তোমার_প্রেমে_মাতাল,পর্ব_৪
লেখিকা_মায়াবিনী (ছদ্মনাম)
ওইদিন ছিল আমাদের প্রথম ছোঁয়া। কিন্তু তাই বলে ওয়াশরুমে? আর নিলজ্জ ছেলেটা কই প্রথম বার মিষ্টি হেসে হাত ধরার পারমিশন চাইবে। তা নাহ, বেহায়া! সরাসরি এত কাছে এসে মুখ চেপে ধরেছে? তার বাম হাত দিয়ে আমার ডান হাতের কব্জি দেয়ালে চেপে ধরেছে। আবার তার গরম নিশ্বাস আমার চোখে মুখে আঁচড়েও ফেলছে। অসহ্য। এত বিরক্তকর কেন ছেলেটা? সে পলকহীন চোখে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। কত সেকেন্ড কত মিনিট কত মাস কত বছর-যুগ আল্লাহ মালুম। এইভাবে তাকিয়েই আছে। আর আমি মনে মনে শত গালি দিয়ে ফেলেছি।
-এত নড়াচড়া কিভাবে করতে পারে মানুষ? একটু থামো। তুমি কি বুঝতে পারছো না, আমি না ছাড়লে এক চুল পরিমাণও তুমি সরতে পারবা না?
(ওই পলকহীন চোখে তাকিয়ে বলেই ফেললাম। নিজেও চুপচাপ থাকবে না। আমাকেও থাকতে দিচ্ছে না।পলক ফেলার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে আমার নেই।পলক ফেললেই বুঝি হারিয়ে যাবে আমার মায়াবিনী)
এই ছেলে ভারী অসভ্য। ছাড়লো নাকি এখনো। এখন অনেক কান্না পাচ্ছে। এভাবে কেও আমাকে ছোয়ঁনি। কোনো পুরুষ আমার এত কাছে আসে নাই। এভাবে কেউ ছুয়ে ফেলবে কল্পনাতেও ছিল না আমার। চোখে পানি জমে ঘোলা হয়ে আসলো দৃষ্টি। টুপ করে পরবে এ-ই বুঝি।
– ইশশ! মায়াবিনী এই চোখে আমার জন্য ভালোবাসা ঝরবে। ভালোবাসার বৃষ্টি ঝরবে।আমার ছোঁয়ায় আনন্দের অশ্রু অনুভূতি ঝরবে।কান্না নয়।(বলেই ছেড়ে দিয়ে একটু দূরে সরে দাড়ালাম দুইহাত বুকে গুজে)
-পানি খাবো।( তার কথা শুনে কি হলো কে জানে চোখ শুকিয়ে গেল, পানি পড়লো না।বড়সড় রকমের ভেবাচেকা খেলাম। যার কারন গলা শুকিয়ে কাঠ। আপাতত এই দুই শব্দের বাক্য ছাড়া অন্য কিছু মুখ থেকে বের হলো না)
-এ্যাঁ! তোমার মুখ থেকে প্রথম শোনা কথা পানি খাবো? আজীবন আমাকে এই ভেবে কাটাতে হবে? আমার কথা শুনে তোমার গলা শুকিয়ে গেছিলো? ভালোবাসা পাওয়ার পিপাসা বাদে পানির পিপাসা?(ডান ভ্রু কিঞ্চিৎ উঁচু করে)
-আপনি আস্ত মাথামোটা তো।এই অবস্থায় এমন বাচ্চা মেয়ের ভয় পাওয়াই স্বাভাবিক। উল্লুক লোক একটা ( আমিও বুকে হাত গুজে দেয়ালে ঘেষে দাঁড়িয়েই অন্য দিকে মুখ ফিরালাম ভেংচি কেটে)
-ওয়াশরুমের পানি খাও তুমি। আমি কি করে জানব।( বেসিনের আয়নায় চুল ঠিক করতে করতে বললাম)
আর শুনো বাংগালী নারীরা নিজের স্বামীকে এসব বলে গালিগালাজ করে না।(এখন ওর দিকে তাকিয়ে বললাম)
অবাকের চরম সীমানায় পৌঁছে গেলাম।এই লোকের কথার কোনো ছিঁড়ি নেই।
-বাইরে যাব আমি। পিপাসা পেয়েছে। (বিরক্ত নিয়ে বললাম)
-তোমার ভয় লাগছে না? একা একটা ছেলের সাথে এই কলেজ বিল্ডিংয়ের দোতলায় ওয়াশরুমে। আবার দরজা বন্ধ। কিছু যদি করে ফেলি? আওয়াজ করলেও কেউ জানবে না।মাঠে সব। গান আর নিজেদের চিৎকারের ঠেলায় কিছু বোধহয় শুনবেও না (ওর দিকে তাকিয়ে বললাম কারন ভয়ের মতো কোনো ছাপ এর মধ্যে নেই। না আছে নিজে থেকে বের হওয়ার কোনো তাগিদ। আশ্চর্য মেয়ে তো)
-যে ছেলে আমার চোখে পানি আসার সাথে সাথে আমায় ছেড়ে দূরে সরে দাড়ায়।তার জন্য তার সামনে ভয় পাওয়া বোকামী।ভয়টা তখনই কাটিয়ে উঠে পড়েছি।(আড় চোখে তাকে দেখে বললাম)
-আমাকে ভয় পেতে হবে না।মানুষকে ভয় পাও।কেউ এসে বন্দী দুই ছেলে মেয়েকে দেখলে বাজে মন্তব্য করবে।( বোকা বনে গেছিলাম।ধরা পরার আগে তাড়াতাড়ি এমন বলে কাটিয়ে দিলাম)
-দরজা খুলুন প্লিজ। আজ কলেজের শেষদিন।ইজ্জতের ফালুদা বানাতে চাইনা।খুব স্নেহের ছাত্রী নওয়াজ স্যারের।উনার কাছে বিচার গেলে খুব কষ্ট পাবেন স্যার।( মনে পড়ায় কাঁদো কাঁদো মুখে বললাম)
-নওয়াজ স্যারের অনেক প্রিয় বুঝি তুমি?(মুচকি হেসে বললাম)
-মাথা উপর নীচ করে জ্বি বুঝিয়ে দিলাম।
-উনার কাছে সর্বদা স্নেহ ভালোবাসা পাবে আজীবন। কখনো ছোট হতে দিব না তোমায় উনার কাছে। কথা দিলাম।
একরাশ ভালো লাগা আমার মন ছুয়ে গেল। তৃপ্তির হাসি দিলাম।
বের হয়ে সোজা কলেজের বাহিরে আমরা।পিছনের গেইট দিয়ে বেরিয়েছি।নীল জিন্স আর সাদা পোলো শার্ট। পায়ে স্লাইড। হাতে ঘড়ি।আমার একটু আগে আগে হেটে বের হয়েছে সে।এই ফাঁকে দেখে নেওয়া।
দরজা খোলার আগে কাছে এসে নিচু হয়ে বলে গেছে
-সামনে পরীক্ষা। একদম বাসা থেকে বের হবে না।প্রতিদিন সন্ধ্যার আগের ১০ মিনিট ছাদে আসবে। রেলিং ঘেষে রাস্তার পাশের দিকে দাঁড়িয়ে রাস্তায় তাকিয়ে থাকবে।আযান শুরু হওয়ার আগেই নিচে নেমে যাবে। কেমন? এখন সোজা বাসায় যাও রিকশা নিয়ে।একদম সামনের গেট দিয়ে যাবে না। কেউ যেন সিগনেচার না করে। বুঝেছো?
-হু।(মাথা নাড়িয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে শক্ত হয়ে আছি)
বলেই সে বেরিয়ে গেল। পিছন পিছন আমিও।
রিকশায় উঠে তাকে আর দেখলাম না। চলে গেছে মনে হয়।আপাতত মাথায় কিছু ঢুকছে না।কি বলল শেষে? এসব ভাবতে ভাবতে বাসার সামনে চলে এলাম।
রিকশা থেকে নেমে ভাড়া মিটানোর পর, আমার সামনে একটা বাইক থামলো। নিচু গলায় বলল,
-নিবিড় আহমেদ আমি। তোমার নওয়াজ আহমেদ স্যারের বড় ছেলে। (বলেই চোখ মেরে চলে গেল। হা করে তার চলে যাওয়া দেখলাম। ঢোক গিলে আশে পাশে তাকালাম। কেউ দেখলো কিনা। না ব্যস্ত রাস্তায় মানুষ এসব খেয়াল করে না। বাসায় ঢুকে গেলাম)
আজকে আর পড়া হলো না। দুপুরে খেয়ে ঘুমিয়ে গেলাম। মা না থাকলে যা হয় আরকি। আমায় জন্ম দিতে গিয়ে ইন্টারনাল ব্লিডিং এ মা চলে যায়।ভাইয়ার তখন সাত বছর। জড়িয়ে ধরে মায়ের ভালোবাসা দিয়েছে। চারতলা বাসার দোতলার একটা ছোট ফ্ল্যাট আমাদের। মা চলে যাওয়ার পর বাবা সব সম্পত্তি বিক্রি করে টাকা মহিলা ও শিশু হসপিটালের ফান্ডে দিয়ে দিয়েছে। এই ছোট ফ্ল্যাট ছাড়া গ্রামের দাদাবাড়িটা শুধু রয়েছে। যা ইনকাম করেন সরকারি জব করে তা আমার আর ভাইরার পড়াশোনায় চলে যায়। আমরা এতেই সুখী পরিবার। বানু খালা সেই যে ছোট থেকে আমাকে পালছেন। এখানো আগলেই রাখেন।
ফয়সালঃ বনু মন খারাপ কেন তোর?(রুমে ঢুকে মায়াবীকে টেবিলে বসে চুপচাপ থাকতে দেখে)
আমিঃ ভাইয়া চা বানিয়ে দে।
ফয়সালঃ এই যে এই ভয়েই আমার আসতে ইচ্ছে হয়না। তুমি খুব জ্বালাও পাজি মেয়ে।
আমিঃ ঢং করিস না ভাইয়া।চা না পেলে তোর বউ টেরা হবে।
ফয়সালঃ তোর বান্ধবী টেরা??
আমিঃএ্যাঁ??
ফয়সালঃ তোর বান্ধবী তো, তোরই মতো হবে?
আমিঃ তুই সিউর সৎভাই?
ফয়সালঃউহুঁ।তুই আমার টুকানো বোন?
(এখন খুব রেগে গেলাম।বুঝলাম ওঁকে রাগালেই এইবার থামবে।)
আমিঃ তোর বউ আমার বান্ধবী হলে তোর বন্ধু নিশ্চয়ই আমার বয়ফ্রেন্ড হবে।
ফয়সালঃ থাপ্পড় মেরে তোর সব দাতঁ ফেলে দিব।আর আমার বন্ধু হোক আর যেই হোক। তোর দিকে তাকালেই সেই ছেলের চোখ তুলে দিব আমি। বয়ফ্রেন্ড হওয়া তো দুরের কথা। তুই আমার ছায়ার নিচে বড় হয়েছিস, আমার ছায়ার নিচেই থাকবি বনু।(রাগে বলা শুরু করলেও এখন মায়াবীকে টেনে বুকে এনে ধরলাম।মাথায় চুমু দিলাম।জানি বোনটা আমার কাদছে।)
আমিঃ ভাইয়া আমি তোকে বড্ড বেশি ভালোবাসিরে।( কেদেই চলেছি)
শুক্রবার থাকায় আব্বু বাসাতেই ছিল। আমাদেরকে দরজা থেকে খানিক হেসে চলে গেল। জানেন দুইভাই বোন কেউ কাউকে ছেড়ে এক রাত ও আলাদা জায়গায় থাকে নাই।প্রতি রাতে ঘুমানোর আগে ফয়সাল একবার হলেও মায়াবীকে দেখে ঘুমাতে যায়। নিজে মারা গেলেও কোনো কষ্ট হবে না। ভাই তার বোনকে গাছের ছায়ার মতো প্রতি পদক্ষেপে মাথায় ছায়া দিয়ে চলবে। বোনটাও এমন। ভাই না খাওয়া অব্দি একটা দানাও মুখে দেয় না। ভাইয়ের পরিক্ষার সময় ভাই পড়ায় এত মগ্ন থাকে, সারাদিন ও খায় না। দরজা বন্ধ রাখে। মায়াবী ড্রয়িং রুমে সোফায় বসে শুয়ে রাত দিন পার করে দেয় না খেয়ে। ভাইয়া রুম থেকে বের হলে যেন সে আর ভাইয়া খাবে। কখন না কখন বের হবে পাহারা দিতেই ড্রয়িং রুমে থাকা। এভাবেই একে অপরের খেয়াল রাখে তারা।
টেবিলে পড়তে বসলাম বিকালে।চা দিয়েছিল ভাইয়া। পড়া কচু হচ্ছে। অসভ্য ছেলে মাথায় চেপে বসে আছে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। সন্ধ্যা নেমে আসছে।
উনার বলা কথা মনে পড়লো। দৌড় দিলাম ওড়নাটা নিয়ে সিঁড়িঘরে।পালাজ্জো আর টিশার্ট পরায় ওড়না দিয়ে নিজেকে সম্পুর্ণভাবে জড়িয়ে নিলাম। আর উপরে উঠতে থাকলাম। গন্তব্য ছাঁদ…
চারতলা বাসার পাঁচ তালাতে ছাঁদ।
রাস্তা আজকে অনেকটাই খালি।শুক্রবার। একটা ছেলে মেরুন পাঞ্জাবি পরে দাঁড়িয়ে আছে উপর দিকে তাকিয়ে। বুঝলাম সে জুমার নামাজ আদায় করেছে।এত দুর থেকে তাকে ভালো মত দেখা না গেলেও চিনতে একদম অসুবিধে হয় না। এখন বুঝছি ছাদে আসতে বলার কারণ।
তার মুখে একটা আলতো হাসি। বাইকে হেলান দিয়ে বুকে হাত শান্ত দৃষ্টিতে আমাকে মেরে ফেলছে।এমন কেন লোকটা? বয়স তো কম না লোকটার। অসহ্য একটা লোক। আমাকে না মেরে এর ক্ষান্ত নেই। একদম এই লাইনটা উনারই জন্য, “দৃষ্টিতে ভস্ম”?।
আযান দিবে মাগরিবের। এই বুঝেই বোধহয় বাইক স্টার্ট দিল। এবাবা চলেও গেল?? ইশারায় আমাকে বিদায় ও দিল না? আমাকে যেতেও বলল না? বাঁদর একটা, উল্লুক। নেমে আসলাম আর আজান হল। মনে মনে বললাম কালকে যাব ছাদে? জীবনেও না। নিজেকে ভাবেটা কি? দেখবনি কেমন লাগে।বজ্জাত লোক!!
বাইক চালাচ্ছি, হাওয়া বারবার আমাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। মায়াবিনীকে দেখার পর এই হাওয়াটা বদলে গেছে। যখন আসলাম ওর বাসার সামনে ওই সময়ের হাওয়া নিত্যদিনের মতো ছিল।এখন বিদায় বেলার চলতি পথের হাওয়া তোমার মতোই মিষ্টি মায়াবিনী।
এসব আনমনে ভাবতে ভাবতেই সামনে কি যেন এসে গেল বাইকের…
ক্যাম্পাসের মোড়ে চায়ের দোকানে কয়েকটি ছেলে মেয়ে আড্ডা দিচ্ছে। বিষয়বস্তু কালকে মা ও শিশু হসপিটালের সামনে বিনামূল্যে রক্তদান।
দিপুঃভাই এমনে হেডলাইন দিলে আমার রক্ত হুদাই ফ্রিতে নিয়ে বিজনেস করবে?।
সাদিঃ তোর রক্ত তো A+।তারমানে তোরটাই তাড়াতাড়ি বিক্রি হবে। ৩/৪ ব্যাগ।বহুত টাকা?
নীলাঃ ২ ব্যাগ নেই। বেশি নিয়ে কি? ওতেই সবার মুভির টিকেট হয়ে যাবে।?
দিহানঃ” তুমি আছো তুমি নেই” এইটাই দেখমুনে?
দিপুঃ সস্তা নাকি? তোরা বললেই রক্ত দিব নাকি??
শশীঃ তোর মতো বলদা তো আমরা! এক মহিলাকে ভাড়া করব থিয়েটার থেকে। গর্ভবতী সাজিয়ে এনে, তোর কাছে থেকে রক্ত নিব?
সাদিঃতারপর ব্লাড ব্যাংকে বেঁচে দিব?
দিপুঃ তোরা বন্ধু না শত্রু??
সবাই হেসে দিল?????।
শশীঃ কিরে শিমুল, নিবিড় কেন আসছে না?
দিহানঃ শিমুল ফোনে বলছে নিবিড়কে নিয়ে আসবে।
নীলাঃ শিমুল ওই যে আসছে। নিবিড় তো নেই।( উঁকি দিয়ে আশেপাশে)
শশী আর বাকিরা একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করলো।
শশীঃ তুই নিবিড়কে নিয়ে এখন তো এসব ভাবা বাদ দে।চার বছরেও ও তোকে পাত্তা দেয়নি। প্রেম ও আর কখনো করবে না। স্কুল থেকে চিনি ওকে। আমার আর শিমুল থেকে নিবিড়কে আর কেউ চিনে না।(নীলার দিকে তাকিয়ে ওর কাঁধে হাত দিয়ে)
নীলা নিচের দিকে তাকিয়ে বলল
নীলাঃ বাদ দিলে অনেক আগেই দিতে পারতাম। এখন সেটা আর সম্ভব নয়। ও যেমন আর কখনো কাউকে মন দিবে না। আমিও আমার মন ওর থেকে সরাতে পারব না।
সবাই চুপ করে গেল।
শিমুল ওদের কাছে চলে আসছে।কিন্তু নিবিড় আসে নাই এখনো….
চলবে