#Mr_Husband,পর্ব_৪৫
#লেখিকা: আবনী ইবনাত মুন
স্কুল ছুটি হয়েছে কিছুক্ষণ আগেই। কোমরে হাত দিয়ে মুখ ফুলিয়ে স্কুলের গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে মিষ্টি। কারণ রাত বা মুন কেউই এখনো তাকে নিতে আসেনি। মিষ্টি মাথা ঘুরিয়ে পাশে তাকালো তিশান দাঁড়িয়ে আছে পাশে। তিশানের মুখ ভঙ্গি একদম স্বাভাবিক। যেখানে মিষ্টির এতোক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকাতে থাকতে রাগ লাগছে। সেখানে কারণ ছাড়া দাঁড়িয়ে থেকেও তিশানের চোখে মুখে কোনো ভাবান্তর নেই। ছুটির পর মিষ্টিকে কেউ নিতে আসেনি দেখে তিশান ও মিষ্টিকে একা ছেড়ে যায়নি। ওর সাথে স্কুলের সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। আরো কিছুক্ষণ পর রাফি আসে তিশানকে নিতে। রাফি মিষ্টিকে দেখে ওকে কোলে নিয়ে আদর ককরে বলে,
—“মামনী তুমি এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেনো?”
তিশান বলল,
—“বাবা মিষ্টিকে নিতে রাত আঙ্কেল বা মনি’মা কেউই এখনো আসেনি তাই।”
রাফি মিষ্টির দিকে বলল,
—“তো কি হয়েছে? মিষ্টি তুমি আমাদের সাথে চলো তোমার খাম্মি তোমাকে দেখলে খুশি হবে। আর আমি আমার শালীকাকে ফোন দিয়ে বলে দিবো। যাবে তো আমাদের সাথে?”
মিষ্টি কিছুক্ষণ ভেবার ভাব করে চট করে বলল,
—“ওকে।”
রাফি তিশান আর মিষ্টিকে নিয়ে চলে গেল।
.
আঁধার হসপিটালের কেবিনে বসে কিছু ফাইল খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছে আর ওর সামনের চেয়ারে আয়েশ করে বসে আছে আশিক। আঁধার ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে তাকিয়ে বলল,
—“এই ফাইল যা বলছে তা কি সত্যি?”
—“অভিয়াসলি ব্রো। এই ফাইলে যা ইনফমেশন আছে সব সত্যি।”
আঁধার চোখ দুটো বুঝে হাতের মুষ্টি শক্ত করে
অনেক কষ্টে নিজের রাগ সংযত করে বলল,
—“তুই আজ এই মুহূর্তে ও আগে যেখানে থাকতো সেখানে যাবি। ওর ফুল ডিটেল্স বের করবি। আমি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত জানতে চাই। a to z সব কিছু। ছোট থেকে ছোট জিনিস ও বাদ দিবি না। ওর সাথে সম্পর্কিত যারা আছে তাদের ডিটেল্স ও আমার চাই। আজকের দিনটাই আছে তোর কাছে। এখন তুই যেতে পারিস।”
একটা ছবির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে কথা গুলো বলল আঁধার। আশিক কিছুক্ষণ অসহায় নয়নে আঁধারের দিকে তাকিয়ে থাকলো। কিন্তু আঁধার সেদিকে পাত্তাই দিলো না। ওর দিকে একবার ফিরেও তাকালো না। আশিকের আর কি করার? এতিমের মতো মুখ করে উঠে চলে গেলো। আঁধার এখনো তাকিয়ে আছে ছবিটার দিকে। ছবিতে থাকা বাচ্চা মেয়েটাকে কেনো যেন খুব আপন মনে হচ্ছে আঁধারের। দীর্ঘ শ্বাস ফেল্ল আঁধার। আজ রাতের মধ্যেই সব ক্লিয়ার হয়ে যাবে। সব জট খুলে যাবে।
.
মুনকে ফোন করে তাহেরা জানিয়ে দিয়েছে মিষ্টি ওদের সাথে আছে। রাত তার কিছুক্ষণ আগে মুনকে বলেছিল ও একটা কাজে আটকে গেছে তাই মিষ্টিকে নিতে যেতে পারবে না। মুন যেন অফিস থেকে ছুটি নিয়ে মিষ্টিকে পিক করে নেয়। মিষ্টি রাফি কাধে উঠে গলা জড়িয়ে ধরে আদুরে গলাত বায়না করে বলে,
—“আঙ্কেল তুমি না অনেক কিউট। একদম চকোচকোর মতো। আর অনেক ভালোও। একদম সফট হার্টেড।”
রাফি খিক করে হসে দিলো। তিশান পাশে বসে হোমওয়ার্ক করছিলো মিষ্টির কথা গুলো শুনে আড়চোখে মিষ্টির দিকে তাকালো। মিষ্টি যে ওর বাবাকে পাম দিচ্ছে তা ভালো বুঝতে পারছে। রাফি মিষ্টির গালে চুমু দিয়ে বলল,
—“তাই বুঝি?”
মিষ্টি সুর টেনে বলল,
—“হ্যাঁ”
—“তো এতো সব মিষ্টি মিষ্টি কথা আমাকে মিষ্টি কেনো বলছে? কিছু চাই?”
মিষ্টি ইনোসেন্ট ফেস করে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল। রাফি হেসে দিলো। তারপর জিজ্ঞেস করলো,
—“কি চাই মিষ্টির?”
—“মিষ্টি ঘরতে যেতে চায়।”
তাহেরা রান্না ঘরে ছিলো। রাফি তাহেরাকে ডাকলো। তাহেরা একটা ছোট ট্রেতে করে দুটো চকলেট শেকের গ্লাস নিয়ে এলো। একটা গ্লাস মিষ্টিকে দিলো আরেকটা তিশানকে। তারপর রাফির দিকে তাকিয়ে বলল,
—“কি হয়েছে ওভাবে ডাকছিলে কেন?”
—“তাহেরা আজ ঘুরতে গেলে কেমন হয়? মিষ্টি যেতে চাই ছিল।”
মিষ্টি বেবী ফেস করে বলল,
—“প্লিজ খাম্মি চলো না।”
তিশান নিজের হোমওয়ার্ক করছে আর সবার কথপকথন শুনছে। তাহেরা হেসে মিষ্টির গাল টিপে বলল,
—“আগে চকলেট শেকটা খেয়া শেষ করো তারপর।”
মিষ্টি খুশিতে লাফিয়ে উঠে তেহেরার গালে চুমু খেলো। তাহেরা তিশানকে বলল,
—“তৃশ বইখাতা গুলো ব্যাগে গুছিয়ে রাখো। হোমওয়ার্ক রাতে করবে। এখন জলদি ওটা ফিনিশ করে রেডি হও। আজ আমরা ঘুরকে যাবো।”
তিশান বাধ্য ছেলের মতো বলল।
—“ওকে মা।”
.
আইসক্রিম পার্লারের সামনে দাড়িয়ে আছে রাফি, তাহেরা, তিশান আর মিষ্টি। মিষ্টির ইচ্ছেতেই আইসক্রিম কেনা হচ্ছে। আইসক্রিম পার্লারের সামনে অনেক ভীর তাই কিনতে একটু সময় লাগছে। মিষ্টির দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে বোর লাগছিলো। হঠাৎ মিষ্টির চোখ যায় রাস্তায়। রাস্তার মাঝে ছোট্ট একটা সাদা খরগোশ। আশপাশ দিয়ে গাড়ি চলছে। মিষ্টির মনে হলো খরগোশটা আর কিছুক্ষণ ওখানে থাকলে কোনো না কোনো গাড়ির নিচে নির্ঘাত চাপা পরবে। তাই মিষ্টি চারপাশে দেখে গুটিগুটি পায়ে খরগোশটির দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো। খরগোশটা রাস্তার মাঝে বসে কিছু একটা খাচ্ছে। মিষ্টি দিয়ে খরগোশটার সামনে বসে ওকে কোলে উঠালো। খরগোশটির গলায় একটা লকেট ছিলো মিষ্টি সেটাই খুটিয়ে দেখতে ব্যস্ত হয়ে পরলো। মিষ্টির মাথা থেকে বিরিয়ে গেল ও রাস্তার মাঝে বসে আছে। মিষ্টির হঠাৎ খেয়াল হতেই ও চকিত চোখে সামনে তাকালো। সামনে থেকে ফুল স্প্রিডে একটা গাড়ি তেড়ে আসছে ওর দিকে। মিষ্টি ভয়ে জড়সড় হয়ে চোখ খিচে খরগোশটাকে আকরে ওখানেই বসে থাকে। ভয়ে শব্দ করে কেদেঁ দিয়েছে মিষ্টি। গাড়িটা যখন মিষ্টিকে ছিন্নভিন্ন করতে ছুনে আসছিল ওর দিকে তখনই কেউ একজন দেবদূতের মতো এসে মিষ্টিকে টেনে বুকের মাঝে নিয়ে সরে গেলো। আজ একটুর জন্য মিষ্টি বেচে গিয়েছে। অগন্তক এখনো মিষ্টিকে শক্ত করে বুকের সাথে চেপে ধরে আছে। মিষ্টির ছোট্ট শরীরটা থরথর করে কাপছে। অগন্তক মিষ্টির মাথায় হাত বুলিয়ে মিষ্টিকে শান্ত করতে বলল,
—“রিল্যাক্স বাচ্চা! কিচ্ছু হয়নি। কাম ডাউন।”
মিষ্টি কাপা কাপা গলায় অস্পষ্ট স্বরে বলল,
—“ড্যাড্যা!”
এটুকু বলেই মিষ্টি জ্ঞান হারায়। অগন্তক থমকে গেলো। এই একটা শব্দ যেন তাকে থামিয়ে দিলো। সে ধীরে ধীরে মিষ্টির মুখটা উঠিয়ে চোখের সামনে ধরলো। ভীতু ফ্যাকাশে মুখটা শত মায়ায় জরজরিত। মুখটা বড্ড টানছে তাকে। খুব আপন আপন লাগছে। রক্তের টান যাকে বলে। এই মুখটায় নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে পারছে আঁধার। হসপিটাল থেকে বাড়ি ফির ছিলো আঁধার হঠাৎ একটা জরুরী কল আসায় গাড়ি সাইডে থামিয়ে কথা বলছিলো। তখনই আঁধের চোখ যায় মিষ্টির উপর। আঁধার খেয়াল করে একটা গাড়ি মিষ্টির দিকে ফুল স্প্রিডে ছুটে আসছিলো। আঁধার ‘ওহ শিট’ শব্দ টা উচ্চারণ করেই এক মিনিট সময় নষ্ট না করে ছুটে যায়। আঁধার আর এক মিনিট দেড়ি করলেই মিষ্টির দেহটা এখন ওই রাস্তায় ছিন্নভিন্ন হয়ে পরে থাকত। ভাবতেই আঁধারের বুকের মধ্যে অজানা কারণে মোচড় দিয়ে উঠে। আঁধার আনমনে মিষ্টির কপালে গভীর ভাবে ঠোঁট ছুইয়ে গাঢ় চুম্বন একে দেয় মিষ্টির কপালে। আঁধার খেয়াল করে মিষ্টির শরীর ভয়ে ঠান্ডা হয়ে গেছে। অন্যদিকে রাফি, তাহেরা, তিশান মিষ্টিকে না দেখে চারপশ তন্ন তন্ন করে খুজছে। তাহেরা তো কাদতে কাদতে হয়রান। রাফির টেনশন হচ্ছে একটু আগেই তো মেয়েটা এখানে ছিল। তাহলে মাত্র কিছু সময়ের ব্যাবধানে কোথায় হাওয়া হয়ে গেল। তাহেরাকে এক জায়গায় বসিয়ে তিশানকে ওর পাশে রেখে রাফি এদিক ওদিক মিষ্টির ফটো দেখিয়ে মিষ্টির খোজ করছে। এরই মধ্যে হঠাৎ আঁধার ক্যাপ আর মাক্স পরা একটা লোক মিষ্টিকে কোলে নিসে এগিয়ে আসে। যাতে ওকে কেউ চিনে না ফেলে। তাহেরা মিষ্টিকে দেখেই ছুটে গিয়ে ওকে কোলে নিয়ে চুমু দিতে লাগলো। রাফিও দৌড়ে এলো। আঁধার গম্ভীর গলায় বলল,
—“একটুর জন্য গাড়ির নিচে পরেনি। ঠিক সময় না দেখলে কি হতো বুঝতে পারছেন? অনেক বেশি ভয় পাওয়ার কারণে জ্ঞান হারিয়েছে। রাতে জ্বরও আসতে পারে তাই ওষুধ খাইয়ে দিবেন। আর এই নিন এটাকে বাচাতে গিয়েই এতো কিছু। এরপর থেকে খেয়াল রাখবেন।”
খরগোশটা রিফির হাতে দিয়ে বলল। রাফি কৃতজ্ঞ হয়ে বলল,
—“জ্বী! থ্যাঙ্ক ইউ।”
আঁধার আর এক মুহূর্তও দাঁড়লো না। গটগট করে চলে গেলো।
.
সকাল সকাল মুন অফিসে আসার সাথে সাথেই শুনতে কম্পানির হাফ পার্সেন্স শেয়ারের নতুন এমডি’র কথা। তার গুনোগানে সবাই পঞ্চ । মুন নিজের কেবিনে বসে নতুন ডিজাইন গুলো দেখছিলো যে ড্রেস গুলো পরে মডেলরা ফটো সুট করবে। কিছুক্ষণ পর একজন কলিগ এসে মুনকে বলল,
—“মুন, নিউ এমডি তোমার সাথে দেখা করতে চায়। যে ডিজাইনস গুলো কালকে সিলেক্ট করা হয়েছিলো সেগুলো নিয়ে তার কেবিনে যেতে বলেছে।”
মুন ছোট করে বলল,
—“ওকে। তুমি যাও আমি আসছি।”
মুন নতুন এমডি’র কেবিনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ছোট্ট একটা নিশ্বাস ছেড়ে দরজায় নক করলো। ভেতর থেকে কেউ বলল,
—“কাম ইন।”
মুন ফাইল হাতে ভেতরে ঢুকলো। এমডি চেয়ারটা পেছনের দিকে ঘুরিয়ে বসে আছে। ওভাবেই মুনকে বলল,
—“সিট”
মুন চুপচাপ গিয়ে তার সমানের চেয়ারে বসলো। মুনের কি বলে কথা শুরু করা উচিত ও বুঝতে পারছে না। মুন ঠোঁট ভিজিয়ে ডিরেক্ট কাজের কথাই বলল,
—“স্যার ফোটো সুটের জন্য যে ডিজাইনস গুলো সিলেক্ট করা হয়েছে সেগুলো নিয়ে এসেছি।”
ব্যক্তিটি আচমকা চেয়ার ঘুরিয়ে সামনে ফিরতেই মুন চমকে গেল। আকাশ সমান বিষ্ময় নিয়ে বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেলো। কিন্তু সামনে থাকা ব্যক্তিটির কোনো ভাবান্তর হলো না। তাকে দেখে মনে হচ্ছে না যে সে মোটেও চমকেছে। তার চোখ মুখ একদম স্বাভাবিক। মুন কিছু বলতে চাইছে কিনা পারছে না। গলার কাছে কিছু একটা দলা পাকিয়ে আছে। কথা গুলো সেখানেই আটকে যাচ্ছে। মুন অনেক কষ্টে উচ্চারণ করলো,
—“মি. হাসবেন্ড।
#চলবে,