সোনালী [০৮]

0
642

সোনালী [০৮]

জলভরা রাগী চোখে রোজান তার বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। সে ভাবতেই পারছেনা তার বাবা কি করে এমন একটা কাজ করতে পারলো! টাকার লোভে নিজের একমাত্র ছেলের সঙ্গে বেঈমানী? কার জন্য এসব সঞ্চয় করছে? কে আছে আর উনার?
এদিকে তার মামার চোখেমুখে প্রকাশ্য বিজয়ের হাসি , যেন দিয়ালীর সব উপহার উনিই পেতে যাচ্ছেন।

রোজান তার মার দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ তুমি তোমার এমন ভাই, আর এমন স্বামী নিয়ে এতবছর কীভাবে আছো মা?

রোজানের মা মাথা নিচু করে চুপ করে রইলো। এমনটা যে হবে উনি হয়তো আগেই আঁচ করতে পেরেছিলেন। কিন্তু রোজানের বাবা গলা উঁচিয়ে বললো,
‘ রোজান আমি তোমার বাবা! মুখ সামলে কথা বলবে। যা বুঝোনা তা নিয়ে একদম বাড়াবাড়ি করবেনা।

রোজান রাগী চোখে তার বাবার দিকে তাকিয়ে আবার নিজেকে সংযত করলো। তার মামার দিকে এগিয়ে বললো,
‘ ছি! আপনারা এতো নিচু? বিশেষ করে আপনি! আপনাকে বলাটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল, এখন আমি ভুলটা উপলব্ধি করতে পারছি। জিন্দেগীতে আর আপনাদেরকে কোনো ছোট কারণে আমি বিশ্বাস করবোনা।

দিয়ালী সবকিছু শুনছিলো। সে এবার রোজানের কথার মধ্যে নরম স্বরে বললো,
‘ বাবা রাগ করোনা। উনারা তো শুধু আমার মেয়েকে ফিরিয়ে দিতে চাচ্ছে, খারাপ কিছু তো না।

রোজান চিৎকার করে বললো,
‘ এই যে আপনি কান খোলে শুনুন, উনারা আপনার মাতৃত্বের প্রতি দয়াশীল হয়নি, উনাদের টাকা প্রয়োজন, তাই আমার তথ্য অনুযায়ী এই পর্যন্ত চলে এসেছে। আর আমি বোকার মতো আপন ভেবে সবটা বলে দিয়েছিলাম। ওরা আপনাকেও ঠকাতে দুবার ভাব্বেনা। মিলিয়ে নিয়েন!

দিয়ালী কোনো জবাব না দিয়ে বললো,
‘ এই তাড়াতাড়ি ওই পাড়ে চলো না। আমি আমার মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরার তীব্র আকুলতা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিনা।

দিয়ালীর কথায় রোজানের মামার দলের লোকজন নদীতে নামতে লাগলো। এদিকে রোজানের বাবাও তাদের নৌকায় উঠলো। রোজান তার মায়ের সাথে উঠবে বলে দাঁড়িয়ে ছিলো। এদিকে খেয়াল করলো নৌকা তীর ছেড়ে যাচ্ছে, সে দ্রুত পায়ে উঠতে যাবে তখনি তিনি চালককে ইশারা করলেন নৌকা জোরে টানতে। চোখের পলকে নৌকা স্থান পেরুলো। সে তাকিয়ে দেখলো ওই নৌকাটাও পানিতে ভাসছে। মাথার চুলে খামচিয়ে ধরে রোজান চিৎকার করে বললো,
‘ আজকে যদি এই লোক আমার বাবা না হতো, উনাকে আমি কাদার নিচে জ্যন্ত কবর দিতাম। স্বার্থপর মানুষ, কার সাথে এমন করছে একবারও ভাবলোনা।

রোজানের মা আস্তে করে রোজানের পাশে এসে ধির কণ্ঠে বললো,
‘ তোর বাবা আজীবন অর্থের পেছনেই ছুটেছে, তার কাছে স্ত্রী সন্তানদের মূল্য অর্থ সম্পদের চেয়ে কখনোই বেশি ছিল না। একটা সময় খুব কাঁদতাম, তখন আমাদের নতুন নতুন বিয়ে, অথচ উনি রোজ একটা কিংবা দুইটাই ফিরতেন। শুক্রবারটার এক মূহুর্তও বাসায় কাটাতেন না, আর আমি সারাদিন সব সামলে এতো রাত অব্দি অপেক্ষা করে যেতাম। তাও এসে যে আমার সাথে খুব মিষ্টস্বরে কথা বলেছে তা না, আচরণ দেখে মনে হতো আমি বাড়ির চাকর, আর উনার বাড়ি সামলে রাতে উনার আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করাটাই আমার কাজ। তবে কল্পনা করিনি সেটা কখনো নিজের ছেলের উপর দেখাবে! কিন্তু যখন ভাইয়ের মুখে শুনলাম ওই মেয়েকে ফিরিয়ে দিতে পারলে একদিনেই উনার প্রোপার্টির কয়েকগুণ বেশি সম্পত্তির মালিক হতে পারবে, তখনি বুঝে গেলাম উনি মৃত্যু আসলেও এই লোভ ছাড়বেন না। যেটা জীবনের ৫০ বছরে করতে হয়েছে সেটার বেশিকিছু যদি ১ দিনেই পায়, কেই বা সুযোগ হাতছাড়া করবে বল?

রোজান চুপ করে শুনছে। আর তার বাবার প্রতি তীব্র ক্ষোভ জমাচ্ছে। রোজানের মা আবারও বললো,
‘ রোজান শুন মন খারাপ করিস না!

রোজান ফিরে তাকিয়ে বললো,
‘ মা চুপ করো। আমি পাগল হয়ে যাবো! এতো মানুষ একযুগে গেছে, নিশ্চয়ই ওরা সোনালীকে জোর করে দিয়ালীর নিকট তুলে দিবে। আর দিয়ালী মেয়েকে নিয়ে চলে যাবে নিজ দেশে! আর আমি?

বলেই রোজান হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো।

কান্নার মধ্যেই সে হেলিকপ্টারের আওয়াজ শুনে চমকে উঠলো। এটা ওই পাড়ের দিকে এগুচ্ছে। তবে কি এপাড়ে না এসেই দিয়ালী সোনালীকে নিয়ে চলে যাবে? না না একি করে হয়?

দেখতে দেখতে ওরা সবাই নৌকা থেকে নেমে গেলো।আর ধিরে ধিরে হাবিলের বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করতে লাগলো। রোজান হাঁটু ভেঙে বসে আর্তনাদ করে বললো,
‘ আমি লাস্টবার দেখার আগেই আমার সোনালী হারিয়ে যাবে!

তখনি জসিম পাশ থেকে বললো,
‘ তুমি আমার লাইজ্ঞা মেলা করছো বাপ। শেষবার দেহি তোমার লাইজ্ঞা কিছু করাতারি নাকি!

রোজান চোখ তুলে বললো,
‘ কি করবেন আপনি?

জসিম আস্তে আস্তে পানির দিকে অগ্রসর হয়ে বললো,
‘ আমি হাতরাইয়া গিয়া ওইপাড় থেইকা নৌকা নিয়া আমু। তুমি ত জীবনে পানিতে নামো নাই।

রোজান তার মায়ের দিকে তাকালো। একটু আশা পেলো যেন!
এদিকে হেলিকপ্টার থেকে দুইজন বেড়িয়ে বাড়ির ভেতর গিয়েছে। অথচ এখনো কোনো ঝামেলা শোনা যাচ্ছেনা, কিছু হচ্ছেনা কিনা একদম বুঝা যাচ্ছেনা। হাবিল সাহেব কি নিজ ইচ্ছেয় মেয়ে দিয়ে দিবেন নাকি? কোনো হাঙ্গামা করছেন না কারণ কি?
রোজানের ভয় আরো বেড়ে গেলো!

এদিকে জসিম সাঁতরে চলেছে। এতটা জায়গা এই মানুষ কিভাবে সাঁতরে যাবে রোজান জানেনা। তবে তার প্রতি কৃতজ্ঞতায় তার বুক ভরে উঠছে। এতো কষ্ট করতেছে!
এদিকে আধ ঘন্টা হয়ে গেছে ওখান থেকে কেউ বের হচ্ছেনা, জসিমও ওখানে পৌঁছে নৌকা নিয়ে এগিয়ে আসতেছে। রোজান শুধু ভেতরে ভেতরে জপছে তারা হেলিকপ্টারে উঠে যাওয়ার আগেই যেন সে পৌঁছাতে পারে!

একটা বিষয় রোজানের মাথায় যাচ্ছেনা দিয়ালী নৌকা চড়ে পার হলো কেন? চাইলে একদম সেখানেই হেলিকপ্টার দিয়ে নামতে পারতো! এর পেছনে তার মামা কিংবা বাবার কোনো বুদ্ধি জড়িত হয়তো।

জসিম প্রাণপণে নৌকা নিয়ে আসলো। রোজান তার মা আর শামিমকে নিয়ে উঠতেই জসিম আবার নৌকা চালাতে বৈঠায় হাত দিলো। কিন্তু রোজান উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
‘ আমাকে দিন এটা, আপনি ভীষণ ক্লান্ত! আমি চালাতে পারি।

জসিম একবার তাকিয়ে বৈঠাটা রোজানের হাতে দিয়ে নৌকায় বসলো।

কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা সেখানে পৌছে গেলো। রোজান তার মায়ের হাত ধরে দ্রুত পায়ে বাড়ির ভেতরে যেতে থাকলো। একদম নিরব লাগছে সবকিছু। এতো মানুষ আসছে, অথচ শোরগোল নেই ব্যপার কি?

এমন অদ্ভুত নিরবতায় রোজান হঠাৎ ভয় পেলো আর কিছুক্ষণ গিয়ে তার মায়ের হাত ছেড়ে অজানা আতংকে দৌঁড়ে সেখানকার বড় ঘরটায় প্রবেশ করলো। সে হাঁপাতে হাঁপাতে প্রবেশ করেই দেখলো, সবাই মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে!
রোজানকে সেখানে হন্তদন্ত হয়ে যেতে দেখেই তার মামা দাঁড়িয়ে বললো,
‘ এভাবে আমাদের নাকে দঁড়ি দিয়ে না ঘুরালেও পারতে রোজান!

রোজান অবাক চোখে বললো,
‘ মানেহ?

রোজানের বাবা উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
‘ এই মেয়ে সোনালী?

রোজান তাকিয়ে দেখলো তারা একটা মেয়ের দিকে ইশারা করে বুঝাচ্ছে এটাই সোনালী কিনা। রোজান মাথা নেড়ে বললো,।
‘ এটা সোনালী হবে কেন?

হাবিল সাহেব দাঁড়িয়ে বললো,
‘ তো কেডা সোনালী? আমার মাইয়া আমি চিনিনা?

রোজান দেখলো মেয়েটা কুচকুচে কালো। হাবিলের মতোই চেহেরা। ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
রোজান এগিয়ে বললো,
‘ তোমার নাম কি?

মেয়েটা আস্তে আস্তে বললো,
‘ সোনালী!

রোজান চোখ বড় বড় করে পিছিয়ে গেলো!

চলবে……

লেখাঃ তাজরীন_খন্দকার

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here