“তৃ-তনয়া” পর্ব- ২২

0
2653

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ২২
(নূর নাফিসা)
.
.
প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে চোখে ঘুম নেমে এসেছে। আর ওদিকে মেহেদী আড্ডায় মেতে। বেশ কিছুক্ষণ পর রায়ান মেহেদীকে দেখালো, নাহিদা জানালায় মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে! মেহেদী দ্রুত উঠে এসে তার মাথা তুলে সোজা করলো। নাড়া পেয়ে নাহিদার ঘুম ভেঙে গেছে। ছোট ছোট চোখে করে ঘুমঘুম চোখে তাকাতেই মেহেদী ধমকের সুরে বললো,
– এটা কেমন অভ্যাস! যানবাহনে ঘুমানোর অভ্যাস থাকলে বাসা থেকে বিছানাপত্র নিয়ে আসতে পারলে না! জানালায় মাথা রেখে কিসের ঘুম! কোনো বাধা পেলে তো এখনই মাথা কাটা যেতো!
নাহিদা চোখমুখ কুচকে রেখেই তার বন্ধুদের দিকে তাকালো। তাকে তাকাতে দেখে তার বন্ধুরা আবার অন্যদিকে ফিরে নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। মেহেদী তাকে ধমকে জানালার পার্টিশন লাগিয়ে দিচ্ছে। নাহিদা মনে মনে মেহেদীকে বকে যাচ্ছে! লোকটা কত বড় বজ্জাত! বন্ধুবান্ধবদের সামনে বউকে এভাবে বকাঝকা করে কেউ! নিজে বন্ধুদের সাথে আড্ডায় মেতে থেকে এখন দায়িত্ববোধ দেখাতে আসছে! মেহেদী জানালা লাগিয়ে দিয়ে বললো,
– এবার মনপ্রাণ ভরে ঘুমাও। প্রয়োজনে সিট ছেড়ে মেঝেতে গুমাও। কে জানে, কখন আবার সিট থেকে ঠাস করে মেঝেতে পড়ে!
বলতে বলতে মেহেদী তার বন্ধুদের কাছে চলে গেলো। তার কথায় বন্ধুরা হেসে উঠলো আর নাহিদা কিছুটা লজ্জা পেলো। রাগও হচ্ছে কিন্তু দেখাতে পারছে না। মেহেদী তাদের সামনে থেকে একটা স্পিড ও একটা প্যাকেট এনে নাহিদার পাশে সিটে রেখে বললো,
– ক্ষুধা লাগলে খেয়ে নাও।
মেহেদী আবার চলে গেলো। তারা বন্ধুরা এবার নিরব হয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে আর ক্যান বক্সে ইংলিশ গান চলছে। সবার হাতেই একটা করে স্পিড। গন্ধে পুরো কেবিন ভরে আছে! নাহিদার বিরক্ত লাগছে। স্পিডের গন্ধও তার সহ্য হয় না। তার জন্য আবার স্পিড রেখে গেছে! কি মজা পায় এসব পানিতে! না জানি সাথে মাদক দ্রব্যও নিয়ে এসেছে! নাহিদা তাদের নিচের দিকে তাকিয়ে দেখলো প্যাকেট ফেলে ভরে ফেলেছে! যেন ময়লার ডাস্টবিন! এতো খাদক! এইটুকু সনয়ে এতো কিছু খেয়ে ফেলেছে! ট্রেনের ঝাড়ুদার এনে এগুলোকে ধাক্কা দিয়ে ট্রেন থেকে ফেলে দেওয়া উচিত!
নাহিদা এক হাতে নাক চেপে রেখে তাকে দিয়ে যাওয়া প্যাকেটটা খুলে দেখলো কি কি খাবার রাখা আছে। প্রথমেই চোখে পড়লো আচারের প্যাকেট। গণে গণে দেখলো এক ডজন আচারের প্যাকেট! এতো আচার কিনেছে কেন! আচার নামিয়ে দেখলো কেক, বিস্কুট, জুস, চিপস, চকলেট! এগুলো কি এনেছে! এই প্যাকেটেই তো প্রায় পাচশো টাকার খাবার হবে! ত্রিশ হাজারে তার চলবে কি করে! সে তো অযথা টাকা নষ্ট করে! বাসা থেকে মা যে খাবার দিয়েছে সেই খেয়াল কি আছে তার! ওগুলো না খেলে নষ্ট হবে না!
নাহিদা ফোনটা নিয়ে দেখলো এগারোটার বেশি বাজে! সময়তো তাহলে অনেকই কেটেছে। ট্রেন ছেড়েছে সকাল আটটায়!
এতোক্ষণে তার পেটে ক্ষুধা অনুভব করলো। সময় দেখে ক্ষুধা লেগে গেছে! ভাবতেই নাহিদার মুখে মৃদু হাসি ফুটে উঠলো! সে সিট ছেড়ে উঠে কেবিনের মাঝামাঝিতে এলো। মেহেদী ও বাকিরা তার দিকে তাকালো। নাহিদা তাদের দৃষ্টি উপেক্ষা করে একহাতে শাড়ির আঁচল ধরে অন্যহাতে দুই লাগেজের মাঝামাঝিতে থাকা মেহেদীর ব্যাগটা উপর থেকে টানলো। কিন্তু এতো ভারি ব্যাগ এক হাতে নামানো দায়। মেহেদী বসা থেকেই বিরক্তিকর ভাবে বললো,
– এটাতে আবার কি?
তার এমন ভঙ্গিতে কথা শুনে নাহিদা কোনো জবাব দিলো না। এখন থেকে এটাই স্থির করে নিলো, যতক্ষণ পর্যন্ত না ভালোভাবে কথা বলছে ততক্ষণ পর্যন্ত তার কোনো জবাব সে দিবে না। মেহেদী তার জবাব না পেয়ে উঠে এসে বললো,
– সরে দাড়াও।
নাহিদা সরে দাড়ালে মেহেদী ব্যাগ নামিয়ে দিলো। নাহিদা ব্যাগ তুলে সিটে রাখলো। ব্যাগ খুলে যতক্ষণ পর্যন্ত সে খাবারটা বের করলো ততক্ষণ পর্যন্ত মেহেদী তার দিকে তাকিয়ে ছিলো সে ব্যাগে কি করছে সেটা দেখার জন্য। যখন দেখলো খাবার বের করছে তখন দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। নাহিদা জানালা খুলে তারপর খাবারের বাটি নিয়ে খেতে লাগলো। বিরিয়ানির গন্ধ পেয়ে মেহেদীর বন্ধু জিহাদ বললো,
– ভাবি, একা একাই খাবেন! আমরা খেয়েছি আপনার জন্যও রেখেছি। তাহলে আমাদের খাবারের ভাগ কোথায়!
– এতো কিছু খাওয়ার পরেও আপনাদের পেটে জায়গা আছে!
– আমার তো পেটের কোনাও ভরেনি!
– বিশ্ব খাদক দেখছি আপনারা!
নাহিদা ছোট বাটি টা তার কাছে রেখে বড় বাটিটা এগিয়ে দিতেই তাদের হুলস্থুল! কেননা চেয়েছে জিহাদ। এপাশে মেহেদী ও রায়ান থাকায় হাত বাড়িয়ে রায়ান নিয়ে নিলো বাটি। আর তাদের বাদ রেখে একের পর এক চামচ বিরিয়ানি ঢুকছে রায়ানের মুখে। এ নিয়ে বাকি দুজন রায়ানকে খাওয়ার মাঝেই মাইর লাগাতে শুরু করেছে! নাহিদা হতবাক তাদের কাণ্ডে! মেহেদী পাশে থাকায় বাটি কেড়ে নিয়ে মাঝামাঝিতে রাখলো এবং চারজনই খেতে লাগলো। রায়ানের হাতে চামচ আর বাকিরা খালি হাতে। হাতও ধুয়া নেই তাদের অথচ এভাবে খেতে লেগে গেছে! বন্ধুদের কর্মকাণ্ড দেখে আনন্দও লাগছে আবার ঘিনঘিনও লাগছে নাহিদার! যেন অনাহারে থাকা বাচ্চারা বিরিয়ানি খেয়ে যাচ্ছে। আর এক একজনের কি প্রশংসা, “আন্টির হাতের বিরিয়ানি, অসাধারণ! ভাবি আপনার হাতে বিরিয়ানি খাওয়াবেন কবে!”
নাহিদার খাওয়া আর চলছে না। তাদের দেখেই তার পেট অর্ধেক ভরে গেছে। যতটুকু বাকি আছে ততটুকু ক্ষুধা টানটান লাগছে! তার এইটুকু বাটি শেষ হয়নি অথচ তাদের এতো বড় বাটি শেষ করতে পাঁচ মিনিটও লাগেনি। মেহেদী ঢেকুর তুলে বললো,
– এটুকুই ছিলো। নাকি আরও দিয়েছে আম্মু?
নাহিদা তার বাটি দেখিয়ে বললো,
– আর এটা দিয়েছে।
– ধুর! তোমার জুটা খাবো নাকি!
নাহিদা মলিন মুখে বললো,
– আগে জানলে তো এটুকুও খেতাম না। রেখে দিতাম আপনার জন্য। তাছাড়া মা তো জানতো না, ভাইয়ারা সাথে আছে।
– লাগবে না। খাওয়া শেষ করো আর ঘুমাতে হলে জানালা লাগিয়ে ঘুমাও।
খালি বাটি নাহিদার দিকে দিয়ে তারা সবাই হেলান দিয়ে চোখ বুজে গান শুনছে। নাহিদা আর খেতে পারলো না। জুটা কথাটা শুনে কেন জানি একটু খারাপ লাগলো। আরাফকে নাজিয়ার হাতের খাবার খেয়ে নিতে দেখেছিলো। তার বাবাকে তার মায়ের মুখে খাবার তুলে দিতে দেখেছিলো। তার বাবা তাদের তিন বোনের হাতেও খাবার খেয়েছিলো। হঠাৎ আশিকের কথাও মনে পড়ে গেছে তার! আশিক তার খাওয়া লাচ্চিটা কিভাবে খেয়ে নিয়েছিলো! ওটা তো জুটাই ছিলো! এতো খারাপ কেন আশিক! অন্যের জুটা খেয়ে ফেলে! তার চোখে অশ্রু ভীড় জমিয়েছে। সে দ্রুত চোখ মুছে নিতে নিতে মনে মনে বললো, “না না! এসব কি ভাবছি আমি! আশিককে কেন ভাবছি! এখন তো আমার হাসব্যান্ড আছে। ও তো পরপুরুষ! এসব ভাবা ঠিক না। তাছাড়া খারাপ লাগার কি আছে! সে তো ভুল কিছু বলেনি! খাওয়া খাবার তো জুটা ই হয়।”
নাহিদা আরও কয়েক চামচ বিরিয়ানি পানির সাথে গিলে নিলো। খাবার গিলতেও যেন কষ্ট হচ্ছে তার! সে বাকিটুকু পরে খাওয়ার জন্য রেখে দিলো। এবং সব গুছিয়ে রেখে আনমনে বাইরে তাকিয়ে রইলো। আর ঘুম নামেনি চোখে।
দুপুরের শেষ সময়ে তারা চিটাগং এসে পৌছালো। সেখান থেকে বাসে উঠে কক্সবাজারে রওনা দিলো। ব্যাগ লাগেজ কিছুই তাকে বহন করতে হয়নি। সব মেহেদী ও তার বন্ধুরাই টেনেছে। ট্রেন ভ্রমণ করতে ভালো লাগলেও বাসে ভ্রমণ করে মাথাটা ঝিম ধরে গেছে নাহিদার। আর বাকিরা অভ্যস্ত হওয়ায় শরীরে খুব এনার্জি নিয়ে এখনো আমেজে মেতে আছে। রিসোর্টে এসে বন্ধুদের জন্য একটা রুম বুক করতে হয়েছে। অত:পর তারা যার যার রুমে চলে এলো। ব্যাগ ট্যাগ কোনোমত রুমে রেখে তারা বেরিয়ে গেছে। আর নাহিদা রুমে একা। কোথায় গেছে, কেন গেছে কিছুই বলে যায়নি তাকে। তারাহুরো করে শুধু বেরিয়ে গেলো মেহেদী। নাহিদা দরজা ভেতর থেকে আটকে দিয়ে গোসল করে নিলো বাথরুমে। কাপড়চোপড় নেড়ে দেওয়ার মতো বারান্দা ছাড়া আর কোনো জায়গা পেলো না। মাথাটা ব্যাথা করছে। সে বিরিয়ানিটুকু খেয়ে বাটি ধুয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। অস্থির লাগছে খুব! বাকি খাবারের প্যাকেট সামনেই রাখলো যদি মেহেদীর প্রয়োজন হয় এই ভেবে। কিন্তু মাথার যন্ত্রণায় ভালো লাগছে না! একটা টেবলেট খেয়ে নিলে ভালো লাগতো। কিন্তু সেটা পাবে কোথায়! বেশ কিছুক্ষণ শুয়ে থাকার পর চোখে ঘুম নেমে আসছিলো মাত্র। এমনি দরজায় ধুপধাপ শব্দ হতে লাগলো! মেহেদী চেচিয়ে বলছে,
– ওই, মহারানী! আমি কি বাইরেই থাকবো! রুম তো আপনার একার জন্য ভাড়া করেনি! আরে! মরে গেলো নাকি! হ্যালো…ভেতরে কেউ আছে!
নাহিদা বিরক্তি নিয়ে উঠে এলো। দরজা খুলে দেখলো ভেজা কাপড়চোপড়ে মেহেদী। সমুদ্রে গোসল করে দেহ একদম সাদা ভেটকি মাছের মতো হয়ে গেছে। মেহেদী রুমে ঠুকতে ঢুকতে বললো,
– এতোক্ষণ কি করছিলে রুমে একা একা! কখন থেকে ডাকছি! আমার এতো উচ্চ কণ্ঠস্বর পৌছায় না তোমার কানে!
নাহিদা তার কোনো প্রতুত্তর করলো না। এমনিতেই মাথাটা ঝিম ধরে আছে! তার উপর এমন চেচিয়ে কথাবার্তা! মেহেদী কাপড়চোপড় নিয়ে বাথরুমে চলে গেলো। নাহিদা দরজা লাগিয়ে পাপোশ দিয়ে ভেজা জায়গা মুছে দিলো। মেহেদী মাথা মুছতে মুছতে বেরিয়ে এলে নাহিদা বাথরুমে এসে তার কাপড়চোপড় ধুয়ে দিলো। মেহেদী টিশার্ট পড়ে ফোন হাত নিয়ে শুয়ে আছে। হঠাৎই তার ফোন বেজে উঠলো আর সে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো! ফোন রিসিভ করেই মুখে মিথ্যে হাসির একটা ঝিলিক ফুটিয়ে তুললো। যেটা বারান্দায় যাওয়ার সময় নাহিদার চোখে পড়ে গেছে। আর বুঝতেও বাকি নেই আম্মু কিংবা আব্বু কল করেছে।
মেহেদী হাসিমুখে বললো,
– জ্বি আব্বু, বলো।
– পৌছেছো ঠিকঠাক মতো?
– হ্যাঁ, এই যে দেখো বেডে বসে আছি।
– জানাতে বলেছিলাম, জানাও নি কেন?
– ফ্রেশ হওয়ার সময় তো দিবে। এখনই তো জানাতাম তোমাকে।
– হু, বাটপার ছেলে আমার। তোমাকে খুব চেনা আছে। নাহিদা কোথায়?
– লজ্জা করে না তোমার, নিজেকে বাটপারের বাবা হিসেবে পরিচয় দিতে!
– তুমি যেমন বাটপারি করতে করতে অভ্যস্ত হয়ে গেছো, আমিও তেমন পরিচয় দিতে দিতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। এখন বলো, নাহিদা কোথায়? তুমি একা কেন রুমে? ওর খেয়াল রাখতে বলেছিলাম।
মেহেদী বিছানা ছেড়ে বারান্দায় চলে এলো। নাহিদা কাপড় নেড়ে দিচ্ছিলো আর মেহেদী তার পেছনে দাড়িয়ে সামনে ফোন ধরে বললো,
– এই যে দেখো তোমাদের নাহিদাকে। দেখেছো? খেয়াল না রাখলেই কি এখনো এখানে দাড়িয়ে আছে!
হুট করেই মেহেরুন ইসলাম স্ক্রিনের সামনে এসে বললো,
– নাহিদা, তোর চোখমুখ এমন দেখাচ্ছে কেন? কি হয়েছে?
– তেমন কিছুনা মা, জার্নি করার ফলে মাথাটা একটু ব্যাথা করছে।
– বিকেল হতেই মুখটা কেমন শুকিয়ে গেছে! খেয়েছিস কিছু?
– হ্যাঁ, মা। বিরিয়ানি খেয়েছি।
– মেহেদী, এটাই তুই খেয়াল রেখেছিস! খেয়াল রাখলে তার মাথা ব্যথা করছে!
মেহেদী অবাক ভঙ্গিতে পেছনে থেকেই নাহিদার কপালে গলায় স্পর্শ করে বললো,
– এ! তোমার মাথা ব্যথা করছে! জ্বর টর হয়েছে নাকি! আমাকে বলোনি কেন! আমি তো ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতাম! আম্মু, আব্বুকে বলো নাহিদাকে হসপিটালে নিয়ে যাবো। হসপিটালের খরচ বিকাশ করতে।
তার কথা শুনে ওদিকে বড়বোন মেহতাজ অট্টহাসিতে ফেটে পড়েছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here