Mr_Husband,পর্ব_৫৯,৬০

0
3776

#Mr_Husband,পর্ব_৫৯,৬০
#লেখিকা: আবনী ইবনাত মুন
#পর্ব_৫৯

শীতের শুরু হয়েছে সপ্তাহ খানেক হবে। খুব দ্রুত দিন ফুরিয়ে যায়। সময়ের সাথে ঠিক তাল মিলিয়ে চলা যায় না। কিছুক্ষণ আগেই মাগরিবের আযান দিয়েছে। অন্ধকার বেশি না হলেও কুয়াশার কারণে ঘন কালো অন্ধকার মনে হচ্ছে চারদিকে। এর মাঝে রেজওয়ান ম্যানশন সেজে উঠেছে ঝলমলে নিয়ন আলোয়। সাদা সাদা ফেইরি লাইটে ঘিরে রেখেছে পুরো বাড়িটাকে। মেইট গেট থেকে বাড়ি পর্যন্ত রেড কার্পেট বিছানো হয়ে। বাড়ির ভেতর টা পিংক অরপ হোয়াইট কালারে ডেকোরেট করা হয়েছে। যেমন: বেলুন, পর্দা, ও ফুল। মুন নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সব ডেকোরেট করছে। সেই সকাল থেকে এক টানা দৌড়াদৌড়ি করে চলেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই গেস্ট আশা শুরু করে দিবে। মুন একটা হলুদ রঙের স্কার্ট আর লাল রঙের টপ পরে আছে। সকালে চুল গুলো কাঠি দিয়ে পেচিয়ে রেখেছিল এখনো সেরকমই আছে। ছুটাছুটিতে আশপাশ দিয়ে কতেক চুল বেরিয়ে গেছে। নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘামের রেশ। মুন চারপাশ আরেকবার ভালো করে চক্কর দিয়ে দেখলো। সবই ঠিক আছে। লোকজন আশা শুরু করার আগে গিয়ে রেডি হতে হবে আর মিষ্টিকেও রেডি করতে হবে। মিষ্টি এখন আঁধারের সাথেই আছে। আঁধারকে একবার পেলে যেন ওর আর কিছু লাগে না। মাম্মামকেও ভুলে যায়। মেয়েটা যে বাপের পাগল হয়েছে সেটা আগে থেকেই জানা। এর থেকে ছেলে হলে ভালো হতো তাও পাগল তো হতো। সারাক্ষণ লেপটে থাকে আঁধারের সাথে। আরিফা রেজওয়ান আর রাই’র মা রান্নার কাজ দেখছে। বেশি মানুষ আসবে না। শুধু আত্মীয়রা আর কিছু বন্ধু ও কলিগ আসবে। তবুও কম না। এরই মধ্যে ইসীরাও এসে পরলো। ওরা বিকেল পর্যন্ত ছিলো মুনের সাথে। ওরাও মুনকে সাহায্য করেছে অনেক। ইসী এসে দেখলো মুন এখনো রেডি হয়নি। তা দেখে বলল,

—“মুন তুমি এখনো এই অবস্থায়! রেডি হওনি কেনো? আর রাই? রাই রেডি হয়েছে?”

মুন মৃদু হেসে বলল,

—“ওই একটু কাজ ছিলো তাই রিডি হওয়ার সময় পাইনি। রাই হয়তো রেডি হচ্ছে নিজের রুমে।”

—“ঠিক আছে তুমি গিয়ে রেডি হও। আমি রাইকে দেখছি।”

ইসী রাই’র কাছে গেলো। মুনও উপরে চলে গেলো। মুন আঁধারের রুমের সামনে এসে থামলো। যে রুমটা একসময় ওর’ও ছিলো। মুন ভাবতে লাগলো ভেতরে যাবে কিনা! অনেকক্ষন ভেবে দরজায় নক করলো। দরজা আগে থেকেই খোলা ছিল আঁধার ভেতর থেকে বলল,

—“নক করার কি আছে? চলে এসো, এটা তো তোমার রুমই।”

মুন ভেতরে ঢুকতেই আঁধার বলল,

—“ওহ, তুমি? আমি ভাব ছিলাম রাই!”

তারপর মেকি হাসলো। মুন কিছু বলল না। ভেতরে ভেতরে রাগ লাগলো। আঁধার শুয়ে আছে আর আঁধারের গালের উপর গাল রেখে শুয়ে আছে মিষ্টি। মিষ্টি আঁধার কার সাথে কথা বলছে দেখার জন্য মাথা উঠালো। মুনকে দেখে বলল,

—“মাম্মাম, পাপা কখন আসবে?”

মুন ছোট্ট করে বলল,

—“কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবে। চলো তোমাকে রেডি করে দি।”

মিষ্টি উঠে ঠিক করে বসে বলল,

—“আজ তুমি রেডি করে দিবে না।”

মুন ভ্রু কুঁচকে বলল,

—“তাহলে কে রেডি করে দিবে?”

মিষ্টি আঁধারের গলা জড়িয়ে ধরে একটা ভয়ংকর বাক্য উচ্চারণ করলো। বাক্যটা শুনে মুন কেপে উঠলো। মিষ্টি বলল,

—“আমার ড্যাডা।”

আঁধার বাকা হাসলো। মুন কম্পিত স্বরে উচ্চারণ করলো,

—“ড্যাডা!”

—“হ্যাঁ, এটাই তো আমার ড্যাডা, তাই না সুপার ড্যাডা?”

আঁধার মিষ্টিকে টাইটলি হাগ করে বলল,

—“ইয়েস মাই লিটল এঞ্জেল।”

মিষ্টি মুনের কাছে এসে বলল,

—“মাম্মাম ইউ নো হোয়াট? সুপারম্যান হ্যাভ এ ডটার, লাইক মি! বাট ওর পচা মাম্মাম সুপারম্যানকে রেখে ওকে নিয়ে অনেক দূরে চলে গেছে। সুপারম্যানের অনেক কষ্ট হয় তার মেয়ের জন্য! তাই আমি বলেছি আমি আজ থেকে সুপারম্যানেরও মেয়ে। আমি তাকে ‘ড্যাডা’ বলে ডাকবো। ইয়ে এখন মিষ্টির দুইটা বাবা। একটা পাপা, একটা ড্যাডা।”

বলে মিষ্টি বেডের উপর লাফাতে লাগলো। আঁধার একবার মুনকে দেখে নিলো তারপর সোজা ড্রেসিং টেবিলের কছে চলে গেল। ওখান থেকেই মিষ্টিকে উদ্দেশ্য করে বলল,

—“লিটল এঞ্জেল যাও তোমার ড্রস নিয়ে এসো আজ ড্যাডা তোমাকে রেডি কে দিবে। মিষ্টি খুশিতে আত্ম হারা হয়ে দৌড়ে বেরিয়ে গেল। আঁধার এক পা এক পা করে মুনের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো। মুন ভ্রু কুঁচকে তাকালো। যখন দেখলো আঁধর ধীরে ধীরে ওর একদম কাছে চলে আসছে তখন পিছাতে লাগলো। একসময় দেয়ালের সাথে পিঠ ঠেকে গেলো। আঁধার মুনের থেকে এক হাতের দূরত্বে। মুন ঘাবড়ালেও সেটা দেখালো না। আরো রাগি গলায় বলতে লাগলো,

—“কি করছে? আপনার মতলব কি? এতো কাছে কেনো আসছেন। দেখুন আমার সাথে উল্টো পাল্টা কিছু করার চেষ্টা করে একদম মেরে দিবো।”

আঁধার নিজেদের মধ্যের দুরত্বে একবারে কমিয়ে দিলো। আঁধারের গরম নিশ্বাস আছড়ে পরছে মুনের পুরো মুখ মন্ডলে এসে পরছে। এতে মুনেরও শ্বাস প্রশ্বাস বেড়ে গেছে। আঁধার মুনের মুখের দিকে একটু ঝুকতেই মুন নিজের দু হাত দিয়ে ঠোঁট ঢেকে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে কাপতে লাগলো। আঁধার মুনের মুখ থেকে হাত সরিয়ে নিজের হাতের মধ্যে আবদ্ধ করলো। মুন তোতলিয়ে বলল,

—“আপনি ঠিক করছেন না কিন্তু। আমি কিন্তু চিৎকার করবো।”

আঁধার নেশালো কন্ঠে বলল,

—“তো করো, কে বারণ করেছে?”

মুন সত্যি চিৎকার করতে যায় কিন্তু গলা থেকে একটা আওয়াজও বের হয় না। মুন করুণ চোখে আঁধারের দিকে তাকায় আঁধার আরো একটু এগি আসতে নিবে এমন সময় রাই’র কঠিক গলার আওয়াজ পাওয়া যায়।

—“এখানে কি হচ্ছে?”

আঁধার মুনকে ছেড়ে বেডে এসে বসে আর এমন ভাব করে যেন কিছু হয়’ই নি। মুনের মুখটা একদম চুপসে গেছে। রাই রুমের ভেতরে প্রবেশ করে। বুকে হাত বেধে তীক্ষ্ণ চোখে দুজনকে পর্যবেক্ষণ করে। রাই দগ্ধ কন্ঠে বলল,

—“মুন তুমি এ রুমে কি করছো?”

মুন কি বলবে বুঝতে পারছে না। মিষ্টিকে নিতে এসেছে যে বলবে তা বিশ্বাস নাও করতে পারে কারণ মিষ্টি তো ড্রেস আনতে গেছে। তাই বলল,

—“উনি রেডি হয়েছে কিনা দেখতে এসে ছিলাম।”

—“দেখা হয়ে গেছে? তাহলে এখন আসতে পারো। আমাদের একটু প্রাইভিসি দরকার।”

মুন চোখ দুটো জলে টলমল করতে লাগলো। মুন অনেক কষ্টে নিজের চোখের জল আটকালো। তারপার মাথা নেড়ে দ্রুত পায়ে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো। সেদিকে তাকিয়ে আঁধার মুচকি হাসলো। রাই রাগী চোখে আঁধারের দিকে তাকালো পরক্ষণেই দুজনে এক সাথে শব্দ করে হেসে দিলো। রাই হাসি থামিয়ে বলল,

—“কাজ হয়ে গেছে না?”

আঁধার কিছু বলল না বাকা হাসলো। রাই খুশিতে উৎফুল্ল হয়ে এসে আঁধারকে জড়িয়ে ধরে গালে জোরে একটা চুমু দিলো। আঁধার রাইকে দু হাতে দূরে ঠেলে নাক ছিটকালো। তা দেখে রাই হাসিতে ফেটে পড়লো।

—“তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নিচে এসো। আজ আমাদের এংগেজমেন্ট বলে কথা লেট হও না যেন।”

বলতে বলতে বেরিয়ে গেলো। মুন রুমে এসে ওয়াশ রুমে ঢুকে গেল। শাওয়ার ছেড়ে নিচে বসে পরলো। খুব বেশি কষ্ট হচ্ছে ওর। একটু আগে দেখা দৃশ্যটা বার বার চোখে ভাসছে। রাই আঁধারকে জড়িয়ে ধরে কিস করছে দৃশ্যটা দেখা মুনের জন্য কতটা কষ্ট কর মুন বলে বুঝাতে পারবে না। যত যা’ই বলুক না কেনো ভালো তো আজও বাসে ওই রাক্ষসটাকে। কি করে সহ্য করবে মুন? মুন কান্না করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পরে। পার্ট মনে নহয় এতোক্ষণে শুরু হয়ে গেছে। মুন চোখ মুছে উঠে ভালো করে শাওয়ার নিয়ে বের হয়। কফি কালারের উপরে রেড স্টোনের কাজ করা একটা লং গাউন পরে হালকা মেকআপ আর অর্নামেন্টস পরে রেডি হয়ে নিজেকে মনে মনে শক্ত ও প্রস্তুত করে রুম থেকে বের হয়।

#চলবে,

#Mr_Husband
#লেখিকা: আবনী ইবনাত মুন
#অন্তিম_(১ম খন্ড)
#পর্ব_৬০

মুন নিচে এসে দেখলো ইতিমধ্যে হলরুম ভরে গেছে মানুষে। ধীরে ধীরে মানুষের কোলাহল বারছে। সবাই একে অপরের সাথে ভাব বিনিময়ে ব্যস্ত। মুন নিশ্চুপ এক কোণে দাঁড়িয়ে আনমনে কিছু একটু ভাবছিলো তখন হঠাৎ কারো গলার আওয়াজ শুনে কল্পনার জগত থেকে বাইরে বের হয়ে আসে।

—“তুমি সত্যি খুব বোকা মুন! আসল সোনা আর লোহার মধ্যে পার্থক্য তুমি বুঝলে না। কিন্তু শুধু একটা কথাই বলব, এখনো সময় আছো আটকাও এসব নিজের জায়গাটা এভাবে ছেড়ে দিও না। খুব বড় ভুল করছো। পস্তাতে তোমাকে হবেই।”

মুন ঘুরে তাকালো ইসীর দিকে। তারপর চোখ-মুখ শক্ত করে তীক্ষ্ণ স্বরে বলল,

—“ভুল আমি নয় তোমরা করছো। আমি এটাই বুঝতে পারছি না যে তুমি মেয়ে হয়ে কি করে উনাদের সাথে যুক্ত হতে পারো?”

মুনের কথা ঠিক বোধ গম্য হলো না ইসীর।

—“মানে? কি বলতে চাও সোজাসুজি বলো।”

—“শিশু পাচার, নারী পাচার, অস্ত্র পাচার, ড্রাগ সাপ্লাই, ব্লাক মানি ইত্যাদি আরো কত কি! এগুলোই তো তোমাদের মাফিয়াদের কাজ তাই না? কি করে করতে পারো তোমরা এসব? বন্ধুর মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে গিয়ে নিজেদের এতোটা নিচে নামিয়েছ! তোমাদের আর কি বলব আমার স্বামী নামে পরিচিত মানুষটিই তো এসবের মূল।”

ইসী মুনের হাত ধরে টেনে আনলো একটা রুমে। এক প্রকার ঝাড়া দিয়ে ওর হাত ছেড়ে দিলো তারপর চাপা দর্জন করে বলল,

—“তোমার মতো ত্যাড়া আর জেদি মেয়ে আজ পর্যন্ত দেখিনি। তোমাকে এই পর্যন্ত সবাই বোঝানোর চেষ্টা করেছে কিন্তু তুমি কারো কথা বোঝা তো দূর শোনার চেষ্টা পর্যন্ত করো নি। তুমি কি একবার ওকে সুযোগ দিয়েছো কিছু বলার? না দেও নি। তোমার কাছে ও এতোই যখন খারাপ মানুষ তাহলে শোনো, আরুশের জন্য আঁধারের এই কালো জগতে পা দেওয়া। খারাপকে শেষ করতে গেলে আগে নিজেকে খারাপ হতে হয়। আর তাই করেছে আঁধার। নিজে অন্ধকারে তলিয়ে গিয়ে অন্যদের নিজের আলো দিয়েছে ও। তুমি একটু আগে বললে না? শিশু পাচার, নারী পাচার, ড্রাগ সাপ্লাই এগলো যারা জন্ম দেয় তাদের শেষ করাই ওর কাজ। যেই নারী পাচারের হাত থেকে মেয়েদেরর বাচাতে গিয়ে ওর প্রাণ প্রিয় বন্ধু মরেছে তুমি ভাবলে কি করে আঁধার সেই কাজ গুলোই করবে? ওর অতীত সম্পর্কে তুমি জানো? আমি বিশ্বাস করি, আমার দেখা শ্রেষ্ঠ বীর পুরুষ আঁধার। ওর ছায়ায় একটা পিপড়াও সুরক্ষিত। এক মাত্র তোমার জন্য ওর জীবন নরক হয়ে গেছে। যখন তুমি ওকে ছেড়ে চেলে গেছিলে না তখন ও পাগলের পুরো বাংলাদেশে খুজেছে তোমাকে। শুধু মাত্র আন্টির দিকে তাকিয়ে নিজেকে বাচিয়ে রেখেছে। না হলে কবেই মরে যেত। কিন্তু বেচে থেকেও বা বেচে ছিলো কই প্রতিটা ক্ষণ প্রতিটা মুহুর্ত ধুকে ধুকে মরেছে। তবুও তোমাকে ভালোবেসে গেছে। তোমার দিকে একটা আঙুলও উঠতে দেয় নি। তোমাকে কখনো দোষও দেয় নি। কিন্তু তুমি ওকে বুঝলে না।”

মুন স্তব্ধ ইসী আরো অনেক কিছু বলছে কিন্তু তা মুনের কান পর্যন্ত পৌছালেও মস্তিষ্ক পর্যন্ত পৌছাতে পারলো না। ও বারাবরই ভুল ছিলো। হ্যাঁ ও ছোট থেকেই ভুল করে আসছে। সব সময় চিন্তা ভাবনা না করে ভুল সিদ্ধান্তটাই নিয়ে এসেছে। মুন আর কিছু ভাবতে পারলো না দৌড়ে বেরিয়ে গেল ওই রুম থেকে। ইসী অবাক হলো মুনের এমন কান্ডে মুনকে পেছন থেকে অনেকক্ষণ ডাকলো কিন্তু শুনলো না মুন। গাউন দু হাতে জাগিয়ে ধরে সবাইকে উপেক্ষা করে হলরুম থেকে দৌড়ে বেরিয়ে গেল। ওর এমন কাছজে সবাই হতবাগ। কি হলো এটা? এই একটাই প্রশ্ন ঘুরছে সবার মাথায়। মুন দৌড়াতে দৌড়াতে রাস্তার মাঝেই বসে পরলো গগন কাপানো চিৎকার করে উঠলো। অপরাধ করেও ততটা কষ্ট হয় না যতক্ষণ না কেউ তার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে সে অপরাধ করছে। আর যখন সে ব্যক্তি বুঝতে পারে সে অপরাধ করেছে তার থেকে বড় শাস্তি হয় তো কোনো শাস্তি না। এই যে একটু আগেও মুন নিজের ভুলটাকে সঠিক ভেবে বসে ছিলো তখন বিন্দু মাত্র কষ্টও হয় নি। আর এখন যখন বুঝতে পারলো সে অনেক বড় ভুল করে ফেলেছে তখন মনে হচ্ছে কষ্টের কোনো শেষ নেই। যে ভুল করে তাকে যদি কেউ তার ভুলটা বুঝাতে পারতো তাহলে হয় তো এতো আইন কানুনের প্রয়োজন হতো না। নিজের ভুল বুঝতে পারাটাই তার জন্য সব চেয়ে কঠিন শাস্তি হতো। মুন নিজের গালে একটার পর এক চড় দিয়ে যাচ্ছে। আর চিৎকার করে বলছে,

—“আমাকে কেউ শাস্তি দেও। আমি খুব বড় ভুল করেছি। আমাকে কেউ কঠিন থেকে কঠিন শাস্তি দেও। আমি একজন নিষ্পাপ মানুষের জীবন নষ্ট করেছি। আমি তাকে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছি। ক্ষত বিক্ষত করেছি তার সুন্দর হৃদয়। আমি অপরাধী। এমন কোনো আইন কেন তৈরি হয়নি? যে কারো মন ভাঙ্গলে তাকে শাস্তি পেতে হবে। এমন কোনো আইন কেনো তৈরি হয়নি? যে কারো জীবন নষ্ট করলে তাকে শাস্তি পেতে হবে। কেন নেই এমন কানুন? আমি দোষী আমার শাস্তি প্রাপ্য। এসকজন বাবাকে তার মেয়ের থেকে আলাদা করেছি। ঊকজন সন্তানকে তার পিতার থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছি। আমার মতো পাপি দুনিয়াতে আর একটা নেই। শাস্তি চাই আমি শাস্তি চাই।”

এক একটা চড়ে আঙ্গুলের ছাপ গুলো স্পষ্ট হয়ে লেগে আছে গালে। রক্ত যেন এখুনি ফেটে পরবে গাল থেকে। মুন অনুতাপের আগুনে এতোটাই পাগল হয়ে গেছে যে রাস্তার পাশ থেকে একটা সরু ইটের টুকরো নিয়ে হাতে একটার পর একটা গাঢ় টান দিতে লাগলো। হাত কেটে রক্তের ছড়াছড়ি। কিন্তু এতোও নিজের উপরের রাগটা বিন্দু মাত্র কমলো না। নিজের কাজে নিজেকে সব থেকে জঘন্য নিকৃষ্ট একজন মনে হচ্ছে। নিজের প্রতি নিজের ঘৃণা হচ্ছে। ও কি করে এরকম করতে পারলো। ওর এই ভুলের কারণে নিজের জীবন তো নষ্ট হয়েছেই তার সাথে আঁধার আর মিষ্টির জীবনও নষ্ট করে দিয়েছে। নিজের মেয়ের সামনে দাঁড়াবে কি করে ও? কি বলবে ও? আর কি করেই বা বলবে। যে এতো দিন যাকে তুমি নিজের বাবা জেনে এসেছো সে আসলে তোমার কেউই না। কিন্তু মুন তো শুধু ওদের নিজেদের জীবনই নষ্ট করেনি সাথে রাতের জীবনও জড়িয়ে আছে। যখন আঁধার মিষ্টিকে নিয়ে যাবে তখন রাত কি করে থাকবে মিষ্টিকে ছাড়া? একবার ভেবে দেখে ছিল কখনো? রাত নিজের জান ছড়ায় মিষ্টির উপরে। ভাবতেই রাগ লাগছে খুব ইচ্ছে করছে নিজেকে শেষ করে দিতে। তীব্র রাগে হাতের অবস্থা খারাপ বানিয়ে ফেলেছে মুন। আবারো কান্নায় ভেঙ্গে পরে মুন। হঠাৎ ওর উপর গাড়ির হলুদেটে হেড লাইটের আলো এসে পরে। মুন দু হাতে নিজের চোখ ঢেকে ফেলে। গাড়ি ওর থেকে কিচছুটা দূরে থামে। গাড়ি থেকে নেমে কেউ দৌড়ে আসে ওর কাছে। মুন আলোর কারণে ভালো করে কিছু দেখতে পায়না। কেউ এসে হঠাৎ ওকে নিজের বুকের সাথে আগলে নেয়। একটা পুরুষালী কন্ঠ বলে উঠে,

—“ভয় নেই আমি আছি।”

কথাটায় কি ছিলো মুন বুঝতে পারেনি। মুন শুনতে পারে লোকটার হার্ট খুব দ্রুত বিট করছে। প্রতিটা হার্ট বিট বলে দিচ্ছে ওকে হারানোর ভয়ে তারা এতো দ্রুত চলাচল করছে। মুন এটুকু বুঝতে পারে লোকটা আঁধার নয়। তাহলে কে? যার মন ওকে হারানোর ভয়ে এতো ছটফট করছে? তার অনুভুতি গুলো বড্ড অচেনা মুনের কাছে। মুন ধীরে ধীরে মাথা তুলে লোকটির দিকে দৃষ্টিপাত করলো। স্পষ্ট হতে লাগলো তার মুখ। মুন অস্পষ্ট স্বরে বলল,

—“রাত…!”

রাত রেজওয়ান মেনশনের দিকেই যাচ্ছিলো হঠাৎ দেখলো একটা মেয়েকে এই নির্জন জনমানবশূন্য রাস্তার মাঝে বসে থাকতে দেখে কিছুটা অবাক হয়। ভাবে যদি কোনো বিপদে পরে থাকে মেয়েটা! এই ভেবে এগিয়ে আসে আর কিছুটা কাছে আসতেই অতি পরিচিত প্রিয় মুখটা দেখে বিষ্ময়ে কিংকর্তব্যবিমুঢ় সাথে ঘাবড়েও যায়। ছুটে আসে প্রিয় মানুষটির কাছে আর নিজের বক্ষস্থলে আবদ্ধ করে তার মাথা। মুনের মুখের এ অবস্থা দেখে বুকের মধ্যে খানটা অজানা ব্যথায় কেপে উঠে। রাত এখনো মুনের হাতের দিকে খেয়াল করেনি। মুন অশ্রু শিক্ত চোখে অপরাধীর মতো দৃষ্টি ফেলে বলল,

—“আমি তোমারও কষ্টের কারণ। তোমাকেও আমার জন্য কষ্ট পেতে হবে। আমি সত্যি খুব খারাপ নিজের উপর আমার প্রচণ্ড ঘৃণা হচ্ছে। আমাকে প্লিজ ক্ষমা করে দেও কেনো আমি মরে যাচ্ছি না? সেদিন রক্ত বমি করাটা কি কোনো ভয়ানক মৃত্যু রোগের কারণ হতে পারতো না? তাহলে আজ সত্যের মখোমুখি অন্তত হতে হতো না। মিথ্যে নিয়েই না হয় মরে যেতাম।”

—“মুন কি বলছো এসব? ক্ষমা কেনো চাইছো? তুমি আমার কষ্টের কারণ কেনো হবে? আমি কিছু বুঝতে পারছি না। আর তুমি রক্ত বমি কখন করেছো? কি হয়েছে তোমার? তুমি রাস্তায় কেনো বসে আছো? তুমার মুখের এই অবস্থা কে করেছে?”

এক দমে এতো গুলো প্রশ্ন করলেও উওর একটাও মিলল না। মুন শুধু একটা কথাই বলল,

—“আমাকে আব্বুর কাছে নিয়ে চলো।”

রাত আর কিছু বলল না মুনের মানসিক অবস্থা ঠিক না। কিছু তো হয়েছেও সিওর। রাত মুনকে ধরে উঠাতে নিলে এমন সময় দেখতে পারলো মুনের হাত থেকে অর্নগল রক্ত ঝড়ছে। হাতের বীভৎস অবস্থা দেখে আতকে উঠে রাত।

—“হাতের এই অবস্থা কি করে হলো? ব্লিডিং বন্ধ হচ্ছে না।”

রাত যেন পাগল হয়ে গেছে। কি করবে বুঝতে পারছে না। রাত আসে পাশে খুজে কিছু পাতা নিয়ে এলো। এবং সেগুলো হাত দিয়ে পিষে মুনের হাতের উপর দিয়ে নিজের পকেট থেকে রুমাল বের করে বেধে দিলো। পুরোটা সময় মুন চুপচাপ ছিলো। অপরাধ বোধ ভেতরে ভেতরে ওকে খেয়ে যাচ্ছিলো।

.
—“তোমার মেয়ে কাউকে ভালোবাসতে জানে না আব্বু। তোমার মেয়ে কারো ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য না। আমাকে মেরে ফেলো আব্বু। না হলে এই অনুতাপের আগুনে পুড়ে ছাড়খাড় হয়ে যাবো আমি।”

কবির খান কিছুতেই মেয়েকে শান্ত করতে পারছেন না। মেয়ের এই অবস্থা দেখে নিজেরও কষ্ট হচ্ছে। উনি সব শুনেছে। এ ও জানতে পেরেছে যে মিষ্টি রাতের না আঁধারের মেয়ে। আর রাতের সাথে আসলে মুনের বন্ধুত্ব ছাড়া কোনো সম্পর্কও নেই। জানার পর খুব অবাক হয়েছে ছিল। মুন কখনো তার কাছ থেকে কোনো কথা লুকায় নি। ছোট ছোট বিষয় গুলোও জানিয়েছে। সেই মেয়ে তার কাছ থেকে এত বড় একটা কথা লুকিয়েছে। এমন কি মিথ্যেও বলেছে। কিন্তু সে সব ভাবার সময় এখন নেই। মুনকে এখন আগে শান্ত করতে হবে। আর মুনকে একমাত্র আঁধারই শান্ত করতে পারে। কবির খান আঁধারকে কল করে দ্রুত খান ভিলায় আসতে বলল। আঁধার মুনকেই খুজ ছিলো এতোক্ষণ। যখন শুনলো মুন একা একা এই রাতে বেড়িয়ে গেছে তখনই আঁধারও ওকে খুজতে বেরিয়ে পরে। মুনের বাংলোতেও খুজেছে ওখানে পায়নি। খান ভিলা’ই যাচ্ছিল এমন সময় কবির খানের ফোন আসে। আঁধার পোনার মিনিটে পৌছে যায়। আঁধার কলিং বেল টেপার সাথে সাথে কেউ দরজা খুলে দেয়। আশে পাশে কিছু দেখার প্রয়োজনই মনে করলো না আঁধার। সোজা ভেতরে ঢুকে মুনের রুমে চলে গেলো। মুন বেডের উপর বসে আছে। কবির খান মুনের পাশে আর রাত সাইডে দাঁড়িয়ে আছে। আঁধার রুমে ঢুকতেই সবার আগে ওর চোখ পরলো মুনের উপর। মুনের বীভৎস অবস্থা দেখে বুক কেপে উঠলো ওর। যতই হোক এই মেয়েটাকেই তো ভালোবাসে। ভালোবাসা তো কোনো দোষ গুন দেখে না। হতে পারে মেয়েটা দোষী কিন্তু চেয়েও যে তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া সম্ভব না। একেই হয় তো ভালোবাসা বলে। ভালোবাসার মানুষটির হাজার ভুলও মাফ। আর এই ছোট্ট বোকা মেয়েটা তো না জেনে ভুল করেছে। কি করে তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবে আঁধার? সেই সাহস কি আছে তার? ভালোবাসার মানুষটিকে সত চেয়েও কি ঘৃণা করা যায়? ভেতর থেকে উওর এলো, না!যায় না। আঁধার আস্তে আস্তে এগিয়ে যায় মুনের দিকে। মুন সোফায় বসে ছিলো। আঁধার গিয়ে মুনের সামনে দুই হাটু গেড়ে বসলো। মুন নিচের দিকে তাকানো। একবারের জন্য ভুলেও আঁধারের দিকে অথবা ওর চোখের দিকে তাকালো না। কবির খান রাতকে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। রাত কিছুই বুঝতে পারছে না কি হচ্ছে এখানে। আঁধার রেজওয়ান এখানে কি করছে আর তার মুনের সাথেই বা কিসের সম্পর্ক। কিছুই মাথায় ঢুকছে না ওর। অপরাধীর মতো নিজের নজর নামিয়ে রাখেছে মুন। আঁধার আলতো করে হাত রাখলো মুনের গালে। গাল গুলো অনেকটা ফুলে গেছে। রক্ত জমাট বেধে আছে। আঁধার বুঝতে পারে এগুলো মুনের নিজেরই কাজ। হাতের দিকেও চোখ যায়, সাদা ব্যান্ডেজ পেচানো হাতে। চোখ দুটোও ফুলো। আঁধার আদুরে গলায় ডাকলো,

—“মুন…”

মুন নিশ্চুপ ওর মুখ থেকে কোনো কথা বেড়লো না। আঁধার আবারো ডাকল,

—“মুন…তুমি আমার চোখের দিকে তাকাচ্ছো না কেনো? তাকাও একবার। দেখ, দেখ আমার এই দু চোখে তোমার জন্য না আছে কোনো ঘৃণা। আর না আছে কোনো অভিযোগ। শুধু আছে ভালোবাসা। ওই আকাশ সমান ভালোবাসি বোকাপাখি।”

আবেগ মিশিয়ে কথা গুলো বলল আঁধার। কিন্তু মুন তাকালো না আঁধারের দিকে। নিচের দিকে তাকিয়েই শান্ত গলায় বলল,

—“আমি আপনার কাছে ক্ষমা চাইবো না। কারণ আমি চাই না আপনি আমাকে ক্ষমা করুণ। আমার এতো গুলো ভুলের কোনো ক্ষমা হয় না। আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিলেও আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো না। তাই আমি চাইবো আপনি আমাকে শাস্তি দিন। আমি আপনার সাথে যে অন্যায় গুলো করেছি তার জন্য কঠিন শাস্তি।”

আঁধার নিশ্চুপ হয়ে গেল। মুন আঁধারকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে মুন দীর্ঘ শ্বাস নিলো। নিজের চোখের জল মুছে কঠিন এক সিদ্ধান্ত শুনালো।

—“আপনি যখন আমার জন্য কোনো শাস্তি ডিসাইড করতে পারছেন না তাহলে আমি নিজেই ডিসাইড করছি।”

বলে মুন কিছুক্ষণ থামলো তারপর আঁধারের চোখে চোখ রেখে কঠিন এক সিদ্ধান্ত শুনালো।

—“আপনি রাই আপুকে বিয়ে করছেন না? খুশি খুশি করে নিন। আমি কখনো আপনাদের মাঝে আসবো না। আমার মিষ্টিকে আমি আপনাকে দিয়ে দিবো। তারপর আমি দূরে কোথাও চলে যাবো। অনেক দূরে। মিষ্টির সাথেও কখনো দেখা করতে আসবো না। সেখানে একা একাই জীবন পার করে দিবো। আর এটাই হবে আমার শাস্তি।”

আঁধার তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো। তারপর মুনের চোখে চোখ রেখে বলল,

—“বিয়ে? তোমার সত্যি মনে হয় আমি অন্য কাউকে বিয়ে করে নিবো? তুমি আমাকে না আগে বুঝে ছিলে আর না এখন বুজঝতে পারছো। এই সব নাটক ছিলো। শুধু তোমাকে দেখানোর জন্য। যাতে তুমি বুঝতে পারো যে তুমি ভুল করছো। আর আমার কাছে ফিরে আসো। কোনো বিয়ে টিয়ে করার ইচ্ছে নেই আমার। থাকলে অনেক আগেই করতে পারতাম। কোনো নারীদের প্রতি আসক্তি নেই আমার। আমি আসক্ত শুধু তোমাতে। তুমি বলছো তুমি আমাকে ছেড়ে মিষ্টিকে ছিড়ে দূরে চলে গিয়ে নিজেকে শাস্তি দিবে। কিন্তু একবারো ভেবে দেখেছো তোমার সাথে সাথে আমরাও কষ্ট পাবো? আমাদের কি দোষ? আমরা কেনো শাস্তি পাবো? মিষ্টি থাকতে পারবে তার মাম্মামকে ছাড়া? আবারো ভুল করছো তুমি। অন্তত একবার আমার কথা শুনো। ভুলে যাও সব। নতুন করে শুরু করি আমরা। একদম শুরু থেকে।”

মুন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আঁধারের দিকে। ওর ও খুব করে ইচ্ছে করছে সব ভুলে যতে। নতুন করে শুরু করতে। মুন অনেকক্ষণ সময় নিয়ে ভাবলো আঁধারের কথা গুলো। সত্যিই তো মিষ্টি থাকতে পারবে ওকে ছাড়া? ওর ভুলের কারণে মিষ্টি কেন শাস্তি পাবে? আরো একবার ভুল করতে যাচ্ছিলো। কিন্তু সব ভুলতেও তো পারছে না। নিজের বিবেক বোধ ভুলতে দিচ্ছে না। মুন তাকালো আঁধারের দিকে করুণ সেই দৃষ্টি।

—“আমি নিজের কাছেই ছোট হয়ে যাবো। কারণ আমি যে দোষী।”

আঁধার ছোট্ট করে নিশ্বাস ফেলে বলল,

—“তুমি শাস্তি চাও তো। ঠিক আছে আমি তোমাকে শাস্তি দেবো। তোমার শাস্তি হলো…..তোমার আবারো আমাকে বিয়ে করতে হবে। সুন্দর কে যত্ন নিয়ে ভালোবেসে আমার সংসার সামলাতে হবে। আমার মেয়েকে ও তার বাবাকে ভালোবাসতে হবে। আমি যা বলব সব শুনতে হবে কখনো কোনো কথা অমান্য করতে পারবে না। এখন বলো সব শাস্তি মানতে রাজি তো? বিয়ে করবে তো আমাকে?”

#চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here