Dangerous-husband,পর্বঃ_৯_অন্তিম পর্ব
লেখকঃ_নুসরাত_জাহান_সম্পা
আদিবার মুখের রঙ বদলে একাকার হয়ে গেল। আবিরের বাবা যদি সবটা শুনে থাকে তাইলে তো ছেলেকেও তার কাছে নিয়ে যাবে। বড়লোকদের ব্যাপার স্যাপার বলে কথা।
আদিবাকে দেখে আবিরের বুঝতে বাকি রইল না যে ও টেনশনে পড়েছে। মুখটা কালো করে আদিবাকে বলল,
– কি হয়েছে তোমার? সমস্যা কি?
গম্ভির গলায় আবিরের কথার জবাবে বলল,
– আমার আবার কি হবে? পতিতার কি কিছু হতে পারে? তাছাড়া আমার কোন সমস্যা নেই। সমস্যা শুধু একটাই মায়ের চিকিৎসা করানোর টাকার ব্যবস্থা করা।
– আদিবা বলেছি না এটা নিয়ে ফালতু চিন্তা করবা না। আমি টাকাটা পাঠিয়ে দিব।
দীর্ঘশ্বাস নিয়ে আদিবা বলল,
– আপনার কাছে ফালতু হতে পারে আমার কাছে না৷
– হুম।
আদিবা আমাদের এখান থেকে বের হতে হবে কারণ বাবা যেকোন সময়ে আসতে পারে। আমি চাই না এটা নিয়ে কোন ঝামেলা হোক।
– একটা কথা বলব।
– কি কথা?
– বলব?
– বল।
– আমাকে নিয়ে এত চিন্তা করতে হবে না আপনার। তারচেয়ে বরং আমি আমার হাজবেন্ডের কাছে চলে যাই৷
আদিবার কথা রাগান্বিত হয়ে গেল আবির।
আবিরের চোখ লাল হয়ে গেল। রাগান্বিত হয়ে আদিবাকে টেনে হিঁচড়ে নিজের কোলের ভিতরে রেখে থুঁতনিটা চেপে ধরল। কোথায় যাবে? আবার বল। ঐ রবির কাছে? এত্ত সখ তোমার ডেঞ্জারাস হজবেন্ডের কাছে যাওয়ার। প্রেগন্যান্ট করেছে তাতেও তোমার সখ মেটেনি। তাইলে যাও তোমার রবির কাছে এবার পুরো সখ মিটিয়ে আসো।
আবিরের কথা শুনে খিলখিল করে হাসল আদিবা।
এদিকে মুখ গোমড়া করে আদিবার দিকে তাকিয়ে ভারী গলায় বলল,
– লজ্জা করছে না আবার হাসছ।
– নাহ্ তো। কিসের লজ্জা? তুমি যা বলেছ তাতে লজ্জার তো কিছু নেই। যা বলেছ সত্যিটাই বলেছ।
– এবার মাথাটা একশো ডিগ্রিতে গরম হয়ে গেল আবিরের। মিনিট পাঁচেক আদিবার দিকে বড়বড় চোখ করে তাকিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায় সে। আদিবা পথের পানে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। মনেমনে কষ্ট অনুভব করছে খুব। কি করল এসব? আবিরের সাথে এমন ঠাট্টা করাটা তার উচিত হয়নি বরং তাকে বুঝিয়ে বলা উচিত ছিল যে আমি আপনার সাথে মজা করছি।
আদিবা আবিরের রুমে বিছানার উপরে পা তুলে বসে পড়ল। মাথাটা চিনচিন করে ব্যথা করছে। বেলা গড়িয়ে রাত, রাত গড়িয়ে সকাল, সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে গেছে তবুও আবির এখনো আসেনি তার কাছে। আবিরের মোবাইল নাম্বারও নেই তার কাছে যে কল করে বলবে কোথায় আছে। খুব অভিমান করেছে সে। এতটা অভিমান ছেলেদের কখনো করতে দেখেনি। ভুল করে হলেও আবিরের সাথে যদি একটিবারও দেখা হত তাইলে তার কথাগুলোর জন্য ক্ষমা চেয়ে ভুলগুলে শুধরে নিত। কয়েকদিন অপেক্ষা করার পরেও আবির ফিরে আসল না। আদিবা তো টেনশনে একাকার হয়ে গেছে। মায়ের অপারেশনের টাকাটা কিভাবে মেনেজ করবে বুঝতে পারছে না। টাকা না হলে কোন কিছু সম্ভব না। মাকে এভাবে মৃতু্বরণ করতে দেখতে পারবে না সে। মা ছিল তার একমাত্র ভরসার অবলম্বন।
চোখ বন্ধ করে সবকিছু কল্পনা করতেই বুকের বা পাশটা চিনচিন করে ব্যথায় ডুকরে ওঠে।
আদিবা আরও সাতদিন এভাবেই আবিরের আসার অপেক্ষার প্রহর গুনল কিন্তু প্রতিদিনই নিরাশ হল। আবিরকে খোঁজার অনেক চেষ্টা করার ইচ্ছা থাকলেও কোন কূলকিনারা খুঁজে পেল না। নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছে। সত্যি আজ নিজের ভুলের কারণে আবিরকে হারিয়েছে। হারানোর কষ্টটা কখনও উপলব্ধি
করেনি কিন্তু আজ বুঝতে পারছে কষ্টটা।
কষ্টগুলো চোখের পানি হয়ে গড়িয়ে পড়ছে। অনেকদিন বাসায় কথা হয়নি। মায়ের অবস্থা জানতে ইচ্ছা করছে কিন্তু কিভাবে কল দিবে বুকে সাহস পাচ্ছে না। টাকাটা জোগাড় ককথা রতে পারেনি বলে হয়তোবা সাহস হচ্ছে না। আদিবা বুক ভরা কষ্ট নিয়ে ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে যায় আদিবা। রাস্তায় বেড়িয়ে কোথায় যাবে দিক খুঁজে পাচ্ছে না৷ অনেকটা কষ্ট নিয়ে রাস্তার পাশ দিয়ে হাঁটতে শুরু করল আদিবা। মাথায় কোন কাজ করছে না। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত অবস্থায় বটগাছের নিচে গিয়ে বসল আদিবা। ব্যাগের ভিতরে হাত দিয়ে ফোনটা বের করে আবিরের নাম্বারে কল দিল। এখনো সুইচ অফ বলছে ফোন। এদিকে চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়ছে আদিবার৷ বাবার নাম্বারে কল দিল আদিবা। কয়েকবার কল বাজার পরে রিসিভ করল বাবা।
বাবা মা কেমন আছেন? আতংকিত কন্ঠে বলল আদিবা।
– এই তো ভালোই আছে এখন। অপারেশন করার পরে এখন আগের চেয়ে অনেকটা ভালো আছে।
– অপারেশন! মায়ের অপারেশন হয়েছে?
– কেন রে আদিবা তুই কি চাসনি তোর মায়ের অপারেশন হোক! তাইলে ব্যাংকে টাকাটা কেন পাঠিয়েছিলি। হসপিটালের বেডে বসে অপারেশনের আগে তোর মা কত করে যে তোকে দেখতে চেয়েছিল তুই ভাবতেও পারবি না। সবকিছু ঠিক থাকত যদি তুই একটিবারের জন্য আসতি৷ আচ্ছা আদিবা মা তুই কি এমন চাকরি করিস যাতে তুই কয়েকদিনের ভিতরে এতগুলো টাকা পাঠালি। জানিস সবাই আমাকে প্রশ্ন করে কিন্তু আমি কোন উত্তর দিতে পারি না৷ এখন বল তুই কবে আসবি।
– আসলে বাবা কেউ কারও ভালো দেখতে পারে না। আমি আজ ভালো আছি তো সেটা কারও সহ্য হয় না। যখন মার খেয়ে সারারাত ফ্লোরে গড়াগড়ি খেতাম কই তখন তো আর কেউ আসত না। শীতের কনকনে রাতে বাহিরে সিঁড়িতে বসে কত রাত যে পাড় করেছি তার কথা মনে করলে কষ্টে বুকটা কেঁপে উঠে।
– আদিবা মা তোকে তো জরুরি একটা কথা বলতে ভুলে গেছি এতক্ষণ।
– কি কথা বাবা?
– রবি এসেছিল তোকে খুঁজতে গতকাল বিকালে। আমি বলে দিয়েছি তোমার সাথে আমার মেয়ের কোন সম্পর্ক নেই৷ তোমার এত জানোয়ার স্বামী যেনো কারও কপালে জোটে না। জানিস সে কি রাগ, বলে আমি যেভাবেই হোক আমার বউকে খুঁজে বের করব৷
– কি বল?
– হ্যাঁ মা। তুই একটু সাবধানে তাড়াতাড়ি পারি তোমাদের সাথে দেখা করতে আসব।
কলটা রেখে স্তব্দ হয়ে চারদিকে তাকাল আদিবা।
কোথাও যাওয়ার মত পরিস্থিতি না পেয়ে আবারও সোজা হাঁটতে লাগল অচেনা গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।
১ বছর পরে………….
দরজার সামনে এসে অপরাধীর মত দাঁড়িয়ে আছে আবির। সারাটা রাস্তা জিজ্ঞেস করতে করতে এসেছে আদিবার বাসা কোনটা? কিন্তু কেউ আদিবা নামে চিনতে পারল না৷ অনেক খোঁজা খুঁজির পরে এক ভদ্রলোক আদিবার বাসা দেখিয়ে দিল। লোকটির কথা শুনে আবিরের কপাল বেয়ে ঘাম তরতর করে পড়ছে। পা থরথর করে কাঁপছে। গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। দরজায় কড়া নাড়লে বৃদ্ধ একজন ভদ্রলোক দরজাটা খুলে দিল। আবির লোকটিকে দেখে বুঝতে পারল এটা নিশ্চয়ই আদিবার বাবা। গলাটা কাশি দিয়ে খকখক করে কাশি দিলে ভদ্রলোক ভিতরে গিয়ে এক গ্লাস পানি এনে বলল,
– নাও এটা খেয়ে নাও কাশি কমে যাবে।
ভদ্রলোকের কথা শুনে আবির যতটা না অবাক হল তারচেয়ে বেশি হতভম্ব হল। দরজার ফাঁকা দিয়ে ভিতরের দিকে চোখ পড়তেই আরও বেশি চমকে গেল। খাটের উপরে মশারী টানানো কিন্তু ভিতরে কেউ নেই। ঘরে আগরবাতি জ্বলছে। সামনে রাখা মাটির চুলোর উপরে পানি টগবগ করে ফুটছে। আবির এবার মুখ খুলল বলল,
আংকেল আদিবা কোথায়? আর আন্টি কেমন আছেন?
– “…………….”
– আংকেল, আদিবা কোথায়?
– “…………..”
– আংকেল, প্লিজ কথা বলুন।
আবিরের বারবার জিজ্ঞেস করাতে আদিবার বাবা কান্নায় ভেঙে পড়ে। আবির তাকে সামলে নিয়ে বিছানার উপরে বসিয়ে দিল। জগ দিয়ে পানি ঢেলে দিয়ে বলল,
– আংকেল পানিটা খেয়ে নিন। আর কি হয়েছে একটু বলুন আমাকে।
কাঁপা কাঁপা হাতে পানির গ্লাসটা হাতে নিয়ে ঢকঢক করে পান করল সে। অনেকটা ঝিমিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
– তুমি কি আবির?
আংকেলের মুখে নিজের নামটা শুনে চমকে উঠল আবির। গলার ভিতরে ঢোক গিলে বলল,
– জি আমি আবির। আংকেল আদিবা কোথায়? আর আন্টি কেমন আছেন?
এবার আরও জোড়ে জোড়ে কাঁদল আংকেল।
তুমি বড্ড দেরি করে এসেছ।
– মানে?
– আদিবা আর বেঁচে নেই।
আদিবার মৃত্যুর কথাটা নিজের বাবার মুখে শুনে হাতে থাকা মোবাইলটা নিচে পড়ে গেল। বিছানার উপরে ধপাস করে বসে পড়ল আবির। চোখদুটো ঝাপসা হয়ে এসেছে। চারিদিকে পুরো অন্ধকার হয়ে এসেছে। চোখ খুলে সামনে তাকিয়ে দেখল মাথাটা ঘুরছে। ধীর গলায় আংকেলকে বলল,
– এটা কিভাবে হল আংকেল?
– এক বছর আগে আদিবা আমাদের বাসায় আসে। খুব খুশি ছিলাম আমরা। আদিবা দর্জির কাজ শিখে তাই করা শুরু করল। বেশ ভালো ভাবেই চলছিল আমাদের সংসার কিন্ত..
– কিন্তু কি আংকেল?
– ওর স্বামী রবি একদিন রাতে বাসায় আসে কিছু ভাড়াটে গুন্ডাদের সাথে নিয়ে। আদিবাকে ওর সাথে নিয়ে যেতে চায় কিন্তু আদিবা না করে দেয় আর এতেই ক্ষিপ্ত হয়ে রবি আদিবার পেটে ছুরি ঢুকিয়ে দেয় আর ঘটনাস্থলে আদিবা মারা যায়। তবুও হসপিটালে নিয়েছিলাম কিন্তু ততক্ষণে আদিবার পরাণ পাখি আল্লাহর কাছে চলে যায়। মেয়ের মৃত্যুর খবর শুনে আদিবার মা সহ্য করতে পারেনি সাথে সাথে ব্রেন স্টক করে মারা যায়।
আদিবার স্বামী নয় ও একটা ডেঞ্জারাস হাজবেন্ড। আমারই ভুল হয়েছিল ওর নামে মামলা দিয়ে রাখা উচিত ছিল। আদিবার সুরক্ষার ব্যবস্থা করা উচিত ছিল। ও শুধু আমার মেয়েকে নয় আদিবার পেটে থাকা বাচ্চাটা, ওর মাকেও মেরে ফেলেছে আর আমাকে জীবন্ত লাশ বানিয়ে রেখে গেছে।
কথাগুলো শুনে বাসা থেকে বেরিয়ে যায় আবির।
ভাবছে সেদিন যদি আমাকে বিনাকারণে পুলিশে আটক না করত হয়তোবা আজকে আবিবা বেঁচে থাকত। আদিবা কি মনে করেছে আমাকে ভেবেছে হয়তো ধোঁকাবাজ, বেইমান। হয়তো এমনটাই বিধাতা লিখে রেখেছিল। নেতার ছেলে মার্ডার করল আর পুলিশ প্রশাসন এসে বিনাকারণে আমাকে ফাঁসিয়ে দিল। আমাকে তাদের আসামী দেখানোই লাগত না হলে নেতার ছেলেকে জেলে যেতে হত। পরে লোক পাঠিয়ে আর আদিবাকে পায়নি কেউ। ৪ দিনের রিমান্ড শেষে শরীরের কোন অস্তিত্ব ছিল না তখন যে কিছু মনে করতে পারিনি।
এরপর অনেক দূর হাঁটার পরে হঠাৎ উচ্চস্বরে হাসতে লাগল আবির। আদিবা আমি আসছি আমাকেও তোমার সাথে করে নিয়ে যাও। ওই যে তোমাকে দেখছি তুমি আকাশের তাঁরা হয়ে আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছ। তোমার ডেঞ্জারাস হাজবেন্ডই তোমার জীবন নিয়ে নিল হা হা হা বলে কাঁদল আবির।
সমাপ্ত