#Mr_Husband,পর্ব_৩৮,৩৯
#লেখিকা: আবনী ইবনাত মুন
#পর্ব_৩৮
—“কাউকে ভালোবাসাটাই যদি পাপ হয়ে থাকে, তাহলে আমিই বড় পাপি!! আমাকে কষ্ট দিয়ে যদি তুমি সুখি হও, তাহলে আমিই সব চেয়ে বড় সুখি!!”
আঁধারের কন্ঠে কাতরতা। দু চোখে তৃষ্ণা, পিপাসা, তীব্র আকাঙ্ক্ষা সব এক সাথে দেখা যাচ্ছে। আঁধার মুনকে চায়। খুব করে চায়। নিজের এই বুক পাজরে বন্দী করে রাখতে চায়। আঁধার আবারো বলল,
—“তোমাকে বিয়ে করতে চেয়ে ছিলাম তার কারণ, আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চেয়ে ছিলাম। ভালোবাসা না পাওয়ার কষ্টটা বোঝাতে চেয়ে ছিলাম। পেয়েও হারেইয়ে ফেলার কষ্ট উপলব্ধি করাতে চেয়ে ছিলাম। নিজে কাছে আটকে রেখে শাস্তি দিতে চেয়ে ছিলাম। কারণ আমি মনে করেছিলাম তোমার কারণে সেদিন আমি রুশাকে হারিয়েছি। কিন্তু হলো অন্য কিছু। তোমাকে শাস্তি দিতে গিয়ে আমি নিজেকেই তোমাতে জরিয়ে ফেলেছি। তোমাকে ভালোবাসা শেখাতে গিয়ে আমি নিজেই তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি। কিন্তু বিশ্বাস করো আমি তোমাকে কখনো হার্ট করতে চাইনি। আমি জানি আমি খুব খুব খারাপ। কিন্তু সত্যি বলছি তোমাকে অনেক বেশি ভালোবাসে এই খারাপ ছেলেটা। প্লিজ ফিরে এসো আমার কাছে। আমি প্রমিজ করছি তোমাকে আর কখনো কষ্ট দিবো না। এই মাটি তোমার পা ছুয়াতে দিবো না। রানী করে রাখবো আমার এই রাজত্বের। প্লিজ সোনা ফিরে এসো তোমার এই মি. হাসবেন্ডের কাছে। প্লিজ। জানো সবাই আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে। তুমিও চলে গেলে। প্লিজ সোনা ফিরে এসো তোমার এই মি. হাসবেন্ডের কাছে। প্লিজ। আর রাগ করে থেক না। চলে এসো। এই ছয়টা বছর কি কম ছিল আমাকে কষ্ট দেওয়া জন্য। ছয় বছরে কম শাস্তি তো দেওনি। আর কত? এবার তো ফিরে এসো! দেখ আমি ভালো নেই। আমি মরে যাচ্ছি।”
আকুতি ভরা কন্ঠে বলল। ইসী দরজা খুলে রুমের ভেতরে ঢুকে। ইসীর চোখ, মুখ ফোলা। ফর্সা মুখে রক্ত জমাট বেধেঁ রয়েছে এমন মনে হচ্ছে। ইসী দেখে পুরো রুমের দেয়াল জুড়ে শুধু মুনের ছবি। হাসি, কান্না, রাগ, অভিমান, দুষ্টুমি, খুনসুটি মুনের প্রতিটি রিয়েকশন ও প্রতিটি মূহুর্ত্তের ছবি এখানে আছে। পুরো রুমে আসবাবপত্র বলতে শুধু একটা ছোট টেবিল। টেবিলের উপর অনেক গুলো এলকোহলের বোতল। কয়েকটা খালি বোতল মেঝেতে পরে আছে। ইসী আস্তে করে গিয়ে আঁধারের কাধে হাত রাখে আর বলে,
—“আজকের দিনে এগুলো না খেলে হতো না?”
আঁধার আচমকাই পেছনে ফিরে ইসীকে জরিয়ে ধরে আর বাচ্চাদের মতো করে কেদেঁ বলে,
—“ও আমার কথা শুনছে না ইসী। ও আমার কথা শুনছে না। ও ফিরে আসছে না আমার কাছ। সবাই কেনো আমাকে ছেড়ে চলে যায় ইসী? ইসী, ওকে বল না ফিরে আসতে। আমি কষ্ট পাচ্ছি ওর জন্য। কষ্ট হচ্ছে আমার খুব। দেখ এই এইখানটায় খুব কষ্ট হচ্ছে।”
বুকের বাম পাশে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে। ইসীর ঠোঁট ভেঙে কান্না আসে। আঁধারকে জড়িয়ে ধরে নিজেও কেদেঁ দেয়। এত কঠিন ব্যক্তিত্বের ছেলেটার কি অবস্থা হয়েছে। কত সহজে ওই মেয়েটা এই ছেলেটাকে ভেঙে গুড়িয়ে দিয়ে চলে গেছে। এতটা তো রুশা চলে যাওয়ার পরও ভেঙে পরেনি যতটা ওই মেয়েটার জন্য পরেছে। ইসীর খুব রাগ হচ্ছে মুনের প্রতি। যদি কখনো মেয়েটার সাথে দেখা হয়, সাথে সাথে ঠাটিয়ে দুটো চড় মেরে জিজ্ঞেস করবে ‘কেন, কেন এই ছেলেটাকে ছেড়ে চলে গেছো? কিভাবে পায়ে ঠেলে চেলে গেছো এই পাগল ছেলেটার ভালোবাসা। গিয়েছো ভালো কথা তার আগে ছেলেটাকে নিজের হাতে মেরে চলে যেতে। একবারে মরে যেত। এভাবে বারবার ধুকেধুকে তো আর মরতে হতো না ওকে।’ ইসী নিজেকে সামলে নেয়। আঁধারের পিঠে হাত বুলিয়ে ভাঙা গলায় বলে,
—“আঁধার আরুশের সাথে দেখা করতে যাবি না? ও অপেক্ষা করছে তো আমাদের জন্য। গিয়ে দেখবি রাগ করে মুখ ফুলিয়ে বসে আছে। চল আমাদের দেরী হয়ে যাচ্ছে। বাইরে গাড়িতে সবাই অপেক্ষা করছে। আমি যাচ্ছি তুই ফ্রেশ হয়ে তাড়াতাড়ি চলে আয়।”
আঁধারকে ছেড়ে ওর চোখের জল মুছে দিয়ে বলল। তারপর চলে গেল নিজের চোখের জল আড়াল করে। আঁধার এক নজর মুনের ছবিটির দিকে তাকিয়ে রুমের দরজা লক করে চলে গেল।
–
বড় কালো গাড়িটি এসে থামলো একটা নির্জন, নিস্তব্ধ জায়গায়। বড় গেট দিয়ে সবাই পাচিলে ঘেরা বাগানটিতে ঢুকে। সোরু একটা রাস্তা ধরে ওরা হেঁটে যায় সামনে। পুরো জায়গাটা জুরো ফুলগাছের ছড়াছড়ি। নাম জানা না জানা নানান ধরনের ফুল গাছ। ওদের পথ এসে থামে একটা বাধানো কবরের সামনে। কবরটিতে খোদাই করে মৃত ব্যক্তির নাম লেখা। ইসী কবরটির সামনে আসতেই ধপ করে নিচে বসে পরে। হাতে থাকা ক্যামেলিয়া ফুলের তোরাটা কবরের উপর রাখে। কবরটিকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে দেয়। কবরের উপর হাত ছুড়তে ছুড়তে গলা ফাটিয়ে কাঁদতে কাঁদতে অভিযোগের সুরে বলল,
—“কেনো চলে গেলি তুই? কি করে আমাকে ফেলে একা একা চলে গেলি? তোর বুক কাঁপলো না? এতো সাহস কোথায় পেলি। একটুও ভয় করলো না তোর? একবারো মনে পরলো না আমার কথা? একবারো ভাবলি না আমি কি করে থাকবো? কি নিয়ে বাঁচবো? কার সাথে ঝগড়া করবো? চুপ করে আছিস কেনো উওর দে? যোগ্য শাস্তি কি তোর এই অপরাধের? তুই তো ঠিকই চোখ বন্ধ করে আরামে ঘুমাচ্ছিস। কিন্তু আমার ঘুম কেনো কেড়ে নিলি? কেনো? অ্যান্সার মি রুশ। অ্যান্সার মি।”
সবাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। কারো মুখে কোনো কথা নেই। দু চোখের বাঁধ ভেঙেছে সবার। আঁধার মূর্তি ন্যায়’ই দাঁড়িয়ে আছে। তার কোনো হেল দোল নেই। আরুশের সেই হাস্যউজ্জল মুখ, দুষ্টুমি-খুনসুটিতে কাঁটানো কিছু মুহুর্ত ভেসে উঠে আঁধারের চোখের সামনে। আঁধার ভাবতেই পারছে না তার প্রাণ প্রিয় বন্ধুটি আর নেই। চলে গেছে অনেক বছর আগে। শান্তিতে ঘুমাচ্ছে সে। তার জন্য’ই তো এতো কিছু। সে আজ সাথে থাকলে তার জীবনের মোড়টা অন্য রকমই হতো। স্বাভাবিক একটা জীবন হতো তার ও।
.
—“প্রিন্সেস আবার কি করেছো তুমি? ইউরেনা মিস কেনো ডেকেছে আমাকে? তুমি আবার কারো সাথে ফাইট করোনি তো?”
সন্দিহান চোখেমিষ্টির দিকে তাকিয়ে কথাটা বলল রাত।
—“পাপা ইউ ডু’নট বিলিভ মি?
মিষ্টি আড়চোখে তাকিয়ে বলল। রাত মিষ্টির সামনে হাটু গেড়ে বসে মিষ্টির হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বলল,
—“নো প্রিন্সেস। আই বিলিভ ইউ। বাট হোয়াই ডিড ইউর মিস কল মি?”
মিষ্টি কাচুমাচু হয়ে বলল,
—“জ্যান আমার পেন ছিনিয়ে নিয়ে যায়। আমি ভালো ভাবে ওর কাছে আমার পেন চাইলে ও আমাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়। আমি পরে গিয়ে অনেক ব্যাথা পাই। তাই আমিও উঠে ওকে ধাক্কা দেই। আর ‘ও’ ও পরে গিয়ে ব্যাথা পায়। এখন তুমিই বলো পাপা, আমি কি ভুল কিছু করেছি?”
রাত মিষ্টির নাক টেনে হেসে দেয়। আর বলে,
—“না, একদম ঠিক করেছো। এই জন্যই তো তুমি পাপার প্রিন্সেস।”
বলেই দুই বাপ মেয়ে হাই ফাইভ করলো। মিষ্টি চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল,
—“বাট পাপা এ্যাংরি বার্ড যদি জানতে পারে তখন কি হবে?”
রাত ও মিষ্টির মতো ভাবার এ্যাক্ট করে বলল,
—“সত্যিই তো, তখন কি হবে?”
মিষ্টি বলল,
—“ভয়ের কিছু নেই পাপা। আমার বদলে তুমি বকা খেয়ে নিবে।”
রাত মুখ ভার করে বলল,
—“এটা কি হলো?”
মিষ্টি তাড়া দিয়ে বলল,
—“এ্যাংরি বার্ডের আমরা দুজনে মিলে পরে সামলে নিবো। এখন মিসকে আগে তুমি সামলাও।”
–
রাত আর মিষ্টি ইউরেনা মিসের সামনে বসে আছে। ধবধবে ফর্সা রঙের সোনালি চুলের বিদেশি মেয়েটির নাম ইউরেনা। মষ্টি মাথা নিচু করে বসে আছে আর ইউরেনা মিস মিষ্টির দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে আছে। আর রাত তো ইউরেনা মিসের দিকেই তাকিয়ে আছে। ইউরেনা মিসকে দেখে যেন রাতের ঠোঁট থেকে হাসিই সরছেই না। ইউরেনা মিস একবার রাতের দিকে আরেক বার মিষ্টির দিকে তাকিয়ে গলা খেকাড়ি দিয়ে ইরেজিতে বললেন,
—“মি. রাত আঁধরিকা দিন দিন অনেক দুষ্টু হয়ে যাচ্ছে। কারো সাথে মিলে মিশে থাকতে পারে না। কারো না কারো সাথে ঝগড়া মারামারি লেগেই থাকে। ও নামে অনেক কম্পেন এসেছে। প্লিজ আপনি ওকে বুঝিয়ে বলুন না হলে আমি ওর মমকে কল করে বলবো।”
মিষ্টি রাতের গিকে তাকালো। রাত সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলো,
—“নো, নো মিস। আমি ওকে বুঝিয়ে বলব। ও আর এরকম কিছু করবে না। তাইনা মিষ্টি?”
মিষ্টি ঘনঘন মাথা দুলালো। ইউরেনা মিস বলল,
—-“ঠিক আছে। এখন আসতে পারেন।”
রাত যেতে যেতে আবার ফিরে এসে জিজ্ঞেস করলো,
—“মিস আপনি কি সিঙ্গেল?”
ইউরেনা মিস ভ্রু কুঁচকে বলল,
—“কেন?”
রাত মাথা চুলকে বলল,
“না, এমনি।”
ইউরেনা মিস হাসে। তারপর আবার বলল,
—“ইয়েস।”
রাত লাফাতে লাফাতে ইউরেনা মিসের কেবিন থেকে বের হয়। মিষ্টি ভ্রু কঁচকে রাতকে দেখে। মিষ্টি কেবিন থেকে বের হয়েই জ্যানকে দেখে আর আটকে রাখে। রাতের বকা খাওয়ানোর জন্য। মিষ্টি জোরে ডাক দেয়,
—“পাপা”
রাত এগিয়ে যায় মিষ্টির দিকে। জ্যানকে দেখে জিজ্ঞেস করে,
—“এটাকে?”
মিষ্টি জ্যানের দিকে তাকিয়ে বলল,
—“এটাই সেই ছোট হাতিটা।”
রাত ভ্রু নাচিয়ে তাকায় ছেলেটার দিকে। নাদুসনুদুস একটা ছেলে বিদেশি তাই গায়ের রঙ ফর্সা। পেটটা হাড়ির মতো। গাল দুটো টমেটোর মতো। হাত-পা বেলুনের মতো। মিষ্টির দেওয়া নামটা এর সাথে ভালোই যায় ‘ছোট হাতি”। রাত জোরে ছেলেটার গাল টেনে ধরে বলল,
—“এই শালা তুই আমার প্রিন্সেস কে নাকি ধাক্কা মেরেছিস?”
ছেলেটা ভয়ে ভয়ে বলল,
—“নো আঙ্কেল আমি মারিনি।”
মিষ্টি রেগে ছেলেটার মাথায় চাটি মেরে বলল,
—“আবার মিথ্যে কথা বলিস। পাপা ও আমাকে সরি পর্যন্ত বলেনি।”
রাত ও ছেলেটার মাথায় চাটি মেরে বলল,
—“এই পেটুক এখুনি সরি বল আমার প্রিন্সেসকে।”
ছেলেটা মিষ্টির কাছে সাথে সাথে ক্ষমা চায়,
—“আই এম সরি আঁধরিকা। আর কখনো হবে না।”
মিষ্টি বিরক্তির ভঙ্গিতে বলল,
—“সরি বললেই সব ঠিক হয় না। তবুও যাহ,যাহ মাফ করে দিলাম এতো কাঁদার কিছু নেই।”
রাত জ্যানকে বলল,
—“শোন আজ থেকে তুই আমার প্রিন্সেসের বডি গার্ড। ওকে কেউ কিছু বললে তুই ওকে প্রটেক্ট করবি। যদি ওর কিছু হয় তাহলে কিন্তু তোকে ধরবো আমি।”
ছেলেটা মাথা দুলায়। মিষ্টি খুশি হয়ে রাতের গলা জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খায়। রাত ও মিষ্টিকে কোলে নিয়ে ওর কাপালে চুমু খায়। দুই বাবা,মেয়ে রাজ্যের সব গল্প করতে করতে চলে যায়।
#চলবে,
#Mr_Husband
#লেখিকা: আবনী ইবনাত মুন
#পর্ব_৩৯
আজ অনেক বেশি দেরী হয়ে গেছে। মুন ড্রেসের নতুন ডিজাইন গুলো গুছাতে লাগলো। আজ এ পর্যন্ত’ই থাক। কাল এসে বাকি ডিজাইন গুলো কম্পিলিট করবে। পরশু এই ডিজাইনস গুলো কন্টেস্টে জমা দিতে হবে। এই কন্টেস্টের উপর নির্ভর করছে ওর পুরো ক্যারিয়ার। ওর গোল ওর এ্যাম্ভিশন বেস্ট ডিজাইনার এ্যাওয়ার্ড। অনেক বড় কন্টেস্ট এটা। অনেক বড় বড় ডিজাইনাররা এই প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহন করেছে। দেশ, বিদেশের নামি-দামি কম্পানি গুলো এই কন্টেস্টে লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করেছেন। এই প্রতিযোগিতায় জেতাটা অনেক বড় চ্যালেন্জ মুনের জন্য। 100% এর 70% পার্সেন্ট এগিয়ে যাবে নিজের স্বপ্নের কাছে। অনেক বড় অপরচুনিউটি এটা ওর জন্য। মুন ডিজাইনস গুলো গুছিয়ে ড্রয়ারে রেখে ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পরলো। মুন গাড়িতে উঠে সিট বেল্ট বেঁধে নিলো। তারপর গাড়ি স্টার্ট দিলো। রাত ওকে ড্রাইভিং শিখিয়েছে সাথে বাইকও। মুন বাড়িতে এসে ব্যাগটা সোফায় রেখে শ্বাস নিয়ে প্রথমে এক গ্লাস পানি খেয়ে নিলো। তারপর নিজের রুমে গেলো। মিষ্টি হয় তো ঘুমিয়ে পরেছে। মুন রুমে গিয়ে মিষ্টিকে দেখতে পায় না। তাই রাতের রুমের দিকে যায়। গিয়ে দেখে দুই বাপ মেয়ে ঘুমে বিভোর। মিষ্টি গুটিসুটি মেরে রাতের বুকের সাথে লেপ্টে গুমাচ্ছে। মুন ধীর পায়ে হেঁটে গিয়ে মিষ্টির পাশে বসে। আলতো করে মিষ্টির মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। এই মেয়েটা ওর। ওর নিজের। মুন মমতায় জড়িয়ে ভালোবাসার পরশ একে দিলো মেয়ের কপালে। এই ছোট্ট জানটা তার কলিজা। একে ঘিরেই ওর বেঁচে থাকা। এতো লড়াই। একে ছাড়া বেঁচে থাকা ওর পক্ষে কোনো ভাবেই সম্ভব না। মুন রাতের ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকাতেই চমকে গেলো। এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিলো ওর সামনে আঁধার ঘুমাচ্ছে। রাত বাচ্চাদের মতো চোখ গলতে ডলতে উঠে বসে। পিটপিট করে মুনের দিকে তাকিয়ে ঘুম ঘুম কন্ঠে বলে,
—“কখন এসেছো তুমি?”
—“এই তো একটু আগে।”
রাত ভ্রু কুঁচকে বলল,
—“তাহলে ফ্রেশ না হয়ে এখানে কি করছো?”
—“ওই মিষ্টিকে দেখতে এসেছিলাম। কখন ঘুমিয়েছে? খেয়েছে কিছু? আমার কথা জিজ্ঞেস করে ছিলো?”
—“হ্যাঁ, হ্যাঁ খেয়েছে কিন্তু অল্প। আর অনেক বার জিজ্ঞেস করেছে তোমার কথা। আজ খুব জলদিই ঘুমিয়ে পরেছে। এখন তুমি যাও গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নেও। আমার কিন্তু খুব খিদে পেয়েছে। আর কিছু সময় না খেয়ে থাকলে হয়তো আমাকে আর খুজে পাওয়া যাবে না।”
মুন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
—“তুমি এখনো খাইনি?”
—“নাহ। ভাবলাম তুমি এলে একসাথেই খাবো দুজনে। এবার যাও তো গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসো। আমি ততক্ষণে খাবার গরম করে সার্ভ করছি।”
বলে মুনকে ঠেলে উঠিয়ে দিলো। মুন যেতে যেতে বলল,
—“থ্যাঙ্ক ইউ।”
রাত ঠোঁট গোল করে হেসে জিজ্ঞেস করলো,
—“কিউ?”
—“আমার জীবনে আমার গার্ডিয়ান এঞ্জেল হয়ে আসার জন্য। সব সময় আমার পাশে থাকার জন্য। যে কোনৌ পরিস্থিতিতে আমাকে সাপোর্ট করার জন্য। বিপদে আমাকে সাহায্য করার জন্য। মিষ্টিকে নিজের পরিচয় দেওয়ার জন্য। মিষ্টির বেস্ট পাপা হওয়ার জন্য। ওকে এতো এতো ভালোবাসা দেওয়ার জন্য। তুমি আমাদের জন্য যা করেছো তা আমি বলে শেষ করতে পারবো না। তোমাকে এতত এতত থ্যাঙ্ক ইউ।”
বলতে বলতে মুনের চোখ দুটো চিকচিক করছে।
—“মুন তুমি হয় তো ভুলে গেছো, বন্ধুত্বে নো সরি এ্যান্ড নো থ্যাঙ্ক। আর যদি তুমি আমাকে থ্যাংকস দিতেই চাও তাহলে আমার তোমাকে আরো বেশি থ্যাংকস বলা উচিত।”
মুন আ হয়ে প্রশ্ন করে,
—“কেনো?”
—“কারণ তুমি আমার জীবনে জাদুকরী হয়ে এসেছো। নিজের জাদুর ছড়ি ছোঁয়ায় আমার জীবনটাকে বদলে দিয়েছো। আমার অগোছালো জীবনটাকে পরিপাটি বানিয়েছো। আমাকে জীবনের মূল্য বুঝতে শিখিয়েছো। আমি কাজ নিয়ে স্টেসে থাকলে আমাকে আস্থা দিয়েছো। কখনো ডিপ্রেস্ট হলে সাহস জুগিয়েছো। সিক হলে নির দ্বিধায় সেবা-যত্ন করেছো। আমার সো-কল্ড গার্ল ফ্রেন্ডদের হাত থেকে প্রতিবার বাচিয়েছো। আর তোমার সব থেকে বড় দান এই পরীটি। এই ছোট্ট রাজকন্যাটির পাপা হওয়ার সুযোগ দিয়েছো তুমি আমাকে। এই প্লে-বয় টাকে দায়িত্ববান বাবা বানিয়ে দিয়েছো। আমার বাঁচার একটি কারণ দিয়েছো। এই বাচ্চাটির পাপা আমি। শুধু আমাকে পাপা ডাকে। তার মুখে পাপা ডাক শুনলে চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো খুশি হয় মনে। তখন মনে হয় আমিই এই পৃথিবীর সব থেকে সুখী মানুষ। থ্যাঙ্ক ইউ মুন। থ্যাঙ্ক ইউ এ লট। মিষ্টির মতো মিষ্টির মাম্মাম ও কিউটের ডিব্বা।”
শেষের কথাটা মুনের নাক টেনে বলল রাত। মুন হেসে দিলো। চোখে জল মুখে হাসি, কি মনোরম দৃশ্য। রাতও মুনের সাথে সাথে হেসে দিলো। রাত হাসলে ওর গালে গর্ত হয়। রাত তাকালো মুনের দিকে আর মুনও রাতের দিকে তাকালো। ছেলেটা দেখতে একদম আঁধারের মতো। অনেক সময় মুন গুলিয়ে ফেলে। সেই চোখের রঙ, সেই চুলের রঙ, সেই নাক, সেই মুখ। এক সাথে দাঁড় করালে মনে হবে যেন দুই জমজ ভাই। কিন্তু কিছু আনকমন জিনিস ও আছে। যেমন:- রাত হাসলে ওল গালে টোল পরে আর এই টোল ওর সব চেয়ে বড় আকর্ষণ। আর আঁধার হাসলে ওর গালে টোল না পরলেও ওর চোখ দুটি হাসির তালে তালে হাসে। আঁধারের ঠোঁটের কোণের কালো কুচকুচে ছোট্ট তিল আর ভ্রুর কাটা দাগটা যে দুটি আঁধারের সব চেয়ে বড় আকর্ষণ। এই দুটি দ্বারা দুজনকে চিহ্নিত করা যায়। মুন দুনের মধ্যে পার্থক্য করতে ব্যস্ত আর রাত মুনকে দেখতে ব্যস্ত।
.
আঁধার আরিফা রেজওয়ানের কোলে মাথা রেখে চুপটি করে শুয়ে আছে। আর আরিফা রেজওয়ান ছেলের মাথায় আলতো করে।হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর ভাবছে। মুন নামের মেয়েটি চলে যাওয়ার পর তার ছেলেটি কেমন যেন হয়ে গেছে। কারো সাথে অযথা কথা বলে না। অল্পতেই কারণে অকারণে রেগে যায়। কখনো হাসির ছিটে ফোটাও দেখা যায় নি ছেলেটির ঠোঁটের কোণে। কেমন যেন নিশ্বঃপ্রাণ হয়ে গেছে। হয়ে গেছে রাগি,বদমেজাজি, এক রোখা। কষ্ট হয় ছেলেটাকে দেখে। কত নিখুঁত অভিনেতা হয়ে গেছে তার ছেলে! বাইরে থেকে নিজেকে পাথরের খোলসে ঢেকে রাখে আর ভেতরে ভেঙে গুড়িয়ে যাওয়া পাথরের টুকরো শুধু। আঁধার যেদিন বাড়িতে এসে বলে ‘মুন চলে গেছে আমাকে ছেড়ে।’ ‘কোথায় গেছে?কেনো গেছে? কি হয়েছে?’ এরকম অনেক ধরনের প্রশ্ন করলেও আঁধারের কাছ থেকে কোনো উওর পাওয়া রায় না। আরিফা রেজওয়ান ও আর কখনো বলার জন্য জোর করেনি আঁধারকে। তার বিশ্বাস তার ছেলে একদিন নিজ থেকে এসে তাকে সব বলবে। আরিফা রেজওয়ানের মুনের উপর কোনো রাগ নেই। আছে শুধু জমানো কিছু অভিমান। তিনি জানেন দোষ এখানে তার ছেলের ও আছে। কারণ এক হাতে কখনো তালি বাজে না। কিন্তু আঁধার কোনো ভুল করে থাকলে মুন তাকে বলতে পারতো। সে শাসন করতো তার ছেলেকে সুধরে দিতো। কিন্তু মুন কিছু না বলেই চলে দিলো। তাদের একবার জানানোর প্রয়োজনও মনে করলো না। আঁধারের কন্ঠ স্বরে আরিফা রেজওয়ান ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসেন।
—“মম!”
—“হুম?
—“বিশ বছর আগের সেই দিনের কথা তোমার মনে আছে?”
স্বাভাবিক কন্ঠে জানতে চাইলো আঁধার। আরিফা রেজওয়ান আঁধালের কথায় আতঙ্কিত হলেন। বিশ বছর আগের কোন দিনের কথা বলছে আঁধার? সে যেদিনের কথা ভাবছে সেদিনের কথাই বলছে না তো আঁধার? আরিফা রেজওয়ান নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করে কাঁপা কাঁপা গলায় প্রশ্ন করলেন,
—“কো’কোন দিনের ক’কথা?”
—“যেদিন প্রথম এই হাত দুটি এক অমানুষের রক্তে রাঙা হয়েছিলো।”
খুবই স্বাভাবিক ভাবে একটা অস্বাভাবিক ভয়ংকর অতীতের কথা বলে দিলো আঁধার। আরিফা রেজওয়ান শিউরে উঠেন সেদিনের কথা ভেবে। তার চোখের সামনে ভেসে উঠে বিশ বছর আগের সেই ভয়ংকর দৃশ্য। এগারো বছরের একটা বাচ্চা ছেলে রক্ত মাখা চপার হাতে দাঁড়িয়ে আছে। রক্তে দু’হাত রাঙিয়ে তুলেছে তার। চোখ, নাক ও মুখ সহ পরনের সাদা টিশার্ট টিও রক্তে রঙিন হয়ে আছে। পাশেই একটা অমানুষ রক্তাক্ত অবস্থায় পরেছে। তার রক্তে ভিজে যাচ্ছে সারা মেঝে। যেদিকে চোখ যায় সব জায়গায়ই শুধু রক্ত আর রক্ত। আর ভাবতে পারছে না আরিফা রেজওয়ান। শরীর কাপছে তার। আরিফা রেজওয়ান আঁধার মুখ চেপে ধরে তেজী গলায় বলে,
—“চুপ! একদম চুপ! তোমাকে বলে ছিলাম না এসব কথা কখনো না মনে করতে? যা হয়েছে সব ভুলে যেতে বলেছিলাম কি না? তাহলে এত বছর পর আবার সেই কথা কেনো তুলেছো? আর কখনো যেন তোমার মুখ থেকে এ বিষয়ে কোনো কথা না শুনি। কখনো না। ভুলে যাও সব। ওই অমানুষটা ওর পাপের শাস্তি পেয়েছে।”
আঁধার মায়ের হাতটা মুখ থেকে সরিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসে আরিফা রেজওয়ানের মুখোমুখি বসে চাপা রাগ দেখিয়ে গর্জে উঠে বলল,
—“নো মম। ওই জানোয়ারটা এতো সহজ মৃত্যু ডিজার্ভ করে না। এর থেকেও ভয়ংকর মৃত্যুর ওর প্রাপ্য।”
আঁধারের এমন কথা শোনে আরিফা রেজওয়ান শিউরে উঠলেন। আঁধারের এমন নিষ্ঠুরতা দেখে সে হতবাক। আঁধারের তো এরকম হওয়ার কথা নয়। এটা তো তার শিক্ষা না। আরিফা রেজওয়ান রেগে ধমকে বললেন,
—“আঁধার, এতো না নির্দয়ের মতো কথা কি করে বলতে পারো? আমি এ বিষয়ে তোমার মুখ থেকে আর একটা ওয়ার্ড ও শুনতে চাই না।”
বলেই আরিফা রেজওয়ান রেগে উঠে গটগট পায়ে হেটে ওখান থেকে চলে গেলেন। আঁধার মায়ের যাওয়ার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে জোরে জোরে হাসতে লাগলো। ভয়ংকর সেই হাসির শব্দ। এই হাসিতে হিংস্রতা প্রকাশ পাচ্ছে। আরো প্রকাশ পাচ্ছে হারানোর যন্ত্রণা, চাপা আর্তনাদ।
#চলবে,