শ্রাবণ_তোমার_আকাশে,২৭,২৮

0
1539

শ্রাবণ_তোমার_আকাশে,২৭,২৮
লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
পর্ব___২৭

অনেকগুলো দিন শাম্মীদের বাসায় কাটানোর পর ওরা নিজেদের বাসায় ফিরে যায়। তবে আরাফাতের সাথে বেশ ভালো বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে বেলার। ওদের বাসায় বাজারসদাই করে দেওয়া বা প্রয়োজনীয় কাজগুলোও আগ্রহের সাথে করে দেয় আরাফাত। ওর মনটা আসলেই খুব ভালো। একদিন সীমা বেগম ওকে দাওয়াত করেও খাওয়ান। দীর্ঘকাল বিদেশে শাইনির চিকিৎসা চলছে। এর মধ্যে নাইমুদ্দীন সাহেবের কিছু পরিবর্তন হয়েছে।

আজকাল দেশে নিজের স্ত্রী-মেয়ের কাছে নাইমুদ্দীন সাহেব ফোন করেন। বেলা কোনোদিন কথা বলে, কোনোদিন বলে না। পরে সীমা বেগমের কাছ থেকে খোঁজ নিয়ে নেয়। শাইনির সঙ্গে প্রথম যেদিন কয়েক সেকেন্ড ওর কথা হয়েছিল, তারপর আর কথাই হয়নি বেলার। সেদিন শাইনি সবেমাত্র থেরাপির ধকল কাটিয়ে উঠেছে, কারোর কথা না মেনে অবুঝের মতো বেলাকে ফোন করে বসে। লুকিয়ে ফোন করলেও তা দেখে ফেলে সেখানকার একজন দায়িত্বশীল ডাক্তার। অতঃপর শাইনির কাছ থেকে ফোনটা তিনি কেড়ে নেন। এই খবরটা নাইমুদ্দীন সাহেব নিজে থেকে ফোন করে জানান বাসায়। সেদিন বেলার সাথে দীর্ঘক্ষণ তিনি কথা বলেন। নিজের ভুলগুলো স্বীকারও করেন। আসলে নাজনীন বেগম যে শাইনির গর্ভধারিণী মা নয় সেটা তিনি জানতেন না। নাজনীন বেগম শাইনির নামে অনেক বাজে কথা বানিয়ে বানিয়ে বলেন নাইমুদ্দীনকে। যার ফলে রাগতে বাধ্য হন শাইনির ওপর। কোনো মা তো আর এমনি এমনিই তাঁর ছেলের সম্বন্ধে মন্দ কথা বলবেন না! এসবকিছু ভেবেই বেলাকে শাইনির কাছ থেকে দূরে সরাতে চেয়েছিলেন নাইমুদ্দীন। এতটুকু কথাই বেলাকে জানান নাইমুদ্দীন।

আর নাজনীন বেগমের ঘটনা শোনার পর বেলার মনে হলো, ওর মনের ভেতর থেকে একটা পাথর নেমে গেল। যাক, বাবা অন্তত সত্যিটা জানে। এবার সে নিশ্চিত। পুরো ঘটনাটা সীমা বেগমকে জানান নাইমুদ্দীন। পরে বেলা ওর মায়ের কাছ থেকে ঘটনাটি শোনে। ঘটনাটা ছিলো এরকম, বেলা সেদিন হাসপাতালে অজ্ঞান হওয়ার পর আলম সাহেব খুব ঘাবড়ে গেলেন। একদিকে ছেলের কন্ডিশন ভালো না, অন্যদিকে বেলার অসুস্থতা। সেই কঠিন সময়টাতে পাশে থাকার মতো কেউ ছিলো না ওনার৷ নাজনীন বেগম জিদের চোটে বেলার মুখদর্শনও কর‍তে চাননি। সেই রাতে আলম সাহেবকে দোটানায় ফেলে তিনি নিজের ভাইয়ের বাসায় ফিরে যান। একা একা আলম সাহেব খুব ভেঙ্গে পড়েন। বেলাকে এডমিট করা হয় হাসপাতালে। তখন আলম সাহেব সাত-পাঁচ কিছু না ভেবে ফোন করেন নাইমুদ্দীন সাহেবকে। মেয়ের অসুস্থতার খবর শুনে রাতেরবেলা ছুটে আসেন নাইমুদ্দীন। আলম সাহেব ভরসা পান। বেলার চিকিৎসার ব্যবস্থা করার পর সময় সুযোগ বুঝে ওনি নাইমুদ্দীনের কাছে সবকিছু খুলে বলেন এবং তাঁর ভুল ভাঙান। নাজনীন বেগমের সব সত্যি তিনি বলে দেন। প্রথমে বিশ্বাস কর‍তে না চাইলেও পরবর্তীতে নাজনীন বেগমের কটু এবং উদ্ভট ব্যবহার দেখে নাইমুদ্দীন যা বোঝার বুঝে নেন৷ নাজনীন বেগমের সন্দেহজনক আচরণ তাঁকে সব সত্য বিশ্বাস করাতে বাধ্য করে।

বেলার সেদিন বাবার প্রতি বড্ড অভিমান জমলেও, পরে বুঝতে পারে আসলে নাজনীন বেগম যেভাবে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে, তার বিপরীতে ওনাকে খারাপ মানুষ ভাবাটা খুব কঠিন। অতি সহজেই তিনি তার ভালোমানুষি ব্যবহার দিয়ে অন্যকে নিজের অধীন করে নিতে পারেন। নাইমুদ্দীন সাহেবের ভুল হওয়াটাও অস্বাভাবিক কিছু নয়।

আলম সাহেব নাজনীন বেগমের নামে অর্ধেক সম্পত্তি লিখে দেন। বিনিময়ে তিনি শীলাকে নিজের কাছে রেখে দেন। অর্থলোভী মায়ের কাছে শীলাও থাকতে রাজি হয়নি। ওর মা যে শাইনির আসল মা নয়, এটা জানতে পেরে শীলা খুব কষ্ট পেয়েছিল। টাকাপয়সা, সম্পত্তি দিয়ে ও কী করবে? বাবা তো দিচ্ছিলোই সবকিছু। তবুও মায়ের এমন ছোটলোকি আচরণ ওর ষোড়শী মনটা মেনে নিতে চাইলো না। এজন্যই নাজনীন সবসময় শাইনির নামে খারাপ খারাপ কথা বলতো, ওকে তেমন মিশতে দিতে চাইতো না। নিজের মায়ের প্রতি শীলার বড্ড ক্ষোভ জন্মে। সেজন্য মায়ের কাছ থেকে সে বেলাদের বাসায় চলে আসে এবং এখানেই থাকে, যেহেতু আলম সাহেব দেশে নেই।
নাজনীন বেগম সম্পত্তি পেয়ে খুশি হলেও শীলার এহেন আচরণে স্তব্ধ হয়ে যান। যে মেয়ের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তিনি এসব করলেন, সে-ই আজ ওনাকে একা রেখে চলে গেলো? ওর জন্যই সবার কাছে খারাপ হলো আর ও নিজে মাকে এতটা ঘৃণা করে? তাহলে এত টাকাপয়সা দিয়ে এখন কী করবেন ওনি? ভাইয়ের বাসায় থেকে চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়েন তিনি। এখন ফিরে যাওয়ারও আর উপায় নেই৷ কারণ আলম সাহেব স্পষ্ট বলে দিয়েছেন, ওনার বাড়িতে এই মহিলার আর কোনো স্থান নেই৷ বাকিটা যা করার দেশে এসে সিদ্ধান্ত নেবেন তিনি।

বাবার সাথে সম্পর্কের সবকিছু মিটমাট হয়ে গেলে, আগের মতোই বাবার সাথে সহজ-স্বাভাবিক হয়ে পড়ে বেলা। আলম সাহেবও ফোন করে বেলার খোঁজখবর নিতো৷ শাইনির অবস্থা তখন একটু ভালোর দিকে। কিন্তু দুজনের কথা হতো না। বেলা তৃষ্ণার্ত কাকের মতো অনুরোধ করতো আলম সাহেবকে, শাইনি যেন ওর সাথে কথা বলে। কিন্তু শাইনি ইচ্ছাকৃতভাবে বেলার সাথে কথা বলতো না। দিনদিন এটা কমতে কমতে এমন একটা পর্যায়ে এলো যে, শাইনি ওর সাথে আর কথাই বলতে চায় না। তখন বেলা মনে মনে খুব কষ্ট পায়। এরপর অভিমান করে নিজের কাছে নিজেই প্রতিজ্ঞা করে যে, শাইনির সাথে ও কথাই বলবে না। মরে গেলেও না৷ থাকুক নির্দয় লোকটা নিজের মতো। ওর কোনো প্রয়োজন নেই। চাপা অভিমানে বেলা ভেতরে ভেতরে গুমড়ে মরলেও সেটা প্রকাশ করে না সে।

কেটে গেছে আরও কিছু মাস। বছর ঘুরে আরও একটি নতুন বছরে পদার্পণ করেছে। দেশে ফিরেছেন নাইমুদ্দীন। শাইনির থেরাপি নেওয়া শেষ। তবুও কিছু চিকিৎসা বাকি। অনেকগুলো দিন নিজের পরিবার থেকে দূরে ছিলো বলে সবার আগে তিনি দেশে ফিরে আসেন। আর শাইনির সাথে রয়ে গেছে আলম সাহেব।
প্রিয় মানুষটি যখন কাছে থাকে না, তখনকার সময়টা যে কতটা কষ্টের সহিত কাটাতে হয় তা বেশ ভালোভাবেই উপলব্ধি করতে পারছে বেলা। ওর দিন যায়, রাত ফুরুয় কিছুই ভালো লাগে না। সবকিছুতে শূন্যতা অনুভূত হয়।

গ্রীষ্মের এক রুক্ষ বিকেল। কাঠফাটা রোদ্দুরে ঘিরে আছে পুরো শহর। সূর্য তির্যকভাবে রোদ ফেলছিলো শহরের অলিগলিতে। চিকচিক করে এক মুঠো রোদ এসে পড়ছিলো বেলার অগোছালো ঘরের বারান্দায়। দুপুরের খাবার না খেয়ে দরজা বন্ধ করে বেশ কিছুসময় গুম মেরে বসে থাকলো বেলা। নাইমুদ্দীন ফেরার পর আলম সাহেব কয়েকবার ফোন করে ওর খোঁজ নিলেও, শাইনি একটা মুহূর্তের জন্য ওর কাছে ফোন করেনি। না ওর কোনো খোঁজ জানে। সবকিছু এমন এলোমেলো হয়ে গেলো কেন বেলা বুঝতে পারে না। যে লোকটা নিজের থেকে ওকে এক সেকেন্ডের জন্য দূরে রাখতে চাইতো না, সে এতগুলো মাস ধরে ওর থেকে যোজন যোজন মাইল দূরে। না দিচ্ছে নিজের খোঁজ, না নিচ্ছে বেলার খোঁজ। আচ্ছা, ওখানে কোনো সুন্দরী মেয়েকে দেখে শাইনি আবার ওকে ভুলে যায়নি তো? হতেই পারে। অস্বাভাবিক কিছু না। কিন্তু বেলা! ওর কথা কি শাইনির একটুও মনে নেই? এত কষ্ট কেন দিচ্ছে ওকে? সবাইকে ওর খোঁজ না দেওয়ার জন্য বলে রেখেছে। এত নির্দয়, পাষাণ কেউ হতে পারে? ওর কি কষ্ট হয় না? এসব ভেবে সারা দুপুর কান্নাকাটি করে কাটিয়েছে বেলা। অপেক্ষা জিনিসটা অনেক নিষ্ঠুর এবং হৃদয়বিদায়ক জিনিস৷ আর পারছে না ও সহ্য করতে। ওর মুঠোফোনটা রাখা ছিল বিছানার ওপর। ভাইব্রেশন মুড অন করা অবস্থায় ফোনটা বিছানা কাঁপিয়ে বেজে ওঠলো। বেলা বিরক্ত নয়নে ফোনটা দিকে তাকালো। ইচ্ছা করলো ফোনটাকে দু-টুকরো করার। যে ফোনে শাইনি ফোন করে না সেই ফোন রেখে লাভ কী? স্ক্রিনে না তাকিয়ে ফোন রিসিভ করে জিজ্ঞেস করলো, ‘আসসালামু আলাইকুম।’

‘বেলা বউ?’

শাইনির শান্ত গলার প্রশ্ন। বেলা লাফ দিয়ে বিছানায় ওঠে বসলো। এটা সত্যিই শাইনি? কোনো স্বপ্ন দেখছে না তো ও? দু-চোখ জলে ভিহে ওঠলো। রুক্ষ দুপুরের সোনালি সূর্যকে লুকিয়ে দিয়ে আকাশ শ্রাবণের সাদামেঘেদের নিয়ে উড়ে বেড়াতে লাগলো যেন।
বেলার মনের ভেতর হঠাৎ যেন প্রশান্তির বাতাস বয়ে গেল। কি আশ্চর্য, আজকের দুপুরটা এতো সুন্দর কেন? নির্মল হাওয়ায় যেন শত শত রঙিন প্রজাপতি ডানা মেলে উড়ে যাচ্ছে। ঘোর থেকে বেরিয়ে সে জবাব দেয়, ‘ককেমন আছেন আ আপনি?’

‘কেমন আছে আমার বেলা বউ?’

বেলা অদ্ভুত কন্ঠে বললো, ‘ভালো আছি আমি। আপনি?’

শাইনি মুচকি হেসে বললো, ‘অলওয়েজ ভালো। কী করছো এখন?’

বেলা মিথ্যে বলল, ‘খাওয়াদাওয়া সারলাম। আপনি খেয়েছেন?’

শাইনি বলল, ‘সত্যি?’

বেলা কান্নাভাবটা আটকে বলল, ‘হুম। আমি ভালো আছি আর খেয়েছিও। আমি ঠিক আছি। সব ঠিক আছে।’

‘আমি এতকিছু জিজ্ঞেস করিনি। মন কোথায় থাকে তোমার? এত অন্যমনস্ক মনে হচ্ছে কেন?’

বেলা অপ্রস্তুত গলায় বলল, ‘অন্যমনস্ক না তো!’

শাইনি কঠিন সুরে জিজ্ঞেস করে, ‘সত্যিই সব ঠিক আছে?’

বেলা চুপ হয়ে গেলো। এই প্রশ্নের মিথ্যে উত্তর দেওয়া ওর পক্ষে সম্ভব নয়। আর ও তো প্রতিজ্ঞা করেছিল শাইনির সাথে কথা বলবে না৷ তাহলে বলছে কেন? ভালোবাসার মানুষের ওপর যে রাগ পুষে রাখা যায় না মুহূর্তেই বুঝে গেলো সেটা। বেলা উদাস কন্ঠে বলতে নেয়, ‘আ আসলে…মন…’

শাইনি ওকে থামিয়ে দেয়। বলে, ‘তাঁর উদাস কন্ঠটা বলে দেয়, সে দূরে থাকলেও তাঁর মন পড়ে আছে ওই একটি বেপরোয়া লোকের কাছে, যে মৃত্যুর আগেও ছাড়তে চায়না তাঁকে।’

বড্ড অগোছালো পর্ব। শব্দচয়ন, বাক্যগঠন ভালো হয়নি। তাড়াহুড়ো করে লিখেই দিয়ে দিলাম। ভুলভ্রান্তি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

চলবে…ইনশাআল্লাহ!

#শ্রাবণ_তোমার_আকাশে
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব___২৮

শাইনি কঠিন সুরে জিজ্ঞেস করে, ‘সত্যিই সব ঠিক আছে?’

বেলা চুপ হয়ে গেলো। এই প্রশ্নের মিথ্যে উত্তর দেওয়া ওর পক্ষে সম্ভব নয়। আর ও তো প্রতিজ্ঞা করেছিল শাইনির সাথে কথা বলবে না৷ তাহলে বলছে কেন? ভালোবাসার মানুষের ওপর যে রাগ পুষে রাখা যায় না মুহূর্তেই বুঝে গেলো সেটা। বেলা উদাস কন্ঠে বলতে নেয়, ‘আ আসলে…মন…’

শাইনি ওকে থামিয়ে দেয়। বলে, ‘তাঁর উদাস কন্ঠটা বলে দেয়, সে দূরে থাকলেও তাঁর মন পড়ে আছে ওই একটি বেপরোয়া লোকের কাছে, যে মৃত্যুর আগেও ছাড়তে চায়না তাঁকে।’

বেলা ধরা গলায় জিজ্ঞেস করে, ‘ঘা গুলো শুকিয়েছে আপনার? কষ্ট হয় না তো? ব্যথা হয় শরীরে? ভালো আছেন?’

‘হ্যাঁ, শুকিয়েছে। ব্যথা হয় বুকে। যতটা থাকা যায়, পারা যায় ততোটাই ভালো আছি আমি!’

এ পর্যায়ে বেলা আর কান্না আটকাতে পারলো না। হু হু করে কেঁদে ফেললো। ওপাশ থেকে শাইনি চুপ করে শুনলো, কাঁদুক মেয়েটা। কত কষ্টই না দিয়েছে এতদিন৷ দেখা হয় না প্রায় এগারো মাস যাবৎ। ফোনে কথা অবধি বলেনি। ইন্টারনেটের এই আধুনিক যুগে ভিডিয়ো কল দেওয়ার মতো সহজ পদ্ধতি থাকা স্বত্তেও নিজেকে দেখায়নি শাইনি। চেহারার যা বিশ্রি অবস্থা হয়েছিল, মাথায় চুল ছিলো না, ফর্সা মুখে কালচে দাগছোপ পড়ে ভয়ানক অবস্থা হয়েছিল ওর। কড়া ডোজের এন্টিবায়োটিক ঔষধ ওকে কাহিল করে দিয়েছিলো। ওকে এভাবে দেখলে বেলা খুব কষ্ট পেতো, তাই নিজের কষ্ট হলেও বেলার মুখোমুখি হওয়ার সাহস করেনি। মেয়েটা বড্ড ইমোশনাল। দেখা যাবে, ওর এই অবস্থা দেখার পর দুশ্চিন্তা করে মরবে। অবশ্য শাইনির নিজেরও কম কষ্ট হয়নি। সেই দুঃখগুলো বুকে চাপা দিয়ে রেখেই বাবার কথামতো সে চলেছে। দীর্ঘ এই পথযাত্রার সঙ্গী হয়ে অবশেষে নিজের শরীর থেকে ক্যান্সার নামক ভয়াবহ রোগটিকে বিতাড়িত করতে পেরেছে। মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে অবলোকন করে অবশেষে সে জয়ী হতে পেরেছে। এর পেছনে অবশ্যই বেলার ভালোবাসা এবং বাবা-র দোয়া রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা ওর মনোবাসনা পূরণ করেছেন। ওর বেলা বউয়ের সঙ্গে আরও কয়েকটি বছর বেঁচে থাকার সুযোগ করে দিয়েছেন। এ সুযোগের হাতছাড়া করবে কেন ও?

‘কান্না করে মন হালকা হয়েছে?’

‘আপনি নিষ্ঠুর।’

‘বউকে খুব ভালোবাসি।’

‘ভালোবাসলে এত কষ্ট দিতেন না৷’

শাইনি জিজ্ঞেস করলো, ‘কী করেছি আমি?’

বেলা জীর্ণ গলায় আড়ষ্ট কন্ঠে বলল, ‘জানেন না? ওহ, আমাকে তো ভুলেই গেছেন এখন! আমি আর কে?’

শাইনি হাসি চাপিয়ে বলল, ‘আসলেই তো! কে তুমি রমণী, হৃদয়হরণী?’

বেলা বলল, ‘আচ্ছা আ.. আপনি কী ওখানে কোনো সাদা চামড়ার মেয়েকে দেখে প্রেমে পড়ে গেছেন?’

শাইনি ভ্রু কুঁচকে তীক্ষ্ণ কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, ‘কেন বলো তো?’

বেলা বলল, ‘তাহলে আমাকে দেখা দেন না কেন আপনি?’

‘দূরে আছি তাই।’

‘ভিডিয়ো কলে আসুন না, দেখি আপনাকে। আপনার বুঝি আমাকে দেখতে ইচ্ছে করে না? কতদিন দেখিনা আপনাকে!’

শাইনি দৃঢ় কন্ঠে জবাব দিল, ‘না।’

বেলা আহত হলো, ‘কেন?’

‘ওটা উহ্য থাকুক।’

বেলা মন খারাপ করে ফেললো, ‘বউ তো পুরাতন হয়ে গেছি৷ এবার আপনি নতুন কাউকে জুটিয়ে নিন। আমি বাঁধা দেব না।’

শাইনি ম্লান হেসে বলল, ‘তোমার বাঁধা মানছেই বা কে? আমার বউকে আমি জুটিয়ে নেব, তাতে কার কী সমস্যা থাকতে পারে!’

বেলা রেগে বলল, ‘আপনি ফোন দিবেন না আমাকে।’

‘কেন?’

‘আপনি এখন আমার সাথে কথা বলতে ইচ্ছুক নন, বুঝতে পারছি। এতদিন যখন না বলে থাকতে পেরেছেন, বাকি দিনও পারবেন। আমার মতো নগন্য একটা মেয়েকে মনে রেখে কার কী লাভ বলুন। ওই দেশে চোখের সামনে সারাক্ষণ সাদা সাদা চামড়ার মেয়েরা ঘুরাঘুরি করে, দেখতে নাকি খুব সুন্দর। আব্বু বলেছে। আপনি হয়তো সেজন্যই আমার প্রতি ইন্টারেস্ট হারিয়ে ফেলেছেন। যতই হোক, আমি তো আর সাদা চামড়ার অধিকারীনি নই।’

বেলার কন্ঠের তেজের সাথে সাথে ওর জেলাসি ভাবটা বেশ বুঝতে পারলো শাইনি। ও মিটিমিটি হেসে যাচ্ছে, তবে বেলা বুঝতে পারলো না। এতদিন পর শাইনির সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পেয়ে বেচারি ইমোশনাল হয়ে পড়েছে, যার দরুন বাচ্চাদের মতো আবোলতাবোল বকেই যাচ্ছে। একপর্যায়ে ফোন কেটে দিলো বেলা। শাইনি ব্যাক করলো না। বেলা তাতে প্রচন্ড ক্ষেপলো। রাগে,দুঃখ ওর কান্না পেলো আবারও। আসলেই শাইনি ওকে আগেরমতো ভালোবাসে না। শুধু মুখে মুখেই ওর যত মধুর কথা। কল করতে গিয়েও আর ফোন করলো না শাইনিকে। ও দেখতে চায় শাইনি ওকে ফোন করে কি-না। কিন্তু না, সেইদিন আর ওই নম্বর থেকে আর কোনো ফোন আসেনি। বেলা প্রচন্ড হতাশ হলো। কী দরকার ছিল তখন রাগ করে ফোন কেটে দেওয়ার? শাইনি হয়তো কষ্ট পেয়েছে ওর আচরণে, তাই আর কল ব্যাক করেনি। নিজের ভুল বুঝে পেরে নিজেই নিজের কপাল চাপড়ালো বেলা। তখুনি ফোনটা টুং করে শব্দ করে ওঠলো। বেলা বিরক্তি নিয়ে ফোনটা হাতে নিলো। স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখলো শাইনির নম্বর থেকে ম্যাসেজ এসেছে৷ গোটা বাংলা অক্ষরে লেখা ম্যাসেজটা কোনো হুমকির চেয়ে কম কিছু নয়।

‘প্রতিটি মানুষের সুস্থ থাকার জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনীয় যে জিনিস, সেটা হলো খাবার। আর তুমি কী করছো? না খেয়ে আমাকে মিথ্যা বলছো? তোমার কাছ থেকে আমি এটা আশা করিনি মোটেও। খেয়ে নাও, নয়তো আমি আর কখনোই ফোন দেব না। আর না দেশে ফিরবো। তুমি কী ভেবেছো আমি তোমার সম্বন্ধে কিছু জানি না? তোমার শান্ত গলায় বলা কথাগুলো যে মিথ্যে তা আমি বুঝতে পারবো না? তুমি আসলে আমাকে পুরোপুরি চিনে ওঠতে পারোনি। আমার রাগ সম্বন্ধে একটু ধারণা আছে তো তোমার? নিজের প্রতি এতটা অবহেলা করে কী বোঝাতে চাও? আমাকে খুব ভালোবাসো! আমাকে ভালোবাসলে, আমার মানুষটার প্রতি যত্ন নিতে কার্পণ্যবোধ করতে না প্রিয়। কখনো মিথ্যে বলবে না, আই নিড অ্যাকুরেট আন্সার অলওয়েজ। আমি কাউকে ওয়ার্নিং দেই না। তুমি আমার ‘প্রিয়’ বলেই ওয়ার্নিং দিয়েছি। সেকেন্ড চান্স পাবে না। মিথ্যেটা অন্তত আমার সাথে বলো না। সো, কিপ ইটিং!’

ম্যাসেজটা পড়ে বেলা এক মুহূর্ত দেরি না করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। দুপুরের খাবার নিয়ে বসলো। সীমা বেগম অসময়ে মেয়েকে খেতে বসতে দেখে খুব অবাকই হলেন, তবে মনে মনে খুশিও হলেন। যাক, মেয়ের মতি ফিরেছে। নিজের চেহারা-শরীরের যা হাল করেছে তাতে মাঝেমধ্যে নিজের মেয়েকে চিনতেই পারেন না তিনি। আর বেলা গপগপিয়ে খাচ্ছে। যেন শাইনি ওর সামনে বসে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে ওকে অবলোকন করে যাচ্ছে, না খেলে, নিজের যত্ন না নিলে শাইনি যে আর ফিরবে না, যেন বারবার তা মনে করিয়ে দিচ্ছে। পেটপুরে খেয়ে নিজের ঘরে ফিরে এলো বেলা। বিছানাপত্র গুছিয়ে, কাপড় নিয়ে গোসলে ঢুকলো। সময় নিয়ে গোসল সেরে ঘরে এসে দেখলো শিলা ওর বিছানায় শুয়ে আছে। উলটো ঘুরে শুয়ে থাকায় বেলা উঁকি দিয়ে দেখলো, শিলা ভাতঘুম দিয়েছে। মেয়েটার মায়াভরা মুখখানি দেখে মায়া হয় বেলার। বাবা-মা, পরিবার থাকতেও ওদের সাথে নেই ও। নাজনীন বেগমের ভুলের জন্য ষোড়শী মেয়েটা আজ নিজের মায়ের কাছ থেকে দূরে৷ এ বয়সে মেয়েরা একটু বেশিই আবেগী হয়। কাছের মানুষদের কাছ থেকে প্রতারিত হওয়া ওদের সহ্য করতে পারে না। শিলাও পারেনি নিজের মা’কে ক্ষমা করতে। আচ্ছা, শাইনি কী সবকিছু জেনে গেছে? নাজনীন বেগম যে ওর মা নয় তা কী জানে? হয়তো না..তাহলে সবচেয়ে বড় আঘাতটা ও-ই পাবে। বেলা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভেজা কাপড়গুলো বারান্দায় মেলে দিলো। তারপর ঘরে এসে বিছানায় বসে ফোনটা হাতে নিলো। নোটিফিকেশন চেক করতে গিয়ে দেখল হোয়াটস অ্যাপে শাইনি লিখেছে ‘খাওয়া হয়েছে, ভেরি গুড। নিয়মিত চালিয়ে যাও। ব্যতিক্রমী হয়ো না!’

বেলা আশ্চর্য হয়ে মনে মনে বলল, ‘ওনি কীভাবে জানলো এটা?’ তারপর ম্যাসেজ লিখলো, ‘আপনি কীভাবে জানলেন এটা?’

‘সিক্রেট।’

‘দেশে ফিরবেন কবে?’

‘বিয়ের সময়!’

বেলা বিস্ফোরিত নয়নে তাকালো লেখাটার দিকে। বিয়ে? কার বিয়ে? কীসের বিয়ে? শাইনি ওকে রেখে অন্য কাউকে বিয়ে করবে? এসব বলছে কী ও? কাঁপাকাঁপা হাতে টাইপ করল, ‘মানে?’

‘রিভেঞ্জ। তোমার বাবা আমাকে যা জ্বালিয়েছে তার শোধ নিতে হবে না?’

‘তাই বলে আপনি আরেকটা বিয়ে করবেন?’

‘তোমার বাবা একটা চিজ। এবার শোধ নেওয়ার পালা।’

‘আপনি সবসময় আমার বাবার কথা ভাবেন। ওনার সাথেই আপনার শত্রুতা। আমি কে তাহলে?’

‘তুমি আমার বউ।’

‘বউ থাকতেও আপনি বিয়ে করবেন, তাও আবার আমার বাবার জন্য?’

‘তোমার বাবাকে বোঝাতে হবে না, আমি ভালো ছেলে, ভালো মেয়ে ডিজার্ভ করি! আমি অবশ্যই একটা ভালো মেয়েকে বিয়ে করে তোমার বাবার সামনে গিয়ে বলবো দেখুন শ্বশুরমশাই, ভালো মেয়েরাই আমাকে বিয়ে করে। খারাপ মেয়েরা নয়। খারাপ মেয়েরা তো শাইনির পায়ের তলায় থাকার যোগ্যও নয়!’

বেলা ক্ষেপাটে গলায় আওয়াতে আওড়াতে লিখল, ‘দ্বিতীয় বিয়ে করতে গেলে প্রথম স্ত্রীর অনুমতি নিতে হয়। আমি মরে গেলেও সেই অনুমতি দেব না আপনাকে।’

ওপাশ থেকে নীরবে হেসে শাইনি টাইপ করলো, ‘দেশে ফিরি? তারপর দেখা যাবে, তুমি কীভাবে অনুমতি না দিয়ে থাকতে পারো। দরকার হলে আবার কিডন্যাপ করবো, জোর করে অনুমতি নেব।’

বেলা অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলো। আর কোনো উত্তর দিলো না৷ এবার সে নিশ্চিত, শাইনি ওকে আর ভালোবাসে না। উপরে উপরে ‘ভালোবাসি ভালোবাসি’ বলে ওর শুধু মন রক্ষা করার জন্য। নয়তো কখনোই দ্বিতীয় বিয়ের কথা মুখে কেন মাথায়ও আনতো না। ওর জায়গা কাউকে দিয়ে দেওয়ার কথা ভাবতো না। বেলা অভিমান নিয়ে লিখল, ‘তাহলে আমিও আরাফাতকে বিয়ে করে নেব। আপনি সুখে থাকুন।’

Israt’s Typescripts

চলবে…ইনশাআল্লাহ!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here