শ্রাবণ_তোমার_আকাশে,১৩,১৪

0
1419

শ্রাবণ_তোমার_আকাশে,১৩,১৪
লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
পর্ব___১৩

বেলা অনেক বোঝানোর পর শাইনি ওর কথায় বাড়ি ফিরতে রাজি হলো। তবে শর্ত একটাই, বেলা ওকে ছেড়ে কোথাও যেতে পারবে না।
সেদিন রাতটা পার করে কোনোমতে সকালে উঠে সবকিছু গোছগাছ করলো বেলা। প্রয়োজনীয় ব্যবহৃত জিনিসপত্র গুলো সেখানকার এক আদিবাসীকে দিয়ে দিলো। এতদিন এখানে থাকায় কেমন একটা মায়া বসে গেছে বেলার। অভাবনীয় সুন্দর মুহূর্তগুলোর কথা বারবার মনে পড়ছিল ওর। সারাজীবন এই পাহাড়ের ওপর কাটিয়ে দেওয়ার জন্য ইচ্ছে করছিল। সকালের নাস্তা তৈরি করে ওরা ব্রেকফাস্ট সেরে নিলো। চা আর বনরুটি। বেলা বনরুটি পছন্দ করে না তেমন। কিন্তু উপায় না পেয়ে খেতেই হলো। ওদিকে শাইনির ভীষণ পছন্দ বনরুটি। চায়ের ভেতর ডুবিয়ে নরম করে চা-সহ এক চুমুকে পুরোটা খেয়ে নিতে দেখে বেলা আঁতকে উঠে বলল, ‘এসব কী করছেন? ছিঃ!’
শাইনি ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘ছিঃ কেন? কী করলাম?’
-চায়ে ডুবিয়ে এভাবে খায় নাকি!
-হুম। তুমিও খাও।
-ছিঃ, বিদঘুটে খাদ্য।
-তোমার কাছে বিদঘুটে বলে আমার কাছেও বিদঘুটে লাগবে এটা কোনো কথা নয়।
-আমার সামনে বসে এভাবে খাবেন না।
-খাবো।
বেলা হেঁচকি উঠিয়ে বলল, ‘আমার কিন্তু বমি আসছে!’
-আমি কী করব তাহলে?
বেলা রেগে বলল, ‘আপনার জ্বর হওয়ার সময় সেবা করিনি? তাহলে আপনিও আমার সেবা করবেন। বমি পরিষ্কার করবেন।’
-আমি তো ঘরে বমি করিনি।
বেলা শক্ত কন্ঠে বলল, ‘আমি করবো।’
-তাহলে তুমিই তা পরিষ্কার করবে।
-আপনি করবেন।
-আমিতো অসুস্থ, তা-ও এত অত্যাচার করবে? কষ্ট হবেনা?
বেলা কিছু না বলে চুপচাপ উঠে যায়। আধখাওয়া খাদ্যগুলো ঘরের পেছনে এসে ফেলে দেয়। হাতমুখ ধুয়ে বাইরের মাচায় এসে বসে থাকে। একটু পরেই রওয়ানা দেবে বাড়ির উদ্দেশ্যে। সব গোছগাছ শেষ। যাবার আগে একটু রিলাক্স করার জন্যই সব আগেভাগে করে ফেলেছে বেলা। মাচায় বসে আরও একবার চারদিকে চোখ বুলিয়ে নেয়। এখানে তাদের কত স্মৃতি জমে আছে! সেদিন হ্রদে গোসল করতে গিয়ে কী মজাটাই না করেছিল দুজন! শ্রাবণের বৃষ্টিতে পথঘাট কর্দমাক্ত ও পিচ্ছিল দেখে বেলার মনে শয়তানি বুদ্ধি উঁকি দেয়। আর সে জন্যই শাইনির অগোচরে হঠাৎ ওকে কাদা মাখিয়ে ভূত বানিয়ে দিয়েছিল। আর ও রেগে একাকার তখন! অবশ্য শাইনি বেলাকেও ছাড়েনি, প্রচন্ড জ্বালিয়েছিল সেদিন। ওর গায়ের চটচটে কাদা দিয়ে বেলার শখের ওড়নাটা নষ্ট করেছিল, আবার ওর কর্দমাক্ত মুখটা বেলার গালে ঘষে দিয়েছিল। খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি গালে লাগাতে বেলার গাল জ্বলছিল প্রচুর। মরিচ লাগলে যেমন হয় তেমনই লাল হয়ে গিয়েছিলো। ও ইচ্ছেমতো শাইনির বুকে কিল-ঘুষি মারতে মারতে হ্রদের পানিতেই ফেলে দিয়েছিল। গাল ফুলিয়ে কটমট করছিল। শাইনিকে একদম সহ্য হচ্ছিলো না ওর। অবশ্য পরে রাগ টাগ ভুলে হ্রদে গা ডুবিয়ে গোসল করেছিল দুজন। বেলা এটা মিস করতে চায়নি কোনোভাবেই৷ হাঁসদের সঙ্গে খেলা করে, দুষ্টু-মিষ্টি কিছু সময় কাটিয়ে এই ঘরটায় ফিরে এসেছিল তারা। যেন এটা ওদের নিজের সংসার, একান্তই নিজের। কারো আধিপত্য নেই, কিছু নেই।

শাইনির সাথে স্বাভাবিক একটা জীবন পেলে এই মুহূর্তগুলোই তাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত হতো। এটা হতো তাদের মধুচন্দ্রিমা! কিন্তু ওর জীবনের সবকিছুই যেন উলটো করে ঘটলো। লোকটা যে ভয়ংকর এক অসুখে আক্রান্ত! কীভাবে ঠিক হবে সবকিছু? ভুল বুঝাবুঝির অবসান ঘটিয়ে বাবা-মা কী ফিরিয়ে দেবে শাইনির কাছে? নাকি বিয়েটা ভাঙার সিদ্ধান্তেই তারা অটল থাকবে? তার ওপর বেলাকে কিডন্যাপ করে মস্ত বড় ভুল করেছে শাইনি। এত সহজে সবকিছু ঠিক হবেনা। তার বাবা কঠিন লোক। এখান থেকে ফিরে গেলে বিশাল বড় ঝামেলার মুখোমুখি হতে হবে শাইনিকে। লোকটার শরীরের যা কন্ডিশন তাতে কি এসবের মুখোমুখি হওয়া ঠিক হবে? তার ওপর জ্বরটা থেমে থেমেই উঠছে। কে জানে কী অপেক্ষা করছে ওদের জন্য! একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো বেলা।

পাহাড়ের পাদদেশে গঠিত বৌদ্ধ মন্দির হতে ঢং ঢং শব্দ আসছে। শব্দটা কেটে কেটে আসছে। কী এক মোহনীয় বার্তা নিয়ে যেন ছুটে সেই শব্দ! অসাধারণ লাগলো মুহূর্তটা বেলার কাছে। মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে দেখলো কেমন কুয়াশা যেন জমে আছে সবখানে। তবে বেলা জানে ওগুলো আসলে মেঘ! একটু কিনারে গিয়ে চোখ বন্ধ করে দাঁড়াতেই কিছু মেঘ বেলার গাল ছুঁয়ে যায়। কেমন অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। ও চোখ খুলে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকিয়ে শাইনিকে দেখতে পায়৷ শাইনির বুকের সঙ্গে ওর পিঠ লেপ্টে আছে। ওকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। বেলা অস্বস্তিতে পড়ে গেলো৷ শাইনি ওর হাতদুটো নিজের মুঠোয় নিতে নিতে বলল, ‘পাখি হতে ইচ্ছে করে না?’
-হুম।
-তাহলে হাত দুটো এভাবে ছড়িয়ে দাও। পাখির ডানার মতো। মেঘেরা যখন ছুঁবে তখন নিজেকে ঠিক পাখি ই মনে হবে। স্বাধীন, মুক্ত মনে হবে।
বেলা ওর কথামতো দাঁড়াতেই পেছন থেকে শাইনিও ওর হাতের ওপর হাত রাখলো। দুজনকেই পাখি মনে হচ্ছে। খোলা আকাশের নিচে পৃথিবীর সবচেয়ে সবচেয়ে সুখী মনে হচ্ছিলো দুজনকে।

ঢাকায় এসে বাস থামলো যখন, তখন রাত সাড়ে বারোটা। ওরা রওয়ানা দিয়েছিল দুপুরের দিকে।লম্বা সময় ধরে বাসে বসে থাকার দরুণ ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল বেলা, শাইনির কাঁধে মাথা রেখে। বাস থামার পর শাইনি বেলাকে ডেকে তুললো।
-পৌঁছে গিয়েছি?
-হুম, নামতে হবে।
-আচ্ছা।
দুজনেই নামলো। শাইনিদের ড্রাইভার অপেক্ষা করছিল বাসস্ট্যান্ডে। শাইনি বেলাকে নিয়ে সেখানে উঠে পড়ে৷ ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দেয়। বেলার খুব অস্বস্তি হতে থাকে। এই প্রথম শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছে তাও এত রাতে। অথচ ওদের বিয়ে হয়েছে সাড়ে চারমাস আগে। বাবা-মা জানতে পারলে না জানি কী করবে আল্লাহ জানে। ওর খুব চিন্তা হলো। শাইনি ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করলো, ’ঘুম পেয়েছে?’
-নাহ।
-ঘুমাতে পারো।
-দরকার নেই৷ আপনি ঠিক আছেন?
-হুম।
-দেখি তো জ্বর আছে কি-না!
বেলা ওর ডান হাতটা শাইনির কপালে ঠেকিয়ে চেক করে জ্বর আছে কি-না। গা গরম সামান্য। মানে রাতে উঠার পায়তারা করছে। বেলা হাত নামিয়ে বলে, ’ঔষধ নেননি? গা গরম তো!’
-ঔষধ ফেলে এসেছি।
বেলা অবাক হয়ে বলল, ’এত কেয়ারলেস আপনি? ওহ গড!’
-উতলা হওয়ার কিছু নেই।
বেলা ধমকে বলল, ’এক্ষুনি ঔষধ নিয়ে আসুন।’
-এত রাতে সব দোকানপাট বন্ধ।
-না। হাসপাতালের সামনের ডিসপেনসারি গুলো এখনো মনে হয় না বন্ধ করেছে।

বেলার জোরাজুরিতে গাড়ি থামিয়ে ডিসপেনসারি থেকে প্রয়োজনীয় ঔষধ নিয়ে আসে শাইনি। গাড়ি আবার চলতে শুরু করে। পানি দিয়ে জ্বর নামার ট্যাবলেটটা ওকে খাইয়ে দিলো বেলা। শাইনি এবার হাসতে হাসতে বলল, ’খুব চিন্তা হয় আমার জন্য তাই-না?’
বেলা অস্বীকার করে বলল, ’একদমই না।’
-বউ আমার বেশি মিথ্যা শিখেছে। আমি জানি তোমারও চিন্তা হয় আমার জন্য। আমি বুঝতে পারি গো বউ!
-হুহ!

একটা দোতলা বাড়ির সামনে গাড়ি থামে। বেলা ভয়ে ভয়ে গাড়ি থেকে নামে। শাইনি ওকে হাত ধরে ভেতরে নিয়ে যায়। গিয়ে দেখে দরজা খোলা। এত রাতে দরজা খোলা দেখে অবাক হয় বেলা। হঠাৎই দরজার সামনে একটা মহিলাকে দেখতে পায়। পরক্ষণেই চিনতে পারে। এটা শাইনির মা অর্থাৎ বেলার শ্বাশুড়ি। তার পাশে দাঁড়িয়ে আলম সাহেব অর্থাৎ বেলার শ্বশুর। তাদের ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি। নাজনীন বেগম ওদেরকে বরণ করে ভেতরে ঢোকায়। বেলা কুশল বিনিময় করে। হাতমুখ ধুয়ে আসে। ডাইনিংয়ে হরেক রকম খাবার সাজানো হয় নতুন বউয়ের উদ্দেশ্যে। সবকিছুই যেন পূর্বপরিকল্পিত। প্রচন্ড ক্ষিধে থাকায় শাইনি-বেলা দুজনেই খেতে রাজি হয়ে যায়। রাত তখন দেড়টা। ওরা ক্লান্ত থাকায় আলম সাহেব আর কথা বাড়ালেন না। নাজনীন বেগম ওদেরকে ঘরে পাঠিয়ে দিলেন। শাইনির ঘরটা খুব সুন্দর করে সাজানো-গোছানো। বেলা নিজের কাপড় পালটে ব্যাগ থেকে একটা কামিজ বের করে পরে নেয়। শাইনিও কাপড় পালটে বিছানায় এসে বসে। বেলা জিজ্ঞেস করে, ’ওনারা কী জানতেন আমরা আসবো?’
শাইনি বলল, ’হুম৷ আমি আসার সময় জানিয়ে দিয়েছিলাম আব্বুকে। তাইতো বাসস্ট্যান্ডে গাড়ি পাঠিয়ে দিলো।’
-ওহ। আপনার আম্মুকে কিন্তু ভালোই লাগলো। সব স্বাভাবিকই আছে৷ আপনার সাথে কথাও বলেছে সুন্দর করে।

শাইনি বলল, ’আমার মা সবসময়ই এমন। সে ভালো খুব। সবার সাথেই মিষ্টি হেসে কথা বলে। কিন্তু আমি মা মা ব্যবহারটা পাই না কেন জানি!’

-আপনার ব্যবহারগুলোর জন্যই হয়তো তিনি আপনার সাথে সহজ নন। তাই মায়ের ভালোবাসাটা বুঝতে পারেন না।

চলবে..ইনশাআল্লাহ!

#শ্রাবণ_তোমার_আকাশে
#লেখনীতে: ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব___১৪

পরেরদিন শাইনিকে জোর করে আলম সাহেবের সাথে হসপিটালে পাঠালো বেলা। ওকে ছাড়া যেতে চাইছিলো না কিছুতেই, ভাবছিল ওকে ছেড়ে বুঝি চলে যাবে নিজের বাসায়। কিন্তু বেলা ওকে আশ্বস্ত করে কোথাও যাবেনা সে। তারপরই যেতে রাজি হয়। ওদিকে বেলার বাবা-মাকে কোনো খবর দেওয়া হয়নি ও এসেছে। ইচ্ছাকৃতভাবেই বেলা দেয়নি, তাহলে একটা ঝামেলা হয়ে যাবে। ওরা প্রচুর রাগ করবে। ধীরে সুস্থে সময় সুযোগ বুঝে বেলা বাসায় ফোন করবে বলে ঠিক করলো। শাইনি আর আলম সাহেব বেরিয়ে যাওয়ার পরই ও পুরো বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখলো। চারদিকেই আভিজাত্যপূর্ণ ছাপ, কিন্তু কেমন যেন গা ছমছমে ভাব। শাইনির ছোট বোন শিলা। বয়স ষোলো সতেরো হবে। ওর সাথে অনেকক্ষণ গল্প করলো। মেয়েটা হাসিখুশি, চটপটে। খুব সহজ ভঙ্গিতেই বেলাকে ‘ভাবি ভাবি’ বলে ডাকতে লাগলো। বেলা অপ্রস্তুত হলেও তা প্রকাশ করলো না। তারপর রান্নাঘরে চলে গেলো। গিয়ে দেখলো নাজনীন বেগম দুপুরের রান্নার আয়োজন করছেন। বেলা গিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘আমি কিছু করবো?’

নাজনীন বেগম বললেন, ‘রান্নাবান্না জানো?’
-জি। করবো আমি?
-তোমার ইচ্ছে হলে করতে পারো, না করলেও পারো। আমার দুটোতেই সম্মতি আছে। কিন্তু নতুন বউ, তাই না করাটাই ভালো।
-তা কেন হবে! দিন আমি করে দিচ্ছি।
-করবে?
-হুম।
-তাহলে সবজিগুলো কেটে দাও, গোশত কাটতে পারো?
-জি।
-তাহলে গরুর গোশতগুলো কেটে দাও। ঝাল ঝাল ভুনা হবে।
বেলা অবাক হয়ে বলল, ‘ঝাল ঝাল তরকারি কে খাবে আন্টি?’
নাজনীন বেগম হেসে বললেন, ‘শিলা।’
বেলা ছোট্ট করে বলল, ‘ওহ। আঙ্কেল কী খেতে পছন্দ করেন?’
-তোমার আঙ্কেল ভেজিটেরিয়ান। সবজি-ফলের দিকেই ওনার সব মনোযোগ। তার দেখাদেখি আমিও সবজির প্রতি ঝুঁকে গেছি। বয়স হচ্ছে তো এখন আর মাছ-মাংস ভালো লাগেনা। মেয়েটার জন্যই করি। আর আমরা দুই আধবুড়ো সবজিই পছন্দ করি।
বেলা বলল, ‘ভালো তো। সবজি খেলেই না হয় সুস্থ থাকা যাবে। মাঝে মাঝে মাছ-মাংস খেলেও মন্দ না।’
-তা বটে।
-আর ওনি? কী খেতে পছন্দ করেন ওনি?

নাজনীন বেগমের মুখ থেকে হাসি হাসি মুখটা মিলিয়ে গেলো। জিজ্ঞেস করলো, ‘কার কথা বলছো?’
-আপনার ছেলে।
নাজনীন বেগম এবার পাংশুটে মুখ করে বললেন, ‘ওহ! শাইনি আর কী খাবে, ও তো বাইরের অখাদ্য-কুখাদ্য খাবার খায়। দেখো না কত বড় রোগ বাঁধিয়ে বসেছে!’
-ঘরের খাবার খায় না?
-না। মাঝে মধ্যে নিজের ইচ্ছা হলে খাবে, নয়তো বাইরে থেকেই আনিয়ে খায়৷ কাল রাতে তো তোমার সাথে বসে খেলো। অন্য সময় নয়৷ কিছু বললে ওর বাবা রেগে যায়, তাই আমি আর কিছুই বলিনা। বাপের আস্কারা পেয়েই তো এমন হয়েছে। আমার কী!

বেশ রেগে রেগেই কথাগুলো বললেন নাজনীন বেগম। বেলা ভাবতে লাগলো, মা হয়ে ছেলের এতবড় একটা রোগের কথা জেনেও ওনি কীভাবে স্বাভাবিক? নিজের ছেলের সম্বন্ধে এভাবে কথা বলতে খারাপ লাগছে না ওনার? যতইহোক, নিজের সন্তান তো! তারপরও এমন ব্যবহার, আচরণ মানায় নাকি ওনাকে? ছেলের পছন্দের খাবার তৈরি না করে উৎফুল্ল মনে তিনি মেয়ের জন্য মাংস ভুনা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। শাইনির জন্য আলাদা কোনো অনুভূতি দেখতে পাচ্ছেনা ও। এ কেমন মা? শাইনি ঠিকই বলেছিল, নাজনীন বেগমের কাছ থেকে ও মা মা ব্যবহারটা দেখতে পায় না৷ কেন কে জানে!

নাজনীন বেগম ওকে বসে থাকতে দেখে ডাকলেন, ‘বেলা?’
-জি আন্টি।
-কিছু ভাবছো?
-না না।
-আমার কথায় কিছু মনে নিও না।
বেলা জিজ্ঞেস করলো, ‘কোন কথা আন্টি?’
-ডিভোর্সের ব্যাপারে তোমার সাথে কথা বলেছিলাম না ফোনে? সেটার কথা বলছি আমি!
বেলার মনে পড়তেই সে বলল, ‘না আমি কিছু মনে করিনি। পরিস্থিতি ভিন্ন ছিল তখন।’
-নাজনীন বেগম চুলায় তরকারি বসিয়ে চুলার আঁচ কমিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তো কী ঠিক করলে?’
বেলা বলল, ‘কীসের কথা বলছেন আন্টি?’
-ডিভোর্সের ব্যাপারে? প্রথমবার তো তোমার বাবার চেষ্টা সব বিফলে গেল। কী করবে?
-ভাবিনি কিছু।
-ওহ আচ্ছা। তবে শাইনির জন্য স্যাক্রিফাইস করার প্রয়োজন নেই৷ তুমি খুব ভালো মেয়ে, শুধু শুধু নিজের জীবন নষ্ট করার দরকার কী!

শাইনির মায়ের কথা শুনতে বেলার খুব বিরক্ত লাগছিল। তাই এড়িয়ে গিয়ে বলল, ‘সবজি কাটা শেষ।’
-আচ্ছা।
-আমি তাহলে ঘরে যাই?
-হুম যাও।

বেশ বেলা হয়ে গিয়েছে তখন। পাখির কিচিরমিচির শব্দ শোনা যাচ্ছে এই অসময়েও।
ঘরে এসে ক্লান্ত ভঙ্গিতে কিছুক্ষণ বিছানায় শুয়ে রইলো বেলা। শাইনির মায়ের কথাগুলো নিয়ে কতক্ষণ ভাবলো কিছু ভাবনা। ভাবতে ভাবতে একসময় ঘুমিয়ে পড়লো। ঠক ঠক শব্দ কর্ণগোচর হতেই ঘুম ভাঙলো ওর। আড়মোড়া ভেঙে ওঠে বসলো। শাইনি এসেছে ভেবে ওড়নাটা গায়ে জড়িয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেলো। কিন্তু দরজা খুলে দেখলো শিলা দাঁড়িয়ে আছে।
-ঘুমাচ্ছো ভাবি?
বেলা হাসার চেষ্টা করে বলল, ‘ওই একটু চোখ লেগে গিয়েছিল আরকি..’
-আচ্ছা, ফ্রেশ হয়ে ডাইনিং টেবিলে খেতে চলে আসো।
বেলা ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করলো, ‘ওনারা ফিরেননি?
বুঝতে পেরেও শিলা হেসে প্রশ্ন করলো, ‘কারা?’
-তোমার ভাইয়া?
শিলা বলল, ‘চিন্তা হচ্ছে নাকি?’
-আরে না। এমনিই জিজ্ঞেস করছিলাম।
-ওয়েল! আব্বু ফোন করেছিল, বলেছে আসতে লেইট হবে। আমরা যাতে দুপুরের খাবার খেয়ে নিই। আর ভাইয়া তোমার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিল, দরজা বন্ধ ছিল তাই ভাবলাম ঘুমিয়ে আছো। আর ডাকিনি!
বেলা ছোট্ট করে বলল, ‘ওহ আচ্ছা।’
-আচ্ছা আমি যাই। তুমি গোসল সেরে চলে এসো।

শিলা চলে যাওয়ার পর দরজা বন্ধ করে বেলা বিছানায় বসে রইলো। দেয়াল ঘড়িতে দুপুর দুইটা বাজে। কিছুতেই সময় কাটছেনা ওর। মন খারাপ হয়ে এলো। এই কয়েকদিন সকাল – বিকাল শাইনির সঙ্গে থাকতে থাকতে ও কেমন একটা অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছে। তাই আজ নিজেকে একা একা লাগছে। খুব চিন্তা হচ্ছে ওর, শাইনিটা ভালো হয়ে যাবে তো? এতদিন যা পাগলামি করেছে তাতে বলা বাহুল্য শাইনি ওকে ছাড়া কিছুই বুঝে না। মন খারাপ হয়ে গেলো ওর। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ব্যাগ থেকে জামা-কাপড় বের করে গোসলে ঢুকলো বেলা।

দীর্ঘ আধঘন্টা সময় নিয়ে গোসল সেরে বেরিয়ে এলো।
কাপড়গুলো বারান্দায় মেলে ঘরে এলো। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে ভেজা চুলগুলো আঁচড়ে নিলো। বেড সাইড টেবিলের ওপর একটা ফটোফ্রেমে চোখ পড়লো। শাইনির হাসিমাখা একটা ছবি। বেলা ছবিটা হাতে তুলে নিলো। সারাদিনে একবারও চোখে পড়েনি কেন ছবিটা? মাথা গেছে ওর। কোনো খেয়ালই নেই। শাইনির ছবিটাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো। বেশ সুদর্শন লোকটা৷ হাসিমুখে ছবিটায় আরও দারুণ লাগছে। অথচ…

ছবিটা জায়গায় রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো বেলা। খাবার টেবিলে শিলা, নাজনীন বেগম ওর জন্য অপেক্ষা করছেন। বেলা গিয়ে শিলার পাশের চেয়ারটাতে বসে পড়লো। নাজনীন বেগম ওর পাতে খাবার তুলে দিলে। খেতে খেতে টুকটাক কথা হলো ওদের। তিনজনে একসাথে খাবার খেয়ে নিলো। সব গোছগাছ করলো বুয়া। তারপর কিছুক্ষণ টিভি দেখে, গল্পগুজব করে যার যার ঘরে চলে এলো। সারাটাদিন পেরিয়ে গেলো শাইনির দেখা নেই। বিকেলের দিকে আবারও ঘুমিয়ে পড়লো ও নিজের অজান্তেই।

কপালে কারোর উষ্ণ নিঃশ্বাস পড়তেই ঘুম ভাঙলো বেলার। হতচকিত হয়ে উঠে বসলো। ঘর অন্ধকার। কে এমন করলো? ভয়ে চুপসে গেলো ও। এমন সময় শাইনির গলা শুনতে পেলো।
-ভয় পাওয়ার কী হলো? দাঁড়াও আলো জ্বালাচ্ছি!

আলো জ্বালাতেই ঘরটা জ্বলজ্বল করে উঠলো। রাত তখন এগারোটা বেজে পনেরো মিনিট। বেলা বলল, ‘আপনি? অন্ধকারে আমাকে ভয় দেখাচ্ছিলেন তাই-না? অসভ্য লোক।’
শাইনি হেসে বলল, ‘ভয় দেখাইনি। চুমু খেয়েছি।’
-চুমু খেয়েছেন মানে?
-আমার বউটা এত কিউট করে ঘুমাচ্ছিলো যে তাকাতেই চুমু চুমু পেয়ে গেলো। বুঝলে?
-অসভ্য।
-অসভ্যতামির কী দেখলে? লিগ্যালি তুমি আমার বউ। হুহ!
বেলা জিজ্ঞেস করলো, ‘কখন ফিরলেন?’
-সন্ধ্যায়।
বেলা হতভম্ব হয়ে বলল, ‘আমাকে ডাকেনি কেন কেউ? আমি এতক্ষণ ঘুমালাম, ইশ।’
-আমি মানা করেছি ডাকতে। খাবে চলো।
-আপনি খেয়েছেন?
-হুম। তোমাকে ছাড়াই খেয়েছি। আবার নিয়েও এসেছি।
-কী খেয়েছেন?
-আব্বু স্যুপ বানিয়ে দিয়েছিল তাই।
-আমাকে বললেই করে দিতাম।
-বাদ দাও। খেতে বসো হাতমুখ ধুয়ে।
বেলা বিরক্ত গলায় বলল, ‘খাবো না। প্লিজ জোর করবেন না আর কিছু জিজ্ঞেসও করবেন না।’
শাইনি হেসে বলল, ‘আচ্ছা। আমাকে মিস করেছিলে নাকি?’
-না।
-তাই?
-হুম, তাই।
-ডাক্তার কী বললেন?
-কাল জানাবেন। তার আগে অন্যান্য ডাক্তারদের সঙ্গে ডিসকাশন করতে হবে, সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নিবেন।
-আপনি সাবধানে চলবেন এখন থেকে। যা কেয়ারলেস আপনি? আমার খুব চিন্তা হয়।

বেলার কথা শুনে শাইনি ভ্রু কুঁচকে তাকালো। তারপর বাতি নিভিয়ে ড্রিম লাইট অন করে বিছানায় এলো। বেলার পাশে বসে হঠাৎ বলল, ‘আমাকে একটা কিস দাও বউ।’
বেলা ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘কীহ!!’
শাইনি মুখটা অবুঝের মতো করে বলল, ‘বলছি আমাকে কিস দাও৷ বিয়ের এতমাস পরেও একটা চুমু দিলে না তুমি। এটা কিন্তু ঘোরতর অন্যায়! আমার বুঝি বউয়ের কাছ থেকে আদর পেতে ইচ্ছা করেনা!’

বেলা বোকার মতো চেয়ে রইলো। এসব কী বলছে ও? শাইনি ওর মাথাটা নিচু করে বলল, ‘দাও না একটু আদর?’
বেলা সম্মোহিতের মতো ওর কপালে চুমু খেলো। তারপর নিজেই লজ্জা পেয়ে কাঁথার ভেতর মুখ লুকালো। শাইনি হেসে বলল,
‘লজ্জাবতী লাজুকলতা
তুমি আমার কল্পলোকের কল্পলতা।’

চলবে…ইনশাআল্লাহ!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here