অন্তর্দহন_৫

0
1489

অন্তর্দহন_৫
লেখায়- শেখ অলিন্দ্রিয়া রুহি

অন্তরীক্ষে পূর্ণ চাঁদ, জ্যোৎস্নার আলোয় চারিদিক থৈথৈ করছে। সবকিছু স্পষ্ট, দেখতে কষ্ট হয় না। অভ্রর বুকে পড়ন্তকে দেখতেও শায়লার বেগ পেতে হলো না। পা জোড়া যেন কেউ টেনে ধরে রেখেছে মেঝের সঙ্গে। শরীরটা কেমন ঝনঝন করছে, বোধহয় রাগে। পৃথিবীর কোন পুরুষ বিয়ের দ্বিতীয় রাত্রে স্ত্রীকে ফেলে অন্য একটি মেয়েকে গিয়ে জড়িয়ে ধরে? পড়ন্তকে যতই ভালোবাসুক, সে তো এখন অন্য মেয়ে, শায়লা তার নিজ স্ত্রী। শরীয়ত মোতাবেক বিবাহ হয়েছে তাদের। শায়লার কোনো হাত ছিল না। শুধু সে চায়নি অভ্র আর পড়ন্তর ব্যাপারটা বাসায় জানাজানি হোক, বিয়েটা ভাঙুক, সেও তো অভ্রকে খুব ভালোবাসে। রূপে,গুণে কোনোদিন থেকেই সে পড়ন্তর চেয়ে কম না, বরং বেশিই বলা যায়। তবুও কেন অভ্র তাকে মেনে নিতে পারে না? না মানুক, অন্তত সময় তো দিক সম্পর্ক টাকে… তা না সে পড়ন্তকে গিয়ে…!
শায়লার চোখ থেকে আপনা আপনি পানি গড়িয়ে পড়ল।
ইচ্ছে করছে বাবা,মা অথবা চাচা,চাচী কাউকে ডেকে নিয়ে এসে তাদের প্রিয় ছেলে মেয়ের নাটকটা দেখানোর জন্য… পরমুহূর্তেই চিন্তাটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলল সে। পড়ন্তর ভালোবাসা একদিক থেকে সেই কেড়ে নিয়েছে, এমনটাই বোঝায়,তবুও কেউ কী বোঝে না, তাদের ভাগ্য দুজনকে একত্রিত করেছে…
কত ভালোবাসা রোজ রোজ পরাজয় বরণ করে। তবুও মানুষ কী থেমে থাকে? বিয়েশাদি করে ঠিকই সুখের সংসার করে। শুধু প্রয়োজন সময়ের, এই যা… সেই সময়টা অভ্রকে দেওয়ার পরেও এরকম কিছু মোটেও আশা করেনি শায়লা। শায়লা কান্না থামিয়ে দু’হাত দিয়ে মুখটা ভালো করে মুছে নিয়ে শক্ত পদক্ষেপে সামনে আগালো।

-“পড়ন্ত!!” চাপা চিৎকারে ডেকে উঠল শায়লা। পড়ন্ত ভড়কে গেল। মাথা তুলে এই প্রথম বারের মতো বুঝতে পারল, অভ্র তার বিভ্রম ছিল না, এটা অভ্রই.. বাস্তব অভ্র। হঠাৎ করেই সে লজ্জা পেতে শুরু করল। অভ্র এখন অন্য কারো স্বামী৷ তাকে এভাবে জড়িয়ে ধরা…! ব্যাপারটা প্রচন্ড দৃষ্টিকটু। শায়লা নিশ্চয়ই ভাবছে, সে একটা খারাপ মেয়ে। শারীরিক তৃপ্তির জন্যে অভ্রকে এভাবে, এখানে জড়িয়ে ধরেছে সে!
পড়ন্ত ভীত চোখে শায়লার আগুন চাউনি দেখল। কী বলবে, ঠাহর করতে পারল না। অভ্র বলে উঠল,
-“তুই এখানে কেন?” শক্ত চোয়াল অভ্রর।
শায়লা রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল,
-“এই প্রশ্নটা তো তোমাকে করা উচিত। স্ত্রী ফেলে তুমি এখানে কী করো? তাও আরেক মেয়েকে বুকে জড়িয়ে… ছি, ছি, ছি! তোমার এতটা অধপতন হয়ে গেছে!”
-“শায়লা! জাস্ট শ্যাট আপ… পড়ন্ত আমার কী হয়, সেটা তুই ভালো করেই জানিস। ওকে শুধু জড়িয়ে না,চুমুও খাবো৷ তোর সামনেই খাবো, দেখবি?”
শায়লা হতবিহ্বল চোখে তাকাল। কিছু বলতে নেওয়ার আগেই শুনল পড়ন্ত ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলছে,
-“অভ্র ভাইয়া! এসব কী বলছ তুমি? তোমাকে আমি আমার… ভ্রম ভেবে জড়িয়ে ধরছি। আমার তখন সেন্স ছিল না আসলে! নইলে তুমিও জানো, আমার ক্যারেক্টার ঢিলা না।”
-“আমার ক্যারেক্টার ঢিলা, হ্যাঁ?”
-“তোমার সাথে আজাইরা প্যাঁচালে জড়াতে চাই না। শোনো,তুমি বিয়ের আগে তো কোনো স্ট্যান্ড নাও নি… এখন কেন খামোকা আমাদের দু’জনকেই কষ্ট দিতেছো বলো তো? মেনে নাও না… শায়লা আপুকে নিয়ে সুখের সংসার করো। আর আমাকেও আমার মতো ছেড়ে দাও! নিজেকে যখনি একটু সামলে উঠি, তখনি তুমি সামনে এসে সব এলোমেলো করে দাও!!”
শায়লা মাঝ দিয়ে বলে উঠল,
-“তোমার দেখি ভাগ্যের উপরে কোনো আস্থাই নেই! নিয়তি বলেও তো একটা কথা থাকে, তাই না? সব দোষ আমার উপর চাপিয়েছো। আমি তোমাকে ইচ্ছে করে তোমাকে বিয়ে করেছি। আচ্ছা, আমি কী ওই গুন্ডা গুলাকে হায়ার করছিলাম? নাকি চাচা-চাচী আর বাড়ির সবাইকে টাকা খাইয়ে বলছিলাম, তোমার সাথে আমার বিয়েটা দিতে? কোনটা? আমি তো কিছু করিনি! তোমাকে ভালোবাসছি, মনে মনে চাইছি। তারপর ভাগ্য আমাদের এক করে দেওয়ায়,আমিও খুশি মনে সেটা মেনে নিছি। বিয়েটা আসলে কী তোমার কাছে বলো তো? শুধুই ভালোবাসার বৈধ রূপ? নাকি একটা দায়িত্ব? নিয়তি আমাকে একটা নতুন দায়িত্ব দিয়েছে যেটা আমি মাথা থেকে ফেলতে চাইনি, তাই চুপচাপ বিয়েতে মত দিয়েছি। তুমি নাহয় কিছু একটা করতা। আমাকে ফেলে চলে যেতে বা ওকে নিয়েই পালিয়ে যেতে… তাইলেই তো হতো। তা না… বিয়ের আগে তুমি কিচ্ছু করোনি, আর এখন তামাশা দেখাইতেছো? ভালো… অনেক ভালো, বুঝছ!!” শায়লার চোখ অশ্রু দিয়ে ভরে উঠল। সে গটগট করে হেঁটে নিজের ঘরের উদ্দেশ্যে রওনা হলো। অভ্র ভ্রু কুঁচকে ওর যাওয়ার পানে ক্ষণকাল তাকিয়ে থেকে পড়ন্তর দিকে তাকাতেই দেখে, পড়ন্ত রেগে ফুলে আছে। অভ্র প্রশ্নবিদ্ধ চাহনি ছুঁড়ে দিলে পড়ন্ত কাটাকাটা গলায় বলল,
-“নিজেও শান্তিতে থাকো, আমাকেও শান্তিতে থাকতে দাও। প্লিজ, আমার সামনে আর এসো না। প্লিজ, দোহাই লাগে, পায়ে পড়ি।” বলে নিচু হয়ে অভ্রর পা ধরতে নিলে অভ্র চট জলদি সরে দাঁড়াল। পড়ন্তকে বলল,
-“তুই ইচ্ছে করে আমাকে উপেক্ষা করতেছিস, তাই না?”
-“বুঝতেছোই যখন, তখন আর জিজ্ঞেস করতেছো কেন? আমি ভালো থাকতে চাই। আমাকেই আমার সাপোর্ট হতে দাও। আমি কাঁদবো, চিৎকার করব, আবার নিজের চোখ নিজেই মুছে উঠে দাঁড়াব। শুধু তোমাকে দেখলে আমার সমস্ত শক্তি নাই হয়ে যায়। আমি তখন দিকদিশা হারিয়ে ফেলি। তাই প্লিজ… আমার সামনে আর এসো না। নিজের সংসার আর পরিবার নিয়ে সুখে থাকার চেষ্টা করো।”
পড়ন্ত চলে যেতে উদ্যত হলেই অভ্র বিষন্ন কণ্ঠে ডাকে,
-“পড়ন্ত..”
-“ডাকবে না, খবরদার।” পেছন ঘুরে তাকায় না সে। ধীরস্থির ভাবে নিজের ঘরে ঢুকে দরজায় খিল আঁটে।

হতাশা মিশ্রিত দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে অভ্রর বুক চিঁড়ে। রেলিং এ হাত রেখে আকাশপানে তাকাল সে। চোখ জোড়া ছলছল করছে। কী এক দোটানাময় জীবন! যার যার দিক থেকে ভাবতে গেলে সবাই-ই ঠিক! শায়লারও দোষ নেই। কেইবা চায় স্বপ্নের মানুষের সাথে বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরও সেই বিয়ে ভেঙে ফেলতে? অভ্র তো গিয়েছিল বাবার কাছে। যে জবাব আর আচরণ পেয়েছে তাতে আরও ঘাবড়ে ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিল সে। তাই কিছু বুঝে উঠার আগেই যা হওয়ার হয়ে গেছে। আর পড়ন্ত… সেও ঠিক আছে। যতই ভালোবাসুক, একটি মেয়ে অন্য একটি মেয়ের সংসার কখনোই নিজ ইচ্ছায় ভাঙতে চাইবে না। যে মেয়েরা অন্য মেয়ের ঘর ভাঙে, তারা কী হয়? তাদের উপাধি কী? তাদের ভাগ্যই বা কী, তা কী পড়ন্ত বোঝে না? শত ভেবেও কোনো কূল কিনারা পায় না অভ্র। শায়লা নিজ ইচ্ছায় অভ্রকে ছাড়বে না, আর শায়লার থেকে অভ্রকে কেড়ে নিয়ে সংসার গড়বে না পড়ন্ত। মাঝ দিয়ে বেচারা অভ্র… ঝুলতে ঝুলতে আর ভাবতে ভাবতেই পাগল হয়ে যাবে বোধহয়!

ভাবনার গতিপথ টেনে ধরে ঘরের দিকে পা বাড়ায় অভ্র। শরীরটা কেমন যেন করছে। আসলে মনের সঙ্গে শরীর ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মন ভালো না থাকলে শরীর কেন, দুনিয়ার যাবতীয় কোনোকিছুই ভালো লাগে না!

শায়লা খাটের উপর পা ঝুলিয়ে বসে রয়েছে। তার চোখেমুখে পানি লেপ্টে রয়েছে। এতক্ষণ ধরে কাঁদছিল নাকি? অভ্রর বিরক্ত লাগলো। ব্যাগ থেকে একটা টি-শার্ট বের করল সে। শার্ট টা খুলতে খুলতে শায়লাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-“ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে কাঁদবি না খবরদার।”
শায়লা ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,
-“আমার কান্না ফ্যাঁচফ্যাঁচ, আর পড়ন্তর কান্না কী মিউজিকের সুর নাকি?”
-“কথায় কথায় এখন ওর সাথে নিজেকে তুলনা দেওয়া বন্ধ কর।”
-“কেন? আমার কথা শুনলে কান পঁচে যায়, আর ওর কথা শুনলে অন্তরে লাড্ডু ফুঁটে?”
অভ্র বিরক্তিভরা চোখে তাকাল।
-“এই যে, আবার!”
-“কী আবার? যা সত্য তাই তো বললাম। আমার তো কোনোকিছুই তোমার ভালো লাগে না। কোনদিন যেন বলবে, তোর নিঃশ্বাসের আওয়াজটাও ভালো লাগছে না, তখন কী নিঃশ্বাস নেওয়া বন্ধ করে দিবো আমি?”
অভ্রর হাসি পেয়ে গেল। তবে সেটা প্রকাশ করল না সে। ঠোঁটের হাসি চেপে সে ক্ষীণ স্বরে বলল,
-“বন্ধ করলে তো ভালোই.. আমি বেঁচে যেতাম।”
-“কীহহহহ!” উঠে দাঁড়িয়ে কোমরে হাত রেখে চোখ পাঁকিয়ে তাকাল শায়লা। অভ্র পাল্টা চোখ রাঙানি দিল।
-“আমার সাথে একদম ভাব ধরতে আসবি না। দেখি, সর। শোবো..”
-“আচ্ছা, তোমার সামনে এরকম জলজ্যান্ত পরী দাঁড়িয়ে, আর তুমি ফিরেও তাকাও না! মানুষ তো ভুল করেও ভুল করে, তুমি তাও করো না! কেন? তোমার সিস্টেমে সমস্যা নেই তো?”
অভ্র মাত্রই শুয়ে চোখটা বন্ধ করেছিল, শায়লার শেষ বাক্যটা শুনে সঙ্গে সঙ্গে চোখ খুলে ফেলল। লাফ দিয়ে উঠে বসে এক হাত দিয়ে শায়লাকে টেনে বিছানার উপর ফেলে দিয়ে নিজে উপরে উঠে বসল। শায়লা ভড়কে গেছে। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে অভ্রর দিকে। অভ্র নিচু হয়ে শায়লার এত কাছে গেল যে… অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু ঘটার সম্ভাবনা টের পেয়ে তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল। অভ্র আরেকটু কাছে ঝুকতেই চোখ জোড়া দ্রুত বন্ধ করে ঠোঁট টা এগিয়ে দিলো শায়লা। বুক টা দুরুদুরু করে কাঁপছে আনন্দে। আবেদনময়ী হয়ে উঠছে শরীরের প্রতিটি অঙ্গ… এক সেকেন্ড, দু সেকেন্ড, তিন সেকেন্ড… সময় গড়ায়, শায়লা উশখুশ করে অপেক্ষা করছে, অভ্রর অধর স্পর্শ পাওয়ার জন্য। কিন্তু যখন আর কোনো সাড়া পায় না, তখন চোখ খুলতেই অভ্র হো হো করে ডাকাতের ন্যায় উচ্চশব্দে হেসে উঠল। শায়লার কান গরম হয়ে উঠল লজ্জায়। সে দ্রুত উঠে বসার চেষ্টা করতেই অভ্র তার গাল জোড়া টিপ দিয়ে ধরে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
-“এত জ্বালা শরীরের? পানি আনবো? আগুন নিভিয়ে দেই?”
অপমানে শরীর রি রি করে উঠল শায়লার। কান্না পেয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে। কোনো জবাব প্রদান করল না সে। মোচড়ামুচড়ি করতে লাগলে অভ্র সরে বসল। শায়লাও নিজেকে সামলে উঠে বসল। শাড়ির আঁচলটা সুন্দর করে টেনে নিয়ে অশ্রুসজল চোখে অভ্রর দিকে তাকাতেই অভ্র বলল,
-“লাভ নেই। মেয়েদের শরীর নিয়ে কোনোপ্রকার লোভ আমার নেই।”
-“তোমার পুরুষত্বেই সমস্যা…” কণ্ঠ খাদে নামিয়ে ফিসফিস করে চাপা আক্রোশে বলল শায়লা। অভ্র সেটা শুনতে পেল না। সে হাই তুলতে তুলতে পাশ ঘুরে শুয়ে ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গেল।

ওড়নায় টান পড়তেই পা জোড়া থমকে গেল উল্লাসীর। পেছন ফিরে না তাকালেও সে বুঝতে পারল, এই কাজ পাপনের। একমাত্র পাপনেরই সাহস আছে তার ওড়না ধরে টান দেওয়ার। তার জায়গায় অন্য কেউ থাকলে এতক্ষণে উল্লাসীর পাঁচ আঙুলের ছাপ বসে যেত চেহারায়…
উল্লাসী পেছন ঘুরে তাকাল না। তার হাত-পা ভয়ে কাঁপছে। আকলিমা বারবার করে মানা করে দিয়েছিলেন, যতদিন পাপনরা আছে সে যেন বাড়ি থেকে না বেরোয়। পাপনের সামনে তার ছায়াও যেন না পড়ে। তবুও দুপুরের ভাতঘুমের সময় সে পা টিপে টিপে সজলদের বাগানে এসেছে পেয়ারা পাড়তে। কে জানত, এখানে আসাটাই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে!

পাপন বলল,
-“আমার থেকে পালিয়ে বেড়ানো শিখে গেছো দেখছি! এবার? এবার পালাও পারলে…”
উল্লাসীর কণ্ঠ ভিজে উঠল। ইচ্ছে করছে পাপনের বুকের উপর ঝাপিয়ে পড়ে বলতে, ‘আমাকে নিয়ে যাও। আমার আর ভালো লাগে না এই বিরহ…’ কিন্তু পারল না। মেয়েরা চাইলেই অনেক কিছু পারে না। তাদের সাহসের অভাব তো থাকেই, সেই সঙ্গে জড়তাও কাজ করে….
কণ্ঠ স্বাভাবিক করে উল্লাসী বলার চেষ্টা করল,
-“ছাড়ুন।”
তার আগেই পাপন তার অনেকটা কাছে চলে এলো। পেছন থেকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে কাঁধে নিজের থুতুনি রাখতেই উল্লাসীর শরীর ঝনঝন করে উঠল। এক অদ্ভুত শিহরণে শিহরিত হলো সে। মুহূর্তেই হাত-পা অসাড় হয়ে পড়েছে। চলার শক্তিটুকু যেন আর নেই। পাপনকে বাঁধা দিতে গিয়েও পারল না। কেউ দেখে ফেলার ভয়টাও মাথা থেকে হাওয়া হয়ে গেল।
-“আমি জানি, তোমার মা আমাকে আর তোমাকে একসঙ্গে পছন্দ করেন না। কিন্তু কী করব বলো? আমি যে তোমাকে ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারি না! আমি চাইলেও তোমাকে ভুলতে পারি না উল্লাসী। আমি অনার্সটা শেষ করেই চাকরি নেওয়ার চেষ্টা করব যেকোনো মূল্যে। তারপরই বাসায় তোমার কথা বলব। ততদিন এই অধমের জন্য অপেক্ষা করতে পারবে না?”
উল্লাসী বলত্র চাইল, ‘না’ কিন্তু তার মুখ দিয়ে অজান্তেই বেরিয়ে এলো,
-“পারব।”
পাপন উল্লাসীর ঘাড়ে চুমু খেলো। উল্লাসী এবার কেঁপে উঠে ছিটকে দূরে সরে দাঁড়াতেই পাপন হাসল।
-“আমার বউটা এত লজ্জা পায়!”
গাল জোড়ায় রক্তিম আভা, ঠোঁট টা কাঁপছে তিরতির করে… মাথা নুইয়ে ফাঁকা ঢোক গিলতেই পাপনের হাতের টানে তার বুকের উপর গিয়ে পড়ল উল্লাসী। পাপন শক্ত হাতে জড়িয়ে রাখল উল্লাসীকে। কতদিন পর পেয়েছে, আবার কবে না কবে দেখা হবে! এই সময়টুকু শুধু তাদের দু’জনার থাক! উল্লাসী কবুতরের বাচ্চার মতো মিশে রইলো পাপনের বুকে। হৃদযন্ত্রের ধুকপুকানি শুনল চুপচাপ কিছুক্ষণ, তারপর মিইয়ে যাওয়া কণ্ঠে বলল,
-“দোহাই লাগে, ছাড়ুন। কেউ দেখে ফেললে..”
-“ফেলুক। ভয় পাই নাকি?”
-“কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।”
-“লাগুক না কিছু কলঙ্ক, যা একান্তই আমার নামে হবে।”
-“তবুও… আম্মা আমাকে মেরেই ফেলবে।”
-“তার আগেই বউ করে ফেলব।”
-“ইশ! পারবেন না.. আপনার সাহস নেই।”
-“তাই? সাহস নেই বলছ? তাহলে দেখবে এখন এখানে আর কী কী করতে পারি?”
উল্লাসী ভয়ে কেঁপে উঠে দ্রুত বলল,
-“না, না… আ…আমি তো…” তার কথা শেষ করতে পারল না, তার আগেই একটা হুংকার ভেসে এলো দু’জনের কানে। উল্লাসী আৎকে উঠতেই পাপন তাকে ছেড়ে দিয়ে পেছন ঘুরে তাকাতেই ছানাবড়া চোখে তাকিয়ে রইলো আকলিমা, তমিজ উদ্দিন, মিথুন উদ্দিন,সজল আর সজলের বাপ সহ গ্রামের জনাকয়েক মুরুব্বীদের দিকে। উল্লাসীর চোখ বেয়ে শীতল অশ্রু গড়িয়ে পড়ল টপটপ করে। আকলিমা তেড়ে আসলেন ‘খা*** মা**’ উচ্চারণ করতে করতে। উল্লাসী ভয়ের চোটে দু’পা পেছোয়। পাপনের দিকে অসহায় চোখে তাকাল। পাপন মাথা নিচু করে ফেলেছে। আকলিমা উল্লাসীর চুলের মুঠি ধরে ধামাধাম কয়েকটি চড় লাগাতেই সজলের বাপ বললেন,
-“আহ! ছাড়ো আকলিমা… ওগো দুইটারই বিচার হইবো আগে। তারপর তোমার মাইয়ার যা করার কইরো।”
আকলিমা দাঁতে দাঁত পিষ্ট করে সরে দাঁড়ালেন। ঘৃণাভরা চোখ জোড়া পাপনকে আপাদমস্তক পরখ করে নিলো। কীভাবে পারল তার ফুলের মতো মেয়েটির শরীরে কলঙ্কের ছাপ বসিয়ে দিতে? রাগে, দুঃখে, ঘৃণায়, চোখে পানি চলে এলো তার।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here