প্রেমমহল,২
মুমুর্ষিরা_শাহরীন
তিন পাখা বিশিষ্ট ফ্যান’টা মাথার উপর শো শো করে ঘুরছে। বাইরে নিঝুম বিকেলের হালকা পবন-রোদের মৃদু ঝলকানি। হৃদয় কপালে হাত দিয়ে শুয়ে থাকতেই ঘরের দরজায় শব্দ হলো। চোখ খুলে প্রেয়সী’কে দেখতেই হৃদয় চটপট উঠে বসে তারস্বরে বলল,
‘হোয়াট দ্যা….. এই রাক্ষসী, কারোর রুমে ঢুকতে যে নক করতে হয় এই ম্যানারস টুকুও নেই?’
প্রেয়সী বিছানায় বসে মিষ্টি হাসলো। হৃদয় বিরক্তে চোখ ঘুরিয়ে নিতেই ঠোঁট উল্টে প্রেয়সী বলল,
‘আমি কোন ঘরে থাকবো?’
হৃদয় মিনিট খানিকের জন্য স্তব্ধ হলো। চমকিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে গেলো ঠোঁট উল্টানো আদুরে মেয়েটাকে। তাকিয়ে থাকতে থাকতেই তার ঠোঁটের কোল ঘেষেও স্ফীত হাসির রেখা মিললো। ভীষণ ভালো লাগাটুকু ছেয়ে গেলো পুরো বুক জুড়ে। কিন্তু পরমুহূর্তেই বিকট শব্দে হৃদয় বলে উঠলো,
‘কোন ঘরে থাকবে মানে? এই মেয়ে, তুমি কি আমার বউ লাগো? যাও, নিজের বাসায় যাও।’
প্রেয়সী পা দুলাতে দুলাতে আবার হাসলো, ‘এখন বউ লাগি না তবে খুব শীঘ্রই লেগে যাবো।’
হৃদয় দাঁত কিড়িমিড়ি করে বলল, ‘আমার ইচ্ছে করছে কি জানো?’
প্রেয়সী কৌতুহল নিয়ে একটু ঝুঁকলো। ক্রমাগত ভ্রু নাচিয়ে বলল, ‘কি কি? চুম্মা দিতে ইচ্ছে করে?’
হৃদয় আহাম্মক হয়ে গেলো। বিস্ফোরিত চোখ দুটো নিয়ে তাকিয়ে থাকার কালেই আরো খানিকটা প্রস্ফুটিত হলো। ধমকে উঠে বলা হলো,
‘ইচ্ছে করছে ঠাস ঠাস করে তোমার গালে কয়েকটা বসিয়ে দেই। নির্লজ্জ মেয়ে। এই, তোমার বাসার এড্রেস দাও।’
প্রেয়সী ঠোঁট ফুলিয়ে প্রশ্ন করলো, ‘হুম?’
‘বাংলা কথা বুঝো না? তোমার মা-বাবার নাম্বার দাও। আই ওয়ান্ট টু টক উইথ দেম। কীভাবে তারা এরকম একটা পাগল মেয়েকে রাস্তায় ছাড়তে পারে? হুটহাট চেনা নেই জানা নেই বেহায়ার মতো আমার বাড়িতে এসে জুটেছে। তোমাকে তো পায়ে শিকল পড়িয়ে বেধে রাখা উচিত। নাম্বার দাও এক্ষুণি।’
প্রেয়সী বোকা বোকা গলায় বলল, ‘নাম্বার? কীসের নাম্বার? নাম্বার কি? আমি তো কোনো নাম্বার জানি না।’
হৃদয় দ্বিতীয় বার আহাম্মক বনে গেলো। নিজেকে ভীষণ নির্বোধ, অবুঝ, বুদ্ধি-জ্ঞানহীন বলে মনে হলো। বোকা বোকা চোখে তাকিয়ে সেও বলল,
‘তুমি পাগল নাকি আমি ছাগল?
‘ওমা! তুমি ছাগল হবে কেনো? তুমি তো বোকা। বোকা গিদর।’
‘সাট আপ। রং ঢং করতে তো ভালোই পারো? আমি বোকা না তুমি বোকা। মস্ত বড় বোকা। এই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বোকা, নির্বোধ। যে নাম্বার কি সেটা পর্যন্ত জানে না।’
‘নাম্বার কি সেটা তো জানি কিন্তু আমি তো আব্বু আম্মুর নাম্বার মুখস্ত করিনি।’
হৃদয় মাথায় হাত দিয়ে বসলো। তার মাথা ঘুরছে। অতিরিক্ত টেনশনে বমি বমিও পাচ্ছে। ক্লান্ত শরীরে নিস্তেজ গলায় সে বলল,
‘এড্রেস টা দাও।’
‘এড্রেস? মানে ঠিকানা? কিন্তু কোথায় ঠিকানা? আমি তো জানি না।’
এই পর্যায়ে হৃদয় চেঁচিয়ে উঠলো, ‘মানে কি? নাম্বার নয় মুখস্ত নাও থাকতে পারে তাই বলে কি ঠিকানাও জানবে না? ইরিটেটিং।’
‘আমার তো বাসা নেই।’
‘বাসা নেই তাহলে কি এভাবেই বিভিন্ন ছেলে ধরো আর যার তার বাসায় থাকো?’
হৃদয় দাঁত চেপে বলতেই প্রেয়সী ভীষণ অবুঝ গলায় বলল, ‘ছেলে ধরা কি? আমি তো ছেলে ধরি না। আর তুমি রেগে যাচ্ছো কেনো বোকা ছেলে? আমি তো তোমার সাথে প্রেম করার জন্য এসেছি। আর কোনো ছেলের সাথে তো আমি প্রেম করি না।’
কিছুক্ষণ নির্বাকে থেকে হৃদয় ক্লান্ত গলায় বলল, ‘তুমি কি আসলেই এতোটা ভালো? সহজ-সরল?’
‘হ্যা, জটিল হবো কেনো? সব মানুষ ই সহজ৷ শুধু মাঝে মাঝে শয়তান মনে জটিলতায় ভরিয়ে দেয়।’
হৃদয় হঠাৎই উদ্বিগ্ন স্বরে বলল, ‘ফোন? হ্যাঁ ফোন?তোমার কাছে ফোন নেই?’
‘হ্যাঁ আছে তো। কিন্তু কেনো?’
হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো ভঙ্গিতে হৃদয় বলল, ‘ফোন আছে? ওহ মাই গড, তোমার কাছে ফোন আছে?’
‘হুম আছে তো।’
‘দেও।’
‘দাঁড়াও, ড্রইংরুমে হ্যান্ডব্যাগ’টা ফেলে এসেছি। নিয়ে আসছি।’
প্রেয়সী দৌড়ে ব্যাগ আনতে গেলো। ব্যাগ থেকে ফোন বের করে হৃদয়ের হাতে দিতেই হৃদয় বিরবির করে বলল, ‘হুহ, বাপ-মায়ের নাম্বার জানে না অথচ ফোন নিয়ে ঘুরে।’ ফোন স্ক্রিন খুলতেই দেখা গেলো ফোনে কোনো লক নেই। হৃদয় চোখ তুলে তাকালো। এরপর আবার ফোনের দিকে চোখ ঘুরাতেই বোকা বনে গেলো। অবাক হয়ে বিস্মিত কন্ঠে বলে উঠলো,
‘ওই, সিম কই? ফোনে তো সিম নাই।’
প্রেয়সী ঠোঁট উল্টে বলল, ‘সিম কি? সবজির শিম? কিন্তু আমি তো শিম খাই না। আর শিম ফোনে কেনো থাকবে?’
হৃদয় বাজখাঁই গলায় চেঁচালো, ‘অসহ্য! আমার তোমাকে সহ্য হচ্ছে না। রাগে শরীর জ্বলছে। এই মেয়ে তুমি কি চাও বলো তো? তোমার ফোনে..’
হৃদয়ের কথা শেষ হওয়ার আগেই প্রেয়সী হিহি করে হেসে বলল, ‘আমি তো তোমার সাথে প্রেম করতে চাই।’
হৃদয় হাত মুঠো করে চোখ মুখ খিচে গলার স্বর টেনে ‘ওহহহ…’ করে চিল্লালো, ‘তোমার ফোনে সিম নেই তো ফোন দিয়ে কি করো তুমি?’
নিষ্পাপ মনে উত্তর দিলো প্রেয়সী, ‘গেমস খেলি।’
হৃদয় বিস্ময়কর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো। এই মেয়ে যতোই আলাভোলার মতো বিহেভ করুক এর মধ্যে ঠান্ডা মাথায় মানুষকে অসহ্য করে ফেলার মতো অসীম ক্ষমতা আছে। বাড়ি কাঁপিয়ে হৃদয় চেঁচিয়ে উঠলো, ‘গেট আউট ফ্রম মাই রুম।’
,
নাসরিন জাহান প্রেয়সীকে খাবার টেবিলে নিয়ে এলেন। হৃদয় খাওয়া থামিয়ে বলল,
‘এই ঢং আর কয়দিন চলবে?’
তোশকা হৃদয়ের সামনাসামনি বসেছে। হৃদয় আবারো খাওয়া শুরু করতেই প্রেয়সী বলল,
‘ঢং কি বোকা গিদর?’
হৃদয়ের হাত থেকে খাবার পরে গিয়ে মুখটা হা হয়েই থাকলো। আড়চোখে মা আর তোশকার দিকে তাকিয়ে জোরপূর্বক হাসি দিলো। এরপর প্রেয়সীর দিকে চাপা আওয়াজে বলল,
‘আমার নাম হৃদয়। যেখানে সেখানে এই উইয়ার্ড নামে ডাকলে, সামনে এই চাকু দেখতে পাচ্ছো না? এই চাকু দিয়ে পেট ফুটো করে দিবো।’
প্রেয়সী নাসরিন জাহানের দিকে তাকিয়ে চোখ ছোট ছোট করে বলল, ‘আচ্ছা মা, পেট ফুটো করলে না আমার পেট থেকে রক্ত বের হবে?’
হৃদয়ের মুখটা আপনাআপনি হা হয়ে গেলো। চোয়াল টা ঝুলে পড়লো নিচের দিকে খানিক। এহেন প্রশ্নে ঠিক কি বলে আখ্যায়িত করা উচিত এই মেয়েটাকে? হৃদয় যেনো এক্ষুণি চেতনাহীন হয়ে পরবে যখন এই নিরেট মূর্খ মানবী ভীষণ অবাক গলায় বলল,
‘পেট ফুটো হলে রক্ত বের হবে। রক্ত বের হলে তো আমি মারাও যেতে পারি? আমাকে হসপিটালাইজড’ও করতে হতে পারে। মা, তোমার ছেলে আমাকে মার্ডার করার প্ল্যান করছে।’
প্রেয়সীর সাথে সাথে নাসরিন জাহানও অবাক হয়ে হৃদয়ের দিকে তাকালেন। হৃদয় অপ্রস্তুত হয়ে লাগাতার খাবার মুখে ঢোকালো। এক পর্যায়ে কাশি উঠে যেতেই প্রেয়সী বলল,
‘মা, তোমার ছেলেকে পানি দাও।’
হৃদয় নিজ হাতে পানি খেয়ে আবারো ধমকে উঠলো, ‘হোয়াট ননসেন্স? কে তোমার মা? রাক্ষসী, খোক্ষসীর মতো আমার বাড়ি দখল করেছো আবার আমার মাকেও মা ডাকছো।’
প্রেয়সী লজ্জা লজ্জা মুখে হেসে বলল, ‘খুব শীঘ্রই তোমার মনটাও দখল করবো। তখন সারাক্ষণ ওগো প্রেয়সী প্রেয়সী করবে।’
হৃদয় চেয়ারে ঠেস দিয়ে বসে টেনে টেনে বলে উঠলো, ‘ও রে… জাতে মাতাল তালে ঠিক।’
প্রেয়সী ঠোঁট উল্টে আবারো বলল, ‘কিন্তু আমি তো মাতাল নই। আমার চৌদ্দ গুষ্টির কেউ-ই মাতাল নয়।’
হৃদয় বিরক্তে চোখ উল্টালো। মিনিট খানিক পরেই কিছু মনে পরার ভঙ্গিতে বলল, ‘এক মিনিট, চৌদ্দ গুষ্টি। তারমানে তোমার যে গুষ্টি আছে সেটা তুমি জানো? ওহ, থ্যাং গড। এবার চটপট তোমার বাবার নাম বলো।’
প্রেয়সীর মুখটা গোমড়া হয়ে এলো। সেকেন্ড দশেক পরেই আবার বলল, ‘বাবার নাম অনামকা আর মায়ের নাম অনামিকা।’
হৃদয় ভ্রু কুচকে বলল, ‘মায়ের নাম নাহয় অনামিকা বুঝলাম কিন্তু বাবার নাম অনামকা? এটা কেমন নাম?’
‘নেই। নাম নেই। হ্যাঁ, নেই তো। অ+নামকা হলো না, নাম নেই আবার অ+নামিকা তার মানেও নাম নেই। যেমন, ধরেন কৃতজ্ঞ। অ যোগ করলে হয় অকৃতজ্ঞ।’
প্রেয়সী চোখ টিপে হাসলো। হৃদয় ঢকঢক করে এক গ্লাস পানি খেয়ে অস্থির কণ্ঠে বলল,
‘ইউ আর জাস্ট টু মাচ। আসলেই, জাতে মাতাল তালে ঠিক।’
নাসরিন জাহান বললেন, ‘হয়েছে হয়েছে, মা তুমি যাও হৃদয়ের পাশে গিয়ে বসো।’
হৃদয় তৎক্ষণাৎ ঘাড় ঘুরিয়ে না করে চেঁচিয়ে বলল, ‘না। কক্ষনো না। ও কি আমার বিয়ে করা বউ লাগে? এই তোশকা আয় তো। আমার পাশে বস।’
তোশকা মিনিট খানিক হা করে রইল। হৃদয় ভাইয়ার পাশে বসবো? অবাস্তব! হৃদয় ভাইয়া তো কখনো ওর কাছেও ঘেঁষতে দেয় না। হৃদয় ধমকে বলল, ‘কি রে কথা কানে যায় না?’
তোশকা দৌড়ে নাচতে নাচতে চলে এলো। প্রেয়সী মুচকি হেসে তোশকার চেয়ারটাতে গিয়ে বসে প্লেট হাতে নিয়ে ভাত বাড়তেই তোশকা প্রেয়সীকে চোখ টিপে দিলো। প্রেয়সী থতমত খেয়ে জোর করে হাসলো। খাবার বেড়ে খেতে খেতেই বিরবির করলো,
‘সমস্যা কোথায়? মেয়েটা কি কোনোভাবে লেসবিয়ান? কথায় কথায় আমাকে কেনো চোখ টিপ মারছে? বুঝেছি, এর জন্যই এই বোকা গিদর টা এই মেয়েকে বিয়ে করতে চায়নি।’
চলবে❤️