সোনালী [০৭]
রোজানকে তার মামা ধমকে বলে উঠলো,
‘ এসব দুদিনের বদ আবেগ ছাড়ো রোজান! টাকা যতো বেশি হবে জীবনের সুন্দরী মেয়েদের দেখা তত বেশি মিলবে!
রোজান রাগী চোখে তার মা’র দিকে ফিরে বললো,
‘ মা তুমি কি চাও? আমাকে নাকি ওই বিদেশী মহিলার টাকাকে?
রোজানের মা কাঁদোকাঁদো চেহেরায় বললো,
‘ তুই ই তো আমার সাত রাজার মানিকরে। তুই খুশি থাকলেই আমি খুশি।
রোজান চোখ ঘুরিয়ে বললো,
‘ তাহলে তোমার ভাইকে বলো আমি যা চাই তাই করতে হবে।
রোজানের মা মিনমিনে স্বরে বললো,
‘ ভাই আমাদের তো কোনো কিছুই কম নেই। এদিকে আমার মাত্র একটা ছেলে, এসবই বা কে খাবে বলো?
তুমি এসব ছেড়ে ও যা চাইছে তাই করো না প্লিজ?
রোজানের মামা সোফা হাতায় হাত দিয়ে একটা থাপ্পড় মারলেন। তারপর ঘটঘট করে বাসা থেকে বেড়িয়ে চলে গেলেন।
রোজানের মা দুদিকে তাকিয়ে এবার অসহায়ের মতো ভাব করে স্থির হয়ে গেলেন।
এদিকে রোজানও দ্রুত পায়ে রুমে গিয়ে আওয়াজের সাথে দরজা বন্ধ করে দিলো। রোজানের মেজাজ চরম খারাপ হয়ে গেছে। সে জানে তার বাবাও হয়তো বলবে, রোজান শুনো জীবনে টাকা আগে, টাকা থাকলেই সব পাওয়া যায়!
তবে রোজান সিদ্ধান্ত নিলো তার মামা কিংবা বাবা রাজী হোক না হোক, রোজান সোনালীকে একাই জয় করে নিবে। দরকার হলে তাকে নিয়ে অনেক দূরে পালিয়ে যাবে! এদিকে তার বাবার আসার সময়ও হয়ে গেছে। লাস্ট চেষ্টা তার বাবাকে বলেই করবে, তবে উনি রাজী না হলেও রোজান পরোয়া করেনা।
‘
ঠিক দুইদিন পর,
তার বাবার আসার কথা আজকে। আর ক’দিন পরে আসার কথা থাকলেও উন্নত চিকিৎসার ফলে এই যাত্রায় তিনি দ্রুতই আশংকামুক্ত হয়েছেন!
রোজান আর তার মা গাড়ী নিয়ে এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করছে।
রোজান তার মাকে বারবার বলছিলো,
‘ মা সোনালীর কথা কি বাবাকে জানালে বাবা মানবে?
তার মা চুপ করে ছিলো। হয়তো তিনি বুঝতে পারছেন এবং ভালোই উপলব্ধি করতে পারছেন উনার চেনা মানুষটা এতো টাকার কথা একসাথে শুনলে কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হবেন!
এদিকে তার বাবা এয়ারপোর্ট থেকে বের হতেই দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো!
রোজানের বাবাও তার কপালে চুমু খেয়ে বললেন,
‘ লক্ষী বাবা! বাবাকে কতখানি মিস করেছো?
রোজান মুখ ছোট করে জবাব দিলো,
‘ অনেকখানি বাবা।
সে ভাবতে লাগলো তার বাবার মতামত রাতে জিজ্ঞাসা করবে। এরপর যা করার নিজেই করবে, শুধু খুব জলদি সোনালীর কাছে পৌঁছাতে হবে।
এমনিই তার আর দিন কাটছেনা!
কিন্তু তার সেই ভাবনাকে ভেঙে দিয়ে তার বাবা বললো,
‘ শুনেছি তুমি একটা হীরে খুঁজে পেলে?
রোজান অবাক হয়ে বললো,
‘ কিসের হীরে বাবা?
রোজানের বাবা তার কাঁধ ধরে সামনে আগাতে আগাতে বললো,
‘ ওহহ হীড়ে নয়, সোনা। তুমি সোনালী নামে একজনকে পেয়েছো, যাকে তুমি বিয়ে করতে চাও!
রোজান ভ্রু কুঁচকে তার মার দিকে তাকালো। কিন্তু তার মার মুখ দেখে কিছু বুঝা যাচ্ছেনা যে এটা তিনিই বলেছেন। তবে রোজান ধরে নিয়েছে তার মা বলেছে। কিন্তু তার বাবা পরক্ষণে আবার বললো,
‘ আমরা যাকে এতোগুলো দিন ধরে খুঁজে চলেছি, তাকে তুমি আমার অনুপস্থিতিতে কীভাবে পেয়ে গেলে? তাও এত তাড়াতাড়ি?
রোজান তার বাবার থেকে দূরে সরে বললো,
‘ আমরা কিসের জন্য খুঁজেছি ভুলে যাও বাবা। আমি তাকে পেয়েছি আমার করার জন্য। সোনালীকে আমি ভালোবাসি, এবং খুব শীগ্রই বিয়ে করতে চাই।
রোজানের বাবা হাসতে হাসতে বললো,
‘ তা আমি মানা করলাম কখন? নিশ্চয়ই আমার ছেলে যা করবে ভালোই করবে!
রোজান এবার হেসে দিলো। তার বাবাকে এসে শক্ত ধরে বললো,
‘ সেরা বাবা আমার! আমি ভাবছিলাম রাজী হবেনা!
রোজানের মা বহুক্ষণ ধরে সবকিছুতেই নিরব দর্শক। কেন উনি এভাবে চুপ করে আছেন রোজান সেটা জানেনা। তবে জানতে চায়না, কেননা তার বাবাকে নিয়েই তার ভেতরে সবচেয়ে বেশি ভয় ছিলো, যার ইতোমধ্যে পরিত্রাণ মিললো। আর তার মা তো সবসময় তার পক্ষেই থাকে! এবার শুধু বাবা মা ছেলে মিলে খুব সহজেই এই অসাধ্যটা সাধন করবে!
সোনালীকে অতি তাড়াতাড়ি তার করে নিবে।
গাড়ীতে বসেই রোজান শামিমকে ফোন দিলো। আর জিজ্ঞাসা করলো,
‘ শামিম তোমার মায়ার কি খবর? আবার দেখতে যেতে চাও?
শামিম বেশ উৎফুল্লের সাথে বললো,
‘ অবশ্যই স্যার। কবে যাচ্ছেন?
রোজান তার বাবার দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ বাবা যেদিন যেতে পারবে!
রাতে রোজান তার বাবার সাথে সিদ্ধান্ত নিলো, তারা কয়েকজন লোকসহ স্বশরীরে মৌয়াল হাবিলের নিকট বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাবে।
রোজানের বাবা এতে সায় দিলো। রোজান তার মাকে বললো,
‘ তুমি কখন যেতে চাও?
রোজানের মা বললো,
‘ তোর বাবা অসুস্থ মানুষ, উনি যেদিন পারবে। আর আমি তো সবসময় প্রস্তুত!
এদিকে তার বাবা জানালো তিনি দুইদিন বাদেই যাওয়ার জন্য রাজী!
কিন্তু এসবের ভীড়ে রোজানের মা কেমন যেন নিশ্চুপ।অনেকবার রোজান সেটা খেয়াল করছিলো, শেষ পর্যন্ত জিজ্ঞাসা করেই ফেললো,
‘ মা তুমি এমন করছো কেন? যেন তুমি একটা জীবন্ত রোবট, কোনো হাসিখুশির রেশমাত্র নেই!
রোজানের মা আশেপাশে একটু তাকিয়ে বললো,
‘ আচ্ছা তুই ভাবছিস সোনালীর কথা তোর বাবাকে আমি বলেছি?
রোজান অবাক চোখ করে বললো,
‘ হুম তুমিই তো বলেছো!
রোজানের মা আস্তে আস্তে বললো,
‘ নাহ আমি বলিনি, উনি অন্য কারো থেকে জেনেছেন। আর আমি কেন জানি কিছুতে আনন্দ পাচ্ছিনা। মনে হচ্ছে খারাপ কিছু হতে চলেছে!
রোজান তার মাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
‘ আমার লোভী বাবার সরল রূপে বিশ্বাস করতে পারছোনা?
তার মা মাথা নাড়লো। রোজান হাসতে হাসতে বললো,
‘ আরে মা কিচ্ছুনা। বাবা মৃত্যুঘাট দেখে এসেছে, এখন আর কিসের জন্য লোভ করবে? কয়দিনই আর বাঁচবে? একদম চিন্তা করোনা, সব ভালোই ভালোই হবে।
রোজানের মা তাও চুপ করে রইলো।
কিন্তু রোজান সেটাকে একদমই পরোয়া করলোনা।
তারপর আসলো সেসময়। তারা রওয়ানা দিয়েছে সেই নির্জন নদীরপাড়ের উদ্দেশ্যে। পেছনে তাদের কয়েকজন লোক সাথে নৌকা নিয়ে ট্রাক দিয়ে আসছে। লোক আনার কারণ হাবিল যাতে আক্রমণ করতে এলেও তারা তাকে সামলাতে পারে!
রোজানের ভেতর তীব্র অনূভুতির ঝড়। আজ কোনো একটা ব্যবস্থা হয়েই যাবে। হাবিল রাজী না হলেও সে অন্য পথ খুঁজে নেবে। সোনালী নিজেই তো তাকে বিয়ে করতে একমত,সেখানে আটকাবে কে?
তারা জঙ্গলের কাছে পৌঁছে সাথে নিলো জসিমকে। বিরাট নৌকা নিয়ে লোকজন এগুতে লাগলো!
এদিকে রোজান আর তার মা বা পেছনে পেছনে ধিরে আসতে লাগলো।
লোকজন নৌকা নদীতে ছাড়তেই রোজান এবং তার মা-বাবা শামিম সহ সেখানে এসে দাঁড়ালো। সবকিছু একদম পরিকল্পনা অনুযায়ী হচ্ছে। ওই পাড়েও আপাতত কাউকে দেখা যাচ্ছেনা। তারা হুট ঘরে প্রবেশ করলে কতটাই না চমক খাবে হাবিল সাহেব!
কিন্তু পাড়ে দাঁড়িয়ে হঠাৎ করেই পাশে জুতার থপথপ আওয়াজে রোজান চমকে উঠলো। চোখ ঘুরিয়ে তাকিয়ে যা দেখলো তা সে একদমই বিশ্বাস করতে পারছিলোনা।
তার মামা, দিয়ালী আর কিছু লোকজন। এরাও সাথে নৌকা নিয়ে এসেছে। রোজান তড়িঘড়ি করে তার বাবার দিকে তাকালো। এক পলকেই দেখে ফেললো তার বাবার মুখে হাসি লুকায়িত করার বৃথা চেষ্টা। রোজান গর্জন করে বলে উঠলো,
‘ তোমাকে বিশ্বাস করেছিলাম বাবা!
চলবে…..
লেখাঃ তাজরীন_খন্দকার