সমাপ্তি_কোথায়?,(প্রথম অংশ)

0
1568

নাম_সমাপ্তি_কোথায়?,(প্রথম অংশ)
অক্ষর_অঙ্কনে_মিমি
জনরা_ভৌতিক
অনুগল্প

?
চারিদিকে হরিদ্বর্ণ তৃণাচ্ছন্ন থমথমে একটা বাড়ি। আশেপাশে গোটাকতক টিনের ঘর আর অনুচ্চ দালান নির্বিকার দাঁড়িয়ে আছে। বাড়িটার ঠিক মাঝ বরাবর এসে দিব্য চোখ বুলালো আশেপাশে। মানুষের আনাগোনা নেই। কিছু সময়ের জন্য মনে হলো এই বাড়ি-ঘর দালান যেন মুখ বাধা অবস্থায় পড়ে আছে। দিব্যর মনে হলো তারা কি যেন বলতে চায়। কিছু একটা যেন আছে তাদের মাঝে লুক্কায়িত। চোখের উপর ঠেসে দেওয়া মোটা ফ্রেমের চশমাটাকে আলতো করে ধাক্কা দিলো সে। কাধে একটা ব্যাগ ঝুলানো। ব্যাগটাতে তেমন কিছু নেই। একটা নোটপ্যাড আর দু’এক খানা কলম৷ বা’হাতে একটা ক্যামেরা। চোখের সামনে ধরে আশপাশটা একটু রিল এ বন্দী করে নিলো। পশ্চিম দিকের দোতলা দালানটার গেইটের কোণায় একটা বোর্ড ঝুলছে। দিব্য এগিয়ে গেলো সেদিকটায়। তীক্ষ্ণ নজরে তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করলো প্রায় আধ মোছা লিখাটা কি। অস্ফুট স্বরে দিব্য বললো,

—- আ আদনান।

কিছু একটা ভেবে চোখ বন্ধ করলো সে। এরপর চোখ খুলে মাথা উচিয়ে দোতলার দিকে তাকালো। গেইট দিয়ে প্রবেশ করতেই দেখলো বিল্ডিংয়ের মেইন ফটক খোলা। নিচ তলায় দুটো ফ্ল্যাট। তবে দুটো দরজাতেই তালা ঝোলানো। দরজার পাশ দিয়েই উপরের দিকে যাওয়ার সিড়িপথ৷ বেশ ময়লা। একবার উপরে তাকিয়ে দিব্য সিড়ি বেয়ে উঠতে লাগলো। ক্যামেরাটা কিন্তু অন৷ নিচ তলার মতো উপরের তলায়ও দুটো ফ্ল্যাট। বা পাশের ফ্ল্যাটটাতেও তালা লাগানো৷ তবে ডানের ফ্ল্যাটটা ভেতর থেকে লাগানো। দিব্য নিঃশ্বাস ফেলে নিজ মনে বললো,

—- তাহলে আসলেই কেউ থাকেন এখানে।

ক্যামেরাটা বন্ধ করে ব্যাগে ভরে নিলো। দরজার বাইরে সুইচ বোর্ডে কিছু তার ঝুলছে। দিব্য বুঝতে পারলো কোন এক সময় কলিং বেলের সুইচ ছিলো বোধহয়। তবে এখন আর নেই। বাধ্য হয়ে দিব্যকে দরজায় টোকা দিতে হলো। প্রথম টোকায় কেউ সারা দিলো না। সময় নিয়ে আবার টোকা দিলো সে। এবারও কোন প্রতুত্তর নেই। দিব্য তটস্থ। ভেতরে কি কেউ নেই? দিব্য ভাবলো চলে যাবে। কিছু একটা ভেবে আরেকবার টোকা দিলো। মনে মনে বললো,

—- এই শেষ বার।

দিব্য বুঝতে পারলো তার প্রয়াস বিফলে গেলো। সেই শহর থেকে শত মাইল পেরিয়ে এখানে আসা টা হয়তো পরাভূত হওয়ার সামিল। হঠাৎ মনে হলো দরজার লাগানো ছোট্ট হোল দিয়ে কেউ একজন তাকিয়ে আছে তার দিকে। এক দৃষ্টিতে। দিব্য পুনরায় টোকা দেওয়ার আগে দরজাটা খানিকটা ফাকা হয়ে গেলো। ভেতর থেকে এক নিস্তেজ ভয়ার্ত পুরুষালী কণ্ঠ আওয়াজ তুললো,

—- কে?

দিব্য দরজার দিকে খানিকটা ঝুঁকলো। লোকটাকে যেইটুকু দেখা যাচ্ছিলো দিব্য ঝুঁকে দাড়ানোর কারণে দরজার আরোও আড়াল হয়ে গেলো সে। দিব্য বুঝলো তার এভাবে আচরণ করা ঠিক হয় নি।

—- আ, এটা কি মি. আদনান রহমান আরিশ এর বাসা?
—- জ্বি আমিই আরিশ।

দিব্য কণ্ঠে বিষ্ময় নিয়ে বললো,
—- আপনি?
—- জ্বি। আপনি আমার পরিচিত কেউ নন।

দিব্য কিছু ভেবে বললো,
—- জ্বি আসলে আপনার সাথে কিছু কথা ছিলো। আমার একটা বন্ধু আপনার ঠিকানা দিয়েছে। যদি একটু ভেতরে আসতে দিতেন তাহলে বসে কথা বলতে পারতাম।

আরিশ ভেতরে দাঁড়িয়ে কি যেন ভাবলো৷ নিরবতা দেখে দিব্য প্রশ্ন করলো,

—- আপনি বোধহয় সংকোচ করছেন।
দিব্যকে অবাক করে দিয়ে আরিশ বললো,
—- আপনার কি কোন ছোট সন্তান আছে বাড়িতে?

দিব্য অবাক হলো। একজন অপরিচিত মানুষকে এমন প্রশ্ন করতে হয়তো প্রথম শুনলো সে। দিব্য বিয়ে করেছে এক বছর হয়েছে মাত্র। সন্তান নেই৷ তবে তার স্ত্রী তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা। দিব্য ভেবে উত্তর দিলো,

—- জ্বি না।

আরিশ দরজা খুলে দিলো। সম্মুখে দাঁড়ানো মানুষটার আপাদমস্তক চোখ বুলালো সে। রোগা, শীর্ণ লম্বাটে গড়নের একটা লোক। চোখের নিচে খয়েরি রঙের আবরণ পড়ে আছে। বেশ অসুস্থ মনে হলো মানুষটাকে। কেন যেন মনে হলো লোকটা এক সময় দেখতে বেশ সুদর্শন ছিলেন। দরজা থেকে সরে গিয়ে আরিশ দিব্যকে বললো,

—- ভেতরে আসুন।

দিব্য হেটে ভেতরে গেলো। ঘরের এক একটা জিনিসে যেন ধুলো জমে চট লেগে গিয়েছে। আদ্রিশ একটা কাপড় দিয়ে সোফাটাকে মুছে দিয়ে বললো,

—- বসুন।

দিব্য বসলো। আরিশও একটা চেয়ার টেনে দিব্যের মুখোমুখি বসে পড়লো। দিব্য নিজের চশমাটাকে আরোও একবার ঠেলে দিলো। আরিশকে লক্ষ্য করে বললো,

—- আপনি কি অসুস্থ?

আরিশ শুষ্কভাবে হাসলো।

—- আমার বাড়ি আসার পথে কেউ আপনাকে কিছু বলে নি?

দিব্য কিছু বললো না। তবে একটা জিনিস খেয়াল করলো। আরিশ খুব ক্ষীণ স্বরে কথা বলছে। আরিশ দিব্যের চাহনির দিকে তাকিয়ে বললো,

—- আমি আস্তে আস্তে কথা বলছি এতে কি আপনার কোন সমস্যা হচ্ছে?

দিব্য সজোরে মাথা নাড়িয়ে বললো,
—- না না৷ সেরকম কিছু না।
—- আসলে আমার স্ত্রী, সারা একটু ঘুমিয়েছে। সারারাত ঘুমায় নি তো। সাথে আমার বাচ্চা ছেলেটাও।
—- ওহ্।
—- আপনার কথা বলুন। কোন কাজে এসেছিলেন?
—- আসলে আমি একটা টিম এ কাজ করি। আমরা আসলে এমন সব ব্যাপার নিয়ে রিসার্চ করি যার কোন ব্যাখ্যা হয় না। হতে পারে সাইকোলজিক্যাল কিছু। বা অন্য ধাচের কিছু। আমরা এমন কিছুর খবর পেলে সেসব জায়গায় যাই৷ আর বিষয়টাকে খতিয়ে দেখি।
—- টিম? কিন্তু আপনি তো দেখছি একা।
—- আসলে আমার যে বন্ধু আপনার কথা বলেছে সে চাইতো আমি নিজ চোখে যেন দেখে যাই। আমার টিমের বাকিরা অন্য একটা প্রজেক্টে খুব ব্যস্ত। আমিও দুদিন পর দেশের বাইরে যাচ্ছি৷ তাই ভাবলাম আমিই আসি।
—- সাহস থাকা ভালো৷ তবে দুঃসাহস নয়।
—- তার মানে এখানে আসা কে আপনি দুঃসাহসিকতা বলছেন?
—- অশরীরী ব্যাপারটাকে বিশ্বাস করেন?
—- সেরকম কিছু আমি আজও দেখি নি। যেখানেই রিসার্চ করতে গিয়েছি ফলাফল জিরো। তাই আমি বিশ্বাস করি না।
—- আমিও বিশ্বাস করতাম না, তাকে দেখার আগে।
—- কার কথা বলছেন?

আরিশ মাথা তুলে তাকালো। ঠিক দিব্যের কাধের পাশ দিয়ে পেছন বরাবর। কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,
—- যাকে সবাই দেখে না।

দেড় বছর আগে…
পড়ন্ত বিকেলের শোভায় পাড়ার কয়েকজন মেয়েলোক মিলে বেশ আড্ডা দিতো তখন। সারাও তাদের মধ্যে একজন। সবার আকর্ষণ বরাবরই সারার দিকে থাকতো। কারণ হচ্ছে সারা দুই জমজ ছেলের জননী। একজনের নাম সাইফ আর অন্য জনের নাম সাঈদ৷ সেদিনও আড্ডা দিচ্ছিলো সারা। সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ায় সেদিন একে একে সবাই বাড়ি ফিরে যায়। তবে সারা আর সুমি নামের একজন তখনও কথা বলছিলো। চারদিকে অন্ধকার যেন দ্বিগুণ গতিতে নেমে আসছিলো। তবে সারা আর সুমি কোন একটা বিষয় নিয়ে প্রচন্ড হাসছিলো। একদম গড়াগড়ি অবস্থা। হাসি থামাতে যেয়েও যেন পারছিলো না। একটু পর সুমি খেয়াল করলো একটা আজব ভূষণের কেউ একজন তাদের থেকে খানিকটা দূরে পায়চারি করছে। চেহারা বুঝা গেলো না। বেশভূষা দেখে বুঝার উপায় নেই মেয়ে না ছেলে। বড্ড আজব! সুমি বললো,
—- সারা, দেখেছো ওদিকে কেমন আজব একটা মানুষ হাটছে। মনে হচ্ছে আমাদেরকেই দেখছে।

সারা একবার তাকিয়ে দেখলো সেদিকে। তবে কোন প্রতিক্রিয়া করলো না। কেন যেন অহেতুক বিষয় নিয়ে ভাবতে তার ভালো লাগে না।

—- আরে ভাবি বাদ দাও। আমি কি বলছিলাম শুনছো?

সারা আগের ব্যাপারটা আবার তুললো। আবার হাসতে লাগলো। তবে সুমির নজর সেই আজব মূর্তির দিকেই আটকে রইলো। কোন একটা বিষাক্ত আকর্ষণ অনুভব করছে সে। ক্রমশই সেই মূর্তিটা তাদের দিকে এগিয়ে এলো৷ চেহারাটা এখন অনেকটা স্পষ্ট। সুমি চোয়াল শক্ত করে নিলো। কেমন অদ্ভুত একটা দুর্গন্ধ নির্গত হচ্ছিলো। গালের এক পাশ পুড়ে দগ্ধ হয়ে আছে। সেখান থেকে কেমন তরল কিছু গলে গলে পড়ছে। চোখের উপরে ভারি কোন পর্দা নেই। কেবল সাদা অংশ। চোখের পাড় দু’পাশ দিয়ে ছিড়ে গিয়েছে যেন। সারার সামনে এসে ভারি গলায় গরগর শব্দ করে বললো,
—- এতো হাসন বালা না। হাসলে কপালে দুক্ক আয়ে।

সুমির কেমন ভয় ভয় করলো। পুরো শরীর যেন হিম হয়ে এলো। সারার হাত ধরে বললো,
—- সারা চলো।

সারা খানিকটা চটে গেলো। সে হাসবে কি হাসবে না সম্পূর্ণই তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। তেতে উঠে বললো,

—- আপনি কেন ফ্রী তে জ্ঞান দিচ্ছেন? হাসবো না কাঁদবো আমার ব্যাপার। আপনি বলার কে?
—- আমি কওয়ার কে দেখতে চাছ?
—- আরে আজব তো। আপনি এরকম পায়ে পাড়া দিয়ে ঝগড়া কেন করছেন? এ কেমন অভ্যাস?

সারা রাগের বশে জবাব দিতে গিয়ে খেয়াল করে নি সেই বিকৃত অবয়বের দিকে। তবে সুমি ঠিকই খেয়াল করেছিলো। অবয়বটার চেহারা একেকবার একেক রকম দেখা যাচ্ছিলো। নিঃশ্বাসে রাগ যেন স্পষ্ট। মুখ থেকে নিসৃত হচ্ছিলো একটা অশ্রাব্য গোঙ্গানির শব্দ। সুমি সভয়ে সারাকে টানতে লাগলো। পারছে না যেন সারাকে ফেলে রেখেই চলে যাচ্ছে। অবয়বটা বলে উঠলো,

—- যা কইলি মনে রাখিস। খোব খারাপ করসস তুই। তোর দুইটা পোলা আছে না?

সারা খানিকটা চুপ হয়ে গেলো। অবয়বটা যে পথে এসেছিলো ঠিক সে পথেই ফিরে যেতে লাগলো। সারা চিল্লিয়ে বলতে লাগলো,

—- আমার সন্তানদের কথা কেন বললেন? আশ্চর্য চলে যাচ্ছেন কেন? উত্তর দিন। আমার সন্তানের কথা কেন বললেন আপনি?

সেই নারী স্বরূপ অবয়বটি অন্ধকারে ক্রমশ মিলিয়ে যেতে লাগলো। সুমি সারার দিকে ভয়ার্ত নজরে তাকিয়ে আছে। সারার ভেতরটাও কেন যেন কেঁপে উঠলো। অবয়বটা তাকে কিছু বলে নি এমন নয়। যাওয়ার সময় যেন বলছিলো,

—- দেহা হইবো। আবার দেহা করমু।

এর ঠিক কয়েকদিন পর সারার জীবনে এমন অধ্যায়ের সূচনা হলো যা সে কোনদিন কল্পনাও করে নি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here