মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর-৩৬,৩৭

0
480

#মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর-৩৬,৩৭
মাহফুজা_আফরিন_শিখা
৩৬

৪৫,
জ্যোৎস্না রাত আলােকময় প্রকৃতির এক বৈচিত্র্যময় উপহার। ভরা পর্ণিমার রাতে নিটোল চাদ তার ঝলমলে আলাের পসরা নিয়ে উপর আকাশে আবির্ভূত হয়। চাদনি রাত প্রকৃতিপ্রেমী মানুষের মনে বিচিত্র ভাব ও উদ্দাম আনন্দের সঞ্চার করে। চাদনি রাতের নৈসগিক পরিবেশ যেমন দৃষ্টিনন্দন, চিত্তাকর্ষক তেমনি উপভােগ্য।
চাদনি রাতের মােহনীয় রূপ-সৌন্দর্য প্রতিটি মানুষের মনেই রং ধরায়। সুখ-শয্যায় ঘুম আসে না, অথচ ঘুম না আসার কোনাে গ্লানিও অনুভূত হয় না। কেমন যেন বুকের তলে জমা হয়, অথচ সেই ভাব প্রকাশের ভাষা নেই । মূলত জ্যোৎস্নার মায়াবী রাঙিয়ে তােলে মানুষকে। অথচ এমন একটা মায়াময়ী রাতের সৈয়দ নওশাদের মনে পড়ছে বিষাদের কথা। মাহবুবার সাথে করা অন্যায়ের কথা। কতনা অমানুষিক কষ্ট দিয়েছে সে মাহবুবাকে। মেয়েটা সব মুখ বুজে সহ্য করে নিয়েছে। কখনো প্রতিবাদ করেনি। অথচ আজ তার জায়গায় এসে রাজত্ব করছে আফিয়া। জায়গাটা এক শুধু চরিত্র দুটো আলাদা। একজন যে সবার অপমান সহ্য করে হাসি মুখে সবার আদর যত্নকরে যেত আর অপরজন যে সবার উপর অত্যাচার করে বেড়ায়। কিছুক্ষণ আগেও আফিয়া আহমেদের সাথে ঝগড়া হয়েছে সৈয়দ নওশাদের। ঝগড়ায় বিষয়টা হলো সৈয়দ নওশাদের মা। সৈয়দা কেন তার মাকে নিয়ে আশ্রমে রেখে আসে না, কেন তাকে এত আদর যত্নকরে! কেন সৈয়দ নওশাদ তার মা-কে নিয়মিত ঔষুদ দিয়ে তাকে সুস্থ করে তুলছে। বুড়ো মানুষ দুদিন পর তো মরেই যাবে তাহলে কেন তার পিছনে এত টাকা খরচ করছে সে, সেটা নিয়েই আফিয়া আহমেদের সাথে তুমুল ঝগড়া হয় সৈয়দ নওশাদের। ঝগড়ায় এক পর্যায়ে সৈয়দ নওশাদ তার মেয়ে আর মা-কে নিয়ে বাড়ি থেকে চলে যেতে চাইলে আফিয়া সেখানেও বাধা হয়ে দাঁড়ায়। রাহি আর সৈয়দ নওশাদকে তিনি কোথাও যেতে দিবেন না। তখন সৈয়দ নওশাদ আফিয়া আহমেদকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলে, কারন তিনি তার সাথে একই বাড়িতে থাকতে পারবেন না। যে মানুষটা আফিয়া আহমেদকে ভালোবাসা ছাড়া কোন দিন মোটা স্বরে কথা বলে নি সেই মানুষটা তাকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলে। অভিমানে বাড়ি ছেড়ে চলে যায় আফিয়া আহমেদ। আফিয়া আহমাদের চলে যাওয়ার পর সৈয়দ নওশাদ হাটু গেরে সেখানেই বসে পরেন। সত্যিটা এটাই যে তিনি আফিয়া আহমেদকে খুব ভালোবাসেন। প্রথম যেদিন দেখেছে তার পর থেকে আজ অব্ধি শুধু তাকে ভালোবেসে গিয়েছে। তাকে ভালোবেসে তার সকল অন্যায়গুলোও হজম করে নিয়েছেন। অথচ আজ তাকেই বাড়ি থেকে বের করে দিলেন সৈয়দ নওশাদ।কোথায় যাবে আফিয়া! কার দুয়ারে দাঁড়াবে সে! এই ভু-খন্ডে সৈয়দ নওশাদ ছাড়া আফিয়ার আর কেউ আছে বলে জানা নেই তার।বুকে হাত রেখে হাটু গেরে বসে পড়েন। এর আগে তিনি কখনো এতটা ভেঙে পড়েন নি। বুকের বা পাশটা খুব ব্যাথা করছে। নিজেই নিজের বুকের উপর মালিশ করতে থাকেন সৈয়দ নওশাদ। নাহ, ব্যাথাটা কিছুতেই কমছে না। আরে গাঢ় হচ্ছে। রাহিকে ডাকবে, কথা বলতে পারছে না সৈয়দ নওশাদ। গলায় এসে সব কথা কুণ্ডলী পাকিয়ে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে সে নুইয়ে পরে।

আফিয়া আহমেদ যখন বাড়ি ছেড়ে চলে যায় তখন রাহি ড্রয়িংরুমে বসে মোবাইলে গেইম খেলছিলো। সৈয়দ নওশাদের মা তাকে আটকাতে গেলেও রাহি সেখানেই বসে ছিলো। রাহি বারবার করে চাইছিলো তার মা নিজ চলে যাক। পরে নিজের ভুলগুলো বুঝতে পারুক। সে তার ভুলের জন্যে সকলের কাছে ক্ষমা চান। কিন্তু আফিয়া আহমেদ সেটা করেন নি। সে নিজের জেদ বজায় রাখতে বাড়ি থেকে চলে যায়। এতে যেন রাহির কোন আপসোস নেই। সে আগের ভঙ্গিতে বসে বসে গেইম খেলছে আর আইসক্রিম খাচ্ছে।

– পড়ালেখা বাদ দিয়ে সারাদিন মোবাইল টিপবি আর অপথ্য গুলো খাইবি। খাবি, তাইলো ভালো কিছু খা, যেগুলা খাইলে বল শক্তি বাড়বো সেগুলা খা, তা না করে সারাক্ষণ শুধু অপথ্য জিনিসগুলা খাবি। আইসক্রিমের বাটিটা নিয়ে কঠিন গলায় কথাগুলো বলল রাহির দাদী।

দাদির কথাশুনে রাহি কপাল কুচকে সামনে তাকায়। মোবাইলটা অফ করে রেখে, দাদিকে উদ্দেশ্য করে বলে,

– উহঃ দাদী তোমাকে না নভেল দেওয়া উচিৎ। এত মজা করে আইসক্রিম খাচ্ছিলাম তুমি আমার মজাটা নষ্ট করে দিলে। এবার আমাকে আইসক্রিমেী বাটিটা দাও। আর যাও তোমার ছেলেটাকে কিছু খাইয়ে দিয়ে এসো।

– বাবা হয় তো। সুন্দর করে কথা বল।

– ঠিক আছে ঠিক আছে। এখন যাও বাবাকে কিছু খাইয়ে দিয়ে তুমিও খেয়ে নাও। তুমি আমাকে আইসক্রিমের বাটিটা দিচ্চো না কেন? খাবা দিয়ে দাদির হাত থেকে বাটিটা নিয়ে নেয় রাহি। দাদী কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে রাহির পাশে বসে পরে। রাজি কপাল কুঁচকে দাদীর দিকে তাকিয়ে বলে,

– তোমার আবার কি হলো?

– আফিয়াকে আটকালি না কেন? সবাই কি বলবে, শ্বাশুড়ি এসেই ছেলে আর বউয়ের মাঝে ঝগড়া লাগিয়ে দিয়েছে। ছেলের বউটাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে।

দাদীর কথাগুনে রাহি দাদী হাতের উপর হাত রেখে বলে,

– পাছে লোকে কিছু বলে! বলুক না তাতে তোমার আমার কি যায় আসে। পিছে তো কু*ত্তাও ঘেওঘেও করে। দেখ দাদী কিছু মানুষ আছে যাদের কাজই হলো পরনিন্দা পরচর্চা করা। নিজের খাবে আর মানুষের গীত গাইবো। তারা ভালো কাজের নিন্দে করে আর খারাপ কাজের উৎসাহ দেয় তাদের ভয়ে তো আমরা আমাদের মানুষত্বটাকে বিসর্জন দিতে পারি না। মায়ের চলে যাওয়া নিয়ে আমার কোন আপসোস নেই। দুষ্ট গরুর চেয়ে শুন্য গোয়াল অনেক ভালো। দাদী, তোমাকে আশ্রমে থাকতে হয়েছে। মেহের আপুকে মরণ যন্ত্রনা ভোগ করতে হয়েছে সেই তুলনায় আফিয়া আহমেদ তো কোন শাস্তুি পায়নি। তুমি কোন চিন্তা করো না দাদী সে ফিরে আসবে। দেখে নিও তুমি মা আবার এই বাড়িতে ফিরে আসবে। অধোর চেপে হাসে রাহি।

– মেহের এখন কেমন আছে রে রাহি?

– ভালো। রাহি আবার মনোযোগ দেয় মোবাইলে গেইম খেলার। দাদী উঠে একটা প্লেটে খাবার সাজিয়ে চলে যায় সৈয়দ নওশাদের রুমের দিকে।

সৈয়দ নওশাদের রুমের লাইট অফ করা। রাতের বেলা চোখে দেখতে পান না তিনি তবুও হাতের সাহায্যে এগিয়ে গিয়ে লাইট অন করেন। পুরো রুমে চোখ বুলিয়েও সৈয়দ নওশাদকে দেখতে পেলেন না। খাবারটা টেবিলের উপর রেখে বারান্দায় চলে যান। সেখানে গিয়ে সৈয়দ নওশাদকে দেখেই দু-হাতে মাথা চেপে ধরে, চিৎকার করে উঠেন।

৪৬,
কলেজ কতৃপক্ষ একটা সংস্কৃতি অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে চাইছে। এবার তাদের তাদের কলেজ ডিবেট এ বিজয়ী হয়েছে মূলত সেই কারনে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা। মেহের এতদিন অসুস্থ ছিলো তাই করা হয়নি। এখন মেহেরও সুস্থ। মেহেরের সাথে কথা বলে আজ থেকেই অনুষ্ঠানের আয়োজন শুরু করা হয়েছে। কলেজে পাঠদান কার্যক্রম বন্ধ। সবাই এখন অনুষ্ঠানে মনোনিবেশ করছে। মেহেরকে নৃত্য পরিবেশনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

হলরুমে যখন মেহের সবার নাম লেখছিলো তখন কলেজের নতুন স্যার আড়াল থেকে তাকে দেখছিলো। তার চোখে ছিলো একরাশ মুগ্ধতা। নাম লেখার ফাঁকেফাঁকে মেহের যখন সবাইকে নাচের স্টেপগুলো দেখিয়ে দিচ্ছিলো তখন তার অধোরে ছিলো মুগ্ধকর হাসি। প্রিন্সিপ্যালের ডাকে পিছনে ফিরে তাকায় নতুন স্যার। নতুন স্যার প্রিন্সিপ্যাল স্যারকে সালাম দিয়ে
সুধায়,

– স্যার আপনি!

– এখানে কি করছো তুমি আহসান।

মেহেরের দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসে আহসান। অতঃপর বলে,

-এমনি, দেখছিলাম আর কি!

প্রিন্সিপ্যাল স্যার হয়তো তার দৃষ্টি লক্ষ করেছে তাই সে আহসানের কাঁধে হাত রেখে বলে,

– মেয়েটা ভিষন ভালো। তোমাকেও আমার পছন্দ হয়েছে!

স্যারের কথাশুনে অবাক চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকে আহসান। এই স্যার বলে কি! আহসানের এমন অবাক করা দৃষ্টি দেখে স্যার মৃদু হেসে বলে,

– মেহেরকে সাহায্য করো গিয়ে। মেয়েটা একা এটা ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছে ।

আহসান গিয়ে মেহেরের পাশে দাঁড়াতেই মেহের আহসানকে সাইড দিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। হল রুমের সবাই তখন তাদের পারফরমেন্সে মন না দিয়ে আহসানের দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে। আর আহসানের দৃষ্টি স্থির মেহেরের দিকে। মেহের কয়েকজনের নাম লিখে তাদের নাচের স্টেপগুলো দেখিয়ে দিতে যাবে এমনি সময় তার মোবাইলে রিংটোন বেজে উঠে। ব্যাগ থেকে মোবাইলটা বের করতেই দেখতে পায় স্কিনে রাহনাফের নামটা জ্বলমল করছে। খুশির ঝলক ফুটে উঠে মেহেরের চোখ মুখে। সে তার এক সহপাঠীকে দায়িত্ব দিয়ে সেখান থেকে বেড়িয়ে আসে। পিছন থেকে আহসান করুন চোখে তাকিয়ে থাকে মেহেরের চলে যাওয়ার দিকে। মেহের চলে আসাতে তার মুখে বিরক্তি ভাব প্রকাশ পায়। আহসানও সেখান থেকে চলে আসে।

মিষ্টি সূরে হেসে হেসে কথা বলে রাস্তাদিয়ে হেটে যাচ্ছে মেহের। হঠাৎ করেই কেউ তার হাত ধরে টান দেয়। মেহের চিৎকার দিতে চাইলে লোকটা ওর মুখ চেপে ধরে। তারপর ওকে টানতে টানতে একটা বিল্ডিং এর পাশে নিয়ে গিয়ে মেহেরের মুখ ছেড়ে দেয়। ছাড়া পেয়ে বড় বড় করে কয়েকবার শ্বাস নিয়ে কঠিন গলায় বলে উঠে,

– এটা কেমন আচরন! আমার প্রাণটাই বের হয়ে যাচ্ছিলো।

মেহেরের রাগ দেখে মৃদু হাসে রাহনাফ। এতে মেহেরের রাগটা আরো বেড়ে যায়। সে রেগে গিয়ে রাহনাফের গলা চেপে ধরতে যায় তখন রাহনাফ তার হাত ধরে হাতের মধ্যে চুমু খেয়ে বসে। বিস্মিত চোখে তাকায় মেহের। তখন রাহনাফ তাকে চোখ টিপ দিয়ে হাটু গেরে বসে পরে। ঘটনার আকস্মিক আরো বেশী অবাক হয়ে যায় মেহের।সে অবাক চোখে ফ্যালফ্যাল করে রাহনাফের দিকে তাকিয়ে থাকে। রাহনাফ মেহেরের দৃষ্টি উপেক্ষা করে বলে,

– পা-টা দাও।

– মানে!

রাহনাফ কিছু না বলে মেহেরের পায়ের জুতা ছাড়িয়ে নিয়ে পর হাটুর উপর রাখে। তারপর সে তার পকেট থেকে একটা পায়েল বের করে সেটা মেহেরের পায়ে পড়িয়ে দেয়। অবাক হয়ে যায় মেহের সাথে খুশিও। সে এতটাই খুশি হয়েছে সে কিছু বলার ভাষা হাড়িয়ে ফেলছে।

– একদম পারফেক্ট। মেহেরকে আবার জুতা পড়িয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ায় রাহনাফ। তারপর বলে,

– পছন্দ হয়েছে লেখিকা সাহেবা?

মেহের কোন কথা বলে না শুধু তার দিকে তাকিয়ে থাকে। রাহনাফ ধরে নেয় এটা মেহেরের পছন্দ হয়নি। সবাই যোখানে গার্লফেন্ডের বড় বড় গিফ্ট দেয় সেখানে রাহনাফ দুইশো টাকার একটা পায়েল কিনে দিয়েছে। এমনটা ভাবাই স্বাভাবিক। মেহের রাহনাফের হাতের উপর হাত রেখে বলে উঠে,

-ভিষন। খুব খুব পছন্দ হয়েছে আমার। রাহনাফের মুখে হাসি ফুটে উঠে। মেহের আবার বলে উঠে,

– আমার চাহিদা এত বড় নয় রাহনাফ। আপনার এই ছোটছোট গিফ্টগুলো আমাকে যতটা আনন্দ দেয় সেটা বড় বড় কোন গিফ্টে পাওয়া যাবে না। আসলে ছোট বিষয়ে আনন্দটা একটু বেশীই। জানেন ছোট বেলাতে পাঁচ টাকা নিয়ে স্কুলে যেতাম। দুই টাকার ঝাড়মুড়ি খেতাম দুই টাকার ফুসকা খেতাম। আর এক টাকা রেখে দিতাম লজেন্সের জন্যে। এক টাকায় চারটা লজেন্স কিনে খেতে খেতে বাড়ি ফিরতাম। আর সেটাতেই অনেক খুশি ছিলাম। আর এখন দুই তিনশো টাকার চকলেট খেয়েও সেই আনন্দ পাইনা। আমার সেই পাঁচ টাকার আনন্দটা এখন হাজার টাকায়ও খুজে পাইনা। আপনি সেই রকম আমায় ছোট ছোট জিনিস দিয়ে আনন্দ রাঙিয়ে তুলুন রাহনাফ। এতেই আমি অনেক খুশি।

মেহেরের হাতের উপর হাত রাখে রাহনাফ অতঃপর বলে,

– চল আমার সাথে। তারপর সে মেহেরের হাত ধরে টেনে সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে।

চলবে,,,

#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।

#মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর। [৩৭]

রাহনাফ মেহেরকে নিয়ে শহর ছেড়ে একটু দূরে একটা মেলায় চলে যায়। মেলার সামনে বড় করে ব্যানারে সাঁটানো হয়েছে, নবান্ন উৎসব। লেখাটা দেখে মেহের প্রশ্নবোধক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রাহনাফের দিকে। রাহনাফ মৃদু হেসে জবাব দেয়,

– সাত দিনের মেলা, আজই শেষ।

– ওহ আচ্ছা। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবার বলে, আপনি কি আগেও এখানে এসেছেন?

– গতকাল এসেছিলাম। আচ্ছা চুড়ি নিবে চুড়ি? চল ওদিকে যাই।

এত মানুষের ভীড়ে রাহনাফ মেহেরের হাতটা ধরে চুড়ির দোকানে নিয়ে যায়। তারপর নিজের পছন্দমত কিছু চুড়ি মেহেরের দু-হাতে পরিয়ে দেয়। মেহের চুড়ি পরে নিজেই দু-হাত নাড়িয়ে খিলখিল করে হাসে। রাহনাফ মুগ্ধ হয়ে সেই হাসির দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। মেহেরের এমন প্রাণ উচ্ছল হাসি দেখলে রাহনাফের মনটা শীতল হয়ে যায়। তারপর ঝিনুকের কানেরদুল পরিয়ে দেয় মেহেরের কানে। মেহের মিররে নিজেকে দেখতে ব্যাস্ত আর রাহনাফ চুড়ি কানের দুলের দাম মিটিয়ে নেয়। ওয়ালেটটা পকেটে পুরে মেহেরের হাত শক্তকরে ধরে মেলার অন্যপান্তে নিয়ে যায়। সেখানে ছিলো অনেক মানুষের ভীড়। এত মানুষের ভীড় দেখে মেহেরের মনে উৎসাহ জাগে ওখানে কি হচ্ছে সেটা জানার জন্যে। মেহের বেশ উৎসাহ নিয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। ব্যপারটা রাহনাফ লক্ষ করতেই স্মিত হেসে বলে,

– ম্যাজিক দেখবে?

– কিসের ম্যাজিক!! পাল্লাপ্রশ্ন মেহেরের।

ভ্রুদ্বয় সংকোচিত করে মেহেরের দিকে তাকায় রাহনাফ। অতঃপর বলে,

– প্রশ্নটা আমি আগে করেছি। ম্যাজিক তো ম্যাজিক-ই হয় তাইনা লেখিকা সাহেবা।

– দেখবো। ইনোসেন্ট মুখ করে বলে মেহের।

রাহনাফ সামনের ভীড় ঠেলে দু-হাতে মেহেরকে আগলে সামনে চলে যায়। সামনে যেতেই অবাক হয়ে যায় মেহের। সেখানে দুজন মাধ্যবয়স্ক মহিলা আর কয়েকজন বাচ্চা মিলে সবাইকে ম্যাজিক দেখাচ্ছে। মেহের মনোযোগ দিয়ে দেখছে। বাচ্চাগুলোর ম্যাজিক তার কাছে বেশী ভালো লাগছে। তারা ম্যাজিকের সাহায্যে একে অপরকে ভয় দেখাচ্ছে। মেহের ম্যাজিক দেখছে আর হাত নাড়াচ্ছে। নিজের কৌতুহল দমাতে না পেরে সে বলে উঠলো, আমিও দেখাবো ম্যাজিক। কথাটা জোরে না বললেও একজন ম্যাজিশিয়ান সেটা শুনতে পায়। সে হাতের ইশারায় মেহেরকে তার কাছে ডাকে। মেহের রাহনাফের দিকে করুন চোখে তাকায়। সে ওই মাধ্যবয়স্ক মহিলার কাছে যেতে ভয় পাচ্ছে । রাহনাফ আলতো করে মেহেরের হাত ধরে ওকে চোখের ইশারায় শান্ত হতে বলে ম্যাজিশিয়ানের কাছে নিয়ে যায়। মাধ্যবয়স্ক ম্যাজিশিয়ান মেহেরকে পা থেকে মাথা অব্ধি অবলোকন করে নিয়ে মেহেরকে তার পাশে বসিয়ে দেয়। অতঃপর সুধায়,

– কে হয় এটা তোর! বর??

মেহের শান্ত দৃষ্টিতে রাহনাফের দিকে তাকায়। রাহনাফ ও উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেহেরের মুখ পানে। মেহের কি জবাব দেয় সেটা দেখার জন্যে। অধোর চেপে হাসছে রাহনাফ। মেহের তার দৃষ্টি শক্তকরে ফেলে। রাহনাফের হাসি যেন আরো বেড়ে যায়। সামনের দিকে তাকিয়ে জবাব দেয়,

– আমরা বিবাহিত ন,,,

পুরো কথাটা বলার আগেই অর্ধবয়স্ক মহিলা বলে উঠে,

– নতুন বিয়ে হয়েছে মনে হচ্ছে। তাকা আমার চোখের দিকে। মেহের তার কথামতো তার চোখের দিকে ভীতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। অর্ধবয়স্ক ম্যাজিশিয়ান ম্যাজিক করে মেহেরকে মিষ্টি কালারের শাড়ি পড়িয়ে দেয়। বিস্মিত হয়ে দু-হাতে মুখ চেপে ধরে মেহের। উপস্থিত সকলে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে মেহেরের দিকে। রাহনাফের চোখ যেন মেহেরের উপর থেকে সরছেই না।

শাড়ি পরে মেলার ঘুরে মেহের। রাহনাফ সব সময় মেহেরের হাত ধরে ওকে আগলে রেখেছে। বাড়ি ফেরার সময় রাহনাফ একটা বেলী ফুলের মালা কিনে নেয় মেলা থেকে আর সেটা মেহেরের চুলে গুজে দেয়। মেহেরকে মেহেরের বাড়ি পৌঁছে দিয়ে সে দুদিনের জন্যে শহরের বাইরে চলে যায়। রাহনাফ তার পৈতৃক বাড়িতে ফিরে যায়। কোন সমস্যার সমাধান করতে হলে আগে গোড়া থেকে জানতে হয়। রাহনাফ তার পৈতৃক বাড়িতে থেকেই সব সমস্যার সমাধান করবে।

৪৭,
রাতের আধার কাটিয়ে পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে।
এক সোনালি সকালের দেখা মিলেছে। যদিও হসপিটালে সকাল দুপুর রাত এটা বুঝা বড় দায়। নিচে কিছু পরার শব্দে ঘুৃম ভাঙে রাহির। চোখ মেলে তাকাতেই দেখতে পায় তার বাবা হাত নাড়াচ্ছে। হাত বাড়িয়ে পাশ থেকে গ্লাস নেওয়ার চেষ্টা করছিলো সে আর তখন গ্লাসটা নিচে পরে যায়। খুশিতে চোখে পানি এসে যায় রাহির। দুদিন ধরে তো এই দৃশ্য দেখার জন্যে সে হসপিটালে পরে আছে। সেদিন রাতে সৈয়দ নওশাদ হার্ট এট্যাক করেন। দুদিন পর আজ চোখ মেলে তাকিয়েছে। রাহি দ্রুত পায়ে সৈয়দ নওশাদের কাছে গিয়ে জিগ্যেস করে,

– বাবা তুমি পানি খাবে?

সৈয়দ নওশাদ কোন জবাব দেয়না শুধু ফ্যালফ্যাল নয়নে তাকিয়ে থাকে রাহির দিকে। রাহি কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। তাই সে বোতল থেকে অন্য একটা গ্লাসে পানি দিয়ে সৈয়দ নওশাদকে খাওয়ানোর চেষ্টা করে কিন্তু সৈয়দ নওশাদ খেতে পারে না। কিন্তু মেয়ের মন রাহির। বাবা পানি খেতে চেয়েছে এমতাবস্থায় কোন মেয়েকি পারে তার বাবাকে পানি না দিয়ে থাকতে। রাহি নিজের হাতে পানি ঢেলে একটু একটু করে সৈয়দ নওশাদের মুখে পানি ঢেলে দেয়। তারপর সে সৈয়দ নওশাদের দিকে তাকিয়ে এক গাল হাসে। চোখের পানি মুছে বলে,

– আমি ডক্টরকে ডেকে নিয়ে আসছি।

লম্বা পা ফেলে বেরিয়ে যায় রাহি। সৈয়দ নওশাদ রাহির চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। কিছুক্ষণ পর ডক্টর এসে সৈয়দ নওশাদকে কিছু টেষ্ট করিয়ে নেয়। টেষ্টের রিপোর্ট সরুপ রাহি জানতে চাইলে ডক্টর চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ। ততক্ষণে রাহির দাদিও হসপিটালে পৌছে যায়। ছেলের জ্ঞান ফিরার কথা জানতে পেরে তিনি আর বাড়িতে বসে থাকতে পারেন নি।

মুখোমুখি বসে আছে ডক্টর আর রাহি, ওর পাশেই বসে আছে আলিহান । রাহির চোখ অশ্রুতে ভরে গেছে। ঠোঁট কাপছে। বুক ফেটে কান্না আসছে তার। আলিহান রাহির এক হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে। তারও কস্ট হচ্চে খুব। ডক্টর তাকিয়ে আছে রাহির মুখের দিকে। মেয়েটাকে দেখে তার মায়া লাগছে খুব। দুদিন ধরে একা একা তার বাবার জন্যে কত কষ্ট করেছে তাইতো ডক্টর রাহিকে এমন একটা খবর দিতে চাইছিলেন না। কিন্তু কি আর কারার! সত্যিটা তো সবাইকে জানাতে হবে। রাহি কান্নামিশ্রত সূরে বলে উঠলো,

– আমার বাবাকি আর কখনো হাটতে পারবে না ডক্টর।

সৈয়দ নওশাদের প্যারালাইজড হয়ে গেছে। তার বা পাশটা প্যারালাইজড হয়েছে। এমন একটা খবর যে কোন সন্তানের কাছেই দুঃখজনক। রাহির কাছেও তাই। ডক্টর রাহির দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,

– হয়তো। বড় করে শ্বাত ত্যাগ করে অধোর কামড়ে নিয়ে তিনি আবার বলতে লাগলেন, পক্ষাঘাতগ্রস্থ মানুষের দেহের অভ্যন্তরের স্নায়ুগুলোকে ‘পুনর্বহাল’ করে বা বলা যায় ‘জোড়া লাগিয়ে’ আবারো তাদের হাত ও বাহু নাড়ানোর ব্যবস্থা করা গেছে, এমনটা বলছেন একজন অস্ট্রেলিয়ান শল্য চিকিৎসক।
ব্রিসবেনের ৩৬ বছর বয়সী পল রবিনসন বলছেন যে, এই উদ্ভাবনী অস্ত্রোপচার তাকে এমন এক ধরনের স্বাধীনতা এনে দিয়েছে যেটি তিনি কখনো কল্পনাও করেননি।
সম্পূর্ণ স্বাভাবিক কাজকর্ম করার ক্ষমতা হয়তো এর মাধ্যমে আনা সম্ভব নয়, তবে ডাক্তাররা বলছেন এতে করে জীবনের পরিবর্তন আনা সম্ভব।
মেরুদণ্ডে কোন আঘাত প্রাপ্তির ফলে মস্তিষ্ক থেকে কোন সংকেত শরীরের অন্য কোন অংশে আর যেতে পারে না। আর এই অবস্থার ফলেই পক্ষাঘাত বা প্যারালাইসিস হয়।
যাদের বিশেষ করে কোয়াড্রিপ্লেজিয়া এফেক্ট ঘটে প্যারালাইসিসের ক্ষেত্রে তাদের বেশিরভাগ অঙ্গই সাড়া দেয় না।তবে কিছু ক্ষেত্রে তাদের উপরের বাহুর পেশী নাড়াচাড়া করার মতো অবস্থা থাকে।তখন মেরুদণ্ডের সাথে সেইসব সচল স্নায়ুগুলোর সংযোগ ঘটানো হয়। ফলে পেশীগুলো আবারো সাড়া দিতে পারে।মেলবোর্নের অস্টিন হেলথ এর ডা. নাতাশা ভ্যান জিল বলছেন, “আমার বিশ্বাস করি নার্ভ ট্রান্সফার সার্জারি প্যারালাইসিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্যে একটি দূর্দান্ত বিকল্প। প্রতিদিনের কাজগুলো করতে হাতের কর্মক্ষমতা ফিরিয়ে দেবার সম্ভাবনা তাদের জীবনে আরো স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনে। তবে পেশেন্টের সুস্থতা নির্ভর করে সময়ের উপর। আপনি কত দিনে রোগীর চিকিৎসা করাচ্ছেন। ছয় থেকে এক বছরের মধ্যে চিকিৎসা করালে রোগীর ভালো হওয়ার সম্ভবনা বেশী।

– তাহলে কি বলতে চাইছেন আপনি, আমার বাবা ভালো হয়ে যাবে! উৎফুল্ল হয়ে বলল রাহি।

– উনার ভাগ্যের উপর নির্ভর করে সেটা।

রাহি মনে মনে প্রতিঞ্জা করে এই অশ্রপ্রচার সে তার বাবাকে করাবে। যে করেই হোক তার বাবাকে সুস্থ করে তুলবে সে। আলিহান আর রাহি দুজনেই ডক্টরের কেবিন থেকে বেড়িয়ে সৈয়দ নওশাদের কাছে চলো আসে। আফিয়া আহমেদ এখনো বাড়ি ফিরে নি। সে কোথায় আছে সেটা এখনো সবার অজানা। তবে আফিয়া আর ফিরবে না?

চলবে,,,,,,

#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here