তোমার_প্রেমে_মাতাল,পর্ব_৩৬+৩৭

0
1717

তোমার_প্রেমে_মাতাল,পর্ব_৩৬+৩৭
লেখিকা_মায়াবিনী (ছদ্মনাম)
পর্ব_৩৬

কিশোর বয়স থেকে যৌবনে পা রাখার বয়সটা বড় অদ্ভুত। এই বয়সে সবটা কেমন রঙিন লাগে। তবে অনুভূতি গুলো বড্ড সুন্দর। এ সময় যার প্রতি মন লেগে যায় তাকে দেখলে বুকে যে ঢিপঢিপ শব্দ করে তা দেখানো যায় না কাউকে, বোঝানো ও যায় না। তবে ওই মানুষটার সাথে চোখে চোখ পরলেই সে সবটা বুঝে যায়। বুঝলেও কি একই অনুভূতি ফিরিয়ে দিতে পারে? সবাই বুঝি সত্যি ভালোবাসার মানুষের কাছে ভালোবাসা পায় না। আমার আর নিবিড় এর মত এমন কয়জনই বা আছে? আমার বোনটার কি এই ভাগ্য হবে?

নীরব কাল রাতেই ফিরেছে। তবে আসার পর থেকেই দেখছি তিন্নির সাথে ওর আচরণটা ঠিক কেমন যেন। ব্যাপারটা সুবিধা লাগছে না আমার। তার মাঝে মা খুব কড়া। বিষয়টা মায়ের চোখে পরলে জল ঘোলা হবে। এইদিকে আমার বোন অন্যদিকে শ্বশুর বাড়ি। কি করবো বুঝে উঠতে পারছি না। এর আগে আমার ধারণা ছিল তিন্নি আর মৌ হ্যান্ডসাম স্মার্ট একটা ছেলে দেখে, সম্পর্কে বেয়াইন তাই মজা নিচ্ছে। কিন্তু তিন্নির চোখ জোড়ায় কেমন কেমন ভাব। নীরব সামনে এসে যখন দাঁড়ালো কাল রাতে, তিন্নির চোখমুখের ভাব কেমন পাল্টে গেল। নিজের চোখের সামনে দেখলাম ছোট বোনের এই পরিবর্তন। কাঁপা কাঁপা ঠোঁটে নীরবকে জিজ্ঞেস করলো কেমন আছে। নীরব এক ঝলক তাকিয়ে ভালো বলে এগিয়ে মায়ের সাথে দেখা করলো। নীরবের এই পাশ কাটিয়ে চলে আসাটা ছিল তিন্নিকে উপেক্ষা করা। নীরব আমার সামনে এসে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো। কি বলব বুঝতে পারছিলাম না। এমনি দিন হলে ও বান্দরবান থেকে আমার জন্য কি এনেছে বলে পাগল বানিয়ে ফেলতাম। কিন্তু কালকে সুচি কথা মনে করে নিজে থেকে কিছু বলতে পারলাম না। নীরবের চোখে কি আছে বোঝার চেষ্টা করছি। তারপর নিজেই বলল, কেমন কেটেছে এ কয়দিন মায়া? হাসি মুখে আমিও শুধু ভালো বলে পাশ কাটিয়ে রান্নাঘরে চলে এলাম। যেন পালাতে পারলে বাঁচি এমনভাবে চলে এসেছি।

এরপর রাতে খাবার খেতে এসে দেখেছি সোফায় নীরব বসে আছে। পাশে মৌ, তিন্নি ও উৎস। একপ্রকার আড্ডা চলছে। নিবিড় অফিস থেকে এসে ফ্রেশ হতে রুমে গেল। আমি আর খালা খাবার রেডি করছি। এইদিকে কান পেতে শুনছি কি কি বলছে ওরা।

-মায়াবী আয় না তুই। এক বয়সী আমরা তিনজন। চল পিচ্চি দুইটাকে নিয়ে একটু মজা করি।

-আরে খাবার রেডি করছি উৎস। আসছি।

যেয়ে দাঁড়ালাম ওদের কাছে। নীরবের দিকে তাকিয়ে আছে তিন্নি। তবে একদৃষ্টিতে না। তাকাচ্ছে আবার চোখ নামাচ্ছে। যেন এটা লজ্জা মাখানো। বুঝতে পারলাম আমার বোন সত্যি প্রেমে পরেছে। কিন্তু নীরব নিজের মতোই আছে। উৎসের সাথে ভবিষ্যতের প্ল্যান নিয়ে কথা বলছে। আমি যাওয়ার পর উৎসকে বললাম,

-তুই জীবনে কি করতে চাস?

-টাকা কামাই করা কোনো ব্যাপার না। কিন্তু উপায় সৎ হতে হবে। এর জন্য একটা মানুষকে সময় দিতে হয়।(নীরব যেচেই আমায় উত্তর দিলো)

-সমবয়সী প্রেম করলে আগে থেকে কিছু হলেও ভাবতে হয়। ইনকাম না করলেও, ইনকাম সোর্স কি তা বলার ক্ষমতা থাকতে হবে নীরব।

-মেয়েরা মোটেও এসবে নির্ভর করে না। একবয়সী হলে সময় দিতে হয়, এভাবে না জানিয়ে বিয়ে করে ফেলতে পারে না। তাদের চাই বড়লোক স্বামী। ভালোবাসা আর টাকা কখনো একসাথে পাওয়া যায় না মায়া।

-কিন্তু মায়াবিনী তো সবই পাচ্ছে। না কোনো অভাববোধ, সাথে আছে আমার অফুরন্ত এক আকাশ ভালোবাসা।

নিবিড় কখন রুম থেকে বেরিয়ে ড্রয়িং রুমে এসেছে খেয়াল করিনি। আমার আর নীরবের কথপোকথন শুনেছে নিশ্চয়ই। তাই নিবিড় এমন বলতে পারলো। নিবিড় এই কথা বলে আমার কাছে এসে আমার দুই বাহু চেপে ধরলো। তারপর আবার বলল,

-তোর ভাবীকেই জিজ্ঞেস কর নীরব। যদি মন থেকে কাউকে পেতে ইচ্ছে করে তবে শুরু থেকেই নিজেকে গোছাতে হয়। যেমন উৎসের জব হয়ে গেছে। নিজে কাজ ও করবে পড়বেও। ভালোবাসার জোর অনেক। উৎসের ভালোবাসা ও এমন। কম হোক বেশি চেষ্টা করছে। মানে সুচিকে বিয়ে করবেই। এমন মানুষের জন্য সৃষ্টিকর্তা ও সুযোগ করে দেন।

-উৎস তোমার জব কনফার্ম হয়েছে?

-দুলাভাই বায়িং হাউজের জবটা দিয়েছে।

আমি নিবিড় এর দিকে তাকালাম মুখ ঘুরিয়ে। নিবিড় আমার বাহুতে একটু চাপ বাড়িয়ে দিয়ে বোঝালো ও দিয়েছে। কিন্তু কেন? আমার চোখমুখ দেখে নিবিড় বুঝে গেল আমার প্রশ্ন।

-উৎস সত্যি মেয়েটাকে ভালোবাসে। জীবনে একসাথে থাকতে চায়। আর উৎস মেয়েটাকে সুখেই রাখবে। শুধু জব নেই বলে কেউ মানবে না, ভালোবাসার পূর্নতা পাবে না। তা কেন? যেহেতু ওর কাজ ভালো, অনেকগুলো ইন্টারভিউ দিচ্ছে। তবে আমার এইখানেই করুক। আস্তেধীরে উন্নতি হবে। আর আমি কিছু করিনি। ওর নিজের যোগ্যতায় জব টা পেয়েছে।

-তুমি কি করে জানলে?

-মায়াবী! আমি দুলাভাইকে শেয়ার করেছিলাম। কিছুদিন মন খারাপ ছিল। দুলাভাই আমাকে বাইরে ডেকে জিজ্ঞেস করে। সমস্যার কথা বলেছিলাম। দুলাভাই বলল, ইন্টারভিউ দিতে থাকো একটায় না একটায় হবেই। বায়িংহাউজের জন্য ইন্টারভিউটা দিলাম। আজ দুলাভাই অফিস ডাকলেন। জানতাম না সেক্টরটা দুলাভাই এর আন্ডারে। উনি জবটা কনফার্ম করে দিলেন। আসলে মায়াবী জানিস, আমি সব জায়গা থেকে রিজেক্ট হচ্ছিলাম। বরাবরের মতো জানতাম এখানেও জবটা হবে না।কিন্তু শুধুমাত্র দুলাভাই বলেছেন বলে জবটা হলো। আমার এখন জব দরকার। তাই নাও করতে পারিনি। তোর হাসবেন্ড দ্যা বেস্টম্যান। এমন মানুষ কি করে পেলি বোন?

সত্যি মনটা ভালো হয়ে গেল। নিবিড় এর মতো আমায় আর কেউ বুঝবেনা। শুধু আমার বেলায় না। আমার ফ্যামিলির প্রতিটা মেম্বারের ও কি সুন্দর খেয়াল রাখে।

সবাই এইদিকে হৈ-হুল্লোড় করে উঠেছে। উৎসের জব হয়েছে বলে একদিক থেকে বিষয়টা স্বাভাবিক হলো। বাকিটা আমার দায়িত্ব। সবাই আড্ডায় মেতেছে, মা আমাকে ডেকে বলছেন,

-মায়াবী মা তুই খেয়ে নে। এভাবে খালি পেতে বেশিক্ষণ থাকিস না। আয় মা।

আসছি বলে থেমে গেলাম। সমবয়সী প্রেম নিয়ে হটাৎ কথা উঠেছে তাই। নীরব বলল,

-উৎস তুমি খুব লাকি, সমবয়সী প্রেম করলে অনেক সুন্দর হয় সম্পর্ক।

-সমবয়সী হলেই এমন সম্পর্ক হয় না। ঝগড়া হয় বেশি। এজ ডিফারেন্স বেশি হলে সম্পর্কের আন্ডারস্ট্যান্ডিং বেশি হয়। এটা মায়াবী আপি আর দুলাভাইকে দেখলেই বোঝা যায়।

-খুব এক্সপেরিয়েন্স মনে হচ্ছে!

-নাহ। কোনো প্রকার এক্সপেরিয়েন্স আমার নেই?।

-তোমার আর কি বয়স। ১৪-১৫ তে আরকি বুঝবা।

-I’m 17. (বলেই মুখ ফিরিয়ে নিলো তিন্নি।)

ওর খুব অভিমান হয়েছে। নীরবের কি হলো জানি না। তিন্নির গাল ধরে টেনে ধরে ওর দিকে ফেরালো। তিন্নির সাথে আমারো চোখ বড় বড় হয়ে গেছে। এই ছেলে করছে টা কি বুঝতে পারলাম না। নিজেই আবার বলল,

-সরি পুচ্চু। রাগ করে না।

এই ছেলের আচরণ আমার বোধগম্য হলো এখন। উৎস তাল মিলালো, তিন্নি একটুতেই মন খারাপ করে। মৌ বলছে তিন্নি এমনই, ন্যাকামি কেবল। কিন্তু তিন্নি কিছু বলছে না। বরং লজ্জা পাচ্ছে। নীরব গাল থেকে হাত নামিয়ে তাকিয়ে আছে তিন্নির দিকে। ফর্সা মেয়েটা কয়েক সেকেন্ডে লাল হয়ে উঠেছে। লজ্জায় উপরে তাকাচ্ছে না। এসব এখন নীরবের চোখে ধরা পরেছে। নীবর তাকিয়েই আছে। ব্যাপারটা ভালো লাগলো না আমার। আমি মেয়েটাকে টেনে আমার সাথে রান্নাঘরে নিয়ে এলাম। যখন হাত ধরে টেনে আনলাম তখন নীরব আমাদের দিকে তাকিয়ে রইলো।

কালরাত পর্যন্ত ঠিক ছিল বিষয়টা। আজকে থেকে কেমন যেন হয়ে গেল সবটা। আজ সারাদিন নীরব তিন্নির সাথে গল্প করেছে। ফোনে কিছু দেখানো, এক সোফায় পাশাপাশি বসে অনেক বিষয়ে কথা বলা সবই দেখেছি। নীরবকে কখনোই কোনো মেয়ের সাথে এভাবে কথা বলতে দেখিনি। আমি যে ওর একমাত্র মেয়ে বন্ধু ছিলাম সেখানেও নীরব আমার সাথে ঘেষে বসেনি। দূরত্ব রেখে কথা বলেছে। কিন্তু নীরব তিন্নিকে নিজের রুমে নিয়েও আড্ডা দিয়েছে বিকালে। আমার চিন্তা হচ্ছে মাকে নিয়ে। মা এসবকে কখনোই ভালো চোখে দেখবেন না। আমি জানি এখানে যা হচ্ছে সবটা হাতের বাহিরে, বলার মতো না। তিন্নিকে আমার কাছে এনে বসিয়েও লাভ হলো না। নীরব রুমে এসে ডেকে নিয়ে গেল। তিন্নির ওই লাজুক মুখশ্রী একদিন আমার অষ্টাদশের নিজেকে মনে করালো। যখন এক যুবকের জন্য নাম না জানা এক টানের কারনে ছুটে যেতাম ছাদে। তাই তিন্নিকে বাঁধা দিতে পারলাম না। এ কেমন দোটানায় পরেছি আমি।

———————————-

মেঠোপথের দুপাশে আকাশী গাছের ছায়া। এতো সুন্দর মনোরম দৃশ্য গত সাত বছরে দেখা হয়নি। পাখিদের অনবরত কিচিরমিচির শব্দে এক অজানা ভালোলাগা পরিস্ফুট ঘটছে। অসম্ভব মন ভোলানো এক গন্ধে মাতোয়ারা আমি। তবে রোদ নেই। কুয়াশায় সবটা ঢাকা। চাচ্চি বলেছিলেন যেন শীতে ঘুরতে যাই। গ্রামের সৌন্দর্য নাকি আরো কয়েকগুণ বেড়ে যায় শীতে। আসলে গ্রাম বলা চলে না। মানিকগঞ্জের বনখুরী এলাকায় আমার দাদাবাড়ী। এইখানেই বড় চাচা আর ছোট চাচার ফ্যামিলি থাকেন। এলাকা সদরের মধ্যে পরে। আর উন্নত দেখে বলা চলে একে মফস্বল। আমার বড় চাচার বেশ কয়েকটা সমিল আছে। আর ছোট চাচার ইট বালুর ব্যবসা। বাবা মেজো ছিলেন এবং বাবার ছোট এক ফুপু। বাবা পড়াশোনায় ভালো ছিলেন বলেই সরকারি চাকরি হয়ে যায়। মাকে নিয়ে শহরমুখী হয়ে যান। বাড়িতে জায়গা সম্পত্তির ভাগ বাবার চায় না আগেই বলে দিয়েছেন। মা বাঁচা থাকতে প্রতিবছর দুইবার আসতেন। শীতে আর গরমের ছুটিতে। মা মারা যাবার পর আমাকে তিন চারবার বাবা নিয়ে এসেছেন। তাও ছোট থাকতেই। শেষবার এসেছিলাম এসএসসি এর পর। এরপর আর হয়নি। আজ এসেছি উৎসের বিয়ের কথা বলতে। জানি না আমি কতোটা সফলতা পাবো। কিন্তু আমার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবেই।

আমি যাচ্ছি বলে রাস্তায় অনেকবার বড় চাচ্চি ছোট চাচ্ছি, ভাইবোনেরা ফোন দিয়ে ফেলেছে। নিবিড় গাড়ি চালাচ্ছে। আমি ওর পাশে। উৎস, মৌ আর শশী আপু পিছনে। যাচ্ছি আমাদের গাড়িটা নিয়ে। প্রাইভেটকার বলে এর বেশি কাউকে আনা হয়নি। তাছাড়া কাল সকালে আবার চলেও যাবো। একদিনের ব্যপার বলে তিন্নিকে রেখে আসতে হলো। যদিও আমার বাবার বাসায় রেখে আসতে চাইলাম। নীরব বলল রেখে যেতে ওকে ওদের বাসায়। আমার শাশুড়ী ও বললেন তিন্নি এখানেই থাকুক। আমি থাকব না, একা একা লাগবে তাই। মায়ের মুখের উপর কথা বলতে পারলাম না। শশী আপু প্রথমবার আসল শ্বশুড়বাড়ি দেখতে চেয়েছে তাই ওকে আনা। আবার ভেবেছিলাম মৌকে রেখে তিন্নিকে নিয়ে যাই। মৌয়ের মা মানে ছোট চাচ্ছি ওকে নিয়ে যেতে বলল। সামনে এসএসসি তাই। সব মিলিয়ে তিন্নিকেই আমার রেখে আসতে হলো। সৌন্দর্যতা দেখে আমি মুগ্ধ। কিন্তু মন এখনো কেমন যেন করছে। মনে হচ্ছে কিছু অঘটন হবে। এসব ভাবতে ভাবতে পৌঁছে গেলাম সাধের দাদাবাড়ীতে।

এত সুন্দর করে স্বাগতম করা হবে ভাবতেই পারিনি আমি। নিবিড় তো ভীষন খুশি। এইদিকে আমার আলাদা যত্ন হচ্ছে। আশেপাশের মানুষজন দেখতে এসেছে। ফরহাদের মেয়ে আর মেয়ে জামাই এসেছে। সাথে ছেলের বউ ও। আবার চাচ্চি দুইজন বল দিলেন সবাইকে, আমি নাকি পোয়াতি হয়েছি। এ শুনে ওনারা আরো খুশি। ভালো লাগছে দেখে। এখন বলি ভাইবোন আর ভাবীদের কথা। বড় চাচার দুই ছেলে এক মেয়ে। বড় আপুর বিয়ে হয়ে গেছে আরো বারো বছর আগে। তারপরের ভাইয়ার বিয়ে হয়েছে। ভাইয়া চাচার সাথেই ব্যবসা দেখাশোনা করেন। ভাবী আর ভাইয়ার বাবু হয়েছে দুইটা। আমার একটা সাত বছরের ভাইপো একটা পাঁচ বছরের ভাইজি। পরের ভাই উৎস। আর ছোট চাচার বড় ছেলে আমার থেকে পাচঁ বছরের বড়। বিয়ে করেছে। বাবু আছে দুই বছরের একটা। ভাবি ভাইয়া ও এইখানেই থাকেন। তারপর মৌ। তারপর একটা ভাই মৃদুল। এইটা ক্লাস এইটে পড়ে। সারাদিন ক্রিকেট খেলায় ব্যস্ত। তিন্নি আমার ফুপাতো বোন। ওর বড় ভাই আছে একটা। এখনো পড়াশোনা করছে এবোর্ডে। ফুপা ফুপু টাঙ্গাইলে থাকেন মৌকে নিয়ে। আমার চাচ্চি দুইজন খুব ভালো মানুষ। সবাইকে এখনো একত্রে ধরে রেখেছেন। এতো বড় পরিবার, অথচ সবাই একসাথে খায়। সবার আচরনে আরো একটু ভরসা পেলাম। যে কাজ করতে এসেছি সবটা বুঝি ভালোভাবে হবে। নিবিড় দেখি টেনশন ছাড়া। দিব্যি ঘুরছে ফিরছে। সবার সাথে এমন ভাবে মিশে গেছে ছেলেটা। মনে হচ্ছে ওর দাদাবাড়ী। ভাইপো আর ভাইজির সাথে খেলছে। ভাবীদের সাথে গল্প। ভাইদের সাথে ব্যবসার বেপারে আলোচনা। তবে সবকিছুর মাঝে আমার দিকে ঠিক খেয়াল আছে। ১০-১৫ মিনিট পরপর এসে জিজ্ঞেস করছে,

-মায়াবিনী একদম নড়াচড়া করবা না। চুপচাপ থাকবা। আমার বাবুর ক্ষুদা পেয়েছে? কিছু খাবা? ভাবীদের বলবো তোমায় খেতে দিতে?

এসব দেখে ভাবী দুইজন হেসেই শেষ। আমার জামাই নাকি বউ পাগল। সাথে শশী আপু ও ওই ভাবীদের আস্কারা দিচ্ছে। তাল মেলাচ্ছে আসলেই এমন। আমাদের বিয়ের কাহিনি ও শোনাচ্ছে। এইদিকে চাচ্চিদের সামনেই আমার জামাই আমাকে মুখে তুলে খাইয়ে দিচ্ছে। গুরুজনেরা মুচকি মুচকি হাসছেন। আমার জামাইটার আসলেই লজ্জা নাই। অসভ্য একটা!

-বারবার আমাকে খাওয়ানোর নাম করে ভাবীদের কাছে যেতে চাচ্ছো কেন? উনাদের বাচ্চা হয়ে গেছে ফাজিল লোক।

-এ্যাঁ? তুমি তো অনেক হিংসুটে। ভাবীরা দেখে যান আপনাদের ননদ আমায় সন্দেহ করছে। কি মেয়ের সাথে যে বিয়ে দিলেন।

-কপাল লাগে এমন মেয়ে পেতে বুঝলে? সুন্দরী দেখে পাগল হয়ে বিয়ে করেছো এখন এই কথা না!

-রুপে না ভাবী ভালোবাসায়। আপনাদের ননদের প্রেমে মাতাল আমি। পাগলের মতো ভালোবাসি ওকে।

এ ছেলেকে কি দিয়ে তৈরি করা হয়েছে? এমন প্রেমে ডুবে যাবো মনে হয়। ভেবে এক লজ্জা মাখানো হাসি দিলাম। ভাবী চাচ্ছীরা আমার স্বামীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ।

সন্ধ্যায় এক বৈঠক বসানো হলো। সবই নিবিড়ের উদ্যোগে। ও চেয়েছে বলে। চাচা চাচ্ছি ভাই ভাবীরা সবাই একত্রিত হলো। আমরা জরুরি কিছু বলতে এসেছি এটা সবাই বুঝেছে। কিন্তু কারন কি জানে না। বড়চাচা ভীষণ রাগী মানুষ। কি বলে শুরু করবো জানি না। কিন্তু বলতে হবে। তাই নিজেই বললাম। কিছুক্ষণ পনপন নীরবতা। বড়চাচা উঠে দাঁড়িয়ে গেলেন। চাচ্ছিরা ঢোক গিলছেন। আমিও চাচার সামনে উঠে গেলাম। ছোট চাচা চেয়ার থেকে উঠে আমার আর বড়চাচার সামনে এসে দাঁড়ালেন। বড় চাচা বললেন,

-ফরহাদ আর মমতার মেয়ে না শুধু আমার মেয়েও তুমি। তুমি আরো দুইবছর পর বলতে তখনই মেনে যেতাম। জামাই নিয়ে এসেছে। নিজের বাড়ি তোমার। অন্য যা বলবে পাবে মা। কিন্তু এই কথা আর তুলবে না। আমার দ্বারা সম্ভব না।

আমি আর কিছু বলতে গেলাম ছোটচাচা থামিয়ে দিলেন। পরে নিবিড় এগিয়ে এসে বলল,

-আমি এ বাড়ির ছেলে না। জামাই। জামাই হিসেবে অনেক কিছু বলা যায় না। তবে চাচা আমি যদি কিছু বলি মানতে হবে এমন না। কিন্তু মায়াবীর বাবার মতো আপনিও আমার শ্বশুরমশাই। মায়াবীর চাচা মানে আমার ও চাচা। এই হিসেবে আমি কিছু বলতেই পারি।

-তুমি কি বলবে?

চলবে…………

???
প্রিয় পাঠকবৃন্দ, গল্পটাকে নতুন কোনো মোড়ে নিবো না। পুরো গল্পে কিছু কিছু অসংলগ্ন করে এসেছি। ওইগুলোকে সাজিয়ে আনতে আজ এই পর্ব। ধৈর্য নিয়ে রাখুন। আর বেশি বড় করব না গল্পটা❤️❤️।

#তোমার_প্রেমে_মাতাল
#লেখিকা_মায়াবিনী (ছদ্মনাম)
#পর্ব_৩৭
জীবন জোয়ার ভাটার মতো। এই উজারে ভেসে যায় আবার জলের শীতলতায় থমথমে করে জীবন কাটতে থাকে। সবই সময়ের খেলা। সময় থাকতে আমরা বুঝতে পারি না। ফুরিয়ে গেলে কি আপস! আমার সাড়ে তিন মাস চলছে। কিছুটা দম বন্ধ পরিবেশে কয়েক দিন কাটিয়েছি। নিবিড়ের খেয়াল বিন্দু পরিমান কমে নি আমার উপর থেকে। কিন্তু সবসময় শুধু খেয়াল রাখলেই হয় না। আমার মন যে খারাপ নিবিড় তা যেন দেখতেই পেলো না। আজ সকালেও আমায় রুমে এনে নাস্তা খাইয়ে রেখে অফিস গেছে। এরপর থেকে আমি বারান্দায় ঘরেই হাঁটছি, বসেছি, শুয়েছি, বই পড়েছি, খোলা হাওয়া খেয়েছি। কিন্তু একাকিত্ব কাটে না। আমাকে রান্নাঘরে না যেতে কড়া নির্দেশ দিয়েছেন মা। গোটা বিশ পঁচিশদিন প্রায় এমনই চলছে। মা প্রতিদিন আমায় এসে রুমে দেখে যান, প্রতি দু’ঘন্টা পরপর কিছু খাইয়ে রেখে যান। কিন্তু বসে গল্প করেন না। আমিও বলি না বাড়তি কোনো কথা। অভিমান হয়েছে আমার। মা কি বুঝতে পারে না? বাবা এর মাঝে একদিন আমাদের বেডরুমে চলে এলেন। বিয়ের পর এই প্রথম বাবা এই রুমের দরজার বাহিরে এসে কড়া নেড়েছেন। আসলে সন্ধ্যাতেও আমি ড্রয়িংরুমে যাই না। বাবা আমায় দেখছেন না বলেই রুমে এসেছেন। নিজেকে ওড়না দিয়ে পেঁচিয়ে ঢেকে নিলাম। বাবা এসে আমার শরীর স্বাস্থ্য ভালো কি না দেখে গেলেন। শরীর বেশি ভালো না তাই সবার সাথে বসে কথা বলা হয় না, বাবাকে বলে দিলাম। অথচ এমন কোনো ব্যাপার নয়।

————————————-

নিবিড় এর বোঝানো বড়চাচা আর ছোট চাচার এত ভালো লাগবে বুঝতেই পারিনি আমি। আমার মনে হচ্ছিল নিবিড় প্রথম আমার দাদাবাড়ীতে এসেছে। নিবিড় এর উপর যদি উনারা রাগ করেন তখন আমি কি করে এসব মানবো। নিবিড়কেও বা কি মুখ দেখাবো। কিন্তু আমার সাথে বাড়ির প্রতিটি সদস্যকে অবাক করে দিয়ে চাচাদের চুপ করিয়ে দিলো। বোঝা গেল উনারা কথাটা ভাবছেন। আমি আবার উৎসের দিক বিবেচনা করলাম। আমার আর নিবিড় এবং ভাইয়া আর শশী আপুর আন্ডারস্ট্যান্ডিংটা বললাম। উৎসের জব হয়ে গেছে, সুচি নিশ্চয়ই লাকি উৎসের জন্য। আরো কি কি বলে চাচাদের মানিয়ে ফেললাম। সবাই হৈ-হুল্লোড়ের মেতে উঠেছে। বড় চাচ্চি আমায় ডেকে নিয়ে গেলেন রুমে। কি করে উনার ছেলের মন রাখলাম আমি যেন ভেবেই পাচ্ছেন না। উনি সবটা জেনেও চাচাকে বলতে পারছিলেন না। সেখানে আমি আর আমার জামাইকে নিয়ে চলে এলাম চাচাকে বলতে। আরো বললেন,

-যদি মেয়ের বাড়ির মানুষ বিয়েতে রাজি ও না হয় তাও আমার আপসোস নেই মা। তুই এত দূর চেষ্টা করেছিস। আমি কখনো ভুলবো না। অনেক সুখি হো।

মনটা ভালো হয়ে গেল। আমার যতটুকু করার ছিল আমি করে ফেলেছি। উৎস আমার কাছে যে আশা করেছিল তা আমি দিতে পেরেছি। উৎস এসে বড়চাচ্চির রুমে আমায় জড়িয়ে ধরলো। খুশিতে চোখমুখ লাল করে ফেলেছে।

-মায়াবী তোকে ছাড়া বাবাকে কখনো রাজি করানো ছিল অসম্ভব। তুই আমার জন্য কি করে পারলি এত কিছু করতে!

-আমার ভাই আমার কাছে প্রথম কিছু চেয়েছে। আর আমি ওকে ফিরিয়ে দিবো? মন ভালো হয়েছে তোর?

নিবিড় আর ছোটচাচা পেছনে এসে দাড়িয়েছে। আমার খুব দোয়া করে দিলেন চাচা। নিবিড় এর মুখে প্রশান্তির ছায়া নেমেছে।

পরেরদিন দুইচাচা, নিবিড়, ছোট চাচার ছেলে মিয়াদ ভাইয়া আর উৎস মিলে সুচিদের বাসায় বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে গেল। আমরা চলে আসতে চাইলাম। ছোটচাচা আর ভাইয়ারা কিছুতেই নিবিড়কে ছাড়া মেয়ের বাড়িতে যাবে না। এইদিকে ভাবী চাচ্চিরাও আমায় ছাড়বে না। এতদিন পর বাড়ির মেয়ে এসেছে বলে কথা। উল্টো ফয়সাল ভাইয়াকে ফোন করে আনলো। এইদিকে আমার আর চাচ্চির টেনশনের নেই শেষ। কি হচ্ছে ও বাড়িতে কে জানে। নিবিড়কে ফোন দিতে চাইলাম। আবার ভাবলাম ব্যস্ত থাকবে। চাচাদের সামনে ফোন ধরতেও ইতস্তত করতে পারে। ভাবী এসে খেতে বলল আমায়। খাবো না এখন বলায় ভাবী বলল,

-তোমার জামাই এর কড়া নির্দেশ। না খেলে নাকি মুখে তুলে খাইয়ে দিতে বলছে। হা করো ননদিনী।

-আহ ভাবী এখন গলা দিয়ে নামবে না যাও তো।

-তোমার ভাই দের কাছে তোমার জামাই বিচার দিবে, বড়ভাবী আর আমি যদি তোমার খেয়াল না রাখি।

-মায়াবী ভাবী খা। তোর জামাই নাইলে আমার ও চুল রাখবে না একটাও। যাওয়ার আগে পইপই করে বলে রেখে গেছে।

বুঝলাম তিন ভাবীকে নিবিড় বড় ডোজ দিয়ে গেছে। আমার জামাই এমনি খুবই ভালো, কিন্তু সে তার বউ বাচ্চা নিয়ে খুবই সিরিয়াস। তাই ভাবীদের না জ্বালিয়ে খেয়ে নিলাম।

সবার চিন্তার অবসান করে ওরা বাসায় ফিরে এলো। কারো মুখে হাসি নেই। চাচারা এমনি গম্ভীর থাকেন। তাই উনাদের দিকে তাকিয়ে কিছু বোঝাবার উপায় নেই। নিবিড় আর মিয়াদ ভাইয়া গাড়ি থেকে নেমে কিছু সিরিয়াস ব্যাপারে ডিসকাস করছে। উৎস নেই তো সাথে। গাড়ি থেকেও নামে নাই। গেছে কোথায়? নিবিড় কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো ভাবীরা ঠিক মতো খেয়াল রেখেছে কিনা। আমি থামিয়ে দিয়ে বললাম,

-ওখানে কি হয়েছে?

চাচ্চি, ভাবীরা দৌড়ে এসেছে। কেউ বলতে পারলো না আর কিছু। উৎস মিষ্টি এনেছে। বাকিটা ভাইয়ার এসে বলল। সুচির বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছিলো তার জন্য সমস্যা হচ্ছিল। পরে নিবিড় আমাদের বিয়ে নিয়ে বলেছে। বাকি আরো অনেক কিছু। এমনকি সুচির বাবার সাথে আমার বাবার কথা বলিয়ে দিয়েছে। এমনকি ভবিষ্যতে কোনো কিছু হলে দায়িত্ব নিবিড় এর নিজের। এমন ও বলে এসেছে। সাতদিনের মাঝে বিয়ের ডেট ফেলে দিয়েছে। চাচারা ওইটা নিয়ে মিটিং করছে।

বাড়িতে বিয়ের আমেজ। সবাই ভীষণ খুশি। আমাদের আর যাওয়া হলো না। আমার শ্বশুরবাড়ির সবাইকে আসতে বলা হলো। জানি বিয়েরদিনের আগে বাবা মা আসবে না। তাই নীরবকেই বলে দিলাম তিন্নিকে নিয়ে চলে আসতে। ফুপি ফুপা চলে আসবেন দুই একদিনের মাঝে। তার আগে তিন্নি না এলে অনেক সমস্যা। আবার আমার নিজস্ব ভয় তো আছে। নীরবকে নিয়ে আর বাঁচি না। এই ছেলে আজ না কাল করে দুইদিন পর এলো তিন্নিকে নিয়ে। ভয় লাগছে আমার। নীরব আর তিন্নি একে অন্যকে যেভাবে দেখে যেকোনো কেউ দেখলে বুঝে যাবে ব্যাপারটা। কিন্তু অন্য কারো চোখে পরছে না কেন?

বিয়ের আর দুইদিন বাকি। নিবিড় আমায় চোখে হারায়। নিজে লেপটপে মিটিং করে। অথচ ওই সময়টা আমায় সামনে বসিয়ে রাখে। আমি ওয়াশরুমে গিয়েও শান্তি নেই। দরজা খুলেই দেখি নিবিড় দাঁড়িয়ে থাকে। আমার পরে যাবার অনেক অভ্যেস আছে। নিবিড় এগুলো জানে। তাই এইসব। কিন্তু এগুলো করতে যেয়ে বিয়ে বাড়ি গ্রামের মানুষজনের দৃষ্টিকটু হচ্ছে এসবে কোনো খেয়াল নেই। লজ্জায় গুরুজনদের সামনে যেতে পারি না। আমার ভাই গুলো ভীষন মজার মানুষ। উনারা আমাকে ক্ষেপিয়ে দেন। নিবিড়কে বাহ বাহ দেন। এইদিকে ভাবীরা আগুন। বোনের জামাইয়ের কাছে থেকে এসব শিখতে পারো না বলে ঝগড়া করছে। আমার ভাইগুলোর শান্তি নাই। ভাবীরা ঠিক মত খেতেও দিচ্ছে না। এখন নিবিড় ভাইয়াদেরকে ওর মতো হওয়ার ফর্মুলা দিচ্ছে। এই ছেলেকে নিয়ে কি যে হবে আমার।

আজ দুপুরে সব পুকুরে নামবে। উৎসকে হলুদ লাগিয়ে গোছল দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সবার সাথে ও নামবে। আমি নামতে চাচ্ছি কিন্তু নিবিড় বড় করে তাকিয়ে আছে। ভয়ে কিছু বলতে পারছি না। ভাবীরা জিজ্ঞেস করলো কয় মাস। আমি দেড় মাস বলেছি। তাই আমাকে নামতে বলল। কি করে বলি আমার আড়াই মাস পেরিয়ে গেছে। ভালো লাগছে না। নিবিড় ও চুপ হয়ে গেল। কিছু বলছে না। মাথা নিচু করে আছে। আমি ওর কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছি।

-নামবো না আমি।

নিবিড় মুখ তুলে তাকালো। ঠোঁট বেঁকেছে। মানে হেসেছে। তারপর নিজে নেমে গেল। পুকুরে খুব বেশি পানি নেই। আমার সামনে হাত বাড়িয়ে দিলো। তারপর নিজেই সাবধানে আমায় নামিয়ে নিলো। সেই ছোটবেলায় একবার নেমেছিলাম। এরপর আর হয়নি। নিবিড় ভাইয়াদের বলল আমার এই সময়, আবার সাতার জানি না। তাই ধরে রেখেছে। হটাৎ খেয়াল ভাঙলো নিবিড়ের জন্য। এই ছেলে পানির মাঝে এসব কি করছে। চোখ গরম করে তাকালাম। লাভ খুব একটা হয়নি। উল্টো আরো জোরে চেপে ধরেছে কোমড়। পিঠে, পেটে ওর অবাধ্য হাতের আঙুল ঘোরাফেরা করছে। পানির মাঝে বলে তেমন কারো খেয়াল নেই এসবে। তিন্নি, মৌ, উৎস, নীরব, মৃদুল, মিয়াদ ভাইয়া, ফয়সাল ভাইয়া সহ উৎসের নানুবাড়ির ভাইবোনরা মজা করছে। নিবিড়এর কান্ডে আমি আপাতত হতবাক। ওর পিঠে জোরে চিমটি মেরে দিলাম। ছেলেটা কিছু বলল না। উল্টো ওর ছোঁয়া গভীর হলো। ওর দিকে তাকাতেই চোখ মেরে দিলো। রেগে ফেটে গেলাম। এখন বুঝলাম আমার মন রাখাতে নামায় নাই পানিতে।

-জান কেমন লাগছে?

রাগে মুখ দিয়ে কিছু বের হলো না। ওর কাছে থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলাম একঝটকায়। উঠে যেতে লাগলাম। নিবিড় ফের আমায় ধরে ফেলল। ভাবলাম রাগ কমাবে। কিন্তু তা হলো না। লাজ লজ্জার মাথা খেয়ে আমার বড়ভাইদের সামনে কোলে নিয়ে নিলো। পেছন থেকে পিচ্চি বিচ্ছুর দলগুলো হেসেই শেষ। পুকুরের ঘাট সিড়ি করা বলে দিব্যি আমায় নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে আমার গুনধর অসভ্য বর। ভাবীরা ঘাটের পাশে বসে মজা নিচ্ছে। নিবিড়ের দিকে তাকিয়ে চুপিচুপি নিচু গলায় বললাম,

-বাসায় যেয়ে নেই। হিসেব কড়ায় গন্ডায় চুকাবো।

আমার নিলজ্জ বর দাঁত কেলানো এক হাসি দিলো। যার অর্থ পরের টা পরে দেখে নিবো। আহ, বিরক্তিকর! পিচ্চিগুলো হাসছে আর টোন মারছে বলে নিবিড়ের ঘাড়ের উপর দিয়ে ওদের দিকে তাকালাম। সবাই আমাদেরই দেখছে। হাসি তামাশা করছে। কিন্তু নীরব হাসছে না। বরং তাকিয়েই আছে। ওমনি দেখলাম তিন্নি যেয়ে নীরবের কাঁধে হাত রাখলো। বাকি কিছু দেখতে পেলাম না। উপরে চলে এসেছি। জামা পাল্টে তাড়াতাড়ি আবার পুকুরপাড়ে যেতে নিলাম। নিবিড় থামিয়ে দিয়ে আমার মাথা মুছিয়ে দিচ্ছে। তাড়াহুড়োতে মোছা হয়নি। তারপর নিবিড়কে জোর করে সরিয়ে পুকুরপাড়ে এলাম। এসে দেখি বড় ভাইয়ারা সব উঠে গেছে। ভাবীরাও নেই। বিচ্ছুগুলোই কেবল এখানে। কিন্তু আমার চোখ অন্য কারো দিকে। এক কর্ণারে দেখি নীরব আর তিন্নি। কি করছে ওরা? পানির মাঝে এত কাছাকাছি। নীরব যেভাবে তিন্নিকে ছুঁয়ে যাচ্ছে নিবিড় বিয়ের আগে আমাকে এভাবে ছুঁয়ে দেখেনি। আর ওদের মাঝে যা চলছে যা তা তো সাতদিন ও হয়নি। আমার বোন এখনো কলেজের গন্ডি পেরোয়নি। জোরে তিন্নি বলে ডাক দেওয়ায় ওদের ধ্যান ভাঙলো। নিবিড় আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। তিন্নিকে ইশারা করে উপরে আনলাম। বিয়ে বাড়িতে এসব নিয়ে আলোচনা করা যাবে না। কেউ না কেউ শুনবেই। নিবিড় নীরবের সাথে কথা বলবে আমি জানি। তাই আমরা নিজেদের মাঝেও কিছু বললাম না।

আজ রাতেই হলুদ। আমার শ্বশুর শাশুড়ী চলে এসেছেন। আমার বাবা আরো দুইদিন আগে এসেছেন। আমার বাবা আর শ্বশুর শাশুড়ীর সাথে বড়চাচা আর চাচ্চি কথা বলবেন। আমাকে আর নিবিড়কে ডাকলো বড় চাচার রুমে। উদ্দেশ্য নিবিড়কে নিয়ে। ওর মতো ছেলে পাওয়া ভাগ্যের। উৎসের জব, বিয়ে, মেয়ের বাড়ি রাজি করানো এমনকি নিজের কাজের ক্ষতি করে সাতদিন ধরে বউ এর দাদাবাড়িতে কাজ করছে বউ এর চাচাতো ভাইয়ের বিয়ে বলে। এমন জামাই আমার বাবা পেয়েছেন। এতদিন শুধু প্রশংসা শুনেছিলো। এবার নিজে চোখে যা দেখলো তা অবিশ্বাস্য। আরো কতো কি যে বলছেন। খুশিতে চোখ ভিজে এলো আমার। বড়চাচা আমার মাথায় হাত রেখে বললেন,

-নিবিড় বাবাকে কখনো কষ্ট দিও না মা। আল্লাহ নারাজ হবেন। এই ছেলেকে আজীবন আগলে নিজের সাথে বেঁধে রাখবে। দুনিয়াতে এমন ছেলেকে স্বামী হিসেবে পাওয়া কপাল লাগে। খেয়াল রেখো। মানুষের নজর ভালো না। কারো চোখ যেন না লাগে তোমাদের দুইটির।

কেঁদে দিলাম। নিবিড়কে কি করে পেয়েছি আমি? সত্যি কি ওকে পাওয়ার যোগ্যতা আমার আছে? মুগ্ধ নয়নে নিবিড়কে দেখে চলেছি। এই চোখের তৃষ্ণা মেটবার নয়।

বিয়ের দিন রাতে ছাঁদে এক অঘটন ঘটে গেল। যা ভয় পেয়েছি তাই হলো। নীরব আর তিন্নিকে মা দেখে ফেলেছেন অপ্রস্তুতভাবে। এই যুগে এইটা তেমন ব্যাপার নয়। কিন্তু মুরব্বিরা ভালো চোখে দেখবেন না। তার মাঝে নিজের ছেলে। মা-বাবা নীরবকে নিয়ে ফিরে গেলেন ওই রাতেই। বাবার সকালে কলেজে পরীক্ষার গার্ড পড়েছে বলে কাটিয়ে চলে গেলেন। এসব কিছুর দোষ মেয়েদেরই হয়। তার মাঝে বোন আমার। আমি আর নিবিড় পরের দিন সারাদিন বৌভাতে থেকে রাতে ফিরে এলাম। নিবিড় জানে। কিন্তু আমার সাথে কিছু বলছে না। এই বাড়ির কেউ জানে না আর। তিন্নি আমার সামনে আর পরে নাই। এমনি লজ্জা পেয়েছে এখন কিছু বললে সহ্য হবে না। বয়সটাই এমন।তাই ভাবলাম কয়েকদিন যাক। ফোন করে কথা বলে নিবো। বোন হিসেবে আমি ভুল। আমি সব দেখেছি। কিন্তু বলিনি। তিন্নিকে রেখে আসাই ভুল ছিল। তার মাঝে হলুদের দিন যা হলো তখন থামালেও মায়ের চোখে পরতো না। আমি কি করে মাকে ফেস করবো জানি না।

বাসায় ফিরেছি কয়েকদিন হলো। মায়ের সাথে কথা বলতে পারিনি। আসলে মা প্রয়োজন ছাড়া কিছু বলছেন না। তাই আগ বাড়িয়ে আমিও বলতে পারলাম না। মা আমায় বলে দিলেন তিনমাস যেন ঘর থেকে না বের হই। বেবি বাম্প হচ্ছে আমার। সবাই জানে দেড় মাস অথচ আমার প্রায় তিন মাস হতে চলেছে। এখন মানুষ দেখলেই বুঝে যাবে। আমি সত্যি লুকাতে চাই। তাই আমায় কষ্ট করতেই হবে। একমাস ও হয়নি। তাই আমি এভাবে থাকতে পারছি না। কি করে আরো দুই আড়াই মাস পার করবো? আগে মায়ের সাথে কথা বলা উচিত। মা বকুক রাগ করুক কিন্তু আমায় বলতেই হবে। পা বাড়ালাম মায়ের ঘরের দিকে…………

চলবে……..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here