কৃষ্ণচূড়ার দিনে,পর্ব-৪

0
1819

কৃষ্ণচূড়ার দিনে,পর্ব-৪
Writer_Asfiya_Islam_Jannat

নিপা বেগমের ফোন আসতেই তনয় দ্রুত কলটা রিসিভ করলো, তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলল, “ফোন অফ কেন তোমার? কতবার ফোন করেছি জানো?”

অপরপাশ থেকে নিপা বেগম বলে উঠলেন, “আরেহ চার্জ ছিল না,বন্ধ হয়ে গিয়েছিল মোবাইল। তার উপর, তোর ফুপুর বাসায় কারেন্টও ছিল না,পাঁচ মিনিট আগেই এসেছে।”

— অন্য কারো ফোন দিয়ে ফোন দিতা? ওই বাড়িতে নিশ্চয়ই ফোনের আকাল পড়েনি।

নিপা বেগম গলা খেঁকিয়ে বললেন,

— নিয়েছিস তো নতুন নাম্বার, আমি বাদে কারো কাছেই তোর নাম্বার নেই। তো ফোন দিব কেমনে?

তনয় কিছু না বলে চুপ বনে যায়। আগের সিম লকড হয়ে যাওয়ায়, দু’দিন আগেই সে নতুন সিম নিয়েছে। নিপা বেগম বাদে কাউকে নাম্বার দেওয়াও হয়নি। উপরন্ত, অফিসের কিছু কলিগ বাদে কারো নাম্বার সেভও করা হয়নি।
নিপা বেগম আবার বললেন,

— আচ্ছা শোন, পাশের বাসার রিপা ভাবীর মেয়ে রুপের আসার কথা ছিল। সে কি এসেছে? তাদের বাসার চাবি আবার আমার কাছে।

তনয় ভাবলো, এখন এই প্রশ্নের উত্তর না দেওয়াই শ্রেয়। অন্যথায় তার মা দূরে বসেই তাল থেকে যে কি আইটেম তৈরি করে ফেলবে তা আল্লাহ মালুম। বাসায় আসলে নাহয় ঘটনা খুলে বলা যাবে, তাই সে প্রশ্নটা সুক্ষ্মভাবে এড়িয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, “চাবি কোথায় রেখেছ তুমি?”

— তোর বাবার যে ঔষধের ড্রয়ারটা আছে না? তারই মধ্যে বা-সাইডে রেখেছি। কিন্তু মেয়েটা কি…

নিপা বেগম কথাটা সম্পূর্ণ করার আগেই তনয় ফোন কাটলো। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “চাবির সন্ধান পাওয়া গিয়েছে মিস, আপনি একটু অপেক্ষা করুন আমি নিয়ে আসছি।”

কথাটা শুনে রুপের চোখে-মুখে ম্লানভাব ছড়িয়ে গেল,আবহাওয়ার মতই এক ঝাঁক কৃষ্ণমেঘ ভর করলো মনের আঙ্গিনায়। সে যে অনাকাঙ্ক্ষিত একটি চাওয়া পুষে বসে ছিল৷
অন্ধকার হওয়ায় তনয় উপলব্ধি করতে পারলো না কিছুই। সে মোবাইলের ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে চলে গেল নিপা বেগমের রুমের দিকে, মুঠোফোনের কৃত্রিম আলোয় খুঁজতে শুরু করলো চাবিটি। তা দেখে রুপ ভাবল, মানুষটার হয়তো তাকে বিদায় করার বড্ড তাড়া। বিষাদিত হলো মন।
এমন সময় কারেন্ট মহাশয়ও চলে এলো, কৃত্রিমতায় ছেঁয়ে গেল পরিবেশ। রুপ খিঁচে নয়ন দু’টির কপাট বন্ধ করে নিল, আঁধারে থাকায় কৃত্রিম দ্যুতির স্পর্শ সূঁচের মত বিঁধছে অক্ষিকাচে। বার কয়েক অবিশ্রান্ত পল্লব ফেলার পর সইলো সবটা, স্বাভাবিক হলো সে। ধীর পায়ে এগিয়ে গেল সোফার দিকে। হাতের মুঠোয় সযত্নে রাখা কৃষ্ণচূড়াটি অযত্নে ফেলে দিল টি-টেবিলের উপর, নির্জীব ভঙ্গিতে গুছিয়ে নিল ব্যাগ। তনয় ততক্ষণে চাবি নিয়ে ফেরত এসেছে, রুপ একপলক তনয়কে দেখে নিল। মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে বলল, “একটি পলিথিন দেওয়া যাবে? আমার জামাগুলো ভেজা।”

তনয় মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানালো, চাবিটা রুপের হাতের দিয়ে রান্নাঘর থেকে পলিথিন নিয়ে এলো। রুপ সবটা গুছিয়ে সবটার জন্য তনয়কে কৃত্রিম হেসে ধন্যবাদ জানিয়ে কদমগুলো হাতের মুঠোয় পুরে চলে এলো নিজ ফ্ল্যাটে। দরজার তালা খোলার সময় রুপ উপলব্ধি করতে পারলো তনয় পিছন থেকেই তাকে দেখছে। রুপ পিছনে ঘুরলো, দুইজনের দৃষ্টি গাঁথিত হলো একই মুক্ত মালায়। দৃষ্টির প্রখরতা সইতে না পেরে রুপ দ্রুত দৃষ্টি সরালো, বিচলিত হলো মন। হৃদস্পন্দনের গতি যেন অস্বাভাবিক হয়ে উঠলো। কিন্তু তনয়! সে বড্ড স্বাভাবিক, দৃষ্টি তখনও ঠাওর। ঠোঁটের কোনে ঝুলানো ক্ষীন উপহাস। ভাব এমন, রুপকে দেখাটাই যেন তার একান্ত কর্ম। রুপ বুঝলো না সেই দৃষ্টির মানে। তাই অপ্রতিভ হলো, দৃষ্টি নত রেখেই ঘুরে দাঁড়ালো। ধীর গতিতে তালাটা খুলে ঢুকে পড়লো ভিতরে। তনয় তা দেখে লম্বা নিঃশ্বাস ফেললো, কিঞ্চিৎ শব্দ করেই লাগালো দরজাটা। পকেটে হাত গুঁজে এগিয়ে গেল ড্রয়িংরুমের দিকে, নজর গিয়ে আটকালো অযত্নে পড়ে থাকা রক্তিমায় মোড়ানো পুষ্পে। তনয় ধীর পায়ে এগিয়ে গেল সেদিক, খুবই সপ্তপর্ণে হাতে উঠিয়ে নিল পুষ্পটি,

— উপকথা রাজ্যের রাণী কি জানে, তার কৃষ্ণচূড়ার আগুন রঙ্গে পুড়ছে সন্ন্যাসী রাজার হৃদয়?

__________________

রুপ দাঁড়িয়ে আছে বদ্ধ জানালার এপ্রান্তে, নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে দেখছে বৃষ্টি। আজ এই বৃষ্টি তার কাছে তিক্ততায় নয় বরং প্রণয়ভোজনে আবৃত ঠেকছে। প্রগাঢ়তা পাচ্ছে অবিদিত অনুভূতি। প্রণয়ের জোয়ার হানা দিচ্ছে অন্তঃকরণের পাড়ে। রুপ গায়ে থাকা শাড়িটা আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো, মানুষটির স্পর্শ লেগে আছে এতে।

এক আঁধারে নিমজ্জিত রাত্রিতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে রুপ, কৃষ্ণমানবটি দেখেছিল বহুদিন আগেই। সেদিন রাস্তার ধারে হরিদ্রাভ আলোর ছটা মানুষটিকে ছুঁয়ে দিতেই তার মাধুর্যতা বেড়ে গিয়েছিল শতগুণ, তার সেই রূপেই মুগ্ধ হয়েছিল সে। চাহনির তেজে পুড়েছিল মন ও হৃদয় দু’টোই। ক্রাশ খেয়েছিল কি-না নিশ্চিত নয়, তবে অনুভূতির যাত্রার সেখান থেকেই। কৌতূহলী মনের তৃষ্ণা মিটাতেই আড়ালে-আবডালে খোঁজ খবর নেওয়ার পর্ব চলেছিল দীর্ঘদিন, কিন্তু অল্পসংখ্যক তথ্য ব্যতীত জানতে পারেনি কিছুই। এমনকি, হাতে গনা দুই-একবার ব্যতীত দেখাও মিলেনি কৃষ্ণমানবটির। রুপ ধরেই নিয়েছিল, মানবটি তার ধরার ছোঁয়ার বাহিরে। দমিয়ে ফেলেছিল নিজের অনুভূতি। অথচ, আজ এই অনাকাঙ্ক্ষিত সাক্ষাৎ-এ সবকিছুরই যেন নব্য সূচনা হলো। অবিদিত অনুভূতি রূপ নিল প্রণয়ের। প্রথম দিকে মানবটির নিকট ধরা দিতে না চাইলেও পরবর্তীতে দিয়েই ফেলল। কিন্তু মানবটির ব্যবহার যে তার মনকে অশান্ত করে তুলেছে, না চাইতেও ভাবাচ্ছে বার বার। আদৌ তার প্রণয়ের ঢেউ পার পাবে তো, নাকি লণ্ডভণ্ড হয়ে যাবে স্রোতেই?

আর ভাবতে পারলো না রুপ, মাথায় অবোধ যন্ত্রণারা বাসা বেঁধেছে, শরীরের তাপমাত্রা অস্বাভাবিক ভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। জ্বর আসবে বোধহয়। রুপ হালকা কিছু মুখে দিয়ে এন্টিবায়োটিক খেয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিল, মুহূর্তেই পারি জমালো নিদ্রাতুর রাজ্যে।

__________

সেদিন, মধ্য রাতেই রুপের প্রচন্ড জ্বর হলো। উত্তপ্ত হলো বালিশ,বিছানা। মাথা চাড়া দিল সুপ্ত অনুভূতির দল। জ্বরটা আদৌ অসুখের ছিল, নাকি প্রণয়ের তা বলা দায়। তবে জ্বরের প্রকট চললো টানা তিন দিন। মেয়ের অসুখের কথা শুনে রিপা বেগম ঢাকায় ছুটে এলেন পরের দিনই। আদর-যত্নে সুস্থ করে তুলতেন মেয়েকে। শারিরীক অসুখ ভালো হলেও, ভালো হলো না মনের অসুখ। যে প্রেমের বাতিক একবার ফুটেছে, তা কি আর সহজে যাওয়ার?
রুপের তো এখন প্রায় মরি মরি অবস্থা, মন তৃষ্ণাতুর কাঙ্ক্ষিত মানুষটির ঝলক পেতে। কত-শত ছুতো দিয়ে যে ঘুরে এসেছে সেই বাসা থেকে, কৃষ্ণমানবটির সামান্য ঝলক পেতে৷ কিন্তু হাহ্! মানুষটি যেন আসলেই তার ধরার ছোঁয়ার বাহিরে।
কেটে গেল আরেক সপ্তাহ। রুপ মুখ ভার করে বসে আছে সোফার এক কোনায়, দৃষ্টি নিবদ্ধ মুঠোফোনের পর্দায়। মনের কাঠগড়ায় জমেছে অভিমানী মেঘ। কোন ভাবেই দেখা মিলছে না, কাঙ্ক্ষিত মানুষটির। রুপ আনমনেই আওড়ালো,

— মানুষটা কি হেরি পটারের ইনভিজিবল ক্লথের ভিতরে ঘাপটি মেরে বসেছে নাকি? নাহলে একটা মানুষ হুট করে এইভাবে অদৃশ্য হয় কিভাবে? অসহ্য!

বিরক্তিকর নিঃশ্বাস ছেড়ে আনমনেই রুপ প্রতিজ্ঞা করলো আর নিবে না মানুষটির খোঁজ৷ কিশোরী বয়সের প্রেম ভেবে ভুলে যাবে তাকে, অযথা বেদনাদায়ক অনুভূতি পুষে রাখার মানেই হয় না। যার মনে তার অস্তিত্ব নেই, তার জন্য বেহায়া হওয়াও বেমানান। কিন্তু কে জানতো, পরবর্তী প্রহরে ভাঙতে চলেছে এই প্রতিজ্ঞা।
রুপের ভাবনার মাঝেই রিপা বেগম এসে তার পার্শ্বে বসেন,

— কি করছিস?

রিপা বেগমের কথায় রুপ একান্ত ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে বলে, ” তেমন কিছু না মা, নিউজফিড ঘাটছিলাম। কেন কিছু বলবে?”

— হ্যাঁ! কিছু কথা ছিল তোর সাথে।

রুপ ফোনের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেই বলে,

— বল, কি কথা।

রিপা বেগম কথা এদিক সেদিক না করে মূল কথাটাই বললেন, ” তোর জন্য একটা খুব ভালো সম্মন্ধ এসেছে। ছেলে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। একমাত্র ছেলে বাবা-মায়ের।দেখতেও মোটামুটি খারাপ না, আচার-ব্যবহারও ভালো। শুধু গায়ের রঙ একটু চাপা। বাদ বাকি, পরিবারের ব্যাকগ্রাউন্ডও অনেক ভালো। পাত্র হিসাবে ছেলেটাকে আমার মনে ধরেছে।”

রুপ একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলে,

— এতই যখন মনে ধরেছে, নিজে বিয়ে করে ফেলো না। আমাকে কেন কুরবানির গরু বানাচ্ছো?

রিপা বেগম রুপের পিঠে চাপড় মেরে বলেন,

— ফাজলামো করিস আমার সাথে?বেদ্দব মেয়ে একটা!

রুপ দ্রুত রিপা বেগমের কাছ থেকেই একহাত সরে গিয়ে বলে,

— আমি এখন বিয়ে করতে চাই না আম্মু, তা তুমি ভালো করেই জানো। তাহলে কেন বার বার বিয়ে নিয়ে প্রসঙ্গ তুলো?

— পাত্র আমার জানা-শোনা না হলে, আমি এইবার বলতাম না। ছেলের তোকে পছন্দ, সাথে তার মায়েরও। পরিবারটাও ভালো, তুই চিনিস তাদের। ওই যে প..

রুপ কথার মাঝে ফোঁড়ন দিয়ে বলে,

— চেনা হোক আর অচেনা হোক আমি এখন বিয়ে করছি না। আর দুইদিন পর পর এইসব ভালো সম্মোধন কোথাকে উদয় হয় শুনি? পরবর্তীতে যদি আরেকটা বিয়ের সম্মোধন এসেছে না, দেইখো তুমি।

— হয়েছিস একদম বাপের মত জেদি। নিজে যা বুঝিস তাই ঠিক, অন্যের কথার গুরুত্বই নেই।

রুপ উঠে দাঁড়িয়ে বলে,

— বাবার মত হয়েছি বলেই, আমার ছুতো দিয়ে বার বার বাবাকে মনে করতে পারো। নাহলে কি পারতে?

রিপা বেগম কিছু বললেন না, নীরব রইলেন। আজ বছর খানেক হলো তার স্বামী মারা গিয়েছেন। এরপর থেকে তিনিই পরিবারের কর্তা, কত টানপোড়ানের মাঝে যে ছেলে-মেয়ে দুইজনকে বড় করেছেন তা একমাত্র তিনিই জানেন। তাই তো চাইছিলেন, সুস্থ সবল থাকতেই সৎ পাত্রে মেয়েটিকে দান করতে আর ছেলেটাকে একটা লাইন করে দিতে। কিন্তু মেয়ে তো তার বুঝতে নারাজ। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন রিপা বেগম, স্বগোতক্তি কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,

— তার মানে, এই সম্মন্ধে তোর মত নেই?

রুপ নিজের রুমের দিকে যেতে যেতে বলে,

— একদম না।

রিপা বেগম হতাশাজনক নিঃশ্বাস ফেলে বলেন,

— আচ্ছা, তাহলে নিপা ভাবীকে আমি না করে দিচ্ছি।

নিপা বেগমের নাম শুনেই রুপ থমকে দাঁড়ায়, চটজলদি ঘাড় ঘুরিয়ে বলে,

— কাকে মানা করবা?

— পাশের বাসার নিপা ভাবীকে।

রুপ বিস্মিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,

— তাকে না করবা কেন?

রিপা বেগম এক রাশ বিরক্তি নিয়ে বললেন,

— তাকে মানা করবো না তো কাকে করবো? তিনিই তো তার ছেলে জন্য এই সম্মন্ধ এনেছিলেন।

কথাটা শুনে রুপের মাথায় বাজ পড়লো। কানে বাজতে থাকলো রিপা বেগমের একটি কথা, “ছেলের তোকে পছন্দ।” তার মানে, তনয় তাকে পছন্দ করে? কিন্তু কিভাবে? হাও? রুপের হাত-পা মৃদু পরিমানে কাঁপছে, সবটাই স্বপ্ন মনে হচ্ছে। তার হৃদয় হরণকারী মানবটি যে আড়ালে-আবডালে রয়েই এমন কান্ড বসিয়ে ফেলবে তা তো তার ভাবনারও শত মাইল দূরেও অবস্থান করে না। সবটা আদৌ সত্য তো?বেশ কিছুক্ষণ নীরবতা আর ভাবনায় অতিবাহিত হয়ে যেতেই হঠাৎ রুপ লাজ-শরম ভুলে চেঁচিয়ে উঠল,

— মা, আমি বিয়েতে রাজি।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here