#Mr_Husband,পর্ব_১
#লেখিকা: আবনী ইবনাত মুন
বড় বোনের না হওয়া বরের বউ সেজে বাসর ঘরে বসে আছে মুন। রাগ, দুঃখ, অভিমান সব এক সাথে মেঘ জমিয়েছে তার ছোট্ট মনে। কিভাবে সবাই তার কথা না ভেবেই তাকে বলির বখরা বানিয়ে অচেনা একটা লোকের সাথে বিয়ে দিয়ে দিল? সবার কথা নাহয় বাদই দিলাম কিন্তু আব্বু সে কি করে পারল তার সাথে এমনটা করতে? তাকে একবার জিজ্ঞেস করার ও প্রয়োজন মনে করল না। তার মতামতের কি কোনো দাম নেই? বড় মেয়ে বিয়ে থেকে পালিয়েছে বলে মানসম্মান বাচাতে তাকে সবাই বলি দিল। দোষ তো তার ও আছে, কি দরকার ছিল তাহেরা কে পালাতে সাহায্য করার? শেষমেষ নিজেই ফেঁসে গেল। মুন ভাবনায় ডুবে যায়।
সবে মাত্র কলেজ থেকে বেরিয়েছে মুন এর’ই মধ্যে হাতে থাকা ফোনটা সাউন্ড বক্সের মতো বেজে উঠে। বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে আসে মুনের। ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখে আম্মু ফোন করেছে। মুন কল রিসিভ করে কানে ধরতেই ওপাশ থেকে মায়ের কন্ঠস্বর ভেসে এলো তার কানে,
“হ্যালো মুন! শোন মা এখন যেখানে যে অবস্থাতে আছিস সেই অবস্থাতেই বাড়ি চলে আয়। দেখ এখন কিছু জিজ্ঞেস করিস না। শুধু এটুকু জেনে রাখ আজ তাহেরার বিয়ে। এখন রাখছি অনেক কাজ আছে আর তুই এক্ষুনি রওনা কর।”
বলেই ফোন কেটে দিল তাহমিনা খান। মুনকে কিছু বলতেও দিল না। মুন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আজ ওর বড় বোনের বিয়ে আর ও’ই জানে না। কিভাবে কি? কিছুই মাথায় ঢুকছে না মুনের।
.
সিলেট থেকে ঢাকা চারঘন্টা জার্নি করে এসে বাড়িতে পা রাখতেই তাহমিনা খান ভালো মন্দ কিছু জিজ্ঞেস না করেই ওকে কাজে বসিয়ে দিল। মুন কিছুই বুঝতে পারছে না। ওর ছোট্ট মনের মধ্যে এতো এতো প্রশ্ন জমেছে যার একটা উওর ও সে এখনো পায়নি। সারা বাড়ি রঙ্গিন আলোয় আলোকিত হয়ে আছে। সবাই দৌড়াদৌড়ি করে কাজ করছে। ৭:৩০ মুন নিজের হাতের কাজটা শেষ করেই ওখান থেকে কেটে পরল না হলে মিসেস তাহমিনা খান ওকে আবার অন্য কোনো কাজে বসিয়ে দিবে। মুন সোজা গিয়ে তাহেরার রুমে উঁকি দিল। তাহেরা কারো সাথে ফোনে কথা বলছে আর কাঁদছে। কিন্তু তাহেরা কি কথা বলছে মুন তা শুনতে পেলনা। তাহেরা ফোন কেটে পিছনে ফিরতেই মুনকে দেখে ঘাবড়ে গেল। মুন রুমের মধ্যে ঢুকে তাহেরার দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচাচ্চে। তাহেরা কে দেখে মনে হচ্ছে চুরি করতে গিয়ে মুনের কাছে ধরা পরেছে। তাহেরার মুখটা ভয়ে একদম চুপসে গেছে। হৃদপিন্ডটা জোড়ে জোড়ে লাফাচ্ছে তার। তাহেরা ভাবছে মুন সব শুনে নিয়েছে। সে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
—“তুই সব শুnনে ফেলেছিস?”
মুন এমন ভান করল যেন সে সত্যিই সব শুনে ফেলেছে। তাই সে বলল,
—“হ্যাঁ। আমি সব শুনে ফেলেছি।”
তাহেরা এবার মুনের সামনে হাত জোড় করে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
—“প্লিস মুন বাবা কে কিছু বলিস না। আমি এই বিয়ে করতে চাই না। আমি অন্য একজনকে ভালবাসি। তাকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারব না। কিন্তু আমি একথা বাবা কে মুখ ফুটে বলতেও পারব না। কারণ এখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। এখন আমার কাছে পালানো ছাড়া কোনো রাস্তা নেই।”
—“ছেলেটা কে? আমি কি তাকে চিনি?”
—“তোকে একদিন আমার এক ছেলে ফ্রেন্ড রাফির সাথে দেখা করিয়ে ছিলাম। ও তোকে অনেক গুলো চকলেট ও দিয়ে ছিল। মনে আছে?”
—“হ্যাঁ। তো?”
—“তোকে আমি সেদিন মিথ্যে কথা বলেছিলাম ও আসলে আমার ফ্রেন্ড না বয়ফ্রেন্ড।”
তাহেরার কথা শুনে মুন প্রচুর অবাক হলো। তাহেরা নিজের বয়ফ্রেন্ড কে বেস্টফ্রেন্ড বলে ওর সাথে পরিচিত করিয়েছে। যাতে মুন কিছু সন্দেহ করতে না পারে!
—“তার মানে এই হলো আসল কাহিনী। কিন্তু ফোনে কার সাথে কথা বলছিলে আর কি বলছিলে?”
তাহেরা যেন আকাশ থেকে পড়ল। সে অবাক ভঙ্গিতে বলল,
—“তার মানে তুই কিছু’ই শুনিস নি?”
মুন ভাবলেশহীন ভাবে জবাব দিল,
—“না।”
—“তাহলে তুই যে বললি, তুই সব শুনে নিয়েছিস?”
—“সেটা তো আমি এমনি বলেছিলাম।”
মুনের কথা শুনে তাহেরা জোড়ে একটা চিৎকার দিল। তার মানে সে শুধু শুধু মুনকে ভয় পেয়ে সব সত্যি নিজে থেকে বলে দিয়েছে? তাহেরা মুনের দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকালো। তা দেখে মুন দাঁত কেলিয়ে একটা হাসি দিল। তাহেরা মুনের দিকে তেড়ে যেতে নেয়, এমন সময় তাহমিনা খান এসে মুন কে বললো তাহেরা কে তাড়াতাড়ি রেডি করতে। একটু পরেই বরযাত্রীরা চলে আসবে। এই বলে তাহমিনা খান চলে গেলেন। তাহমিনা খানের কথা শুনে তাহেরার হাত পা কাঁপছে। সে কি করবে এখন? তার হাতে আর মাত্র কিছুক্ষণ সময়’ই আছে। এর মধ্যে কিছু না করতে পারলে সব শেষ হয়ে যাবে। তাহেরা আর দাঁড়াতে পারল না নিচে বসে পড়ল। সে রাফিকে বড্ড বেশি ভালোবাসে। রাফিকে ছেড়ে অন্য কারোর সাথে সংসার করা তার পক্ষে অসম্ভব। সে রাফির জায়গায় অন্য কাউকে কল্পনা ও করতে পারে না। তাহেরা কিছু না ভেবেই মুনের পায়ের কাছে বসে হাত জোড় করে। মুন লাফ মেরে দূরে সরে গেল।তাহেরা কাঁদতে কাঁদতে বলল,
—“রাফিকে না পেলে আমি মরে যাব। মুন বোন আমার প্লিস আমাকে পালাতে সাহায্য কর। আমি এই বিয়ে কিছুতেই করতে পারব না।”
—“আপু কি বলছ এসব তুমি? আমি তোমাকে কোনো সাহায্য করতে পারব না। তুমি পালিয়ে গেলে আব্বুর সম্মানহানি হবে। আমি তা সহ্য করতে পারব না। আব্বুকে হেনস্থা হতে হবে এমন কাজ আমি কক্ষনো করতে পারব না।”
তাহেরা চোখ মুছে উঠে দাঁড়ালো। মুন কিছুই বুঝতে পারছে না। তাহেরা আচমকা একটা ছুরি নিয়ে হাতে হালকা করে টান দিল। সাথে সাথে উপরের পাতলা চামড়া কেটে গড় গড়িয়ে রক্ত পড়তে লাগল। মুন ভয় পেয়ে গেল।
—“আপু কি করছ? ফেল ওটা। দেখ পাগলামী করো না। ফেল বলছি।”
—“আগে বল আমাকে পালাতে সাহায্য করবি?”
মুন আর কিছু ভাবতে পারল না রাজি হয়ে গেল। তাহেরা হাত থেকে ছুরিটা ফেলে দিল। মুন তাড়াতাড়ি ফাস্ট এইড বক্স এনে তাহেরার হাত ব্যান্ডেজ করে দিল। তারপর বলল,
—“বিয়ে কবে ঠিক হয়েছে আর কার সাথে?”
—“তোর আরমান আঙ্কেলের কথা মনে আছে? বাবার বেস্টফ্রেন্ড, কয়েকবার আমাদের বাসায় এসেছিল। আর প্রতিবার তোর আর আমার জন্য চকলেট নিয়ে আসত।”
—“হ্যাঁ মনে পড়েছে। আরমান রেজওয়ান ওনার নাম। আব্বুর স্কুল লাইফ থেকে বেস্টফ্রেন্ড।”
—“হুম। উনি বাবাকে বলে, আমাকে ওনার ছেলের পুত্রবধূ করতে চান। এত বছরের বন্ধুত্ব কে আত্মীয়তে পরিনত করতে বাবাও রাজি হয়ে যান। ওনার ছেলে একজন ডক্টর ‘হার্ট সার্জেন্ট’ কাজের প্রতি খুবই রেসপনসিবেল। তাই কাজ বাদ দিয়ে বিয়ের কোনো অনুষ্ঠান সে করতে চায় না। তাই কাল আরমান আঙ্কেলের পরিবারের সবাই আমাকে এসে দেখে গেছে। তাদের আমাকে পছন্দ হয়েছে তাই আজ একেবারে বিয়ে।
—“ওওও। সব বুঝলাম এখন বল আমাকে কি করতে হবে?”
—“পালানোর পথ খুঁজে বের করতে হবে। আমার মাথায় কিছু আসছে না। পুরো মাথা হ্যাং হয়ে গেছে। তোর কাছে কোনো আইডিয়া আছে?”
—“দাঁড়াও ভাবতে দেও।”
মুন ভাবতে লাগল তাহেরা কে কিভাবে বাড়ির বাইরে নিয়ে যাওয়া যায়। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ ওর মাথায় একটা বুদ্ধি এলো। মুন ছুটে কাবার্ডের কাছে গেল তারপর কাবার্ড থেকে একটা বোরখা আর নিকাব নিয়ে এসে তাহেরা কে দিয়ে বলল,
—“নেও এগুলো পরে পরো।”
—“কেন এগুলো পড়ে কি হবে?”
—“দেখ বাড়ির চারপাশে মানুষজনে ভরা তাই তুমি যদি পালাতে যাও কারো না কারো চোখে তুমি ধরা পরবেই। আর আমাদের বাড়ির প্রতিটা রুমের বারেন্দায়’ই গ্ৰিল লাগানো। তাই তুমি বারেন্দা দিয়ে পালাতে পারবে না। পালাতে হলে তোমাকে সারার সামনে দিয়েই পালাতে হবে। তাই যদি তুমি বোরখা পড়ে নিকাব দিয়ে মুখ ঢেকে তাদের সামনে দিয়েও যাও কেউ তোমাকে চিনতে পারবে না। কেমন আইডিয়া দিলাম বল?”
তাহেরা হঠাৎ করে মুনকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল আর বলল,
—“তুই সত্যিই খুব ভালো বোন মুন।”
—“হয়েছে হয়েছে আর পাম দিতে হবে না। তোমার হেল্প করেছি বলে এখন ভালো হয়ে গেলাম তাই না? বুঝি বুঝি সব বুঝি।”
—“না রে। আমি একদম সত্যি বলছি। আমি চলে গেলে আমাকে তোর মনে পরবে?”
—“একটুও না। তুমি চলে গেলে পুরো বাড়িতে আমার রাজক্ত হবে। শুধু আইসক্রিম খাওয়ার সময় একটু মনে পরবে। তাও বেশি না। দেখ এই টুকু।”
আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বলল মুন। তাহেরা হেসে দিল। তারা ঝগড়া করে ঠিকি কিন্তু একে অপরকে খুব ভালোবাসে। আর ভাই-বোনের সম্পর্ক গুলো তো এমনই খুনসুটিময় ভালোবাসায় পরিপূর্ণ।
.
মুন দরজার ফাঁক দিয়ে বাইরে উঁকি মেরে দেখল কেউ আছে কিনা। নাহ কেউ নেই। মুন তাহেরা কে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। তাহেরা ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে গেছে। যদি একবার ধরা পরে যায় তো সব শেষ। মুন চোরের মতো চারদিকে চোখ ঘুরিয়ে দেখছে কেউ সন্দেহ করছে কিনা। আর মনে মনে আয়াতুল কুরসি পড়ছে যেন ধরা না খায়। তাহলে তাহেরার সাথে সাথে ও ও শেষ। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামার সময় একজন প্রতিবেশীর সামনে পরে যায় ওরা। সে সন্দিহান চোখে মুনের দিকে তাকিয়ে আছে। আর তার দৃষ্টি দেখে মুনের ঘাম ছুটে যাচ্ছে। মহিলাটি বলল,
—“কিরে মুন এটা কে রে? আর তুই ওনাকে এভাবে ধরে রেখেছিস কেন?”
মুন হাসার চেষ্টা করে বলল,
—“আসলে আন্টি উনি আমার দূর সম্পর্কের আত্মীয়। বুড়ো মানুষ তো তাই সিঁড়ি দিয়ে নামতে পারছিল না। তাই আমি তাকে সাহায্য করছি।”
–“ওওও। তোর মা কোথায় রে?”
—“আম্মু, আম্মু তো মনে হয় রান্না ঘরে আছে।”
—“তাহেরার তো শেষ এবার কিন্তু তোর পালা তৈরি হয়ে থাকিস।”
বলেই মহিলিটি হাসতে হাসতে চলে গেল। ওরা দুজনে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। তারপর দুজনে তাড়াতাড়ি সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেল। ড্রইংরুম পেরিয়ে মেইন দরজার কাছে আসতেই পিছন থেকে তাহমিনা খান ডাক দিলেন। তাহেরার বুক ধুকধুক করছে। এই বুঝি ধরা পরে গেল। আর মুনের তো জান যায় যায় অবস্থা। বলে না যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়। ওদের অবস্থা হয়েছে ঠিক সেই রকম। মুন মাথা ধুরিয়ে পিছনে ফিরে তাকাল। তাহেরা পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যেন নড়াচড়ার শক্তি টুকু ও নেই। দম বন্ধ হয়ে আসছে তার। শ্বাস যেন গলায়’ই আঁটকে আছে। তাহমিনা খান এগিয়ে আসলেন আর বললেন,
—“কিরে তুই এখানে কি করছিস? আর তাহেরা কোথায়?”
তাহেরার বুকের মধ্যে ছ্যাত করে উঠল এই বুঝি মা ধরে ফেলল। মুন আমতা আমতা করে বলল,
—“আসলে আম্মু আপুর সাজতো প্রায় শেষ তাই আপু আমাকে বলল আমিও যেন রেডি হয়ে নেই।”
তাহমিনা খান মুনকে একবার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে নিয়ে ভ্রু জোড়া কুঁচকে বললেন,
—“তাহলে তুই রেডি না হয়ে এখানে কি করছিস?”
—“আসে আম্মু আমার কিছু ফ্রেন্ড আসবে তাই ওদের আনতে যাচ্ছি।”
তাহমিনা খান আর কিছু বললেন না চলে গেলেন। মুন যেন প্রান ফিরে পেল। তাহেরা ফিসফিসিয়ে বলল,
—“তাড়াতাড়ি চল নাহলে আবার কেউ এসে পড়বে।”
—“হ্যাঁ হ্যাঁ চল। এটুকু রাস্তা পার হতে পারলে’ই বাঁচি বাবাহ।”
.
পুরো বাড়িতে থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছে। কবির খান চেয়ারে মাথা নিচু করে কপালে হাত ঠেকিয়ে বসে আছে আরমান রেজওয়ান আর তার পরিবারের সামনে। আর মুন তার পাশেই্ দাঁড়িয়ে আছে। তাহমিনা খান মেয়ের পালানোর কথা শুনেই জ্ঞান হারিয়েছে। এখনো পর্যন্ত জ্ঞান ফেরেনি তার। মুনের এখন মনে হচ্ছে তাহেরা কে পালাতে সাহায্য না করে আব্বুর কাছে এসে সোজা বলে দিলেই ভালো হতো। তাহলে আর আব্বু কে সবার সামনে অপমানিত হতে হতো না। অবশ্য ছেলেপক্ষরা এখনো তেমন কিছু বলে নি কিন্তু তাও বিয়ের দিন মেয়ে পালিয়ে যাওয়া টা তো অপমানজনক’ই। মুন এসব কথা চিন্তা করছিল। হঠাৎ কবির খান উঠে আরমান রেজওয়ানের সামনে গিয়ে হাত জোড় করে বললেন,
—“মাফ করে দে আরমান। আমি খুবই লজ্জিত নিজের মেয়ের কর্মকান্ডে। আমি তোকে দেওয়া কথা রাখতে পারলাম না রে। আমাদের বন্ধুত্ব কে গভীর করার জন্য তাহেরা কে তোর পুত্রবধূ বানাতে চেয়েছিলাম কিন্তু তা আর হলো না। প্লিস আমাকে মাফ করে দিস।”
আরমান রেজওয়ান কবির খানের হাত ধরে নিচে নামিয়ে বললেন,
—“তুই ক্ষমা চাইছিস কেন? এতে তোর তো কোনো দোষ নেই? দেখ যা হওয়ার হয়ে গেছে তা নিয়ে ভেবে আর লাভ নেই। তাহেরা কে তোর আর ফিরিয়ে আনা যাবে না। কিন্তু আমাদের বন্ধুত্ব কে এখনো আত্মীয়তে পরিনত করা যাবে?”
কবির খান প্রশ্ন সূচক দৃষ্টিতে আরমান রেজওয়ানের দিকে তাকালেন। আরমান রেজওয়ান হেসে বললেন,
—“তোর যদি কোনো সমস্যা না থাকে তাহলে তোর ছোট মেয়েকে আমার ছেলের বউ করতে চাই। খালি হাতে ফিরিয়ে দিস না বন্ধ।”
আরমান রেজওয়ানের কথা শুনে মুন চমকে তাকালো তার দিকে। কবির খান কি বলবেন বুঝতে পারছেন না। মুন সবে মাত্র এসএসসি পাস করে কলেজে ভর্তি হয়েছে। তাছাড়া মুনের এখনো বিয়ের বয়স হয়নি। কিছুদিন হলো ষোল তে পা দিয়েছে। এখন কিভাবে সে তার পিচ্চি মেয়েটাকে বিয়ে দিয়ে দিবে। মুনের বয়স যদি আঠারো হতো তাও কোনো সমস্যা ছিল না কিন্তু মুন তো এখনো নাবালিকা। কিন্তু বিয়ে করতে এসে বরযাত্রী খালি হাতে ফিরে গেলেও তো লোকজন খারাপ বলবে। আর আরমান রেজওয়ান তার দিকে এমন আশা ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে যা ফিরিয়ে দেওয়া ও তার পক্ষে সম্ভব না। অনেক ভেবে কবির খান একটা সিদ্ধান্ত নিলেন। আরমান রেজওয়ান অধৈর্য হয়ে বললেন,
—“বল তুই কি আমাকে তোর মেয়ে দিবি? আমি তোর কাছ থেকে বৌমা না মেয়ে চাইছি।”
—“হ্যাঁ আমি রাজি।”
আব্বুর মুখের কথা শুনে মুন যেন জমে পাথর হয়ে গেছে। অনুভূতি গুলো একদম শূন্য। সে কখনো তার আব্বুর কাছ থেকে এরকম কিছু আশা করে নি। মুনের পুরো বিশ্বাস ছিল যে কবির খান কখনো রাজি হবে না। কিন্তু কবির খান মুনকে মিথ্যে প্রমান করে হ্যাঁ বলে দিল। আরমান রেজওয়ান কবির খানকে জড়িয়ে ধরল। তারপর আবার শুরু হলো বিয়ের তোরজোর। কবির খান মুনের সাথে কথা বলতে ওকে একটা রুমে নিয়ে গেল তারপর বলল,
—“আম্মুটা আমার রাগ করো না আমার উপর। আমি তোমার মতামত না জেনেই ওদের হ্যাঁ বলে দিয়েছি। আমি যা করছি তোমার ভালোর জন্যই করছি। আমি ওদের চিনি ওরা তোমাকে বাড়ির বউ না মেয়ের মতো করে রাখবে। আঁধার ও খুব ভালো ছেলে ও তোমাকে সুখে রাখবে। আমি জানি তুমি আমার কথা রখবে। সত্যি রাখবে তো?”
মুন কিছু বলল না নিশ্চুপ রইলো। কবির খান মুনের চুপ থাকা কে হ্যাঁ মনে করে চলে গেল। মুনের চোখ থেকে গড়িয়ে পড়লো একফোঁটা জল। কেউ বুঝল না তার কষ্ট। কিছুক্ষণ পর কিছু মেয়েরা এসে মুনকে রেডি করিয়ে নিচে নিয়ে গেল। একটা সিগনেচার আর তিনবার কবুল বলেই মুন বিয়ে নামক বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে গেল। মুন এখনো জানে না তার সাথে কার বিয়ে হয়েছে। তাকে দেখেনি পর্যন্ত। কারন বিয়ের সময় মুন আর ছেলেটির সামনে একটা পর্দা টাঙ্গানো ছিল। মুন বিয়ে পড়ানোর সময় একদম পাথর হয়ে বসে ছিল। যেন কোনো জীবন্ত লাশ। যার কোনো অনুভুতিই নেই।
.
দরজার খোলার শব্দে মুনের ভাবনার সুতো কাটে। মুহুর্তেই তার মনের মধ্যে একগাদা ভয়েরা বাসা বাঁধে। শরীর থরথর করে কাঁপছে তার। এসির নিচে বসে থেকেও সে ঘামছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে এখনই নিঃশ্বাস আঁটকে মারা যাবে সে। কিন্তু তারপরও মুন নিজেকে যথেষ্ট শক্ত দেখানোর চেষ্টা করছে। মুনের দেখতে ইচ্ছে করছে কে এসেছে কিন্তু ভয়ে মাথা তুলে তাকানোর সাহস পাচ্ছে না। জীবনে এর আগে কখনো এমন পরিস্থিতির স্বীকার হতে হয়নি তাকে। আঁধার রুমে ঢুকে ধিরিম করে দরজা বন্ধ করে দিল। যার শব্দে কেঁপে উঠলো মুন। মুন জানে না যে ওর সাথে কি হতে যাচ্ছে। মুন বেডের একদম মাঝখানে বসে ছিল। আঁধার সোজা গিয়ে আচমকা মুনের হাত ধরে বেড থেকে টেনে নামিয়ে ফ্লোরে ছুরে মারে।মুন নিচে পরে ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠে। সাথে সাথে চোখ থেকে জল বেরিয়ে আসে। মুন জলে ছলছল চোখে অবুঝ দৃষ্টিতে আঁধারের দিকে তাকিয়ে আছে। আঁধার চিৎকার করে বলে ওঠে,
—“কিসের জন্য আমাকে বিয়ে করেছ হ্যাঁ? টাকার জন্য? কত টাকা চাই বল আমি এক্ষুনি দিয়ে দিচ্ছি। নিয়ে বিদায় হও। যে মেয়ের বড় বোন বিয়ে থেকে পালিয়ে যেতে পারে তার ছোট বোন কেমন হবে তা আমার খুব ভালো করে জানা আছে। তোমাদের বাবা মেয়ের মতলব আমি বুঝি না ভেবেছো? ছেলে ভালো, দেখতে সুন্দর, সিনিয়র ডক্টর, নিজের হসপিটাল আছে, বাবার বিজনেস আছে, বড়লোক। এমন ছেলেকে তোমার বাবা কিছুতেই হাত ছাড়া করতে চায়নি। তাই তো বড় মেয়ে বিয়ে থেকে পালিয়ে যাওয়ার পরেও ছোট মেয়েকে আমার গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছে।”
মুন এতোক্ষণ চুপ করে থাকলেও আব্বুর সম্পর্কে এমন বাজে কথা শুনে আর চুপ থাকতে পারলো না। মুন উঠে দাঁড়িয়ে আঁধারের দিকে আঙ্গুল তুলে তেজি গলায় বলল,
—“আমার আব্বুকে নিয়ে আর একটা বাজে কথা বললে একদম খুন করে ফেলবো আপনাকে। আমাকে যা বলার বলুন কিছু বলব না। কিন্তু আমার আব্বুকে কিছু বললে আমি চুপ থাকব না। আর নিজেকে কি মনে করেন আপনি হ্যাঁ? বিশ্ব সুন্দরী? নিজেকে কখনো আয়নায় দেখেছেন? আপনাকে দেখতে একদম রাক্ষসের মতো লাগে। আর টাকার গরম দেখাচ্ছেন কাকে? আপনার টাকার খাতায় আগুন। আর শুনে রাখুন আমার আব্বু আপনার বাবার পায়ে পরে বলেনি যে আমার মেয়েকে বিয়ে করুন। আপনার বাবাই আমার আব্বুর কাছে এসে অনুরোধ করেছিল যাতে আমাকে আপনার সাথে বিয়ে দেয়। তাই আর একটাও উল্টাপাল্টা কথা আমার বাবার নামে বলবেন না।”
আঁধার অবাক হয়ে মুনের দিকে তাকিয়ে আছে। সে ভাবে ছিল মুন এসব শুনে তাকে ডিভোর্স দিয়ে চলে যাবে। কিন্তু তা হলো না। আঁধার নিজেকে সংশোধন করে নিল তারপর গম্ভীর মুখে বলল,
—“দেখ আমি তোমাকে আমার………”
মুন আঁধারকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
—“জানি জানি আপনি এখন আমাকে কি বলবেন। আপনি গল্প/সিনেমার নায়কদের মতো বলবেন, আমি তোমাকে আমার স্ত্রী হিসেবে মানি না। আমি অন্য কাউকে আমার জান,প্রান,হাড্ডি,কলিজা, লিভার সব দিয়ে দিয়েছি। তাই আমি তোমাকে স্ত্রী’র মর্যাদা দিতে পারব না। তুমি আমার থেকে কোনো কিছু আশা করবে না। আমি তোমার সাথে এক বেডে শুতে পারবে না। তুমি নিচে/সোফায় গিয়ে ঘুমাও ইত্যাদি। এগুলোই তো বলবেন তাইনা? কিন্তু হো স্যাড আমি গল্প অথবা সিনেমার নাইকা না যে ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদতে কাঁদতে আপনার কথা মতো নিচে গিয়ে শুয়ে পরব। শুনুন Mr. Husband আপনি মানেন আর না মানেন আমাদের বিয়ে হয়েছে আর আমি আপনার স্ত্রী। এই রুমে আপনার যত টুকু অধিকার আমারো ঠিক ততো টুকুই অধিকার। তাই এই বেডে ও আমার অধিকার আছে। এখন আপনার যদি আমার সাথে বেড শেয়ার করতে প্রবলেম হয় তাহলে আপনি সোফায় গিয়ে ঘুমাতে পারেন। আমি তো ভেবেই শোবো।”
বলেই মুন গিয়ে বেডে আরামসে ব্লাংকেট মুড়ি দিয়ে শুয়ে পরল। আর আঁধার হাবলার মতো দাঁড়িয়ে আছে। আঁধার মুনকে দেখে অবাকের পর অবাক হচ্ছে। এই মেয়ে এতো কথা বলতে পারে! যে ওকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নিজে একা একাই মনগড়া কথা বলে বেডে গিয়ে শুয়ে ও পড়ল। আচ্ছা এই মেয়ে কি পাগল? আঁধার আর কিছু বলল না বেগ থেকে একটা বালিশ নিয়ে লাইট অফ করে সোফায় গিয়ে শুয়ে পরল। হঠাৎ করে মুন চিৎকার করে উঠলো। মুনের চিৎকার শুনে আঁধার ধরফরিয়ে উঠে লাইট অন করে দিল। মুনের চোখে ভয়। সে কাঁপছে। মুন চেঁচিয়ে বলল,
—“লাইট অফ করেছেন কেন?”
—“তাহলে মানুষ কি লাইট অন করে ঘুমায়?”
—“মানুষের কথা জানি না আমি লাইট অন করেই ঘুমাই।”
—“তুমি কি মানুষ না?”
—“না এলিয়েন।”
—“আমারো তাই মনে হয়।”
—“আপনার যা ইচ্ছে মনে হোক আমার তাতে কিছু যায় আসে না। কিন্তু লাইট অফ করা যাবে না।”
—“কিহ? আমি লাইট অন থাকলে ঘুমাতে পারি না।”
—“আমিও লাইট অফ থাকলে ঘুমাতে পারি না। আমার ভীষণ ভয় করে। তাই লাইট অন থাকবে।”
—“না লাইট অফ থাকবে।”
—“না অন থাকবে।”
—“না অফ থাকবে।”
দুজনে অন অফ নিয়ে তর্ক করতে করতে এক পর্যায়ে মুন জোড়ে চিৎকার করতে শুরু করলো। মুন এতো জোড়ে চিৎকার করছে আঁধারের কানের পর্দা যেন ফেটেই যাবে এমন অবস্থা হয়েছে। আঁধার কানে দু’হাত চেপে ধরে। তারপরও মুন থামছে না চিৎকার করেই চলেছে। আর সহ্য করতে না পেরে আঁধার গিয়ে মুনের মুখ চেপে ধরে ধমকের সুরে বলল,
—“চুপ একদম চুপ। আর একটা শব্দও যেন মুখ থেকে না বের হয়।”
বলেই আঁধার মুনের মুখ থেকে হাত সরিয়ে নিল। মুন মিষ্টি করে হেসে বলল,
—“এটা তো ট্রেইলার ছিল। লাইট অফ হলে পুরো ফিল্ম দেখাবো।”
বলেই চোখ টিপ মারল মুন। আঁধার হার মেনে লাইট অফ রেখেই সোফায় গিয়ে মুখে বালিশ চেপে শুয়ে পরলো। মুন বিজয়ীর হাসি দিয়ে বলল,
—“থ্যাঙ্ক ইউ Mr. Husband। আর এটা তো সবে মাত্র শুরু সারা জীবন তো পরেই আছে।”
আঁধার কোনো উওর দিল না। মুন ব্লাঙ্কেট মুড়িয়ে শুয়ে পড়ল। সাথে সাথেই ঘুম পরীরা এসে ভার করল তার দু’চোখে।
চলবে,