অন্তর্দহন_৮

0
1259

অন্তর্দহন_৮
লেখায়- শেখ অলিন্দ্রিয়া রুহি

চন্দ্র তারকাবিহীন ম্লান আকাশ! বাতাসের তীব্রতা উল্লাসীকে ক্ষণে ক্ষণে কাঁপিয়ে তুলছে। পাপন বলল,
-“জানালাটা লাগিয়ে দাও।”
উল্লাসী বাঁধ সাধলো,
-“থাক না, বাতাস ভালো লাগছে।”
বলে পাপনের কাঁধে মাথা রেখে কিছুটা ঘনিষ্ঠ হয়ে বসল সে। পাপন মৃদু হেসে একহাতে নিজের বাহুডোরে উল্লাসীকে পেঁচিয়ে নিয়ে সিটে হেলান দিয়ে মাথাটা রাখলো। বাস ছুটে চলেছে ঢাকার উদ্দেশ্যে। পৌঁছোতে চার ঘন্টার ন্যায় লাগতে পারে। অর্থাৎ একদম ভোর বেলা তারা ঢাকায় গিয়ে পৌঁছুবে।
-“আচ্ছা, তোমার কী ভয় লাগছে পাপন?” পাপনের মুখপানে চেয়ে প্রশ্ন করে উল্লাসী।
-“প্রথমে একটু লেগেছিল কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, আমি চাইলেই পারব।”
-“তুমি তো কখনো কোনো কাজ করোনি পাপন। বাবার হোটেলে খেয়েছো, মায়ের কোলে ঘুমিয়েছো। এখন তো অনেক কষ্ট করে জীবন যাপন করতে হবে। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, তোমাকে জাহান্নামে ঠেলে দিলাম আমি! এর চেয়ে ওই বুড়োটাকে বিয়ে করলেই ভালো হতো। তুমিও বেঁচে যেতে।” বলতেই উল্লাসীর ঠোঁটের উপর আঙুল রেখে থামিয়ে দিল পাপন।
-“শশশ… এসব অলক্ষুণে কথাবার্তা বাদ দাও। আগামীতে কী হবে তাই ভাবো। আর যত যাই হোক, আমরা টিকে থাকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করব। কথায় আছে না, ইচ্ছে থাকলে উপায় হয়?”
উল্লাসী আরও শক্ত করে পাপনকে চেপে ধরল।
-“তুমি পারলে আমিও পারব। আর আমরা দু’জনেই পরিশ্রম করব না হয়। তাহলে অনেকটা আগাবে।”
-“হুম। আর বাচ্চাকাচ্চা এখন না। আরো ছয়-সাত বছর পরে, ওকে?”
উল্লাসী লজ্জা পেয়ে গেল। কীসের ভেতর কী! এখনো বিয়েটাই তো হলো না! আর এই ছেলে আছে বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে! উল্লাসী হেসে ফেলল। আসলেই পাপন বলদ, গাছ বলদ একেবারে!
-“কী ব্যাপার, হাসছো কেন?” সরু চোখে তাকাল পাপন। উল্লাসী হাসি থামালো না। মুখে বলল,
-“না, কিছু না।”
বুঝতে চেষ্টা করল পাপন। সে এমন কী বলেছে যার জন্যে হেসে কুটিকুটি হতে হবে উল্লাসীকে! পরমুহূর্তেই মাথায় এলো বাচ্চার ব্যাপারটা নিয়ে নয় তো? পাপনও মৃদু হাসল। ইশ! জীবনটা কত সুন্দর লাগছে। এই রাত, রাতের আকাশে ভেসে বেড়ানো মেঘপুঞ্জ, এই বাতাস, বাসের ছুটে চলা, বুকের উপর উল্লাসীর রিনঝিন হাসি, সবমিলিয়ে একটা রোমাঞ্চ অনুভব করছে পাপন। কিছুক্ষণ আগেও কত বিরক্ত লাগছিল নিজের উপর! অথচ এখন মনে হচ্ছে, দুপুরে বিয়েটা হয়ে গেলে এই মজা গুলো মিস করত সে! পালিয়ে বাস স্ট্যান্ড অবধি আসা, তারপর বাকিটা পথও এক প্রকার ভয়ে ভয়ে পার করা, এসব এডভেঞ্চারের জন্ম দিচ্ছে তার মনে।
-“কী হলো? হঠাৎ থম খেয়ে গেলে যে?”
হাসি থামিয়ে চাপা কণ্ঠে প্রশ্ন করল উল্লাসী। পাপন ভাবনা থামিয়ে সঙ্গে সঙ্গে বলল,
-“না, তেমন কিছু না। আচ্ছা উল্লাসী, তুমি আলু ভর্তা আর ডাল দিয়ে কতদিন ভাত খেতে পারবে?”
-“হঠাৎ এই প্রশ্ন?”
-“বলা তো যায় না! যদি ভর্তা ভাতই জোটে কপালে।”
-“জুটলে জুটবে। কত মানুষ না খেয়ে থাকে, সেই হিসেব করেছো? আর খোদা আমাদের রিযিকে যা লিখে রেখেছে, তাই খাবো আমরা। তারচেয়ে কম বা বেশি না। তাই ওসব চিন্তা না করে আল্লাহর কাছে মন থেকে দোয়া করতে থাকো, উনি যেন আমাদের হারিয়ে না দেন। সবাই যে বলে, ভালোবাসার বিয়ে টিকে না, অভাব আসলে ভালোবাসা জানালা দিয়ে পালায়, এসব যেন আমাদের ভাগ্যের সাথে না হয়। আমরা যেন যুগের পর যুগ একত্রে থাকতে পারি।”
-“আমিন।” একটা স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লো পাপন।
-“এই, তুমি সিগারেট খাও?” তীক্ষ্ণ কণ্ঠে প্রশ্নটা করতেই পাপন থতমত খেলো।
-“ইয়ে মানে.. না খাই না, আবার খাই!”
-“মানে?” উল্লাসীর রাগী কণ্ঠ।
-“আরে, আগে শোনো তো। আমি সিগারেট এভোয়েড করি নর্মালি। তবে যখন বন্ধুবান্ধবদের সাথে কোথাও হ্যাং আউটে যেতাম তখন ওদের পাল্লায় পড়ে দু-একটা টান আর কী..” মিনমিন করে উত্তর দিলো পাপন। উল্লাসী ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো।
-“এখন আর বন্ধুবান্ধব নাই, সো ওসব টান-ফান বাদ। আমার সাথে সংসার করতে হলে কোনো আজেবাজে কাজে জড়ানো যাবে না, বুঝছো? ঠিকঠাক মতো কাজ করবা, আর সংসার.. আর আমি..”
-“তা তো বুঝলাম। কিন্তু করব টা কী? আমাকে চাকরিই বা দেবে কে?”
উল্লাসী নিচের ঠোঁট কামড় দিয়ে কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল,
-“পরেরটা পরে দেখা যাবে।”

ঢাকায় পৌঁছুনোর আগ পর্যন্ত এভাবেই গুটুর গুটুর করে গল্প চললো দু’জনের। বাস যখন থামলো তখন সাড়ে পাঁচটা বাজছে ঘড়িতে। চারিদিকে আলো ফোঁটেনি অত ভালো ভাবে। রাস্তায় ভীড় নেই, লোকজনের আনাগোনা কম। পাপন আর উল্লাসী বাস থেকে নামলো। উল্লাসীর হাত-পাও কালো মোজায় ঢাকা, মুখে নেকাব। তাকে কেউ চিনে ফেলার উপায় নেই। পাপন একহাতে উল্লাসীকে শক্ত করে ধরে রেখেছে, অন্য হাতে ব্যাগটা ধরা। দু’জনে মিলে প্যাসেঞ্জার ওয়েটিং রুমে গিয়ে ঢুকলো। আপাতত বাকি সময়টুকু এখানেই কাটানোর প্ল্যান করেছে তারা। প্যাসেঞ্জার ওয়েটিং রুমে শুধুমাত্র একজন বসে রয়েছে। সেও হেলান দিয়ে ঘুমোচ্ছে। পাপন বেছে বেছে একটা ফ্যানের নিচে দুটো চেয়ারে গিয়ে বসল। চেয়ারে বসা মাত্রই উল্লাসীর চোখজোড়া বন্ধ হয়ে আসতে চাইলো। ঘুমে চোখের পাতা মেলা মুশকিল! পাপন বলল,
-“তুমি ঘুমাও। কোনো ভয় নেই। আমি জাগতে পারবো।”
-“তুমি জাগবে আর আমি ঘুমাবো! এটা কেমন কথা?”
-“আমি সারারাত গেমস খেলে সকালে কলেজ যেতাম। একেবারে দুপুরে বাসায় এসে ঘুম দিতাম। সো আমার অভ্যেস আছে। তুমি ঘুমাও। চট্টগ্রামের বাসে উঠবো যখন, তখন ঘুমানো যাবে।”
উল্লাসী আর কথা বাড়ালো না। পাপন ব্যাগটা কোলের উপর রাখল। উল্লাসী ব্যাগের উপর মাথা দিয়ে পা তুলে দিল সিটের উপর। তারপর ঘুমিয়ে গেল। আর পাপন উল্লাসীকে একহাতে জড়িয়ে নিয়ে ফোন বের করে গেমস খেলতে লাগল। ফোনটা ফ্লাইট মুড করা অবশ্য!

সকাল সকাল চিৎকার, চেঁচামেচির শব্দে অভ্র জেগে উঠে বসল। আশেপাশে তাকিয়ে শায়লাকে খুঁজতে লাগল। এই ক’দিনে ঘুম থেকে উঠেই শায়লার বিরক্তিকর মুখটা দেখা অভ্যেসে পরিণত হয়ে গেছে যেন। তবে আজ শায়লাকে দেখতে না পেয়ে খানিকটা অবাকই হলো অভ্র। গতকাল রাতেও শায়লা তার সঙ্গে কোনো কথা বলেনি। এসে চুপচাপ শুয়ে পড়েছিল। আজ অবশ্য তাদের ঢাকায় রওনা হওয়ার কথা। সেই জন্যেই কী বাহিরে চেঁচামেচি হচ্ছে? অভ্র হামি তুলে বাথরুমে ঢুকলো। একটা ছোট্ট শাওয়ার নিয়ে গলায় গামছা ঝুলিয়ে বের হতেই তার চোখ দুটো চড়কগাছ। পড়ন্ত বিছানার উপর বসে রয়েছে! এটা কী করে সম্ভব!

অভ্রকে বেরোতে দেখেই পড়ন্ত উঠে দাঁড়াল। জড়সড় ভাবে বলল,
-“এখানে একটা কারণে এসেছি। অন্যকিছু ভাববে না আবার।”
অভ্র মনে মনে হেসে বলল, ‘আমার কাছে কাজ ছাড়া তো আসিস না তুই! এই অভ্র তো তোর গোলাম! তুই বলবি, আর সে সব পটপট করে করবে। শুধু ভালোবাসা চাইতে গেলেই ছ্যাৎ করে উঠে দূরে সরে যাবি।’
মুখে বলল,
-“আবার কী?”
-“একটা ঝামেলা হয়ে গেছে।”
-“কী ঝামেলা?”
-“পা..পাপন..” পড়ন্তর কথা শেষ হতে না হতেই অভ্র বলল,
-“আজকে কী ওই মেয়ের সাথে ঘরের ভেতর থেকে উদ্ধার করা হইছে ওকে?”
-“ধুত না!” বলে বিরক্তি প্রকাশ করে পড়ন্ত।
-“অন্য কাহিনী। উল্লাসীকে সকাল থেকে পাওয়া যাচ্ছে না। পাপনকেও পাওয়া যাচ্ছে না। আর…”
-“আর?”
-“উল্লাসীর মা’কে যেই পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়েছিল না বাবা? তাও নাকি নেই! আকলিমা কাকীর ধারণা পাপন উল্লাসীকে নিয়ে ভেগে গেছে। আর যাওয়ার সময় ওই টাকাও নিয়ে চলে গেছে। এখন বাসায় এসে অনেক তামাশা করতেছে।”
অভ্র মুখ দিয়ে ‘চ’ কারান্ত একটা শব্দ উচ্চারণ করে বিছানায় গামছাটা ছুঁড়ে মারলো।
-“এই পাপন টাকে যা মন চায় না আমার! বয়স কত? অথচ কর্মকাণ্ড দেখ! কালকেই কতবড় গ্যাঞ্জাম হলো, আর আজকেই…”
-“পাপনকে বকছো কেন? ও তো তাও ওর ভালোবাসা হারিয়ে যেতে দেয়নি। আর তুমি তো…” বলেই চুপ করে গেল পড়ন্ত। অভ্র গোল চোখে তাকিয়ে রইল।
-“বাদ দাও, যদি কিছু করতে পারো করো, আর নইলে থাক..”
পড়ন্ত চলে যেতে চাইলো, অভ্র বলে উঠল,
-“কী করতে বলিস আমায়? পাপনকে খুঁজে বের করব?”
-“উমম.. না। ওকে খোঁজার কোনো দরকার নাই। বরং বাবা, চাচারা ওকে খোঁজার জন্য তোমায় বললে তুমি এদিক ওদিক খুঁজে এসে বলে দিও, পাইনি। ওর আশা ছেড়ে দিতে। ব্যস।”
-“মানে?” অভ্র অবাক। পড়ন্ত ক্ষণকাল চুপ থেকে বলল,
-“আমি চাই পাপন উল্লাসীকে নিয়ে খুশি থাক। সুখে থাকুক। ভালোবাসা হারানোর কষ্ট অনেক। সেটা আমি তো বুঝছি, তাই আর কারো ভালোবাসা হারিয়ে যাক, এটা চাই না।” বলেই চলে গেল পড়ন্ত। অভ্র পড়ন্তর কথাগুলো বোঝার চেষ্টা করল। যখন বুঝতে পারল, তখন ভাবলো, সত্যিই তো! পাপন তার চেয়ে কত ছোট বয়সে! তবুও কতবড় একটা স্টেপ নিয়ে নিলো! আর সে…
অভ্রর নিজেকেই নিজের কাছে লজ্জিত লাগলো।

আকলিমা বারে বারে ফিট খেয়ে পড়ছেন। থেমে থেমে বিলাপের সুরে উল্লাসীকে উদ্দেশ্য করে গালি দিয়ে উঠছেন। বলছেন,
-“ওরে মা** রে.. খা** মা**… চুতমা***.. গেছোস গেছোস, আমারে শেষ কইরা দিয়া গেলি! এমন ক্যান করলি তুই? আমার উপর একটুও তর দয়ামায়া হইলো না!”
গ্রামবাসী অনেকে এসেই আকলিমার বাড়ির সামনে ভীড় জমিয়েছে। কেউ কেউ তামাশা দেখছে, কেউ কেউ আকলিমাকে শান্ত হতে বলছে। কেউ কেউ আকলিমাকেই দোষারোপ করছে,কেন গতকালকেই বিয়েটা দিয়ে দিলো না এই বলে.. শুধু সজলের বাবা মুখে কুলুপ এঁটে বসে রয়েছেন নিজের ঘরের দাওয়ায়। সজল রাগেক্ষোভে এদিক সেদিক অনেক জায়গায় খোঁজ নিয়েও ওদের কোনো খবর না পেয়ে ব্যর্থ চিত্তে উঠোনে পা রাখতেই সজলের বাবা ডাকলেন,
-“কুনু খবর পাইছোস?”
-“না আব্বা। গেরাম ছাইরা গেছে গা মনে হয়।”
-“তো তোর লইগা এহনো বইয়া থাকবো নাকি? বলদের বাইচ্চা… আরো দূরে দূরে খোঁজ লাগা। ওই ছেরিরে আমার চাই।”
-“আপনের ওরে দিয়া কী কাম আব্বা?” বলেই সরু চোখে তাকাল সজল। সজলের বাবা খুকখুক করে কেশে উঠে চলে গেলেন। কেন তার উল্লাসীকে চাই, এই কথা সজলের সামনে প্রকাশ করলেন না। সজলের মনে সন্দেহের দানা সৃষ্টি হলো। বাবার মতিগতি কেন যেন তার কাছে ভালো ঠেকছে না।

উল্লাসী বাসের সিটে বসে রয়েছে। দুইটা বিরিয়ানির প্যাকেট কিনে পাপনও বাসে উঠল। কিছুক্ষণ আগেই চোরাই মার্কেটে গিয়ে ফোনটা বিক্রি করে দিয়ে এসেছে সে। যেরকম মূল্য চেয়েছিল, তার চেয়েও ভালো মূল্য পেয়েছে। নগদ পনেরো হাজার! ফোনটা একে তো বিদেশী, তার উপর চল্লিশ হাজার দাম! অথচ পাপনের একটুও আফসোস হয়নি। উল্লাসীর জন্য নিজের কিডনি বিক্রি করতেও তার আপত্তি নেই।

কিছুক্ষণ পর বাস ছেড়ে দিলেই পাপন ঘড়ির দিকে তাকাল। কাটায় কাটায় বারোটা। পৌঁছুতে কতক্ষণ লাগবে কে জানে! উল্লাসী আবার ঘুমিয়ে পড়েছে। পাপন বিরিয়ানির প্যাকেট দুটো জানালার সাইডে রেখে উল্লাসীকে নিজের বাহুডোরে টেনে নিয়ে জানালায় পর্দা ফেলে দিলো। বাতাস আসছে, তবুও ঘামছে মেয়েটা। কপালের উপর বিন্দু বিন্দু ঘাম ফোঁটা। আঙুলের ডগা দিয়ে সেগুলো আলগোছে মুছে দিয়ে আলতো করে চুমু এঁকে দিলো পাপন।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here