অন্তর্দহন_৬
লেখায়- শেখ অলিন্দ্রিয়া রুহি
অলস দুপুর, ঘুমটা পুরোপুরি ভাবে জুড়ে বসেছে নেত্রে, ঠিক তখনি একটা রিনরিনে গলার আওয়াজে অভ্রর চোখমুখ কুঁচকে গেল। সে চোখ মেলতেই মুখের উপর শায়লার চোরা চাউনিটা দেখে মেজাজ বিগড়ে ফেলল। ধমকের স্বরে বলে উঠল,
-“কী?”
শায়লা থতমত খেল।
-“না মানে, তোমাকে ডাকতে বলছে।”
-“কে?” পূর্বের স্বরেই বলল অভ্র।
শায়লা মুখ গোমড়া করে জবাব দিল,
-“আব্বু। মানে তোমার আব্বু। পাপনরে নিয়ে সভা বসাইছে। তোমাকে ডাকছে।”
-“পাপনরে নিয়ে সভা বসাইছে মানে!” বুঝতে না পেরে প্রশ্ন করল অভ্র। সেই সাথে উঠেও বসল।
শায়লা বিজ্ঞের ন্যায় বলল,
-“ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে ওদের দু’জনকে পাওয়া গেছে। একদম হাতেনাতে ধরা যাকে বলে। দুটা মিলে আকাম কুকাম করতেছিল নাকি। তাই জন্যে সভা ডাকছে। তোমাকে জলদি যাইতে বলছে।”
-“মানে কী! পাপন আর কে?”
-“উল্লাসী।”
-“আকলিমা কাকীর মেয়ে উল্লাসী না?”
-“হুঁ।”
অভ্র থ বনে গেল। এই দুটিতে মিলে আবার কোন ভোজগট পাঁকিয়েছে কে জানে, তবে যেহেতু সভা বসে গেছে এর মানে মামলা সিরিয়াস! অভ্র শায়লার সঙ্গে কথা বাড়াল না, দ্রুত বিছানা ছেড়ে নামল।
উঠোনে সভা বসেছে। গ্রামের চেয়ারম্যান, মেম্বারসহ আরও অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ রয়েছে। আছে তমিজ উদ্দিন আর তার দুই ভাই। আকলিমার মা-ও এক পাশে দাঁড়িয়ে নিরবে কাঁদছে। ইতিমধ্যেই তার কানে কিছু উড়ন্ত কথা এসেছে। গ্রামের সবাই নাকি ছি ছি করছে উল্লাসীকে। পাপন ছেলে মানুষ, ছেলেদের এসব ছুকছুকানির স্বভাব থাকেই। তাই বলে সে মেয়ে হয়ে কেন ধরা দিবে? তাও দিন দুপুরে ক্ষেতের মধ্যে! রশিদ হাওলাদারের পুত্র সিয়াম হাওলাদারের জন্যে উল্লাসীকে অনেক আগে চেয়েছিলেন তিনি। সিয়ামও উল্লাসীকে ভীষণ পছন্দ করত। আকলিমা ডাট দেখিয়ে দেয়নি, প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছে। অথচ আজ রশিদ হাওলাদার আকলিমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলেছেন,
-“আল্লাহ যা করেন, ভালার লাইগাই করেন। তোমার এই খা*** মাইয়া আমার পোলার জীবনে আহে নাই, এই লইগা আল্লাহর দরবার কুটি কুটি শুকরিয়া… ”
উত্তরে আকলিমা শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন। কোনো জবাব দিতে পারেননি। পাপন আর উল্লাসীকে মুখোমুখি দুই পাশে দাঁড় করানো হয়েছে। মাথায় লম্বা ঘোমটা টেনে রেখেছে উল্লাসী। থেমে থেমে কাঁদছে তবে নিঃশব্দে। হাতের মুঠ মুষ্টিবদ্ধ করে আছে। এত লজ্জা, এত হেনস্তা! ইচ্ছে করছে মাটির নিচে মিশে যেতে… আফসোস ধরণী তার প্রতি সহায় হলো না।
অভ্র উঠোনে বেরিয়ে আসলো। একবার দোতলায় তাকাতেই পড়ন্তর সাথে চোখাচোখি হলো। পড়ন্ত কাঁদছে, তার চোখ দুটো ফুলে ফেঁপে উঠেছে। নিজের বিপদের মধ্যে আবার এ কোন বিপদ এসে হাজির হলো! মিথুন উদ্দিন ভীষণ রেগে আছেন। পাপনকে হাতের কাছে পেলে মেরেই ফেলবেন বোধহয়। নাসরিন মূর্ছা যেতে যেতে বেঁচেছেন। তাকে ঘরের মধ্যে শুইয়ে রাখা হয়েছে। পাপনের বয়স মাত্র আঠারো। এই বয়সে তার ছেলের বিয়ে হয়ে যাবে তাও আকলিমার মেয়ে সঙ্গে! কথাটি চিন্তা করলেই বুক দুরুদুরু বেড়ে যাচ্ছে। যদিও মিথুন উদ্দিন শান্ত থাকতে বলেছেন। যেভাবেই হোক, পাপনকে এই বিপদের মধ্য দিয়ে বের করে আনবেন, কথা দিয়ে গিয়েছেন। তবুও শান্ত হতে পারছেন না নাসরিন। গ্রাম অঞ্চলে এসব ভীষণ সেনসিটিভ ব্যাপার। উল্লাসীকে বিয়ে করা ছাড়া আর কোনো উপায় তো হারিকেন জ্বালিয়েও খুঁজে পাচ্ছেন না তিনি…
মেম্বার পান চিবুচ্ছিলেন, পানের পিক মাটিতে সশব্দে ফেলে দিয়ে উল্লাসীর দিকে তাকালেন। ঘোমটার জন্য মুখ দেখা যাচ্ছে না। তিনি পৈশাচিক হাসি হাসলেন। গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন,
-“ঘোমটা সরাও মাইয়া। আকামের সময় লজ্জা লাগে না, আর এহনে লজ্জা লাগতিছে? ঘোমটা সরাও।”
শেষ বাক্যটি তিনি ধমকের সুরে উচ্চারণ করলে উল্লাসী কেঁপে উঠে। পাপন তাকায়, তার ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে। কেন যে আবেগে গা ভাসিয়ে বাস্তবতা ভুলে গিয়েছিল সেই মুহূর্তে কে জানে! তাদের দু’জনকে দেখেছে তো দেখেছে, একেবারে ওরকম একটি অবস্থায়! আগুন গরম চোখে ঠোঁটে হাসি নিয়ে থাকা সজলের দিকে একবার তাকায় পাপন। সজলই প্রথম তাদের দু’জনকে একত্রে দেখে। তারপর চুপিচুপি গিয়ে সবাইকে ডেকে আনে। সে যদি এটি না করত, তবে এরকম পরিস্থিতি মোটেও তৈরি হতো না। সে এটি কেন করেছে, তাও খুব ভালো করেই জানে পাপন। এতে করে উল্লাসীর জীবন থেকে পাপনকে সরিয়ে দিতে পারবে। উল্লাসী ফোনে বহুবার জানিয়েছিল সজলের কথা। সজল প্রায়শই তাকে ইঙ্গিতে বোঝাতো পছন্দের কথা। উল্লাসী পাত্তা দিতো না। আজ পরিবেশ তার অনুকূলে থাকায় সেই প্রতিশোধ উশুল করে নিলো সজল! তবে সে তো জানে না, এতে করে শাপে বর হয়েছে পাপনের। এখন সবাই উল্লাসীকে বিয়ে করার জন্য চাপ দিবে। আর পাপন তো এক পায়ে খাঁড়া.. ব্যস, এরপর উল্লাসী তার, আজীবনের জন্য… মাঝ দিয়ে হা মুখ করে কপাল চাপড়াবে সজল। ভেতরে ভেতরে দুর্বোধ্য হাসল পাপন। একদিক থেকে এই ঘটনার জন্য সে খুশিই… একটু ঝামেলা হলেও উল্লাসীকে সে আজকের পর থেকে একদম নিজের করে পেতে পারবে…
ধমক খেয়ে ঘোমটা অল্প একটু উপরে তোলে উল্লাসী। এতে তার নাক আর ঠোঁট টা দেখা যাচ্ছে, তবে চোখ নয়… পাপন দেখল, ঠোঁট জোড়া ভিজে জবজব করছে। নাকের পাঠা লাল… খুব কাঁদছে মেয়েটা? অবশ্য কাঁদার মতোই পরিবেশ! পাপন মনে মনে আওড়ালো,
-“তোমার কান্না আমি খুব জলদি মুছে দেবো উল্লাসী। আর মাত্র কিছুক্ষণ…”
-“এইবার বলেন চেয়ারম্যান সাব, এদের কী বিচার করা যায়?” মেম্বার চেয়ারম্যান কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন।
আগত গ্রামবাসীদের মাঝ দিয়ে কেউ একজন বলে উঠল,
-“কী আর করবেন, ধইরা বিয়া দিয়া দেন দুইটারে। শরীরের জ্বালা কমুক।”
উল্লাসীর শরীর রি রি করে শিউরে উঠল। প্রতিটি লোমকূপ কাটাকাটা… কান্নার বেগ বাড়ল। ভরা সমাজের মধ্যে এভাবে কখনো অপদস্ত হতে হবে, তা কল্পনাও করেনি উল্লাসী।
তমিজ উদ্দিন সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন,
-“ওদের কী একসাথে এক কামড়া থেকে উদ্ধার করা হয়েছে? দু’জনে জঙ্গলের মধ্যে কথা বলতেছিল। এই জন্য একেবারে বিয়ে অবধি যাওয়াটা কী ঠিক?”
-“একজন আরেকজনরে বুকের লগে মিশাইয়া কী কথা কইতাছিল, একটু জিগান দি।” বলে উঠল সজলের বাপ। মুখ বাঁকালেন তিনি।
-“নিজের পোলারে বাঁচানির চিন্তা করতাছেন? এই মাইয়াডার গায়ে যে কলঙ্ক লাগল,সেইটা একবারও দেখতাছেন না? এখন এই মাইয়াডারে কেডায় বিয়া করব হ? বাপ মরা মাইয়া… একলা মায়ে আজীবন পালতে পারব নাকি?”
-“উল্লাসীর বিয়ের দায়িত্ব এবং যাবতীয় যত খরচ আছে সব আমার। আমি ঢাকা থেকে ওর জন্য ভালো পাত্র নিয়ে আসবো। তবুও আমার বাড়ির ছেলের সঙ্গে ওর বিয়ে হবে না।” নির্লিপ্ত অথচ দৃঢ় কণ্ঠে তমিজ উদ্দিন কথাটি বলতেই পাপন চমকে উঠল। মোড় তো অন্যদিকে ঘুরে যাচ্ছে। সে অসহায় চোখ করে উল্লাসীর দিকে তাকাল। তবে কী উল্লাসী তার হয়েও হলো না?
মুহূর্তেই গ্রামবাসী হৈহল্লা লাগিয়ে দিল। তাদের এক কথা, পাপনের সঙ্গেই বিয়ে দিতে হবে। আকাম করবে একজনের সাথে আর ধরেবেধে অন্যজনের সাথে বিয়ে দেওয়া! এসব চলবে না। পরিস্থিতি বিগড়ে যাচ্ছে দেখে তমিজ উদ্দিন চেয়ারম্যানের কানে কানে কী যেন বললেন। চেয়ারম্যান হাত ইশারায় সবাইকে শান্ত হতে বলে উঠে দাঁড়ালেন।
-“আমি এগোর সাথে আলাপ কইরা আসি। আপনেরা বসেন সবাই। পোলার বাপ-মা আছে। মাইয়ার মাও আছে। তাদের ছাড়া তো কোনো সিদ্ধান্ত আমি নিতে পারি না। পোলার মা অসুস্থ হইয়া পড়ছে। আমি তার কাছে গিয়া তার কথাগুলা আগে শুইনা আসি। আর এই আকলিমা, তুমিও চলো আমার লগে। তোমার লগেও কথা আছে।”
চেয়ারম্যান বাসার ভেতর পা রাখলেন। পেছন পেছন আকলিমা, তমিজ উদ্দিন, মিথুন উদ্দিন ও গেল। খোকন উদ্দিন পাপনের পাশেই দাঁড়িয়ে রইলেন। উল্লাসীর পা জোড়া কাঁপছে। তার কেন যেন মনে হচ্ছে, তার সঙ্গে ভয়ংকর কিছু ঘটবে।
প্রায় মিনিট বিশের মাথায় সবাই বেরিয়ে আসলেন। আকলিমার চোখমুখ আগের চাইতে অনেকটা শান্ত এখন। আর কারও কথা তার গায়ে লাগছে না যেন। তমিজ উদ্দিন খোকন উদ্দিনের দিকে তাকিয়ে চোখ ইশারা করলেন, যার অর্থ কাজ হয়ে গেছে। চেয়ারম্যান আসনে বসে ক্ষণকাল চুপ করে থেকে জনতার সামনে বলতে লাগলেন,
-“পোলার অন্য জায়গায় বিয়া ঠিক করা আছে। খালি মাইয়ার সম্মান দেখলেই হইবো না। পোলার পরিবার আমাগো এলাকার গণ্যমান্য পরিবার গুলোর মধে একটা। তাগো দিকটাও দেখা লাগবো। তাই উভয় পক্ষের সাথে আলাপ আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হইছে যে, পোলারা আগামীকাল সকালেই এই গ্রাম ছাইড়া চইলা যাইবো। আর আইবো না। তাগো বাড়িটাও বিক্রি কইরা দিবো। আর মাইয়ার মায়রে নগদ পঞ্চাশ হাজার টাকা দিবো। এছাড়াও মাইয়ার বিয়ার সময় ভালো পাত্রের সন্ধান দিবো, বিয়ার যাবতীয় খরচপাতিও দিবো। মাইয়ার মা এতেই খুশি। যেহেতু পোলা মাইয়ারে ঘরের মধ্যে আরও বিশ্রী অবস্থায় পাওয়া যায় নাই, তাই একদম বিয়ার মতো বড় সিদ্ধান্ত নিতে পারতাছি না। প্রেম পিরিতি আজকাল কেডা না করে? এহন এই লইগা সবাইরে ধইরা ধইরা বিয়া দিলে হইবো?”
উল্লাসীর মাথা থেকে ঘোমটা নেমে গেল। রক্তবর্ণের ন্যায় টলটলে চোখজোড়া মেলে পাপনের দিকে তাকিয়ে দেখল, পাপন মাথানিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। খুব না বলেছিল, কিচ্ছু হবে না! তোমাকে বিয়ে করে নিব! কই সেসব দাপট? এক ঝড়েই সব ফুস? ভেতরটা তেতো হয়ে উঠল উল্লাসীর। সেই সাথে মনবাড়িতে ভালোবাসার জায়গায় ‘ঘৃণা’ শব্দটা উচ্চারিত হলো বারংবার।
‘ঘৃণা করি তোমারে… ঘৃণা করি আমি…’ ঠোঁট নাড়িয়ে আওড়ালো উল্লাসী। মাথাটা ঘুরে উঠল তার। সে পড়ে যাওয়ার আগেই আকলিমা তারে ধরে ফেলল। পাপন একদম তাকাল না। খোকন উদ্দিন তার কানে কানে যা মন্ত্র ঢালার ঢেলে দিয়েছেন। অকালে যদি বাপের হাতে মরতে না হয়, তবে চুপ থাকাই শ্রেয়। ভালোবাসা ভালো থাক!
★
চেয়ারম্যান কে হাত করার জন্য বেশ কিছু অর্থ মিথুন উদ্দিনের গচ্ছা গেল। তারপর আবার আকলিমাকে দিতে হলো! সব কার্যক্রম শেষ করে শেষ বিকেলে ঘরের ভেতর পা রাখলেন তিনি। নাসরিন ছেলেকে ফিরে পেয়ে সুস্থ হয়ে গেছেন। তিনি চাইছিলেন,আজকেই রওনা হয়ে যেতে। দাদীমা মানা করলেন। একটা গোছগাছের ব্যাপার আছে তো।
মিথুন উদ্দিন ঘরে ঢুকতেই পাপনকে সামনে পেয়ে গেলেন। নিজের ক্রোধ আর ধরে রাখতে না পেরে ঠাস ঠাস করে পাপনের গালে চড় লাগিয়ে দিলেন। পাপন ছিটকে পড়ল। কোমড় থেকে বেল্ট খুলে নিয়ে ইচ্ছেমতো পেটাতে শুরু করলেন পাপনকে। পাপন সব ব্যথা হজম করে নিল। মুখ দিয়ে একটা টু শব্দও করল না। পড়ন্ত শব্দ পেয়ে ঘরে এসে এই অবস্থা দেখে দ্রুত থামাতে এসেও পারল না। তাই বেরিয়ে গেল কাউকে না কাউকে ডেকে আনার জন্য। লম্বা বারান্দায় পড়ন্ত যখন পাগলের ন্যায় ছুটে যাচ্ছিল, তখনি পেছন থেকে অভ্রর গলার স্বর শুনতে পেল।
-“পড়ন্ত! পড়ন্ত, শোন প্লিজ.. পালিয়ে যাইস না। একটু দাঁড়া!”
পড়ন্ত দাঁড়াল। অভ্রকে ঘুরে দেখল। অভ্র কিছু বলার আগেই তার হাত ধরে কাঁদোকাঁদো স্বরে বলল,
-“বাবা পাপনকে খুব পিটাচ্ছে। তুমি একটু আটকাও, প্লিজ।”
-“কাকা মারতেছে কেন!” বলতে বলতে অভ্রও ছুটলো। পাপনের পিঠ ততক্ষণে রক্তাক্ত হয়ে উঠেছে। বেহাল দশা… অভ্র গিয়ে মিথুন উদ্দিনকে জাপ্টে ধরে সরিয়ে আনলো। পড়ন্ত ততক্ষণে মা’কে, নিতুকে, বড় চাচাকে ডেকে এনেছে। তাদের পেছন পেছন বাকি সবাইও চলে এসেছে। নাসরিন ছেলেকে দেখামাত্র আঁতকে উঠে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন। মিথুন উদ্দিনের দিকে ঘৃণাভরা চোখে তাকিয়ে বললেন,
-“তুমি কী মানুষ!কেউ তার নিজের সন্তানকে এভাবে মারতে পারে! ছি..”
-“ও আমার সন্তান না। আমার আজকে থেকে কোনো ছেলে নাই। যে ছেলে আমার সম্মানের কথা একটাবারও চিন্তা করল না তাকে আমার দরকার নাই। আমি ওকে ত্যাজ্য করলাম।”
-“মিথুন! চুপ কর।” হুংকার ছাড়লেন তমিজ উদ্দিন।
-“মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোর? এসব কী বলতেছিস? বাচ্চা মানুষ একটা ভুল না হয় করেই ফেলছে। তাই বলে এই কথা তোর মুখ দিয়ে কেমনে বের হয়?”
মিথুন উদ্দিন তমিজ উদ্দিনের হাত জড়িয়ে কেঁদে ফেললেন।
-“এই গ্রামে আমাদের আব্বার সম্মান কতটা ছিল, তা কী ভুলে গেছেন ভাই? আব্বাকে সবাই উঠতে বসতে সালাম দিত। কারও কোনো পারিবারিক ঝামেলা হলেও আব্বার কাছে ছুটে আসতো। আব্বা চলে যাওয়ার পর, গ্রামের সবাই আমাদের তিন ভাই কেও সেই একই সম্মানের চোখে দেখেছে। অথচ আজকে আমার সন্তান, সবার চোখে আমাকে নামিয়ে দিল! আমার সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিল! আপনি যদি না থাকতেন, তাহলে উল্লাসীকে বিয়েই করতে হতো হয়তো। ও কী করে সংসার জীবনের কষ্ট বুঝবে? উল্লাসী কোনো মেয়ে হলো সংসার করার মতো? ও তো আছে ওর আবেগ নিয়ে। ওর চোখ যেদিন খুলবে সেদিন বুঝবে, আবেগ ওর কতকিছু ধ্বংস করে দিছে!!”
মিথুন উদ্দিন হাতের উল্টোপিঠে চোখ মুছে বেরিয়ে গেলেন। উপস্থিত সবার মুখ গম্ভীর। তমিজ উদ্দিন পাপনকে কিছু বলতে গিয়েও বলল না। ওর প্রাপ্য শাস্তি ও পেয়ে গেছে। তিনি বাতাসে দীর্ঘশ্বাস মিশিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। ধীরে ধীরে সবাই চলে গেলেও অভ্র গেল না। সে তাকিয়ে আছে পড়ন্তর দিকে। চোখ ইশারায় বোঝাচ্ছে, পড়ন্তকে কিছু বলতে চায় সে। পড়ন্ত না চাইতেও ইশারায় বাইরে যেয়ে দাঁড়াতে বলল। অভ্র বেরিয়ে আসার মিনিট দুইয়ের মাথায় পড়ন্তও বেরোলো।
-“কী বলতে চাও?” প্রশ্ন করল পড়ন্ত।
উত্তরে ভেঙে পড়া এক অসহায় মানুষের দীর্ঘশ্বাস বাতাসে মিলিত হলো।
-“এগুলো কী হচ্ছে পড়ন্ত! এভাবে যদি চলতে থাকে, তবে তো তোর কথা বাসায় বলতেই পারব না রে!”
-“এখন আর বলে কী হবে? শায়লা আপু..”
-“প্লিজ, ওর কথা শুনতে চাই না। একটা এক্সিডেন্টে ঘটা বিয়ের কোনো মর্যাদা নেই, অন্তত আমার কাছে। আমি তোকে ভালোবাসি, তোকে চাই আর মৃত্যুর আগ অবধি তোকেই চাইবো। প্রতি রাতে শায়লার আমাকে পাওয়ার জন্য যে পরিমাণ ছটফট করে, তা যদি তুই দেখতি! অথচ আমি ওর কাছেও ঘেঁষি না। কার জন্য নিজেকে ধরে রাখি, সামলে রাখি, বুঝিস না তুই? আমি যদি শায়লাকে তোর আদরের ভাগ দিয়ে দেই, তবে তুই তা সহ্য করতে পারবি পড়ন্ত? বল আমাকে… একদম মিথ্যে বলবি না, সত্যি করে বল।”
চলবে…