প্রেমমহল,১

0
1555

প্রেমমহল,১
মুমুর্ষিরা_শাহরীন

‘এই বোকা ছেলে শোনো, আমার সাথে প্রেম করবা?’

নীল বিশাল আকাশের এক প্রান্ত ডুবেছে দূরের ওই সবুজ মাঠের তেপান্তরে। চারিদিকে তখন ঝিকঝিকে রোদ। পেছনে ঘুরে বিহ্বল চোখ দুটোর উপরে এক হাতের ছায়া রেখে ভ্রু কুচকে উল্টো পাশ থেকে ভেসে এলো,

‘বোকা ছেলে? কে বোকা ছেলে?’

প্রেয়সী খিলখিল করে হাসলো। হাসতেই মাড়ি ভেসে উঠলো। চোখ বড় বড় হলো। হাসির ধ্বনি, প্রতিধ্বনি হয়ে ভাসলো মৃদু শরীর দুলানো পবনে। সুন্দর দেখালো তাকে। সে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো। তাকিয়ে থাকার কালেই প্রেয়সী আচ্ছন্ন ভরপুর কন্ঠস্বরে বলল,

‘শুনো বোকা ছেলে, এভাবে তাকাবে না। আমার লজ্জা লাগে।’

সে ঘোমট কন্ঠে বলল, ‘ডোন্ট কল মি বোকা ছেলে। মাই নেম ইজ হৃদয়।’

‘কিহ গিদর?’

বলেই প্রেয়সী আবারো খিলখিল করে হেসে উঠলো। হৃদয় রাগে কপাল কুচকে বলল,

‘বিরক্তিকর! এই মেয়ে, তুমি কে? কথায় কথায় হাসো কেনো?’

চোখ টিপে প্রেয়সী বলল, ‘আমি তোমার হব হব প্রেমিকা। আর তুমি আমার হব হব প্রেমিক।’

হৃদয় তাজ্জব বনে গেলো। ভীষণ অবাক গলায় বলল,

‘তুমি কি কোনোভাবে মেন্টালি সিক? এলাকায় নতুন? তোমার বাবা-মা কোথায়? তারা কীভাবে এরকম একটা পাগল ছাগল মেয়েকে রাস্তায় ছেড়ে দিতে পারে? ইরেসপন্সিবল বাবা-মা।’

‘তুমি আসলেই একটা বোকা সাথে গিদর সুতরাং বোকা গিদর।’

শরীর দুলানো মৃদু বাতাস টুকুও থেমে গেছে। তেজস্বী সূর্যতনয়ে পিচ ঢালা রাস্তা’টা তপ্ত গরম। গরমে রাগে হৃদয়ের কানের চিপ বেয়ে পানি পরছে। দাঁত চেপে তাকে বলতে শোনা গেলো,

‘তুমি তো একটা রাক্ষসী মেয়ে। ভয়ংকর রাক্ষসী নয় মিনমিনে রাক্ষসী। সাংঘাতিক ক্ষতিকর! এই মেয়ে তোমার নাম কি?’

দুপুরের রাস্তা তখন শুনশান। জনমানবশূন্য। প্রেয়সী গোমড়া মুখ করে তাকিয়েও আবার খিলখিল করে হেসে উঠলো। হৃদয় মাত্রাতিরিক্ত বিরক্ত হলো। আশ্চর্য তো! সত্যি পাগল নাকি এই মেয়ে? উচ্চস্বরে হাসতে হাসতেই প্রেয়সী বলল,

‘ছি! ভবিষ্যত প্রেমিকার নামটা পর্যন্ত জানো না, বোকা গিদর? ধিক ধিক শত ধিক!’

‘ইউ আর জাস্ট টু মাচ ষ্টুপিড গার্ল।’

‘এন্ড ইউ আর দ্যা ফুলিশ গিদর বয়।’

‘এই রাক্ষসী পথ ছাড়ো তো। অপরিচিত একটা ছেলের সাথে কেউ এভাবে প্রেমের কথা বলে? লজ্জা নেই?’

‘ওমা! এখানে অপরিচিত কে? তুমি তো আমার হব হব প্রেমিক। পরিচিত না হলে কি আর প্রেমিক বলতাম, বলো?’

হৃদয় ক্রুদ্ধ নয়নে কিছুক্ষণ তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। প্রেয়সীকে এড়িয়ে চলে যেতে নিলেই প্রেয়সী বলল,

‘বোকা গিদর, তুমি তো আমার নাম না শুনেই চলে যাচ্ছো।’

প্রেয়সী হৃদয়ের পেছনে পথ ধরলো। হৃদয় এড়ানো গলায় জবাব দিলো, ‘দরকার নেই নাম শুনার।’

‘নাহ দরকার আছে, আমার নাম না শুনলে তো তোমার চলবে না। আফটার অল…’

হৃদয় খানিকটা উঁচু স্বরে বলল, ‘সাট আপ ম্যান।’

মুখে আঙ্গুল তুলে প্রেয়সী বলল, ‘ওকে।’

কিছু মুহুর্ত কেটে যাওয়ার পর-ই হৃদয়ের পাশাপাশি হাটতে হাটতে প্রেয়সী বাচ্চামো গলায় বলল,

‘একটা কথা বলি?’

হৃদয় চোখ পাকিয়ে তাকালো। প্রেয়সী মাথা দুলিয়ে হেসে বলল, ‘আমার নাম প্রেয়সী।’

হৃদয় থমকালো। ভ্রু কুচকে বলল, ‘প্রেয়সী? প্রেয়সী আবার কারোর নাম হয় নাকি?’

‘হয়তো।’

‘কার?’

‘এই যে আমার।’

হৃদয় বড় করে নিঃশ্বাস ফেলল। পথ মাড়িয়ে যেতে যেতেই বলল, ‘পার্ফেক্ট। প্রেয়সী ইকুয়াল টু রাক্ষসী।’

‘সে তুমি আমাকে ভালোবেসে যে নাম দিবে আমি মাথা পেতে নিবো, বোকা গিদর।’

প্রেয়সী দাঁত বের করে হাসতেই হৃদয় রোষানলে জ্বলে উঠলো। বারবার এক নামে ডাকাতে ত্যক্ত বিরক্ত সে। আঙ্গুল তুলে শাসানোর ভঙ্গিতে বলল,

‘আর একবার বোকা গিদর বলে ডাকলে, এই ড্রেনে পুতে ফেলবো।’

‘ওমা! ড্রেনে পুতা যায় বুঝি? আমি তো জানতাম মাটিতে পুতে ফেলে।’

‘এই রাক্ষসী, তুমি কে বলো তো? যাও এখান থেকে।’

‘যাবো মানে? কোথায় যাবো? আমি তো এখন তোমার সাথে আমার হব হব শ্বশুড় বাড়ি যাবো।’

হৃদয় বিস্মিত বনে গিয়ে বোকা বোকা চোখে তাকালো। অবুঝ দৃষ্টি জোড়ার দিকে তাকিয়ে প্রেয়সী মুচকি হাসলো। অবচেতনেই ভীষণ মাত্রায় বিরক্ত হয়ে তপ্ত রাস্তার কিনারা ধরে উল্টোপাল্টা পা ফেলে এগোলো হৃদয়। ওর পেছন নিয়েই ফুটপাত ধরে এগোলো প্রেয়সীও।

,

বাড়ি ফেরার আধ ঘন্টা হাটার রাস্তাটা হৃদয় দুই ঘন্টায় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে এলো। তবুও এই মেয়ে পেছন ছাড়ছে না। আজব! দুপুর গড়িয়ে বিকেল এখন গুনগুনিয়ে আসছে। আকাশের শেষ মাথায় উত্তপ্ত সূর্যের তেজ নরম হয়ে মেঘের ভেলায় ভাসছে। বেল বাজাতেই দরজা খুললেন নাসরিন জাহান। ওড়নায় হাত মুছে প্রেয়সীর দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলেন,

‘কে বান্ধবী? নিয়ে আয় ঘরে।’

প্রেয়সীকে একটু দ্বিধাবদ্ধ দেখালো তবে হৃদয় অবাক হলো না। থমথমে মুখে তাকাতেই চোখে ভেসে উঠলো বিদীর্ণতা ভাব। সময়-অসময়ে প্রায় বাড়িতে হৃদয় বন্ধু-বান্ধব আসা-যাওয়া করে। কিন্তু এই মেয়ে বন্ধু তো দূর জীবনে দেখাও হয়নি হৃদয়ের সাথে। হৃদয় তিক্ত মুখে ভেতরে ঢুকতেই নাসরিন জাহান বললেন,

‘একি! ওকে বাইরে রেখেই এসে পরলি? তোর বন্ধু কিন্তু আমাদের তো মেহমান।’

হৃদয় যারপরনাই বিমুখ কন্ঠস্বরে বলল, ‘মা ও আমার বন্ধু-বান্ধবী কোনোটাই নয়।’

নাসরিন জাহান ভ্রু নাচিয়ে বললেন, ‘তবে?’

‘প্রেয়সী।’

নাসরিন জাহান বিহ্বল বনে গেলেন। চকিতেই বিমূর্তে পরিণত হয়ে বিমূঢ় চোখে তাকিয়ে বলে উঠলেন, ‘তোর প্রেয়সী?’

হৃদয় পানি খাচ্ছিলো। মায়ের কথা শুনে ঠিকরে মুখ থেকে পানি বের হয়ে গেলেই সে জ্ঞানশূন্যহীন গলায় বলল, ‘ওহ মাই গড, হেভ ইউ লস্ট ইউর মাইন্ড।’

নাসরিন জাহান মুখে আচঁল গুঁজে বিলাপ পেরে কেঁদে উঠলেন,

‘তুই আমাকে এভাবে ঠকাতে পারলি, বাবা? আমি তোকে কখনো কোনো কাজে বাধা দিয়েছি? আর তুই আমাকে না জানিয়ে ঘরে প্রেয়সী নিয়ে এলি। ও… একি হলো। কপাল পুড়লো গো আমার। সব্বনাশ..সব্বনাশ। পেটের পোলা আজ পেটের নয় রে।’

হৃদয় ধমকে উঠলো, ‘মা, কি মরা কান্না শুরু করলে?’

বসার ঘরে এসে দাঁড়িয়েছে তখন প্রেয়সী। হৃদয় কটমট করে একবার তাকালো। নাসরিন জাহান চোখ তুলে প্রেয়সীর দিকে তাকাতেই প্রেয়সী ঠোঁট প্রসারিত করে হাসলো। দৃশ্যমান হলো ঝকঝকে দাঁত, লাল-গোলাপি মাড়ি। ঠোঁটের কোণায় ভাঁজ পরলো। তখন তাকে ভীষণ সুশোভন লাবণ্যময় যুবতী দেখালো। বলতে নেই, হৃদয়ের হৃদপিন্ড হঠাৎ-ই ধীর হয়ে এলো। নাসরিন জাহান তাকিয়ে থাকলেন প্রেয়সীর হাসির দিকে। মেয়েটার হাসি নজরকাঁড়া। মনে হবে, পুতুল সাজিয়ে সামনে বসিয়ে সারাক্ষণ তার হাসি দেখে যাই৷ নাসরিন জাহান হঠাৎ ওর থুতনি ধরে চুমু খেলেন। হৃদয় বড় বড় চোখ করে তাকালো। নাসরিন জাহান তৃপ্তি নিয়ে বললেন,

‘বেশ সুন্দর দেখতে তো! তুমি আমার ছেলের প্রেয়সী?’

প্রেয়সী হাসলো। হৃদয় কঠিন দৃষ্টিতে তাকালো। মেয়েটা সবসময় হাসে। হাসিওয়ালা রাক্ষসী! হাসির রোগ আছে বোধ হয়। হালকা করে মাথা দুলিয়ে প্রেয়সী বলল,

‘আমার নাম প্রেয়সী সাথে তোমার ছেলেরও প্রেয়সী।’

‘বাহ! কন্ঠটাও কি সুন্দর! শুধু ছেলের প্রেয়সী কেনো এ বাড়ির প্রেয়সী করে আনবো তোমায়।’

হৃদয় মুখভর্তি বাতাস গিলে বলল, ‘এ্যা? আম্মা এসব কি বলো?’

‘কি বললাম আর? যেহেতু প্রেয়সী বানিয়ে রং ঢং করে প্রণয় ঘটিয়েই ফেলেছিস তবে এই মহলে তাকে সাদরে গ্রহণ করা যাক।’

হৃদয় বিস্মিত হয়ে তাকালো। অবাক প্রসন্ন দুটি চোখ সাগরে হাবুডুবু খেতে খেতেই আবার পাহাড়ের বিশাল গর্তের গহব্বরে স্থানান্তর হলো। বিশাল গোহায় চাপা পরলো। এসব কি হচ্ছে? সব যেনো অপার্থিব। হৃদয় কি সত্যি অন্য কোনো গ্রহে চলে এলো? তা নাহলে এক বেলার মাঝেই জীবনের মোড় পরিবর্তন হয় কীভাবে? হৃদয় নিশ্চিত, এ নিশ্চয়ই ওর স্বপ্ন কিংবা কল্পনা। এক পুলকিত মনোহর হাস্য রাক্ষসীর জন্য কল্পনা।

তখনি তোশকা নিচে নেমে এলো। সে হৃদয়ের ফুফাতো বোন। প্রেয়সীকে দেখিয়ে নাসরিন জাহান কপাল চাপড়িয়ে বললেন,

‘এই বোকা ছেলের প্রেয়সী আছে। এর জন্যই বিয়ে করতে চাইতো না। তুই কষ্ট পাস না মা। এই গর্দভ টা তোকে বিয়ে করছে না তো কি হয়েছে তোর জন্য আমি অনেক ভালো ছেলে খুঁজে এনে দিবো।’

তোশকা ছলছল চোখে তাকালো, ‘হৃদয় ভাইয়া তুমি এজন্য আমাকে বিয়ে করতে চাওনি? সবসময় বলেছো, ভালোবাসা, বিয়ে এসবের কোনো মানে হয় না। ভালোবাসা বলতে কোনো অনুভূতি নাকি এই পৃথিবীতে এক্সিস্ট-ই করে না। অথচ তুমি নিজেই সবার আগে প্রেয়সী ট্রেয়সী বানিয়ে ঘর পর্যন্ত নিয়ে চলে এসেছো?’

হৃদয় হতবাক হয়ে গেলো। একটা মানুষও তাকে কিছু বলার সুযোগ দিচ্ছে না? সাথে প্রচন্ড রাগ হলো মায়ের বলা বোকা শব্দটা শুনে। রাগে দুঃখে হৃদয় বড় বড় পা ফেলে নিজের ঘরে চলে যেতেই তোশকা প্রেয়সীর দিকে তাকিয়ে বাম চোখ টিপে দিলো। প্রেয়সী থতমত খেয়ে বিনিময়ে হাসি ফিরিয়ে দিলো। তোশকা এবার ডান চোখ টিপে চলে গেলো। প্রেয়সী বিরবির করে বলল, ‘আশ্চর্য চোখ টিপা-টিপির রোগ আছে নাকি? বাম-ডান সব চোখ টিপে দিচ্ছে।’

চলবে❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here