অন্তর্দহন (সিজন-২) পর্ব- ৬ (শেষ পর্ব)

0
3006

অন্তর্দহন (সিজন-২)
পর্ব- ৬ (শেষ পর্ব)
লেখিকা-অলিন্দ্রিয়া_রুহি

শিখার চোখজোড়া রক্তজবার ন্যায় লাল বর্ণ ধারণ করেছে। তার বুক ফেটে কান্নারা হৈহৈ করে বেরিয়ে আসতে চাইলেও ঠোঁট কামড়ে ধরে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা চালাচ্ছেন তিনি। খোকন উদ্দিন ধরা গলায় নিতুকে বললেন, ‘তোর মা’কে ভেতরে নিয়ে যা।’
নিতু এক কদম এগিয়ে আসলে শিখা নড়েচড়ে দাঁড়ালেন। কম্পিত ভাঙা গলায় বললেন, ‘আমি কোত্থাও যাবো না। আমি ঠিক আছি।’
‘ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নাও শিখা। ভেঙে পড়ো না একদম। ও যেটা করেছে, সেটা কত বড় পাপ তা যদি বুঝতে পারো, তাহলে নিজের মেয়ের পক্ষ নিবে না আশা করি।’
শিখা নাক টানলেন। জবাব না দিয়ে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালেন। মিথুন উদ্দিন এসে ভাইয়ের কাঁধে একটা হাত রাখলেন। খোকন উদ্দিন ভেতরে ভেতরে খুব ভেঙে পড়েছেন সত্য, কিন্তু যেটা অন্যায় সেটা অন্যায়ই। কে করেছে তা দেখার দরকার নেই। যেই করেছে তাকে তার প্রাপ্য শাস্তি পেতে হবে। এবং এই কারণে পুলিশ ডেকে এনে তমিজ উদ্দিন শায়লাকে, আসিফকে ধরিয়ে দিয়েছেন। উপস্থিত সব প্রমাণ, শায়লার জবানবন্দির উপর ভিত্তি করে কোর্ট কী রায় দিবে সেটা দেখার বিষয়। তমিজ উদ্দিন অনেক রেগে গেছেন শায়লার উপর। ঘরের মেয়ে হয়ে এরকম একটা কাজ করতে পারল কী করে! পড়ন্ত একদিকে তার বউ, অপরদিকে তাদের বংশের মেয়ে। আবার একদিকে তার ছেলে, অপরদিকে শায়লার কারণে তার ছেলের প্রথম সন্তানও মারা গেল। যদি শায়লা এরকমটা না করতো, তাহলে পড়ন্ত নিশ্চিন্ত থাকতো, এবং অতিরিক্ত চিন্তার ফলে বাচ্চা মৃত হওয়ার মতো ঘটনাটি তার জীবনে ঘটতো না। বড়চাচীও খুব রেগেছেন। শায়লা যাওয়ার আগে সবকিছুই স্বীকার করেছে এবং কেঁদে কেঁদে মাফ চেয়েছে। পড়ন্তর সামনে হাতজোড় করলে পড়ন্ত একটি কথারও জবাব দেয়নি। শুধু একটা থাপ্পড় গালে লাগিয়ে প্রশ্ন করেছে, ‘আমার বাচ্চাটার কথা অন্তত ভাবতে আপা!’
শায়লা জবাব দিতে পারেনি। অভ্র পড়ন্তকে নিয়ে তাদের ঘরে চলে গিয়েছে। শায়লাকে নিয়ে যাওয়ার সময় তারা কেউ সামনে থাকেনি। শায়লার মুখটা ইহজনমে আর দেখতে পাওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে দু’জনের ভেতরে জমা নেই। ফুরিয়ে গেছে সবকিছু… সম্পর্কের ভেতর যে প্যাঁচ শায়লা লাগিয়েছিল, সেই প্যাঁচে আজ সে নিজেই ডুবেছে। অভ্রর জেল পাঁচ বছরের হলেও, তার শান্ত এবং ভদ্র আচরণের জন্য এক বছর শাস্তি কমিয়ে কিছুদিন আগে খালাস করা হয়। তার কিছুদিনের ভেতরেই বাড়িতে যোগাযোগ করে অভ্র। সবার আগে যোগাযোগ করে নিতুর নাম্বারে, তারপর এদিকে কী কী হয়েছে তার সবটাই নিতু তাকে জানালে অভ্র হকচকিয়ে যায়। এরপর পড়ন্তর সঙ্গে কথা বলে সব ঠিকঠাক করার পর পড়ন্ত জানায় সেই অবয়বের কথা, যা প্রতি রাত্রে তাকে দেখা দেয়। অভ্র পড়ন্তকে জানায়, সে যত দ্রুত সম্ভব দেশে আসবে। কিন্তু তার আসার আগ অবধি পড়ন্ত আগের মতো অস্বাভাবিক আচরণ করতে থাকুক। এবং ওই অবয়বটি আসলে কার, সেটি জানার চেষ্টা করুক। অভ্রর কথামতো পড়ন্তও তার পাগলামি আচরণ চালিয়ে যায় এতদিনে। তারপর পিঠে ছুরি মারা সেই বন্ধুকে খুঁজে বের করে মাইর লাগায় অভ্র। তার মুখ থেকে শায়লার কূটনৈতিক চালের সম্পর্কে সব যখন শুনল অভ্র, তখন থমকে যায় সে। শায়লা এতটা নিচে নামতে পারবে, যা ছিল ধারণার বাইরে। একজন আপন মানুষ, ঘরের মানুষ যখন আপনার সুখের জীবনে বিষ ঢালার জন্য মূল দায়ী হয়ে থাকে, তখন আপনি কী করবেন বা কী বলবেন বুঝে উঠতে পারেন না। সবকিছু প্রচুর এলোমেলো লাগে। অস্থির হয়ে উঠে চিত্ত। অভ্ররও দশা তেমন… অভ্রর মাথায় তখনই ভাবনা আসে, পড়ন্ত যে ছায়ার কথা বলে সেটির পেছনেও শায়লার হাত আছে কী-না। এবং শেষতক অভ্রর অনুমানই সঠিক প্রমাণিত হলো। গত রাতে যখন পড়ন্ত সেই অবয়বের ডাকে সাড়া দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল, নিচে নেমে সবার আগে পাপন এবং উল্লাসীকে এক ফাঁকে চট করে ডেকে নেয় পড়ন্ত। তারপর সে আগে আগে গেলেও, পাপন ওঁৎ পেতে রইলো। তাদের সঙ্গে ছিল অভ্রও। যেদিন শায়লা দেশে ফিরেছে,অভ্রও সেই একই দিনে দেশে ফিরে আসে। কথাখানা বাড়ির সকলকে জানায় পড়ন্ত, শায়লার মা শিখাকে বাদ দিয়ে। তারাও পড়ন্তর কথামতো অভ্রর আসার খবরটা চেপে গিয়ে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে। সেই রাতে আসিফকে হাতেনাতে পাপন আর অভ্র মিলে ধরার পর ধোলাই খেয়ে শায়লার সকল পাপকর্মের কথা গড়গড় করে উগলে দেয় আসিফ। তাকেও ধরে নিয়ে এসেছে অভ্র। ভোর রাতেই বাসার প্রতিটি সদস্যকে শায়লার কৃতকর্মের কথা জানিয়ে দেয় সে। প্রথমে কেউই বিশ্বাস করতে চাইছিল না। পরে আসিফের স্বীকারোক্তি আর অভ্রর সেই বিদেশী বন্ধুর থেকে শোনা ঘটনাগুলির রেকর্ডের মাধ্যমে বাড়ির সবাইকে বিশ্বাস করাতে সক্ষম হয় অভ্র। তমিজ উদ্দিন সাত সকালেই পুলিশে ফোন করে রেখেছিলেন। অপেক্ষা ছিল শায়লার ঘুম থেকে জেগে উঠার। শেষবারের মতোন শান্তির ঘুম ঘুমিয়ে নিলো সে। ওর নামে স্বয়ং তমিজ উদ্দিন এটেম্প টু মার্ডার কেস করে দিয়েছে। শায়লার ভবিষ্যতে যে কী লিখা রয়েছে, তা স্বয়ং বিধাতাই জানেন!

আজ যেন বাড়িতে সত্যিকারের উৎসব লেগেছে। সবার ভেতর হৈচৈ, রমরমে ভাব। পড়ন্ত যেন নতুন বউ, মিনিটে মিনিটে লজ্জা পাচ্ছে। দীর্ঘ চারটি বছর অপেক্ষার পর আজ যখন অভ্র তার সামনে,।তখন জমানো কোনো কথাই মুখ ফুঁটে বলতে পারছে না পড়ন্ত। সব কিছু এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। এতদিনের চেনা মানুষটাকেও কেমন লজ্জা লজ্জা লাগছে! অদ্ভুত শোনালেও সত্য কথা। পড়ন্ত ঘরেই আসছে না সহজে। এই কাজ ওই কাজের বাহানা দিয়ে অভ্রর থেকে দূরে দূরে থাকছে। দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পর অভ্র যখন বাথরুমে, পড়ন্ত তখন চুপিচুপি তার রুমে এলো। অভ্র নেই দেখে চট করে আলমারি খুলে একটা নীল শাড়ি বের করে নিলো সে। এই শাড়িটা পরে রাতের বেলায় অভ্রের সামনে উপস্থিত হয়ে তাকে চমকে দিবে- এমনটাই পড়ন্তর প্ল্যান। কিন্তু তার আগেই দরজা আঁটকানোর শব্দ শুনতে পেয়ে পড়ন্ত নিজেই চমকে ঘুরে তাকাল। অভ্র পা টিপে টিপে বাথরুম থেকে বেরিয়ে দরজা আঁটকে দিয়েছে। পড়ন্তকে কিছুতেই বেরোতে দিবে না এখন। সকাল থেকে একটিবারও নিজের কাছে পাওয়া যায়নি মেয়েটাকে। ফাজিল মেয়ে! এবার বোঝাবে, কত ধানে কত রাইস!

পড়ন্ত থতমত খেয়ে গেল। আমতাআমতা করে বলল, ‘দরজা আঁটকালে কেন?’
‘আমার মন চাইছে।’ দায়সারাভাবে কথাখানা ছুঁড়ে দিয়ে শার্টের বোতাম গুলো খুলতে শুরু করলো সে। পড়ন্ত ফাঁকা ঢোক গিললো। তার হাত ঘামছে। মানুষটাকে এভাবে নির্জনে, একাকী পাওয়ার জন্য কত রাত ছটফট করেছে গোপনে গোপনে! আর আজ যখন পেলো, তখন এত লজ্জা এলো কোথাথেকে? আর কেনই বা গ্রাস করে নিলো তাকে! সে যে আজ সব লজ্জা একপাশে রেখে বেহায়া হতে চায়। ভালোবাসতে চায় নিজের সবটা দিয়ে। এমনভাবে আঁটকে ফেলতে চায় অভ্রকে, যেন আর কোনোদিন কোথাও অভ্র হারিয়ে যেতে না পারে…
পড়ন্তর ভাবনার সুতো কাটলো একটা হ্যাঁচকা টানে। পরিপূর্ণ ভাবে দৃষ্টি মেলে নিজেকে সে আবিষ্কার করল অভ্রর বাহুডোরে। অভ্র মিটিমিটি হাসছে। পড়ন্তর চোখের তারায় হাসি, কিন্তু ঠোঁট গম্ভীর। অভিমানী কণ্ঠটা নাড়িয়ে সে বলল, ‘হয়েছে, এখন এত প্রেম দেখানো লাগবে না। যেভাবে হারিয়ে গিয়েছিলে সেভাবেই থাকো। কী দরকার আমাকে ভালোবাসে!’
‘আমি কী ইচ্ছে করে হারিয়েছিলাম নাকি? ভাগ্যের লিখন! আর এই হারানোর মাধ্যমেই আমাদের সম্পর্ক আরও মজবুত হলো,এটা মানো?’
পড়ন্ত জবাব দিলো না। অভ্রর শার্টের উপরের বোতাম দু’টি লাগাতে শুরু করল।
‘বোতাম লাগাচ্ছো কেন? গরম লাগছে তো। খোলা থাকুক।’
‘না, একদম খোলা রাখা যাবে না। নইলে আমার দ্বারা কোনো ভুলটুল হয়ে যেতে পারে।’
বলেই ঢোক গিললো পড়ন্ত। অভ্র ভ্রু নাচিয়ে দুষ্টু গলায় বলল, ‘আচ্ছা তাই? হলে হোক না.. আমি কী মানা করেছি? আজ ভুল করার দিন। যত ভুল করার করে নাও। বাঁধা দিবো না।’
পড়ন্ত চোখ তুলে তাকাল, ‘সত্যি বলছো?’
‘বলছি..’
কথাটি শেষ করে চোখের পলক ফেলতে পারল না অভ্র, তার আগেই তার শরীরের উপর প্রায় ঝাপিয়ে পড়ল পড়ন্ত। তার গালে, গলায় উদ্ভ্রান্তের ন্যায় চুমু খেতে শুরু করল। যেন কত জনম পড়ন্ত চুমু খাওয়ার জন্য অপেক্ষা করে ছিল! অভ্রর হাসি পেলেও নিজেকে সামলে নিলো। পড়ন্তকে নিজের বাহুডোরে আরও টেনে নিয়ে দুটো শরীর একত্রে মিশে গেল। সমস্ত দুঃখ, যন্ত্রণা, কষ্ট, ক্লেশ ভুলে ভালোবাসার পবিত্র বন্ধন এখান থেকেই শুরু হলো। অন্তর্দহনের সবটুকু আগুনে অভ্রর নিখাঁদ ভালোবাসা তরল রূপে পতিত হয়ে উত্তাপ নিভিয়ে স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে দিলো। মন বাগানে এখন অন্যরকম বসন্ত! দুটো কোকিল এক ডালে বসে গলা ছেড়ে গান গাইছে….

গোসল সেড়ে ক্লান্ত দেহটা বিছানায় এলিয়ে দিলো পড়ন্ত। মাথাটা একটু একটু ব্যথা করছে তার। অভ্র পাশেই শুয়ে আছে। পড়ন্ত বলল, ‘একটু ঘুমাও। বিকেল প্রায় ফুরিয়ে এলো।’
‘এখন ঘুমালে মাথা ভার হয়ে থাকবে। তারচেয়ে চলো, ছাদে হেঁটে আসি।’
‘একটু অপেক্ষা করো। চা বানিয়ে নিয়ে যাই। আড্ডা দেওয়া যাবে। আর আমার মাথাটাও ধরেছে।’
‘আচ্ছা।’ পড়ন্তর কপালে অভ্র তার অধর স্পর্শ বসিয়ে দিলে পড়ন্ত মিষ্টি করে হেসে উঠে দাঁড়াল। ঠিক তখনি দরজায় টোকা পড়ার শব্দ হলো। ওপাশে নিতুর গলা। পড়ন্তকে ডাকছে। পড়ন্ত দরজা খুলতেই নিতু বলল, ‘আপা, তন্ময় ভাইয়া এসেছে।’
পড়ন্ত থমকে গেল। অভ্র পেছন থেকে উঁকি দিয়ে গলা বাড়িয়ে ধরলো। একবার পড়ন্তর মুখের দিকে তাকাল, আরেকবার নিতুর দিকে তাকাল। এরপর প্রশ্ন করল, ‘এই সেই তন্ময়,যার সঙ্গে আমার বউয়ের বিয়ে দেওয়ার কথা চলছিল?’
‘হুঁ..’ অস্ফুটস্বরে বলে উঠল পড়ন্ত। অভ্র বুঝলো, তন্ময়ের প্রসঙ্গ আসায় পড়ন্ত কিছুটা বিব্রতবোধ করছে। নিজেকে দোষীও ভাবছে হয়তো। তাই নিতুকে চলে যেতে বলে দরজাটা ভিড়িয়ে দিয়ে পড়ন্তর মুখোমুখি এসে দাঁড়াল অভ্র।
‘তাকাও আমার দিকে। কী হয়েছে? তুমি তো কিছু করোনি! তুমি তো তাকে বিয়ে করতে চাওনি। আমাদের পরিবার থেকে তোমাকে বিয়ে দিতে চেয়েছে। আর তারাও ভুল না পড়ু। এখানেও শায়লার হাত.. ও যদি না ছড়াতো আমি মৃত, তাহলে কী এরকম পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো বলো? ওর শাস্তি ও ঠিকই পাবে। এবার এই তন্ময়ের কিছু করা দরকার।’
‘উনি আমাকে মেরেছেন অভ্র। ওই লোকটা প্রচন্ড বাজে লোক। উনি আমাকে চড় দিয়েছিলেন।’
অভ্র হকচকিয়ে গেল। সেই সঙ্গে সে অনুভব করল কেউ তার মাথায় এক বালতি গরম পানি ঢেলে দিয়েছে। ঠান্ডা মেজাজটা চট করে সরে গেল। সৃষ্টি হলো উত্তপ্ত গরম মেজাজ.. অভ্র আর কিছু না বলে চুপচাপ বেরিয়ে গেলে তার পিছুপিছু পড়ন্তও গেল। সে মোটেও চিন্তিত নয় যে তন্ময়কে অভ্র কী বলবে বা কী করবে। উল্টো সে খুশি…তন্ময়ের মতো মানুষদের শাস্তি পাওয়া দরকার। নইলে এরা মেয়েদের শরীরকে সরকারি ভোগের বস্তু হিসেবেই বিবেচনা করে যাবে আজীবন।

তন্ময় সোফার ঘরে বসে রয়েছে। তার সামনে তমিজ উদ্দিন, মিথুন উদ্দিন, নাসরিন। এরা এতক্ষণ অভ্রর আগমনের ঘটনা তন্ময়কে খুলে বলেছে এবং মাফ চেয়েছে এই কারণে যে, তন্ময়ের সঙ্গে পড়ন্তর আর কোনো ধরনের সম্পর্ক হতে পারবে না। তন্ময় প্রত্যুত্তরে কোনো কথা না বলে চুপ করে বসে রয়েছে। তার মন চাচ্ছে অভ্র নামক সেই পুরুষটিকে একবার দেখতে, যার জন্য পড়ন্ত মেয়েটা পাগলের ন্যায় হয়েছিল এতদিন। কেউ যে কাউকে এত পরিমাণে ভালোবাসতে পারে, তা পড়ন্তকে না দেখলে কোনোদিনই বুঝতে পারতো না তন্ময়। তন্ময়ের মনের বাসনা পূর্ণ হলো। অভ্র ঘরের ভেতর ঢুকলো। তমিজ উদ্দিন বলে উঠলেন, ‘এই যে অভ্র, আমার একমাত্র ছেলে। অভ্র এ হচ্ছে তন্ময়।’
অভ্র ছোট্ট করে উত্তর দিলো, ‘জানি।’ তারপর তীক্ষ্ণ চোখে তন্ময়ের দিকে তাকিয়ে রইলো। তন্ময়ের কপালে যে শনির দশা ঘুরছিল, তা ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে গেল। কেননা হাত বাড়িয়ে ‘হাই,হ্যালো’ করার আগেই তন্ময় আন্তরিক ভাবে ক্ষমা চাইলো অভ্রর কাছে। অভ্রসহ বাকি সবাই অবাক হলো। তন্ময় ক্ষমা চাইছে! কিন্তু কেন?
তন্ময় নিজের ভুলটা স্বীকার করে নিলো। সেদিন রাগের বশে সে অতিরিক্ত ডেসপারেট হয়ে উঠেছিল। যার ফলে পড়ন্তকে আঘাত করতেও দ্বিতীয়বার ভাবেনি। কিন্তু বাসায় যাওয়ার পর সে অনুভব করতে পেরেছে, পড়ন্তর সঙ্গে ওরকম আচরণ করা মোটেও উচিত হয়নি তার। অনুতপ্ত হওয়ার জন্যেই এই ক’দিন আসেনি সে। লজ্জা পাচ্ছিল পড়ন্তর সামনে আসতে। আজ সাহস জুগিয়েই এসেছে। ক্ষমা চাইতে এবং এটা বলতে যে, পড়ন্ত না চাইলে কখনোই বিয়েটা হবে না। সে আর জোরাজুরি করবে না। কিন্তু এসে যখন শুনলোই অভ্র ফিরে এসেছে, তখন আর বিয়ের প্রসঙ্গ উঠার মানেই হয় না।
অভ্র ক্ষমা করে দিলো। তন্ময় আন্তরিক ভাবে বিদায় জানিয়ে চলে গেল। মানুষের জীবনে কতকিছুই না ঘটে! কেউ কেউ রাগের বশে এমন কিছু কাজ করে বসে, যার কারণে মানুষ তাকে খারাপ মানুষের কাতারে ফেলে বিচার করে। এইজন্যে বলে, রাগ সবসময় ধ্বংস ব্যতীত অন্যকিছু নিয়ে আসে না। তাই যেকোনো আচরণ করার আগে আমাদের বুঝেশুনে করার উচিত। তবেই না আমরা মানুষ!

নিতু সিদ্ধান্ত নিলো সে আর জাওয়াদকে আগ বাড়িয়ে ফোন করবে না। জাওয়াদের যদি তাকে প্রয়োজন না হয়, তাহলে তারও জাওয়াদকে প্রয়োজন নেই। নিতু বিড়বিড়িয়ে বলল, ‘আমার জন্য অনেক পোলাপান লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে মিস্টার জাওয়াদ। তোমার মতো বুইড়া খাটাশ আমার জীবনে না আসলেই ভালো হয়।’
ঠিক তখনি নিতুর ফোনটা বেজে উঠল। নিতু অবাক চেয়ে দেখলো, জাওয়াদ ফোন দিয়েছে। বাহ! নিষ্ঠুরটা একেবারে সঠিক সময়ে কী করে ফোন দিলো! নিতু ভাবলো সে ফোন ধরবে না। কল বেজে বেজে কেটে যাবে। ওদিকে জাওয়াদও যেন পণ করেছে, আজকে ফোন করেই যাবে করেই যাবে.. শেষ পর্যন্ত, বাধ্য হয়েই ফোনটা কানে তুলে নিলো নিতু। কানে তুলেই দিলো এক রাম ধমক, ‘ফোন করেছেন কেন? আমার সঙ্গে সব কিছু শেষ না? তাহলে আবার কীসের এত ফোন করা? নাকি হাতের ঘঁষা লেগে চলে এসেছে?’
জাওয়াদ ঠোঁট টিপে হাসল।
‘একটা খবর দিতে ফোনটা দেওয়া নিতু। মা আমার জন্য মেয়ে দেখেছে। আজকেই আংটি পরিয়ে আসতে চাইছে।’
‘কীহ!’ নিতু মুহূর্তেই স্তব্ধ হয়ে গেল।
‘হুম। আমি কী রাজী হয়ে যাবো নিতু? আমার তো বয়স হয়ে গেছে। এখন বিয়ে না করলে কবে করব বলো তো!’
একটা কান্না দলা পাঁকিয়ে গলায় এসে আঁটকে গেল যেন। নিতু কোনোমতে ধরা গলায় বলল, ‘বাহ! আপনি রাজী? তাহলে করে ফেলুন। আজকেই কবুল বলে মেয়েটাকে গলায় ঝুলিয়ে নিয়ে আসুন। আমাকে ফোন করেছেন কেন?’
‘তোমার একটা মতামত আছে না নিতু..’
‘আমার আর মতামত! যান, যান, বিয়ে করুন ফেলুন।’
‘আর ইউ সিরিয়াস? সত্যি বলছো তুমি?’
নিতু ছোট্ট করে উত্তর দিলো, ‘হুম।’
‘ওকে নিতু, রাখছি তাহলে। মা ডাকছে।’
নিতু কিছু বলার আগেই ফোনটা কেটে গেল। নিতু ধপ করে মাটিতেই বসে পড়ল। তার দিন দুনিয়া সব উলোটপালোট হয়ে গেছে। জাওয়াদ কী করে এক মুহূর্তে সব ভুলে অপর একটি মেয়েকে বিয়ে করে নিতে পারবে! আজ আবার আংটি পরানো হবে! আংটি! নিতু মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো, জাওয়াদের আন্ডারগ্রাউন্ডের সবকিছু ভেঙে চুরমার করে দেবে। তারপর দেখবে, কে বিয়ে করে এই দামড়া পাঠাটাকে…
নিতু চোখ মুছে আবার ফোন করল। লাগাতার চারটা ফোনের পর অত্যন্ত বিরক্ত গলায় জাওয়াদ বলে উঠল, ‘কী ব্যাপার নিতু্! তৈরি হচ্ছে তো। এত ফোন দিচ্ছো কেন? আমি ব্যস্ত আছি।’
‘তোর ব্যস্ততা তোর পাছায় দেবো কুত্তা কোথাকার!! প্রেমের সময় আমি, আর বিয়ের সময় অন্য মেয়ে? কোন মুখ দিয়ে এই কথা বলিস তুই? যে মুখ দিয়ে বলেছিস, সেই মুখ যদি আমি না ভাঙি..’
‘এসব কী ধরনের কথাবার্তা নিতু! ফোন রাখো। পাগল মেয়ে..’
‘হ্যাঁ, এখন তো আমি পাগল, ছাগল, বোকা– সবকিছু! আর ভালো কে? ওই মেয়ে? কেন রে.. ওই মেয়েরটা বড় বড়? দেখতে ভালো? আমার গুলো ছোট তাই দেখে মজা নেই? তাই আর আমাকে ভালো লাগছে না?’
জাওয়াদ হতভম্ব হয়ে যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, সেখানেই বসে পড়ল। তারপর ফ্যাঁচফ্যাঁচ শব্দে কান্নারত নিতুকে বলল, ‘নিতু, নিতু, কাম ডাউন। আমি মজা করছিলাম জাস্ট। বাবারে বাবা.. তুমি এইধরনের কথা বলতে পারো, আমি জন্মেও ভাবিনি!’
‘আমি আরও অনেক কিছুই বলতে পারি মিস্টার জাওয়াদ খান। ফের যদি এরকম কোনো মজা করা হয় আমার সঙ্গে, তাহলে এর চাইতেও ভয়াবহ কথা শুনতে হবে।’
‘তুমি সত্যি পাগল! আমি বললাম আর ওমনি বিশ্বাস করে নিলে? আমি তোমাকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করতে পারব? তুমি হতে দিবে? যেই গুন্ডী তুমি..’
‘কীহ?’ নিতু কান্না থামালো। কণ্ঠে রাগ তার। জাওয়াদ হো হো করে হেসে ফেলল। নিতু চাপা অভিমানে চুপসে গেল। কিন্তু বুকের মধ্যিখানে প্রশান্তি। এই বুড়ো ভামকেই তার চাই.. এই একে নিয়েই যুগের পর যুগ, অনায়াসে পার করে দিতে পারবে সে…

_____________

বাড়ির প্রতিটি সদস্য চিন্তিত। উল্লাসী চিৎকার চেঁচামেচি করে একাকার করে তুলেছে হাসপাতালের আনাচে কানাচে। তার চিৎকার শুনে মনে হচ্ছে, এই পৃথিবীতে একমাত্র তারই বাচ্চা হচ্ছে। এর আগে আর কারো হয়নি এবং ভবিষ্যতেও হবে না। পাপন লজ্জিত ভঙ্গিতে এক কোণে চুপচাপ বসে রয়েছে। পড়ন্ত গিয়ে পাপনকে বলল, ‘তোর বউকে গিয়ে থামা একটু। কয়েকজন রোগী এসে নালিশ দিয়ে গেল। তাদের সমস্যা হচ্ছে এই হৈচৈ-এ।’
পাপন মিনমিনিয়ে বলার চেষ্টা করল, ‘কী করব আমি! আমাকে তো আরও বেশি সহ্য করতে পারছে না!’ কিন্তু বলতে পারল না। ডাক্তারকে কেবিনে ঢুকতে দেখে পাপনও পেছন পেছন গিয়ে ঢুকলো। তাকে দেখামাত্র উল্লাসী চেঁচিয়ে উঠল।
‘এসেছো তুমি? আমার মরণ দশা দেখতে এসেছো? আমি মরলে তোমার কী! আরেকটা বিয়ে করতে পারবে! সোনায় সোহাগা.. আর এদিকে আমার দম ফাটলো। বলেছিলাম, ওগো, আরও পরে বাচ্চা নেই। আমি নিজেই তো নিজেকে সামলাতে পারি না। বাচ্চা কী আর সামলাবো। না.. আমার কথা সে কেন শুনবে! এখন আসো। নিজে এসে বাচ্চা জন্ম দিয়ে যাও।’
পাপন সুরসুর করে কেবিন ছেড়ে বেরিয়ে এলো। ব্যথার চোটে উল্লাসীর মাথাটাই গেছে পুরোপুরি ভাবে। অভ্র হাসছে। পড়ন্ত তাকে কনুই দিয়ে গুতো মারলো। কপট ধমকের সুরে বলল, ‘হাসছো কেন? বাচ্চা হওয়াতে কত কষ্ট, আইডিয়া আছে কোনো?’
‘এমনভাবে বলছো যেন তুমি বাচ্চা জন্ম দিয়েছো!’ বলেই চুপ হয়ে গেল অভ্র। পড়ন্তর চেহারায় নেমে এলো মেদুর রঙের ছায়া। সে মুখ ঘুরিয়ে চলে যেতে নিলে অভ্র তার একটা হাত টেনে ধরল। পড়ন্ত তাকালে অপরাধী চেহারা করে অভ্র বলল, ‘সরি।’
পড়ন্ত নির্বিকার গলায় বলল, ‘ইটস ওকে।’ তারপর অভ্রর কাঁধে মাথা রাখলো। তার দু’চোখে জল। অভ্র আশ্বাস দিলো, ‘আমাদের আবার বাবু আসবে পড়ু। মন খারাপ করো না প্লিজ।’
‘আমার খারাপ লাগে এই ভেবে যে, আমার বাচ্চাটার কথা কী করে একবারও ভাবল না শায়লা আপা! অথচ সে আমার বোন ছিল! এটা যতবার ভাবি, ততবার ভেতরটা খারাপ লাগায় ছেয়ে যায়।’
‘যার যার কর্মের ফল সে পাচ্ছে পড়ু। শায়লার চার বছরের জেল হয়েছে। মেঝ কাকা বলল, শায়লাকে নাকি এখন চেনা যায় না। শুকিয়ে কী হয়ে গেছে। কথা বলে না। মানসিক বিকারগস্ত লাগে নাকি দেখতে।’
‘সে আমাকে মানসিক রোগী বানিয়ে দিতে চেয়েছিল, আল্লাহ আজ তাকে মানসিক বিকারগস্ত বানিয়ে দিচ্ছেন। এটাকেই বলে, আল্লাহর বিচার আস্তেধীরে..’
অভ্র মৃদুশ্বাস ফেলল। পড়ন্তর একটা হাত শক্ত করে নিজের হাতের মুঠোয় নিলো। হঠাৎ কেবিনের ভেতর থেকে একটা রিনরিনে কণ্ঠস্বরের কান্নার শব্দ ভেসে এলো। পড়ন্ত পুলকিত, একজন নার্স এসে জানালেন, উল্লাসীর ছেলে হয়েছে। পাপনকে দেখা গেল পশ্চিমে ফিরে আল্লাহর দরবারে শুকরিয়ায় মাথানত করে দাঁড়িয়েছে। পড়ন্তর মনটা ভরে গেল প্রশান্তিতে। সে মনে মনে বিড়বিড় করল, ‘হে করুণাময় রব, আমার পরিবারটি যেন এভাবেই সুখের আদলে থাকে সবসময়। আর কোনো অন্তর্দহনে আমি বা আমার পরিবার যেন না জ্বলে। অন্তর্দহনের জ্বালা কেবল যার হয় সেই বোঝে। এই জ্বালা না বলা যায়,না সহ্য করা যায়। শুধু নিজের মনের দহনে পুড়তে পুড়তে একসময় নিজেকে ছাঁই হয়ে যেতে হয়।’

(সমাপ্ত)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here