থাকব। ‘তারপর আকাশে মুখ তুলে বলল,’আম্মা, তুমি নিয়ে যাও আমাকে। আমার আর এখানে ভালো লাগছে না।’ বলে সে তারস্বরে চিৎকার করে কাঁদতে লাগল। নিনাদ বিস্মিত হয়ে সেদিকে তাকিয়ে ব্যাস্ত স্বরে বলল, ‘আরে আরে করছ কি? চুপ চুপ। মানুষ কি বলবে। আশেপাশের সবাই ছুটে আসবে এখনি।’ বলে তিতিক্ষার মুখ চেপে ধরল।
-‘আপনি আমাকে ধরেছেন কেন? আর ধরবেন না।’
-‘আচ্ছা।’
-‘আমার সাথে আর কথাও বলবেন না।’
-‘হু’
-‘আপনি এখন ওই পেতনির কাছে ফিরে যান। আর আসবেন না।’
-‘আচ্ছা। কি! কেন? ওখানে কেন যাবো? ‘
তিতিক্ষা কর্কশ স্বরে বলল,’আমাকে নিয়ে তো আপনার চলছে না। তাই ওর কাছেই ফিরে যান।’
-‘ফিরে যেতে হবে না। তোমাকে নিয়েই আমার চলবে। প্লিজ এখন কান্না থামাও। আশেপাশের লোকজন নাহয় এসে এবার আমাকে গণধোলাই দেবে।’
তিতিক্ষা চোখ মুছে হিচকি তুলে বলল,’ তাহলে আর কখনো কথা বলবেন না ললিতার সাথে। প্রমিজ করুন।’
-‘করতে পারি। কিন্তু ললিতা রোজ সকালে একবার কল করে ‘ভালোবাসি’ বলে আমার ঘুম ভাঙায়। এটা না শুনলে আমার আবার দিনের শুরুটা ভালো হয়না। ওর সাথে কথা না বললে এটা কার কাছথেকে শুনবো?’
-‘আপনি এত অসভ্য! যারতার কাছে ভালোবাসি না শুনলে আপনার দিন শুরু হয়না? ছিঃ!’
-‘রাগ করছো কেন। ওর বদলে রোজ একবার তুমিই নাহয় বলে দিও। তাহলেই মিটে গেল। আচ্ছা এখনি একবার বল তো।’
তিতিক্ষা কিছু না বলে হুট করেই উঠে গটগট করে হেটে চলে যেতে লাগল। নিনাদ তা দেখে দৌড়ে গিয়ে ছাদের দরজায় তাকে আটকাল। ‘আরে আরে! চলে যাচ্ছো কেন? কত সুন্দর জোৎস্না চারিদিকে দেখেছ? এখানেই বসি চল আরও কিছুক্ষণ।
-‘তার আগে বলুন। আপনি কি সত্যিই ললিতার কাছে যাবেন আর কখনো? ‘
-‘পাগল! আমি তো এমনিই বলছিলাম। তুমি আবার কাঁদছ কেন? বোকা মেয়ে! ‘বলে কাছে গিয়ে সে হাত রাখল তিতিক্ষার মাথায়।
-‘একটু জড়িয়ে ধরি?’
-‘না’ তিতিক্ষা দায়সারা ভাবে বলল।
-‘নিনাদ তবুও কথা শুনল না। তাকে জড়িয়ে ধরল। তিতিক্ষার মাথাটা নিজের বুকে চেপে বলল, ‘আহঃ! কি শান্তি।’
তিতিক্ষা শব্দ করে হেসে ফেলল।
সমাপ্ত