সোনালী [০৩]
রোজান পরিস্থিতি সামাল দিতে জোরে দৌঁড়াতে শুরু করলো। শামিম আর জসিমও দৌঁড়াচ্ছে। শামিম আর রোজানের শরীরে টগবগে তারুণ্যের ছোঁয়া থাকতেও তাদের চেয়ে জসিম বিশ্রাম ছাড়াই বেশি দৌঁড়াতে পারছে । ওদের মতো এমন হাঁপাচ্ছেও না।
আধ কিলোমিটার দূরে গিয়ে রোজান বসে পড়লো।
আর হাত নেড়ে বললো,
‘ থামেন থামেন! আর আমাদের নাগাল পাবেনা। তবে বলেন দেখি আমরা তিনজন পুরুষ একজন পুরুষের ভয়ে পালাচ্ছি কেন? আবার আমাদের কাছে বন্দুকও আছে!
জসিম বন্দুকের দিকে একবার তাকিয়ে বললো,
‘ পালাচ্ছি আমার নিজের লাইজ্ঞা । আমার তো শান্তিতে এইহানে থাকন লাগবো বাপ। আমারে দেখলে খবর আছে। ওই হাবিল নিজেই একটা বাঘ। ওর যে মাইয়াডা আছেনা? এইডার লাগিই এমন করে। একবার ঘুরতে আসা এক ছেমরা ওই মাইয়ার দিকে নজর দিছিলো, হাবিল তীর ছুঁইড়া পোলার বাম হাত অবশ কইরা দিছে। পারলে চোখ দুইটাই কানা বানাই ফেলতো, কিন্তু তার আগেই পালাইছে।
রোজান আৎকে উঠলো! কি ভয়ানক মানুষ হাবিল। তাহলে সে ওখানে কি করে পৌঁছাবে? তাও এমন একা! সোনালীকে কি কাছ থেকে দেখা হবে না?
নাকি ওই এক ঝলকই শেষ দেখা!
এদিকে শামিম উঠে দাঁড়ালো। তার তাড়াতাড়ি মায়াকে দেখতে যেতে হবে। রোজান ধিরে ধিরে এগুচ্ছে। আসার সময় রাস্তাটাকে যতটা স্বল্প মনে হয়েছিলো এখন ফেরার পথে সেটাকে তার কয়েকগুণ বিশাল মনে হচ্ছে।
অবশেষে ক্লান্তির চরম পর্যায়ে গিয়ে তারা গাড়ীর নিকট পৌঁছালো। রোজান জসিমের হাতে একটা চেক ধরিয়ে বললো,
‘ এখানে দেড় লাখ আছে। ৩০ হাজার এডভান্স দিলাম, কেননা কালকে আবার আসবো। তৈরি থাকবেন।
জসিম কেন জানি না করতে গিয়েও পারলোনা।
শুধু বললো,
‘ আইচ্ছা আমারে ডাইকা দিও।
রোজান আর শামিম গাড়ীতে উঠেই হাসপাতালের দিকে ছুটলো। উদ্দেশ্য মায়াকে দেখা!
হাসপাতালের সামনে গিয়ে শামিম পড়লো বিপাকে। সে বুদ্ধি বের করতে পারছেনা রোজানের কি পরিচয় দিবে? এমনিতেই মায়ার মা বাবা বিষয়টা ভালো নিচ্ছেনা। তাদের বিবাহ উপযুক্ত মেয়েকে এমন একটা পুরুষ প্রতিদিন দেখতে আসাটা সত্যিই আপত্তিকর। এখন যদি সাথে আরেকজনকে নিয়ে যায় তাহলে সন্দেহ আরো গাঢ় হবেনা?
কিন্তু রোজান বললো,
‘ শামিম তুমি তোমার যাওয়া যাও। আমি আসছি আমার মতো করে।
শামিম মাথা নাড়িয়ে কোনো রকম আশপাশ না তাকিয়ে মায়ার কেবিনে ঢুকলো। রুমে এখন আরো বাড়তি মানুষজনরাও আজকে বসে আছে। হয়তো মায়াকে দেখতেই কিছু আত্মীয়রা আজ আসছে। মায়া এখনো নিজে উঠে বসতে পারেনা।
শামিম দরজায় দাঁড়িয়েই বললো,
‘ মায়া কেমন আছে এখন?
মায়া শামিমের আওয়াজ শুনতে চোখ খুলে তাকালো। মিষ্টি করে হাসলো আর বললো,
‘ আগের চেয়ে একটু ভালো, আপনি বসুন।
কিন্তু শামিম দেখলো বসার মতো জায়গা নেই। আজকে এখানে অল্প সময় থাকার মতো ওয়েও নেই। সে বেড়িয়ে যেতে চাইবে তখনি সাদা এপ্রন গায়ে রোজানের প্রবেশ!
রোজানকে দেখেই রুমের সবাই তাকালো। তারা ভাবছে নতুন ডক্টর এভাবে চলে আসলো?
সাথে কোনো নার্সও নেই।
এদিকে রোজান শামিমের দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ ভেতরে সরে দাঁড়ান, আর এই রোগীর অবস্থা কেমন এখন? উঠাবসা করতে পারে?
মায়ার বাবা বললো,
‘ না স্যার, আঘাতে চামড়া ছুঁলে যাওয়ার অংশগুলো এখন পেকে উঠেছে, এগুলোর যন্ত্রণায় মায়া আরো নিস্তেজ। তবে খুব শীগ্রই এগুলো ভালো হয়ে যাবে। কিন্তু ভেতরকার হাড় কয়েকটা ভেঙে যাওয়ার ব্যাপারে শফিক সাহেব বেশ হতাশাজনক ইঙ্গিত দিলেন।
রোজান চশমাটা হাত দিয়ে চোখে ভালো করে এঁটে বললো,
‘ হুম জটিল! আচ্ছা আমি দেখছি।
বলেই হনহন করে বেড়িয়ে গেলো। কিন্তু রোজান উঠার সময় খেয়াল করেছে মায়া মিটমিট করে হাসছে। কেননা মায়া জানতো শামিমের সাথে আজকে তার বস আসবে।
রোজানের পেছন পেছন শামিমও বের হলো। রোজান বারান্দায় মোড় নেওয়ার সময়ই এপ্রন খোলে হাতে মোড়াতে মোড়াতে নিচে নেমে গেলো।
শামিম গাড়ীর কাছে গিয়েই বললো,
‘ স্যার যদি ধরা পড়তেন?
রোজান মাথা নেড়ে বললো,
‘ এতো সহজ?
শামিম আর কিছু বললো না। তবে রোজান যাওয়ার পরে সেই রুমে আরো কিছুক্ষণ থাকতে পারাটাও তার জন্য আনন্দের ছিল।
রোজান গাড়ীতে বসে বললো,
‘ শামিম কিছু সাদা পেপার আনতে পারবে?
শামিম অবাক হয়ে বললো,
‘ কেন? আচ্ছা কয়টা লাগবে?
রোজান ভেবে বললো,
‘ ১০০ নিয়ে আসো।
শামিম কিছুটা দূরের একটা লাইব্রেরি থেকে কিছু কাগজ নিয়ে গাড়ীতে বসলো।
হোটেলে পৌঁছেই আগে খেয়ে নিলো। তারপর রোজান তার ফোন বের করে সোনালীকে দেখার ভিডিও, ছবিগুলো আবার দেখতে লাগলো।
শামিমকে আজ সারাদিন একটা বিষয় খুব ভাবাচ্ছে। যেটা মুখ ফুটে বলছিলোনা। কিন্তু এবার সে সাহস করে বলে ফেললো,
‘ আচ্ছা, কিছুদিন আগে আমাদের সবাইকে একটা মেয়ের সন্ধানের জন্য বড় স্যার কিছু বৈশিষ্ট্য দিয়েছিলেন, যেটার প্রথম বৈশিষ্ট্য ছিল মেয়ের চুলের রঙ সোনালী, মেয়ের চোখের রঙ নীল, মেয়েটা একদম ফর্সা, এমন কাউকে পেলে যেন যেভাবেই হোক নিশ্চিত হই মেয়ের পিঠে কোন দেশের মানচিত্রের মতো একটা জন্মদাগ আছে কিনা। তারপর যেন বড় স্যারকে বিষয়টা জানাই, বিনিময়ে উনি আমাদের প্রত্যাকের মাসিক ইনকামের তিনগুণ বকশিস দিবেন! মেয়েটা নাকি ভীনদেশের, তার মা’র কাছে পৌঁছে দিতেই আমাদের সাহায্য প্রয়োজন।
রোজান ভ্রু ভাঁজ করে বললো,
‘ হুম বাবা বলেছিলেন তো।
শামিম মিনমিন করে বললো,
‘ এটাই সেই মেয়ে নয়তো স্যার? তাকে সেখান থেকে এনে তার আসল জায়গায় ফিরিয়ে দিতেই কি আপনি এমন ব্যকুল হয়ে উঠেছেন?
রোজান চোখ বড় করে রাগী চেহেরায় শামিমের দিকে তাকালো। ধমকের সাথে বললো,
‘ অসম্ভব!
শামিম বুঝলোনা রোজান আসলে এই অসম্ভব দ্বারা কি বুঝিয়েছে। তবে সে চুপ করে গেলো।
এদিকে রোজান ছবিগুলো দেখা শেষ করে, কাগজে কলম দিয়ে একের পর এক কিছু লেখার চেষ্টা করতে লাগলো, যেটা সে সোনালীর কাছে পৌঁছাবে।
সোনালীর কাছাকাছি যাওয়ার কোনো রাস্তা সে ভেবেই পাচ্ছেনা । হাবিলের ভয় না থাকলে রোজান যেকোনো ব্যবস্থা করে ফেলতো। এমনিতে সে চাইলে হ্যালিকপ্টার আনিয়ে সেখানে যেতে পারে । কিন্তু এতে হাবিল ঝামেলা করবে আর গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সোনালীর ব্যপারটা ছড়িয়ে যাবে! হাবিলকে লোক দিয়ে ঘায়েল করা কোনো ব্যপার না। শুধু সেই মেয়েটার অবস্থা ভেবে থেমে গেলো ।
আর রোজান যে সোনালীর কিছু হতে দিবেনা।
সোনালী যদি দিয়ালীর হারিয়ে যাওয়া সেই সন্তান নাও হয়ে থাকে তবুও রোজান সোনালীর ভেতর পর্যন্ত পৌঁছাবে। তার হাঁটু পর্যন্ত নেমে আসা সোনালী চুলেরা তাকে যেন অদ্ভুতভাবে পেঁচিয়ে ধরেছে। প্রায় অর্ধ যুগ পরে রোজান আবারও কোনো নারীর মায়ায় আটকালো! এবার সে তাকে কোনোভাবেই হারাতে দিবেনা। রোজান বুঝতে পারলো সে সত্যিই সোনালীর প্রেমে পড়ে গেছে!
রোজান সবশেষে চার লাইনের একটা কাগজ আলাদা করে রেখে দিলো! এটাই দিবে, আগে নিশ্চয়তা….
সেদিন রোজানের পুরোটা রাত নির্ঘুম কাটে! সময় যত অতিক্রম হতে থাকে, সেই এক পলক দেখা পরম সুন্দরীর উপর তার অনূভুতির তীব্রতা বেড়েই চলে।
ভোরের দিকে একবার চোখ লেগেছিলো, তখন তার স্বপ্নেও সোনালী হাজির!
ঘুম ভেঙে যেতেই সে উঠে বসে। বাইরে আলো ফোটার আগেই সে সেখানে যাওয়ার জন্য তৈরি হতে থাকে। শুধু কবে আবার দেখবে এই তাড়নায় !
৬ টা থেকে শামিমকে ডাকতে লাগলো। অলস শামিম ৭ টার দিকে উঠলো। ভেতরে ভেতরে খুব বিরক্ত সে। শুধু অফিসের বস বলে কিছু বলতে পারছেনা। তারা ৮ টায় যথারীতি রওয়ানা দিলো।
জসিমের বাড়ির সামনে নামলো সাড়ে আটটায়, এরপর তিনজন হাঁটতে লাগলো।
ঠিক গতকালের মতো, রোজানের যাত্রাপথটাকে অতি মাত্রায় ক্ষুদ্র মনে হলো।
সাড়ে ১০ টার আগেই তারা নদীর পাড়ে চলে গেলো।
এখন অপেক্ষা করে চলেছে সোনালী কখন আসবে?
জসিম আর শামিম একদম ভেতরে বসে বসে গল্প করতেছে। আর রোজান একা উঁকি দিচ্ছে। হাতে পাথরের উপর সুতো দিয়ে বাঁধা একটা কাগজের টুকরো! সাড়ে ১০ টার দিকে একজনের দেখা মিললো, ময়লা শাড়ী পরিধান এদিকেই আসছে, হাতে কিছু জিনিসপত্র। রোজান গাছের আড়াল থেকে দেখতে লাগলো। মহিলাটা এসে নদীতে সেসব ধৌত করলো। এরপর চলে যেতে লাগলো।
মহিলা একটু যাওয়ার পরেই দূরে দেখা গেলো গোলাপি রঙের কামিজ পরিহিতা সেই অপরূপাকে। রোজানের স্বপ্নের রাণী, যে এক দেখাতেই তাকে পাগল করে দিয়েছে।
রোজান ধিরে ধিরে আড়াল থেকে বের হলো। মেয়েটা পাশে কাপড় রেখে গোসলের জন্য নদীতে নামলো। দুইটা ডুব দিয়ে মাথা তোলার সময়ই রোজা পাথরটা ছুঁড়ে মারলো ওই পাড়ে। যেটা সোনালীর পেছনের কাপড়ের জায়গায় পড়লো। কিন্তু পানির নিচে থাকায় সোনালি কিছুই বুঝতে পারলোনা। সে সুন্দরমতো উঠে গামছা দিয়ে শরীর ঢেকে বাড়ির দিকে চলে যেতে চাইবে তখনি পাথরে সুঁতো দিয়ে বাঁধা কাগজটাকে নজর করলো । নিচু হয়ে এটা নিয়ে সে এদিক ওদিক তাকালো। কিন্তু কাউকে দেখলোনা।
এটা খুলে দেখলো লেখা আছে,
”’ তুমি সেই সোনালী যাকে আমি খুঁজে চলেছি! যার পিঠে রয়েছে অদ্ভূতুরে এক কালো মেঘ,চোখে জমিয়েছো আকাশের সব নীল,সকালের কিরণ তোমার চুল থেকে প্রতিনিয়ত রঙ চুরি করে আভা ছড়ায়! ”’
লেখাগুলো পড়েই সোনালী চমকে উঠলো। হাত দিয়ে নিজের পিঠে আলতো ছুঁলো। যেটা রোজানের দৃষ্টির অগোচর হয়নি। সোনালীর পিঠে তাহলে কোনো জন্মদাগ আছে? সেই তাহলে দিয়ালীর খুঁজে চলা হারানো সন্তান? কিন্তু এখানে কীভাবে আসলো?
চলবে…….
লেখাঃ তাজরীন_খন্দকার