শ্রাবণ_তোমার_আকাশে,২৫,২৬
লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
পর্ব__
২৫
বেলার কান্না আর আকুতিতে শাম্মীর মন খানিকটা নরম হলো। তিনি বেলাকে অনেক কষ্টে শান্ত করে নাইমুদ্দীন সাহেবকে ফোন দিবেন বলে আশ্বস্ত করলেন। সেই সাথে তিনি এই বিষয়েও পরিষ্কার হলেন যে, বেলা তাঁর বরকে কতটা ভালোবাসে। নাইমুদ্দীন সাহেব হয়তো ব্যাপারটা বুঝতে পারছেন না। নয়তো কি তিনি এতোটা কঠোর হতেন? শাম্মী নিজের ফোনটা নিয়ে বেলার বাবার নম্বরে কল করলেন। দু-বার রিং হয়ে কেটে গেলো। তৃতীয়, চতুর্থ এবং পঞ্চমবারের মাথায়ও নাইমুদ্দীন সাহেবের ফোন রিসিভ হলো না। শাম্মী ফোন কানে নিয়েই বেলার দিকে তাকালেন। আড়ষ্ট গলায় বললেন, ‘রিসিভ করছে না ফোন।’
বেলা অস্থির হয়ে পড়লো, ‘আবার চেষ্টা করুন না ফুপি।’
বেলার কথায় শাম্মী আবারও ফোন করলেন, কিন্তু এবারও ওপাশ থেকে সাড়া পাওয়া গেলো না৷ শাম্মী ফোন রেখে দিয়ে বেলাকে বললেন, ‘চিন্তা করো না। রাত অনেক হয়েছে, ঘুমিয়ে পড়েছে হয়তো!’
‘কিন্তু ওনার অবস্থা তো আমার জানতে হবে। আপনি জানেন ফুপি? আব্বু আপনাকে কিছু বলেনি?’
‘ভাই তো তাড়ায় ছিলো। তোমার বিষয়ে টুকটাক কথা বলেছে, তোমার হাজব্যান্ডের কথা অবশ্য বলেনি। যা বলেছিলো তা ফোনেই সীমাবদ্ধ ছিল।’
বেলা ভাবতে পারছে না কিছু। বড় করে শ্বাস নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘এটা কোথায় আন্টি?’
‘মোহাম্মদপুর।’
বেলা ঠান্ডা মাথায় ভাবলো মোহাম্মদপুর থেকে ধানমন্ডি যেতে খুব একটা বেশি সময় লাগবে না। তাছাড়া রাত হওয়ায় যানজট থাকার সম্ভাবনাও নেই। বেলা বসা থেকে সটান উঠে দাঁড়িয়ে পড়লো। গায়ের ওড়না গোছাতে গোছাতে বলল,
‘আমি এখন যাবো ফুপি। নিয়ে চলুন আমাকে।’
শাম্মী আঁৎকে উঠে বললেন, ‘সেকী! এত রাতে কোথায় যাবে তুমি?’
‘আমি ওনার কাছে যাবো। আমাকে নিয়ে চলুন ফুপি, আমার খুব ভয় করছে, ওনি আমাকে না দেখতে পেয়ে না জানি কি অবস্থা করছেন। থাকতে পারবে না আমাকে না দেখে। আমার সেখানে থাকতে হবে যে-কোনো মূল্যেই..!’
শাম্মী বলল, ‘এখন যাওয়ার মতো পরিস্থিতি নেই মা।’
বেলা বিরক্তি নিয়ে বলল, ‘কেন ফুপি? আচ্ছা ঠিক আছে। আপনাদের যেতে হবে না। প্লিজ আমাকে যেতে দিন, আমি একাই যেতে পারবো।’
শাম্মী কপালে ভাঁজ ফেলে বেলাকে পাশে বসিয়ে বললেন, ‘এটা ঠিক হবে না মা। এত রাতে তোমার একা যাওয়াটা রিস্কি। তাছাড়া তোমার হেলথের কন্ডিশন ভালো নয়। অতিরিক্ত মানসিক চাপে তুমি স্বাভাবিক চিন্তাভাবনা করার ক্ষমতা হারিয়েছো। আর ভেবে দেখো, তুমি যাঁর জন্য এমন করছো সে যদি তোমাকে এই অবস্থায় দেখে তাহলে কী কষ্ট পাবে না? তোমার উদ্বিগ্নতাই প্রমাণ করে দিচ্ছে তুমি তাঁকে কতোটা ভালোবাসো। আর ভালোবাসার মানুষটার সামান্যতম কষ্ট কেউ মেনে নিতে পারে না। সেখানে তোমার হাজব্যান্ড যখন দেখবে তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী নিজের প্রতি খেয়াল রাখেনি তাহলে সে কী ভাববে? তোমার যেমন কষ্ট হচ্ছে তাঁর ও নিশ্চয়ই তেমনই লাগবে। তোমার তো আরও স্ট্রং হতে হবে তাইনা? ওর সামনে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে জানান দিতে হবে ওর জন্য তুমি ভেঙে পড়োনি, বরং ভালোবাসার জোরে আরও সাহসী হয়ে উঠেছো। আমার বিশ্বাস, তোমার হাসিমুখটাই ওর কাছে সবচেয়ে দামী। কী ঠিক বললাম তো?’
বেলা সম্পূর্ণ কথাটা মনোযোগের সহিত শুনলো। তারপর অসহায় কন্ঠে বলল, ‘আপনি বুঝতে পারছেন না ফুপি, আব্বু ফোন ধরছেন না। আমি কোথা থেকে খোঁজ নিবো ওনার? আমার শুধুমাত্র ওনার খোঁজ চাই যেকোনো মূল্যে।’
বলতে বলতে বেলা কেঁদে ফেললো৷ শাম্মী মাথায় হাত বুলিয়ে ওকে সান্ত্বনা দিতে লাগলেন। নাইমুদ্দীন সাহেবের ওপর রাগ উঠছে খুব। অবশ্য রাগ হওয়াটাই স্বাভাবিক। কোনো বুদ্ধিমান, বিবেকমান মানুষ কী এরকম কাজ করে? নাজনীন বেগমের মতো মহিলার কথা বিশ্বাস করে নিজের মেয়ের সংসার ভাঙতে উঠেপড়ে লাগে? নাইমুদ্দীন সাহেব এক্ষেত্রে বোকার পরিচয় দিয়েছেন। যদি শাইনির কিছু হয় তাহলে বাবাকে কোনোদিনও সে ক্ষমা করতে পারবে না।শাইনির জন্য চিন্তায় চিন্তায় মরে যাচ্ছে বেলা। হৃদযন্ত্র নামক অঙ্গটা রকেটের গতিতে ছুটে চলেছে। দ্রিমদ্রিম করে শব্দ তুলছে ছন্দের মতো। এভাবে মানুষ বাঁচতে পারে? একটুর জন্য হলেও শাইনির মুখটা না দেখলে বেলা বোধহয় মরেই যাবে! অবশ্য শাম্মীর কথাগুলোও ঠিক। বেলার এই অসুস্থ চেহারা নিয়ে শাইনির সামনে দাঁড়ালে ও ঠিকই কষ্ট পাবে। নিজেকে মনে মনে দোষী ভাববে। কী করবে বেলা এখন?
রাত বারোটা। প্রতিটি মিনিট, সেকেন্ড অস্থিরতায় কাটছে বেলার। শাম্মী ঘরে নেই। বেলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে শাইনির কথা ভাবছে। গাল বেয়ে পানি গড়াচ্ছে সেদিকে ওর খেয়াল নেই। তখনই পেছন থেকে একটা পুরুষালি কন্ঠ শোনা গেল, ‘আপনি ঠিক আছেন এখন?’
বেলা তাকিয়ে দেখলো লম্বাচওড়া একজন যুবক ওর বারান্দার দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। গায়ে ব্লেজার, মুখে ক্রুর হাসি। দৃষ্টি বেলার ওপর। এ আবার কে? বিরক্তি চেপে বেলা বিষন্ন গলায় বলল, ‘জি। আমি ঠিক আছি। আপনি কে?’
প্রশ্ন শুনে যুবকটি মাথা হেলিয়ে উত্তর দিল , ‘আমি আরাফাত। আপনার শাম্মী ফুপি, ওনি আমার আম্মু।’
বেলার তখন মনে পড়লো শাম্মীর ছেলের কথা, ‘আপনি ফুপির ছেলে?’
যুবকটি সহাস্যে উত্তর দিল, ‘জি।’
‘ওহ। আমি বেলা।’
‘জানি আমি।’
বেলা আরকিছু বললো না। ও এখন একা থাকতে চাইছে।
‘আপনি বোধহয় আমার সাথে পরিচিত হয়ে খুশি নন?’
বেলা লজ্জা পেয়ে বলল, ‘একদম না। আমি আসলে একটু একা থাকতে চাইছি!’
আরাফাত মাথা নাড়িয়ে হেসে বলল, ‘এজ ইউর উইশ। বাট আপনি এখন ঠিক আছেন তো? এই ক’দিন তো জ্ঞান ছিল না আপনার।’
বেলা বলল, ‘আমি ঠিক আছি।’
‘কোনো সমস্যা হলে আমাকে জানাবেন। জানেনই তো, উকিল আর ডাক্তারের কাছে কোনো কথা লুকোতে নেই।’
বেলা অবাক হয়ে বলল, ‘আপনি ডাক্তার?’
আরাফাত হেসে বলল, ‘জি মেম। আমি, আমার বাবা-মা, এককথায় আমাদের ফুল ফ্যামিলি ডাক্তার।’
ওহ।’
এমন সময় শাম্মী এলেন। আরাফাত হসপিটাল থেকে ফিরেছে মাত্র। বেলার সঙ্গে আরও একদফা আরাফাতকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে তিনি ওকে ফ্রেশ হয়ে নিতে বললেন। তারপর বেলাকে জোর করে টেনে নিয়ে গেলেন ডাইনিংয়ে। টেবিলে সাজানো ভাত, তরকারি দেখে বেলার মন বিষন্ন হয়ে পড়লো। শাইনির জন্য খুব যত্ন করে খাবার বানাতো৷ নিজহাতে খাইয়ে দিতো। পুরোটা সময় ওকে বিভিন্নভাবে জ্বালাতন করতো শাইনি। অথচ লোকটার কোনো খবর আজ ওর কাছে নেই। শাম্মী ওকে নিজের পাশে বসিয়ে খাইয়ে দিলেন। তখন অন্যপাশের চেয়ারে এসে বসলো আরাফাত৷ প্লেটে খাবার নিতে নিতে আড়চোখে বেলাকে লক্ষ্য করলো। বেলার বিষন্ন মুখ দেখে মুহূর্তেই মনটা খারাপ হয়ে গেলো। বেলা যখন জানবে ওর প্রিয় মানুষটাকে আর দেখতে পাবে কি-না, সেই সম্ভাবনা অনেক কম তখন ওর রিয়েকশন ঠিক কেমন হবে! মেয়েটা বোধহয় খুব কষ্ট পাবে। বেলা শাইনির জন্য কতোটা ভালোবাসা পুষে রেখেছে, সবটা শুনেছে সে আলম সাহেবের মুখ থেকে। এই ভালোবাসাকে মূল্য দিয়ে শাইনি সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনযাপনে আবার ফিরে আসতে পারবে কি-না জানে না আরাফাত। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ও খাবারে মনোযোগ দিলো।
খাওয়াদাওয়ার পর্ব শেষ করে আরাফাত ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলো ওর ঘরে। হঠাৎ দেখলো বেলা দরজায় দাঁড়িয়ে ইতস্তত করছে। আরাফাত বলল,
‘আপনি? দরজায় দাঁড়িয়ে কেন? আসুন ভেতরে আসুন..’
বেলা ঘরে ঢুকে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। আরাফাত সন্দিগ্ধ চোখে ওকে পরখ করে জিজ্ঞেস করলো, ‘কিছু প্রয়োজন?’
বেলা মাথা নাড়িয়ে বলল, ‘আপনার ফোন আছে? আসলে ফুপি ঘুমিয়ে পড়েছে তাই ওনার ফোনটা.. ‘
আরাফাত ফোন এগিয়ে দিতেই বেলা তড়িঘড়ি করে ফোনটা নিয়ে নিলো। তারপর একবার নাইমুদ্দীন সাহেবকে ফোন করলেন, বরাবরের মতোই তিনি ফোন ধরলেন না। উপায় না পেয়ে বেলা আলম সাহেবের নাম্বারে ডায়াল করলো, আর বেলাকে অবাক করে দিয়ে সেই ফোনটা নট রিচেবেল বললো। সীমা বেগমের নাম্বারে ফোন দিয়ে দেখলো সেটা বন্ধ। আসলে তিনি যখন প্রয়োজন হতো তখন বেলাকে কল করতেন, বাকিসময় ফোন বন্ধই থাকে। আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হলে নাইমুদ্দীন সাহেবর ফোন দিয়ে যোগাযোগ রক্ষা করেন। সবার ফোন একেএকে বন্ধ পেয়ে বেলার মন খারাপ দ্বিগুণ হলো। হচ্ছেটা কী ওর সাথে? বিরক্তি নিয়ে ফোনটা এগিয়ে দিলো আরাফাতের দিকে। তারপর বলল, ‘আর একটা হেল্প চাই আমার…’
আরাফাত ওর দিকেই তাকিয়ে ছিলো, ‘বলুন।’
‘আ আসলে আপনি তো ডাক্তার। আমার এই হেল্পটা করে দিন না প্লিজ..’
আরাফাত ওকে বসতে বলল। তারপর জিজ্ঞেস করলো, ‘কী হেল্প?’
‘আপনি একটু ইউনাইটেড হসপিটালে যোগাযোগ করে দেখুন না, আই সি ইউতে এডমিট শাইনি আলম এখন কেমন আছেন?’
আরাফাত বলল, ‘আপনি সত্যিই ওনার খোঁজ জানতে চান?’
বেলা অবাক হয়ে বলল, ‘আপনি জানেন?’
‘হুম। সবটাই তো শুনলাম আপনার শ্বশুর আর মামার কাছ থেকে।’
বেলা ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনি আঙ্কেলকে চিনেন? আর মামা কে?’
‘মামা মানে আপনার আব্বু। ওনিই তো আলম আঙ্কেলের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন।’
বেলা অবাক হয়ে বলল, ‘আব্বু? আব্বু পরিচয় করিয়ে দিয়েছে?’
‘হুম।’
বেলা এবার ব্যতিব্যস্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, ‘তাহলে প্লিজ একটা খবর এনে দিন না ওনার! আমি খুব কৃতজ্ঞ থাকবো আপনার কাছে..’
আরাফাত মুচকি হেসে বললো, ‘কৃতজ্ঞ থাকতে হবে না। আপনি নিজের যত্ন নিন। এতেই আমরা আপনার ওপর কৃতজ্ঞ থাকবো৷ এটলিস্ট আপনার আব্বুর কথাটা তো রাখতে পারবো।’
বেলা নিদারুণ অবাক গলায় বলল, ‘মানে?’
‘আপনার আব্বু আপনাকে আমাদের দায়িত্বে রেখে গেছেন। মেয়ের যাতে কোনো অযত্ন-অবহেলা না হয় সেজন্য বারবার রিকুয়েষ্ট করে গেছেন। আমার আম্মু তো অনেক অনুরোধ করে এখানে এনে রেখেছে আপনাকে।’
বেলা সন্দেহ নিয়ে বলল, ‘আব্বু কোথায়?’
আরাফাত দীর্ঘশ্বাস ফেলে উত্তর দিল, ‘তিনি দেশের বাইরে।’
বেলা যেন আকাশ থেকে পড়লো। একটু জোরেই চেঁচিয়ে বলল, ‘দেশের বাইরে? কেন?’
‘আপনার হাজব্যান্ডের সুচিকিৎসার জন্য গত পরশু আপনার আব্বু এবং শ্বশুর দেশের বাইরে রওয়ানা হয়েছেন!’
বেলা আহত স্বরে বলল, ‘কী বলছেন আপনি? ওনি ঠিক আছেন তো? এখন কেমন আছেন?’
আরাফাত বলল, ‘বাকি চিকিৎসাটুকু দেশের বাইরে করালে বোঝা যাবে৷ বাকিটা আল্লাহ তায়ালা ভালো জানেন।’
বেলা আর কোনো প্রশ্ন করলো না। নাইমুদ্দীন সাহেব শাইনির চিকিৎসার জন্য বাইরে গিয়েছে কথাটা কেমন স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছে। যাওয়ার সময় শাইনির সাথে দেখা হলো না বিষয়টা মানতে ওর কষ্ট হচ্ছে৷ আজ কতদিন সে শাইনিকে দেখেনা! পাঁচদিন…পাঁচটা দিনে কতকিছু পালটে গেলো! শাইনি কী সুস্থ হয়ে ফিরতে পারবে? নাকি বেলা আর ওকে দেখতে পাবেনা? ভয়ে কেঁপে উঠলো মন। ধীরপায়ে নিজের জন্য বরাদ্দ ঘরটায় গিয়ে দরজা আটকে দিলো..দীর্ঘ অপেক্ষা যেন করছে শাইনির জন্য! কিন্তু আলম সাহেব কেন ওকে জানালো না? নাকি এখানে কোনো গন্ডগোল আছে? আ আর..সীমা বেগম কোথায়? নাইমুদ্দীন সাহেব যদি ওকে এখানে রেখেই যান তাহলে তো সীমা বেগমের থাকার কথা। বেলা ভারাক্রান্ত মন নিয়ে একটি নির্ঘুম রাত পার করে দেয়।
চলবে…ইনশাআল্লাহ!
#শ্রাবণ_তোমার_আকাশে
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব___২৬
সকাল দশটার দিকে হঠাৎ সীমা বেগম এসে হাজির শাম্মীর বাসায়। আরাফাত তখন ব্রেকফাস্ট সেরে ডিউটিতে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছিলো। বেলা মন খারাপ নিয়ে ঘরে বসেছিলো। সীমা বেগমকে বাসায় আসতে দেখে শাম্মী খুব খুশি হলো। কত বছর পর দেখা!
‘ভাবি কেমন আছেন?’
সীমা বেগম নিরুত্তাপ গলায় বললেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ আছি কোনোরকমে। তোমরা কেমন আছো?’
‘আলহামদুলিল্লাহ!’
সীমা ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বেলা নাকি তোমাদের বাসায়?’
আরাফাত হসপিটালের ডিউটিতে যাওয়ার জন্য বের হচ্ছিলো। কথাটা শুনে সে এগিয়ে এসে পরিচিত হলো সীমা বেগমের সাথে। তারপর বলল, ‘বেলা। মানে আপনার মেয়ে আমাদেরই বাসায় আছে মামানি। ওনি অসুস্থ ছিলেন, এখন ঠিক আছেন।’
সীমা বেগম উদ্বিগ্ন স্বরে বললেন, ‘অসুস্থ ছিল? আমাকে জানাওনি কেন তোমরা?’
শাম্মী উত্তর দিল, ‘ভাই না করেছিলো। আপনি না-কি অসুস্থ। চিন্তা করবেন তাই আর জানাইনি।’
সীমা বেগম অপ্রসন্ন গলায় বললেন, ‘লোকটাকে নিয়ে আর পারা যায় না। তাঁর অদ্ভুত কান্ডকীর্তিতে দেখবে একদিন হার্ট অ্যাটাক করে মরে যাবো।’
আরাফাত অপ্রশস্ত হাসলো। অতঃপর বলল, ‘মামানি আপনি থাকবেন আমাদের বাসায়। মামার সাথে যোগাযোগ হলে বলে দিব। তাছাড়া আপনারা মা-মেয়ে দুজনেই তো অসুস্থ। এত কেন টেনশন করেন আপনারা, বুঝিনা। জীবনে যা,ঘটার ঘটবেই, দুশ্চিন্তা না করে বিষয়টাকে কীভাবে সামলানো যায় সেটা নিয়ে চিন্তা করা উচিৎ আমাদের।’
সীমা বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘টেনশন কি আর বলে কয়ে আসে? এমনিতেই হয়ে যায়। আর দেখো, তোমার মামা যেসব কান্ড করছে এতে কি টেনশন না করে থাকা যায়? এই লোক পাগল করে দিবে আমাদের। কোনো খবর না দিয়ে সে দেশের বাইরে গেছে, আর এই খবর আজকে সকালে আমাকে জানালো। ভাবো, এই লোকের কাজটা কি ঠিক? অনন্ত জানিয়ে তো যাবে!’
আরাফাত বলল, ‘তাও ঠিক।’
শাম্মী বলল, ‘ভাই হলো জেদি লোক।’
‘আমার ডিউটির দেরি হয়ে যাচ্ছে মামানি। আপনি কিন্তু এখানেই থাকবেন। আম্মু আসছি আমি।’ আরাফাত বলল।
আরাফাত যাওয়ার পরে সীমা বেগম শাম্মীকে অনুরোধের স্বরে বলল, ‘বেলা কোথায়? একটু ডেকে দাও না। কতদিন দেখি না মেয়েটাকে!’
‘হ্যাঁ অবশ্যই!’
বেলা একা ঘরে বসে থাকতে থাকতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল বুঝতেই পারেনি। শাম্মীর মিহি কন্ঠের ডাকে ওর ঘুম ভাঙে। একরাশ বিরক্তি নিয়ে ধীরপায়ে হেঁটে ড্রইংরুমে আসতেই সোফায় বসে থাকা সীমা বেগমকে দেখে খুব অবাক হলো। সীমা বেগমের চোখের কোন ভরে উঠলো জলকণায়। আলতো হাতে তিনি তা মুছে নেন। ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসির রেখা একে মেয়ের দিকে তাকান। আর নাইমুদ্দীন সাহেব কবে থেকে এতো লুকোচুরি শিখে গেল? ওনি যে বেলার মা তা কি ভুলে গেলো লোকটা, যে অন্যের বাসায় ওকে রেখে গেলো? মেয়ের সাথে সীমা বেগমের দেখা হলো অনেকগুলো মাস পড়ে। সামনাসামনি দেখে সীমা বেগম দমে গেলেন। একী হাল হয়েছে তাঁর মেয়েটার? মলিন চেহারা, চোখের নিচে কালি, শরীর ভেঙে গেছে। হাসি নেই ঠোঁটের কোণে। অসুস্থ চেহারাটা অবলোকন করে সীমা বেগম বেলাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেন। বেলা মাকে শান্ত করে সপ্রতিভ কন্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘আম্মু তুমি এখানে? ফোন কোথায় তোমার? কাল রাতে কতগুলো ফোন দিলাম, ধরলে না যে!’
সীমা বেগম শাড়ির আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে বললেন, ‘ফোন বন্ধ ছিলো। সকালে উঠেই দেখেছি এতগুলো ফোন। নাম্বার চিনি না তাই আর ফিরতি কল করিনি।’
‘ওহ!’
‘তোর আব্বু যে দেশের বাইরে গিয়েছে জানিস?’
‘হুম। শুনলামই তো কাল।’
সীমা বেগম বললেন, ‘তোর আব্বু এটা কোনো কাজ করেছে? এতকিছু ঘটে গেলো আর আমাকে একটা কথা পর্যন্ত বলে নাই। এখন হুট করে বলে সে নাকি দেশের বাইরে। তাও আবার শাইনির চিকিৎসার জন্য!’
বেলা অবাক হয়ে বলল, ‘মানে? আব্বু তোমাকেও বলে যায়নি? তুমি কোথায় ছিলে?’
সীমা বেগম হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘আমি তোর মামার বাড়ি গিয়েছিলাম।’
‘মামার বাড়ি? কেন?’
‘তোর আব্বুর সাথে ঝগড়া হয়েছিল না সেদিন? এরপর প্রেসার ফল করলো রাতেরবেলা। পরদিন রাগ করে বাড়ি চলে যাই৷ তোর আব্বু আমাকে একটা ফোন অবধি করেনি। কিছু জানায়নি!’
‘আমি যে এখানে জানলে কীভাবে?’
‘তোর আব্বু আজ সকালে বড়ভাইয়ের ফোনে ফোন করে সব বলে আমাকে। আমি তো অবাক! শাইনিকে সে মেনে নিয়েছে। প্রতি লাইনে তিনবার করে ওর সুস্থতা কামনা করেছে। হঠাৎ করে তাঁর এতটা পরিবর্তন হলো বুঝলাম না!’
বেলা বিস্মিত হয়ে বলল, ‘সত্যিই?’
‘তা নয়তো কি! আমার তো প্রথমে বিশ্বাসই হচ্ছিলো না। পরে ভিডিয়ো কলে দেখলাম। আলম ভাইও সাথে ছিলেন। ওনার সঙ্গেও কথাবার্তা হলো দীর্ঘক্ষণ।’
বেলা ঢোক গিলে অসহায় কন্ঠে মা’কে জিজ্ঞেস করলো, ‘আ আর ওনি? ওনার খোঁজ নাওনি? কেমন আছেন ওনি আম্মু?’
সীমা বেগম মেয়ের মনোভাব বুঝতে পেরে মুচকি হাসলেন। তারপর ধীর গলায় বললেন, ‘ শাইনি তখন বেডে শুয়ে ঘুমাচ্ছিলো। কথা হয়নি ওর সাথে!’
বেলা কম্পিত কণ্ঠে বলল, ‘ভালো আছে তো?’
‘বলেনি আমায়। তৃতীয় থেরাপি দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে শুনলাম।’
বেলা ক্রন্দনরত কন্ঠে বলল, ‘আমাকে নিয়ে গেলে কি হতো!’
মা-মেয়ের কথা এতক্ষণ মনোযোগী শ্রোতার মতো শুনছিলেন শাম্মী। এবার ওদের কথার মাঝখানে শাম্মী বলে উঠলো, ‘নিজের যা হাল করেছো তারপরে ভাই তোমাকে আর নিয়ে যাওয়ার সাহস পায়নি। স্বামীর কষ্ট নিজের চোখের সামনে দেখে সহ্য করতে পারতে না! প্রথম থেরাপির এফেক্টেই নাওয়াখাওয়া ভুলে অজ্ঞান। বাকিগুলোর সময় কি হবে তা চিন্তা করেই ওরা আর সঙ্গে নেয়নি তোমাকে। আমিই বারণ করলাম। আরাফাতের আব্বুও এটাই বললো। একা মেয়েমানুষ, সেখানে অসুস্থ হলে খেয়াল রাখবে কে! তোমাকে সামলাবে না তোমার হাজব্যান্ডকে!’
সীমা বেগম মাথা নাড়িয়ে সায় জানালেন, ‘হুম। সবদিক বিবেচনা করেই তোর আব্বু আর নিয়ে যায়নি তোকে।’
কথাগুলো শুনে বেলার মন থেকে বড় একটা পাথর নেমে গেলো বলে মনে হলো। যাক, শাইনির বিষয়ে কিছু তো তথ্য,জানতে পেরেছে, এটাই বা কম কীসের! এবার অপেক্ষা করার পালা। কিন্তু এখনো মনের ভেতর দুটো প্রশ্ন উঁকি মারছে। এক.নাজনীন বেগম কোথায়? কী অবস্থা তার? বেলা যে এত অসুস্থ ওনি তো একবারও খোঁজটোজ নিলেন না, নাকি নিয়েছেন? দুই.নাইমুদ্দীন সাহেব হঠাৎই শাইনিকে মেনে নিলেন কেন? চিকিৎসার জন্য বাইরে অবধি নিয়ে গেছেন, কিন্তু কেন? যে লোকটাকে ওনি পছন্দই করেন না…
মনের ভেতর প্রশ্নগুলো চেপে রেখে মায়ের সঙ্গে আরও কথাবার্তা বললো বেলা। শাম্মী দুপুরের রান্নার আয়োজন নিয়ে ব্যস্ত। সীমা বেগম বেলাকে নিয়ে এখানেই থাকবেন ক’টা দিন। দুজনের শরীর-মনের অবস্থা ভালো নয়। তাছাড়া এখানে থাকলে আরাফাতের কাছ থেকে শাইনির বিষয়ে আপডেট জানা যাবে৷ এজন্যই থাকা। এভাবেই বেশকিছু দিন কেটে গেলো। মা-মেয়ে দুজনেই শাম্মীর বাসায় থাকে। শাম্মীর বর কয়েকদিনের জন্য কানাডা গেছে বলে, বেলাদেরকে বাসায় ফিরতে দিলেন না তিনি। বেলার মনটা সারাক্ষণ শাইনির চিন্তায় মগ্ন হয়ে থাকলেও কেউ ওকে ফোন করে শাইনির খবর দেয় না।আরাফাতের কাছে ফোন দিয়ে সবকিছু বলে, বেলাকে ওর কাছ থেকেই জেনে নিতে হয়৷ যার ফলে
আরাফাতের সঙ্গে বেলার বেশ ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেলো। অবশ্য বেলা আজকাল বেশ চুপ হয়ে গেছে। শাইনির বিরহে প্রতিটি ক্ষণ বিষের চেয়েও বিষাক্ত মনে হয়। দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে হৃদযন্ত্রে অদ্ভুত তোলপাড় শুরু হলেও দেখার কেউ নেই। দীর্ঘ অপেক্ষার প্রহর কাটিয়ে যেদিন শাইনি ফিরবে, সেদিন আচ্ছামত ওর বুক জাপটে পড়ে থাকবে বেলা। কোনোদিন আর ছাড়বে না। চোখের জল ফেলা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই ওর৷ বাবা নামক ব্যক্তিটাও ওকে বুঝলো না। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে বুকের গভীর থেকে।
মাস তিনেক পেরিয়ে গেছে৷ সেদিন এক বৃষ্টিস্নাত সতেজ গোধূলি বিকেল। মন মাতানো রিমঝিম বৃষ্টি নেমেছে বিকেলের প্রথম প্রহরে। তিনতলা বারান্দার ওপর রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি শেষে প্রকৃতির অদ্ভুত সতেজতা মুগ্ধ চোখে দর্শন করছে বেলা। সদ্য বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে পরিষ্কার হয়ে যাওয়া পিচঢালা কালো রাস্তাটা চকচক করছে অবিরাম। কৃষ্ণচূড়া গাছের পাতার গা ছুঁয়ে ছুঁয়ে শিশিরকণার ন্যায় টুপটাপ ঝরছে বর্ষণের একছাঁট শীতল বৃষ্টি। মন জুড়িয়ে যায় প্রতি মুহূর্তে। বেলার হাতে থাকা সীমা বেগমের ফোনটা করুণ এক সুরে বেজে ওঠলো। বেলা বাইরে থেকে দৃষ্টি নামিয়ে ফোনের দিকে তাকালো। ফোনটা সারাক্ষণই ওর কাছেই থাকে। বড্ড আশা তাঁর, যদি কোনোদিন বেলার বাবা ফোন করে, তাহলে শাইনির খোঁজটা ওনার কাছ থেকে নিয়েই ছাড়বে! কিন্তু সেই আকাঙ্ক্ষিত ফোন কলটি আর আসে না। বাবা ফোন দেয় না। সেজন্য পাহাড়সম একরাশ অভিমান জমেছে বেলার কোমল মনে। কিন্তু এতদিন পর হঠাৎ আননোন নাম্বার থেকে ফোন দেখে বেলা খানিকটা অবাকই হলো বটে। কম্পিত হাত বাড়িয়ে ফোনটা রিসিভ করে কানে ঠেকালো, ‘আসসালামু আলাইকুম.. ক কে বলছেন?’
‘ক কেমন আছো ব বেলা ববউউউউ..?’
বেলা কথাটুকু শ্রবণ করেই হাউমাউ করে কেঁদে ওঠলো। ওপাশের ব্যক্তিটির অসুস্থ কন্ঠ ওর বুকে তীরবিদ্ধের মতো আঘাত হানছে৷ বেলা ফুঁপিয়ে ওঠে জিজ্ঞেস করলো, ‘আ আপনি ক কেমন আছেন?’
ওপাশ থেকে উত্তর এলো, ‘ভ ভালো নেই আমি। তোমাকে ছাড়া এখা…’
তারপর আর কথা এলো না৷ কেউ যেন ফোন নিয়ে নিয়েছে জোর করে। অতঃপর লাইনটি কেটে গেলো। পরবর্তীতে বেলা ট্রাই করলেও কল বারবার কেটে গেলো। সেদিন পুরোদিন ঘরের দরজা বন্ধ করে কাঁদলো বেলা। রাতে খেলোও না৷ শাইনি ভালো নেই একথা শোনার পর ওর গলা দিয়ে কী আর খাবার নামবে? কখন শাইনিকে পুরোপুরি সুস্থভাবে নিজের চোখের সামনে দেখতে পারবে? আর কতদিন অপেক্ষা করবে বেলা?
চলবে…ইনশাআল্লাহ!