প্রেমমহল,৩

0
811

প্রেমমহল,৩
মুমুর্ষিরা_শাহরীন

‘তোদের বিয়ের তারিখটা তবে পাকা করে ফেলি?’

নাসরিন জাহানের হঠাৎ প্রশ্নে হৃদয় বিষম খেলো। প্রেয়সী আতংকিত দৃষ্টিতে একবার তাকিয়ে পরমুহূর্তেই লাজুক হাসলো। ছেলেকে পানি দিতে দিতে তিনি আবার বললেন,

‘মা, তোমার বাবা-মার মতামতও তো লাগবে। তুমি একটু ফোন নাম্বার টা দাও।’

প্রেয়সী কিছুক্ষণ নির্বাকে পলক ফেললো। হৃদয় ঠোঁট কামড়ে তাকালো। খানিক বাদেই প্রেয়সী বলল, ‘আমি তো জানি না আমার বাবা-মার নাম্বার।’

নাসরিন জাহান অবাক হলেন, ‘জানো না? বেশ তবে, ঠিকানা দাও আমি গিয়ে দেখা করে আসি।’

‘ঠিকানাও তো জানি না। আমার বোধহয় বাবা-মা নেই।’

প্রেয়সীর এহেন ধারার কথায় হৃদয়ের আবারো কাশি উঠলো। নাসরিন জাহান করুণ চোখে তাকিয়ে বললেন, ‘আহারে, মা টা।’

রাগে চেতে হৃদয় বলে উঠলো, ‘চিনি না জানি না যার তার সাথে আমার বিয়ে ঠিক করছো? মানে কি এইসবের?’

‘ওমা! আমি নাহয় নাই চিনলাম কিন্তু তুই তো চিনিস। প্রেমিকা বানিয়ে প্রেম ট্রেম করে এখন ন্যাকা সাজার মানে কি?’

‘মা, আমি প্রেম করিনি। এই মেয়েটাকে আমি চিনি না। কেনো বুঝতে চাইছো না?’

‘চিনিস না তবে কি মেয়েটা উড়ে এলো। মেয়েটা তোর সম্পর্কে সব জানে। তুই কোন খাবারটা পছন্দ করিস সেটা অবধি জানে। আর তুই বলছিস চিনিস না। মানছি, ঝগড়াঝাটি হয়েছে। আরে সম্পর্কে টুকটাক ঝগড়া না হলে কি জমে নাকি?’

‘কিসের ঝগড়া? কিসের সম্পর্ক? কিসব বলছো?’

‘কি বলছি মানে? প্রেয়সী আমাকে সব বলেছে, ওর সাথে তোর হালকা ঝগড়া হয়েছে বলেই না তুই মেয়েটার সাথে এই দুর্ব্যবহার করছিস!’

‘হোয়াট?’

‘এতো হোয়াট হোয়াট করিস না আমরা জানি তুই ইংরেজি পারিস।’

পাশ থেকে প্রেয়সী বলল, ‘ইংরেজ বোকা।’

হৃদয় নিচের ঠোঁট মুখের ভেতরে নিয়ে থুতনি ফুলিয়ে তাকালো। নাসরিন জাহান তাড়া দিয়ে বললেন,

‘বল, কত তারিখের দিকে বিয়ে ঠিক করলে তোর জন্য সুবিধা হবে? একা হাতে আমাকে সব সামলাতে হবে। আমার অনেক কাজ।’

হৃদয় উঠে দাড়িয়ে টেবিলে শব্দ তুলে বলল, ‘মা আমি এই মেয়েকে বিয়ে করবো না। বিশ্বাস করো, এই মেয়ের সাথে আমার আজ-ই প্রথম দেখা হয়েছে। আমি চিনি না। নামটা পর্যন্ত জানতাম না।’

নাসরিন জাহান চোখ পাঁকিয়ে তাকালেন, ‘এক কথা বারবার শুনতে ভালো লাগে না।’

‘আমি এই মেয়েকে বিয়ে করবো না। না মানে না।’

‘তাহলে কাকে বিয়ে করবি?’

হৃদয় ভাবলো। ভাবতে ভাবতেই এদিক সেদিক তাকালো। তোশকার দিকে চোখ পরতেই বলল, ‘হ্যাঁ, তোশকা। তুমি না তোশকার সাথে আমাকে বিয়ে দিতে চাইছিলা? ওকেই বিয়ে করবো। এই অচেনা মেয়েকে বিয়ে করার থেকে তোশকা ঢের গুন ভালো।’

তোশকা ঠোঁট টিপে লজ্জার হাসি দিলো। মিনিট দুয়েক পর আবেগি চোখে হৃদয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি হৃদয় ভাই।’

কথাটা আস্তে করে বললেও হৃদয়ের কানে ঠিক ই বাজলো। হৃদয় ঢকঢক করে এক গ্লাস পানি খেলো। দেখা গেলো, তার ক্রমাগত হেচকি উঠছে। কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না। এরমাঝেই প্রেয়সী বলল,

‘বিয়ে করবে? কিন্তু কেনো? আমি তো তোমার হব হব প্রেমিকা। আমাকে রেখে অন্য কাউকে কেনো বিয়ে করবে?’

শিশুসুলভ গলায় বলা প্রেয়সীর কথাগুলো শুনে হঠাৎ হৃদয় পূর্ণদৃষ্টিতে তাকালো। বাইরে আধার জগতের আধূলি। শনশন বাতাসে বাড়ির পাশের পুকুরের পানিতে ছলচ্ছল শব্দ। হৃদয় বলল, ‘বউ হওয়া সহজ। প্রেমিকা হওয়া সহজ নয়। দুর্লভ!’

হৃদয় চলে গেলো, প্রেয়সী তাকিয়ে রইল সেই পথের দিকে। তাকিয়ে থাকতে থাকতেই হালকা হাসলো। এরপর ঠোঁট প্রসারিত করে হেসে খাবারের দিকে মনোযোগ দিতেই দেখা গেলো, তৃতীয়বারের মতোন তোশকা চোখ টিপ দিয়ে উঠে চলে গেলো। প্রেয়সীর সামনে হাতে ধরা খাবারটা হাতেই থমকে গেলো সাথে ভীষণ অবাকতায় মুখটাও হা হয়ে থাকলো।মাত্রাতিরিক্ত বিরক্তিতে বিরবির করে বলল,

‘ভেবেছিলাম আমি একা পাগল। কিন্তু নাহ…আমার চেয়েও বড় পাগল আছে।’

,

পরবর্তী পরিকল্পনায় মত্ত হতে হতেই কাটলো রাত। আযান দিতেই ফজরের নামাজ পড়ে ঘুমাতে যাওয়ার উদ্যোগ করতে না করতেই ভোর পেরিয়ে সকালের সূর্য নামলো। প্রেয়সীর রাগ হলো। ভীষণ রাগে ফোলা লাল চোখে হাত-মুখ ধুয়ে এলো।

এ বাড়ির কর্তা নেই বললে চলে। হৃদয়ের বাবা বহুবছর আগেই আরেকজন রমণীর প্রেমখেলায় মগ্ন হয়ে সংসার ত্যাগ করেছে সেই নারীর হাত ধরে। নাসরিন জাহান সম্ভান্ত্র পরিবারের মেয়ে ছিলেন বলেই রাজার হালে ছেলেকে মানুষ করে গেছেন। হৃদয় একজন আর্কিটেক্ট। এই বাড়িটাও তার নির্দেশনায় বানানো। বাড়িটা দেখতে মহলের মতোন। প্রেয়সী নিচে আসতেই শুনতে পেলো বসার ঘর থেকে হাসির আওয়াজ আসছে। নিজেকে যথাসম্ভব প্রস্তুত করে সেদিকে এগিয়ে যেতেই দেখা গেলো হৃদয়ের পাশে সোফায় আরেকজন বসে আছে। প্রেয়সী ভ্রু কুচকালো পরমুহূর্তেই কেমন করে যেনো হাসলো। সোহান হৃদয়ের দিকে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

‘কে রে মেয়েটা?’

হৃদয় দায়সারা ভাবে জবাব দিলো, ‘জানি না। ‘

‘জানিস না তাহলে তোদের বাড়িতে কি করে?’

‘তাও বলতে পারছি না।’

‘আশ্চর্য। মেয়েটাকে চিনিস না অথচ তোর বাড়িতে?মেয়েটা আসলে কে?’

‘আরে, কেউ বিশ্বাস করতে চায়ছে না। আমি তো বলছি, কস্মিনকালেও এই মেয়েকে আমি চিনি না, জানি না।’

সোহান ভ্রু কুচকে প্রেয়সীর দিকে তাকাতেই প্রেয়সী ঠোঁট প্রসারিত করে হাসলো। দৃশ্যমান মাড়ির সাথে প্রসারিত হাসিটা খুব সুন্দর মানালো। সোহান মিনিট কয়েক হা করে হাসিটার দিকেই তাকিয়ে রইলো। কি ভয়ংকর হাসি! নিজেকে সামলে নিয়ে সোহান সৌজন্যে হেসে বলল,

‘আসসালামু আলাইকুম। আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না। আপনি?’

প্রেয়সী তার সাংঘাতিক হাসিটা বজায় রেখেই বলে,

‘আমি তো প্রেয়সী। সহজ ভাষায়, হৃদয়ের প্রেয়সী।আমার আর ওর ভাষায়, বোকা গিদরের রাক্ষসী।’

গরম চা ছিটকে মুখ থেকে বেরিয়ে গেলো। চায়ের দাগ বসে গেলো সাদা গেঞ্জিটায়। সোহান অবাক। হৃদয় বিস্মিত। বিশাল বড় বড় চোখ গুলো নিয়ে বলল, ‘কিহ? হৃদয়ের প্রেয়সী? আজকে তো আমি তোমায়…’

হৃদয় গেঞ্জির হাতা উঠিয়ে যেতে নিলেই সোহান আটকে বলল, ‘মেয়েদের গায়ে হাত দিতে নেই। বস।’

‘ওর গায়ে হাত দিবে কে? আমি তো ওকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিবো। সামান্য মানসম্মান পর্যন্ত নেই। এতো পরিমাণে অপমান করছি কালকে থেকে তবুও আমার বাড়িতে খুঁটি গেড়ে বসে আছে?’

প্রেয়সী কিছু মুহুর্ত তাকিয়ে থাকলো মন্ত্রবিষ্টের ন্যায়। চোখ দুটো উচ্ছল। থুতনিতে ভাঁজ। ঠোঁটের কোণায় কি একটু; মৃদু বাঁকা হাসি বহমান ছিলো? তোশকা ঘুম থেকে উঠে বসার ঘর পার হতেই, সেই ঘুমুঘুমু মুখ’টার দিকে তাকিয়ে থাকলো সোহান মিনিট কয়েক। হৃদপিণ্ড থেমে গিয়েও হঠাৎ তুমুল বেগে চলতে শুরু করলো।

তোশকা থেমে দাঁড়িয়ে চোখ ঘুরিয়ে প্রেয়সীর দিকে তাকাতেই প্রেয়সী চোখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিলো। বলা যায় না, এই মেয়ে কখন আবার সবার সামনে চোখ মেরে বসে। অলরেডি তিনবার ডান। এবারও প্রেয়সী আর ওর চোখাচোখি হলে আরেকবার কনফার্ম। তোশকা প্রেয়সীর থেকে চোখ ঘুরিয়ে আনলো ডানদিকের সোহানের দিকে। সোহান ওর দিকেই তাকিয়ে ছিলো। তাকাতেই দুজনের চোখাচোখি হলো। বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়েও থাকা হলো। প্রেয়সীর এখন দেখার পালা তোশকা সোহানকেও চোখ টিপ মারে কিনা?
কিছু সময় অতিবাহিত হলো। কিন্তু না, তোশকা চোখ টিপ মারলো না। উল্টে প্রেয়সীকে অবাক করে দিয়ে চোখ মারার বদলে বলল, ‘সকাল সকাল দাঁত ব্রাশ করা ছাড়াই কেনো প্রতিদিন আমাদের বাড়িতে চলে আসো, বলো তো?’

সোহান হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে অসহায় কণ্ঠে বলল, ‘কিন্তু আমি তো দাঁত ব্রাশ করেছি।’

‘কে বলেছে করেছো? তুমি জানো তোমার দাঁতগুলো কি পরিমাণে হলুদ হয়ে আছে? ইউ হেভ এনি আইডিয়া?’

সোহান হৃদয়ের কানে ফিসফিস করে বলল, ‘ দেখ তো ভাই আমার মুখ থেকে কোনো গন্ধ কিংবা দাঁত হলুদ দেখায় নাকি?’

সোহান বত্রিশপাটি বের করে ‘ই’ করলো। হৃদয় বিরক্তে সোহানের পেটে ঘুষি মেরে বলল, ‘ওয়াক থু!’ পেট চেপে সোহান মোচড়ামুচড়ি করে বলে,

‘আই এম সিউর। আমার দাঁত একদম হলুদ নয়। আমি পাক্কা দশমিনিট ধরে ভালো মতো ব্রাশ দিয়ে দাঁত মেজে এসেছি এবং আমি ওভার সিউর আমার দাঁতগুলো এতো সুন্দর লাগছে আর মুখ থেকে এতো সুন্দর পেস্টের গন্ধ আসছে যে, তোরও কিস করতে সমস্যা হবে না।’

হৃদয় চমকে দূরে সরে বসলো। ‘আল্লাহ’ বলে বুকে থু থু দিলো। ভীতু চোখে আতংকিত কন্ঠে বলল, ‘এখানে কিস এর কথা কোথা থেকে এলো?’

তোশকা চোখ উল্টে বলল, ‘চোরের মন পুলিশ পুলিশ।’

প্রেয়সী, হৃদয় আর সোহানের সোফার পেছনেই দাঁড়িয়ে ছিলো। সোহানের কথা শুনে সে বড় বড় চোখ মেলে বিরবির করল, ‘বাহ! একটা লেসবিয়ান আরেকটা গে। হোয়াট আ নাইছ কম্বিনেশন!’

প্রেয়সী স্বভাবসুলভ বোকা বোকা গলায় বলে উঠলো,

‘ভাইয়া আপনি চোর? আবার আপনার মন পুলিশ? তাহলে থানা কোথায়? চোরকে ধরে পুলিশ কোথায় রাখে?’

হৃদয় মাথায় হাত দিয়ে বসলো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

‘যাক, এটলিস্ট চোর পুলিশ কি এটা তো বুঝেছো? তোমার জন্য এটুকুই অনেক গো খুকি।’

প্রেয়সী আবারো কিছু বলতে যাবে তার আগেই হাত দেখিয়ে সোহান বলল, ‘এই তোশকা, রান্না করতে গিয়ে আমার হাতে পরেছে ফোসকা৷’

আবারো নামের বিকৃতি। তোশকা বড় বড় পা ফেলে মুখ ফুলিয়ে নাসরিন জাহানের ঘরের দিকে গেলো।

চলবে❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here