অন্তর্দহন (সিজন-২) পর্ব- ২

0
2366

অন্তর্দহন (সিজন-২)
পর্ব- ২
লেখিকা- অলিন্দ্রিয়া_রুহি

দরজায় ধরাম ধরাম করাঘাত। পড়ন্তর মেজাজ খিঁচে গেল। এত রাতে কে? মাত্রই চোখটা লেগেছিল, ওমনি ঠক ঠক শব্দ! পড়ন্ত দরজা খুলতেই নাসরিনকে দেখতে পেল। নাসরিনের কপালে সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম ভাঁজ, মেয়ের উপর ক্ষেপে রয়েছেন তিনি।

-“তুই ভাত খাসনি কেন?”

পড়ন্ত জবাব না দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। এমন একটা হাবভাব যেন শুনতেই পায়নি মায়ের কথা। নাসরিন ফের বললেন,
-“কী হলো? কিছু জিজ্ঞেস করছি তো আমি, নাকি?”
-“ক্ষিদে পায়নি, তাই খাইনি। এখন যাও। ঘুমাবো।” কটকট করে কথাটি বলে পাশ ফিরে শুলো পড়ন্ত। ইদানীং কাউকেই তার সহ্য হয় না। একা থাকতে ইচ্ছে করে সবসময়। জাগতিক কোনোকিছুই তার ভালো লাগে না। সবকিছু থেকে মন উঠে গেছে।
নাসরিন সশব্দে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বুক ভেঙে কান্না পাচ্ছে তার। কেন পড়ন্ত বাস্তবতা বুঝতে চায় না! কত মেয়ে স্বামী হারিয়ে দ্বিতীয় বার জীবনে এগিয়ে যায়। পড়ন্ত কেন পারে না! কীসের টান এত? এই টানের সুতো কই? সেটা পেলে নিমিষেই ছিঁড়ে ফেলবেন নাসরিন। মেয়েটাকে এভাবে ধুঁকে ধুঁকে মরতে দেখতে পারছেন না তিনি।

পড়ন্তর শিয়রে বসলেন নাসরিন। তারপর মাথায় আলতোভাবে হাত রাখতেই পড়ন্ত ছ্যাৎ করে উঠল।
-“তোমার আহ্লাদ আমার সহ্য হচ্ছে না। যাও তো এখান থেকে…”
নাসরিন হু হু করে কেঁদে ফেললেন। পড়ন্ত নিভলো একটু। গলার স্বর খানিকটা মোলায়েম করে বলল,
-“আম্মু, আমাকে একা থাকতে দাও প্লিজ। তুমি জানো আমি এখন কোনোকিছুই সহ্য করতে পারি না। কাউকে না.. তবু কেন আসো আমার কাছে? এসে কেন কষ্ট পাও? তোমাদের কষ্ট দিতে আমার ভালো লাগে না। বাট তোমরা শুনলে তো!”
-“তুই আমার মেয়ে। আমার পেটে ধরা ধন! তোকে দশ মাস এই পেটে রেখে যুদ্ধ করে পৃথিবীতে এনেছি। আর আজ আমি আমার মেয়ের কাছে আসতে পারব না? এত পাষাণ তুই কবে থেকে হলিরে পড়ন্ত?” কাঁদতে কাঁদতে বললেন নাসরিন৷ কথাগুলো একপ্রকার বিলাপে পরিণত হলো তার।
পড়ন্ত কী যেন বলতে গিয়েও বলল না। উত্তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে মিইয়ে যাওয়া গলায় বলল,
-“আমি ঘুমাবো আম্মু।”
নাসরিন বুঝলেন তাকে চলে যেতে বলা হচ্ছে। তিনি কান্না থামাতে পারলেন না। কাঁদতে কাঁদতেই উঠে রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। বারান্দার শেষ মাথায় উল্লাসী খোলা হাওয়ার টানে দাঁড়িয়ে ছিল। কিন্তু শ্বাশুড়ি কে এভাবে কাঁদতে দেখে সে অবাক হলো না, বরং দুঃখ পেল। এটা নতুন কিছু নয়। সপ্তাহে তিন-চার বার পড়ন্তর রুম থেকে কান্নাকাটি করে বের হন তিনি। প্রতিবারই উল্লাসীর কষ্ট লাগে। তার ইচ্ছে করে, কিছু একটা করতে যাতে সবকিছু আগের মতো ঠিক হয়ে যেতো!

মা চলে গেলে পড়ন্ত জানালার পাশে গিয়ে বসল। ঘুম আসছে না। শুধু শুধু মা’কে তাড়িয়ে দিতে তার একটুও ভালো লাগে না। কিন্তু সে যে নিরুপায়। প্রতিদিন এই সময় টাতে অভ্র আসে। যদি তার সঙ্গে অন্য কেউ থাকে তাহলে আসবে না। পড়ন্ত যখন একা থাকে তখনই অভ্রকে দেখতে পায়। উত্তরের এই জানালা দিয়ে নিচে তাকালে এক টুকরো খোলা মাঠ। সেই মাঠে একটা অবয়ব দাঁড়িয়ে থাকে। না বোঝা যায় চোখমুখ, না চেহারা..তবুও পড়ন্ত জানে ওটা অভ্র। তাকে দেখতে আসে। পড়ন্ত সে সময়টা গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে নিরবে কেঁদে যায়। তার কান্না দেখে অভ্র’র একটু যদি দয়ামায়া হয়! সে যদি ফিরে আসে তার কাছে! কিন্তু অভ্রর দয়ামায়া হয় না কোনো কালেই। কতক্ষণ পড়ন্তকে এক নজরে দেখে তারপর ধীর পায়ে কোথাও একটা চলে যায়!
পড়ন্তর ইচ্ছে করে পিছু নিতে। কিন্তু কেন যেন নিতে পারে না। কী এক জড়তা তাকে গ্রাস করে নিয়েছে। তার একটাই ধ্যান ধারণা, অভ্রর অভিমান ভাঙাতে হবে। তাহলেই অভ্র ফিরে আসবে তার কাছে। আর এই অভিমান ভাঙানোর জন্য সে সব করতে পারবে। যদি তন্ময় কে খুন করে দূরে সরাতে হয়, তাহলে তাই করবে। তবুও অভ্রকে তার দরকার!

বাতাসে ঘ্রাণ ভেসে এলো। পড়ন্তর ধ্যান ভেঙে যায়। সে অস্থির নয়নে এদিক ওদিক তাকিয়ে খুঁজতে লাগলে একসময় একটা কালো অবয়বের দিকে চোখ চলে গেল। শুরু হলো পড়ন্তর কান্না। তারা চোখ বেয়ে গাল ছুঁয়ে চিবুকে এসে মিশছে। গ্রিলে বার কয়েক মাথা লাগিয়ে নিজেকে নিজেই আঘাত করতে চাইলো পড়ন্ত। শেষ ধাক্কাটা একটু জোরে লেগে যায়, পড়ন্ত ব্যথা অনুভব করে। বাম হাতে কপাল ধরলে আঙুলে রক্ত চলে আসে। মাথা ফেটে গেছে! পড়ন্ত সামনে তাকাল। কোথাও কোনো অবয়ব নেই। অভ্র চলে গেছে। তার কপাল ফাটা দেখেও অভ্রর মায়া হলো না বুঝি! পড়ন্ত ধপ করে মেঝেতে বসে পড়ে।

একটা ছোট কাঁথা সেলাই করছে উল্লাসী। এই নিয়ে মোট আঠারোটি কাঁথা সেলাই করা হয়েছে। পাপন বলেছে, আর লাগবে না। তবুও উল্লাসী নিত্যনতুন কাঁথা নিয়ে বসে। নিজের অনাগত সন্তানের জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে চায় সে।
পাপন অন্য রুম থেকে এশার নামায আদায় করে আসলো। দরজা আঁটকে দিয়ে মাথা থেকে টুপি টা খুলতে খুলতে বলল,
-“আবারও?”
উল্লাসী ঠোঁট বাঁকায়, জবাব প্রদান করল না।
পাপন অল্প একটু হাসে।
-“আর ক’দিন পর মা হতে যাচ্ছো, অথচ বাচ্চামো এখনো গেল না! এতগুলো কাঁথা দিয়ে করবে টা কী? ছেলের সঙ্গে সঙ্গে তুমিও ব্যবহার করবে নাকি?”
-“করলে করব, তাতে তোমার কী? নাকি তোমার জ্বলতেছে? তোমার লাগলে তুমিও নিও।”
-“আমার দরকার নাই। তুমি আর তোমার ছেলের গোডাউনেই ভরো।”
পাপন শুয়ে পড়ল। ঠোঁটে তার ফিচেল হাসি। মাঝে মাঝে নিজেকে ভীষণ সুখী মনে হয় তার। কিন্তু যখনই বাকি সবার কথা ভাবে আর চোখের সামনে নিজের বোনের এই অবস্থা দেখে, তখনই সব কিছু এলোমেলো হয়ে যায়। নিজেকে বড্ড অসহায় এবং ব্যর্থ মনে হয়।
উল্লাসী কাঁথা পাশে রেখে পাপনের মুখের দিকে ফিরে তাকালো। প্রশ্ন করল,
-“তুমি সবসময় ছেলের কথা কেন তুলো? তুমি এতটা শিউর কী করে হও যে আমাদের ছেলে হবে?”
-“জানি না। কিন্তু মন বলে।”
-“আমার মন বলে মেয়ে হবে।”
-“আচ্ছা, যদি দুটোই হয়, তখন?”
পাপনকে আপ্লুত দেখালো। উল্লাসী ভ্রু কুঁচকে বলল,
-“দুইটার জ্বালা যন্ত্রণা তুমিই সহ্য করো। আমি নাই বাবা এসবে.. একটা কীভাবে পালবো, তাই ভেবে পাই না। আবার দুইটা!”
-“আহা, আমি আছি না? তোমাকে একা সব করতে হবে মনে হয়?”
-“এক গ্লাস পানি ঢেলে খেতে পারো না এখনো, আবার বলছো আমাকে সাহায্য করবে?”
-“ওহ..পানির কথা শুনে মনে পড়ল। এই আমার না খুব পানির তেষ্টা পেয়েছে। এক গ্লাস পানি যদি…”
তার কথা শেষ হবার আগেই উল্লাসী ‘আনছি’ বলে গটগট পায়ে চলে গেল। পাপন মৃদু হাসে। উল্লাসীর ছেলেমানুষি গুলো সে বড্ড উপভোগ করে।

উল্লাসী পানি নিয়ে ঘরে আসার পথে শিখার কথোপকথন খানিকটা শুনতে পেল। সে ফোনে কথা বলছিল। ফোন নামিয়ে রাখতেই উল্লাসী প্রশ্ন করল,
-“শায়লা আপা কবে আসবে?”
শিখা খুশিতে গদগদ হয়ে বলল,
-“পরশুদিন ফ্লাইট। এবার মেয়েটা আসলেই বিয়ে দিয়ে দিবো। আর যেতে দিবো না ওই ভিনদেশে..আমার দুইটা মাত্র মেয়ে। একটা তো বিয়ের নাম শুনলেই চেতে উঠে। আর এই একটা কোথায় গিয়ে পড়ে রয়েছে। বিয়েশাদি করার নাম নেই।”
-“এখন আর বিয়ে করা লাগে না চাচী আম্মা। ওখানে লিভ-ইন-রিলেশনশীপ তো অহরহ।” বলে ঠোঁট চেপে হাসি আঁটকালো উল্লাসী। শিখার মুখ থেকে খুশিটুকু উবে গিয়ে কপালে ভাঁজ পড়ল বেশ কয়েকটি। উল্লাসী চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াচ্ছিল, ওমনি শিখা তার বাহু টেনে ধরলেন। থতমত খাওয়া গলায় বলে উঠলেন,
-“এই মেয়ে, কী বলতে চাও তুমি?”
উল্লাসী বোকা কণ্ঠে জবাব দিলো,
-“কী বলতে চাইবো আমি? কিছু না তো।”
-“তোমার কথার মানে আমি বুঝিনি ভেবেছো? শোনো, আমার শায়লা মোটেও ওইরকমের না। ও ওখানে পড়াশোনা করতে গেছে। পড়া শেষ, এখন চলে আসবে।”
-“হুম, আমিও তো এটাই বলি চাচী আম্মা। পড়ালেখা করতে গেছে। মাঝে মাঝে ছেলেদের সাথে রাতের বেলা পার্টি করতে যায় এখানে ওখানে, আর সেসব ছবি তুলে ফেসবুকে আপলোড করে। এগুলা আর এমন কী! আপনি তো ফেসবুক চালান না চাচী আম্মা। এখন থেকে চালাবেন। তাহলে দেখতে পারবেন, শায়লা আপু কী পড়াটাই না পড়ছে! আমার কথায় দুঃখ পাবেন না চাচী আম্মা। আপনার ভালোর জন্যেই বললাম। আমি চাই না আপনি অজ্ঞাত থাকুন আপনার মেয়ের কর্মকান্ড থেকে। পরে একটা দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেললে আপনিই মুখ দেখাতে পারবেন না।”
হড়বড় করে কথাগুলো বলে মিষ্টি করে হাসি ছুঁড়ে দিলো উল্লাসী। ‘আসি’ বলে ফের পা ফেলতে গেলে শিখা কাচুমাচু ভঙ্গিতে বলল,
-“আমাকে ফেসবুক চালানো শিখিয়ে দিও তো।”
উল্লাসী মুচকি হাসল। মাথা কাত করে ‘হ্যাঁ’ বলে চলে এলো ধীর পায়ে। এই বাড়িতে এসেই বুঝেছে, সবাই যেমন তেমন হলেও শিখাটা মোটেও সোজা না। এই মহিলাই সব খারাপের পেছনে মূল কাঠিটা নাড়িয়ে দেন। তাই একে একদম ঢিল দেয় না উল্লাসী। তারটা সে খায় বা পড়ে না যে ভয় পেয়ে চলতে হবে উল্লাসীকে। প্রতিটি কথায় সত্য এবং যুক্তিযুক্ততা দেখিয়ে শিখাকে বুঝিয়ে দিয়েছে উল্লাসী, সেও সহজ মেয়ে নয়…
আসার পথে পড়ন্তর রুমটা ক্রস করার সময় ভেতর থেকে ধুপধাপ শব্দ শুনতে পেলে থেমে গেল উল্লাসী। পড়ন্ত আগে বাবা-মায়ের সঙ্গে এক ফ্ল্যাটে থাকলেও এখন আলাদা রুম নিয়েছে উত্তর দিকে। একা থাকতে পছন্দ করে বিধায় কেউ মানা করেনি। প্রায় তার ঘর থেকে কান্নার আওয়াজ, চেঁচানোর আওয়াজ, আর্তনাদের আওয়াজ পাওয়া যায়। মাঝে মাঝে ভাংচুর ও করে। তবে সেটা প্রথম প্রথম করতো। আর অভ্রকে উদ্দেশ্য করে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলতো,
-“কেন আমাকে ফেলে চলে গেলে তুমি? কী দোষ ছিল যে আমাকে দেওয়া কথা রাখলে না। ভঙ্গ করলে? আমি তোমার দাবী কক্ষনো ছাড়বো না অভ্র। হাশরের ময়দানে তোমাকে জবাব দিতেই হবে।”
এরপর আস্তে আস্তে যখন একটু স্বাভাবিক হয় পড়ন্ত, তারপর থেকে কান্না বা আর্তনাদের আওয়াজ পাওয়া গেলেও ভাংচুর করতো না সে আর। আজ হঠাৎ এতদিন বাদে এরকম শব্দ আসছে কেন! উল্লাসী ঘাবড়ে গেল। হাতে ধরা কাঁচের গ্লাসটা একপাশে নামিয়ে রেখে সে দরজায় টোকা দিতেই দরজা খুলে গেল। দরজা খোলাই ছিল মূলত। উল্লাসী অবাক হয়ে ঘরের অবস্থা দেখল। মোটামুটি সব শেষ। শুধু খাটটাই ভাঙা বাকি। বালিশ ছিঁড়েফুঁড়ে তুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিয়েছে। ড্রেসিং টেবিলের বড় আয়না ভেঙে একাকার। তারচেয়েও বেশি অবাক হলো পড়ন্তর মাথা থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে রক্ত পড়ছে দেখে…
উল্লাসী এক পা ঘরের ভেতর দিতে না দিতেই পড়ন্ত চিৎকার করে উঠল।
-“আসবে না,খবরদার আসবে না একদম.. ও আমাকে ফেলে কেন চলে গেল? আমার মাথা ফেটে গেছে দেখেও ওর মায়া হলো না কেন? আমি ওকে চাই…ওকে এনে দাও উল্লাসী। ওকে এনে দাও..”
উল্লাসীর বুক ধুকধুক করছে। এই ঘরটা একদম কোণায় বলে কেউ শুনতেও পায় না সহজে এখানে কী হচ্ছে। উল্লাসী দুরুদুরু বুক নিয়ে প্রশ্ন করল,
-“কে দেখেছে?”
-“অভ্র…ও এসেছিল। ওই যে, ওই মাঠে..”
উল্লাসী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে নিলো, এসব পড়ন্তর ভ্রম। অভ্র নেই, সে আর কোনোদিনই আসতে পারবে না। কিন্তু তার আগেই একটা অদ্ভুত ঘ্রাণ তার নাকে ভেসে এলো। এই স্মেলটা ভীষণ অচেনা। এই বাড়ির কেউ এই ধরনের পারফিউম ব্যবহার করে বলে তো মনে হয় না। তাহলে এই ঘ্রাণ কোথা থেকে পাচ্ছে উল্লাসী?

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here