কয়েন,পর্ব_৫

0
611

কয়েন,পর্ব_৫
রহস্য_গল্প
পৃথা_সামন্ত_ঘোষ

আলেখ্য যে মুম্বাই যায়নি , সেটা আগেই আন্দাজ করতে পেরেছিল আলিশা , আর তাই সে দায়িত্ব দিয়েছিলো রুপম দেবরায়কে সত্যিটা জানার উদ্দেশ্যে । আজ সে যাবে মিসেস বাগচীর সাথে দেখা করতে । এখনও অবধি ওনার সাথে সেভাব কথাই হয়নি তার ।

কোনোমতে ব্রেকফাস্ট সেরে রৌনকের ওষুধপত্র তার হাতের কাছে গুছিয়ে রেখে আলিশা বেরিয়ে পড়ে থানার উদ্দেশ্যে । সেখানে পৌঁছে দেখে রুপম দেবরায় বেশ প্রফুল্ল চিত্তে চেয়ারে বসে পায়ে দোল দিতে দিতে সিগারেটে সুখটান দিচ্ছেন আর বাঁ হাতে ধরে থাকা মোবাইলটায় কি যেন দেখছে ! আলিশাকে সে লক্ষ্য করেনা । আলিশা টেবিলের এপ্রান্তে দাঁড়িয়ে বললো — অফিসার ! আমার একটা এফ আই আর করানোর আছে ।

চোখ তুলে তাকিয়েছে এবার রুপম ।

— কি হলো ? আপনি আজ এতো সকালসকাল ?

— আমার রুম মেটের ওপর গতকাল রাতে হামলা করা হয়েছে , বাড়ির খুব কাছাকাছি কোথাও । মাথায় ভারি কোনো জিনিস দিয়ে আঘাত করা হয়েছে । এই নিন প্রেসক্রিপশন ডিটেইলস ! বলে কাগজটা এগিয়ে ধরে আলিশা ।

রুপম হাত বাড়িয়ে কাগজটা নিয়ে দেখতে দেখতে একবার আলিশার দিকে আলগোছে তাকিয়ে তাকে বসতে বলে । আলিশা না বসেই বলে — বসবো না , কাজ আছে অনেক গুলো ।

কাগজটা দেখে সেটা আলিশাকে ফেরত দিয়ে রুপম বলে — আপনার রুম মেট একজন…

— হ্যাঁ , একজন পুরুষ । তাতে কমপ্লেইন নিতে কোনো সমস্যা ?

— নাহ , তা কেন হবে ! আমি ভাবতাম আপনি আপনার বুঝি বাবা মায়ের সঙ্গেই থাকেন !

— নাহ , সেটা বহুদিন থাকিনা । আপনি কাইন্ডলি রিপোর্টটা লেখানোর ব্যবস্থা করুন , আমার আজ একটু তাড়া আছে । আমি আমার মতো করে রৌনকের এটাকের পিছনে কার হাত আছে খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি , হয়তো কিছুটা এগিয়েওছি ! কিন্তু আই নিড টু বি স্পেসিফিক । তাই এফ আই আর টা করা জরুরি ছিল । এখন এটা খোঁজা আপনার ও কাজ । আপনিও খুঁজুন , আমিও খুঁজি ! আর একটা কথা… ত্রিদিববাবু আর এনা যদি প্রাইমসাস্পেক্ট হয়… তাহলে আরও কেউ কিন্তু এখনও রয়ে গেছে পর্দার আড়ালে ! আলেখ্য কোথায় ঘাপটি মেরে আছে , জানতে পারলেন কিছু ?

— খেচর রা আছে ছড়িয়ে । ওর বাড়ির সামনেও লোক আছে আমাদের । অফিসের আশেপাশেও থাকছে তারা । ধরা তো ওকে পড়তেই হবে । শুধু সময়ের অপেক্ষা । কিন্তু , আমি বলিকি… আমার ওপর সবটুকু দায়িত্ব না চাপিয়ে এবার নিজেও একটু ফিল্ডে নামুন !

আলিশা বিরক্ত হয়ে রূপমের দিকে তাকিয়ে বলল — আমার যেটা করার আমি করবো , কেউ বললেও আর না বললেও । আমি ফিল্ডে নেমেছি কিনা বা কতটা নেমেছি , সেটা জানতে হলে আপনাকে আমার সাথে সাথে ঘুরতে হবে । আমার কাছে আপনার মত হুডখোলা কোনো জিপসি গাড়ি নেই , আছে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট । আমি অনেক সময় হেঁটেও যাই এদিক ওদিক । চাইলে একটা গাড়ি আমিও পেতে পারি… বাবার থেকে , কিন্তু আমি ইন্ডিপেন্ডেন্টলি করতে চাই সবটা । তাই বিলাসিতা আমি করিনা । পারবেন আমার সাথে ফিল্ডে ঘুরে ঘুরে কাজ করতে ?

— আপনি পারলে আমিও নিশ্চয়ই পারবো ।

উত্তর দিলোনা আলিশা ,হাসছে । রুপম বলে ওঠে — হাসছেন যে !

— কিছুনা । রিপোর্টটা লেখানোর ব্যবস্থা করুন । আমাকে এক্ষুনি বাগচী ম্যানশন যেতে হবে ।

রিপোর্ট লিখিয়ে থানা থেকে বেরোনো সময়ে রুপম বলে — আমিও আজ একবার ওদিকে যাবো ভাবছি । সবার সাথে আরও একবার কথা বলতে হবে !

— আমি কি সেটা ওদের ইনফর্ম করবো ?

— করবেন ! আচ্ছা করুন , ভালোই হবে তাহলে !

থানা থেকে বেরিয়ে পড়লো আলিশা । এবার সে যাবে বাগচী ম্যানশন । সেখানে পৌঁছে বাড়ির দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে মিস্টার বাগচীর ফোনে ফোন করে সে । বলে মিসেস বাগচীর সাথে দেখা করতে এসেছে , নীচে দাঁড়িয়ে আছে । মিস্টার বাগচী বলে ওঠেন — কেউ গেট খোলেনি এখনো ?

— আমি বেলটা বাজানোর আগে একবার কল করে নিলাম আপনাকে । উনি বাড়ি আছেন তো ?

— হ্যাঁ , তুমি একেবারে দোতলায় চলে এসো ।

দোতলায় ওঠার শেষ সিঁড়িতে পা রাখতেই আলিশা মিস্টার বাগচীকে দেখতে পেল । আলিশাকে উনি নিয়ে এলেন মিসেস বাগচীর ঘরে । মেয়ের মৃত্যুর পর আলাদা ঘরে থাকছেন মিসেস বাগচী অর্থাৎ বিদিশা । দরজা ঠেলে ঘরের ভিতর পা রাখতেই মিষ্টি সুবাস ঝাপটা দিলো নাকে , ধূপের গন্ধে ভরে রয়েছে ঘরটা । বিছানার উপর বসে… বিদিশা বাগচী । চোখদুটো তাঁর বন্ধ অবস্থায় সজাগ , হাত দুটো কোলের উপর রাখা… উনি ধ্যান করছিলেন । চোখ বন্ধ করেই বললেন — বসুন ! দু মিনিট পর কথা বলছি ।

আলিশা মিস্টার বাগচীর দিকে তাকালো । মিস্টার বাগচী ইশারায় তাকে বসতে বললেন । আলিশা গতদিনের চেয়ারটাতে বসে অপেক্ষা করতে থাকলো । ওদিকে আলেখ্য এখন কোথায় গা ঢাকা দিয়ে বসে আছে , সেটা জানা গেলোনা , এখান থেকে বেরিয়ে একবার আলেখ্যর বাড়ি যেতে হবে । আচমকা তার মনে এক অদ্ভুত আশঙ্কা দানা বাঁধতে শুরু করলো । তার মনে হলো… রুপম দুম করে আলেখ্যর বাড়ি চলে না যায় ! সেক্ষেত্রে আর কিছু না হোক অনেকটা সময় নষ্ট হবে । রুপম সেখানে পৌঁছনোর আগে তাকে সেখানে পৌঁছতেই হবে । আলিশা ঈষৎ উশখুশ করে উঠলো । মিস্টার বাগচী দরজার কাছে দাঁড়িয়ে তাঁর স্ত্রীর ধ্যান ভাঙার অপেক্ষায় । একটু পরে চোখ খুললেন বিদিশা ।

দুই চোখের কোল জুড়ে লেপে রয়েছে গভীর কালিমা… বললেন — বলুন , কি বলবেন !

— আপনি মেডিটেশন করেন নিয়মিত ? আলিশা প্রশ্ন করে ।

— আমি মেডিটেশন করছিলাম না , রেইকি করছিলাম । অবশ্য সেটাকে আপনি মেডিটেশন বলতেই পারেন !

— ওহ ! আপনি রেইকি করেন ? বাহ !

— করি , আমি ফিউচার প্রেডিক্ট ও করি , আমার প্রেডিক্শন মিলেও গিয়েছে প্রতিবার , শুধু ইশাকেই আমি ধরে রাখতে পারলাম না… ইশার ভবিষ্যত টা আমি দেখতেই পেলাম না ! মাথাটা দুপাশে নাড়াতে নাড়াতে বলে উঠলেন বিদিশা ।

— তোমরা কথা বলো , আমি ঘরে যাচ্ছি । আলিশা , যাওয়ার আগে একবার দেখা করে যেও ।

ঘাড় কাত করে আলিশা আবার ফিরেছে বিদিশার দিকে । মিস্টার বাগচী চলে গেলেন নিজের ঘরে ।

— দুই মেয়ের মধ্যে ঈশা বরাবর আপনার বেশি প্রিয় ছিল কেন… সেটা জানতে পারি ?

বিদিশার দৃষ্টি ঘুরে গেছে আলিশার দিকে । এই প্রশ্ন আজকের আগে কেউ তাঁকে কোনোদিন করেনি , এমনকি কুশলও না । তিনি উত্তর দিলেন — সেটা আমার ব্যক্তিগত বিষয় মিস সোম !

— ব্যক্তিগত কিভাবে হলো ? এনাও আপনারই মেয়ে !

— এই প্রশ্ন এনা নিজে আমাকে কোনোদিন করেনি । আপনাকে কি সে পাঠিয়েছে এই প্রশ্ন করতে ?

দ্বিতীয় প্রশ্নটি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে আলিশা বললো — এনা যদি আগেই আপনাকে এই প্রশ্নটা করতো… হয়তো আজ বেঁচে থাকতো ঈশা !

— মানে ? সত্যিই কি এনা খুন করেছে ইশাকে ? শেষ পর্যন্ত কি এটাই হওয়ার ছিল ? দুহাত জোর করে কি যেন প্রার্থনা করেন বিদিশা বাগচী !

আলিশা একটা পায়ের উপর আরেকটা পা চাপিয়ে সোজা হয়ে বসে বলে উঠলো — আপনি কি অন্যরকম কিছু ভাবছেন মিসেস বাগচী ?

— আমি কিছুই ভাবতে পারছিনা । ইশাকে ছেড়ে বেঁচে থাকাটাই আমার কাছে এখন যন্ত্রণার । এই যন্ত্রনা থেকে যত তাড়াতাড়ি মুক্তি পেতে পারি.. সেই অপেক্ষায় দিন গুনছি ।

— এনা এখনও থানায় , ওর বেল হয়নি এখনও । আপনি কি মনে করেন যে এনা নয়… ইশার খুনি অন্য কেউ ?

— এনা আর ইশার মধ্যে বনিবনা ছিলোনা কোনোদিন , কিন্তু তাই বলে নিজের বোনকে সে খুন করবে.. এই শিক্ষা আমার কাছ থেকে সে কখনো পায়নি ।

— শুনলাম… আপনি ছোট থেকেই এনার ব্যাপারে তেমন কনসার্ন্ড ছিলেন না ! খোঁজ খবর রাখতেন না ! আপনি কেবল ইশারই টেক কেয়ার করতেন !

— কে বললো এই কথা ? যে বলেছে সে অর্ধসত্য বলেছে । দৃঢ় গম্ভীর স্বরে বলে উঠলেন বিদিশা ।

— কিরকম ! কয়েকটা ভাঁজ পড়ে আলিশার কপালে ।

— ঈশা আর এনার তখন পাঁচ বছর বয়স । একটা রিসোর্টে গিয়েছিলাম ছুটি কাটাতে । বাচ্চারা খেলে বেড়াচ্ছিল , আমরা আড্ডায় ব্যস্ত ছিলাম , বন্ধু বান্ধবরা একসাথে গেলে যা হয় ! পাশেই একটা সুইমিং পুল ছিল । ওদের বারণ করা সত্বেও ওরা তার পাশেই খেলতে খেলতে চলে যাচ্ছিল বারবার । ঝুপ করে একটা শব্দে তাকিয়ে দেখি… জলের মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছে ঈশা । প্রথমটায় আমি বুঝিইনি ঈশা না এনা কে পড়ে গেছে ! ওতো দূর থেকে দেখতে পাচ্ছিলাম না ।আমি ছুটে গেলাম পুলের কাছে । তারপর বুঝলাম ঈশাই পড়ে গেছে । ততক্ষনে কুশল পুল থেকে তুলে এনেছে ঈশাকে । সার নেই কোনো । ঘন্টাখানেক পরে চোখ মেলে তাকালো মেয়ে । ওকে জিজ্ঞেস করলাম — পড়ে গেলি কিভাবে ? কতবার বারণ করলাম ওখানে খেলতে !

— মা ! বলে ঈশা চুপ করে গিয়েছিল । একটু পরে বলেছিল — আমি পড়ে যাইনি , এনা আমাকে… ধাক্কা.. !

আর কোনো কথা বলেনি ঈশা সেদিন । কিন্তু আমি যা বোঝার বুঝে গিয়েছিলাম । কুশলকে বলতে ও বলেছিল — বুঝিয়ে বললে ঠিক হয়ে যাবে , বাচ্চা ওরা । ওতো কি বোঝে নাকি ? শুধুশুধু টেনশন কোরোনা ।

কিন্তু আমি এরপর থেকে ঈশাকে চোখে চোখে রাখতাম , এনার ওপরেও নজর রাখতাম । ঈশাকে আমি এনার থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চাইতাম । ওই ঘটনার পর আমি ওদের দুজনের আলাদা রুমের ব্যবস্থা করি । আমি আপনাকে আগের দিন একটা কথা বলেছিলাম মিস সোম ! আমি তেমন মা নই… যে সন্তানদের মধ্যে ভেদাভেদ করবে ! সেদিন যদি এনার বদলে ঈশা এনাকে ধাক্কা দিতো , আর এনা সবটা জেনেও একইভাবে তার বোনকে ভালোবেসে যেত সারাটাজীবন… তাহলে সেদিন হয়তো এনা আমার শ্রেষ্ঠ সন্তান হতো ! এনা সেটা পারেনি , কোনোদিন পারেনি , পেরেছে ঈশা । বরাবর ও অন্যের জন্যে করেছে । রাস্তা থেকে অসুস্থ ছোটো কুকুরছানা তুলে এনে বাড়িতে রেখে তাদের সেবা করেছে , একটা এনজিও তে গিয়ে সপ্তাহে দুদিন করে পড়িয়েছে অনাথ শিশুদের , নিজের পড়ার সময় বাঁচিয়ে , কোনোকিছু ফিরে পাওয়ার আশা না করেই করেছে । বরাবর দুর্দান্ত রেজাল্ট করে আমাদের গর্বিত করেছে ! এনাকেও ও অসম্ভব ভালোবাসতো ছোটবেলা থেকেই । ওর হোমওয়ার্কে সাহায্য করতে চাইতো , যদিও এনা কোনোদিন ইশার সাহায্য নিতে চায়নি !

— মিস্টার বাগচী কাকে বেশি ভালোবাসতেন ?

— দুজনকেই উনি সমান ভালোবাসতেন । যা করতেন দুজনের জন্যে । কোনোদিন অন্যরকম কিছু দেখিনি আমি । তবে ঈশা পড়াশোনায় বরাবর দারুন রেজাল্ট করতো বলে ইশার ব্যাপারে উনি খুব আশাবাদী ছিলেন ।

— ইশার জন্যে প্রতিবছর পার্টি থ্রো করতেন শুনলাম ! ওর রেজাল্টের অনারে !

— হ্যাঁ হতো । এটা কোথায় শুনলেন ?

— মিসেস বাগচী… আমাকে একটা কথার উত্তর দিন । আপনাদের কখনো মনে হয়নি… যে বাচ্চা মেয়েটা পাঁচ বছর বয়সে তার বোনকে জলে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতে পারে… সেই মেয়েটা দিনের পর দিন অবহেলিত হতে থাকলে বড়ো হয়ে আরও মারাত্মক কিছু করে ফেলতে পারে ! বিকৃত মানসিকতার অধিকারী হতে পারে ! আরও বড় কোনো ক্ষতি খুব সহজেই করে ফেলতে পারে !

— অবহেলা ওকে কোনোদিন করা হয়নি । এগুলো সবই মানসিক সমস্যা ।

— হ্যাঁ , অবশ্যই মানসিক সমস্যা , কিন্তু তার কারণ বোধহয় এই আপনারাই… আপনাদের মত বাবা মারা ! প্রথম যখন এনা অস্বাভাবিক কাজটা করেছিল , আপনাদের ওকে দূরে সরিয়ে না দিয়ে ওর প্রপার মেন্টাল হেলথ চেক আপ করানো উচিত ছিল । জানা উচিত ছিল.. কেন এই কাজটা সে করেছিল ! উল্টে দিনের পর দিন আপনারা তাকে আরো অসুস্থ হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন… নিজের থেকে তাকে দূরে সরিয়ে দিয়ে !

— ও কোনোদিন বদলাতো না । শান্ত স্বরে বললেন বিদিশা — আমরা নিয়ে গিয়েছিলাম ওকে । ট্রিটমেন্ট ও হয়েছিল কিছুদিন । তখন দুজনেরই বারো বছর বয়স । ঈশা পোকা মাকড়ে ভয় পেত খুব , মাঝেমধ্যেই ওর স্কুলব্যাগ থেকে বেরিয়ে আসতো… মরা আরশোলা , টিকটিকি কিংবা মরা ইঁদুর ! ঈশা ভয়ে চিৎকার করতো সেসব দেখে । এনা কোনোদিন স্বীকার করেনি যদিও কিন্তু জানি এনাই রেখে দিতো সেগুলো ইশাকে ভয় পাওয়ানোর জন্যে । এই ঘটনা বেশ কয়েকবার ঘটার পরে আমরা ওকে নিয়ে যাই চেকআপে… কিন্তু লাভের লাভ কিছুই হলো না । এর কিছুদিন পর ইশার স্কুলের সাদা মোজায় একদিন হঠাৎ দেখা গেলো থিকথিকে লাল পিঁপড়ে ভরে আছে সেটায় কারন তার মধ্যে রাখা ছিল ছোটো এক টুকরো চকলেটের টুকরো । সকাল বেলা ঘুম চোখে ঈশা সেটা না দেখেই পরে ফেলেছিল , তারপর চিৎকার করতে করতে মোজাটা টান মেরে ছুঁড়ে ফেলে দেখে এই কান্ড । এনা সেদিন ও কিছু স্বীকার করেনি , পরেও কোনোদিন না । ধীরে ধীরে নিজেকে এনার থেকে আমি তখন সরিয়ে নিচ্ছিলাম , মা হিসেবে ওর এসব আচরণ মেনে নিতে পারছিলাম না ।

— কখনো ভালোবেসে ওকে কাছে টানার চেষ্টা করে দেখেছেন… ফল কি হয় জানার জন্য ? প্রশ্ন করে আলিশা ।

— সেই সুযোগ এনা আমাকে কোনোদিন দেয়নি । ঈশাকে হিংসা করার পাশাপাশি আমাকেও দারুন অপছন্দ করতো সে । আমি ওর ঘরে যাই.. সেটাও ও চাইতো না , ভীষণ বিরক্ত হতো ।

— তাহলে এনা ঈশাকে খুন করেছে… এটা আপনারও মনে হচ্ছে , তাই তো ?

— সেটা তো আপনি বলবেন মিস সোম ! এর জন্যই আমার হাজব্যান্ড আপনাকে হায়ার করেছেন । মোটা টাকা পেইমেন্ট পাবেন এর জন্যে । আমার মেয়ের খুনিকে খুঁজে বের করার জন্যে ।

— অবশ্যই । বাই দ্য ওয়ে… আলেখ্যকে কেমন বলে মনে হয় আপনার ?

— কখনো খারাপ লাগার মতো কিছু চোখে পড়েনি , ও এবাড়িতে আসতো কম । তবে ছোটো থেকেই তো ওকে দেখছি , চোখের সামনেই বড় হলো । ওর বাবা মা আমাদের খুবই ভালো বন্ধু । ওর ব্যাপারে আমার কিছু খারাপ লাগেনি কখনও ।

সামান্য হাসলো আলিশা । বললো — তাহলে আপনার এই ধারণা আজ এই মুহূর্ত থেকেই বদলে ফেলুন মিসেস বাগচী… কারণ এক্ষুনি যেটা আমি আপনাকে বলবো সেটা শুনলে আপনি হয়তো ভীষণ অবাক হবেন !

— কি হয়েছে ?

— গতকাল আলেখ্য জানায় ও বিজনেসের কাজে মুম্বাই যাচ্ছে , কিন্তু আসলে সে কোথাও যায়নি , এই শহরেই ঘাপটি মেরে বসে আছে । এবার ভাবুন.. ছোট থেকে আলেখ্যকে দেখেও আপনি তাকে কতটা চিনতে পেরেছেন ?

মিসেস বাগচী বিহ্বল দৃষ্টি মেলে চেয়ে থাকেন আলিশার দিকে । থেমে থেমে বলেন — মিস্টার বাগচী জানেন এই কথা ?

— এখনও না । আমি এখন এখান থেকে আলেখ্যর বাড়ি যাবো । ওর মা আর বাবার সাথে কথা বলবো । আশা করছি আগামী দু তিন দিনের মধ্যে আমি ফাইনালি জানাতে পারবো.. ঈশার খুনি আসলে কে !

— এনাকে আজ বেল দিয়ে দেবে , ত্রিদিব দা কেও দিয়ে দেওয়ার কথা ছিল , কিন্তু একই সাথে দুজনকে বেল দেবে না , কারণ আলাদা মার্ডারের এলিগেশন রয়েছে দুজনের ওপর । তাই আগামীকাল ওনাকে বেল করানো হবে ।

— ওর পরিবার ! তারা কোথায় ?

— এই খানেই আছে ।

— ওদের কিন্তু কোথাও বেরোতে বারণ করে দেবেন । বিকেলে হয়তো আজ পুলিশ আসতে পারে ! আমি এখন উঠছি , আবার দেখা হবে । বলে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লো আলিশা । মিস্টার বাগচীর সাথে দেখা করে প্রতিদিনকার সমস্ত কাজের আপডেট দিয়ে বেরিয়ে পড়ল বাগচী ম্যানশন থেকে ।

এখন সে যাবে আলেখ্যর বাড়ি । মস্তিষ্কের শিরাউপশিরা জুড়ে ধাবমান রক্তকণিকার স্রোত একধরণের ঝিমঝিমে ভাব তৈরি করছে প্রতিক্ষণে । এমনটা খুব বেশি হয়না । আলেখ্য গা ঢাকা দিয়ে কোথায় লুকিয়ে থাকতে পারে… জানতে না পারা পর্যন্ত কিচ্ছু ভালো লাগছেনা তার । সে ক্যাবের ড্রাইভারকে বলে — দাদা , একটু তাড়াতাড়ি চলুন !

সুবিশাল রাজকীয় ম্যানশনটার গেটের সামনে ক্যাবটা ছেড়ে দিয়ে গেটে নক করলো আলিশা । একটু পড়ে একটা ছোট্ট চৌখুপ্পি থেকে মুখ বার করে তাকে দেখলো আগের দিনের দারোয়ান লোকটা ।

— কার সাথে দেখা করবেন ?

— মিসেস দাসগুপ্তর সাথে ।

— ফোন করে আসছেন ?

— ফোন ! না , ফোন তো করিনি !

— নাম বলুন আর কি কাজে এসেছেন সেটাও বলুন ।

— আপনি গেটটা খুলুন , আমি বলছি সব ।

— না , এখন অর্ডার নেই গেট খোলার । আপনি বলুন জলদি , নাম বলুন আপনার !

কয়েক মুহূর্ত কিছু ভাবলো আলিশা । তারপর নাম বলছে নিজের , কাজও বলছে । দারোয়ান তার মালকিনকে ফোন করে অনুমতি নিচ্ছে তার জন্যে গেট খুলবে কি না ! আলিশা ছোট্ট চৌখুপ্পিটার দিকে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে ছিল । সেখানে আবার এখন সেই দারোয়ানের মুখ ।

— আসুন ভিতরে । অর্ডার মিলেছে ।

গেট পার করে ভিতরে চলে এলো আলিশা । মোরাম বিছানো পথে বাড়িটার দিকে কিছুটা হেঁটে গিয়েও আবার ফিরে এলো সে গেটের কাছটায় । দারোয়ান জিজ্ঞাসু দৃষ্টি মেলে তাকালো । আলিশা অল্প হাসলো তার দিকে তাকিয়ে । তারপর বলল — তোমার নাম কি ?

— নাম কেশব সিং ।

— দাদাবাবু কি বাড়ি আছেন ?

— না , উনি বাড়ি নেই , কবে ফিরবেন জানিনা ।

— কোথায় গেছে জানো ?

— না , আমি এসব কিছু জানিনা । আপনি আন্দার যান ।

— হ্যাঁ , যাবো । কিন্তু তুমি কি সত্যিই জানোনা যে তোমার দাদাবাবু কোথায় গেছেন ?

— বললাম তো একবার… জানি না ।

পাঁচশো টাকার একটা কড়কড়ে নোট কেশব সিংয়ের বুকপকেটে আলগোছে রেখে দিল আলিশা । বললো — এবার বলো ।

আশেপাশে একবার সজাগ দৃষ্টিতে দেখে নিলো কেশব , তারপর বলল — দাদাবাবু বাইরে যাননি , এটা পাক্কা খবর আছে ম্যাডাম ।

— সেটা আমি জানি , যেটা জানিনা… সেটা বলো ।

— আর তো কিছু জানিনা !

আলিশা আরও একটা পাঁচশ টাকা বার করে লোকটার চোখের সামনে ধরলো । লোকটার চোখ এখন টাকাটার দিকে । সেটা দেখতে দেখতে খপ করে টাকাটা নিয়ে নিল সে , তারপর বলল — নিউটাউনে দাদাবাবুর একটা ফ্ল্যাট আছে । সেখানে দেখতে পারেন । ম্যাডাম , আমার নাম আপনি কিন্তু লিবেন না ! আমি গরিব মানুষ আছি , চাকরি চলে গেলে বউ বাচ্চা নিয়ে পথে বসবো !

— কিচ্ছু হবে না । চাকরি গেলে চাকরি আবার পাবে । আমি কথা দিলাম ।

— এরা আমাকে অনেকগুলো টাকা মাইনে দেয় ম্যাডাম , এত টাকা আমাকে অন্য কোথাও দেবেনা । আপনি যা সাহায্য চান আমি করবো , শুধু দেখবেন আমার নামটা যেন সামনে না আসে !

— বেশ তাই হবে । পকেট থেকে নিজের ফোনটা বার করতে করতে বলে আলিশা — ফ্ল্যাটের এড্রেসটা দাও । মিস্টার দাশগুপ্ত এখন কি বাড়িতে ?

— এখন তো আছেন , তবে বেরিয়ে যাবেন একটু পরে ।

— বলো এড্রেস !

নিজের ফোনে এড্রেসটা নোট করে নিয়ে আবার চালান করে সে সেটা পকেটে । তারপর এগিয়ে যায় মেইন ডোরের দিকে । বাগানের মালিটি কাস্তে হাতে ঘাস ছাঁটছে লনের , দরজাটার কাছে পৌঁছে বেলের সুইচে আঙ্গুল ছোঁয়াল , হঠাৎ চোখ পড়তে দেখতে পেলো… মালিটা স্থির দৃষ্টিতে দেখছে তাকে… দূর থেকে । ডান হাতে কাস্তেটা ধরে লোকটা দাঁড়িয়ে আছে একভাবে । আলিশার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সজাগ হয়ে উঠছে ধীরেধীরে , ঠিক সেই সময় দরজাটা খুলে গেল । দরজার সামনে দাঁড়িয়ে একটি মেয়ে । সাধারণ কামিজ আর সালোয়ার পরনে , দেখে মনে হয়… এই বাড়িতে কাজ করে সে । মালিটার দিকে ফিরতেই দেখলো কাস্তে হাতে সে ফিরে গেছে নিজের কাজে ।

— কাকে চাই ?

— মিস্টার এন্ড মিসেস দাশগুপ্ত কি বাড়ি আছেন ? আমি একবার দেখা করবো । সিকিউরিটি কথা বলে নিয়েছে , তুমি একটু খবর দিয়ে দাও , বলো আলিশা সোম এসেছে ।

— আসুন আলিশা ! আমি নিজেই নেমে এলাম নীচে আপনাকে স্বাগত জানাতে । বলুন কি সাহায্য করতে পারি আপনাকে ? সাদা শিফনের শাড়িতে নিজেকে ঢেকে অদ্ভুত ছন্দে নেমে আসতে আসতে বলে উঠলেন আলেখ্যর মা ।

— নমস্কার !

— আমি সুনন্দিতা ! আগের দিন পরিচয় হয়নি , তাইনা !

— বসুন । মিস্টার দাশগুপ্ত কি বাড়িতেই আছেন ? থাকলে ওনাকে একটু ডাকলে ভালো হয় ! আসলে এই কেসে আলেখ্য ভীষণই একটা গুরুত্বপূর্ণ এবং দামি চরিত্র হয়ে উঠেছে । আমি আজ ওর বিষয়েই আপনাদের সাথে কথা বলতে এলাম !

সুনিন্দিতার সুমখশ্রী এখন যেন একটু অন্যরকম ! আলিশা মনে মনে হাসলো । ভাবলো… ক্ষমতার শীর্ষে বসবাসকারী মানুষজনেরাও তাহলে কখনও কখনও ভয় পায় ! অপরাধের লম্বা হাত… ভয় ঠিকই দেখায় তাহলে… তাদেরও ! তার প্রথম কেসে ক্ষমতার বলে বলীয়ান সেই দাম্ভিক খুনি টি এলের মুখটা হঠাৎই মনে পড়ে গেলো এই মুহূর্তে একবার । আর মনে পড়ে গেলো… এককোনে বসে থাকা সেই গোবেচারা ছেলেটাকে… সে সরাসরি চোখ রাখলো মিসেস সুনন্দিতা দাসগুপ্তর চোখে , বলে উঠলো — কিহলো , মিসেস দাশগুপ্ত… ডাকুন আপনার হাসব্যান্ডকে !

|| এরপর ||

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here