Mr_Husband,অন্তিম_(২য় খন্ড) #পর্ব_৬০

0
4778

#Mr_Husband,অন্তিম_(২য় খন্ড)
#পর্ব_৬০
#লেখিকা: আবনী ইবনাত মুন

মুন কান্না মিশ্রিত চোখে তাকায়। আঁধার অবাক হয়ে বলল,

—“কি হলো কাদছো কেনো? খুব বেশি কঠিন শাস্তি দিয়ে ফেললাম বুঝি?”

মুন আচমকা হামলে পরলো আঁধারের বুকে। কান্নার সুরে বলল,

—“আপনি কেন এতো ভালোবাসেন আমায়? আমি তো আপনার ভালোবাসার যোগ্য না।”

আঁধার অপ্রস্তুত হয়ে পরেছিলো মুনের আকষ্মিক হামলায়। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিলো। মুনের এরকম কথায় হেসে দিলো তারপর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,

—“ভালোবাসা কখনো কমে না সময়ের সাথে সাথে আরো বৃদ্ধি পায়। আর কে বলেছে তুমি আমার ভালোবাসার যোগ্য না?”

মুন মাথা নিচু করে ফেলল। একটু পর মিন মিনিয়ে বলল,

—“আমি খুব খারাপ তাই। আমি আপনার সাথে অন্যায় করেছি।”

আঁধার মুনকে বুক থেকে তুলে দু হাতে মুনের দু গাল আকড়ে ধরে গাঢ় করে অধর ছোয়ালো কপালে। আঁধারের স্পর্শে চোখ আবেশে বুজে গেল মুনের। কপাএ গভীর চুম্বন একে দিয়ে আঁধার আবেগ মিশ্রিত স্বরে বলল,

—“তুমি যদি সবটা জানতে তাহলে এমন করতে না। তুমি যা করেছো না জেনে করেছো। সিচুয়েশনটাই এমন ছিলো যে ভুল বোঝারই কথা। আর আমিও তখন তোমাকে বুঝাতে পারিনি কারণ ইসী গুলি লেগেছিল খুব ক্রিটিক্যাল অবস্থা ছিলো তাই ইমিডিয়েটলি ওকে হসপিটালে নিয়ে যেতে হয়েছিলো। আর অন্য দিকে অবুঝ তুমি আমাকে ফাকি দিয়ে উড়াল দিলে আকাশে। তোমার বয়সটাই তখন অমন ছিলো। আবেগ প্রবণ। একটুতেই সেনসিটিভ হয়ে পরতে। তাই এটা ছোট একটা ভুল মাত্র। তুমি তো আর আমাকে ধোকা দেওনি, ঠকাও নি, তাই ভালো না বাসার কোনো কারণ আমি দেখছি না।”

মুনের চোখ ছলছল করে উঠে। আঁধার বলল,

—“আবার কি হলো?”

—“আপনি আমাকে যতটা ভালো করে চিনেন, বুঝেন ততটা হয়তো আমি নিজেও ভালো করে নিজেকে বুঝি না। আমি এমনই একজনকে চেয়ে ছিলাম যে আমাকে বুঝবে। আমার ত্রুটি গুলোকে আপন করে নিবে। আমার ভুল গুলো নিয়ে অভিযোগ না করে সুধরে দিবে। অনেক অনেক ভালোবাসবে আর আগলে রাখবে। আমি যা চেয়েছি আমার মনে হয় তার থেকেও বেশিও পেয়েছি।”

আঁধার মুখ ভার করে বলল,

—“তুমি তো যা চেয়েছো তা পেয়েছো কিন্তু আমি যা চেয়েছি তার এক বিন্দুও পাই নি। রুশা ঠিক ছিলো ওর মধ্যে সে সব কোয়ালিটি ছিল যা আমি চাইতাম।”

কথাটা শুনে অভিমানে পর্ণ হলো মুনের মন। নিজেকে আঁধারের থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল,

—“তাহলে যান আপনার রুশার কাছে। কে বারণ করেছে?”

আঁধার মুনের মুখের ভাব দেখে হেসে দিলো। কিন্তু কোনো শব্দ হলো না। আঁধার আফসোসের সুরে বলল,

—“তা সম্ভব না ও তো অনেক দূরে চলে গেছে। এতো দূরে যে সেখান থেকে আর কখনো ফিরতে পারবে না।”

মুন ততক্ষনাৎ আঁধারের দিকে তাকালো। আঁধারের নীলাভ চোখ দুটি অতিমাত্রায় শান্ত। মুন অবাক সুরে বলল,

—“মানে?”

আঁধার স্বাভাবিক গলায় বলল,

—“মরে গেছে।”

মুন আরো বেশি অবাক হলো। রুশা মরে গেছে? কবে? কি ভাবে? এতো এতো প্রশ্ন ঘুরছে মুনের মাথায়। মুন আবারো প্রশ্ন করলো,

—“কিভাবে? কি হয়েছিলো উনার।”

আঁধার মুনের অনেকটা কাছে এসে কানের লতিতে ছোট করে চুমু খেয়ে বলল,

—“ও ওর অপকর্মের শাস্তি পেয়েছে।”

মুন বিষ্ময়ে চোখ বড় বড় করে আঁধারের দিকে তাকায়। আঁধার সেদিকে পাত্তা না দিয়ে মুনের হাতের আঙ্গুল গুলো নাড়া চাড়া করতে করতে বলল,

—“তোমাকে বার্থডে তে ওই চিঠিটা কে পাঠিয়ে ছিলো জানো?”

মুন মাথা এপাশ ওপাশ নাড়িয়ে বলল জানে না। আঁধার বলল,

—“রুশা। ওগুলো রুশা পাঠিয়েছিল তোমাকে। ওর জন্য তুমি আমাকে ভুল বুঝে পালিয়ে গেলে আমার কাছ থেকে। ওর জন্য আমি জানতেও পারিনি মার ছোট্ট একটা রাজকন্যা আছে। ওর জন্য আমি আমার রাজকন্যার মুখ থেকে বাবা ডাক শুনতে পারিনি। শুধু ওর জন্য আমার রাজকন্যা অন্য একজনকে বাবা ডাকে। ও যদি সেদিন ওই চিঠিটা না দিতো তাহলে এতো কিছু কখনো হতো না। আমাদের জীবন থেকে এতো গুলো জীবন নষ্ট হতো না। ওর শাস্তি ওকে পেতেই হতো। তাই মেরে দিয়েছি।”

আঁধারের চোখ মুখ দেখেই মেন বুঝতে পারে যে সে খুব রেগে গেছে। মুন কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,

—“আমি এতো গুলো বছর একটা ছেলের সাথে এক বাড়িতে থেকেছি আপনি আমাকে কোনো প্রশ্ন করবেন না? আপনার মনে কি কোনো সন্দেহ জাগে নি?”

আঁধার মুনের কপালে আবারো ঠোঁট ছুইয়ে বলল,

—“একদম না। কেনো সন্দেহ জাগবে? আমি জানি তো আমার বোকাপাখিটা কতটা নিষ্পাপ। তার উপর আমার পুরো বিশ্বাস আছে। তুমি জানো একটা সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে সবচেয়ে বেশি কিসের প্রয়োজন?”

মুনকে ভেবে বলল,

—“ভালোবাসা?”

—“উহু! ভুল! একটা সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন বিশ্বাসের। ভালোবাসা ছাড়াও একটা সম্পর্ক বিশ্বাসের উপর টিকে থাকতে পারে। কিন্তু ভালোবাসা থাকা সত্বেও যে সম্পর্কে বিশ্বাস নেই সেই সম্পর্ক ক্ষণস্থায়ী। কারণ বিশ্বাস শব্দটা এতোটা মূল্যবান যে যেকোনো সম্পর্কে এই বিশ্বাসের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। সেটা হোক বন্ধত্বের সম্পর্ক অথবা স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক। তাই যা হয়ে যাক কখনো বিশ্বাস হারাবে না। কারণ চোখে দেখা, কানে শোনার বাইরেও অনেক কিছু থাকে যা খালি চোখে দেখা যায় না। সেগুলো দেখার জন্য বিশেষ অনুবেক্ষণ যন্তের প্রয়োজন।”

মুন আর কিছু বলল না চুপটি করে আঁধারের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পরলো। আঁধার বুঝতে পারে মুনের মন আবার খারাপ হেয়ে গেছে। তাই মুনের মাথায় বিলি কাটতে কাটতে দুষ্টুমি ছলে বলল,

—“এই যে বোকাপাখি তুমি আগে ছোট ছিলে তাই ছাড় দিয়েছি এবার কিন্তু নো ছাড়াছাড়ি। এতদিন তুমি আমাকে যত জ্বালিয়েছো তা সব সুধে আসলে ফেরত দিবো। একবার শুধু বিয়েটা হতে দেও।”

মুন লজ্জায় মুখ লুকিয়ে ফেলে। আঁধার মুনের লজ্জায় মুখ লুকানো দেখে শব্দ করে হেসে দেয়।
দরজার আড়াল থেকে কেউ একজন ওদের দুজনের প্রেমময় মুহূর্ত দেখে চোখ থেকে এক ফোটা জল ফেলে ওখান থেকে সরে যায়। মানুষটা রাত। বুক চিড়ে হাহাকার বেরিয়ে আসে নিশ্বাসের সাথে। বুকে বা দিকটা যন্ত্রণায় ফেটে যাচ্ছে।। মন ভাঙ্গার কষ্টটা কি এমনই হয়? আগে তো জানা ছিলো না। হ্যাঁ এটা সত্যি যে ওর অনেক গুলো গার্লফ্রেন্ড আছে কিন্তু তাদের মধ্যে কাউকেও মন থেকে ভালোবাসেনি। তারাও টাইমপাস করে ‘ও’ ও টাইমপাস করে। প্রতিরাতে তারার মেলা বসে ওর আকাশে। কিন্তু একদিন রাতে হঠাৎ চাঁদের আগমন ঘটলো ওর আকাশে। আর আলোকিত হলো ওর আকাশ। সেইদিনের কথা ভেবেই হেসে দেয় রাত। কি ভাবে চর ভেবে ফুলদানি দিয়ে ওকে আঘাত করতে গেছিলো মুন। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে চলে যায় ছাদে। অনুভুতি গুলো চাপা পরে যায় মনের গহীনেই।

.
আজ বিকেলে মেহেন্দি অনুষ্ঠান। আর রাতে গায়ে হলুদ। বিয়ের তিনদিন আগে থেকেই কমিউনিটি সেন্টারে উঠেছে দুই পক্ষ। এখানেই বিয়ের সব ফাংশন হবে। মুনের স্বপ্ন ছিলো ডেস্টিনেশন ওয়েডিং। আর সেই জন্যই আঁধার ঠিক করেছে সব মুনের পছন্দ মতোই হবে। মুনকে কলাপাতা রঙ্গের একটা শাড়ি পড়ানো হয়েছে। মুখে হালকা মেকআপ। হাইলাইট করা চুল গুলো একপাশ করে ফ্যান্স বেনী করা।। গোল্ডের সিম্পাল জুয়েলারি পরেছে। মুনকে দেখতে বেশ সুন্দর লাগছে। মুন রুম থেকে বেরিয়ে স্টেজের দিকে যাচ্ছিলো আচমকা হাতে টান পরে। একটা পুরুষালী শক্ত হাত মুনের হাত ধরে টেনে নেয়। মুন ঘাবড়ে যায়। ভয় পেয়ে চোখ বন্ধ করে নেয়। ধাক্কা খায় একটা বলিষ্ঠ বুকে। মুন এখনো চোখ বন্ধ করে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ কেউ মুখের উপর ফু দিলো। সামনের ছড়ানো চুল গুলো এলোমেলো হয়ে গেল। মুন পিটপিট করে চোখ মেলে তাকায় আঁধারকে দেখে বিষ্ময়ে চোখ বড় বড় হয়ে যায়। মুন চাপা স্বরে বলল,

—“আপনি!”

আঁধার ভ্রু বাকিয়ে বলল,

—“আমি ছাড়া আর কারো সাহস আছে তোমাকে ছোয়ার?”

মুন কিছু বলতে পারশলো না। আঁধার আবারো বলল,

—“তোমার হাত দেও”

মুন অবুঝের মতো তাকায়। আঁধার অধৈর্য হয়ে বলল,

—“মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছো কেনো? হাতটা দেও!”

মুন কিছু বুঝে উঠতে পারে না। কিন্তু তাও চুপচাপ নিজের ডান হাতটা বাড়িয়ে দেয়। আঁধার পকেট থেকে একটা মেহেদীর কোন বের করে। মুন এবার আর চুপ থাকতে পারে না। প্রশ্ন করেই ফেলে,

—“এই মেহেদী কোথায় পেলেন? আর এটা দিয়ে কি করবেন?”

আঁধার মুনের বারিয়ে দেওয়া হাতটা টেনে ধরে মেহেদীর কোন দিয়ে কিছু একটা আঁকিবুকি করতে করতে বলল”?

—“বোকার মতো প্রশ্ন করো না তো? মেহেদী দিয়ে মানুষ কি করে?”

মুন অবাক হয়ে বলল,

—“আপনি কি আমাকে মেহেদী পরীয়ে দিবেন?”

আঁধার নিজের কাজ করতে করতে বলল,

—“হ্যাঁ। আমার বউকে প্রথম আমিই মেহেদী পরাবো।”

আঁধারের মুখে বউ ডাকটা শুনতে অন্য রকম ভালো লাগছে। মুন আঁধারের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আঁধার সবুজ রঙের পাঞ্জাবি আর সাদা রঙের প্যান্ট পরে আছে। মুন আজ প্রথম কালো ছাড়া অন্য কোনো রঙে দেখছে আঁধারকে। রঙ টা শরীরের সাথে বেশ ভালো মানিয়েছে। ব্রাউন রেশমি চুল গুলো সব কপাল ঢেকে ভ্রুর উপর এসে পরেছে। চোখ দুটো দৃষ্টি মুনের হাতের উপরই নিবদ্ধ। দাঁত দিয়ে বারবার ঠোঁট কামড়াচ্ছে। মুন মুগ্ধ হয়ে সব কিছু দেখছে। হঠাৎ আধারের কন্ঠে ঘোর কাটে।

—“মনপাখি দেখতো কেমন হয়েছে? এই প্রথম মেহেদী দিয়ে কিছু আর্ট করলাম তাই বেশি ভালো নাও লাগতে পারে তোমার।”

মুন নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে দেখলো খুব সুন্দর করে হার্টবিট এঁকেছে আঁধার। আবার নিচে নিজের নামও লিখে দিয়েছে। আঁধার একপ্রকার শাসিয়ে বলে গেল,

—“খবরদার এতো তাড়াতাড়ি উঠেবে না। মেহেদী শুকাবে তারপর।”

মুন ঘাড় নাড়লো আর আঁধার চলে গেলো। মুনও স্টেজের দিকে গেলো।

.
রাত ঘুরে ঘুরে চারপাশের ডেকোরেশন গুলো দেখছিলো। হঠাৎ কোথা থেকে সেখানে রাই উদয় হলো। রাত রাইকে দেখেও পাত্তা দিলো না। রাই বলল,

—“হ্যালো মি. হ্যান্ডসাম?”

রাত রাইকে না দেখার আর ওর কথা না শোনার ভাব করে চলে যাচ্ছিল। রাই রাতের বাহু টেনে ধরে নিজে সামনে দাঁড় করিয়ে বলল,

—“আমার কথার উওর না দিয়ে ওদিকে কোথায় যাচ্ছো? এভাবে কাউকে ইগনোর করা ঠিক না। আর সে যদি হয় কোনো সুন্দরী নারী তাহলে তো সেটা ঘোর পাপ?”

রাত মেকি হেসে বলল,

—“কিন্তু আমি তো আমার আশে পাশে কোনো সুন্দরী নারীকে দেখতে পাচ্ছি না।”

অপমানে মুখ হা হয়ে যায় রাই এর। কিন্তু তবুও গায় মাখে না।

—“তাহলে তুমি নিশ্চিত অন্ধ। আচ্ছা এসব কথা বাদ। আচ্ছা তুমি কি আঁধার ভাইয়ের মেলায় হারিয়ে যাওয়া কোনো ভাই?”

কথাটা শুনে আপনা আপনি রাতের ভ্রু দুটো বেকে যায়। তা দেখে রাই কথা ঘুরিয়ে বলে,

—“না মানে তোমাকে দেখতে তো অনেকটা আঁধার ভাইয়ের মতো তাই। কিন্তু কোনো ব্যাপার না এক রকম দেখতে এই পৃথিবীতে সাতজন মানুষ থাকে। তাছাড়া এই রাই কিন্তু একটাই। আমার মতো আর দুটো পাবে না। তাই মিস করো না।”

রাত রাই এর একদম কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বলল,

—“আমার থেকে দূরে থাকো। এতেই তোমার মঙ্গল। কারণ রাত যদি একবার নিজের রুপে ফিরে তাহলে তোমার সর্বনাশ নিশ্চিত।”

বলেই রাত সামনের দিকে হাটা ধরলে রাই রাতের পাঞ্জাবির কর্লার টেনে ধরে আটকায়। রাত বিরক্ত হয়ে বলল,

—“সমস্যা কি তোমার? বারবার টেনে ধরছো কেনো? কর্লার ছাড়ো।”

রাই দুষ্টুমি করে বলল,

—“এক শর্তে যদি তুমি আমার হাতে মেহেদী পরিয়ে দেও তো।”

—“হোয়াট? আমি তোমাকে মেহেদী পরিয়ে দিবো?”

—“হ্যাঁ তুমি।”

রাত বিরক্তির ভঙ্গিতে বলল,

—“আমি পারি না। নিজেই পরে নেও।”

রাই জেদ বলল,

—“তাহলে ছাড়বোও না।”

—“রাই কর্লার ছাড়ো। আমার কাজ আছে।”

রাই নাকচ করে বলল,

—“না। আগে বলো মেহেদী পরিয়ে দিবে তারপর।”

রাত শেষমেশ হার মানতেই হয় রাই এর কাছে। রাই তো খুশিতে বাকবাকুম।

.
মিষ্টি দৌড়ে এসে মুনের কোলে বসে বলল,

—“মাম্মাম মিষ্টিও মেহেদী দিবে।”

কোথা থেকে আঁধার এসে মিষ্টিকে কোলে নিয়ে মুনের পাশে বসলো। আঁধার মিষ্টির গালে চুমু দিয়ে বলল,

—“মিষ্টির ড্যাডাও মেহেদী দিবে।”

আরিফা রেজওয়ান ওখানে এসে গম্ভীর গলায় বলল,

—“তুমি এখানে কি করছো? যাও নিজের বন্ধুদের কাছে যাও।”

—“মম আমি তো এমনিই একটু দেখতে এসে ছিলাম।”

—“এমনিই একটু দেখা হয়েছে? তাহলে এখন যেতে পারো। বিয়ের আগে দেখা করা যাবে না।”

—“কিন্তু মম আমি তো আমার বউকেই বিয়ে করছি। তাহলে এসব নিয়ম কেনো?”

আরিফা রেজওয়ান কঠিন গলায় বলল,

—“বিয়ে দশবার করলেও নিয়ম মানতেই হবে। তোমাকে যেতে বলেছি যাও। বিয়ের আগে আর এমুখো হবে না।”

মিষ্টি খিলখিলিয়ে হাসছে আঁধারের বকা খাওয়া দেখে। মুনও মুখ টিপে হাসছে। মুনের হাসি দেখে রাগে যায় আঁধার। যেতে যেতে আরিফা রেজওয়ানের আড়ালে কানে ফিস ফিস করে বলে,

—“তোমাকে দেখে নিবো।”
.
সন্ধ্যা থেকেই তোড়জোড় চলছে হলুদের অনুষ্ঠানের। বিকেলে আঁধারের বন্ধুরা কেউ আসে নি। কিন্তু সন্ধ্যা বেলা এসে চারজনে সব মাতিয়ে রেখেছে। ইসী আর রাই মুনকে সাজতে সাহায্য করছে। মুন লাল পাড়ের বাসন্তি রঙের শাড়ি পরেছে গ্রাম্য স্টাইলে। কাচা ফুলের গহনা। হালকা মেকআপ। চুল গুলো সুন্দর করে খোপা করা। ইসী আর রাইও শাড়ি পরে সুন্দর করে সেজেছে। মুন নিজেকে আয়নায় ভালো করে দেখছিল। আর ইসী মুনের টিকলিটা সেট করছিলো। হঠাৎ দরজায় কেউ নক করে। ইসী বলল,

—“রাই দেখো তো কে।”

বলতে বলতে আবারো নক করে। রাই গিয়ে দরজা খুলে দিতেই বাইরে আঁধারকে দেখতে পায়। রাই ভ্রু নাচিয়ে বলল,

—“কি চাই। এখানে কি করছো ভাই?”

আঁধার বিরক্ত হয়ে বলল

—“সামনে থেকে সর। ভেতরে ঢুকতে দে।”

—“উহু! কাকিমা নিষেধ করেছে। মুনের সাথে তোমাকে দেখা করা যাবে না।”

আঁধার ভ্রু কুচকে তাকায়। রাই এখনো দরজা ধে ঝুলে আছে। আঁধার ধমক দিয়ে বলল,

—“তুই ভালোয় ভালোয় সরবি না মার খেয়ে তারপর সরবি?”

—“কে এসেছে রাই?”

বলতে বলতে ইসী এগিয়ে আসে। আঁধারকে দেখে কপালে ভাজ ফেলে বলল,

—“তুই এখানে কি করছিস? তোর না গায়ে হলুদ চলছে?”

আঁধার রাগে বলল,

—“আমি আমার বউয়ের কাছে এসেছি। আমার বউকে সবার প্রথম হলুদ আমি লাগাবো। তোরা সর এখান থেকে।”

ইসী সয়তানি হাসি দিয়ে বলল,

—“উহু! তা তো হচ্ছে না। তোদের দুজনের দেখা করা যাবে না।”

—“কি চাই তোদের?”

ইসী মিচকে হাসি দিয়ে বলল,

—“এই তো মামু লাইনে এসেছো। আমাদের দুজনকে দশ হাজার দশ হাজার বিশ হাজার টাকা দে। না হলে আমরা কিছুতেই নিয়ম ভাঙ্গবো না।”

আঁধারের মেজাজটা পুরো গরম হয়ে গেছে। ঝাড়ি মেরে বলল,

—“আমি কি বাসর ঘরে ঢুকছি নাকি যে তোদের টাকা দিতে হবে?”

রাই বলল,

—“দেখ ভাই তোমাকে আমরা জোড় করছি না। তোমার ইচ্ছে। দেখা করতে হলে টাকা দিয়ে তারপর ভেতরে যেথে হবে। না হলে নাই। মাত্র বিশ হাজার টাকা দিতে তোর এতো কিপ্টামি?”

আঁধার জানে যে এদের সাথে কথা বলে লাভ নেই। তাই পকেট থেকে ফোন বের করে ইসীকে বিকাশ এ্যাপ থেকে টাকা পাঠিয়ে দেয়। তারপর ফোন দেখিয়ে বলল,

—“দেখ পাঠিয়ে দিয়েছি। এবার এখান থেকে বিদায় হ।”

ইসী রাই এর দিকে তাকিয়ে বলল,

—“কি বলো রাই যেতে দেওয়া যায়?”

—“থাক বেচারাকে যেতে দেও।”

আঁধার শাসিয়ে বলল,

—“তোদের বাঘে পাই একবার তারপর দেখাবো মজা।”

বলেই ভেতরে ঢুক যায়। ইসী আর রাই হাসতে হাসতে মাটিতে লুটোপুটি খাওয়ার অবস্থা। মুন নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত ছিলো। আঁধার যে এসেছে সে দিকে কোনো খেয়াল নেই। আঁধার দরজা লাগিয়ে দিলো। বুকে হাত গুজে দরজার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে হালকা কাশি দিলো মুনের মনোযোগ নিজের দিকে আনার জন্য।
মুন আঁধারকে দেখে ভয় পেয়ে গেলো। চাপা স্বরে বলল,

—“আপনি এখানে কি করছেন? কেউ দেখে ফেলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। জলদি বেরিয়ে যান। আঁধার মুনের কথায় পাত্তা না দিয়ে একপা একপা করে ওর দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো। মুন স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো আঁধারকে এগিয়ে আসতে দেখে। আঁধারের গায়ের সাথে ফিটিং হয়ে হলুদ রঙের পাঞ্জাবিটা লেগে রয়েছে। কালো প্যান্ট। চুল গুলো জেল দিয়ে পেছ দিকে ঠেলে দেওয়া। গালে কাচা হলুদ লেগে আছে। দু চোখে ঘোর লেগে আছে। ঠোঁটে বাকা হাসি। আঁধার এগিয়ে আসতে আসতে মুনের একদম কাছে এসে পরেছে। আঁধার মুনের কানের কাছে মুখ নিয়ে স্লো ভয়েসে বলল,

—“তোমাকে সবার প্রথম হলুদ লাগানোর অধিকার শুধু আমার বোকাপাখি।”

মুন আঁধার এমন কন্ঠ স্বর শুনে জমে গেছে একদম। বিন্দু পরিমাণ নড়তেও পারছে না। আঁধার আস্তে করে নিজের গালটা মুনের গালের সাথে ঘসা দিলো। যাতে আঁধারের গালের সব হলুদ মুনের গালে লেগে যায়। বাইরে থেকে ইসীর ডাক শুনতে পাওয়া যায়। আঁধার এক সেকেন্ডও দেরী না করে দ্রুত দরজা খুলে বেরিয়ে যায়।

.
আলিয়া আর অয়ন সবার আড়ালে চুপিচুপি প্রমের সাগরে ভাসছে। আলিয়া অয়ন পাশাপাশি ট্যারেসের রেলিংয়ে বসে আছে। আর ওদের মাঝে বসে আছে মিষ্টি। মিষ্টিও আর শাড়ি পরেছে। মুন নিজের হাতে মেয়েকে শাড়ি পরিয়ে কাচা ফুলের গহনা পরিয়ে দিয়েছে। মিষ্টি খুব খুশি ওর মাম্মাম আর ড্যাডার বিয়ে। আলিয়াও খুব খুশি ফাইনালি ভাই আর মুনের মাঝের সব ভুল বোঝাবুঝি শেষ হয়ে গেছে। আলিয়া যখন শনে ছিলো ওর ভাইয়ের আর মুনের ছোট্ট একটা পরি আছে। ও ফুপি হয়ে গেছে অনেক আগেই তখন কি যে খুশি হয়ে ছিলো বলে বোঝানো সম্ভব না। খুব রাগও হয়ে ছিলো মুনে উপরে। আলিয়া মিষ্টিকে প্রথম যেদিন দেখেছিল সেদিন চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে ভরিয়ে দিয়ে ছিলো। যতক্ষণ মিষ্টি আলিয়ার কাছে ছিলো ততক্ষণ ওকে কোলে নিয়ে নিয়ে ঘুরেছে। মুন আর আঁধারের বিয়েতে আলিয়া হয়তো ওদের থেকেও বেশি খুশি। ভাইকে খুব বেশি ভালোবাসে। মুন যখন ছিল না তখন আঁধারের অবস্থা দেখে খুব কষ্ট হতো। বাড়িটাও প্রাণহীন হয়ে পরে ছিলো। যতক্ষণ অয়নের সাথে থাকতো ততক্ষণই একটু ভালো থাকতো। অয়ন সব সময় ওকে খুশি রাখার চেষ্টা করে। ওর ভালো লাগা খারাপ লাগা গুলোকে সব কিছুর উপরে প্রধান্য দেয়। অয়ন বলেছে আঁধারের বিয়েটা হয়ে গেলেই ওর বাবা মাকে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে পাঠাবে। আলিয়ার যেন খুশি ফুরাচ্ছে না।
অন্যদিকে আশিকের পুরো মুখ হলুদ ভুত বানিয়ে দৌড় দেয় ঊর্মি। আশিকও এক মুঠো হলুদ নিয়ে ঊর্মির পেছনে পেছনে দৌড়ায়। ওদের দুজনকে হলুদ নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করতে দেখে রাই এর মাথায়ও সয়তানি বুদ্ধি ঘুরতে শুরু করে। রাইও অনেক খানি হলুদ নিয়ে হাতে রাতকে খুজতে শুরু করে। মুনকে যেখানে সবাই হলুদ মাখাচ্ছে তার এক পাশের পিলারের গা ঘেষে বুকে হাত গুজে দাঁড়িয়ে আছে। রাই পেছন থেকে গিয়ে ভাউ করে উঠলো কিন্তু রাতের মধ্যে কোনো হেলদোল দেখা গেল না। রাই বলল,

—“মেহেদী পরিয়ে দিয়েছ, মেহেদীর রঙ কেমন হয়েছে দেখবে না? এই দেখ।”

রাত অনুভুতি শূন্য চোখে রাই এর দিকে তাকায়। কিন্তু রাই রাতের চোখের ভাষা বুঝতে পারে না। ওর মাথায় তো এখন দুষ্টুমি ঘুরছে। রাত রাইয়ের হাতের দিকে তাকায় দেখে হাতে হলুদ লেপা। রাই আচমকা রাতের মুখে হলুদ লেপে দিয়ে সাদা পাঞ্জাবি ভরিয়ে দিয়ে খিল খিল করে হাসতে হাসতে দৌড়ে পালায়। রাত হতবুদ্ধি, বাকরুদ্ধ। বারবার নিজের পাঞ্জাবির দিকে আর রাই এর যাওয়ার পানে তাকায়। হাসির ঝংকার কানে বাজতে থাকে।

.
আজ আঁধার আর মুনের বিয়ে। বিয়ের দিনটা সবারই অন্য রকম অনুভুতি হয় মুনেরও হচ্ছে। হতে পারে এটা প্রথম বার না কিন্তু। আগের বারের বিয়েতে ওর এরকম অনুভুতি হয় নি যা আজ হচ্ছে। বিয়ের কাজ সবাই ব্যস্ত। তাহেরা মেহেন্দী হলুদ কিছুতেই থাকতে পারেনি। শশুর বাড়িতে যেতে হয়ে ছিল। শাশুড়ি মা অসুস্থ তাই। আজ বিয়েতে এসেছে। তিশান আসার পর থেকে মিষ্টি তিশানের সাথে সাথেই ঘুরছে। ঘুরছে বললে ভুল হবে তিশানকে ঘুরাচ্ছে। রাতকে তাহমিনা খান একটা শপিং ব্যাগ দিয়ে বলল,

—“রাত বাবা এই ব্যাগটা একটা আরিফা রেজওয়ান মানে আঁধারের মাকে একটু দিয়ে আসবে? আমার ওদিকে কাজ আছে।”

রাত হেসে বলল,

—“অবশ্যই

রাত আরিফা রেজওয়ানকে চিনেনা। কখনো দেখে নি। রাত রাইকে দেখলো অদ্ভুত অদ্ভুত পোজে সেলফি তুলছে। রাত এগিয়ে গেল রাইয়ের দিকে। ‘উহুম’ শব্দ করে রাইয়ের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করে। কিন্তু কোনো লাভ হয় না। রাই নিজের সিলফি তুলতেই ব্যস্ত। তাই রাত ডাকলো,

—“রাই!”

রাই নিজের কাজ অব্যহত রেখেই বলল,

—“কিছু বলবে?”

—“আরিফা রেজওয়ানের কোথায়?”

—-“কাকিমা রুমে আছে।”

—“কোন রুমে?”

—“আমার রুমের পাশের রুমটা।”

—“তোমার রুম কোথায়?”

রাই বিরক্ত হয়ে বলল,

—“ধুর শান্তিতে একটু সেলফিও তুলতে দিবে না। এসো আমার সাথে। ফলো মি।”

বলেই রাই রাতের হাত টেনে নিজের সাথে নিয়ে যেতে লাগলো।

—“এইটা কাকিমার রুম যাও।”

বলেই রুম দেখিয়ে চলে গেল রাই। রাত দরজায় নক করলো। ভেতর থেকে এসতে বলল। রাত দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকেই বিষ্ময়ে কিংকর্তব্যবিমুঢ়। নিজের চোখকে বিশ্বাসই করতে পারছে না। অস্পষ্ট স্বরে আওড়ায়,

—“মম!”

আরিফা রেজওয়ান হেসে জিজ্ঞেস করলো,

—“কিছু বলবে?

রাত ভালো করে আরিফা রেজওয়ানকে দৈখে বলল,

—“আপনিই আরিফা রেজওয়ান?”

—-“হ্যাঁ”

রাত ব্যাগটা দিয়ে বলল,

—“আন্টি এটা আপনাকে দিতে বলেছে বলেই দ্রুত পায়ে বেরিয়ে যায়। নিজের চোখকে এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না। রাত ফোন বের করে কাউকে ফোনকে। ফোন রিসিভ হতেই প্রশ্ন করে,

—“মম তুমি এখন কোথায় আছো?”

ওপাশ থেকে জবাব এলো,

—“কেনো?”

রাত অধৈর্য হয়ে বলল,

—“উফ! প্রশ্ন করো না তো। বল এখন কোথায় আছো?”

—“আরে কোথায় আবার থাকবো আমেরিকায় আছি।”

রাত উত্তেজিত হয়ে বলল,

—“আমি তোমাকে এই মাত্র বাংলাদেশে দেখলাম।”

—“মানে? কি বলছো তুমি? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।”

অবাক স্বরে বলল। রাত বলল,

—“সত্যি বলছি মম। অবিকল তোমার মতো দেখতে। এক চুলও এদিক ওদিন না। তোমার চোখ, তোমার নাক, তোমার ঠোঁট, গলার স্বরও বাচন ভঙ্গিও তোমারই মতো।”

ওপাশ থেকে কোনো আওয়াজ শোনা গেল না। রাত হ্যালো, হ্যালো করতে লাগলো। কয়েক সেকেন্ড পরে ওপাশ থেকে শোনা গেল,

—“আমি আজই আসছি বাংলাদেশে।”

তারপরই ফোন কেটে গেল। রাত মমের এমন বিহেভিয়ারে ভিষণ অবাক হলো। কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না।

.
বিকেলের দ্বিতীয় প্রহর। রাত নিজের মমকে আনতে এয়ারপোর্টে গেছিলো। এই মাত্র গাড়ি এসে থেমেছে কমিউনিটি সেন্টারের সামনে। কমিউনিটি সেন্টারটা অনেক বড়। গাড়ি থেকে নামলেন আয়শা রায়জাদা। ড্রাইভার লাগেজ নিয়ে ভেতরে গেল। আয়শে রায়জাদা আর রাত কমিউনিটি সেন্টারের ভেতরে প্রবেশ করলেন। যে যে তাকে দেখছে সেই চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছেন আরিফা রেজওয়ান হলেই উপস্থিত ছিলেন সেও অবাক হয়ে দেখছে আয়শা রায়জাদাকে। দুজনের চোখেই খুশির ঝলক। জল চিকচিক করছে। হলে এখন নিরবতা চলছে। শুধু দুজনের ফোপানোর শব্দই কানে বাজছে। দুজনই দুজনকে জড়িয়ে ধরে কেদে দিলো। সবাই অবাক চোখে দুজনকে দেখছে। রাত আঁধারের মুখ হা হয়ে গেছে নিজেদের মায়েদের দেখে। আয়শা রায়জাদা কাদতে কাদতে বললেন,

—“আমাদের উপর এতো রাগ তোমার? যে এতো বছরে একবারও খবর নেওয়ার প্রয়োজন মনে করো নি? আমরা খুব পর হয়ে গেছি তোমার তাই না?”

আরিফা রেজওয়ান অভিমানী কন্ঠে বলল,

—“কি করবো বলো। ড্যাড যে আমাকে বলেছিল আমি যেন কোনো দিনও তোমাদের সাথে যোগাযোগব করার চেষ্টা না করি। তবুও ছেলে হওয়ার পর আমি আমার ছেলেকে নিয়ে গিয়ে ছিলাম মম ড্যাডের কাছে। কিন্তু তারা এতোটাই নিষ্ঠুর হয়ে গেছিলো যে আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। আর আমার ছেলের গায়ে পর্যন্ত হাত তুলে। যেটা আমি মানতে পারিনি। সেদিন থেকে আমি মনে করি আমার কেউ নেই। স্বামী সন্থান ছাড়া এই পৃথিবীতে কেউ নেই। তাই বলে তুমিও তো এলে না আমার খোজে।”

—“আমি তোমার খোজ করার চেষ্টা করে ছিলাম কিন্তু তুমি কোথায় থাকো কেউ বলতে পারেনি।”

আরিফা রেজওয়ান আঁধার আর আলিয়াকে দেখিয়ে বলল,

—“আমার ছেলে আঁধার আর মেয়ে আলিয়া।”

আয়শা রায়জাদা আলিয়াকে আদরকে কপালে চুমু খেলো। আর আঁধারকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখতে লাগলো। আরিফা রেজওয়ান বলল,

—“কি দেখছো?”

আয়শা রায়জাদা বলল,

—“আমার রাতের সাথে চেহারায় অনেক মিল।”

মুন আর তাহেরা এক কোনায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে। ওরা এটুকু বুঝেছে যে আরিফা রেজওয়ান আর আয়শা রায়জাদা দুইজন জমজ বোন। আর এই জন্যই আঁধার আর রাতের মধ্যে এতো মেল খুজে পাওয়া যেত।

আরিফা রেজওয়ান আর আরমান রেজওয়ানের লাভ ম্যারেজ। আরিফা রেজওয়ানের বাবা এই বিয়ের বিরুদ্ধে ছিলেন তার কারণ সে আরিফা রেজওয়ানের জন্য আগে থেকেই ছেলে পছন্দ করে রেখেছিল। আরিফা রেজওয়ান যখন এ কথা জানতে পারে তখন সে বলে, সে অন্য কাউকে ভালোবাসে। কিন্তু তার বাবা মানতে নারজ ছিলো। সে বলে দেয় যদি আরিফা রেজওয়ান তার মতের বিরুদ্ধে বিয়ে করে তাহলে তাকে সারাজীবনের জন্য ভুলে যেতে হবে তার কোনো বাবা মা পরিবার ছিলো। আরিফা রেজওয়ান ও আরমান রেজওয়ানকে কথা দিয়ে ছিলো। তাই সে আরমান রেজওয়ানের হাত ধরে আমেরিকা ছেড়ে চলে আসে বাংলাদেশে। এবং এখানেই আরমান রেজওয়ানের সাথে সংসার করতে শুরু করে।

.
বিয়ের আসরে পর্দার এপাশে ওপাশে বসে আছে মুন আঁধার। মুন ব্লাক কালারের উপর হোয়াইট স্টোনের ডিজাইন করা লেহেঙ্গা পরে আছে। হোয়াইট ডায়মন্ডে অর্নামেন্ট’স। ভারী মেকআপ। বিয়েতে ব্লাক পরাটা আজব লাগলেও মুন খুব সখ করে পরেছে। সবাই তো লাল, খয়েরী, গোলাপী রঙ পরে। খ্রিস্টানরাও বিয়েতে সাদা পরে। কিন্তু কালো কেউ পরে না। তাই মুন ঠিক করে ছিল ওর বিয়েতে ও কালো রঙর লেহেঙ্গা পরে বিয়ে করবে। না হলে বিয়েই করবে না। এতে যদি কেউ ওকে এলিয়েন বলে তো বলুক নো সমস্যা। কিন্তু ভাগ্য অন্য কিছু লেখা ছিল। তাই আগের বার ভাবনা মোতাবেক কিছুই করতে পারেনি। কিন্তু এবার সব সেরকম ভাবেই করবে। আর কালো রঙটা আঁধারেরও ভীষন ফেবারিট। তাই আর কোনো প্রবলেমই নেই। আঁধার হোয়াইট কালারের উপর ব্লাক স্টোনের ডিজাইন করা সেরোয়ানি পরে আছে। মাথায় ব্লাক কালারের পাগরি পরা।
মুনের সাথে ম্যাচিং করে মিষ্টির জন্যও লেহেঙ্গা বানানো হয়েছে। মিষ্টিকে দেখতে একদম ছোট্ট পরির মতো লাগছে। তিশান যখন প্রথম দেখেছিল আধা ঘন্টা হা করেই ছিল। যা দেখে মিষ্টি খিলখিল করে হেসে উঠে। কাজি সাহেব বিয়ে পরানো শুরু করলো। অয়ন আর আলিয়া সবার আড়ালে একে অপরের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ঊর্মি আশিকের বুকের মাথা রেখে দাঁড়িয়ে আছে। আপনও নিজের গালফ্রেন্ড কে নিয়ে এসেছে। সকল জুটিদের মনেই একই রকম অনুভুতি খেলা করছে। কাজি সাহেব মুনকে আগে বলল কবুল বলতে। মুনের মনের কমন যেন হচ্ছে। হার্টবিট বেরে গেছে। শীতেও ঘামছে। মুন অনেক কষ্টে বলল,

—“কবুল, কবুল, কবুল”

আঁধারকে বলার আগেই আঁধার বলতে শুরু করলো,

—“কবুল, কবুল, কবুল”

হাসির রোল পরে গেল। মুন নার্ভাসনেসের মধ্যেও হসে দিলো। রাত ট্যারেসে দাঁড়িয়ে আছে। মুখ দিয়ে নিকোটিনের ধোঁয়া ছেড়ে উড়িয়ে দিচ্ছে। রাত ড্রিংক করলেও কখনো সিগারেট খায় নি। আজই প্রথম। কষ্ট গুলোকেও এই বিষাক্ত ধোঁয়ার সাথে উড়িয়ে দিচ্ছে। সিগারেটে লম্বা টান মেরে নাক মুখ দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে আকাশের ওই চাঁদটির দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলো,

—“দুঃখ এটা নয় যে আমি তামাকে পাবো না, কষ্ট এটাই যে আমি তোমাকে কখনো ভুলতে পারবো না!!”

রাই পা টিপে টিপে রাতের পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে। আস্তে করে ফু দেয় রাতের কানে। রাত পেছনে না তাকিয়েই বলল,

—“কেনো এসেছো এখানে?”

রাই কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,

—“যাকে তোমার জন্য তৈরি করা হয়নি সে যাবেই। আর যাকে তোমার জন্য তৈরি করা হয়েছে সে সব কিছা ছেড়ে তোমার কাছে আসবেই!!”

রাত কিছু বলল না। চুপচাপ সিগারেটে টান দিতে লাগলো। রাই কিছু একটা ভেবে বলল,

—“বিয়ে করবে আমাকে?”

রাতের হাত থেকে সিগারেট পরে যায়। চমকে তাকায় রাইয়ের দিকে।
ইসী ট্যারেসের অন্য পাশে দাঁড়িয়ে আছে। আজ আরুশকে খুব মনে পরছে। ওর সেই নজর কাড়া হাসিটা চোখের সামনে ভাসছে। ইসী আরুশের একটা পার্সোনাল ডায়েরি পেয়েছিল। আরুশ বলে যেতে না পারলেও লিখে গেছে ও ইসী ভালোবাসতো। উসীর জন্য ওর অনুভুতি গুলো লেখা আছে সেই ডায়েরিতে। ইসী শূন্য দৃষ্টিতে কোনো একদিকে তাকিয়ে আনমনা হয়ে বলতে লাগলো,

—“দোয়া করি, যারা যাকে ভালোবাসো তাকেই যেন পায়। কারণ অসমাপ্ত ভালোবাসা গুলো সত্যিই খুব কাঁদায়
.
মুন আর আঁধার সমুদ্রের পাড়ে খালি পায়ে পাশাপাশি হাটছে। সমুদ্রের ঢেউ এসে পায়ে পরছে। আজকে পূর্ণিমা। আকাশে অনেক বড় গোল থালার মতো চাঁদ উঠেছে। এক চাঁদকে ঘিরে হাজারো তারার মেলা বসেছে। আলো আঁধারের লুকোচুরি চলছে। মুন বাসর রাতে গিফট হিসেবে চেয়ে ছিলো খোলা আকাশের নিচে সমুদ্রের পাড় দিয়ে হাটতে। তাই আঁধার মুনের কথা রাখতে তখনই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পরেছে। মুন ভিষন খুশি আজ। আজেকের দিনটা ওর জীবনের সব থেকে স্মরণীয় দিন হিসেবে থাকবে। আঁধার মুনকে একটা কাঠের পুলের উপর নিয়ে আসে। আঁধার মুনের সামনে হাটু গেড়ে বসে নিজের হাতের মুঠোয় ওর হাত নিয়ে বলল,

—“ভালোবাসি, ভালোবাসি চন্দ্রিকা। নিজের জীবনের থেকেও বেশি। তুমি ওই চাঁদকে যতটা ভালোবাস তার থেকেও বেশি। আমার ভালোবাসা আকাশ সমান। যার কোনো সীমা নেই। আর এভাবেই সারাজীবন ভালোবেসে যেতে চাই। তুমি মনে করো না যে তুমি সুন্দর বলে আমি তোমাকে এতো ভালোবাসি। তোমাকে ভালোবাসি বলে তোমাকে আমার কাছে সুন্দর লাগে। যখন তুমি বুড়ো হয়ে যাবে, তোমার সব চুল পেকে যাবে, শরীরের চামড়া কুচকে যাবে তখনও ঠিক একই ভাবেই ভালোবেসে যাবো কথা দিচ্ছি।”

মুন আঁধার নীলাভ মনিতে নিজের কালো মনি নিবদ্ধ করে বলল,

—“আমি ওই চাঁদটার থেকেও আপনাকে বেশি ভালোবাসি মি.হাসবেন্ড। আমি এই খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে ওই চাঁদকে সাক্ষী রখে কথা দিচ্ছি, জীবনে কখনো যে পরিস্থিতিই আসুক না কেন আপনাকে ভুল বুঝবো না। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ভালোবেসে যাব। আপনার ওই পাজরের হাড় হয়ে থাকবো।”

আঁধার উঠে মুনকে জড়িয়ে ধরে। মুনও দু হাতে আঁধারের পিঠ আকড়ে ধরে। শুরু হয় ওদের নতুন করে পথ চলা। হাজারো বাধা বিপত্তির পরেও যে মানুষটি প্রিয় মানুষের হাত শক্ত করে ধরে থাকে, ভালোবাসা পাওয়ার অধীকার শুধু মাত্র তার!!

সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here