Mr_Husband,পর্ব_৪৬,৪৭

0
3146

#Mr_Husband,পর্ব_৪৬,৪৭
#লেখিকা: আবনী ইবনাত মুন
#পর্ব_৪৬

সকাল ছয়টা বাজে। আকাশে ঘন কালো মেঘের ছড়াছড়ি। থেকে থেকে ভয়ংকর গর্জন করে উঠছে। চারদিক নির্জন নিস্তব্ধতা ছেয়ে আছে। আশেপাশে কোথাও কুকুর বিড়ালের কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে। মুন জানলার কাছে দাঁড়িয়ে প্রকৃতির এই সুনসান দেখছে। মুন কেমন কু ডাকছে। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বারবার জানান দিচ্ছে কিছু হতে চলেছে। কিছু তো হতে চলেছে। কিন্তু সেটা ঠিক না। বিষন্ন মন নিয়ে মিষ্টির পাশে গিয়ে বসলো মুন। মিষ্টি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। মুন মিষ্টির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছে। একদম বাবার মতো হয়েছে। রাগী, জেদী, বদমেজাজি, কিন্তু মুনের মতো প্রানোচ্ছল্ল। হাসতে ভালোবাসে ভালোই হয়েছে অন্তত বাপের মতো গমড়ামুখো হয়নি। ভেবতেই মুন আনমনে হেসে ফেলে। আবার হঠাৎ করেই মিলিয়ে যায় সেই হাসি। ইশ যদি সেই কথাগুলো সেই দৃশ্যগুলো মিথ্যে হতো! তাহলে হয় তো মুনের জীবনটাই অন্য রকম হতো। তাহলে আজ ও আঁধার আর মিষ্টি এক সাথে থাকতো। খুনসুটিত,ভালোবাসায় তাদের জীবন কাটতো। কিন্তু তা আর হবার নয়। এসব ভেবেই মুন দীর্ঘ শ্বাস ছাড়ে। পরম মমতায় গভীর চুম্বন একে দেয় মেয়ের কপালে। তারপর মিষ্টির পাশেই ওকে জড়িয়ে শুয়ে পরে।

.
রাত কাল বাড়ি ফিরতে পারেনি একটা সমস্যায় আটকে গেছে তাই আজ শুটিং শেষ করে তারপর বাড়ি ফিরবে। মুনের সাথে কথা হয়েছিলো সকালে। মিষ্টির সাথে কথা বলতে চাইছিল কিন্তু মিষ্টি তখন ঘুম তাই আর মিষ্টির সাথে কথা বলতে পারেনি। কাল লাস্ট মিষ্টিকে দেখেছিল ৮টা বাজে স্কুল ড্রপ করার সময়। এক রাত পেরিয়ে গেছে এখন সকাল দশটা বাজে। ২৬ ঘন্টা হয়ে গেছে রাত মিষ্টির সেই সিগ্ধ চঞ্চল মুখটা দেখে না। মিষ্টির সেই প্রণোচ্ছল খিলখিল হাসি দেখে না। খুব বেশি মিস করছে ছোট্ট পরিটাকে। তার দুষ্টুমি, খুনসুটি, উচ্চ স্বরে পাপা বলে ডাকা সব কিছু খুব বেশি মিস করছে। রাত অবাক হচ্ছে খুব পাঁচটা বছরে ওর অভ্যস হয়ে গেছে ওই ছোট্ট জানটা। মাত্র 25 ঘন্টা দেখেনি তাতেই অস্থির হয়ে পরেছে। যদি কখনো একে বারে তার থেকে দূরে চলে যায় বা হারিয়ে যায় তখন কি করবে? ভাবতেই বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠে রাতের। রাত কেন ভাবছে এসব ফালতু কথা তা সে নিজেই বুঝতে পারছে না। রাত ফোনের ওয়ালপেপারের তার মুন আর মিষ্টির এক সাথে তোলা একটা পিক সেভ করেছে সেটা দেখতেই রাতের চোখ জুড়িয়ে যায়। গ্যালারীতে গিয়ে মিষ্টির একটা পিক বের করে সেটিতে চুমু খায়। তারপর উঠে কাজে মন দেয়। এতোক্ষণ ব্রেক চলছিল।

.
আলিয়া হসপিটাল থেকে বের হতেই অয়নকে দেখতে পায়। কিন্তু অয়নকে দেখেও না দেখার ভান কে ওকে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। আলিয়ার এমন ব্যবহারে অয়ন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। অয়ন ভাবনা বাদ দিয়ে আলিয়ার পেছনে ছুটে। আলিয়েকে ডাকলেও আলিয়া অয়নের ডাক শুনে না। সে তার মতোই হাটতে থাকে। অয়ন দৌড়ে গিয়ে আলিয়ার পথ আটকে দাঁড়ায়। আলিয়া বিরক্তি ঝেড়ে বলে,

—“সমস্যা কি? এভাবে পথ আটকে দাঁড়িয়েছেন কেনো?”

অয়ন পেন্টের পকটে হাত গুজে ভ্রু কুঁচকে বলে,

—“আমার সমস্যা? তোমার কি সমস্যা সেটা আগে বলো? কাল থেকে ফোন করছি ফোন ধরছো না কেনো?”

আলিয়া এবার বুকে হাত গুজে বলল,

—“আমার ইচ্ছে!”

—“আচ্ছা?

—“হ্যাঁ! এতোই যদি কথা বলতে ইচ্ছে করে তাহলে বিয়ে করে নিন তখন সরাদিন রাত কথা বলবো। আর কেউ বারণ ও করবে না।”

অয়ন বিরক্ত হয়ে বলল,

—“তুমি সারাক্ষণ এতো বিয়ে বিয়ে করো কেন বলো তো? বিয়ে ছাড়া কি মানুষ থাকে না?”

আলিয়া অয়নের উপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ভ্রু কুঁচকে বলল,

—“আপনার মতলবটা কি বলুন তো? ও আচ্ছা! বুঝেছি! গাছের টাও খাবেন তলার টাও কুড়াবেন তাই না? প্রেম করবেন আমার সাথে আর বিয়ে করবেন অন্য কাউকে? আপনার নামে আমি মানহানীর মামলা করবো। দুশচরিত্রা লোক একটা। এই জন্যই পুলিশদের এক চোখে দেখতে পারি না।”

বলেই আলিয়া হনহনিয়ে চলে গেলো। আর অয়ন বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইলো অয়ন বুঝতে পারলো না আলিয়া কোথার কথা কোথায় নিয়ে গেছে। সামান্য একটা কথাকে বারিয়ে চারিয়ে পাহাড় বানিয়ে ফেলল। এই মেয়েরা একটা কথা পেলে সটাকে টেনে ছিচড়ে পিন্ডি চটকে তার গুষ্টি উদ্ধার করা পর্যন্ত থামবে না। ভেবতেই ভেতরে চাপানো দীর্ঘ শ্বস বেরিয়ে আসলো।

.
মিষ্টিকে স্কুলে ড্রপ করে মুন অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। যেতে চাইছিলো না কিন্তু আঁধার ফোন করে থ্রেট দিয়েছে না গেলে মিষ্টিকে চিরদিনের জন্য কেড়ে নিয়ে যাবে আর কখনো মিষ্টির ছায়াটাও দেখতে দিবে না। মুন এক মনে গাড়ি চালাচ্ছিল হঠাৎ ওর ফোন বেজে উঠে। মুন না দেখেই ফোন রিসিভ করে ব্লুটুথ কানেক্ট করে বলল,

—“হ্যালো! কে বলছেন?”

ওপাশ থেকে চির’পরিচিত কন্ঠ ভেসে এলো,

—“তোমার হাসবেন্ড।”

মুন ভ্রু কুঁচকরে নাম্বার চেক করে দেখে আঁধার। মুন বিরক্ত হয়ে বিরবির করে বলে,

—“উফ! আবার এই রাক্ষসটা!”

স্বশব্দে বলল,

—“অাবার কি?”

—“কোথায় আছো? এখনো আসছো না কেনো?”

আঁধারের কথা শুনে মুন রেগে বলল,

—“আসবো না যান। কি করবেন আপনি?”

আঁধার ক্ষেপে বলল,

—“আসবে না? তুলে নিয়ে আসবো।”

মুন আঁধার কে ভেঙ্গিয়ে বলল,

—“তুলে নিয়ে আসবো! এ্যাহ! বললেই হলো? এতো সোজা নাকি? দেশে আইন কানুন আর নেই!”

আঁধার বাকা হেসে বলল,

—“আমার বউ আমি তুলে নিয়ে আসবো সেখানে আইন কেনো আইনের বাবাও কিছু করতে পারবে না। আর তুমি ভালো করে জানো AR আইনকে ভয় পায় না। আইন AR কে ভয় পায়।”

মুন কি বলবে বুঝতে পারছে না। এই লোক যখন তখনই নিজের পাওয়ার দেখাতে লেগে পরে। মুন বলল,

—“আপনি নিজের পাওয়ার অন্য কাউকে দেখান তারা হয় তো ভয় পারে কিন্তু আমি না।”

বলেই মুন ফুন কেটে দিলো। ভালয় লাগছে না এই লোকের সাথে কথা বললে। কারণ কথা বললেই মুন একটু একটু করে তার কথার জালে পরে দুর্বল হয়ে পরে। আর তার সামনে গেলে তো একদম আইসক্রিমের মতো গলতে শুরু করে।

#চলবে

#Mr_Husband
#লেখিকা: আবনী ইবনাত মুন
#পর্ব_৪৭

মিষ্টি মনোযোগ দিয়ে ক্লাস করছিল হঠাৎ দেখে কাপড় দিয়ে মুখ বাধা কয়েকটা লোক বন্দুক হাতে ক্লাসে ঢুকে একটা বাচ্চার মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে ম্যামকে উদ্দেশ্য করে বলে,

—“সব বাচ্চাদের নিয়ে আমার পেছনে পেছনে আসুন। কোনো প্রকার চালাকি করলে এই বাচ্চাটাকে উপলরে পাঠিয়ে দিবো।”

বাচ্চারা জোড়সড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ম্যাম তো ভয়ে রিতি মতো কাপছে। কাপতে কাপতে মাথা নেড়ে বাচ্চাদের উদ্দেশ্যে বলল,

—“বাচ্চারা সবাই আমার সাথে এসো। কেউ কোনো শব্দ করবে না চুপচাপ চলবে।”

লোকটা বাচ্চাদের আর ম্যামকে নিয়ে হল রুমে গেলো। ওখানে আরো বাচ্চারা আর টিচার্সরা আছে। তিশান এতোক্ষন মিষ্টির আসারই অপেক্ষা করছিলো। মিষ্টি আসতেই তিশান মিষ্টিকে টেনে নিজের পাশে বসিয়ে ওর হাত শক্ত করে ধরে রাখে। তিশানও কিছুটা ভয় পাচ্ছে। ছোট মানুষ ভয় পাওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু মিষ্টির চঞ্চল চোখ দুটিতে ভয়ের রেশ মাত্রও নেই। ওর কাছে এসব এডভেঞ্চার মনে হচ্ছে। একশন মুভি গুলোতে যেরকম হয়। গুন্ডারা বাচ্চাদের আটকে রাখে তারপর সুপার ম্যান এসে বাচ্চাদের বাচায়, ঠিক সেরকমই। আচ্ছা ওদের বাচাতেও কি কোনো সুপার ম্যান আসবে?

.
মুন অফিসে এসে দম ও ফেলতে পারেনি তার আগেই আঁধারের ডাক পরে। কি আর করার? কিছুক্ষণ কপাল চাপড়ে আঁধারকে গালাগালি করে এক গাদা বিরক্তি নিয়ে আঁধারের কেবিনে যায়। দরজায় নক করে বলে,

—“মে আই কাম ইন?”

—“এসে পরো সুইটহার্ট। তোমারই অপেক্ষা করছিলাম।”

মুন ভেতরে প্রবেশ করে। আঁধার হাসি মুখে বলল,

—“বসো।”

মুন বিরক্তি ভঙ্গিতে বসলো। আঁধার মুনের দিকে ঝুকে বলল,

—“তো কি ভাবলে মিসেস ওয়াইফি? ফিরে আসবে নাকি এখনো নিজের জেদ বজায় রাখবে? দেখ আমি কিন্তু তোমার সব অপরাধ ভুলে গিয়ে দ্বিতীয় সুযোগ দিয়ে কাছে টানতে চাচ্ছি। তাই ভালো হবে নিজে থেকে এসে আমার কাছে ধাও। কথা দিচ্ছি ভালোবেসে আগলে রাখবো। এক বিন্দু জল ও চোখ বেয়ে গরিয়ে পরতে দিবো না। আর যদি আমার কথা না মানো তাহলে অনেক পস্তাতে হবে। এতো কাদাবো যে চোখের জল ফুরিয়ে যাবে কিন্তু তোমার কান্না থামবে না। এক সময় জলের পরিবর্তে রক্ত ঝরবে ওই মায়াবী আখি গোলক থেকে।”

শীতল কন্ঠে এত ভয়ংকর হুমকি দেওয়া যায় মুন আগে জানতো না। শব্দ গুলো কত সাধারণ কিন্তু এর অর্থ গুলো কতটা ভয়ংকর। মুন কি বলবে বুঝতে পারছে না। কথার ঝুলি মুহূর্তেই ফুরিয়ে গেছে। সব কথা এলোমেলো হয়ে গেছে। আঁধারের চোখে স্পস্ট হিংস্রতা দেখতে পাচ্ছে। না আঁধারের চোখ দুটিতে হিংস্রতা ছাড়াও আরো কিছু আছে। যা মুন ঠিক বুঝতে পারছে না। কি সেটা এক আকাশ অভিমান? মুনের ভাবনার সুতো ছিড়ে ফোনের রিং টোনের আওয়াজে। আঁধারের ফোন বাজছে। আঁধার কল রিসিবভ করে ফোন কানে দিয়ে গম্ভীর স্বরে বলল,

—“হ্যালো!”

ওপাশ থেকে কি বলল শূঢ়নতে পেলো না মুন। কিন্তু খেয়াল করলো আঁধারের চেহারার রঙ পাল্টে গেছে। ওপাশের ব্যক্তি কি এমন বলল যে আঁধারের চোখ মুখ কঠিন হয়ে এলো, কপালে চিন্তার ভাজ পরলো?

—“আমি এক্ষুনি বের আসছি।”

বলেই আঁধার ফোন কেটে দিবো। মুনের দিকে না তাকিয়েই চেয়ার থেকে ব্লেজারটা নিয়ে মুনের হাত ধরে টেনে বের হতে হতে বলল,

—“চুপচাপ আমার সাথে চলো।”

মুন অবাক হয়ে বলল,

—“কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে?”

—“কোনো প্রশ্ন করো না এখন। দু মিনিটের জন্য নিজের মুখটা বন্ধ রেখে আমার সাথে চলো। ভয় পেয়ে না নিয়ে মেরে ফেলবো না।”

মুন আড়চোখে আঁধারের দিকে তাকিয়ে বলল,

—“মেরেও ফেলতে পারেন আপনাকে ভরসা নেই।”

আঁধার গাড়ির দরজা খুলে মুনকে বলল,

—“তোমার ফালতু কথা বন্ধ করে গাড়িতে বসো।”

মুন রাগ দেখিয়ে বলল,

—“আমি আপনার কথা কেনো শুনবো?”

আঁধার দাঁত কিড়মিড় করে বলল,

—“কারণ তুমি শুনতে বাধ্য।”

—“আমারকে রিজন নি বললে আমি আপনার সাথে যাবো না।”

মুনের এরকম ত্যাড়ামি দেখে আঁধারের রাগে মাথার রগ ফুলে উঠেছে। রক্ত ফুটন্ত পানির মতো টগবগ করছে। আঁধারের ইচ্ছে করছে ঠাটিয়ে একটা চড় মারতে। সব জাগায় এর খামখেয়ালি। অনেক কষ্টে নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণ করে বলল,

—“মিষ্টির স্কুলে ট্যারেরিস্ট এ্যাটাক হয়েছে। তোমার যদি যেতে ইচ্ছে হয় তাহলে এসো আর না হলে এখানেই দাঁড়িয়ে থাকো।

কথাটা বলে ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসলো আঁধার। মুন ওখানে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। আঁধার গাড়ির হন বাজিয়ে আবারো বলল,

—“যাবে নাকি চলে যাবো? গেলে উঠো। হাতে সময় খুব কম।”

মুন দ্রুত গাড়ির ফ্রন্ট সিটে উঠে বসলো। আঁধার গাড়ি স্টার্ট দিলো। ড্রাইভ করতে করতে আঁধার বাকিদেরও ইনফর্ম করে দিলো। আঁধার খেয়াল করলো মুন জানালার দিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে আছে। বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পরছে। মুনের শরীর মৃদু কেপে কেপে উঠছে। হয়তো কাদছে। আঁধার ফুস করে নিশ্বাস ছাড়ে। বাবা হয়ে ওর যেখানে দম বন্ধ হয়ে আসছে সেখানে মা হয়ে মুনের উপর দিয়ে কি ঝড়টা যাচ্ছে তা বোঝার সাধ্য তারও নেই। আঁধার এক হাতে স্ট্রারিং সামলে অন্য হাতে মুনকে কাছে টেনে নেয়। মুন ছুটাছুটি করলে আঁধার আরো শক্ত করে আকড়ে ধরে। একসম হার মেনে আঁধারের বুকে মাথা রাখে। এক সময় এটাই যে ওর এক মাত্র ভরসার স্থান ছিলো। নিরবে অশ্রু ফেলে আঁধার শার্ট ভেজায়। আঁধারের ভতরের জ্বলন্ত আগুনটা মুনের চোখের জলে মুহূর্তেই নিভে যায়। অনেক বছর পর বুক ভরে শ্বাস নেয় আঁধার। ভেতরটায় কেমন যেন সুখময় অনুভুতি হচ্ছে। আঁধার মুনকে আস্বস্ত করে বলল,

—“কিচ্ছু হবে না আমাদের মেয়ের। আমি আছিতো! ওর ড্যাড্যা ওর কিছু হতেই দিবে না। তুমি ভয় পেও না। সি ইজ মাই ডটার। ওর শরীরে আমার রক্ত বইছে। আমার সাহসী মেয়ে ও।”

.
শুটিং ব্রেক চলছে। রাত একটা চেয়ারে হেলান দিয়ে। বসে কোলড্রিংক খাচ্ছে আর ফেসবুক স্ক্রান কর করছে। হঠাৎ করে একটা নিউজে চোখ আটকে যায়। রাত সব কিছু ফেলে ওখান থেকে দ্রুত বেরিয়ে আসে। ডিরেক্টর, প্রডিউসার রাতকে হঠাৎ শুটিং মাঝ পথে ফেলে যেতে দেখে রাতের পথ আটকে জিজ্ঞেস করলো,

—“রাত কি হয়েছে? কোথায় যাচ্ছ তুমি? শুটিং তো এখনো শেষ হয়নি।”

রাত অস্থির হয়ে পরেছে। দুশ্চিন্তায় শরীরের ঘাম ছুটেছে। উৎকন্ঠে জবাব দিলো রাত,

—“স্যার আমাকে এক্ষুণি যেতে হবে। আমার মেয়ে যে স্কুলে পড়ে সেখানে ট্যারেরিস্ট এ্যাটাক হয়েছে। আমার বাচ্চাকে বাচাতে যেতে হবে।”

রাত কাউকে আর কিকিছু বলার সুযোগ না দিয়ে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পরলো। না জানি মিষ্টি এখন কি করছে। হয় তো ভয় পেয়ে কাদছে, পাপাকে ডাকছে। রাত বিরবির করে আওড়ালো,

—“তুমি ভয় পেও না প্রিন্সেস। পাপা আসছে।”

রাত গাড়ির স্প্রিড দ্বিগুণ বারিয়ে দিলো। রাত এখন ঢাকার বাইরে আছে। ঢাকা পৌছাতে অনেক সময় লাগবে। তাই রাত সময় নষ্ট না করে। এদিক ওদিক না তাকিয়ে রকেটের মতো গাড়ি চালাচ্ছে। ওর মাথথায় একটাই কথা গেথে গেছে ‘মিষ্টি ভয় পাচ্ছে। ওকে ডাকছে।’

.
আঁধার স্কুলের থেকে কিছুটা দূরে গাড়ি থামায়। ওখান থেকেই খেয়াল করে স্কুলের সামনে ইতি মধ্যে পুলিশ, মিডিয়া, প্রেস, জার্নালিস্টদের ভীর জমে গেছে। তাই সামনে দিয়ে তো ভেতরে যেতে পারবে না। আর ভেতরে যেতে হলে পাচিল টপকে পেছন দিক দিয়ে যেতে হবে। যাতে কারো চোখে না পরে। আঁধার গাড়ি ডেস্ক থেকে গানটা পকেটে ঢুকিয়ে নিয়ে মুনের হাত টেনে স্কুলের পেছনে নিয়ে যায়। তারপর মুনের দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচিয়ে বলল,

—“পাচিল টপকাতে পারবে।”

মুন একবার ভালো করে দেখে নিয়ে বলল,

—“এটাতো অনেক উচু। আর ধরে উঠার মতোও তো কোনো কিছুনেই।”

আঁধার পাচিলের গা ঘেষে দাঁড়ানো গাছটিকে দেখে বলল,

—“গাছে উঠতে পারো?”

মুন মাথা এপাশ ওপাশ ঘুরিয়ে বোঝালো ও পারে না। আঁধার বিরক্ত হয়ে বলল,

—“আমার বউ হয়ে গাছে উঠতে পারো না, সামান্য এই পাচিলটাও টপকাতে পাচিলটা টপকাতে পারো না। তুমি এক কাজ করো তুমি এখানেই দাঁড়িয়ে থাকো তোমার ভেতরে যাওয়ার দরকার নেই।”

কথা গুলো মুনের ইগোতে লাগলো। মুন রাগে ফুসতে লাগলো। আঁধার নিচে এক হাটু ভাজ করে বসে বলল,

—“আমার হাটুতে এক পা দিয়ে উঠে আরেক পা আমার হাতে রেখে কাধে উঠো।”

মুন তাই করলো। আঁধারের হাটুতে একপা রেখে উঠে দাঁড়িয়ে আরেক পায়ের ভর আঁধারের হাতের উপর রেখে কাধে উঠলো তারপর পাচিলে ধরে উঠে ওপালে লাফ দিলো। আঁধার এপাশ থেকে মৃদু চিৎকার করে জিজ্ঞেস করলো,

—“তুমি ঠিক আছো?”

ওপাশ থেকে আওয়াজ এলো,

—“ঠিক আছি।”

আঁধার স্বস্তির শ্বাস ফেলে। লম্বা হওয়ার কারণে আঁধার পাচিল সহজেই নাগাল পায়। তাই বেশি কষ্ট হয়না। সহজেই পাচিল টপকে এপাশে এসে পরে। এর পরের কাজ হলো পাইপ বেয়ে ছাদে ওঠা। আঁধার আড়চোখে মুনের দিকে তাকিয়ে বলল,

—“পাইপ বেয়ে ছাদেতে উঠতেই পারবে?”

মুন ভ্রু কুটি করে কোমরে হাত দিয়ে বলল,

—“আমাকে দেখে কি আপনার সুপার ওম্যান অথবা স্পাইডারম্যান মনে হয়? নাকি আপনার মতো ক্রিমিনাল মনে হয়?”

আঁধার দাঁতে দাত চেপে বলল,

—“আমি এখন তোমার সাথে ঝগড়া করার মুডে নেই তাই বারতি কথা বলবে না। ছোট একটা প্রশ্ন করেছি হ্যাঁ বা না উওর দিবে তা না করে….”

মুন মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকালো। আঁধার শার্টের হাতা গুটিয়ে পাইপ বেয়ে উঠতে উঠতে বলল,

—“তুমি এখানে দাঁড়াও আমি উপরে উঠে দেখছি কোনো দড়ি পাই কিনা। নাহলে তোমাকে এই পাইপ বেয়েই উঠতে হবে।”

মুন কিছু বলল না। দু মিনিটের মধ্যে আঁধার পাইপ বেয়ে ছাদে উঠে পরলো। মুনের এখন আঁধারকে স্পাইডারম্যান মনে হচ্ছে। আঁধার ছাদে উঠে এদিক ওদিক দড়ির সন্ধান করলো। আর ভাগ্য ক্রমে পেয়েও গেলো। আঁধার নিচে দড়ি ফেলে বলল,

—“উঠে পরো।”

মুন আঁধারের কথা মতো দড়ি বেয়ে উঠতে লাগলো। মুনের জন্য এটা নতুন তাই ভয়ের সাথে সাথে কষ্টও হচ্ছে খুব। উপরে উঠে দুজনেই এবার সাবধানে এগিয়ে যেতে লাগলো। যে করেই হোক মিষ্টিকে ও বাকি বাচ্চাদের বাচাতে হবে। পুরো স্কুলে ট্যারেরিস্ট’রা ছড়িয়ে আছে। যাতে কোনো পুলিশ বা বাইরের কোনো মানুষ ভেতরে না ধুকতে পারে। সবার হাতেই বন্দুক। সিড়ির কাছেও একজন পাহাড়া দিচ্ছিলো। আঁধার খুব সাবধানে এগিয়ে যেতে লাগলো। আর আঁধারকে অনুসরণ করে মুন চলতে লাগলো। আঁধার সুযোগ বুঝে লোকটার মুখ চেপে ধরলো। মুনকে মৃদু আওয়াজ করে বলল,

—“ক্লোরোফর্মটা জলদি এর মুখে স্প্রে করো।”

মুন কাপা হাতে দ্রুত লোকটার মুখে ক্লোরোফর্ম স্প্রে করলো। তারপর আঁধার সাবধানে লোকটাকে একটা রুমের মধ্যে রেখে বাইরে থেকে দরজা লক করে দিলো।

.
এদিকে মিষ্টি বসে থাকতে থাকতে বোর হচ্ছে আর এই তিশানও আসার পর এক মুহূর্তের জন্যও ওর হাত ছাড়ে নি। মিষ্টি বিরক্ত হয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,

—“তিশু হাতটা ছাড়ো এখন। মিষ্টির ব্যথা করছে।”

তিশান কিছু বলল না। চুপচাপ মিষ্টির হাত ধরে বসে রইলো। মিষ্টি এবার বিরক্ত হয়ে জোড়ে বলে উঠলো,

—“এভাবে আর কতক্ষণ বসে থাকবো আঙ্কেল? মিষ্টির খিদে পেয়েছে তো!”

মিষ্টির কথা শুনে সবাই ভীত চোখে ওর দিকে তাকালো। টিচাররা সব বাকরুদ্ধ। ট্যারেরিস্ট গুলোর মধ্যে একজন ধমক দিয়ে বলল,

—“খিদে পেয়েছে তো আমরা কি করবো? চুপচাপ বসে থাক। ”

মিষ্টি কপাল কুঁচকে বলল,

—“বাহ রে! সকাল থেকে আটকে রেখেছো আবার খিদে পেয়েছে বললে ধমকাচ্ছ? আমার ছোট পেট সেই সকালে মাম্মাম কাইয়ে দিয়ে ছিলো এখনো খিদে পায় নি বুঝি আমার?”

লোকটা ক্ষিপ্ত হয়ে বলল,

—“এই মেয়ে তোকে চুপ করে বসতে বলেছি না?”

মিষ্টি জেদি কন্ঠে বলল,

—“আমার খিদে পেয়েছে খেতে দেও।”

—“আয় তোকে বুলেট খাওয়াই।”

মিষ্টি নাকচ করে বলল,

—“না আমি পিজ্জা খাবো সাথে কোল্ড ড্রিংক।”

তিশান মিষ্টির কথা শুনে ঢোক গিলে ওর দিকে তাকিয়ে আরো শক্ত করে হাতটা চেপে ধরলো।

—“তোকে তো আমি…”

বলে লোকটা মিষ্টির দিকে তেড়ে যেতে লাগলো। সবাই লোকটাকে রেগে যেতে দেখে ভয়ে সিটিয়ে গেলো। দলের আরেকজন লোক ওি লোকটাকে বাধা দিয়ে বলল,

—“নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখ। বাচ্চা মেয়ে সকাল থেকে না খেয়ে আছে তাই এরকম করছে।”

লোকটা কিড়মিড় করে বলল,

—“একে চুপ করা নাহলে কিন্তু সুট করে দিবো।”

দ্বিতীয় লোকটা রুম থেকে বেরিয়ে গেলো কিছুক্ষণ পর একটা স্যান্ডউইসের প্যাকেট আর একটা পানির বোতল এনে মিষ্টিকে দিয়ে বলল,

—“খেয়ে নেও। আর কথা বলবে না। চুপচাপ বসে থাকবে।”

‘মিষ্টি’ মিষ্টি করে হেসে মাথা নাড়ালো। লোকটাও বিনিময়ে মৃদু ঠোঁট প্রসারিত করলো। লোকটার নিজেরও মিষ্টির বয়সি আদরের একটা মেয়ে আছে। মিষ্টির মধ্যে নিজের মেয়েকে দেখতে পাচ্ছে সে। তাই অন্যজনের মতো সে নির্দয় হতে পারেনি।

#চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here