“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ১০
(নূর নাফিসা)
.
.
নাজিয়া আরাফের বুকে মাথা রেখে শুয়ে বললো,
– একটা কথা বললে রাখবে?
– কি?
– রাগ করবে না তো?
– বলো।
– পড়াশোনা করে তো বেকারই বসে আছি। একটা চাকরি যোগাড় করে দাও। অন্তত শিক্ষাটা কাজে লাগাই।
– মাথা খারাপ! তুমি উপার্জনে নামবে!
– তো কি হয়েছে! মেয়েরা করে না চাকরি!
– অন্যদের সাথে তোমার তুলনা না। সারা সংসার সামলানোর ভার মাথায় তুলে নিয়েছো! সকালে ঘুম থেকে উঠে লেগে যাও আর শেষ হয় রাত এগারোটা বারোটা! চাকরি করার সময় তুমি কোথায় খুজে পাও!
– তখন কাজ একপাশে চাপিয়ে নেওয়া যাবে।
– সারাদিন কাজকর্মে লেগে থেকে এমনিতেই তোমার শরীর দুর্বল! তারউপর চাকরি করতে দেই আর তুমি পুরোপুরি অসুস্থ হয়ে যাও! এতোটা পাগল আমি হই নি! মাস্টার্সে ভর্তি হতে বলেছিলাম, হওনি। আগামী বছর চাইলে ভর্তি হয়ে যেও। পড়াশোনা করতে নিষেধ করবো না।
– না, থাক। লাগবে না।
– মন খারাপ করছো কেন! মানুষের মস্তিষ্ক বলেও তো একটা কিছু আছে! কত চাপ সহ্য করতে পারে এইটুকু মস্তিষ্ক! অতিরিক্ত চাপে মানুষের স্ট্রোক হয়ে যায়! আমি তোমাকে হারাতে চাই না কোনো ভাবে। যেভাবে আছো সেভাবেই থাকো। পারলে সংসারের কাজ থেকেও একটু চাপ কম নাও। নিজের শরীর মনেরও একটু বিশ্রামের প্রয়োজন আছে। তোমার খাওয়া দাওয়া ঠিকমতো চলে না সেটা আমার খুব ভালোভাবেই জানা আছে।
– হয়েছে মাস্টার মশাই। অনেক জ্ঞান দিয়ে ফেলছেন একসাথে! বেশি খেলে আবার বদ হজম হয়ে যাবে! একটু কম কম করেই গিলতে দিন।
আরাফ হেসে নাজিয়ার মাথায় বিলি কাটতে কাটতে বললো,
– আরোহীর আম্মু?
– হুম?
– গতকাল রাতে ফরহাদ স্যারের জমজ বাচ্চা হয়েছে।
– আলহামদুলিল্লাহ। সুস্থ আছে সবাই?
– হুম। আমরা নতুন মেহমানদের আনবো কবে?
নাজিয়া আরাফের বুকের লোম গুলোতে বিলি কাটতে কাটতে বললো,
– এখন কি বেবি নেওয়া ঠিক হবে! এমনিতেই এক ঝড় গেলো পরিবারের উপর! আবার আয়াতের বিয়ের সমন্ধ আসছে। বিয়ে ঠিক হয়ে গেলে তো এমনিতেই কতো টান পড়বে! তাছাড়া বাচ্চা নিলেও তো বাচ্চার জন্য সব দিক থেকে প্রিপেয়ার থাকতে হবে!
– হুম, তা তো হবেই। তবুও তো বাচ্চা আসতে মোটামুটি অনেক সময়ের ব্যাপার। হয়ে যাবে না সবটা প্রস্তুত?
– আমার মনে হয় একটু স্বচ্ছলতায় এগিয়ে তারপর সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। সবদিকই বিবেচনায় আনতে হবে। ভেবে দেখো তুমি। তোমার সিদ্ধান্তেই আমি মত পোষণ করবো।
– ওকে, পরেই প্ল্যান করবো। এবার একটু ঘুমাও। রাত অনেক হয়েছে।
.
লোকজনের দেনাপাওনা সব পরিশোধ করা হয়েছে সাথে দোকানটাও বেচে দিয়েছে আলফাজ সাহেব। কেননা এটা নিয়ে চলা যাবে না। ছেলেদেরকে তার জন্য অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে! আর কষ্ট দিতে পারবে না। ছেলেরা উপার্জন করে দুমুঠো খাবার মুখে তোলার জন্য দিলে খাবে আর না হয় না খেয়ে মরে যাবে। তবুও আর লোকসানের ঘানি টানতে পারবে না। তাই ঋণ পরিশোধ করা সত্ত্বেও বিক্রি করে দিলো। তবে দোকান বিক্রির টাকা সঞ্চিত রাখা হয়েছে। অন্যান্য কাজে লাগাতে পারবে। আপাতত কোনোমতেই চালিয়ে নিচ্ছে সংসার। গত দেড় মাসে যা অবস্থা হয়েছে তা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে কে জানে কতদিন লাগবে! বিপদ কি আর আসতে দেখা যায়! আসে আচমকা ঝড়ের মতো বেগে আর যায় কচ্ছপের ন্যায় ধীর পায়ে! ক্লান্তির ছাপ ফেলে অর্ধেক লাশ বানিয়ে তারপর না অবসান ঘটে দুঃখের!
আজ দুপুরের পর ঘটক আয়াতের জন্য আরেক সমন্ধ নিয়ে এসেছে। কেননা আয়েশা বেগমের তাড়া মেয়েকে বিয়ে দিয়ে সংসারের সদস্য কমানোর! একজন কমলে একজনের খরচই কমবে। এমনিতেই সংসার ডুবে আছে কাদার নিচে! কে জানে উদ্ধার পাবে কিনা! এটা আয়েশা বেগমের ভাবনা!
আজ নাজিয়া মেহমানদের সামনে যায়নি। খাবারদাবার সব গুছিয়ে দিয়েছে আর আয়েশা বেগম নিয়ে গেছেন মেহমানদের সামনে। ছেলেপক্ষ মোটামুটি পরিচিতই তাদের। কেননা আরাফের বাসা থেকে দূরে না বেশি ছেলেদের বাসা। লোকজন যখন ঘরে প্রবেশ করছিলো, নাজিয়া কিচেনে থেকেই দেখেছিলো তাদের। এখানে ছেলে এসেছে কিনা ভাবা মুশকিল! একজন বয়স্ক মহিলা ও একজন বয়স্ক পুরুষ। সাথে একটা প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ! ঘটকসহ তিনজন পুরুষের মুখেই পান খাওয়ার ছাপ দেখা গেছে!
মেহমান মেয়েকে দেখে কথাবার্তা বলে চলে গেলো। আরাফ সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে হাতমুখ ধুয়ে নাজিয়াকে ডেকে এক গ্লাস শরবত চাইলো। ওদিকে আলফাজ সাহেব নিজের ঘর থেকে আরাফকে ডাকলে আরাফ নাজিয়াকে শরবত বাবার ঘরে নিয়ে যেতে বললো এবং সে বাবার কাছে চলে এলো। আলফাজ সাহেব দুপুরে আসা মেহমানদের কথা বলছে আরাফের কাছে। আয়েশা বেগমও পাশে বসে আছে। নাজিয়া লেবুর শরবত এনে আরাফের হাতে দিয়ে আলফাজ সাহেবকে বললো,
– বাবা, আপনার জন্য আনবো এক গ্লাস?
– না। তুমিও বসো কথা আছে।
নাজিয়া চেয়ার টেনে বসলো। আলফাজ সাহেব আরাফ ও নাজিয়ার উদ্দেশ্যে ছেলের পরিবার সমন্ধে বললেন। নাজিয়া জিজ্ঞেস করলো,
– বাবা, আজ কি ছেলে এসে দেখে গেছে আয়াতকে?
– হ্যাঁ। ছেলের পরিবার পরিচিতই। আয়াতকে পছন্দ হয়েছে। জমিজমা ভালোই আছে। তোমার আম্মা রাজি এখানে বিয়ে দিতে। তোমরা কি বলো?
হুট করেই দরজার সামনে থেকে আয়াত বলে উঠলো,
– আম্মা রাজি হলেই কি হবে! যাকে বিয়ে দিবা তার মতামত নিয়েছো! আমি নিজেই রাজি না। করবো না বিয়ে!
আয়েশা বেগম ধমকে বললো,
– তোর কিসের মতামত নিতাম! আমার বিয়ের সময় কি বাপ মা আমার মতামত নিয়া বিয়ে দিছে! নিজের পছন্দ হইছে দিয়া দিছে! বড়দের কথার মাঝে বেশি কথা বলবি না। চুপচাপ নিজের ঘরে যা, আর পড়াশোনা কর। আর একটা কথাও যাতে না শুনি!
আয়াত রেগে চলে গেলো সেখান থেকে! আরাফ বিয়েতে রাজি না। তবুও বাবামায়ের উপর সরাসরি বলতে পারছে না। সে বয়সের অযুহাত দিলে আয়েশা বেগম উল্টো বুঝিয়ে দিলো সংসারের টান। তাছাড়া আয়াতের মেধা তেমন ভালো না। রেজাল্ট ভালো হয় না, এই পড়াশোনা দিয়ে কি করবো! নাজিয়া আগেই চলে এসেছে সেখান থেকে। পরে আরাফ রুমে এলে নাজিয়া বললো,
– আয়াতের বিয়ে কি সেখানেই দিবে?
– হয়তো!
– মেহমান যখন এসেছিলো কিচেনে থেকে তখন দেখেছিলাম। ভালো মনে হয়নি! বুড়ো লোকের মতো পান খায়। তাছাড়া আয়াতের তুলনায় অনেক বয়স্ক মনে হয়েছে!
– হুম, চিনি আমি তাদের। আমারও ভালো লাগছে না। ছেলেটা আমার চেয়েও কয়েক বছরের বড়। পড়াশোনাও করেনি, বাবার ব্যবসা সামলায়! যাইহোক, দেখি বাবা মা কি করে।
পরদিন আরাফের বাবা মা ছেলেদের বাড়ি দেখে এলো। আয়েশা বেগমের খুব পছন্দ হয়েছে। বাড়িটা তাদের বাড়ি থেকে বড়। টাকা পয়সা আছে। তিনি ঘটককে বিয়ের কথা এগিয়ে নিতে বললেন। শুক্রবারে ঘটক এলো তাদের বাড়িতে। আরাফ বাড়িতেই আছে। আলফাজ সাহেবের ঘরে বৈঠকে বসলো তারা। নাজিয়া হালকা নাস্তার ব্যবস্থা করেছে তাদের জন্য। ঘটক জানালো ছেলে পক্ষ দাবি করেছে আসবাবপত্র দিয়ে তাদের ঘর সাজিয়ে দিতে হবে আর নগদ পঞ্চাশ হাজার টাকা দিতে হবে। এতো বড়সড় দাবি শুনে আরাফের পাশাপাশি আলফাজ সাহেবও অমত পোষণ করলেন। আলফাজ সাহেবকে থামিয়ে দিয়ে আয়েশা বেগম জানতে চাইলো দাবি একটু কমানো যায় কিনা। কমানো গেলে তারা বিয়ে দিয়ে দিবে। এদিকে আয়াত বাইরে থেকে তাদের কথাবার্তা শুনে ভেতরে এসে বললো,
– মা, এইসব বন্ধ করবা! আমি কিন্তু বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো!
আয়েশা বেগম চোখ রাঙিয়ে বললো,
– যাবি এখান থেকে! নয়তো জুতা দিয়া কপালে মারমু! বড়দের কথার মাঝে কথা বলতে না করছি না! বিয়ে তো ওই বাড়িতেই হইবো। যা!
আয়াত কান্নার সহিত ফুসতে ফুসতে বেরিয়ে গেলো। নাজিয়া যৌতুকের কথা শুনে মৃদু স্বরে বললো,
– আম্মা, যৌতুক দিয়ে কিংবা নিয়ে বিয়ে ঠিক না! দুটাই পাপ এবং দণ্ডনীয় অপরাধ। তাছাড়া যে পরিবার এতো দাবি রাখে সে পরিবার সুখী হয় না। সবসময় তারা একের পর এক দাবি নিয়ে প্রস্তুত থাকেই। অবশেষে দাবি পূরণ না হলে বিচ্ছেদ হয়ে যায়!
– চুপ থাকো! বেশি বুঝইতে আইসো না! পড়াশোনা আমরাও করছি! তোমার বাপের তো সামর্থ্য নাই, ভাগ্য ভালো তোমার কিছুই লাগে নাই! কে জানে কোন পাগল হইয়া আমার ছেলে বিনা পয়সায় ঘরে তুলে আনছে! সবাইরে নিজের পরিবারের মতো ছ্যাচড়া পরিবার ভাইবো না। যৌতুক না, এইসব উপহার বুঝছো! বিয়েতে উপহার হইলেও দেওয়া লাগে যেটা তোমার পরিবার দেয় নাই! দিবেই কিভাবে, থাকলে তো!
আরাফ এবার তেজ নিয়ে জবাব দিলো,
– মা, তুমি এসব কি শুনিয়ে যাচ্ছো! তুমি কি জানো ওর পরিবারে আছে নাকি নেই! তোমার পরিবারের চেয়ে খুব ভালো সচ্ছলভাবে চলে তার পরিবার। আমি নিতে চাইলে তো উনারা আমাকে দিবে! যতই বলে চালান করে দাও উপহার, এগুলো যৌতুক আর যৌতুকই রয়ে যাবে। উপহার তো স্বেচ্ছায় দেওয়া হয়, তাহলে তারা দাবি রাখবে কেন সেখানে! আর ভাবলে কিভাবে আমি একজন শিক্ষিত ছেলে হয়ে যৌতুক নিব! যদি আট দশটা মূর্খদের মতো যৌতুক চেয়ে বসি তাহলে কোথায় থাকবে মূর্খের সাথে শিক্ষিতদের পার্থক্য! কোথায় থাকবে সেই শিক্ষার মর্যাদা! এমনই যদি হতে হয় তবে লাভটা কি হলো এতো পড়াশোনা করে!
– আরাফ! মায়ের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় সেটা জানা নেই তোর! বড় হচ্ছিস আর বেয়াদবের কাতারে পড়ছিস!
– শিক্ষা তো এমনই দিচ্ছো না? বাবার মুখের উপর তুমি কথা বলে যাও সেটা বেয়াদবি হয় না আর আমরা উচিত কথা বললে বেয়াদবি হয়ে যায়! বরাবরই তুমি নাজিয়ার সাথে বাজে ব্যবহার করে যাও! কেন? সে কোনো প্রচেষ্টা কম করে এই সংসারের জন্য! একা একজন সবদিক সামলে নিচ্ছে তবুও তোমাদের মন রক্ষা করতে পারে না! কি চাও তুমি? যৌতুক এনে দিক বাবার বাড়ি থেকে, সেটা চাও? তাহলে তা কোনোদিন পূর্ণ হবে না। আমি হতে দিবো না।
মায়ের সাথে উঁচু গলায় কথা বলতে দেখে নাজিয়া তাকে থামাতে বললো,
– আরাফ, তুমি কি বলে যাচ্ছো এসব! মায়ের সাথে এভাবে কথা বলে কেউ! চুপ থাকো।
– একটা কথাও বলবে না তুমি! ওনাদের মেয়েকে উনারা যেভাবে, যেখানে ইচ্ছে বিয়ে দিক। এ ব্যাপারে কোনো কথা বলবে না। যাও, ঘরে যাও! যাও।
নাজিয়া ঘর ত্যাগ করতে লাগলো আর আরাফ তার বাবা মাকে বললো,
– এতোক্ষণ তো পরোক্ষভাবে অমত পোষণ করছিলাম। কিন্তু এখন প্রত্যক্ষ ভাবে বলছি, আমি এই সমন্ধে একটুও রাজি না। মেয়ে তো তোমাদের তাই তোমাদের যা ইচ্ছে করো। আমাকে আর ডেকো না এসবের মাঝে। আর ভবিষ্যতে কোনো ঝামেলা হলেও আমাকে ডাকতে পারবে না।
কথাটা বলে আরাফ বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে এবং চলে গেলো বাড়ির বাইরে।