শ্রাবণ_তোমার_আকাশে,পর্ব_৩১
লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
বিবাহ সংক্রান্ত সকল ফর্মালিটি শেষ হতেই কাজিসহ মেহমানরা মিষ্টিমুখ করে বেলাদের বাসা থেকে বিদায় নিলেন। বেলা তখনো নিজের ঘরে অপেক্ষায়, কখন শাইনির দেখা পাবে। লোকটা ওর অন্তরালে কেন? সামনে এসেও দেখা দিচ্ছে না। নিষ্ঠুর কেন লোকটা? বিয়ের সময়ও ওকে দেখা দেয়নি। সে কী জানে না, বেলার তৃষ্ণার্ত চোখদুটো ওকে পাগলের মতো খুঁজে চলেছে বাড়ির আনাচেকানাচে?
রাত আটটা। ডাইনিং রুম থেকে প্লেট, চামচ, গ্লাসের টুংটাং শব্দ ভেসে আসছে। খেতে বসেছে হয়তো কেউ। বেলা আওয়াজ শুনেও উঠলো না। মন ভালো নেই। আর মন ভালো না থাকলে পৃথিবীর সবকিছু অসহ্যকর লাগে। ভাঙচুর করতে ইচ্ছে হয়। বেলা অভিমানী মন নিয়ে ব্যলকনিতে গিয়ে বসে রইলো। সেখানেও ভালো লাগছে না। বাইরে গিয়ে শাইনিকে খুঁজাখুঁজি করতেও ইচ্ছে করছে না। অগত্যা নিজের ঘরে ফিরে এলো। কাউচে চোখ বন্ধ করে বসে রইলো। ওর অস্থিরতার মধ্যেই ঘরে ঢুকলো শিলা। কারোর আওয়াজ পেয়ে বেলা চোখ খুলে তাকালো। শিলার চোখমুখে খুশি খুশি ভাব। বেলার কাছে এসে ওকে জড়িয়ে ধরে বিগলিত গলায় বলল, ‘আমার ভাইয়ার জীবনে থাকার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ এবং নতুন করে নতুন জীবনে প্রবেশ করার জন্য অনেক অনেক শুভেচ্ছা ভাবি!’
বেলা স্মিত হাসলো৷ তারপর চোখমুখ কুঁচকে সন্দেহী গলায় জিজ্ঞেস করলো, ‘তুমি সবকিছু জানতে শিলা?’
‘না। ভাইয়া দুপুরে ফোন করে জানালো আমাকে। তোমাকে সারপ্রাইজ দিবে বলে, আমাকে বলতে বারণ করে দিয়েছে।’
বেলা নির্লিপ্ত হেসে দরজায় উঁকিঝুঁকি দিলো। ফিরে এসে শিলাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘তলে তলে শয়তানি মহাশয়ের। তা কোথায় ওনি?’
শিলা ভ্রু উঁচিয়ে বলল, ‘এতো প্রেম? দেখার জন্য একেবারে উসখুস শুরু করে দিয়েছো!’
বেলা অস্থির হয়ে বলল, ‘ঠিক তা নয়। যাইহোক, আংকেল কোথায়?’
‘আব্বুকে বেশ কিছুক্ষণ আগে দেখলাম, কথা বলছে নাইমুদ্দীন আংকেলের সাথে।’
‘ড্রইংরুমে? আসলে আংকেলের সাথে আমার কথা ছিলো।’
‘না। ওনারা দু’জন একটু আগেই বেরিয়ে গেলেন। ফিরতে রাত হবে একটু।’
বেলা বিষন্ন গলায় বলল, ‘ওহ! আচ্ছা, তোমার সাথেও ওনি দেখা করেননি?’
শিলা হেসে বলল, ‘করেছে তো! ওই যে, বিকেলে যখন
ঘুমাচ্ছিলে তুমি, ছাদে বসে সবাই আড্ডা দিয়েছিলাম।’
বেলা আঁৎকে উঠে বলল, ‘আমাকে ডাকো নি তুমি? এত কাছে থেকেও দেখা দেন নি ওনি? এত খারাপ লোক জীবনেও দেখিনি আমি!’
শিলা হাসতে লাগলো। বেলা মুখ ফুলিয়ে বিছানায় গিয়ে বসে রইলো। ইচ্ছে করছে দুনিয়ার সবকিছু উলটাপালটা করে দিতে। লোকটা এত কষ্ট দেয় ওকে যে আর নিতে পারছে না। এরইমধ্যে সীমা বেগম ডাক পারলেন রাতের খাবার খাওয়ার জন্য। শিলা আগেই খেয়ে নিয়েছে তাই ও আর যাবে না। বেলার ক্ষিধে নেই। শিলা জোর করে ওকে খেতে পাঠালো। এটাও নাকি শাইনির আদেশ। বেলা এতক্ষণে বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছে সব প্ল্যান ওরা দুই ভাই-বোন মিলেই করেছে। শিলার ওপর অভিমান হলেও কিছু বলতে পারলো না৷ ডাইনিং টেবিলে সব খাবার সাজিয়ে রেখে দিয়েছে সীমা বেগম। তিনিও খাননি, মেয়ের সঙ্গে খাবেন বলে। বেলাকে গম্ভীর দেখে তিনি বিচলিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী হয়েছে? মুখখানা এত গম্ভীর কেন?’
বেলা আশেপাশে তাকিয়ে বলল, ‘বাসা এত নীরব কেন? এতক্ষণ শোরগোল শোনা যাচ্ছিলো।’
‘তোর শ্বশুর, আরাফাতের আব্বা ওরা খেয়ে উঠলো একটু আগে। তারপর তোর আব্বুকে নিয়ে হাওয়া খেতে বাইরে গেছে।’
বেলা অবাক গলায় বলল, ‘হাওয়া খেতে?’
‘হুম। কেন?’
বেলা টেবিলে বসতে বসতে বলল, ‘শিলা এমনভাবে কথাটা বলেছে যে, আমি ভাবলাম কোনো কাজে বাইরে গেছে বুঝি।’
সীমা বেগম প্লেটে পোলাও বেড়ে দিতে দিতে বললেন, ‘কাজে না।’
‘আরাফাতের অবস্থা কেমন এখন?’
‘বাসায় নিয়ে গেছে, ভালোই এখন।’
‘আমাদের কী দেখতে যাওয়া উচিৎ?’
‘যাবো একদিন সময় করে। আমাদের বেলায়ও কতো সাহায্য করেছে ছেলেটা। শোন, তোকে একটা কথা বলি, হয়তো তুই জানিস না।’
বেলা ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো, ‘কী?’
সীমা বেগম নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললেন, ‘শাইনি কিন্তু তোকে ছেড়ে ভীনদেশে গিয়ে চিকিৎসা করাতে রাজি হয়নি। তুই জ্ঞান হারিয়ে ফেলার পর আরাফাত-ই শাইনিকে বুঝিয়ে রাজি করেছিলো কিন্তু বিদেশে চিকিৎসা নিতে। তখন তো শাইনির অবস্থা অনেক খারাপ ছিলো। বেচারা তখনও তোর না খাওয়া, শরীরের প্রতি অযত্ন-অবহেলা মেনে নিতে পারেনি। যার ফলে বাধ্য হয়ে শাইনি রাজি হয়েছে। যাতে ও ভালো হয়ে যায় আর তুই ওর জন্য চিন্তা না করিস। ভালোবাসার মানুষকে কেউ ছেড়ে যেতে তো আর চায় না, তাই না!’
বেলা মায়ের দিকে একটু ঝুঁকে গিয়ে চোখ বড় বড় করে বলল, ‘তুমি এসব কথা আজ বলছো আমাকে?’
‘আমি কী আর জানতাম নাকি? তোর আব্বুর পেট থেকে বের করেছি সেদিন!’
‘এতদিন বলে নি কেন?’
‘তুই নাকি চিন্তা করে কষ্ট পেতি তাই।’
বেলা শুকনো কন্ঠে বলল, ‘জিনিয়াস আব্বু।’
‘খেয়ে নে।’
‘তা তোমার জামাইবাবাজি কোথায়? তার চাঁদপানা মুখখানা দেখাচ্ছে না কেন আমাকে?’
সীমা বেগম আড়ালে হেসে বললেন, ‘সময় হলে নিজেই সামনে আসবে। তুই খাওয়া শেষ কর মা। সারপ্রাইজটা কেমন দিলো সেটাই বল না!’
বেলা চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ‘তোমাদের এসব সারপ্রাইজ একদম বাজে। দয়া করে সারপ্রাইজ সারপ্রাইজ খেলাটা এবার বন্ধ করো আর তোমার জামাইবাবাজিকেও কথাটা জানিয়ে দিও। তাঁর তো এখন আর বেলা বউয়ের প্রয়োজন নেই।’
___________________________________
রাতের আকাশে ফুটে আছে কোটি কোটি তারা। মোমবাতির মতো মিটিমিটি করে জ্বলছে। তাকালেই যেন চোখ টিপে দেয়। বেলার মাথাটা ভার ভার লাগছিলো৷ তাই সীমার ঘর থেকে মাথা ব্যথার ট্যাবলেট আনতে গিয়ে ড্রইংরুমের দরজায় একটি যুবককে দেখে ওর চোখ আটকে গেল। নিমিষেই ভুলে গেল মাথার ভেতর দপদপ করা যন্ত্রণার কথা। মনের ভেতর জমা অন্তর্দহনের অগ্নি বরফের ন্যায় গলে গিয়ে প্রশান্তির উষ্ণ বাতাস বয়ে গেল যেন। অভিমানের তলায় চাপা পড়া ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনুভূতির প্রয়াস ঘটলো যেন আরো একবার। হৃদযন্ত্রের দগ্ধপোড়া ভাবটা ক্রমেই শীতল হাওয়ায় ছেয়ে গিয়ে ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটালো। বেলার অশ্রুসিক্ত চোখজোড়া থেকে নেমে এলো বারিধারার অবাধ বর্ষণ। এলোমেলো পায়ে ছুটে এসে আছড়ে পড়লো যুবকটির বুকে। যুবকটিও পরম যত্নে ওকে আগলে ধরলো, মুখে তার স্বস্তির চিহ্ন, প্রশান্তির হাসি।
বেলা ক্রন্দনমিশ্রিত কন্ঠে বলল, ‘আপনি এতো খারাপ, আমি ভাবতেও পারিনি। এত নির্দয় মানুষ আমি কখনো দেখিনি, আমার থেকে এত লুকোচুরি করার মানে কী?’
শাইনি হেসে বলল, ‘লুকোচুরি করে দেখলাম বউ আমাকে কতোটা চোখে হারায়, ভালোবাসে।’
বেলা শাইনির বুকে ধাক্কা দিয়ে বলল, ‘ভালোবাসি না।’
ধাক্কা খেয়ে শাইনি কিছুটা পেছনে সরে বুকে হাত দিয়ে ছোট ছোট চোখ করে বলল, ‘ব্যথা হয় এখানে।’
বেলা উদ্বিগ্ন স্বরে বলল, ‘দুঃখিত, খুব দুঃখিত আমি। কোথায় ব্যথা হচ্ছে দেখি, আমাকে দেখান..আমি আসলে বুঝতে পারি নি।’
বেলা শাইনির শার্ট আঁকড়ে দেখার চেষ্টা করে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লো। শাইনি ওর হাতদুটো নিজের মুঠোয় নিয়ে বলল, ‘অস্বীকার করে লাভ নেই। ভালোবাসো যে, তা তো আরও একবার প্রমাণ হয়ে গেলো বেলা বউ আমার। হৃদয়হরণ করা হরিণী আমার। বুকের বাঁ পাশে ব্যথা ধরিয়ে দেওয়া সুন্দরী আমার। বেলাশেষের মেঘরাণী, শ্রাবণের এক টুকরো বৃষ্টি আমার। মনপ্রাণ হরণকারী প্রাণনাশিনী আমার..’
বেলা শীতল চোখে চেয়ে রইলো ওর চেহারার পানে। হুট করে শাইনির বুকে মাথা রেখে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, ‘আপনি কী সত্যিই এসেছেন? না-কি আমার ভ্রম?’
শাইনি বিগলিত গলায় বলল, ‘পরখ করে নাও। হয়তো ভ্রম-ই! তোমার মাথাযন্ত্রণার কারণে স্বাভাবিকভাবে সবকিছু দেখতে পারছো না। এতদিন যা ঘটেছে সবকিছু ভ্রম বিভ্রম ছিল, মনে করে ভুলে যাও…’
বেলা চকিতে তাকালো ওর দিকে। শাইনির চেহারা হাসিমিশ্রিত। ও কী সত্যিই বলছে যে, এতদিনের সবকিছু ভ্রম মনে করে ভুলে যেতে? বেলার তা বোধগম্য হলো না।
চলবে…ইনশাআল্লাহ!