Mr_Calculus (পর্ব – ১২)

0
515

#Mr_Calculus (পর্ব – ১২)

এক মাস পর পুষ্প কনফার্ম হয় সে মা হতে চলেছে! সে এই খুশিটা রিফাতের সাথে কীভাবে শেয়ার করবে সেই উত্তেজনায় অস্থির। পরদিন ভোর বেলা সে দুজনের জন্য দুকাপ চা বানিয়ে নিয়ে রিফাতের ঘুম ভাঙায়। রিফাত চোখ মেলতেই অবাক হয়ে যায়… তার বুনো ফুলটা এই সাত সকালে পার্পেল কালারের শাড়ি পরে সুন্দর করে সেজে গুজে তার ঘুম ভাঙাচ্ছে! সে তার বিস্মিত ভাব কাটিয়ে উঠে বলল-

-এই সাত সকালে কোথায় যাচ্ছ?

-চা খেতে।

-চা খেতে! কোথায়?

-তোমার সাথে, আর… কোথাও যাচ্ছি না, এই ঘরেই, এইখানে বসেই তোমার সাথে চা খাব। এবার উঠে এই পাঞ্জাবিটা পরে নাও, জলদি।

-তুমি কী নরমালি বলবে কী হচ্ছে এসব?

-আগে পাঞ্জাবি পরে নাও বলছি সব। জলদি করো।

রিফাত তার টিশার্ট খুলে পাঞ্জাবি পরে নিল। পাঞ্জাবি পরার পর পুষ্প চায়ের ট্রে নিয়ে এসে রিফাতের সামনে রাখল। রিফাত দেখল সেখানে দুটো কাপের পাশে ছোট্ট আরও একটা কাপ আর একগুচ্ছ হলুদ গোলাপ রাখা। সে পুষ্পর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। পুষ্প বলল-

-বুঝতে পারোনি?

-না!

-এখানে কয়টা কাপ?

-৩টা।

-আমরা মানুষ কয়জন?

-দুইজন।

-উহু, হয়নি। এখানে কাপ যে কয়টা মানুষও সেই কয়জন। মানে ৩জন।

-রিফাত প্রথমে বুঝল না পরে পুষ্পর মুখে লজ্জামাখা হাসি দেখে বুঝে গেল। তখন সে আনন্দে পুষ্পকে জড়িয়ে ধরল। পুষ্প সেই সময় কয়েকটা সুইট সেলফি নিয়ে নিল। বাবা-মা হবার প্রথম মুহূর্ত থেকেই সে সবটুকু আনন্দ ধরে রাখতে চায়।

পুষ্পর মা হবার খবরে এবাড়িতে আবার প্রাণ ফিরে এলো। সবাই আনন্দে ঝলমল করে উঠল। কেবল তানিয়ার বুক থেকে হাহাকার গেল না। সে এখনো উদাস নয়নে আকাশের দিকে ঠায় তাকিয়ে থাকে। দিন দিন সে কেমন রোগাও হয়ে যাচ্ছে! ঠিক মত খায় না, ডাকলে সাড়া দেয় না… কেমন অন্য এক জগতে বাস করে যেন! এই তানিয়াকে দেখতে রাইয়ানের আজকাল খুব ভয় হয়। তার কেবলই মনেহয় সে তানিয়াকে হারিয়ে ফেলছে… খুব ধীরে নি:শব্দে সে হারিয়ে যাচ্ছে… সবার মাঝে থেকেও সবার অন্তরালেই হারিয়ে যাচ্ছে। যেটা শুধু রাইয়ান সশব্দে টের পাচ্ছে অন্য কেউ না!

রেহানা ইসলাম পুষ্পর খুব যত্ন করতে লাগলেন। আজকাল তিনি আবার সরব হয়ে গেছেন। প্রথম ৩মাস পুষ্পর খুব কষ্ট হল। কিছুই খেতে পারে না। যা খায় তাতেই বমি হয়। রিফাত তাকে নিয়মিত চেকাপ করাতে নিয়ে যায় সাথে রেহানা ইসলামও যান। তিনি এবার একটু বেশিই সচেতন যেন! পুষ্প এই অবস্থাতেও বেশ ভালোই পরীক্ষা দিল। পরিস্থিতি এমন হতে পারে ভেবে আগে থেকেই সে প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল তাই এখন এসে চাপ নিতে হয়নি আর রিফাত তো আছেই তাকে সাহায্য করতে।

পুষ্পর যখন ৬মাসে পরল তখন রিফাত এক বিকেলে কী এক দরকারে ভাইয়াকে খোঁজ করতে করতে ছাদে চলে যায়। ছাদে গিয়ে কাউকে দেখতে না পেয়ে ফিরে আসতে যাচ্ছিল কিন্তু এমন সময় সে কারো ফুপিয়ে কান্নার আওয়াজ শুনতে পায়! সে তখন কান্নার শব্দ লক্ষ্য করে এগিয়ে গিয়ে দেখে তার ভাইয়া পানির টাংকির আড়ালে দাঁড়িয়ে কাঁদছে!!! রিফাত স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। সে আস্তে করে ডাকল ভাইয়া…

রাইয়ান পেছনে তাকিয়ে রিফাতকে দেখে হুরমুর করে কেটে ফেলা গাছের মত ভেঙে পড়ল… রিফাতকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকল-

-আমার সাথে এমন কেন হল রিফাত? তোর ভাবিকে দেখেছিস? এত চেষ্টা করছি অথচ মেয়েটা দিন দিন কেমন শেষ হয়ে যাচ্ছে! ও ভেতর থেকে একবারে মরে গেছেরে… আমি ওকে কোনভাবেই ফিরিয়ে আনতে পারছি না… এত চেষ্টা করছি কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। আমি আর কী করব? কী করলে ওকে ফেরাতে পারব? আমি তো কোনদিন কারো সাথে কোন অন্যায় করিনি তাহলে আমার সব কিছু কেন এভাবে শেষ হয়ে যাচ্ছে? কী এমন অপরাধ করে ফেলেছি আমি যার জন্য এত বড় শাস্তি আমাকে পেতে হচ্ছে?

রিফাত ভাইয়াকে শান্তনা দেবার কোন ভাষা খুঁজে পেল না… যে ভাই তাকে সব সময় বাবার ছায়া দিয়ে এসেছে, সন্তানের মত প্রতিটি পদক্ষেপ সুন্দর আর মজবুত করে দিয়েছে তার এমন অসহায় অবস্থা রিফাত সহ্য করতে পারছে না। সে বিমূঢ়ের মত দাঁড়িয়ে রইল। শুধু বলল- “তুই ভাবিস না ভাইয়া আমি আছি, আমরা আছি… আল্লাহ নিশ্চই এই সময়টাও পার করে দেবেন। তিনি তার প্রিয় বান্দার পরীক্ষা নিতে পছন্দ করেন। তুই আল্লাহর উপর ভরসা রাখ শুধু।”

সেদিনের পর থেকে রাইয়ানও চুপচাপ হয়ে গেছে। তানিয়ার সেদিকেও কোন খেয়াল নেই! সে কোন খেয়ালে কোন ধ্যানে থাকে কেউ বলতে পারে না। রিফাত সাইকোলজিস্ট দেখিয়েছে কিন্তু তাতেও কোন ফল পাওয়া গেল না। সে না ঘুমায়, না জেগে থাকে, না কোন ঔষধ খায়, না ডাক্তারের কোন পরামর্শ শোনে! তার মা এসে একদিন তাকে নিয়ে যেতে চাইল রাইয়ান প্রথমে আপত্তি করলেও পরে ভাবল- মায়ের কাছে গিয়ে ভালো লাগতেও পারে তাই যেতে দিল।

পুষ্পর তখন বাবু হবার সময় হয়ে এসেছে… পুষ্প আজকাল খেয়াল করেছে রিফাত কী একটা নিয়ে সারাক্ষণ ভাবনায় থাকে। জিজ্ঞেস করলে উত্তর দেয় না এড়িয়ে যায়। কিন্তু কিছু একটা তার ভেতরে যে চলছে এটা সে ঠিক বুঝতে পারে। আজকাল পুষ্পর কেমন ভয় ভয় লাগে… আজেবাজে স্বপ্ন দেখে আর জেগে রাত পার করে মাঝে মাঝেই। রিফাতকে বলে দেয় কাউকে পেলে যেন কিছু অর্থ দান করে দেয়। এই উছিলায় যদি আল্লাহ তাকে মাফ করেন। শেষ যেদিন চেকাপ করিয়েছে ডাক্তার বলে দিয়েছে বেবির পজিশন ভালো, নরমালেই হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। রিয়ানাও মোটামুটি ডাক্তারি ফলাবার চেষ্টায় থাকে তার উপর। তারপরও পুষ্পর কেমন অজানা আশঙ্কায় বুক ভার হয়ে থাকে!

রিফাত তার ভাইয়াকে বলে রাখে- বাবু হবার সময়টাতে আমি ভাবিকে পাশে চাই। তাই তুমি তাকে নিয়ে তৈরি থেকো। রিফাতের এই কথাটা রাইয়ানের ভালো লাগে। সে তানিয়াকে জোর করে তার মায়ের বাসা থেকে নিয়ে আসে।

পুষ্পর প্রেগন্যান্সির ৯মাস ২১ দিনের মাথায় তার লেবার পেইন ওঠে। দুপুরে খেয়ে ওঠার পর থেকে তার ব্যথা করতে শুরু করে তারপর ক্রমেই বাড়তে থাকে। রিয়ানা ঘরেই ছিল তাই সে তাকেই প্রথমে ডাকে। রিয়ানা এসে পুষ্পকে এভাবে দেখেই বুঝে যায় কী হয়েছে। সে তাড়াতাড়ি রিফাতকে ফোন করে চলে আসতে বলে। তারপর বাকিদের ডেকে প্রয়োজনীয় সব কিছু নিয়ে পুষ্পকে নিয়ে হাসপাতালে চলে যায়। রিফাত হাসপাতালে এসে দেখে পুষ্পকে গাইনি বিভাগে চেকাপ করে অবজার্ভেশনে রাখা হয়েছে। রাইয়ান সব দিক সামলে নিয়েছে। রিফাত এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে বাড়ির সবাই আছে শুধু তার ভাবি নেই! সে ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করল-

-ভাইয়া, ভাবি কোথায়?

-সে আসেনি। আসবে না।

-ঠিক আছে আমি যাচ্ছি তাকে আনতে।

-তুই যাচ্ছিস মানে কী? এখানে এখন তোকে দরকার আর আমি তো তাকে বলেছি সে আসেনি এখন তুই যেয়ে কী করবি?

-এখানে সবাই আছে ডাক্তার আছে, ব্লাড ডোনার আছে, সব আছে। সবচেয়ে বড় কথা তুই আছিস। আমি না থাকলেও কোন সমস্যা হবার কথা না। আমি যাব ভাবিকে নিয়ে চলে আসব, দেরি করব না। তুই থাকিস এখানে। বলে আর এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে চলে আসে।

রিফাত বাসায় এসে দেখে তানিয়া তার ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। সে তার পাশে গিয়ে বলে-

-ভাবি আমার সাথে চলো।

তানিয়া রিফাতের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছু বলে না।

রিফাত তার শীর্ণ হয়ে যাওয়া হাত ধরে টেনে নিয়ে আসতে আসতে বলে তুমি না গেলে চলবে না ভাবি। তোমাকে যেতেই হবে। তানিয়া এবারও কিছুই বলল না, সে চুপচাপ রিফাতের সাথে হেঁটে চলল। রিফাত হাসপাতালে এসে দেখে পুষ্পকে লেবার রুমে নেয়া হয়েছে। যেকোন মুহুর্তে বাবু হয়ে যাবে। রিফাত শুকরিয়া আদায় করে যে সে আসার আগেই বাবু হয়ে যায়নি।

তারা আরও ১০ মিনিট অপেক্ষা করার পর বাচ্চার কান্না শুনতে পায়… রিয়ানা ঘরিতে দেখল রাত ৮.১০ বাজে। মিনিট দশেক পর লেবার রুমের দরজা খুলে একজন নার্স বের হয় যার কোলে রিফাতের সদ্যোজাত শিশু… নার্স দরজায় দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে-

-বাচ্চার বাবা কোথায়? আসুন কোলে নিন… আপনার ছেলে হয়েছে। সবাই একসাথে “আলহামদুলিল্লাহ” বলে নার্সের দিকে এগিয়ে আসে… রিফাত তানিয়ার হাত ধরে টেনে এনে এগিয়ে এসে বলে- “ওকে ওনার কোলে দিন আগে”।

অপেক্ষারত সবগুলো চোখ একসাথে রিফাতের দিকে ঘুরে যায়। রেহানা ইসলাম একটু আহত হলেন। নার্স ততক্ষণে তানিয়ার কোলে ছেলেকে দিয়ে দিয়েছে। রিফাত একবার ছেলের মুখটা তাকিয়ে দেখে তারপর অস্ফুটস্বরে বলে “মাশা-আল্লাহ” রাইয়ান ততক্ষণে তানিয়ার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। তার চোখে পানি…। তানিয়া বাবু কোলে নিয়ে কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। রিফাত তখন তাকে বলে-

ভাবি ওর দিকে ভালো করে একবার তাকাও, দেখো… দেখতে একদম ভাইয়ার মত হয়েছে না? ভাইয়ার কোলে দেখলে যে কেউ “বাবার ফটোকপি” বলবে না বলো?

তানিয়া তখন বাবুর দিকে তাকায় তারপর আবার রাইয়ানের দিকে তাকায়, তারপর আবার বাবুর দিকে তাকিয়ে আলতো করে তার গাল ছুঁয়ে দিয়ে ছোট্ট হাতটা ধরে… হাত ধরতেই বাচ্চাটা কেমন তার হাত শক্ত করে ধরে মুঠো করে ফেলল!!! তানিয়ার বুক কেঁপে ওঠে! তার আটকে থাকা নি:শ্বাসটা সশব্দে বের হয়ে আসে… তারপর সে কেঁদে ফেলল… হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে… আজ বহুকাল পর সে কাঁদল! সব কিছু হারিয়ে সে কষ্টে কষ্টে পাথর হয়ে গিয়েছিল আজ এই ছোট্ট প্রাণ তার দেহে প্রাণ ফিরিয়ে আনতে পেরেছে! সে ছেলেটাকে বুকে আগলে ধরে আকুল হয়ে কাঁদতে থাকে… রাইয়ান তানিয়ার কাঁধে হাত রেখে নিজেও কেঁদে ফেলে… তানিয়াকে কাঁদতে দেখে আজ তার আনন্দ হচ্ছে… বহুদিনের দহনের দিন আজ তানিয়া চোখের পানিতে ভাসিয়ে দিক। রাইয়ান পাশে থাকা রিফাতকে জড়িয়ে ধরে। তার এই ছোট্ট ভাইটা কবে এত বড় হয়ে গেল!

বাবু নরমালে হবার কারণে পেশেন্ট কাল সকালেই বাড়ি চলে যেতে পারবে।পুষ্পকে বেডে শিফট করা হলে পুষ্পর কোলে তার ছেলেকে দেওয়া হয়। বাবুকে কোলে নিয়ে পুষ্প তাকিয়ে আছে… এই তার ছেলে? তার নিজের শরীরের অংশ! কী সুন্দর… মাশা-আল্লাহ। তার চোখ থেকে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে। ছেলেকে আলতো করে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখে। কী নরম তুলোর মত এক পুতুল!

রাত ১০ টার দিকে রিফাত সবাইকে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়। ছেলের নানি আর দাদি দুজনই থাকতে চান কিন্তু রিফাত তাদের থাকতে দেয় না। সে শুধু রিয়ানাকে রেখে দেয়। আর এখানে তো নার্স আছেই যেকোনো মুহূর্তে যেকোনো প্রয়োজনে তারা চলে আসবে। সবাইকে এগিয়ে দিয়ে এসে রিফাত তাদের কেবিনে ঢুকে দেখে পুষ্প ছেলে কোলে নিয়ে বসে আছে আর রিয়ানা ফুপি ফুপি করে বাবুর সাথে কথা বলার চেষ্টা করছে। নতুন ফুপু হলে যা হয়। অবশ্য এতক্ষণ পাপড়ি খালামনি খালামনি করে মাথা খারাপ করে রেখে গেছে। রিফাত বেশ বুঝতে পারছে তার ছেলেটাকে ফুপি আর খালামনির কী পরিমাণ অত্যাচার সহ্য করতে হবে! রিফাত ভেতরে এসে বলল-

-তোমরা সব ঠিক আছ তো?

পুষ্প মুখ তুলে বলল- হুম। শোনো আমি বাবুকে ডাকার জন্য একটা নাম ঠিক করেছি…

-ভালো তো। কী ঠিক করেছ?

-“তূর্য”।

নাম শুনেই রিফাত রিয়ানার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বলল-বাহ্, আমার খুব পছন্দ হয়েছে নামটা।

কিন্তু রিয়ানার কানে নামটা যেতেই সে একপ্রকার চিৎকার করে উঠল… না! এই নামটা রাখা যাবে না।

রিয়ানার কথায় পুষ্প খুব অবাক হল। রিফাত বলল- রাখা যাবে না কেন?

-না মানে… নামটা ভালো লাগেনি! অন্য কোন নাম রাখো না? এটা কেন রাখতে হবে?

-কেন এই নামে কী সমস্যা?

-কোন সমস্যা নেই। বললাম তো এই নাম আমার পছন্দ হয়নি। আমি ওকে এই নামে ডাকব না।

-তুই তাহলে অন্য নামে ডাকিস। আমরা ওকে এটাতেই ডাকব। আর ওর তো একটা নামই থাকবে না, ভালো নামও তো একটা থাকবে।

রিয়ানা আর কিছু বলতে পারল না। মনে মনে বলল- ভাবি যে কী! তাকে এই নামটাই ঠিক করতে হল?

রিফাত তখন বলল- তোমাদের কিছু লাগলে বলো নিয়ে আসি?

রিয়ানা বলল, তার কিছু লাগবে না সে নিজে নিচে ক্যান্টিনে গিয়ে এক কাপ চা খেয়ে আসতে চায় শুধু।

রিফাত বলল, যা ভাগ তাহলে। রিয়ানা উঠে চলে গেল চা খেতে। সে ক্যান্টিন থেকে চা নিয়ে ওয়েটিং চেয়ারে বসে চায়ে চুমুক দিয়ে তূর্যকে ফোন করল। তূর্য ফোন ধরে বলল-

-আবারও কী আমাকে মনে পড়ার জন্য স্পেশাল কোন কারণ ঘটেছে?

-আপনিও তো কখনো ফোন করেননি?

-আমি মেয়েদের অকারণ ফোন দেই না।

-“আমিও দেই না” বলে রিয়ানা ফোন কেটে দেয়। সে ফোন কেটে দেয়ার ১০সেকেন্ড পরই তূর্য কল ব্যাক করে। রিয়ানা ধরে বলল-

-আপনি তো অকারণ ফোন দেন না এখন কেন দিলেন?

-এখন কারণ ঘটেছে।

-কী কারণ?

-কাউকে জানানো দরকার যে, শুধুমাত্র প্রয়োজনেই আমাকে যারা স্মরণ করে তাদেরকে মনে পড়লেই ফোন করা যায় না।

-তাহলে এটাও জেনে রাখা ভালো, মেয়েরা চাইলেই হুটহাট ছেলেদের ফোন করে না।

-হুম, বুঝেছি। তারপর বলো…

-জানেন কী হয়েছে?

-আমার কী জানার কথা?

-না, তা না… হয়েছে কী আজ ছোট ভাইয়ার ছেলে হয়েছে ভাবি এখন তার নাম রাখতে চাইছে “তূর্য”! এটা কোন কথা হল?

-ওহ… তূর্য নামটা তোমার তাহলে খুব অপছন্দ?

-আরে তা হবে কেন? ওটা তো আমার খুব পছন্দের নাম।

-তাহলে সমস্যা কোথায়?

-আপনি বুঝতে পারছেন না? ওর নাম যদি তূর্য রাখা হয় তাহলে একই বাড়িতে দুটো তূর্য হয়ে যাবে। এটা কী হয়?

-না, হয় না। কিন্তু বাড়িতে একটা তূর্য থাকতে বাবুর নাম তূর্য কেন রাখতে চাইছে?

-সেটাই তো! এখন আমি তো তাদের আপনার কথা দুম বলতেও পারছি না।

-আমার কথা! এখানে আমার কথা কী করে এলো?

-আসবে না? একদিন তো আপনিই আমাদের বাড়ির জামাই হচ্ছেন তাই না?

-তাই নাকি? আমি তো এটা জানতাম না!

-রিয়ানা চোখ বন্ধ করে জিভে কামড় দিয়ে ফেলল। ইসসস সে এটা কী বলে ফেলল! সে কী পাগল হয়ে গেছে? সে আর কিছু না বলে ফোন কেটে দিয়ে শক্ত হয়ে বসে রইল। জীবনে এতবড় বোকামি সে কোনদিন করেনি! আজ কী করে করল?

মিনিট খানেক পর তূর্য কল দিল রিয়ানার সাহসে কুলাচ্ছে না ফোন ধরার… তবু সে ফোনটা ধরে চুপ করে রইল। ওপাশ থেকেও কোন কথা নেই… রিয়ানা ফোন কাটতে যাচ্ছি এমন সময় তূর্য গেয়ে উঠল- “বধূ কোন আলো লাগলো চোখে…” গান শুনতে শুনতে রিয়ানার চোখ থেকে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল… গান শেষ হতেই সে ফোন কেটে দিল। তখন তার ফোনে তূর্য একটা ম্যাসেজ পাঠাল- “যদিও অপেক্ষাটা অনেক বেশি হয়ে গেছে। তবুও… অবশেষে আমি তোমাকে পাইলাম!” ম্যাসেজটা দেখে রিয়ানার বুকের ভেতর অদ্ভুত এক পাওয়ার আনন্দ এসে ভর করল।

পুষ্প রিফাতকে বলল- রিয়ানা আমাকে সব বলেছে, ভাবির কী অবস্থা এখন?

-ভাইয়া ওকে বাসায় নিয়ে গেছে অনেক সময় ধরে কান্নাকাটি করেছে তাই বাসায় নিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে।

পুষ্প রিফাতের হাত ধরে বলল- তুমি আজ যা করেছ খুব ভালো করেছে।

-আমি ভাইয়ার জন্য সব করতে পারি। ভাইয়া আমাকে কতটা ভালোবাসে সেটা বলে কাউকে বোঝানো যাবে না। সে আমার আশাপাশে থাকলে আমি কোন কিছুর ভয় করি না। আমি জানি সে সব সামলে নেবে। সে আসলেই আমার কাছে একজন সুপারম্যান! যদি প্রয়োজন পড়ে আমি আমার সন্তানকেও তার হাতে তুলে দেব।

পুষ্প এবার চমকালো… সে ছেলেকে আরেকটু শক্তু করে ধরল। রিফাত কী বলছে এসব? তবে ও যা বলছে প্রয়োজনে ও তাই করতে পারবে! পুষ্প দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পড়ল।

হাসতাপাল থেকে ফেরার পর তানিয়া বিছানায় পড়ে গেল… সে টুকটাক কথা বলল রাইয়ানের সাথে। রাইয়ান তূর্যকে কোলে নিয়ে তানিয়ার কাছে বসে থাকত যেন ওকে দেখলেই তানিয়া সুস্থ হয়ে যাবে। আশ্চর্যের বিষয় হল তূর্যকে দেখলে তানিয়া তার শীর্ণ শরীর টেনে তুলে বসে, খুশি হয়, কোলে নেয় তারপর কাঁদতে শুরু করে। এভাবে দুদিন গেল তারপর তানিয়া আর বিছানা থেকে উঠতে পারল না। তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হল ৩ দিন অচেতন হয়ে হাসপাতালে রইল। এই ৩ দিন রাইয়ানের অবস্থা শোকে পাথর হবার মত… ডাক্তার বলে দিয়েছে যেকোন মুহুর্তে তানিয়ার মৃত্যু হতে পারে। সে তো মরে গিয়েছিল অনেক আগেই। তার মন কিছুতেই শরীরকে সাপোর্ট দিচ্ছিল না তাই কোন চিকিৎসা বা ঔষধ তার কোন কাজে আসেনি! এখন শুধু আল্লাহকে ডাকা…

৩দিন পর তানিয়া না ফেরার দেশে চলে গেল কাউকে কিছু না বলে। তানিয়ার এমন নিরব প্রস্থান সবচেয়ে বেশি দু:খিত করল রাইয়ানকে আর অপরাধবোধে ফেলে দিল রেহানা ইসলামকে! আমানত উল্লাহ সাহেব মুখে কিছু না বললেও তার দৃষ্টিতে রেহানা ইসলাম স্পষ্ট দেখতে পায় তানিয়ার এভাবে চলে যাওয়ার পেছনে তার হাত রয়েছে! এটা নিরব প্রস্থান নয়, এটা নিরবে হত্যা করে ফেলা! কেউ যদি এটা ভাবেও তবে খুব একটা ভুলও তো সে নয়… সত্যিই তো! তার একটু সহানুভূতিশীল আচরণ যেখানে তানিয়ার কষ্ট লাঘবে সাহায্য করতে পারত সেখানে তিনি কষ্টে জর্জরিত মেয়েটাকে আরো বেশি কষ্ট দিয়েছেন। মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছেন। ভেতরে ভেতরে রেহানা ইসলাম আত্মদহনে ভয়ানকভাবে পুড়তে লাগলেন। তাই স্বাভাবিকভাবেই অসুস্থ হয়ে গেলেন তিনি। রেহানাকে নিয়ে সন্তানেরা ব্যস্ত হয়ে পড়ল তখন। রাইয়ান হয়ত তার মায়ের অসুস্থতার কারণ ধরতে পারল। সে তার মাকে বলল-

-মা তুমি কেন এভাবে ভেঙে পড়ছ? যে চলে যাবার সে চলে গেছে তাকে নিয়ে কষ্ট পাওয়ার কিছু নেই। তার নিয়তিতে যা ছিল তাই হয়েছে। নিয়তি কেউ বদলাতে পারে না। অতীতের ভুলের জন্য বর্তমানকে কষ্ট দেওয়া ঠিক নয়। কিন্তু রেহানা ইসলামের কোন পরিবর্তন হল না। রাতে ভয়ংকর সব শাস্তির স্বপ্ন দেখতে লাগলেন। তিনি রাইয়ানকে এক সকালে ডেকে বললেন-

-রাইয়ান আমি অনেক বড় পাপ করে ফেলেছিরে, আমার কঠিন শাস্তি হবে, আমি মনেহয় আর বাঁচব না! বলে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন। রাইয়ান অস্থির হয়ে যায় সে কিছুতেই মাকে শান্ত করতে পারে না। রিফাত বাবার দিকে চেয়ে থাকে কী করবে?

আমানত উল্লাহ সাহেব তার বড় ভাই ভাবিকে সব কথা বলে আসতে বলেন। বড় চাচীকে দেখে রেহানা কান্নায় ভেঙে পড়ে। বড় চাচী দেখলেন তানিয়া মারা যাবার এই এক সপ্তাহেই রেহানার চেহারা খারাপ হয়ে গেছে, তার বয়স দুম করেই যেন ১০বছর বেড়ে গেছে। পৃথিবীতে আত্মদহনের চেয়ে কঠিন শাস্তি আর কিছুতেই হতে পারে না, রেহানা সেটাই পাচ্ছে! তিনি কী এক যাদুতে রেহানাকে শান্ত করতে পারলেন। তার কথায় রেহানা আশ্বস্ত হল। বড় চাচী রাইয়ানকে বলে দিলেন ভালো একজন ঈমাম ডেকে নিয়ে আসতে। রাইয়ান তাই করল। সেদিন রাতেই রেহানা ইসলাম তার স্বামী, দুই পুত্র আর বড় চাচীর সামনে ঈমাম সাহেবের কাছে তার অপরাধ স্বীকার করে বললেন-

-ঈমাম সাহেব এবার আপনি বলুন আমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা পাব?

ঈমাম সাহেব বললেন- নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল তিনি তওবাকারীকে পছন্দ করেন। আপনি যেহেতু আপনার ভুল বুঝতে পেরেছেন আপনার গুণাহ ইনশাআল্লাহ আল্লাহপাক মাফ করে দিবেন। আপনি আপনার পুত্রবধূর নামে বেশি বেশি দোয়া আর দানদক্ষিণা করুন।

রাইয়ান তখন বলে- ঈমাম সাহেব আমার স্ত্রী মারা যাবার আগে তিনি হয়ত অনুমান করতে পেরেছিলেন তার আয়ু শেষ হয়ে আসছে। সে ৩দিন আগে আমাকে অনেক কিছুই বলে গেছে। একথাও বলে গেছে যে, আমার মায়ের উপর তার কোন রাগ নেই। শুধু অভিমান ছিল তিনি কেন একবার তার জায়গা থেকে ভাবতে পারেননি? তবে সেই অভিমানও আমার ভাইয়ের পুত্রকে কোলে নিয়ে চলে গেছে। সে সম্পূর্ণ নির্ভার হয়ে গিয়েছিল। সে কারো উপর কোন রাগ রাখেনি… সে খুব ভালো একটা মেয়ে ছিল, ভালো একজন পুত্রবধূ ছিল, ভালো একজন স্ত্রীও ছিল। আমি তার উপর সন্তুষ্ট। আমি চাই জান্নাতে আল্লাহপাক তার সাথে আমার সাক্ষাৎ করাক… এক নাগারে কথাগুলো বলে রাইয়ান নিজেও কান্নায় ভেঙে পড়ে… রিফাত এগিয়ে গিয়ে ভাইয়ার কাঁধে হাত রাখে।

ঈমাম সাহেব তখন বলেন- “সুবহানআল্লাহ” আপনার স্ত্রী অতি সৌভাগ্যবতীদের একজন। আল্লাহপাক আপনার দোয়া কবুল করুক।

রাইয়ান আবার বলল- আমি আমার মাকে অনেক বুঝাচ্ছি কিন্তু সে কিছুতেই নিজেকে ক্ষমা করতে পারছে না। এখন আপনিই বলুন কী করা যায়?

ঈমাম সাহেব বললেন- আমার তো বলার আর কিছু নেই। আপনার স্ত্রী উনাকে ক্ষমা করেই গেছেন আর তিনি যেভাবে অনুতপ্ত তাতে আল্লাহপাকও নারাজ থাকার কথা না। আপনি তওবা পড়ে মহান রব্বুল আলামীনের উপর বিশ্বাস রেখে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসুন। ঈমাম সাহেব আরও কিছু কথা বয়ান করলেন। রাতের খাবার খেয়ে তারপর বিদায় নিলেন তিনি।

এরপর থেকে ধীরে ধীরে রেহানা ইসলাম স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে শুরু করলেন। তানিয়ার মৃত্যু আর মায়ের অসুস্থতার কারণে তূর্যর আকীকা দেওয়া হয়ে ওঠেনি। বাড়ির অবস্থা স্বভাবিক হওয়ায় রিফাত সব আয়োজন করে ফেলে।

আকীকার আগের রাতে রাইয়ান রিফাতের ঘরে যায়। পুষ্পর কাছে একটা গহনার বক্স দিয়ে বলে- এটা রাখ পুষ্প।

পুষ্প অবাক হয়ে বলে- এগুলো তো সব ভাবির গহনা! আমার কাছে কেন দিচ্ছেন?

-তানিয়া তার সমস্ত গহনা, তার সব কিছু তূর্যকে দিয়ে গেছে।

রিফাত আর পুষ্প নির্বাক হয়ে একে অপরের দিকে তাকায়… রাইয়ান তখন বলতে শুরু করে-

-তানিয়া তূর্যকে নিজের সন্তান মনে করেছিল। তূর্য তার জীবনের শেষ দিনগুলো বেঁচে থাকার সার্থকতা এনে দিয়েছিল। ওকে কোলে নিয়ে শুধু বলত- “আমাকে মা ডাকবি কবে বাবা? একবার “মা” বল?” সে শুধু এই কথাগুলোই বলত… আর কয়েক মাসও যদি বেঁচে থাকত… কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার বলতে লাগল- সে তো শেষ কয়েক মাস ঘুমায়নি জেগেই কাটাত, হাসপাতালে নেবার আগের রাতে সে আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বলল- “আমি আমার মৃত নানিকে স্বপ্নে দেখালাম, একদম স্পষ্ট! তিনি আমাকে খুব ভালোবাসত… আমাকে তিনি নিয়ে যাবার জন্য ডাকছিলেন! আমার হাতে আর বেশি সময় নেই রাইয়ান! আমি বললাম- চুপ করো তানিয়া, এসব স্বপ্ন সত্যি হয় না। তুমি ঘুমাবার চেষ্টা করো। সে আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল- আমাকে বলতে দাও রাইয়ান, বলবার জন্য আমি হয়ত আর সময় পাব না। আমি আমার ছেলেটাকে মানুষ করে রেখে যেতে পারলাম না। তুমি ওকে আমার কথা বলো। ও যেন আমাকে ভুলে না যায়। ওকে বলো, আমার নামের সাথে মিলিয়ে ওর নাম রাখা হয়েছে “তূর্য”। ও একদিন অনেক বড় হবে। ওর মা ওকে দোয়া দিয়ে যাচ্ছে। আলমারিতে আমার যত গহনা রাখা আছে সব ওর জন্য রেখে দিবে, সব। আমি তো আমার ছেলের বউ দেখে যেতে পারলাম না তুমি পুষ্পকে বলে দিও ও যেন আমার গয়না দিয়ে আমার ছেলের বউকে বরণ করে। বলো কিন্তু, তোমার মনে থাকবে তো সব? কথাগুলো বলে রাইয়ান নি:শব্দে কেঁদে ফেলল। বক্সটা পুষ্পর হাতে রেখে সে চোখ মুছতে মুছতে চলে যায়।

আকীকার অনুষ্ঠানের পর সবাই যার যার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাবার চেষ্টা করল। শুধু রিফাতের মন থেকে ভাইয়ার চিন্তা যাচ্ছে না। ভাইয়ার জন্য কিছু একটা করতে হবে কিন্তু সেটা কী আর কীভাবে?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here