Mr_Husband,পর্ব_৫৪,৫৫

0
3437

#Mr_Husband,পর্ব_৫৪,৫৫
#লেখিকা: আবনী ইবনাত মুন
#পর্ব_৫৪

বাইরে ঝুম বৃষ্টি পরছে। টুপ টাপ বৃষ্টির ফোটার শব্দ ভেসে আসছে কানে। গাছ পালা গুলো হাওয়ার বেগে এদিকে পরছে আবার ওদিকে দুলে পরছে। পরিবেশ একদম ঠান্ডা। আঁধার ক্লান্ত নয়নে জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে। আর মুন আঁধারের দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে। অনেক বছর পর আবার এই মুখটা দেখছে বলে কথা। কত পিপাসা জমে ছিল মনে শুধু মাত্র এই চেহারাটা দেখার জন্য। আছ ভালো করে দেখে নিজের তৃষ্ণা মিটাচ্ছে। একটু অন্য রকম লাগছে। খোচা খোচা দাঁড়িয়ের কারণে আগের থেকে অনেক বেশি সুদর্শন লাখছে। কাঁটা ভ্রুর নিচে নীল অতল সমুদ্রের মতো গভীর নীলাভ দুটি চোখ। মেয়েলী রক্ত জবার মতো ঠোঁট। আর ঠোঁটের ঠিক নিচে কালো কুচকুচে ছোট্ট একটা তিল। ইশ! ছেলেদের ঠোঁটের নিচে তিল থাকাটা বড্ড বেমানান লাগছে মুনের কাছে। ফর্সা গালে খোচা খোচা চাপা দাড়ি। ডার্ক ব্যাউন চুল গুলো জেল পেছনে ঠেলে দেওয়া হলেও কিছু অবাধ্য চুল কপালে পরে আছে। চেহারায় ফরেনার ফরেনার একটা ভাব আছে। শার্টের উপরের দুটো বোতাম খোলা থাকায় কালো শার্টের ভেতর থেকে লোম হীন ফর্সা চওড়া বুকটা উকি দিচ্ছে। আঁধারের এই বুকের উপর বরা বরই মুন অনেক বেশি দুর্বল। এখনই দুর্বল হয়ে পরছে। বারবার বেহায়ার মতো ওদিকেই তাকাচ্ছে। হঠাৎ করে আঁধার ওর দিকে তাকাতেই দেখতে পায় মুন ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। মুন তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে অন্য দিকে তাকায়। আঁধার সরু চোখে মুনের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। মুন আড়চোখে তাকাতেই আঁধারের সাথে চোখাচোখি হয়ে যায়। আঁধার তা দেখে দুষ্টু স্বরে বলে উঠে,

—“লুকিয়ে লুকিয়ে দেখার কি আছে? সামনা সামনি দেখতে কে নিষেধ করেছে? সব তো তোমারই!”

বলেই চোখ টিপলো আঁধার। মুনের কিছুটা লজ্জা লাগলো। তাই লজ্জাটাকে ঢাকতে রাগ দেখিয়ে বলল,

—“আপনি দেখছি দিন দিন অসভ্য হয়ে যাচ্ছেন। ফালতু সময় নষ্ট না করে কিছু বলার থাকলে বলুন আর নাহলে আমাকে যেতে দিন। মিষ্টিকে নিয়ে বাড়ি ফিরতে হবে তাড়াতাড়ি। রাত অপেক্ষা করছে আমার জন্য।”

আঁধারের রাগ লাগলো এই কথাটায়। মুন ওর বউ। তাহলে ওর বউয়ের জন্য বাইরের একটা ছেলে কেনো অপেক্ষা করবে? আর মুন বা নিজের স্বামীকে ছেড়ে অন্য একজনের কাছে কেনো যাবে? হোয়াই?

—“হোয়াট? তুমি নিজের হাসবেন্ডের চিন্তা না করে অন্য একটা পুরুষের চিন্তা করছো! আমি এর জন্য তোমাকে পার্মিশন দেই নি।””

মুন বিরক্তির স্বরে বলল,

—“আঁধার অবুঝের মতো কথা বলবেন না। হি ইজ ইঞ্জিরিড। হাতে গুলি লেগেছে ওর। ও একা কিছু করতে পারে না। আরেকজনের হেল্প লাগে। আপনি একজন ডক্টর হয়ে এরকম বিহেভ কি করে করতে পারেন? আমার তো এখন আপনার ডক্টর হওয়ার উপর ডাউট হচ্ছে।”

শেষের কথাটা বলে সন্দিহান চোখে তাকালো আঁধারের দিকে। মুন রুদ্ধ স্বরে বলল,

—“আপনি বলেন নাকি?”

—“আচ্ছা বলছি।”

বলেই লম্বা একটা নিশ্বাস নিয়ে বলতে শুরু করলো,

*রুশা সেদিন না বলে চলে যাওয়ার পর আঁধার ভেঙ্গে পরেছিল। কেমন যেন একদম নিরব হয়ে গেছিলো। সারাদিন রুমে দরজা বন্ধ করে বসে থাকতো। কারো সাথে মকশতো না কথা বলতো না। খাওয়া দাওয়াও অফ করে দিয়ে ছিলো। কেউ ওকে খাওয়াতে পারেনি। এমন অবস্থা একমাত্র আরুশই জোর করে ওর কাছে ছিলো। পাশে ছিলো। আরুশ ছাড়া কাউকে আঁধার রুমে ঢুকতে দিতো না। দেখতে দেখতে তিন মাস এভাবে চলে যায়। দিন দিন আঁধারের অবস্থা খারাপ হতে লাগলো। আরিফা রেজওয়ান- আরমান রেজওয়ান চিন্তায় পাগল প্রায়। তখন ইসী বুদ্ধি দিলো আঁধারকে এখান থেকে দূরে নিয়ে যেতে হবে। এখানে থাকলে আরো ভেঙ্গে পরবে। সবাই ওকে সায় দিলো। কিছুদিনের মধ্যে ওরা আবার ইউ.এস.এ ব্যাক করলো। সবাই আঁধারকে মাতিয়ে রাখতে শুরু করলো। শেষে আঁধারও বাধ্য হয়ে ওদের সাথে তাল মেলাতে লাগলো। ধীরে ধীরে আঁধার আবার আগের মতো হয়ে গেলো। আঁধারের উন্নতির পেছনে সব থেকে বেশি অবদান আরুশের ছিলো। ইসী আরুশের প্রতি নিজের ফিলিংস গুলো বুঝতে শুরু করেছিল। দিন গুলো ভালোই যাচ্ছিলো কিন্তু হঠাৎ করে এক দুর্ঘটনায় সব আবার উলোট পালট হয়ে গেলো। ছয়টি ফুল থেকে একটি ফুল খসে পরলো। যার কারণে ভেঙ্গে পরলো আরো পাঁচটি ফুল। হঠাৎ করে হসপিটাল থেকে কল আসে আপনের কাছে। আপন কল রিসিভ করে কানে ধরতেই স্তব্ধ হয়ে যায়। কি করবে কিছু ভেবে পায় না। আঁধার বাদে সবাইকে কল করে তাড়াতাড়ি হসপিটালে আসতে বলে।

.
আপন করিডোরে একটা আসনে কপালে হাত দিয়ে বসে ছিলো। সবাই আসতেই ওকে দেখতে পায়। ইসী দৌড়ে ওর কাছে দিয়ে মাথায় হাত দিয়ে উত্তেজিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

—“এই আপন কি হয়েছে? আমাদের ফোন করে ইমার্জেন্সি ডাকলি কেনো? আর আঁধারকে বলতে বারণ করলি কেনো? তোর কিছু হয়েছে? কথা বলছিস না কেনো?”

আপন ককপাল থেকে হাত সরিয়ে মাথা তুলে তাকায়। আপনকে দেখে এক মুহূর্তের জন্য সবাই ভড়কে যায়। ওর চোখে দুটো ফুলো ফুলো লাগছে। চোখের সাদা অংশ লাল হয়ে আছে। নাক, মুখও ফোলা। মনে হচ্ছে অনেকক্ষণ ধরে কেদেছে। আশিক ওর কাছে এসে বলল,

—“কি হয়েছে তোর? এমন লাগছে কেন তোকে? মনে হচ্ছে কেদেছিস?”

আপন মুখ খুলছে না দেখে অয়ন এবার রেগে গেলো। চিন্তায় ওর মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। আর আপন ধ্যান ধরে ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। অয়ন রেগে আপানের কাধ ঝাকিয়ে জোরে ধমক দিয়ে বলল,

—“হয়েছেটা কি তোর? কথা বলছিস না কেনো? আরুশ, আরুশ কোথায়?”

আপন- অয়নের কোমর জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে কেদে ওঠে। সবাই যেন ওর কান্না দেখে হতবাগ। অয়ন কিছুটা শান্ত হতে ওর গালে হাত রেখে নরম গলায় বলল,

—“এই আপন কাদছিস কেনো? হসপিটালে ডাকলি কেনো? তোর কিছু হয়েছে? বল আমাকে?”

আপন নিছের চোখের জল মুছে অয়নের হাত ধরে বলল,

—“চল আমার সাথে।”

বলে ওকে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো। বাকিরাও ওদের পেছনে পেছনে যেতে লাগলো। মর্গের সামনে এসে থামলো আপন। অয়ন কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

—“এখানে নিয়ে এসেছিস কেনো?”

আপন রুক্ষ স্বরে বলল,

—“ভেতরে গেলেই দেখতে পারবি।”

বলেই ওকে নিয়ে মর্গের ভেতরে ঢুকলো। মর্গের ভেতরে প্রবেশ করতেই গায়ে কাটা দিয়ে উঠে ইসীর। গা ছমছমে একটা পরিবেশ। যেদিকে তাকায় শুধু ডেডবডি। আপন একটা ডেডবডির সামনে এসে দাঁড়ালো। ইসী কাপতে কাপতে বলল,

—“এটা কার ডেডবডি?”

ইসী বলতে না বলতেই অয়ন কৌতূহলের বসে ডেডবডিটার উপর থেকে কাপড়টা এক টানে সরিয়ে ফেলে। সাথে সাথে রুম জুড়ে একটা চিৎকার বাজতে থাকে। ইসী ‘আরুশ’ বলে গগোন কাপানো চিৎকার দিয়ে ওখানেই জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পরে। আশিক অবাক হওয়া বদ দিয়ে আগে ইসীকে ধরে। অয়ন জ্ঞান হীন, বাক রুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ও এখনো বুঝতে পারছে না কি করা উচিত। কাদবে না হাসবে সব ভুলে গেছে। অয়ন এক পা এক পা করে ওখান থেকে পেছাতে থাকে। একসময় দৌড়ে বেড়িয়ে যায় রুম থেকে। তারপর আঁধারকে কল করলো। কোনো রকম ওকে হসপিটালে আসতে বলেই কল কেটে জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে লাগলো। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে ওর।

.
আঁধার কিছুক্ষণের মধ্যেই হসপিটালে উপস্থিত হলো। এসে দেখলো ইসী হসপিটালের বেডে শুয়ে আছে। ওকে ঘুমের ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে। অয়নের শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল বলে ও অক্সিজেন মাক্স লাগিয়ে শুয়ে আছে। ছেলে বলে চিৎকার করে কাদতে পারছে না। কিন্তু চোখের জলও বাধ মানছে না। চোখের কর্নিস বেয়ে অবিরাম জল গড়িয়ে পরছে। আশিক আর আপন নিশব্দে চোখের জল ফেলছে। আঁধার সবার এমন অবস্থা দেখে ভ্রু কুঁচকে ওদের দিকে তাকায়। আঁধারকে দেখেই অয়ন অক্সিজেন মাক্স খুলে ওর কাছে দৌড়ে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে। আঁধার কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না। আঁধার অয়নকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে সামনে দাঁড় করিয়ে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়,

—“কি হয়েছে তোর? এরকম করছিস কেনো? ইসীর বা কি হয়েছে? আর ওই গবেট দুইটাই বা কাদছে কেনো? পুরুষ জাতির মানসম্মান ডুবাবে নাকি? উম, আরুশ কোথায়? ও এখনো আসেনি?”

অয়ন অস্পষ্ট স্বরে বলল,

—“আঁধার আ’আরুশ ওই’ওই খানে আরুশ….”

আঁধার-অয়নের কথা ঠিক বুঝতে পারছে না। তাই ভ্রু বাকিয়ে বলল,

—“কি বলছিস? কিছুই তো বুঝতে পারছি না।”

আপন নিজেকে সংযত করে চোখ মুছে বলল,

—“আমার সাথে আয়, আমি দেখাচ্ছি আরুশ কোথায়।”

আঁধার আপনের পেছনে গেলো। আশিক, অয়নও ছুটলো ওদের সাথে। কারণ সবাই জানে আঁধার আরুশের জান। যাকে বলে ‘দো জিসাম এক জান’। আঁধার যখন আরুশের নিশ্প্রাণ দেহটা দেখবে তখন ওকে সামলানোর জন্য ওদের দরকার পরবে। মর্গে ঢুকে আপন একটা ডেডবডি দেখিয়ে বলল,

—“গিয়ে দেখ আঁধার।”

আঁধারের কিছুটা ভয় করছে। কিছু ভালো ঠেকছে না। আঁধার প্রশ্ন করলো,

—“তুই আমাকে এখানে নিয়ে এসেছিস কেন? কার লাশ ওটা? আর আরুশ, ও কোথায়।”

—“আরুশ আছে। তুই আগে গিয়ে ওই ডেডবডির উপর থেকে কাপড় সরা।”

আঁধার কিছুটা রেগে বলল,

—“আমার কিন্তু এধরনের মজা একদম ভালো লাগে না আপন।”

বলেই আপনের দিকে তাকিয়ে এক টানে ডেডবডির উপর থেকে সাদা কাপড়টা সরিয়ে ফেলল। আপন হালকা হেসে বলল,

—“দেখ আঁধার, ওই তো আমাদের আরুশ।”

কথাটা শুনে আঁধারের বুকের মধ্যে বাদ্য যন্ত্র বাজতে শুরু করলো। আপন আবারো বলল,

—“তাকা আঁধার দেখ একবার।”

আঁধারের ভয় করছে দেখতে। মন কু ডাকছে। মন যেটা বলছে আঁধার বারবার চাইছে সেটা মিথ্যা হোক। কিন্তু এরকম কিছু হলো না। আঁধার ডেডবডিটার দিকে তাকাতেই থমকে গেল। ওর প্রাণের চেয়েও প্রিয় বন্ধু সাদা কাফন জড়িয়ে শুয়ে আছে। শরীরের অসংখ্য আঘাতের দাগ। বাম গালে কাটা দাগ। পিঠেও বড় গভীর একটা কাটা দাগ আছে। পেটে ছুরি ঢুকিয়ে দিয়ে ছিলো কেউ। মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে। তিনটে বুলেটেরও দাগ আছে। একটা কপালের ঠিক মাঝখানে। একটা ডান পাশের বুকে। আর একটা বুকের বাম পাশে। ওখানে উপস্থিত সবাই ভেবে ছিলো আরুশের ডেডবডিটা দেখে হয়তো আঁধার পাগলের মতো রিয়েক্ট করবে। খুব উত্তেজিত হয়ে পরবে। চিৎকার করে আরুশের ডেডবডি জড়িয়ে ধরে কাদবে। একে ওকে ধরে মারবে। কিন্তু সেরকম কিছুই ওলো না। আঁধার একদম নরমাল রিয়েক্ট করলো। এমন বিহেভ করলো যেন কিছু হয়ই নি। ওর আচারণ স্বাভাবিকের চেয়েও স্বাভাবিক। ওর চাহনি ওর কন্ঠ স্বর অত্যধিক শান্ত মনে হলো সবার কাছে। যেটা কারো একদম ভালো ঠেকলো না। সবাই নিজেদের কষ্ট, নিজেদের কান্না ভুলে ড্যাবড্যাব করে আঁধারকে দেখতে লাগলো। এরই মধ্যে ইসীর কন্ঠ শোনা গেল। ইসী চিৎকার-চেচামেচি করছে। কান্নাকাটি করছে। সবাইকে অবাক করে দিয়ে আরুশের ডেডবডির কানে কিছু একটা বলে আবারো সাদা কাপড়ে ঢেকে দিয়ে রুম থেকে বেদিয়ে গেলো। অয়ন, আপন, আশিক বিষ্ময়ে কিংক্যর্তবিমুঢ়।

#চলবে,

#Mr_Husband
#লেখিকা: আবনী ইবনাত মুন
#পর্ব_৫৫

একটু আগেই সন্ধ্যা নেমেছে ইউ.এস.এ এর মাটিতে। ঘন কালো অন্ধকারের মধ্যেও লাল কমলা আভা দেখা যাচ্ছে আকাশে। একটু পরেই ঘন কালো অন্ধকারে ছেয়ে যাবে চারিদিক। পাখিরা সব ক্লান্ত হয়ে দল বেধে নিজ নিজ গৃহে ফিরছে। ইসীকে ইনজেকশন দিয়ে আবারো ঘুম পারানো হয়েছে। একটু আগে উঠেই পাগলামো করছিল তাই। বাকি চার বন্ধু পাশেই নিশ্চুপ ভাবে চেয়ারে বসে আছে। আঁধার একদম শান্ত হয়ে একটা চেয়ারে বসে নিচের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। দৃষ্টি আগের জায়গায় নিবদ্ধ রেখেই অতি মাত্রায় শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলো,

—“এই ঘটনার সময় আরুশের সাথে কে ছিলি?”

আপন শুকনো ঢোক গিলে কিছুটা তোতলানো স্বরে বলল,

—“আ’আমি।”

আঁধার বরফের থেকেও শীতল দৃষ্টিতে নিক্ষেপ করলো আপনের দিকে। আঁধারের এমন শীতল দৃষ্টি দেখে এসি চলা সত্বেও ঘামতে শুরু করলো আপন। আঁধারকে ঠিক সুবিধার ঠেকছে না ওর কাছে। শুধু ও কেনো কেউই আঁধারের এতো স্বাভাবিক বিহেভিয়ার নিতে পারছে না। আঁধার আপনের দিকে দৃষ্টি রেখেই বলল,

—“কে বা কারা মেরেছে আরুশকে? ঠিক কি হয়ে ছিলো? যা ঘটেছে সব ঠিক ঠিক বলবি।”

আপন এক গ্লাস পানি খেয়ে বলতে শুরু করলো।
—“কাল আমি আর আরুশ গাড়ি নিয়ে হোস্টেলের দিকে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ করে আরুশ গাড়ি থামাতে বলল। আমিও ওর কথা মতো গাড়ি থামালাম। আমরা দেখলাম একটা মেয়েকে কয়েকজন মিলে জোর করে গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। রাস্তায় এতো এতো মানুষ থাকতেও কেউ কিচ্ছু করলো না। সবাই না দেখার ভান করে চলে যাচ্ছিল। আমিও তাদেরই মতো চলে আসতে চেয়ে ছিলাম কিন্তু আরুশের জন্য পারিনি। কারণ আরুশ বলেছিল, আমি না গেলে ও একাই যাবে। তবুও মেয়েটাকে বাচাবে। না চাওয়া সত্বেও ওর কথা শুনতে হয়। আমরা গাড়িটাকে ফলো করলাম। গাড়িটা একটা পুরানো বাংলো বাড়ির সামনে এসে থামলো। লোক গুলো মেয়েটাকে নিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকলো। আমি বাংলো থেকে কিছুটা দূরে গাড়ি রেখে এসেছিল। যাতে কেউ সন্দেহ না করে। আমি আর আরুশ বাংলোর চারপাশে ঘুরে দেখার চেষ্টা করছিলাম ভেতরে কি চলছে। আর আমরা দেখলাম বিশ/পচিশটা মেয়েকে একটা রুমে বেধে রাখা হয়েছে। মেয়েগুলো বাংলাদেশী ছিলো। হয় তো বাংলাদেশ থেকে পাচার করে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে। আমার খুব ভয় করছিলো। আমি আরুশকে বারবার বলছিলাম, ‘চল এখান থেকে। আমরা বড় কোনো বিপদে পরবো।’ কিন্তু ও আমার কথা শুনেনি। ও বলে ছিল, ‘এই মেয়ে গুলোকে যে করেই হোক বাচাতে হবে। এটা আমার কর্তব্য। মেয়ে গুলোকে এখানে বিপদের মুখে ফেলে যেতে পারবো না। এরকম কাপুরুষের মতো কাজ আমি করতে পারবো না।’ আরুশ একাই ভেতরে চলে গেল। আমি বাইরেই থেকে গেলাম। তাতে ও কোনো বিপদে পরলে আমি পুলিশকে খবর দিতে পারি। আরুশ খুব সাবধানে আর খুব সহজেই মেয়েগুলোকে যে রুমে রাখা হয়েছিলো সে রুমে প্রবেশ করলো। আর একে একে সব মেয়েদের মুক্ত করে গুন্ডাদের থেকে বাচিয়ে বাইরে বের করতে লাগলো। আমি মেন গেটের বাইরে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম। সব মেয়ে গুলো খুব সাবধানে গুন্ডাগুলোর চোখ ফাকি দিয়ে বেরিয়ে আসলো বাংলো থেকে। আর কাজটা এতো সহজ হলো কারণ ওই গুন্ডা গুলো এক রুমে বসে ড্রিংক’স্ করছিলো। আর আরুশ ওই রুমটা আগে খুজে বের করে বাইরে থেকে লক করে দিয়ে ছিলো। আমি আরুশ আর ওই মেয়েগুলো এই যাত্রায় বেচে গিয়ে ছিলাম। মেয়েগুলোকে সহি সালামতে পুলিশ স্টেসনে রেখে এসে ছিলাম। সব ঠিকই ছিলো কাল। কিন্তু আজ সব উলোট পালট হয়ে গেল। আরুশ আর আমি শপিং মলে গেছিলাম মোবাইল কিনতে। কারণ কাল দৌড়া দৌড়াতে আরুশের মোবাই কোথাও পরে গেছে। আমরা ফোন কিনে বের হয়েছি তখন হঠাৎ আরুশ আমাকে গাড়িতে বসতে বলে আবারো মিলের ভেতরে দৌড়ে গেল। কিছুক্ষণ পর ওকে দেখা গেল। ওর হাতে একটা শপিং ব্যাগ ছিলো। ও হাসি মুখে গাড়ির দিকে এগিয়ে আসছিলো হঠাৎ একটা গাড়ি এসে আরুশকে ধাক্কা দিলো। আরুশ ছিটকে দূরে গিয়ে পরলো। আমি স্তব্ধ হয়ে গাড়িতেই বসে রইলাম। কিছুক্ষণের জন্য জ্ঞান শূন্য হয়ে গেছিলাম। মানুষ ওর দিকে এগিয়ে যেতে গিয়েও থমে গেলো ওই গাড়ির ভেতর থেকে বের হওয়া লোকটাকে দেখে। লোকটাকে দেখে কোনো গ্যাংস্টার মনে হচ্ছিলো। লোকটার পেছনে দশ/পনেরো জনের মতো বডি গার্ড ছিলো। সবার হাতে ধারালো অস্ত্র। আরুশ উপুড় হয়ে ছিল একজন নিজের হাতে থাকা তলোয়ার দিয়ে ওর পিঠে আঘাত করে। আরেকজন পা দিয়ে লাথি দিয়ে ওকে সোজা করে। রাস্তায় ছিটকে পরার কারণে ওর মাথা ফেটে ফিকনি দিয়ে রক্ত পরছে। গাল কেটে গলগল করে রক্ত পরছে। রক্তে রক্তে ভভিজে যাচ্ছে রাস্তা। কেউ এগিয়ে আসছে না ওর কাছে। সবাই ভয়ে জবথব মেরে দাঁড়িয়ে আছে এক পাশে। ওদের বস চোখের সানগ্লাস সরিয়ে আরুশের দিকে তাকালো। শকুনের মতো কি ভয়ংকর হিংস্র চোখ। চোখের মনিটা ঠিক কি রঙের বলা যাচ্ছে না। একদম ভিন্ন দেখতে। মনির পাশের সাদা অংশ ভিষণ লাল। দেখতেই ভয়ে শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠে। একটা চামচা লোকটার হাতে গান দিলো। লোটা দাঁত খিচে কিছুটা বলল যা আমি এতো দূর থেকে শুনতে পায়নি। তারপর লোকটা আরুশের বুকের ডান পাশে গুলি করলো। আরুশ ছটফট করে উঠলো। আবার লোকটা আরুশের বুকের ঠিক বাম পাশে গুলি করলো। গুলিটা হয়তো ঠিক আরুশের হার্টে গিয়ে লেগেছে। এক নিশ্বাসে সাথে সাথে আরুশের জান পাখি উড়াল দিলো। লোকটা সবার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে চলে গেল। যেন চোখ দিয়েই শাসালো। লোক গুলো চলে যেতেই আমি নিজের ঘোর কেটে বেরিয়ে এলাম। ততক্ষণে সব শেষ হয়ে গেছিলো। আমি দৌড়ে ওর কাছে গেলাম। ওকে অনেক ডাকলাম কিন্তু ও আর আগের মতো সারা দিলো না। একদম চুপ হয়ে গেছিলো সারা জীবনের জন্য। আমি ওকে নিয়ে হসপিটালে এলাম। তারপর সবাইকে ফোন করে জানালাম।”

আপন দেখলো আঁধার আগের মতোই শান্ত স্বাভাবিক। কিছুক্ষণ চুপ থেকে আঁধার মুখ খুলল,

—“তুই চিনিস ওদের?”

—“না। কিন্তু দেখে মনে হচ্ছিলো ওরা বড় কোনো গ্যাংস্টার।”

আশিক এর মধ্যে বলল,

—“আরুশকে দাফন…..”

আঁধার আশিকের কথার মাজেই বলল,

—“আরুশের খুনিদের জানাজা পড়ার পরই আরুশের লাশ দাফন করবো। তার আগে নয়।”

শান্ত স্বরের এমন অস্বাভাবিক ভয়ংকর কথা শুনে তিনজনই চকমকে তাকালো আঁধারের দিকে। কি বলছে আঁধার? অয়ন নট এ্যাগ্রি করে বলল,

—“পাগল হয়ে গেছিস তুই? কি সব কথা বলছিস? ওরা কোনো ছোটমোট সাধারণ গুন্ডা না। অনেক বড় গ্যাংস্টার ওরা। শুনিস নি আপন কি বলল? লোক সমাজের মধ্যে দাঁড়িয়ে আরুশকে মেরেছে ওরা। তাও কেউ এগিয়ে আসার সাহস দেখায়নি। ভাব কতো ডেঞ্জারেস ওরা।”

এতোক্ষণের চেপে রাখা হিংস্র রুপ যেন এখন বেরিয়ে আসছে চাইলো। আঁধার উঠে অয়নের কর্লার টেনে ধরে রক্ত চক্ষু নিয়ে তাকালো ওর দিকে। এক মুহুর্তের জন্য অয়ন ভড়কে গেলো। আঁধার চাপা গর্জন করে বলল,

—“আমি ওদের থেকেও বেশি ডেঞ্জারেস।”

.
আপনের কথা অনুযায়ী সেই লোকটার এস্কেচ বানানো হয়। এস্কেচটা কপি করে চারজনই বেরিয়ে পরে সেই লোক গুলোর খোজে। আঁধার ছোট খাটো গুন্ডাদের কাছে খোজ নিচ্ছে। কারণ এরা কম হলেও উপর মহলের খবর জানে। এদের দিয়েই অনেক সময় বড় বড় কর্মকাণ্ড ঘটায়। এভাবেই দু দিন পার হয়ে যায় কিন্তু কোনো খবর পাওয়া যায় না। কিন্তু একজন ওদের একটা জায়গার ঠিকানা দিয়েছে আর বলেছে ওখান থেকে খবর পেলেও পেতে পারে। কিন্তু জায়গাটা খুব বিপদ জনক। হাজার হাজার গুন্ডা, ক্রিমিনালদের বাস ওখানে। তাই খুব সাবধানে যেতে হবে। আঁধার, আশিক, অয়ন, আপন মিলে ভেবে চিন্তে সেই জায়গায় পা রাখে। সামনেই দেখতে পায় মাঠে অনেক গুলো ছেলেরা বাসকেট বল খেলছে। এক একটার সুরত দেখেই বোঝা যায় এরা সব গুন্ডা। আঁধাররা ওরকম গেটাপ নিয়েই ওর দের সামনে দিয়ে হাটা শুরু করে। আঁধারের দিকে পেছন থেকে বাসকেট বলটা বুলেটের গতিতে ছুটে আসে। আঁধারের মাথায় লাগবে তার আগেই আঁধার মাথা পেছন দিকে নুইয়ে দেয়। বলটা আঁধারের উপর দিয়ে গিয়ে ওই ছেলে গুলোর মধ্যে একজনের গায়ে লাগে। একটা লম্বা সাস্থবান ছেলে আঁধারের দিকে এগিয়ে আসে আর কপাল কুঁচকে ইংলিশে প্রশ্ন করে,

—“কে তোমরা? এখানে কি করছো? আগে তো কখনো দেখিনি?”

আঁধার পেছনে ঘুরে লোকটার মুখমুখি দাঁড়িয়ে বলল,

—“আমি AR। বস হ্যাংরির সাথে দেখা করতে এসেছি। আমিও তোমাকে আজই দেখলাম।”

আঁধারের কথা শুনে ছেলেটার ছয় আঙ্গুল কপালে তিন ভাজ পরলো। ছেলেটা তার সঙ্গীদের দিকে একবার তাকালো তারপর আবার আঁধারের দিকে তাকিয়ে বলল,

—“বস হ্যাংরির সাথে তোমাদের কি কাজ? কে তোমরা?”

—“ভয় পাওয়ার কিছু নেই আমরা পুলিশ নই। পার্সোনাল কাজ আছে।”

অয়ন রিকুয়েস্ট করে বলল,

—“ব্রো ওনার সাথে দেখা করতে একটু হেল্প করো না। প্লিজ ব্রো।”

ছেলেটা কিছুক্ষণ কি যেন ভাবলো তারপর বলল,

—“ঠিক আছে। চলো আমার সাথে।”

.
আঁধাররা আর ওই ছেলেটা বড় বিল্ডিং এর ভেতরে প্রবেশ করলো। সবাই কেমন করে যেন ওদের দিকে তাকাচ্ছে। আঁধার সেদিকে পাত্তা না দিয়ে নিজের মতো এগিয়ে যাচ্ছে। বস হ্যাংরির রুমে ঢুকার আগে একটা লোক ওদের চেক করলো কোনো অস্ত্র আছে নাকি সাথে। তারপর ভেতরে যেতে দিলো। ওদের সাথে থাকা ছেলেটা আগে ভেতরে ঢুকলো আর তার পিছে আঁধাররা। হ্যাংরি নামের লোকটা কারুকার্য করা সিঙ্গেল সোফায় পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে। সাদা চামরায় ছিমছাম গড়ন, ডার্ক ব্রাউন চুল-চোখ, পরনের সুটটা জোকারের মতো রঙ বেরঙের। ছেলাটা অনুনয় করে বলল,

—“বস হ্যাংরি আপনার সাথে দেখা করতে কয়েকটা ছেলে এসেছে।”

বস হ্যাংরি বলল,

—“ওকে। ইউ সুড গো নাও।”

ছেলেটা আঁধারদের রেখে বাইরে চলে গেলো। বস হ্যাংরি আঁধারকে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে বলল,

—“তোমরা তোমাদের বন্ধুকে যে মেরেছে তার খোজে আমার কাছে এসো। এম আই রাইট?”

বস হ্যাংরির কথা শুনে সবাই বিষ্ময়ে কিংকর্ত্যবিমূঢ়। আঁধার নিজের বিষ্ময় তেমন একটা দেখালো না। আশিক অবাক হয়ে বলল,

—“আপনি কি করে জানেন এসব?”

বস হ্যাংরি রহস্যময়ী হাসি দিলো। আঁধার বাকা হেসে বলল,

—“এই সামান্য খবরটা জানাটা খুবই স্বাভাবিক। না জানাটাই হয়তো অস্বাভাবিক মনে হতো। তাই না বস…হ্যাংরি?”

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here