#Mr_Husband,পর্ব_৫৮,পর্ব_৫৮ (বোনাস)
#লেখিকা: আবনী ইবনাত মুন
#পর্ব_৫৮
দুপুরের মধ্য প্রহর। সূর্যের তীব্র উত্তাপ। কখনো মেঘের দেখা তো কখনো শরীর ঝলসানো সূর্যের। রাত গাড়ি নিয়ে এসে অপেক্ষা করছে স্কুলের সামনে। গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে ঘড়ির দিকে দৃষ্টি দিয়ে দেখলো 3:25 বাজে আর পাঁচ মিনিট পরই স্কুল ছুটি হবে। ঠিক পাঁচ মিনিট পরই স্কুল ছুটি হলো। রাতের সামনে দিয়েই এক এক করে সব বাচ্চা বেরিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মিষ্টিকে দেখা যাচ্ছে না। প্রতিদিন তো দৌড়ে হামাগুড়ি দিয়ে সবার আগে বেরিয়ে আসতো আজ কি হলো? আস্তে সব বাচ্চারা টিচার্সরা বেরিয়ে যায় কিন্তু মিষ্টির দেখা পাওয়া যায় না। কিছুক্ষণ পর গেটও বন্ধ করে দেয়। তিশানকেও দেখা যাচ্ছে না। তিশান কি তাহলে আজ স্কুলে আসে নি? আর মিষ্টি? মিষ্টিই বা কোথায় গেলো? রাত চিন্তিত হয়ে পরে। মাথায় হাজারো কথা ঘুরপাক খাচ্ছে। দু মিনিটের মধ্যেই মাথায় প্রচণ্ড হারে ব্যাথা শুরু হয়ে যায়। এরই মধ্যে রাত দেখে রাফি গাড়ি নিয়ে এসেছে। গাড়ি থামিয়ে রাফি রাতের দিকে এগিয়ে আসে। হালকা হেসে বলল,
—“কেমন আছো?”
রাত জোর পূর্বক হেসে বলল,
—“ভালো, তুমি?”
—“আমিও ভালো আছি। আজ একটু দেড়ি হয়ে গেলো। তা কোথায় ওই দুটোয়?”
রাত অবাক হয়ে বলল,
—“তিশান আজ স্কুলে এসেছে?”
—“হ্যাঁ? কিন্তু কেনো জিজ্ঞেস করছো? আর ওরা দুজন কোথায়?”
রাত এবার চিন্তুইত হয়ে বলেই দিলো,
—“আমি স্কুল ছুটি হওয়ার দশ মিনিট আগে এখানে এসেছি। কিন্তু স্কুল ছুটি হওয়ার পর মিষ্টি বা তিশান কাউকেই দেখতে পাইনি।”
—“যদি ওরা স্কুলে না থাকে তাহলে কোথায় আছে?”
—“আমিও সেটাই ভাবছি। কোথায় যেতে পারে? আমি তো মিষ্টিকে স্কুলের সামনে নামিয়ে দিয়েই চলে গিয়ে ছিলাম।”
—“আমিইও তৃশকে স্কুলের সামনে ড্রপ করে ছিলাম। একটা জিনিস তো শিওর ওরা কেউ আজ স্কুলের ভেতরে যায় নি আর না ক্লাস করেছে।”
—“হুম। আমার গাট ফিলিং বলছে, ওরা যেখানেই আছে এক সাথে আছে।”
—“শালিকা জানে এ খবর?”
—“না এখনো জানাই নি। আমাদের ওদের খুজতে বের হওয়া উচিত।”
—“কিন্তু কোথায় খুজবো। ওদের যাওয়ার মতো তেমন কোনো জায়গাও নেই।”
—“আমাদের আগে পার্ক আর গার্ডেন গুলো খুজে দেখা উচিত।”
—“ঠিক আছে চলো।”
রাত আর রাফি নিজেদের গাড়ি নিয়ে ওখান থেকে বেরিয়ে পরলো তিশান আর মিষ্টির খোজে।
.
—“সুপারম্যান জানো তোমাকে আমরা কোথায় কোথায় কত্ত খুজেছি?”
আঁধার এখনো চোখ বড় বড় করে মিষ্টির দিকে তাকিয়ে আছে। আঁধারের মাথা কয়েক মুহূর্তেই এতো এতো প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। আঁধার প্রশ্ন করলো,
—“তুমি এখানে কি করে এলে?”
—“হেটে তারপর ওটো করে।”
—“তোমার সাথে বড় কেউ আসে নি? তুমি একা এসেছো?”
ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো আঁধার,
—“না। আমার সাথে আমার বিগ ব্রাদার এসেছে।”
বিগ ব্রাদার কথা শুনে আঁধার হার্ট ব্রেক করতে করতেও করলো না। নিজেকে সামলে বলল,
—“কোথায় তোমার বিগ ব্রাদার?”
মিষ্টি তিশানকে দেখিয়ে দিলো। তিশান এক সাইডে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। আঁধার চোখ ছোট ছোট করে তিশানকে দেখলো। তারপর রুষ্ট কন্ঠে বলল,
—“ও তোমার বিগ ব্রাদার?”
—“হ্যাঁ তো। তিশু ভাইয়া আমার থেকে বড়, তো হলো না বিগ ব্রাদার?”
—“মিষ্টি বড় বলতে শুধু তোমার থেকে বড় নয়। বড় বলতে প্যারেন্স অথবা গার্ডিয়ান বোঝানো হয়েছে। তোমরা স্কুল থেকে পালিয়ে এসেছো তাই না?”
আলিয়া বলল কথাটা। মিষ্টি চোরের মতো মাথা নাড়ালো। তিশান মিহি গলায় বলল,
—“আমি আঁধরিকাকে বারবার বারণ করছিলাম কিন্তু ও আমার কথা শুনেনি। আরও রাগ দেখিয়ে একা একাই চলে আসছিলো।”
আঁধার শুনলো তিশানের কথা। ছেলেটা শান্ত স্বভাবের। ছোট করে কথা বলে। আর মিষ্টি? তার কথা না বলাই ভালো। আলিয়া মিষ্টির দিকে আড়চোখে তাকিয়ে আঁধারকে উদ্দেশ্য করে বলল,
—“ভাই তুমি তো এই পিচ্চু গুলোর ভাষায় সুপারম্যান। আর সুপারম্যান তো সত হয় ন্যায় পরায়ন হয়। ভালো বাচ্চাদের ভালোবাসে। আর দুষ্টু বাচ্চাদের শাস্তি দেয়। এরা কিন্তু দুষ্টু বাচ্চা ভাই। এরা স্কুলে না গিয়ে ক্লাস বাঙ্ক করে এখানে এসেছে তাই এদের কি শাস্তি দেওয়া যায় বলো তো?”
আঁধার আলিয়ার তালে তাল মিলিয়ে মজা করে বলল,
—“হ্যাঁ একদম ঠিক বলেছিস। এদের শাস্তি দিতে হবে।”
মিষ্টি ইনোসেন্ট ফেস করে ঠোঁটটা গোল করে বলল,
—“মিষ্টি কত্ত কিউট দেখেছো? এতো কিউট বাচ্চাকে কেউ শাস্তি দেয়? শুধু আদর করে বুঝেছো? আর সুপারম্যান আমি তোমার সাথে দেখা করার জন্য স্কুল বাঙ্ক করে এলাম আর তুমিই আমাকে শাস্তি দিতে চাইছো? নোট ফেয়ার! জানো তোমার জন্য আমি কত্ত রিক্স নিয়ে এসেছি? এ্যাংরি বার্ড যদি একবার জানতে পারে তাহলে বিনা ওয়াসিং পাউডারে ধোলাই দিবে। আর পাপাও এবার মিষ্টিকে বাচাতে পারবে না।”
আঁধার অবাক হওয়ার ভান করে বলল,
—“আচ্ছা তাই বুঝি? তা এই এ্যাংরি বার্ডটা কে শুনি?”
—“আমার মাম্মাম।”
আঁধার ভঙ্গিমা করে বলল,
—“তোমার মাম্মাম খুব রাগী বুঝি?”
মিষ্টি চোখ বুঝে বলল,
—“অন্নেক। জানো মাম্মাম একবার রেগে গেলে কেউ শান্ত করতে পারে না। তখন মিষ্টি আর পাপা ভয়ে লুকিয়ে থাকি।”
আঁধার মুখ দিয়ে ‘অ’ টাইপ শব্দ করে বলল,
—“আমার মম’ও তোমার মাম্মামের মতো অনেক রাগী।”
মিষ্টি অবুঝের মতো জিজ্ঞেস করলো
—“তোমার মাম্মামও তোমাকে বকে?”
আঁধার মিষ্টিকে কোলে নিয়ে বলল,
—“আগে বকতো। এখন আমি বড় হয়েছি না তাই আর বেশি বকে না।”
মিষ্টি গাল ফুলিঋএ বলল,
—“সব মাম্মামরাই শুধু বকে আর বকে।”
আঁধর হেসে মিষ্টির গালে চুমু খেয়ে বলল,
—“আর সব ড্যাড্যারাই শুধু আদর করে।”
মিষ্টি আঁধারের মুখে হাত বুলিয়ে সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল,
—“তোমাকে না কিছুটা পাপার মতো দেখতে।”
পাপার কথা মনে পরতেই তিশান তাড়া দিয়ে বলল,
—“আঁধরিকা অনেক বেশি দেড়ি হয়ে যাচ্ছে। আঙ্কেল আর বাবা হয় তো স্কুলে গিয়ে আমাদের খুজে না পেয়ে টেনশন করছে। তোমার সুপারম্যনের সাথে দেখা হলে চলো এবার। তোমার জন্য আজ আমিও মায়ের কাছে বকা খাবো।”
মিষ্টি নাকচ করে বলল,
—“দেরী তো হয়েছেই তাহলে আরো কিছুক্ষণ থাকি। বকা এমনিও খাবো ওমনিও খাবো। সুপারম্যান তুমি আমার পাপাকে ফোন করে বলে দেও আমি তোমার কাছে আছি।”
আলিয়াও সায় দিয়ে বলল,
—“হ্যাঁ ভাই তাই করো। মিষ্টি আজ আমাদের সাথেই সময় কাটাক।”
আঁধারও চায় নিজের মেয়ের সাথে সময় কাটাতে। দুষ্টুমি খুনসুটি করতে। মিষ্টি আঁধারকে রাতের মোবাইল নাম্বার দিলো। আঁধার নিজের ফোনে নাম্বারটা ডায়াল করে কল লাগালো রাতের ফোনে। প্রথম বার রিং বাজতে বাজতে কেটে গেল। আঁধার আবার ট্রাই করলো এবার সাথে সাথেই রিসিভ হলো। ওপাশ থেকে রাত বলে উঠলো,
—“হ্যালো কে?
আঁধার মিষ্টিকে দিলো। মিষ্টি ফোন নিয়ে সোফায় পা উঠিয়ে বসে বলল,
—“হ্যালো পাপা! আমি মিষ্টি বলছি।”
রাত অবাক হয়ে কান থেকে ফোন নামিয়ে একবার স্কিনে তাকালো। তারপর আবার ফোন কানে দিয়ে অবাক কন্ঠেই বলল,
—“প্রিন্সেস! প্রিন্সেস কোথায় তুমি?”
—“পাপা আমি হসপিটালে।”
রাত চমকে উঠে হসপিটালের নাম শুনে। কলিজার পানি শুকিয়ে যায়। উতলা হয়ে বলল,
—“প্রিন্সেস কি হয়েছে তোমার? কোন হসপিটাল পাপাকে বলো পাপা এক্ষুনি আসছি। তুমি ভয় পেও না প্রিন্সেস।”
মিষ্টি বিরক্তিতে মুখ দিয়ে ‘চ’ এর মতো শব্দ করে বলল,
—“আমার কিছু হয়নি পাপা। আমি ঠিক আছি। তুমি ভয় পেও না। আমি হসপিটালে সুপারম্যানের কাছে আছি।”
রাত গাড়ি ব্রেক করে বলল,
—“সুপারম্যাম?”
—“ওফ ফো! পাপা, এতো তাড়াতাড়ি ভুলে গেলে? ট্যারিরিস্ট এ্যাটার্ক এর সময় ওই দুষ্টু লোক গুলোকে যে ডিশুম ডিশুম মারলো সে’ই তো সুপারম্যান।”
রাত এবার একটু রেগে গেল। একটু জোরেই বলল,
—“মিষ্টি তুমি স্কুলে না গিয়ে একা একা হসপিটালে চলে গেছো! তোমার মাম্মাম যদি জানতে পারে তাহলে কি হবে তুমি বুঝতে পারছো। আমি তোমাকে স্কুলে না দেখে কত টেনশনে ছিলাম তোমার কোনো ধারণা আছে। যদি তোমার কিছু হয়ে যেত তাহলে? তাহলে আমি আর তোমার মাম্মাম কি করতাম।”
মিষ্টি কাদো কাদো হয়ে বলল,
—“পাপা বকো না। মিষ্টির কান্না পায়।”
রাত থামলো। জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করলো। তারপর বলল,
—“আমি এক্ষুনি নিতে আসছি।”
মিষ্টি চেচিয়ে বলে উঠলো,
—“নো পাপা। আমি একটু আগেই এখানে এসেছি। আমি আরো কিছুক্ষণ থাকবো।”
—“মিষ্টি তোমার মাম্মামকে কি বলবো? ইউ নো না সি ইজ সো এ্যাংরি।”
মিষ্টি হেসে বলল,
—“চিল পিল পাপা! তুমি বাসায় গিয়ে মাম্মামকে বলে দিবে আমি তিশু ভাইয়ার সাথে তাদের বাড়িতে চলে গেছি।”
রাত সন্দিহান গলায় বলল,
—“তিশান আর তুমি এক সাথে আছো?”
—“হ্যাঁ। তুমি হ্যান্ডসামকেও বলে দিও।”
রাতের আর কি কার? মিষ্টি যেখানে একবার বলেছে সেকানে কোনো ভাবেই ওকে মানানো সম্ভব না। খুব জেদী মেয়েটা। রাত নরম গলায় বলল,
—“ওকে। নিজের খেয়াল রেখো। আমি সন্ধ্যায় এসে তোমাকে নিয়ে যাবো। তোমার সুপার ম্যানের কাছে দেও।”
মিষ্টি আঁধারকে দিলো ফোনটা। আঁধার বলল,
—“হ্যালো।”
রাত আবেগী গলায় বলল,
—“খেয়াল রেখো আমার প্রিন্সেসের। অনেক বেশি জেদী আমার প্রিন্সেসটা।”
আঁধার হেসে বলল,
—“একদম ওর মাম্মামের মতো।”
—“ঠিক। ওর মাম্মামও অনেক জেদী।”
—“ডোন্ট ওয়ারি। আমি আমার মেয়ের খেয়াল তো অবশ্যই রাখবো।”
আঁধার বাকা হেসে বলল। রাত বুঝলো না। কিন্তু মাথাও ঘামালো না। আঁধার ফোন কেটে দিলো। আজ প্রথম নিজের মেয়ের সাথে সময় কাটাবে। ঘুরবে, শপিং করবে খাওয়া দাওয়া করবে। দিনটা স্মৃতির পাতায় গেথে রাখবে।
#চলবে,
#Mr_Husband
#লেখিকা: আবনী ইবনাত মুন
#পর্ব_৫৮ (বোনাস)
ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পরছে। মানুষ জন বৃষ্টি থেকে বাচার জন্য এদিক ওদিক ছুটাছুটি করছে। কিন্তু দুজন মানুষের যেন বৃষ্টি থেকে বাচার কোনো তাগিদ নেই। তাদের মধ্যে চলছে মান অভিমানের পালা। কিছু নিয়ে দুজনের মধ্যে কথা কাটাকাটি হচ্ছে। ধীরে ধীরে মুখ দুটো পরিস্কার হতে থাকে। ওই দুটো মুন আর আঁধার। এক পর্যায়ে মুন রাগ করে সামনে জোরে জোরে হাটতে লাগলো। আঁধার কয়েক মুহূর্তে দাঁড়িয়ে থেকে নিজের রাগকে কন্ট্রোল করে মুনের পেছনে পেছনে দৌড়াতে লাগলো। মুনকে দূর থেকে ডেকে যাচ্ছে। মুন অভিমানে ফিরছে না আরও হাটার গতি বারিয়ে দিলো। পেছন থেকে আঁধারের ডাক ভেসে আসতে আসতে হঠাৎ থেমে গেল। মুন কি মনে করে যেন পেছনে ফিরলো দেখলো আঁধার দাঁড়িয়ে আছে। মুন আঁধারের মুখের থেকে চোখ সরিয়ে ধীরে ধীরে নিচে দিকে তাকালো। সুঠাম দেহে সাদা রঙের শার্টটা ফিট হয়ে লেগে আছে। বুকের উপরের দুটো বোতাম খোলা আর, আর বুকের বা দিকটা লাল রঙে রাঙিয়ে উঠেছে। যা বৃষ্টির পানির সাথে সারা শার্টকে রাঙিয়ে তুলছে। এ রঙের উৎপত্তি কোথা থেকে? মুন চাতক পাখির মতো আঁধার চোখের দিকে তাকালো। ওই নীলাভ চোখ দুটি জলে ভাসছে। সচ্ছ কাচের মতো ওই চোখের ভাষা স্পশ্ট বুঝতে পারছে মুন। এক আকাশ সমান অভিমান, এক সাগর সমুদ্র আর এক জীবনের তৃষ্ণা স্পস্ট দেখতে পাচ্ছে মুন। হঠাৎ মুন নিজের গালে গরম পানির আভাস পেলো। মুন আঁধারের দিকে এক পা বাড়াতেই মুনের চোখের সামনে বাম দিক থেকে ফুল স্প্রিডে একটা গাড়ি এসে জোড়ে আঁধারকে ধাক্কা মেরে চলে গেলো। আঁধার ছিটকে গিয়ে দূরে পরলো। যার কারণে পিচ ঢালাই করা রাস্তাতে ডান পাশের গাল ছিলে থেতলে যায়। মাথা ফেটে ফিকনি দিয়ে রক্ত পরে। চোখের কোনা ফেটেও রক্তের জমাট বেধে গেছে। আগের থেকে বৃষ্টির গতি বেরেছে। বৃষ্টির প্রতিটা ফোটা আঁধারের রক্তের সাথে মিশে যাচ্ছে। বিষ্টির পানিতে রক্ত ধুয়ে যাচ্ছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে রাস্তাময়। ঘটনাটা এতো দ্রুতো ঘটলো মুনের বুঝে উঠতে একটু সময় লাগলো। মুন জোরে চিৎকার করে উঠলো,
—“আঁধাআআআআআর”
মুন কোনো কিছু না দেখে কোনো বাধা না মেনে দৌড়ে গেলো আঁধারের কাছে। চোখ দুটো লেগে আছে। মুন ধপ করে নিচে বসে পরলো আঁধারের মাথাটা খুব যত্নে নিজের কোলে নিলো। ডান গালের বীভৎস অবস্থা। মুন কাপাকাপা হাতে গালটা ছুয়ে দিলো। কি হয়ে গেলো? কি থেকে কি হয়ে গেলো? কেনো হলো এমন? এমনটা না হলেও পারতো। আঁধারের এই নির্মম পরিনতি মুন মানতে পারছেনা। তীব্র যন্ত্রণায় বুক চিড়ে চিৎকার বেরিয়ে আসতে চাইছে। মুন আঁধার ফ্যাকাশে অধরে নিজের অধর ছোঁয়ালো। তারপর ডুকরে কেদেঁ উঠলো। আঁধারের মুখটা বুকের সাথে চেপে ধরে ‘আঁধার’ বলে গগন কাপানী চিৎকার দিয়ে উঠলো। আকাশের গিকে তাকিয়ে গলা ফাটি বলতে লাগলো,
—“কেনো? কেনো? করলেন এমন। কি ক্ষতি করে ছিলাম আপনার? মানছি আমাদের মাঝে ভুল বোঝাবুঝি, মান-অভিমান চলছে। হ্যাঁ ঘৃণা করতাম ওনাকে! আবার ভালোও তো আমিই বাসতাম। কিন্তু কখনো ওনার জন্য বদ-দোয়া করনি আপনার কাছে। কখনো ওনার খারাপ চাইনি। সব সময় চেয়েছি উনি ভালো থাকুক, সুস্থ থাকুক, হাসি-খুশি থাকুক। তাহলে? তাহলে কেনো করলেন এরকম। উনিই বা আপনার কি ক্ষতি করেছিলো? উনি যাদের মেরেছে তারাও সাধু ছিলো না। তাহলে কিসের শাস্তি দিলেন? বলুন? চুপ করে আছেন কেনো? জবাব দিন?”
আকাশের থেকে বড় বড় মেগের গর্জন ছাড়া আর কিছু শোনা গেলো না। মুন আঁধার মাথাটা বুক থেকে সরালো তার গালে হাত দিয়ে অভিমানী কন্ঠে বলল,
—“এভাবে একা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন? আমি কি নিয়ে বাচবো? এখন তো ঘৃণা নিও বেচে থাকতে পারবো না। তার উপায়ও আপনি রাখেন নি। এভাবে অপরাধি বানিয়ে চলে যাবেন? প্লিজ উঠুন, উঠে আমাকে খুব করে বকুন, ধমকান, আমার উপর রাগ দেখান তবুও চলে যাবেন না প্লিজ। আমি প্রমিজ করছি আমি একটা কথাও বলবো না। ঠোঁটে আঙ্গুল দিয়ে চুপচাপ বসে আপনার বকা খাবো। আগের মতো কান ধরে এক পায়ও দাঁড়িয়ে থাকবো। তবুও প্লিজ আমাকে একা ছেড়ে যাবেন না। আমি বাচতে পারবো না। আপনাকে ছাড়া এক মুহূর্তও বেচে থাকা কঠিন। এই দেখুন এখনি শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। আমি, আমি ঠিক করে শ্বাস নিতে পারছিনা। এই ডক্টর! উঠুন! দেখুন, আমার কি হয়েছে আমি শ্বাস কেনো নিতে পারছিনা। বুকের বা পাশে এতো ব্যাথা করছে কেনো? এই ডক্টর! আমার কষ্ট হচ্ছে খুব! আপনি শুনতে পাচ্ছেন? আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আমি মরে যাচ্ছি।”
আঁধারের নিথর দেহটা ধাক্কাতে ধাক্কাতে মুন পাগলের মতো করছে আর প্রলেপ গাইছে। মুন এবার বেশি উত্তেজিত হয়ে পরলো। চেচিয়ে বলতে লাগলো,
—“আপনি উঠছেন না কেনো? আমি বলছি তো আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। এই ডক্টর প্লিজ উঠুন না। আপনি যা বলবেন আমি তাই করবো। আর আপনার সাথে রাগ করবো না। আপনি যা শাস্তি দিবেন মাথা পেতে নিবো তবুও আমাকে ছেড়ে যাবেন না। কারণ আমি আপনাকে একটুও ভালোবাসি না। আপনি আমার মি.হাসবেন্ডে তাই আপনাকে আমার কথা শুনতে হবে। আমি বলছি উঠতে তাই আপনি এখন উঠে দাঁড়াবেন।”
মুনের হাত আঁধারের নাকের কাছে লাগলো। মুন অনুভব করলো আঁধার শ্বাস নিচ্ছে না। আর শরীরও ঠান্ডা বরফ হয়ে গেছে। মুন পাগলের মতো এলোমেলো কন্ঠে চেচিয়ে বলল,
—“মি.হাসবেন্ড, আপনি আপনি শ্বাস নিচ্ছেন না কেনো? এ চোখ খুলুন? আমার দিকে তাকান। আমার সাথে কথা বলুন। আমি আপনাকে ডাকছি আপনি শুনতে পাচ্চেন না? মি.হাসবেন্ড আমার রাগ লাগছে খুব। আপনি আমার কথা শুনছেন না কেনো? আমার গলা জ্বালা করছে। আমার চোখ পোরাচ্ছে। বুকের মধ্যে চিলিক দিয়ে উঠছে। খুব ব্যাথা করছে। আমার প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছে। আপনি দেখতে পাচ্ছেন না আমার কষ্টটা? আমি সহ্য করতে পারছি না। আমি সহ্য করতে পারছি না। আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। আঁধার প্লিজ উঠুন, আঁধার। আপনি আমাকে ছেড়ে যেতে পারেন আপনি আমার সাথে এমন করতে পারেরন না। নো, নো, আঁধার ডোন্ট গো। আঁধার ডোন্ট গো। আঁধাআআআআআর”
~
—“আঁধাআআআর”
চিৎকার করে ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠলো মুন। শরীরের সাথে পরনের টিশার্টটাও ঘামে পুরো ভিজে গেছে। এসি চলা সত্বেও এই অবস্থা। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। কোথাও এক বিন্দু পানিও অবশিষ্ট নেই। মুন বেড টেবিল থেকে পানির গ্লাসটা নিয়ে গকগক করে এক চুকে সম্পূর্ণ পানি শেষ করে দিলো। গ্লাসটা আবার জায়গা মতো রেখে ঠায় বসে রইলো। কি ভয়ংকর স্বপ্ন ছিলো। মুন আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করছে এটা স্বপ্ন বলে। মুন তাড়াতাড়ি উঠে অজু করে নামাজে দাঁড়িয়ে গেলো। এরকম স্বপ্ন দেখার পর কিছুতেই শান্ত হতে পারছে না। তাই দু রাকাত নফল নামাজ পরে শুধু এটাই দোয়া করবে যেন এই স্বপ্নটা শুধু মাত্র একটা দুরস্বপ্নই রয়ে যায়।
.
আঁধার ঘুম আছে। পরনে শুধু একটা টাউজার।
হঠাৎ দরজা ফাক করে কেউ রুমে উকি দিলো। আঁধারকে ঘুমতে দেখে পা টিপে টিপে রুমের ভেতরে ঢুকলো। তারপর কোনো শব্দ না করে বেডে উপর উঠলো আস্তে করে কানের কাছে দিয়ে আচমকা জোরে চেচাতে লাগলো। আঁধার ধড়ফরিয়ে উঠলো। মেয়েটা শব্দ করে হাসতে লাগলো। এমন করে ঘুম ভাঙানোর কারণে মেজাজ তেতে উঠলো আঁধার। এক রাম ধমক দিয়ে বলল,
—“সকাল সকাল কি শুরু করেছিস রাই? ঘুমাতেও দিবিনা? যবে থেকে এসেছিস তোর জ্বালায় না খেতে পারছি না শান্তিতে ঘুমাতে পারছি। নিশ্বাসটাও ঠিক করে নিতে দিচ্ছিস না।”
রাই কোমরে দু হাত রেখে বলল,
—“দিবো কেনো? বলো দিবো কেনো? আজ আমাদের এংগেজমেন্ট আর তুমি বেলা দশটা পর্যন্ত পরে পরে ঘুমাচ্ছো? তোমাকে আমি জ্বালিয়ে কয়লা করে দিবো। আগে তো সেই ভোর উঠতে আর এই আমাকে জ্ঞান দিতে। এখন কি হলো। তাড়াতাড়ি উঠো আর গিয়ে ফ্রেশ হও আমি এখানেই বসে আছি।”
আঁধার বিরক্তিতে ‘চ’ এর মতো শব্দ করলো। এমনিতেই সরা রাত জেগে কাজ করে চারটার দিকে ঘুমিয়েছে তারপর আবার এই আপদ এসে সকাল সকাল উদয় হয়েছে। কিছু বলতেও পারছে না। কারণ প্রয়োজনের সময় গাধাকেও বাপ ডাকতে হয়। আঁধার টাওয়াল নিয়ে ওয়াশ রুমের দিকে পা বারাতে গিয়েও বারালো না রাই’র কথা শুনে।
—“তোমার বউ আসবে তো?”
আঁধার পেছনে না ঘুরেই বলল,
—“তাকে তো আসতেই হবে। সে না আসলে এংগেজমেন্ট কি করে হবে? আফটার ওল তার মি.হাসবেন্ডের এংগেজমেন্ট।”
বলেই আঁধার ওয়াশ রুমে ঢুকে গেলো। এক মাস পুরো এক মাস ধরে অনেক চেষ্টে করেছে মুনকে কনভেন্স করানোর কিন্তু মুন কিছুতেই রাজি হলো না। আঁধার এভাবে আর চলতে দিতে চায় না। তাই সিদ্ধান্ত নিলো বিয়ে করবে। এবং যেই ভাবা সেই কাজ। আঁধার আরিফা রেজওয়ানকে জানালে সে কোনো আপত্তি করলো না। মেয়ে দেখতে লাগলো। একদিন আঁধার এসে বলল সে রাইকে বিয়ে করবে। রাই আরমান রেজওয়ানের চাচাতো ভাইয়ের মেয়ে। খুই চঞ্চল দুষ্টু প্রকৃতির। দেখতেও ভালো। ‘ল’ পড়ছে। এতেও কেউ আপত্তি জানালো না শুধু আলিয়া ছাড়া। প্রথমে ঘোর আপত্তি জানালেও হঠাৎ করে আবার হাসি মুখে মেনে নিলো। আর গত এক মাসে মিষ্টির সঙ্গে আঁধারের বন্ডিংটা খুব ভালো হয়েছে। মিষ্টি এখন সুপারম্যান বলতে পাগল। দুদিন পরপর ঘুরতে যাওয়া, আইসক্রিম চকলেট খাওয়া, জোক্স বলা, সার্কাস দেখা এগুলো যেন অংশ হয়ে গেছে আঁধারের লাইফের। মিষ্টি রেজওয়ান মেনশনেও অনেক বার এসেছে। তখন আরিফা রেজওয়ান আরমান রেজওয়ান মাথায় করে নেচেছে বলতে গেলে। মিষ্টি যতখন থাকে ওর খিলখিল হাসিতে পুরো বাড়ি মাতিয়ে উঠে। মিষ্টিকে দেখলে ওনারাও বাচ্চা হয়ে যায়। মিষ্টিও খুব সুন্দ মিশে সবার সাথে। মুন প্রথমে জানতো না। কিন্তু পরে জানতে পরে মিষ্টি আর রাত দুজনের সাথেই রাগ করে কথা বন্ধ করে দেয়। এর থেকে বেশি কি’ই বা করতে পারে? আঁধার ওর বাবা এটা তো আর অস্বীকার করতে পারেনা। আর রেজওয়ান ম্যানশন ওর বাড়ি। আরমান রেজওয়ান আর আরিফা রেজওয়ান ওর দাদা-দিদুন। আর আলিয়া ওর ফিপ্পি। এগুলোর কিছুই মুন অস্বীকার করতে পারে না। আর মিথ্যা প্রমাণও করতে পারে না। আর না মিষ্টিকে আটকাতে পারে। তাই কারো উপর রাগ না দেখাতে পরে নিজের উপরই রাগ ঝাড়ে। আঁধার যখন বলেছে সে আবার বিয়ে করবে তখন মুনের মনে হচ্ছিলো কেউ ছুড়ি দিয়ে তীব্র ভাবে ওর বুকে আঘাত করেছে। আসলে ওই কথাটাই ধারালো ছুড়ির মতো ছিলো যা ঠিক মুনের বুকে গিয়ে প্রচণ্ড বেগে লেগেছে। আঁধার এটাও বলেছে ওর বিয়ের প্রতিটা ফাংশনে মুনকে উপস্তিত থাকতে হবে। আর ওর বিয়েতে সব কাজ হাতে হাতে করতে হবে। আঁধার তারপর ভ্রু নাচায়ে জিজ্ঞেস করে ছিলো ওকে,
—“এই খবর শুনে তুমি খুশিতো মিসেস ওয়াইফি?”
মুন বুকে পাথর রেখে মুচকি হেসে জবাবে বলে ছিলো,
—“আপনি ভাবতেও পারবেন না যে আমি কতটা খুশি। এই খবরটা শুনে আমার থেকে বেশি খুশি হয় তো কেউ হয়নি। আমি অবশ্যই আপনার বিয়েতে থাকবো। নিজ দায়িত্বে সব কাজ করবো। আপনি কিচ্ছু চিন্তা করবেন না। আমি তো খুব নাচবোও আপনার বিয়েতে।”
আঁধার বাকা হেসে শুধু এটুকু বলে ছিলো,
—“দেখা যাক।
#চলবে,